বইয়ের খবর
অগাস্ট ১৫, ২০১৫
"এতোটা শৈল্পিক, এতোটা মায়াময়, অথচ এতোটা সমকালীন ..... কোন লেখা আমি এযাবৎ পড়িনি।"
★★★★☆
আলোচনা - ঋজু গাঙ্গুলি
- বইয়ের নাম: ধুলোখেলা
- লেখক: সৌরভ মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স
- ISBN: 978-93-5040-409-6
- হার্ডকভার, ৩০৪ পৃষ্ঠা
- প্রথম প্রকাশ: এপ্রিল ২০১৪
- রেটিং: পাঁচে চার তারা
“দেশ”-এ ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত ও ৩৯ পর্বে বিন্যস্ত এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু ঘোর সমকালীন। এক পরিবারে একটি মৃত্যুর পর, নিজেদের মধ্যে কথা বলে, পুরনো ভগ্নপ্রায় বাড়িটি বিক্রির বিলি-বন্দোবস্ত করতে গিয়ে হঠাৎই সেই পরিবারের সদস্যরা দেখল যে তাদের সত্তরোর্ধ্বা মা বাড়ি বিক্রিতে রাজি নন। পরিবারটির বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার মধ্যে অনুচ্চ টানাপোড়েন আর পারস্পরিক লোভ-ঈর্ষা-ভয়-হতাশা নিয়ে শুরু হওয়া এই উপন্যাস কিন্তু থেমে রইল না সেখানে। সেই পরিবারের যুবক-যুবতীদের মনের জগতে ওঠা নানা আলোড়ন, নানা মেঘ-রৌদ্রের খেলা, আর বিশেষভাবে গল্পের নায়ক (একেবারে প্রথম থেকেই লেখক বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে ওই তরুণই হবে গল্পে তাঁর নিজস্ব ভাবনার মশাল-বাহক, যদিও এই উপন্যাসে এমন একটি চরিত্রও আছে যে প্রবলভাবে আত্মজৈবনিক)-এর সূত্র ধরে উঠে এল পশ্চিমবঙ্গে জমি আন্দোলনের মাধ্যমে বাম রাজত্বের শেষের শুরু। সমকালীন বিষয় নিয়ে লেখালিখি করা অন্ধের হস্তীদর্শনের মতো বিপজ্জনক কাজ হলেও লেখক সেই ফাঁদে পা দেননি, কারণ তিনি মানবজমিনের কথা বলেছেন, যেখানে কেউ সোনার ফসল ফলায়, কেউ কারখানা গড়তে দেয়, আবার কারও জমি পড়ে থাকে অহল্যা হয়ে মনের মানুষের কল্যাণস্পর্শের আশায়। কিন্তু উপন্যাসটা ঠিক কেমন? আগে লেখা যাক (এই উপন্যাসটি এখনও যাঁরা পড়েননি, তাঁদের জন্যে স্পয়েলার এড়িয়ে) উপন্যাসের যে দিকগুলো আমার ভালো লাগেনি, তাদের কথা: -
(১) উপন্যাসে যে ক’টি যুবক-যুবতীর সম্মুখীন হয়েছি আমরা, তাদের প্রায় প্রত্যেককেই আঁকা হয়েছে বড্ড মোটা তুলিতে। মানুষগুলো বড্ড বেশি ভালো, বা খারাপ, বা স্বার্থপর, বা ঢ্যাবঢেবে, বা চালচুলোহীন, বা বুদ্ধিমান।
(২) মধ্যবয়স্ক চরিত্রদের মধ্যে লেখকের কাছ থেকে সব থেকে বেশি মনোযোগ পেয়েছে (স্বাভাবিক ভাবেই) আত্মজৈবনিক চরিত্রটি। কিন্তু সেখানেও ওই মোটা তুলিটা বড্ড দাগা দিয়েছে প্রায়ই। মানুষটির অতলস্পর্শী হতাশা, ছাদ-ফাটানো আশা, ‘জনারণ্যে একা’ জীবনবৃত্তান্ত, আর সবসময়েই “এ জীবন লইয়া কী করিব” ভাব: এসব দেখে মাঝেমাঝে প্রবল বাসনা জেগেছে চরিত্রটিকে ঘা-কতক দিতে।
(৩) উপন্যাসের সব থেকে আকর্ষণীয় চরিত্র বলে আমার মনে হয়েছে সত্তরোর্ধ্বা তরুলতাকে, যিনি উপন্যাসের শুরুতে স্ফুলিঙ্গ হয়ে এই উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্রকে তাদের নিজস্ব কক্ষপথে ঠেলে দেন, আবার যিনি উপন্যাসের শেষে হয়ে হয়ে ওঠেন সেই বটগাছ যেখানে আশ্রয় নেই ঝড়ে আর হাতিয়ারে আহত ডানাভাঙা পাখির দল। কিন্তু আমার মনে হয়েছে যে মানুষটি প্রাপ্যের চেয়ে অনেকটা কম জায়গা পেয়েছেন এই উপন্যাসে।
(৪) উপন্যাসটা শেষ হয়েও শেষ হয়নি। কনক্লুশন-এর পরিবর্তে আমরা এতে পেয়েছি একটি ক্রান্তিলগ্ন, যেখানে সব ক’টি চরিত্র ব্যক্তিগত বা সামাজিকভাবে নিজস্ব একটা চয়েসের মুখোমুখি হয়েছে: হয় জীবন, নয় মৃত্যু; হয় লেখার মধ্য দিয়ে মুক্তির আশায় লিখে চলা, নয় দিনগত পাপক্ষয়; হয় নিজের অতীতের ভুল-সংশয়-তিক্ততা পেরিয়ে নতুন করে পথচলা, নয় নিজের সঙ্গে দিনরাত যুদ্ধ করে ভয়ে-সংশয়ে বন্দি হয়ে থাকা। শুনলে মনে হবে, এগুলো কোন চয়েসই নয়, কারণ এ তো সহজবোধ্য যে কোনটা বেছে নিতে হবে। জীবন যে সহজ বুদ্ধিতে চলেনা, গোটা উপন্যাসে সেটা প্রমাণ করেও লেখক যে কেন শেষটা এতো ওপন-এন্ডেড রেখে দিলেন, এটা ভেবেই খারাপ লাগছে।
এতোদূর অবধি পড়ে নিশ্চই ভাবছেন যে কেন এর পরেও আমি এই উপন্যাসকে পাঁচে চার দিলাম? এবার তাহলে সেই কারণগুলো লিখি: -
(১) এই সময়ের কোন উপন্যাস যে এতোটা পরিচ্ছন্ন হতে পারে (মানে যাতে যৌনতার সাতকাহন নেই, বিকৃতি নেই, অশ্রাব্য শব্দের বেসাতি নেই, অশুদ্ধ বাংলা আর ভয়াবহ ইংরিজির মিশেল নেই) তা এই উপন্যাস না পড়লে বিশ্বাস হবেনা।
(২) এতোটা শৈল্পিক, এতোটা মায়াময়, অথচ এতোটা সমকালীন (ফলে রক্ত আর বারুদের গন্ধ মেশানো) কোন লেখা আমি এযাবৎ পড়িনি।
(৩) লেখার বাঁধুনিতে, সংলাপের স্মার্টনেসে, আর (মোটা তুলিতে আঁকা হোক বা রোগা) আকর্ষণীয় চরিত্রচিত্রণে, এই উপন্যাস যেকোন রহস্য বা কেচ্ছাকাহিনির থেকেও বেশি আনপুটডাউনেবল, তাই ৩৯টি পর্ব তথা ৩০৪ পৃষ্ঠা শেষ করেও আপনি পাতা ওল্টাতে চাইবেন। মন মানতেই চাইবে না, যে ফুরিয়ে গেছে এই ধুলোখেলা।
এটি কি সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ লেখা? মোটেই না। আমি কোন অবস্থাতেই চাইব না যে লেখক তাঁর যাত্রাপথে এই সোনার বনে, বা এর থেকেও ভালো হিরের বনে থেমে যান। বরং আমি চাইব তিনি যেন এগিয়ে যান ব্রহ্মের সন্ধানে, যেখানে রুপো-সোনা-হিরে এসব কিচ্ছু নেই, তার বদলে আছে সেই ঐশ্বর্য যার পরিমাপ হয়না। তবে তাঁর সেই পথচলার বিবরণ হিসেবে তিনি যদি আমাদের এমন লেখা আরও উপহার দেন, তবে আমাদের, মানে পাঠকদের, নিজস্ব ধুলোখেলায় এমন একবুক ভালোলাগার দুর্লভ মুহূর্ত আরও কিছু তৈরি হয়।
আলোচক পরিচিতি - আলোচক এক উদ্যমী পাঠক, যিনি বিপ্লব, চোখের জল, মানবচরিত্রের অতলস্পর্শী গভীরতা, সিন্ডিকেট, সারদা, ধোনি, ইত্যাদি তাবড় বিষয় থেকে দূরে, স্রেফ বেঁচে থাকার গল্প পড়তে চান। নিজের ভালবাসা থেকেই দীর্ঘদিন বইয়ের রিভিউ করছেন।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।