প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বইয়ের খবর

মার্চ ১৫, ২০১৭

 

শিশু-কিশোর সাহিত্যের 'স্বর্ণযুগ' ফিরে আসা...

ঋজু গাঙ্গুলি

এই সময়ে, যখন এপার বাংলার সবক’টি প্রধান ও অপ্রধান শিশু-কিশোর সাহিত্যকেন্দ্রিক পত্রিকায় জঁর ফিকশনের জোয়ার এসেছে, এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় এই সাহিত্যের ‘স্বর্ণযুগ’ ফিরে আসা নিয়ে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে, তখন মনে হল, এই ঘরানার বই নিয়েই বরং পেশ করি এবারের ‘বইয়ের খবর’।

আনন্দমেলা এবং অন্যান্য পত্রিকায় বিজ্ঞানভিত্তিক রহস্যকাহিনির নিয়মিত লেখক হিসেবে রাজেশ বসু-র নাম আমাদের কাছে সুপরিচিত। গত বইমেলায় প্রকাশিত, এবং এবারের মেলায় হস্তগত তাঁর দুটি উপন্যাস পড়েছি একেবারে সম্প্রতি। আগে তাদের সঙ্গেই আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক।

প্রথম বই:

বইয়ের নাম: মৌমাছির বিষ
শিশু সাহিত্য সংসদ থেকে জানুয়ারি ২০১৬-য় প্রকাশিত
হার্ডকভার, ৯৮ পৃষ্ঠা, দাম ৬৫/- টাকা

এই উপন্যাসটির মূল বিষয়বস্তু হল এই, যে ডাক্তার এবং শখের গোয়েন্দা ইন্দ্র তার সাইডকিক তথা কথক টুকান, ও সাংবাদিক বোন দেবত্রিকে নিয়ে উপস্থিত হয়েছে উত্তরবঙ্গের এক বিজন কোণে, যেখানে এক এনটমোলজিস্ট-এর ছুটি কাটাতে আসা ভাইপো হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তার চিকিৎসা করার পাশাপাশি ওই বাড়ির বাসিন্দাদের আচরণে কিছু অদ্ভুত ও নাটকীয় ব্যাপার দেখে গোয়েন্দা যখন মাথা ঘামাতে শুরু করেছে, তখন রহস্য জমে উঠল প্রথমে চুরি, আর তারপর মৃত্যুতে।
কেন এই মৃত্যু?
কী চুরি করার চেষ্টা হচ্ছিল?
ওপরের অংশটুকু পড়লে মনে হবে, না জানি কোন ঘনঘোর রহস্যের জাল ছিন্ন করতে হয়েছে গোয়েন্দাকে এই গল্পে। আসলে বইটা পড়ে মোটেই ভালো লাগলনা আমার। কেন?

১) চরিত্রগুলো অত্যন্ত কেঠো, দ্বিমাত্রিক, রঙ-চড়ানো, আর অ-বিশ্বাসযোগ্য। তাদের একজনের আচরণ দেখেও মনে হয়নি যে চরিত্রটির সঙ্গে কোনো রকম সহমর্মিতা অনুভব করা যায়।
২) লেখকের অন্যান্য বইয়ের মতো এতেও সুযোগ পেলেই ইনফো-ডাম্প ঘটানো হয়েছে, যাতে না হয়েছে লেখায় অতিরিক্ত রসসঞ্চার, না বেড়েছে গল্পের গতি।
৩) এই এক থিম নিয়ে এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায় প্রায় তিন দশক আগে পাক্ষিক আনন্দমেলায় উপন্যাস লিখেছেন।
৪) সব কিছু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে লেখক কাহিনির যাবতীয় সাসপেন্স এবং থ্রিল বরবাদ করেছেন।

দ্বিতীয় বই:

বইয়ের নাম: মেরুদ্বীপে ভয়ংকর
শিশু সাহিত্য সংসদ থেকে জানুয়ারি ২০১৬-য় প্রকাশিত
হার্ডকভার, ৯৮ পৃষ্ঠা, দাম ৬৫/- টাকা

বইটা পড়তে গিয়ে মাথা ধরে গেল। কেন?

১] এই বইটির প্রচ্ছদ (শিল্পী অজ্ঞাত, পুস্তকসজ্জা ও অলংকরণের পুরো দায়দায়িত্ব প্রকাশক নিজের মাথায় চাপিয়েছেন) থেকে বইটির সম্বন্ধে যে লঘু ধারণা তৈরি হয়, গোটা উপন্যাস জুড়েই লেখক নিজের হাবিজাবি কথায় সেই ধারণাকে সযত্নে লালন করেছেন।
২] যা শুরু হয়েছিল একটি বিজ্ঞান-সুবাসিত অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে, তা খুব শিগগিরই কল্পবিজ্ঞানের মোড়কে টোটাল গাঁজাখুরি জিনিস হয়ে দাঁড়াল। যা হতে পারত সিগমা ফোর্সের হালকা সংস্করণ, তা হয়ে দাঁড়াল রসবোধহীন, নিকৃষ্টতম শঙ্কু-কাহিনির অধম ফ্যান্টাসি।
৩] লেখকের ক্লিষ্ট গদ্যের সঙ্গে একেবারে মানানসই হয়ে থেকেছে চরিত্রচিত্রণ এবং বিরক্তিকর নামকরণ, যাতে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সংগঠনের সম্পাদকের নাম চাকচিক্য চক্রবর্তী, আর ডুবতে থাকা বইয়ের ব্যবসার মালিকের নাম উন্নয়ন সাহা!

সংক্ষেপে শুধু এটুকুই লেখার যে, এই যদি এই সময়ের সবক’টি প্রধান শিশু-কিশোর পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকতাধন্য লেখকের লেখার নমুনা হয়, তাহলে বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যের প্রাতিষ্ঠানিক দিকটির যে কী হাল, তা সহজবোধ্য।

একরকম বিরক্ত হয়েই এবার হাতে তুলে নেওয়া গেল একদা পাঠকের কাছে ফার্স্ট ফ্লাশ হয়ে আসা,  অধুনা ‘গজের চা’-তে পরিণত সত্যসন্ধানী অর্জুনের একটি সাম্প্রতিক কাহিনি, সমরেশ মজুমদারের কলমে।

বইয়ের নাম: খিলজির গুহায় অর্জুন
আনন্দ পাবলিশার্স থেকে জানুয়ারি ২০১৬-য় প্রকাশিত
হার্ডকভার, ১০০ পৃষ্ঠা, দাম ১০০/- টাকা

বইটি হাতে নিয়ে প্রথমেই যা দেখে মেজাজ খিঁচড়ে যায়, তা হল অনুপ রায়-এর অলঙ্করণ। এই শিল্পীর কাজ কী ছিল, আর কী হইয়াছে, তা অবশ্য অনেক দিন ধরেই আমরা দেখে আসছি, যা থেকে এটাই আবার প্রমাণ হচ্ছে যে, এক্সপায়ারি ডেটের ব্যাপারটা আমাদের দেশে খুব কম সৃজণশীল ব্যক্তিই মাথায় রাখেন।

তারপর আসা গেল উপন্যাসে। এর বিষয় আপাতদৃষ্টিতে কৌতূহলোদ্দীপক। বঙ্গবিজেতা, নালন্দা-পোড়ানোর খলনায়ক, এবং আরো নানা অপকীর্তির জন্য দায়ী বক্তিয়ার খিলজির এক উত্তরাধিকারী এসে অর্জুনের সাহায্য চান একটি গুহা খুঁজে বের করার জন্য, যেখানে নাকি বক্তিয়ার তিব্বত অভিযান সেরে ফেরার পথে প্রচুর ধনরত্ন লুকিয়ে রেখে এসেছিলেন। মুশকিল হল গল্প পড়া শুরু করার পরেই। কেন?

১] বুঝতে পারলাম, আরো অনেক ফুরিয়ে যাওয়া লেখকের মতো সমরেশ তাঁর নিজের অর্জুন-কাহিনি “কালাপাহাড়” চরিত্র আর পটভূমিতে সামান্য রদবদল করে আবার চালিয়ে দিয়েছেন এখানে।
২] ঐতিহাসিক বিতর্কের জায়গাগুলো ছেড়ে দিয়েও বলা যায়, এই উপন্যাস তার প্লটের গর্তের দিক দিয়ে চাঁদের পিঠকেও লজ্জা দেবে।
৩] এর মিইয়ে যাওয়া ভাষা সত্যসন্ধানী অর্জুনের কাহিনির সঙ্গে একেবারেই মানায় না।
৪] সর্বোপরি, বরফ ঘেরা সিকিম-সীমান্তের ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলায় কিছুটা পুরোনো ঝলক দেখা গেলেও এই উপন্যাসের ভাষা ও ন্যারেটিভ এতটাই ক্লিষ্ট যে পড়তে গিয়ে মন খারাপ হয়, আরো একটি সম্ভাবনাময় অ্যাকশন থ্রিলারের নেহাত রদ্দি, সম্পূর্ণভাবে সাসপেন্স-বিহীন গল্পে পর্যবসিত হওয়া দেখে।

এইসব বইপত্তরের ঠেলায় মেজাজ এতটাই খারাপ হল যে বিষের সন্ধানে ব্যাপৃত হলাম!
ঘাবড়াবেন না। হাবিজাবি পড়ে পাঠক হিসেবে প্রায় নীলকন্ঠ হয়ে গেলেও এক্ষেত্রে আমি বলছিলাম এই সময়ের শ্রেষ্ঠতম গদ্যশিল্পী দেবজ্যোতি ভট্টাচার্যের অদ্বিতীয় সৃষ্টি বিষবৈদ্য সনাতনের কথা, যার লেটেস্ট অ্যাডভেঞ্চার আমাদের হাতে এসেছে এই বইমেলাতেই।

বইয়ের নাম: নিবাত কবচ অভিযান
অরণ্যমন প্রকাশনী থেকে বইমেলা ২০১৭-য় প্রকাশিত
পেপারব্যাক, ১২৪ পৃষ্ঠা, মূল্য ১৪০/- টাকা

এই গল্পেও আছে ইতিহাস, তবে পুরাণ, কল্পবিজ্ঞান, এবং কিংবদন্তী মিলেমিশে একটি সুখপাঠ্য কাহিনির চেহারায় তা আমাদের সামনে এসেছে। বিষবৈদ্য সনাতন-এর জবানে তারিণীখুড়ো স্টাইলে পেশ করা এই কাহিনির মূল লুকিয়ে আছে মহাভারতে নানা ধুন্ধুমার কাণ্ডের পেছনে লুকিয়ে পড়া এক উপাখ্যানে, যেখানে ইন্দ্রকে গুরুদক্ষিণা দিতে গিয়ে অর্জুন নিবাত কবচ নামক সমুদ্রতলবাসী দানবদের ধ্বংস করেছিলেন। তার সঙ্গে জুড়ে গেছে ক্লাসিকাল তামিল ভাষার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন সঙ্গম সাহিত্যে প্রাচীন এক সমৃদ্ধ শহর ধ্বংসের কথা, পুরাণে রূপান্তরিত আকারে ধরা পড়া বহু-বহু যুগ আগের এক প্রবল দ্বৈরথের আভাস, এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটমান বর্তমান।

বিষবৈদ্য সনাতন-এর বিগত দুটি গ্রন্থবদ্ধ কাহিনি “দোর্দোবুরুর বাক্স” এবং “পংখিলালের গুহা”-র উল্লেখ থাকলেও সম্পূর্ণ একক স্ট্যান্ড-অ্যালোন অ্যাডভেঞ্চার হিসেবেই এটির রসাস্বাদন করা উচিৎ। অন্তত আমি বইটা পড়া শুরু করে শেষ না হওয়া অবধি থামতে পারিনি।

গল্পের ক্লাইম্যাক্স নিয়ে আমার বিস্তর খুঁতখুঁতানি আছে, যেমন আছে মানবজাতির মহাবিপদ এড়ানো তথা আত্মরক্ষার্থে আমাদের প্রটাগনিস্টদের অবলম্বন করা পদ্ধতি নিয়ে। তবে বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যে এইভাবে প্রাচীন ও নবীনের মেলবন্ধন ঘটিয়ে একটি টানটান অ্যাডভেঞ্চার উপহার দেওয়ার জন্য লেখকের উদ্দেশে কৃতজ্ঞতা জানাতেই হচ্ছে। তারিফ প্রাপ্য নতুন প্রকাশনা “অরণ্যমন”-এর, যাদের প্রথম বইয়ে অলঙ্করণ ও প্রচ্ছদ দুর্বল হলেও মুদ্রণ চমৎকার, এবং ছাপার ভুল চোখে পড়েইনি।

সামগ্রিকভাবে এটাই বলার যে বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যে জোয়ার আসার যে ধারণাটা সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, সেটা বাস্তবায়িত হতে গেলে শেষোক্ত বইটির মতো জঁর-এর সীমা পেরোনো, পাঠকের বুদ্ধি ও জ্ঞানের প্রতি সম্মান রেখে লেখা গতিমান কাহিনি আরো বেশি সংখ্যায় প্রয়োজন। ফুরিয়ে যাওয়া, বা পৃষ্ঠপোষকতাধন্য লেখকেরা সূচিপত্রের আড়ম্বর বাড়ালেও তাঁদের কাঁধে ভর দিয়ে শিশু-কিশোর সাহিত্যের পক্ষে ক্রমহ্রাসমান বাজার, পাইরেসি, পি.ডি.এফ, এবং বিকল্প বিনোদনের প্রাচুর্য নামক দৈত্যদানবদের মোকাবিলা করা সম্ভব হবেনা।

বসন্ত-র বাকিটুকু ভালো কাটুক।


 


আলোচক পরিচিতি - আলোচক এক উদ্যমী পাঠক, যিনি বিপ্লব, চোখের জল, মানবচরিত্রের অতলস্পর্শী গভীরতা, সিন্ডিকেট, সারদা, ধোনি, ইত্যাদি তাবড় বিষয় থেকে দূরে, স্রেফ বেঁচে থাকার গল্প পড়তে চান। নিজের ভালবাসা থেকেই দীর্ঘদিন বইয়ের রিভিউ করছেন।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2015 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।