আলোচনা - ঋজু গাঙ্গুলি
চলচ্চিত্র এবং মঞ্চের কিংবদন্তী অভিনেতা বিকাশ রায়-এর শতবর্ষ এসে গেল। কিন্তু ওনার অভিনয়-নৈপুণ্য এবং ব্যক্তি-পরিচিতির কতোটুকু সন্ধান পাবে আগামী প্রজন্ম? মূল্যবান বস্তুর প্রতি আমাদের অবহেলা আর অনাদরের কথা নতুন নয়, তাই এক সময়ে যেসব সিনেমা বা নাটকে অভিনয়ের সুবাদে বিকাশ রায় সাময়িক হিরো বা অ্যান্টিহিরোর ইমেজ ছাপিয়ে এক প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা হিসেবে খ্যাত হয়েছিলেন, সেগুলো আগামী দিনে সংরক্ষিত হবে কি না, সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। তাহলে অভিনেতা বিকাশ রায়, বা তার থেকেও বড়ো প্রশ্ন, মানুষ বিকাশ রায়কে জানতে চাইলে আগামী দিনের চলচ্চিত্র-প্রেমী মানুষ, বা অভিনয় শিল্পের ইতিহাস নিয়ে আগ্রহী ছাত্রদের কাছে রসদ হিসেবে কি কিছুই থাকবে না? একথা বলতে পেরে আমারই ভালো লাগছে যে অবস্থাটা ততোটা হতাশাজনক নয় দুটো কারণে:
(১) প্রযুক্তির উন্নতির পাশাপাশি জনমানসেও বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় (স্বাধীনতার পর থেকে সত্তরের দশকের শেষ পর্যন্ত) সম্বন্ধে জানার আগ্রহ তৈরি হয়েছে; তাই আশা করা যায় যে ওই সময়ের অজস্র স্মরণীয় সিনেমায় ও নাটকে অভিনয় করার সুবাদে বিকাশ রায়ের অভিনয় ক্ষমতা, এবং তাঁর সেই দক্ষতার সদুপযোগে পরিচালকদের সাফল্য আর ব্যর্থতার খতিয়ান নিয়ে আগামী দিনে অনেক আলোচনা হবে।
(২) প্রথাগত ভাবে লেখক না হলেও বিকাশ রায় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশের জন্যে টুকরো-টুকরো আকারে অনেক কিছু লিখেছিলেন। পরবর্তীকালে সেই লেখাগুলো নিম্নলিখিত চারটি আলাদা-আলাদা বই-এ জড়ো হয়। এই বইগুলো আগামী দিনের গবেষক, পাঠক, এবং চলচ্চিত্র-প্রেমীদের জন্যে সম্পদ, তথা বিকাশ রায় ও তাঁর সময়কে জানার উপকরণ হিসেবে থেকে যাবে। আমার আলোচনা এই বইগুলো নিয়েই।
এই চারটি বই-এর সম্বন্ধে যেহেতু অনেকেই ওয়াকিবহাল নন, তাই আগে তাদের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক:
(ক) আমি: ‘যুগান্তর’ দৈনিক, ‘যুগান্তর’ পূজাসংখ্যা, আর ‘উল্টোরথ’ বড়দিন সংখ্যায় প্রকাশিত এই লেখাটা একই সঙ্গে স্মৃতিচিত্রণ, আত্মজীবনী-র একটা খসড়া, সমকালীন চলচ্চিত্র ও নাট্য জগৎ সম্বন্ধে ব্যক্তিগত মতামত, এবং anecdote-এর সমাহার। বইটির প্রকাশকাল: শ্রাবণ ১৩৯২।
(খ) মনে পড়ে: ‘আনন্দলোক’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক ঝাঁক লেখা এই বইতে সংকলিত হয়েছে যেটি “আমি”-র তুলনায় সরস, এবং সুলিখিত। তাছাড়া এতে এমন অজস্র মূল্যবান তথ্য স্রেফ গল্পের ছলে বলে দেওয়া হয়েছে যেগুলো বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে আগ্রহী পাঠক ও গবেষকের পক্ষে অপরিহার্য। বইটির প্রকাশকাল: ভাদ্র ১৩৮৭।
(গ) কিছু ছবি কিছু গল্প: ‘আনন্দলোক’ পত্রিকায় প্রকাশিত আর এক ঝাঁক লেখার সংকলন এই বইটিই, আমার মতে, বিকাশ রায়ের লেখার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। বাংলার কালজয়ী নায়ক, নায়িকা, পরিচালক, সংগীতজ্ঞ, এবং চলচ্চিত্র-শিল্পের সঙ্গে জড়িত নানা রঙের বিচিত্র মানুষদের এমন সরস, অথচ সহানুভূতিময় পরিচয় আপনি বাংলায় আর একটিও পাবেন না। অন্য অনেক বই-এ আপনি তথ্য পাবেন, হয়তো গল্প পাবেন, গুজব পাবেন, চাই কি স্ক্যান্ডাল ও গসিপও পাবেন, কিন্তু এই লেখাগুলোয় উজ্জ্বল আলো আর অন্ধকারের কন্ট্রাস্ট দিয়ে গড়ে ওঠা সিনেমা জগতের যে মানবিক রূপটি ফুটে উঠেছে, তা অন্যত্র প্রায়ই চড়া আলো আর উন্মাদনার আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। এই বই-এর সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু একান্ত দুর্লভ ছবিও। এই বইটির প্রকাশকাল: আষাঢ় ১৩৮৮।
(ঘ) প্রসঙ্গ: অভিনয়: এই বইটিতে কিংবদন্তী-প্রতিম অভিনেতা নিজের অভিজ্ঞতা আর দেশ-বিদেশের নানা তথ্য ও জ্ঞান মিশিয়ে পাঠকদের কাছে অভিনয় শিল্পের খুঁটিনাটি, তথা নানা তাত্ত্বিক দিক তুলে ধরতে চেয়েছেন। বইটির বিশেষত্ব দ্বিবিধ:
এই চারটি বই-এর মাধ্যমে বিকাশ রায়ের জীবন, কাজ, ভাবনা, এবং বঙ্গ রঙ্গমঞ্চে এবং রুপোলি পর্দায় তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতির একটা জোরালো ছবি ফুটে ওঠে। আলাদাভাবে এই চারটি বই-ই আউট-অফ-প্রিন্ট, কিন্তু আমাদের অপার সৌভাগ্য যে করুণা প্রকাশনী এই চারটি বই-কে একসঙ্গে আমাদের কাছে পেশ করেছে একটিই বই হিসেবে, যার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এরকম:
আলোচ্য বইটির মাধ্যমে বিকাশ রায়ের এই চারটি বই আমাদের কাছে তুলে ধরার জন্যে করুণা প্রকাশনী প্রত্যেক চলচ্চিত্র-প্রেমীর কৃতজ্ঞতা-ভাজন হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু বইটি প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা না বলে থাকতে পারছি না:
(১) যদিও বইটি আপাত দৃষ্টিতে সুমুদ্রিত, বইটির প্রথম দিকে প্রকাশিত “আমি”-তে একটি বাঁধাই সমস্যা ঘটেছে। অন্তত আমার কপিটিতে পরের ফর্মার বদলে একই ফর্মা দুবার দেওয়া হয়েছে। অন্য কপির ক্ষেত্রে সেটা না ঘটলে এই অক্ষম আলোচকের প্রতি সিনেমা-দেবতার কটাক্ষ বলে মেনে নেব।
(২) “কিছু ছবি কিছু গল্প”-র সঙ্গে যে ছবিগুলো প্রকাশিত হয়েছিল, সেগুলো এই সংকলনে শামিল করার আগে একটু রিমাস্টার করে নেওয়া মোটেই কঠিন হত না, আর করলে বইটি সর্বাঙ্গসুন্দর হওয়ার পথে আরও এগোতো।
তবে একথাও বলতে হবে যে এই বইটি শুধুমাত্র উপরোক্ত চারটি বই-এর সংকলন নয়। এতে অমিয় সান্যালের দ্বারা সংকলিত যে বিস্তৃত চলচ্চিত্র তথ্যপঞ্জী রয়েছে, সেটি ছাড়া বিকাশ রায়ের বিপুল কর্মকাণ্ড এবং অসামান্য অভিনয় প্রতিভার আন্দাজ পাওয়া কঠিন হত। তথ্যপঞ্জীটির জন্যেই বিকাশ রায়, তথা বাংলা চলচ্চিত্র শিল্প নিয়ে গবেষণায় আগ্রহী পাঠককে এই বইটি পড়ার পরামর্শ দেওয়া যায়, কিন্তু আমি শুধু সেই জন্যে এই বইটি পড়ার কথা বলব না। বিকাশ রায়ের মতো একজন পরিশ্রমী সংগঠক, বেপরোয়া শিল্পী, সৃজনশীলতার তাগিদে অস্থির অথচ নানা সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ পরিচালক, বিরাট মাপের অভিনেতা, এবং মরমী আর সুরসিক মানুষের যথার্থ পরিচয় পেতে গেলে আপনাকে এই গোটা বইটা পড়তেই হবে।
বই-এর পরিমাপ করার জন্যে যেসব তারা আমি দিই, তার তুলনায় বহু-বহু গুণে ভাস্বর এক নক্ষত্রের লেখা এই বইয়ের জন্যে তারাবাজি করতে পারব না। বরং আপনাদের সব্বাইকে অনুরোধ করব এই বইটা খুঁজে বের করে পড়তে। সাদাকালো “৪২” থেকে শুরু করে রঙিন “ওগো বধূ সুন্দরী”, এই সব সিনেমায় শুধুমাত্র নিজের অভিনয় দিয়েই চরিত্রের পর চরিত্রকে স্মরণীয় করে রাখা এই অভিনেতার শতবর্ষে সেই অভিজ্ঞতাই না হয় হবে আমাদের দুর্বল শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আলোচক পরিচিতি - আলোচক এক উদ্যমী পাঠক, যিনি বিপ্লব, চোখের জল, মানবচরিত্রের অতলস্পর্শী গভীরতা, সিন্ডিকেট, সারদা, ধোনি, ইত্যাদি তাবড় বিষয় থেকে দূরে, স্রেফ বেঁচে থাকার গল্প পড়তে চান। নিজের ভালবাসা থেকেই দীর্ঘদিন বইয়ের রিভিউ করছেন।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.