বইয়ের খবর
ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৭
গল্পের দিনরাত্রি
ঋজু গাঙ্গুলি
এমনিতে চণ্ডীমণ্ডপের মতো আড্ডা বা খুচরো কোঁদলের জায়গা হিসেবেই
আমরা ফেসবুককে চিনি। কিন্তু এবার কলকাতা বইমেলার ঢাকে কাঠি পড়ার
সঙ্গে-সঙ্গে তা একটি যুদ্ধক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছিল। একদিকে যেমন
লেখক ও তাঁদের প্রকাশকেরা তারস্বরে নিজ-নিজ বইয়ের প্রচার ও ভার্চুয়াল
বিপণনে লেগে পড়েছিলেন, অন্যদিকে আবার কিছু লেখক তথাকথিত ‘ফেসবুক’-লেখক/কবিদের
উদ্দেশে টীকাটিপ্পনীতে বাজার গরম করে তুলেছিলেন।
লগ-ইন করামাত্র প্রকাশিতব্য বইয়ের ঘোষণায় এবং মাৎসর্য বা ক্রোধের
বশবর্তী হয়ে করা শাপশাপান্তর ঠেলায় যখন যুগপৎ ‘বাঁশবনে ডোম কানা’
ও ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’ বাক্যদ্বয়ের অর্থ হৃদয়ঙ্গম করছি,
তখন বাঙালের হাইকোর্ট দর্শন, মানে বইমেলা গমনের সুযোগ এসে গেল।
মেলায় পৌঁছে নানাবিধ হাহা-হোহো ও জঁর ফিকশনের কেনাকাটার কোটা
কমপ্লিট করার পর মনে হল যে এবার সেইসব লেখকের গল্পের বই কেনা যাক
যাঁদের লেখার সঙ্গে আন্তর্জালে বা ফেসবুকে পরিচয় থাকলেও “মুদ্রিত”
লেখক হিসেবে যাঁদের সাহচর্য পাওয়া হয়নি। আসলে নিজে লেখক নই বলেই
হয়তো বেশি করে এটা জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল যে ঠিক কোন দক্ষতা বা আত্মবিশ্বাসের
বশে তাঁরা সেই ‘থিন রেড লাইন’-এর ওপারে পৌঁছতে পেরেছেন যেখানে
পৌঁছনো এখনও এক বিপুল সংখ্যক মানুষের সাধ্যাতীত। সৃষ্টিসুখ ও দ্য
কাফে টেবল-এর স্টল ঘুরে স্বীয় অভিপ্রায় পূরণ করতে বেশি সময় লাগল
না। আজকের ‘বইয়ের খবর’ তেমন চারটি বই নিয়েই।
একেবারে প্রথমেই লিখি শ্রীমতী সুদেষ্ণা চক্রবর্তীর গল্প-সংকলন
“গল্পরা কথা বলে” নিয়ে।
‘দ্য কাফে টেবল’ থেকে প্রকাশিত ১৫০ টাকা দামের ও ১২৭ পাতার এই
ছিমছাম, সুমুদ্রিত, টাইপো-বর্জিত পেপারব্যাকটির কাঠামোয় প্রথমেই
রয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার শ্রদ্ধেয় এবং জনপ্রিয় লেখক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
সান্যাল (ঘনাদা)-এর ‘ভূমিকা’ ও লেখকের ‘নিজের কথা’।
এরপর যে গল্পগুলো একে-একে পাঠকের সঙ্গে আলাপ করেছে তারা হল:
১. তমসো মা: স্বামীর মৃত্যুর পর বাংলো ছেড়ে দূরে নিজের মেয়ের
কাছে চলে যাচ্ছেন মৃত্তিকা। কিন্তু এই সহজ ও সরল তথ্যের পেছনে
লুকিয়ে আছে কোন গভীর ও গোপন সত্য?
২. না চাহিলে: নিজের হাতে গড়া লাইব্রেরি থেকেই এবার বিদায় নিতে
হচ্ছে দীপঙ্করকে। একে কি ঠেকানো সম্ভব হবে?
৩. অন্তর্লীন: ঠিক কী হয়েছে কস্তুরী চৌধুরীর?
৪. এই তো ভালো লেগেছিল: তাহলে কি খেলা ভেঙেই গেল সুপ্রিয়ার, নাকি
এখনও রয়ে গেছে কিছু চাওয়া, পাওয়া,আর বেঁচে থাকা?
৫. অনুচ্চারিত: একটি ‘কাজের বউ’-এর একটি দিন কেমন কাটে?
৬. গ্রসন: ধীমান ছেলে ও সৎ স্বামীকে নিয়ে সুখের যে খেলাঘর গড়েছে
চৈতি, তার মেয়াদ আর কতদিন?
৭. বৃত্তে ফেরা: স্বামীর সঙ্গে প্রেমহীন দাম্পত্য আর একরাশ অভ্যাসে
বন্দি মধুজা কি পালাতে পারল নিজের বৃত্তের বাইরে?
‘অনুচ্চারিত’ ছাড়া প্রায় প্রতিটি গল্পেরই কেন্দ্রে রয়েছে এক নারী,
যে শিক্ষিত হয়েও, রুচিবোধ ও রূপের সম্ভার নিয়েও দুঃসহ একাকিত্বের
শিকার, এবং যে সেই সোনার খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। দুঃখের বিষয়
হল, একমাত্র “অন্তর্লীন” ছাড়া একটি গল্পেও আকাঙ্ক্ষিত সাসপেন্স
তৈরি করতে পারেননি লেখক। ফলে গল্পগুলো স্রেফ দুঃখবাদী এবং নাটকীয়
অথচ উত্তরণ-বর্জিত একঘেয়েমিতে পর্যবসিত হয়েছে। পুরুষ চরিত্রদের
নিরক্ত ও পুতুলসুলভ আচরণ, গল্পগুলোতে রসবোধের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি,
আমাদের প্রতিনিয়ত উৎক্ষিপ্ত করে চলা এই ধাবমান কালের সঙ্গে সংযোগহীনতা:
এরাও গল্পগুলোকে বিরক্তিকর করে তুলেছে।
সমাজের অন্য স্তরের মানুষের জীবনের একটি দিন দিয়ে লেখা “অনুচ্চারিত”
পড়েও এটাই মনে হয়, আদৌ কোনো দরকার ছিল কি এই শব্দ-বাক্য-অনুচ্ছেদ
স্তূপাকারে সাজিয়ে দেওয়ার?
সখেদে জানাই, এই জিনিস একবারের বেশি পয়সা খরচ করে কেউ পড়বে না,
আর আমার মতো পাবলিক হলে বাকিদের না-পড়ার পরামর্শই দেবে।
এবার আসি ‘সৃষ্টিসুখ’ থেকে প্রকাশিত সরোজ দরবার-এর গল্প সংকলন
“বিরাট কোহলির কভার ড্রাইভ’-এর প্রসঙ্গে।
বাংলা ওয়েবজিনের পাঠকের কাছে সুপরিচিত এই লেখকের একঝাঁক গল্প
এমন একটি স্মার্ট প্রচ্ছদ এবং ১০৬ পৃষ্ঠার ১২৫/- টাকা
দামের ছিমছাম পেপারব্যাকের মাধ্যমে আমাদের কাছে পেশ করার জন্য
‘সৃষ্টিসুখ’-এর উদ্দেশে কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করতেই হচ্ছে।
যেসব গল্প এই বইয়ে আছে তারা হল:
১) রবিবারে স্নান
২) হালখাতা
৩) সে এক অপ্রচলিত দীপাবলি
৪) দিব্যা ভারতীর গুসসা
৫) আশ্রমের নাম কনকলতা
৬) হাতেখড়ি
৭) হারানো মেয়ের গপ্পোটি
৮) রুট নং ৪৫
৯) শান্তু সাহা স্টাম্প আউট
১০) নিজস্বী
১১) বিশ্বাস ডাক্তার (হাতুড়ে)
১২) বোমপচা
১৩) সেরা বাঙালি
১৪) হাসি
১৫) বিরাট কোহলির কভার ড্রাইভ
এই গল্পগুলোর সঙ্গে একটা দিন কাটানোর অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
“স্বপ্নের মতো”।
ভুল বুঝবেন না, প্লিজ। সব স্বপ্ন সুখের হয়না। স্বপ্নে নিজেকে
এক-ক্লাস মেয়ের মাঝে নগ্ন অবস্থায় পেলে যেমন অনুভূতি হয়, বা স্বপ্নেই
বিদেশে পৌঁছনোর মুখে পাসপোর্ট খুঁজে না পেলে যে শ্বাসরোধী ভয়টা
জমা হয় বুকের বাঁদিকে, তেমন অনুভূতিও উপহার দিয়েছে এদের মধ্যে
কয়েকটি গল্প। কিন্তু, সব মিলিয়ে, বাস্তবের বাংলা তথা মহানগর আর
শহরতলী এতটাই নিপুণভাবে ধরা পড়েছে এই গল্পগুলোয় যে আমি ফিদা হয়ে
গেছি এদের নিয়ে।
ঠিক যেভাবে আজকের বাঙালি হালকা হাসি, কিছু না-পাওয়া প্রেম, আর
অনেক অপ্রাপণীয় সাধ পাউডারের মতো করে মুখে বুলিয়ে চোখের নিচের
গর্তে জমা কালি আর জলের শুকনো দাগ ঢেকে দেয়, সেভাবেই এই গল্পগুলো
তাদের সতেজ গদ্য, ঠাসবুনোট গড়ন, আর জীবনের রস দিয়ে ঢেকে দিয়েছে
গল্পে বলা মানুষগুলোর জীবনের তিক্ততা আর হেরে যাওয়াগুলোকে।
আপনার দরবারে একটা আসন চাই সরোজ। নিরাশ করবেন না তো?
এবার আসি ‘সৃষ্টিসুখ’ থেকেই প্রকাশিত, সৌরাংশু-র গল্প-সংকলন “ইয়র্কার
এবং অন্যান্য গল্প”-র কথায়।
১২৫/- টাকা দামের, ১২৩ পৃষ্ঠার ঝকঝকে পেপারব্যাকের প্রচ্ছদটি
ওলটালে প্রথমেই আসে প্রথিতযশা সাহিত্যিক ঈশানী রায়চৌধুরীর ভূমিকা,
যার নামটিও এই বইয়ের নামের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে লক্ষ্যভেদী: সৌরাংশুর
ইয়র্কার।
‘অংশরা’ নামের এক আশ্চর্য মায়াময় ‘উৎসর্গ’-পত্র, এবং একেবারে
সেহওয়াগ-স্টাইলের ‘কৃতজ্ঞতা স্বীকার’-এর পর এসেছে:
১. লেগ বিফোর উইকেট
২. মন্দদেশের উপাখ্যান
৩. ইয়র্কার
৪. সত্যি হলেও...
৫. দ্য এক্সটিংশান
৬. খ্যাঁচাকল
৭. অভিমন্যু
৮. আজও বসন্ত
৯. দক্ষিণদ্বারে
আগেই এটা স্পষ্ট করে বলি যে এদের ‘গল্প’ বলতে আমার সমস্যা হচ্ছে।
একজন খেলোয়াড়কে কোনো ব্যাংক বা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কর্মচারী
হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলে যেমন ভুল হবে, তেমনই নির্ভার, স্মার্ট,
ভীষণ সৎ আর সোজাসাপটা গদ্য দিয়ে ধরা এই ছোটো-ছোটো vignette এবং
অনুভূতিমালাকে ‘গল্প’ বললে ভুল হবে। হ্যাঁ, এদের মধ্যে মাত্র একটা
লেখাই কল্পনা আর পরাবাস্তব মিশিয়ে কিছুটা ‘গল্প-হলেও-সত্যি’ চেহারা
পেয়েছে, আর সেটি হল, “সত্যি হলেও...”। কিন্তু অন্যদের ‘গল্প’ হিসেবে
বর্ণনা করতে পারছিনা।
বরং এই লেখাগুলোর পেছনে অনুক্ত থেকে গেছে যে কথাগুলো, তারাই সমুদ্রের
মতো, পাহাড়ের বুক ছুঁয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের মতো, নিস্তব্ধ অফিসে
বেজে যাওয়া ফোনের মতো করে নিজস্ব শব্দ আর নৈঃশব্দ্য দিয়ে কিছু
গল্প বলেছে, যার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী গল্পটা আছে একেবারে শেষে,
অর্ধেকেরো কম পাতা জুড়ে।
সৌরাংশুর মাচো গদ্য এবং সৎ প্রকাশভঙ্গীর টানে বইটা একটানে পড়ে
ফেলা যায়, কিন্তু এটাই মনে হয় যে এটিকে গল্পের বই হিসেবে না দেখাই
বোধহয় সঙ্গত।
নোনতা আর ঝাল খেয়ে মরে যাওয়া মুখে স্বাদ ফিরিয়ে আনতে শেষ পাতে
তথা রাতে ওস্তাদের মার হিসেবে আমি যে চতুর্থ বইটির আলোচনা পেশ
করছি সেটি ওয়ান অ্যান্ড ওনলি ঘনাদা, অর্থাৎ রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
সান্যাল-এর লেখা “অল্পতে গল্প”।
বৈদগ্ধ্য এবং অভিজ্ঞতাকে রসবোধ দিয়ে ঢেকে দেওয়ার একান্ত আলীসাহেবি
ঘরানায় লেখা ১০০/- টাকা দামের এই গল্প-সংকলনটি আমাদের কাছে এল
‘দ্য কাফে টেবল’-এর সৌজন্যে। পার্থ মুখোপাধ্যায়-এর প্রচ্ছদে সমৃদ্ধ,
মাত্র ৭৯ পৃষ্ঠার এই পেপারব্যাক-এ দেবাশিস আইচ-এর সোজাসাপটা ‘ভূমিকা’-র
পর আছে কিছু গল্প, কিছু ‘গুল্প’, আর সহজ কথার আড়ালে কিছু গম্ভীর
ও গাঢ় সত্যি। তারা হল:
১) বৃক্ষছায়া
২) পিন্টুর মৎস্যরাজ
৩) বাজার
৪) ল্যাহাপড়া
৫) দোতলা বাস
৬) ক্ষেতুবাগচী সিরিজ:
১. বদরীর কবিতা
২. হিটলারী
৩. জাল নোট
৪. ফুটলিশ
৫. পাস্তুরের দস্তুর
৬. ঠেক
৭. গাছ-মা
রম্যরচনা নয়; কিন্তু সহজতায়, সরসতায়, এবং সমকালের সমুদ্রমন্থনে
উঠে আসা নানা চুটকির অক্লেশ পরিবেশনে এই লেখারা হয়ে উঠেছে সাক্ষাৎ
কাঁঠালের আঠা, যাদের একবার পড়ার পর আপনার ভালো বা মন্দ যাই লাগুক
না কেন, ঝেড়ে ফেলতে পারবেন না। তাই সৎ পরামর্শ দিই: ডাইরেক্ট হাতে
সর্ষের তেল না মেখে বরং চাট্টি মুড়ি আর চানাচুর আচারের তেল দিয়ে
মেখে বড়ো বাটিতে নিয়ে এই বইটা পড়তে বসুন। হেব্বি তো লাগবেই, হয়তো
দ্য কাফে টেবল-কে একখান মেইল করে বলেই দেবেন, “কেমন লোক মশাই আপনারা?
এমন বই এত পাতলা করে ছাপিয়েছেন!”
গল্পপাঠ শুভ হোক।
আলোচক পরিচিতি - আলোচক এক উদ্যমী পাঠক, যিনি বিপ্লব, চোখের জল, মানবচরিত্রের অতলস্পর্শী গভীরতা, সিন্ডিকেট, সারদা, ধোনি, ইত্যাদি তাবড় বিষয় থেকে দূরে, স্রেফ বেঁচে থাকার গল্প পড়তে চান। নিজের ভালবাসা থেকেই দীর্ঘদিন বইয়ের রিভিউ করছেন।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।