প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বইয়ের খবর

ডিসেম্বর ৩০, ২০১৬


অঘোরনাথের তন্ত্রকথা

আলোচনা - ঋজু গাঙ্গুলি

তন্ত্র।

শব্দটা শোনা মাত্র আমাদের মনের ঘাটে ছলছলাত করে ধাক্কা খায় কয়েকটা স্মৃতি আর অনুভূতি, যাদের উৎস নানাবিধ, যথাঃ

১) ছোটোবেলায় জীববিজ্ঞানের বইয়ে পড়া কয়েকটা খটোমটো পরিভাষা।
২) মন্ত্র আর যন্ত্রের সঙ্গে ধ্বনিগত ঐক্যের বশে কিছু গান, কবিতা, এবং উত্তেজিত সংলাপের অংশ।
৩) বইয়ে পড়া বা দাদু-ঠাকুমা’র মুখে শোনা কয়েকটা ভীতিকর কাহিনি, যার সত্যাসত্য বিচার করার আগেই ভয় আর কৌতূহলের টাগ-অফ-ওয়ার শুরু হয়ে যেত মনের মধ্যে।

এই শেষোক্ত ব্যাপারটাই আমাকে আকর্ষণ করেছে বরাবর। তাই প্রথমে বিভূতিভূষণের, পরে তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়-এর, এবং হালে শমীক দাশগুপ্ত-র তারানাথ তান্ত্রিকের কাহিনিগুলো আমাকে ভয় পাইয়েছে, ভাবিয়েছে, এবং কার্যত তাড়িত করেছে এটা জানার জন্য যে, সত্যিই কি তন্ত্রসাধনায় এমন সব ঘটনা ঘটে? এর কতটা সত্যি, আর কতটা তরল বা শুকনো দ্রব্যগুণের প্রভাব? কতটাই বা অন্ধ বিশ্বাস আর অনিশ্চিত জীবনযাপনের সঙ্গমে উদ্ভূত কল্পনামিশ্রিত অর্ধসত্য?

গ্রামেগঞ্জে শুধু নয়, আধুনিক নগরজীবনেও তান্ত্রিকদের রমরমা দেখেছি আমরা সবাই, প্রবীর ঘোষ এবং অন্যান্য যুক্তিবাদীদের একেবারে তুশ্চু করে যাদের পায়ে ডাইভ দেন শাঁসালো ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ঝাঁ-চকচকে সরকারি-বেসরকারি গাড়ির সওয়ারি আমলা থেকে ডাক্তার।

আমাকে মার্কেটিং বা সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ হওয়ার চেষ্টা না করে সিভিল সার্ভেন্ট হওয়ার জন্য পড়তে দেখে যে কথাটা অনেকেই বলতেন, সেটাই আমার মাথায় বরাবর ঘুরপাক খেয়েছে তন্ত্র নিয়েঃ “এসব করে কি কিছু হয়”?

উত্তরের সন্ধানে পড়াশোনা করতে গিয়ে প্রথমেই হাতে নিয়েছিলাম একটি বাংলা বই, যেটি এককালের নামকরা সাহিত্যপত্র ‘উত্তরা’-য় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল, এবং প্রথমে তিন খণ্ডে ও পরে অখণ্ড বই হিসেবে এখনও রীতিমতো বেস্টসেলার। বইটি হল, প্রমোদকুমার চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা “তন্ত্রাভিলাষীর সাধুসঙ্গ”। বিশ্ববাণী প্রকাশনী থেকে বর্তমানে উপলব্ধ ৭১২ পাতার হার্ডকভারটি আসলে এক বিচিত্র স্মৃতিচিত্রণ। ১৯১১ থেকে ১৯১৮: এই সময়টিতে লেখক পূর্ব ও উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন তন্ত্র ও সত্যের স্বরূপ সন্ধানে। অজস্র মানুষ, বিশেষত সংসারত্যাগী গৈরিক বা অন্য বসনধারীদের সান্নিধ্যে এসে তিনি খাতায় নোট করে রেখেছিলেন যেসব কথা, গান, শ্লোক, স্কেচ, এবং আত্মোপলব্ধি, সেগুলোই ধরা পড়েছে এই বিপুলায়তন বইটিতে।

সাধু বা চলিত, যে ভাষাতেই লেখা হোক না কেন, লেখকের প্রকাশভঙ্গী খুব সহজ, অনাড়ম্বর, এবং সৎ হওয়ায় প্রায় শতাব্দী-প্রাচীন কথাগুলো পড়তে খারাপ লাগেনি। কিন্তু বইটা পড়তে গিয়ে কিছু অত্যন্ত অস্বস্তিকর কথা আমায় খোঁচা দিতে লাগল, যার মধ্যে প্রধানতম হলঃ পৃথিবী জুড়ে যখন যুদ্ধ চলছে, ভারতবর্ষ যখন জাতিভেদ, নারীর প্রতি অসম্মান, আর ধর্মীয় সংকীর্ণতা নামক ভীষণ দৌর্বল্যকে কাটিয়ে স্বাধীনতার জন্য নিজেকে তৈরি করছে, তখন একজন শিক্ষিত-সচেতন মানুষ কিছু অলস, নেশাগ্রস্ত, এবং জীবনযুদ্ধ থেকে ‘ডেজার্টার’ লোকের পেছনে ধাওয়া করলেন কেন? কুণ্ডলিনী তত্ত্বজ্ঞান নামক পরশপাথরের আশায় দেশ, কাল, নিজের পরিবারের প্রতি দায়িত্বঃ এসব তুচ্ছ করে ছোটাই কি তন্ত্রাভিলাষ?

তন্ত্র নিয়ে আরো কিছু মানুষের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের ভাগীদার হওয়ার আশায় যখন ইংরেজি বইয়ের শরণাপন্ন হলাম, তখন আমাজন ‘বেস্টসেলার’ তকমা পাওয়া একটি তারকাখচিত ট্রিলজির সন্ধান দিল, যার তিনটি বই-ই Robert Svobod-এর লেখা। আমি সেই সিরিজের প্রথম দু’খানা বই “Aghora: At The Left Hand of God” এবং “Kundalini Aghora” পড়ে যা বুঝলাম তা হলঃ

(১) এই ধরণের বইয়ে যেসব লোকের মুখের কথা লিপিবদ্ধ হয়, তাদের ঘনাদা, টেনিদা নয়, বরং বিরিঞ্চিবাবা’র সঙ্গে তুলনা করা উচিৎ। এঁরা প্রায় যা খুশি তাই দাবি করেছেন, অথচ তার পক্ষে কোনো প্রমাণ দেওয়ার দায় অনুভব করেননি।
(২) মানব শরীরের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা শক্তিকে জাগিয়ে তোলার জন্য যোগ, ধ্যান, এবং সাধনার গুরুত্ব মহাপুরুষ থেকে শুরু করে সিরিয়াল দেখায় ব্যাঘাতে বিরক্ত হয়ে চা বানাতে যাওয়া গৃহিণী, সবার মুখেই শোনা যায়। এর জন্যে এত হাঙ্গামা করার কী মানে?

হতাশ ও বিরক্ত হয়ে যখন তারানাথ তান্ত্রিকের গল্পগুলোই আবার বের করার কথা ভাবছি, তখন প্রসিদ্ধ শিশু-সাহিত্যিক জয়দীপ চক্রবর্তীর পোস্টে উল্লিখিত একটি বইয়ের কথা মনে পড়ে গেল। বইটা জোগাড় করে, পড়ে, এবং ক’টা দিন কার্যত ঘোরের মধ্যে থেকে বুঝলাম, আমি নেহাত মূর্খ বলে বনে বাঘ খুঁজছিলাম, যখন সে আমার মনেই অপেক্ষা করছিল, আমার জন্যে।

কী নাম বইটার?

 বইয়ের নামঃ অঘোরনাথের তন্ত্রকথা
 লেখকঃ সব্যসাচী সেনগুপ্ত
 প্রকাশকঃ আনন্দ পাবলিশার্স
 হার্ডকভার, ২২৭ পৃষ্ঠা,
 প্রথম সংস্করণ জানুয়ারি ২০১৬,
 মূল্যঃ ২৫০/- টাকা
 আই.এস.বি.এনঃ 978-93-5040-663-2

‘শনিবারের চিঠি’-র আধুনিক অবতারে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত এই লেখাটি লেখকের নিজের তন্ত্রসাধনা ও শ্মশানবাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে রচিত। এই বইয়ে বর্ণিত ঘটনাবলির মধ্যে কোথাও কি কল্পনা মিশে নেই? হয়তো আছে, কিন্তু মানবপ্রীতি ও অসহায়ের পাশে দাঁড়াবার যে আশ্চর্য রহস্যময় সুর বেজেছে তাদের পেছনে, সেগুলো আমার সদাসন্দিগ্ধ মনকে চুপ করিয়ে দিয়েছে।

এই বইয়ের চালিকা শক্তি হল এর নারীচরিত্ররা। তন্ত্র সাধনায় পঞ্চ ‘ম’ কারের অন্যতম ঐ বিশেষ উপাদানের মহিমা আমরা সবাই শুনেছি বা পড়েছি। কিন্তু ওই একটি বিশেষ দরজা যে শুধু নরকের নয়, স্বর্গের রাস্তাও দেখায়, সেকথা লেখক বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন নানা লৌকিক, অলৌকিক, এবং অতিলৌকিক ঘটনার মধ্য দিয়ে। তাছাড়া শুধু তন্ত্র বা বিশ্বাস নয়, সহজ মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের যে অনুভূতিমালা লেখক গড়ে তুলতে চেয়েছেন, তাতে সুতো হয়ে থেকেছে বিভিন্ন নারীই।

তবে তত্ত্ব, চরিত্র, ঘটনা, স্থান ও কালঃ এসবই অসীম দক্ষতায়, রীতিমতো গায়ে-কাঁটা দেওয়া ভঙ্গিতে ফুটিয়ে তুলেছেন যে মানুষটি, এই বইয়ের আসল আকর্ষণ তিনিই। লেখক তাঁর যে জীবনের বর্ণনা দিয়েছেন এই বইয়ে, সে জীবন থেকে কী পরমার্থ লাভ হয়েছে তা তিনিই বলতে পারবেন। কিন্তু উপন্যাসের চেয়েও রোমাঞ্চকর, উঁচুদরের ট্র্যাজেডির চেয়েও বেদনাবহ, এবং ধর্ম-অর্থ-কাম-এর ব্যূহ ভেঙে বেরিয়ে আসা জীবনের এই বিবরণ পড়ে আমি একটা পুরোনো গানের প্রথম লাইনক’টার মহিমা আবার বুঝলামঃ
“এমন মানব জনম আর কি হবে,
মন যা কর, ত্বরাই কর এই ভবে।“

এমন বই পড়ার জন্যই তো অপেক্ষায় থাকি আমি।



আলোচক পরিচিতি - আলোচক এক উদ্যমী পাঠক, যিনি বিপ্লব, চোখের জল, মানবচরিত্রের অতলস্পর্শী গভীরতা, সিন্ডিকেট, সারদা, ধোনি, ইত্যাদি তাবড় বিষয় থেকে দূরে, স্রেফ বেঁচে থাকার গল্প পড়তে চান। নিজের ভালবাসা থেকেই দীর্ঘদিন বইয়ের রিভিউ করছেন।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2015 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।