বইয়ের খবর
অগাস্ট ১৫, ২০১৫
"এই লেখা আপনারা যখন পড়বেন, তখন স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে মেতে উঠেছে এদেশ। কিন্তু আজ, ২২শে শ্রাবণ, লিখতে বসে খুব বেশি করে সেই মানুষটার কথাই মনে পড়ছে...।"
আলোচনা - ঋজু গাঙ্গুলি
এই লেখা আপনারা যখন পড়বেন, তখন স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে মেতে উঠেছে এদেশ। কিন্তু আজ, ২২শে শ্রাবণ, লিখতে বসে খুব বেশি করে সেই মানুষটার কথাই মনে পড়ছে যিনি এমন এক ভারতের কল্পনা করেছিলেন, যেথায় চিত্ত ভয়শূন্য, শির উচ্চ, জ্ঞান মুক্ত। খবরের কাগজ খুললে শিউরে উঠতে হয় ঠিকই, তবু এখনও এমন অনেক তাপস আছেন যাঁরা তাঁদের সাধনার মধ্য দিয়ে আমাদের ভাবান, “বুঝি বা ফুল ফুটেছে, সুর উঠেছে অরুণবীণার তারে-তারে”। তেমনই এক মানুষের কিছু লেখার সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিতে চাই আজ। মানুষটি অপরিচিত নন, আনন্দলোকের সত্য ও সুন্দরের সন্ধানে তাঁর যাত্রার মাইলফলকের সঙ্গেও আমাদের পরিচয় আছে। তবে তাঁর লেখাগুলো, অবশেষে, একত্রে প্রকাশিত হতে শুরু করেছে বলে মনে হল, তাদের প্রতি একবার দিশানির্দেশ করা উচিৎ এই কলামের মাধ্যমে।
সুধীর চক্রবর্তীর নাম এবং লেখালেখির সঙ্গে পরিচয় নেই এমন বাঙালি কমই আছেন। কিন্তু বিভিন্ন বিষয়ে, বিভিন্ন সময়ে লেখা তাঁর প্রবন্ধ, নিবন্ধ, আস্ত বই, আর সাক্ষাৎকারঃ এগুলো নানা বইয়ে ছড়িয়ে আছে, যাদের অনেকগুলোই ইতিমধ্যে আউট-অফ-প্রিন্ট। লালমাটি প্রকাশনের নিমাই গরাই, যিনি ইতিমধ্যেই “লীলা মজুমদার রচনাসমগ্র” প্রকাশ করে পাঠকের অকুন্ঠ কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন, এই লেখাগুলো “সুধীর চক্রবর্তী রচনাবলি” নামে খণ্ডে-খণ্ডে প্রকাশ করতে শুরু করেন ২০১২-র বইমেলা থেকে।
এখনও অবধি চারটে খণ্ড প্রকাশিত হলেও আমার সংগ্রহে থাকা তিনটি খণ্ডের বিবিধ রতনের সঙ্গেই আপাতত আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই।
-
প্রথম খণ্ড:
- প্রথম প্রকাশঃ বইমেলা ২০১২
- হার্ডকভার, ৪৯৭ পৃষ্ঠা
- আই.এস.বি.এনঃ 978-93-81174-20-3
- বিষয়ঃ জনসংস্কৃতি
দুটি বই, আর তিনটি পুস্তিকা দিয়ে গড়ে উঠেছে এই খণ্ডটি। বই দুটি হলঃ
উৎসবে মেলায় ইতিহাসে
১৯৯৬-এ ‘পশ্চিমবঙ্গের মেলা ও মহোৎসব’ নামে প্রকাশিত বইয়ের লেখাগুলো পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত হয়ে ২০০৪-এ এই গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। যেসব লেখা এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় সেগুলো হলঃ
- উৎসব ও মেলার চালচিত্র
- দেবতার লোকায়নঃ অগ্রদ্বীপের মেলা
- কার্তিকের লড়াইঃ গাঙ্গেয় জনপদ
- সাপের মেলাঃ ব্রহ্মাণীতলা
- রাসযাত্রা ও পটপূর্ণিমাঃ শান্তিপুর ও নবদ্বীপ
- জগদ্ধাত্রীর সন্ধানেঃ কাগ্রামে
- দাতাবাবার মেলাঃ পাথরচাপড়ি
- খৃস্টিয় মেলায় শিকড়ের টানে
- গৌণধর্মের সমন্বয়-সংস্কৃতিঃ ঘোষপাড়া
- বাউল-বৈষ্ণব সমাহারঃ জয়দেব কেঁদুলি
- হারিয়ে যাওয়া জনপদঃ কাশিমবাজার
- পথে যেতে যেতে
- ধর্ম-অর্থ-মন্দির
কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্প ও মৃৎশিল্পী সমাজ
সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এর তরফে প্রকাশিত এই গবেষণাগ্রন্থটি ১৯৮৫-তে প্রকাশিত হয়।
এছাড়া এই বইয়ে আছে তিনটি পুস্তিকা, যারা হলঃ
o লোকসমাজ ও লোকচিত্র: ললিতমোহন সেন স্মারক বক্তৃতার মুদ্রিত রূপ, ২০০৯-এ প্রকাশিত।
o প্রসঙ্গঃ জনসংস্কৃতি: ২০০৮-এ প্রকাশিত ‘ধর্ম ও জনসংস্কৃতি’ বইয়ের ভূমিকা।
o জনসংস্কৃতির আরেক মুখঃ গৌণধর্ম: সুশোভনচন্দ্র সরকার স্মারক বক্তৃতার মুদ্রিত রূপ, যা ২০০৮-এ প্রকাশিত হয়।
-
দ্বিতীয় খণ্ড:
- প্রথম প্রকাশঃ বইমেলা ২০১৩
- হার্ডকভার, ৬৬৩ পৃষ্ঠা
- আই.এস.বি.এনঃ 978-93-81174-76-0
- বিষয়ঃ গৌণধর্ম
যে দুটি বই নিয়ে এই খণ্ডটি গড়ে উঠেছে, তারা এতই বিখ্যাত ও সম্মানিত যে তাদের নিয়ে বেশি কিছু লেখা অর্থহীন। তারা হলঃ
- বাংলার গৌণধর্মঃ সাহেবধনী ও বলাহাড়ি: ১৯৮৫-তে প্রকাশিত “সাহেবধনী সম্প্রদায় ও তাদের গান” এবং ১৯৮৬-তে প্রকাশিত “বলাহাড়ি সম্প্রদায় ও তাদের গান” ২০০৩-এ একত্রে প্রকাশিত হয়। সংযোজন অংশে থাকা দুই সম্প্রদায়ের গান ছাড়া এই বইয়ের মূল আলোচনা যেসব অধ্যায়ে বিন্যস্ত হয়েছে তারা হলঃ
- পিতা আল্লা মাতা আহ্লাদিনী
- কলিকালে মেহেরপুরে পূর্ণমানুষ
- কলিকালে বলে দুলালচাঁদের জয়
- কর স্থিতি ওহে পিতাপ্রতি
- হাড় হাডডি মণি মগজ
- আমার নাম কুমির কবিদার
- সেবার্থে পরমতত্ত্বে সেবাদাসী চাই
- আমার দুখের কথা রইল গাঁথা
- রূপে নয়ন ডুবল না রে
- জলের সুঁই পবনের সুতো
- ব্রাত্য লোকায়ত লালন: ১৯৯২-এ প্রথম প্রকাশিত এই বইটি সর্বার্থে ক্লাসিক, যা একই সঙ্গে লানন-চর্চায় ইচ্ছুক পাঠক, এবং ধর্ম ও সমাজতত্ত্ব বিষয়ে গবেষক-সম্প্রদায়ের কাছে মডেল হতে পারে। ২০০৭-এ প্রকাশিত তৃতীয় তথা পরিমার্জিত সংস্করণের পাঠটিই এই খণ্ডে শামিল হয়েছে। যেসব অধ্যায়ে এই বইটি বিন্যস্ত তারা হলঃ
- আপন ঘরে পরের আমি
- কাক মারতে কামান পাতা
- একি আজব কারখানা
- উৎস থেকে উৎসারিত
- লোহা পাথরের চকমকি
- থাকতে হয় একাকী
- নিজ ভাষায় পরবাসী
- যেথায় থাকে সবার অধম
এর সঙ্গেই আছে পরিশিষ্টের আকারে সংযোজিত কয়েকটি অত্যন্ত মূল্যবান দস্তাবেজ, যার মধ্যে অন্যতম হল ১৮৯৮-এর নভেম্বরে অ্যান্থ্রপলজিক্যাল সোসাইটি অফ বম্বের সভায় মৌলবি আবদুল ওয়ালি পঠিত পেপার, “অন কিউরিয়াস টেনেটস অ্যান্ড প্র্যাকটিসেস অফ আ সার্টেইন ক্লাস অফ ফকিরস ইন বেংগল”।
-
তৃতীয় খণ্ড:
- প্রথম প্রকাশঃ বইমেলা ২০১৪
- হার্ডকভার, ৫৫৫ পৃষ্ঠা
- আই.এস.বি.এনঃ 978-93-81174-95-1
- বিষয়ঃ বাংলা গান (প্রথম পর্ব)
১৯৮৬ থেকে ১৯৯৪-এর মধ্যে প্রকাশিত চারটি গানবিষয়ক বই এই খণ্ডে স্থান পেয়েছে। এরা হলঃ –
গানের লীলার সেই কিনারে:
১৯৮৬-তে অরুণা প্রকাশনী থেকে, এবং ২০১৩-তে প্রতিভাস থেকে পরিমার্জিত আকারে প্রকাশিত হয়েছিল রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ক নিবন্ধের সংকলন এই বইটি। যেসব লেখা এতে আছে তারা হলঃ
- সমকালীন গীতিকার ও রবীন্দ্রনাথঃ বৃক্ষ ও বনস্পতি
- গানের দুই রাজাঃ রবীন্দ্রনাথ, রবার্ট বার্নস
- রবীন্দ্রসংগীতঃ বাংলা গানের সর্বনাশ ও সর্বস্ব
- কবিতা আর গানের আকাশঃ রবীন্দ্রনাথ
- গানে ছবির প্রেরণা ও রবীন্দ্রনাথ
- ‘দেওয়া নেওয়া ফিরিয়ে-দেওয়া’
- কোন ভাঙনের পথে এলে
- বাংলা নাটকের গান, রবীন্দ্র নাটকের গান
- রবীন্দ্রসংগীতে কীর্তনের প্রভাব
বাংলা গানের সন্ধানে:
১৯৯১-এ অরুণা প্রকাশনী থেকে প্রথম প্রকাশিত, এবং ২০১৩-তে প্রতিভাস থেকে পুনর্মুদ্রিত এই বইয়ে যেসব লেখা আছে তারা হলঃ
>জাগো জাগো রে সংগীত
পুরোনো কলকাতার গান
গান-জাগানিয়া
‘এ কি মধুর ছন্দ’
‘তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে’
‘কে হে তুমি সুন্দর’
স্ববিরোধের শিল্পঃ আধুনিক বাংলা গান
বাংলা গানের চারদিগন্ত:
১৯৯২-এ অনুষ্টুপ থেকে, এবং ২০১৩-তে প্রতিভাস থেকে পুনর্মুদ্রিত এই বইয়ে যেসব লেখা আছে তারা হলঃ
বাংলা দেহতত্ত্বের গানের ধারা
বাংলা গণসংগীতের ধারা
যে গান আমাদের নেই
নির্জন এককের গান
বাংলা ফিল্মের গান ও সত্যজিৎ রায়:
১৯৯৪-এ প্রতিক্ষণ থেকে, এবং ২০০৮-এ গাঙচিল থেকে প্রকাশিত এই বইয়ে যেসব লেখা আছে তারা হলঃ
বাংলা ফিল্মের গান
সত্যজিৎ রায়ের সংগীত-বীক্ষা
রবীন্দ্রসংগীত ও সত্যজিৎ রায়
সত্যজিৎ ও গানের প্রয়োগ
গুপী গাইনের গান
সাক্ষাৎকারঃ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
সাক্ষাৎকারঃ স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত
“পড়তে হয়, নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়”-এর বাইরেও যে বাংলা গানের সুরে গুনগুনিয়ে রাত কাটায়, নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখে, নিজের মতো করে সাম-দাম-দণ্ড-ভেদের ঊর্ধ্বে উঠে জল-মাটি-আকাশের আহ্বানে সাড়া দেয়, সেই বাংলার মুখ যদি দেখতে চান, তবে এই বইগুলো পড়ে দেখুন। নইলে সেই বাংলার প্রাণের মাঝে লুকিয়ে থাকা সুধার খবরই হয়তো পাবেন না, শুধু দশচক্রে ভূতায়িত হয়েই কেটে যাবে এইসব দিনরাত্রি।
বন্দে মাতরম।
আলোচক পরিচিতি - আলোচক এক উদ্যমী পাঠক, যিনি বিপ্লব, চোখের জল, মানবচরিত্রের অতলস্পর্শী গভীরতা, সিন্ডিকেট, সারদা, ধোনি, ইত্যাদি তাবড় বিষয় থেকে দূরে, স্রেফ বেঁচে থাকার গল্প পড়তে চান। নিজের ভালবাসা থেকেই দীর্ঘদিন বইয়ের রিভিউ করছেন।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।