বইয়ের খবর
জুন ৩০, ২০১৬
বাংলায় শিশু-কিশোর সাহিত্য নিয়ে, বেশ কিছুদিন ধরে, একটা অভিযোগ ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠছে।
অভিযোগটা হলঃ ছোটোদের কাছে সহজ, খুশিয়াল, আর মূল্যবোধের গল্পের বদলে ভূত, ভয়, আতংক, রহস্য-রোমাঞ্চ, আর খুনখারাপির গল্প বেশি-বেশি করে পৌঁছে দিচ্ছেন এযুগের লেখকেরা।
কেন তাঁরা সেটা করছেন, তার চটজলদি উত্তর কারও কাছেই নেই, কিন্তু এটা সত্যি যে এক সময় বাংলার ছোটোদের শৈশব রঙিন হয়ে উঠত যেসব পত্র-পত্রিকার সৌজন্যে, কন্টেন্টের দিক দিয়ে তাদের থেকে অনেকখানি সরে এসেছে এই সময়ের নামি শিশু-কিশোর পত্রিকাগুলো।
যুগের হাওয়া, আর নেট-এ পাওয়াঃ এই দুই বলবর্ধক-এ পুষ্ট এযুগের লেখকদের লেখা পড়ে যদি আপনি পুরনো “সন্দেশ”-এর কথা ভেবে নস্ট্যালজিক হয়ে পড়েন, তাহলে সেই পত্রিকার ফ্যাক্সিমিলি সংস্করণ সহজেই পেয়ে যাবেন। কিন্তু এই সময়ের ছোটোদের জন্যে কি তাহলে কেউই তেমন সহজ, সতেজ, মন-ছোঁয়া, ঠোঁটে হাসি আনা, আর চোখ চিকচিক করানো গল্প লেখেন না?
লেখেন।
আর তেমন একটা নয়, দু-দুটো বইয়ের সন্ধান দেওয়ার জন্যে রীতিমতো ‘ডাবল বিল’ হয়ে আসছে আমার আজকের “বইয়ের খবর”।
আগে বলি, হ য ব র ল, অর্থাৎ ‘সৃষ্টিসুখ’ প্রকাশনার শিশু-কিশোর সাহিত্যে নিবিষ্ট শাখাটির দ্বারা ডিসেম্বর ২০১৪-য় প্রকাশিত ১০৯ পাতার পেপারব্যাক “সাদায় কালোয়”-এর কথা।
(আই.এস.বি.এনঃ 978-1-63415-113-9)
“সন্দেশ” আর আরও নানা শিশু-কিশোর পত্রিকা যাঁর অলংকরণে সমৃদ্ধ হয়ে চলেছে আজ বেশ কয়েক দশক ধরে, সেই শিবশংকর ভট্টাচার্য, এবং আরেক দিগ্বিজয়ী লেখক শিশির বিশ্বাস-এর বাছাই করা কয়েকটি গল্পের এই সংকলন হাতে নিলেই মনটা শরতের আকাশ দেখার অনুভূতিতে ভরে ওঠে। তারপর যখন বইটার মলাট থেকে শেষ পাতা অবধি ছড়িয়ে থাকা অনবদ্য অলংকরণগুলো দেখার সুযোগ হয়, তখন নাকে শিউলির গন্ধটাও যেন এসে পৌঁছয়। তারপর, গল্পগুলো পড়তে-পড়তে মনটা যখন আনন্দ, হাসি, খুশি, চাপা কষ্ট, ভয়, শিরশিরানিঃ এইসব কিছুর মধ্য দিয়ে যেতে থাকে তখন রীতিমতো ঢাকের বোল ভেসে আসে কানে। আর বইটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর মনে হয়, বিসর্জন হয়ে গেল!
যেসব গল্প আছে এই বই-এ, তারা হল,
শিবশংকর ভট্টাচার্যের লেখায়ঃ
১. সাদায় কালোয়ঃ দুষ্টু কারিয়া আর গম্ভীর পুনু, এই দুই কুকুরের শুধু রঙে নয়, স্বভাবেও জমিন-আসমান তফাৎ। একটা ছুটি একসঙ্গে কাটাল তারা। তারপর কী হল?
২. উলটোপালটাঃ বদলির চাকরি বাবার, তাই নিরুপায় মা আর চার ছেলে-মেয়ে রাত-বিরেতে গিয়ে পৌঁছলেন এক জঙ্গুলে জায়গায়। কেমন জায়গা ছিল সেটা?
৩. আপনজনঃ গভীর বনের প্রভাতী কনসার্টে কড়ির মাঝে হঠাৎ কোমল সুরে ‘মা’ বলে ওঠে কে? আর তাকে নিয়ে বনে মাঝে ঠিক কতটা হুটোপাটি হল?
৪. ভয়ংকরঃ ‘বনজোনাক’ নামের গভীর বনের মধ্যে থাকে এক মূর্তিমান ত্রাস, কিন্তু সে কি শুধুই ভয়ংকর?
৫. ছোটো তরফের পুজোঃ চাংরিপোতা গ্রামের ভটচাজ-দের বাড়ির পুজো দেখতে গিয়ে ঠিক কোথায় পৌঁছে গেল গল্পের নায়ক?
শিশির বিশ্বাস-এর লেখায়ঃ
১. আইসক্রিমওয়ালাঃ গরমে ফুটিফাটা দুর্গাপুর শহরের এক স্কুলের এক পিছিয়ে পড়া ছেলে ঠিক কোন ইচ্ছেয় ভর দিয়ে সত্যিকারের বড়ো হল?
২. অলৌকিকঃ গল্পটা পড়তে-পড়তে, সত্যি বলছি, বেশ গা-ছমছম করছিল।
৩. পাথরের চোখঃ অলৌকিক ও বীভৎস রসের আরও একটা গল্প।
৪. রাজপ্রহরীঃ ইতিহাস আর অলৌকিক মিশে গেছে এই গল্পে।
৫. অর্জুন সর্দারঃ সুন্দরবনের ভয়ংকর সুন্দর পটভূমিতে লেখা এই তাজা গল্পটা পড়তে-পড়তে পাঠকের মানসভ্রমণ এক্কেবারে নিশ্চিত।
অতঃপর, বাড়ির ছোট্টটির হাতে তুলে দেওয়ার জন্যে লীলা মজুমদারের অবিস্মরণীয় লেখাগুলোর মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে হতাশ হবেন না। চটপট যোগাড় করে ফেলুন এই ৯৯/- টাকার বইটি। দায়িত্ব নিয়ে বলছি, গল্পগুলো, বিশেষত শিবশংকরের গল্পগুলো পড়ার পর ভালো লাগা আর অব্যক্ত কষ্টের সেই মিশেলটা গলার মধ্যে দলা পাকিয়ে ওঠা গ্যারান্টিড।
এবার বলি ‘সহজপাঠ’ থেকে জানুয়ারি ২০১৬-য় প্রকাশিত, তাপস মৌলিকের লেখা ৮টি গল্পের ১১৯ পাতার হার্ডকভার সংকলন “দাম সিং”-এর কথা। সুমুদ্রিত এই বইটির অন্যতম সম্পদ হল প্রচ্ছদ আর ভেতরে শিবশংকর ভট্টাচার্যের করা অলংকরণগুলো।
(আই.এস.বি.এনঃ 978-93-82370-29-1)
যেসব গল্প এই বই-এ আছে, তারা হল (বন্ধনীর মধ্যে প্রথম প্রকাশ যে পত্রিকায়, সেটা লিখলাম)
১. দাম সিং (রঙবেরঙ)
২. এক-টুকরো দার্জিলিং (রঙবেরঙ)
৩. রক্ষাকবচ (রঙবেরঙ)
৪. কন্যাকুমারীর শঙ্খ (জয়ঢাক)
৫. রতনদার ব্যবসার আইডিয়া (রঙবেরঙ)
৬. লালতাপ্রসাদের ঘড়ি (রঙবেরঙ)
৭. কানাই (খামখেয়ালি)
৮. বিসর্জন (রঙবেরঙ)
লেখাগুলো একবার শুরু করলে, এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলতেই হয় তাদের সংক্ষিপ্ত দৈর্ঘ্য আর সহজতার জন্যে।
গল্প নয়, বরং লেখকের নিজের জীবনের নানা অভিজ্ঞতা, যার মধ্যে অন্যতম হল পর্বতারোহণ, আর ছোটো-ছোটো অশ্রু-ব্যথার সহজ অথচ মর্মস্পর্শী ভিনেট (vignette) বলেই এদের বর্ণনা দেওয়া উচিত।
খুব সহজ ভাষায়, জীবনের অনেক বড়ো কথাগুলোকে লেখক এখানে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। লেখাগুলোর মাঝেমধ্যে গুঁজে দেওয়া হালকা হাসি আর চোখের জল তাদের ঐশ্বর্যমণ্ডিত করেছে।
তবে এসবের মাঝে ব্যতিক্রমী লেখা হিসেবে আমি ‘কানাই’ নামক গল্পটির দিকে বিশেষভাবে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইব, কারণ এই গল্পটা পড়ার পর এমন একটা “তাই কি?” অনুভূতির রেশ থেকে যায়, যেটা অতুলনীয়।
তাই, এই বইটির ক্ষেত্রেও আমি একই কথা বলব। মাত্র ১৩৫/- টাকার এই বইটি চিরাচরিত ভূত-ভয় আর খুনখারাপির বাইরে, এক অন্যরকম পৃথিবীর গল্প বলতে চাইছে পাঠকের উদ্দেশে। সেই সুযোগ হারানোটা কি ঠিক হবে, বলুন?
আলোচক পরিচিতি - আলোচক এক উদ্যমী পাঠক, যিনি বিপ্লব, চোখের জল, মানবচরিত্রের অতলস্পর্শী গভীরতা, সিন্ডিকেট, সারদা, ধোনি, ইত্যাদি তাবড় বিষয় থেকে দূরে, স্রেফ বেঁচে থাকার গল্প পড়তে চান। নিজের ভালবাসা থেকেই দীর্ঘদিন বইয়ের রিভিউ করছেন।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।