বইয়ের খবর - অন্য হুমায়ূন
জানুয়ারি ৩০, ২০১৬
"বাংলা সাহিত্যে শ্রেষ্ঠ গদ্যকার
কে? উত্তর খুঁজতে গেলে চায়ের পেয়ালায় যা উঠবে তা তুফান নয়, সুনামি।
কিন্তু বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় গদ্যকার? উত্তর নিয়ে দ্বিধা থাকার
কথা নয়,..."
আলোচনা - ঋজু গাঙ্গুলি
বাংলা সাহিত্যে শ্রেষ্ঠ গদ্যকার কে? উত্তর খুঁজতে গেলে চায়ের
পেয়ালায় যা উঠবে তা তুফান নয়, সুনামি। কিন্তু বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয়
গদ্যকার? উত্তর নিয়ে দ্বিধা থাকার কথা নয়, কারণ কলকাতা-কেন্দ্রিক
বুদ্ধিজীবী মহলের ভয়ানক একদেশদর্শিতা উপেক্ষা করে উত্তরটা পাঠক
দিয়েই রেখেছেন: হুমায়ূন আহমেদ। ১৯৭২-এ “নন্দিত নরকে” উপন্যাস-এর
মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় পা রেখেছিলেন হুমায়ূন। ক্রমে তাঁর
জনপ্রিয়তা এমন একটা স্তরে পৌঁছয় যা শুধু ঈর্ষণীয় বললে কিছুই বলা
হয় না। কোনক্রমে ১০০০ কপির একটি সংস্করণও ফুরোয় না এমন বাজারে
তাঁর বই বিক্রি হওয়ার পরিসংখ্যান দেখলে মাথা ঘুরে যেতে পারে। কিন্তু
তাঁর এই জনপ্রিয়তা যেসব চরিত্র আর রচনা (যেমন: “হিমু” সিরিজ, “মিসির
আলি” সিরিজ, “শংখনীল কারাগার” বা “আগুনের পরশমণি”-এর মতো উপন্যাস)-র
সঙ্গে জড়িয়ে আছে, তাঁর বাইরেও তিনি অনেক লিখেছেন। সেই রচনার মধ্যে
একটি বড়ো অংশই ছিল পাঠক ও প্রকাশকের চাহিদায় লেখা, কিন্তু সমালোচকের
তোলা নানা খুঁতের কথা মাথায় রেখেও তাদের ‘আনপুটডাউন-এবল’ প্রকৃতি,
এবং বিষয়গত বৈচিত্র্য উপেক্ষা করা অসম্ভব। তেমনই কয়েকটি ব্যতিক্রমী
লেখার পরিচয় দেওয়ার জন্যে এই লেখা, যাদের বিষয় এমনই যে বাংলায়
তাদের নিয়ে লেখালেখি এখনও দুঃসাহসের পরিচায়ক।
(১) কুহক:
১৯৯১-এ প্রকাশিত এই নভেল্লাটির বিষয়বস্তু আপাতভাবে কল্পবিজ্ঞানের।
একটি নিঃসঙ্গ মানুষ এক্স-রে করাতে গিয়ে অত্যধিক রেডিয়েশনের শিকার
হন। এর ফলে তিনি একদিকে যেমন অতিমানবিক শক্তির অধিকারী হন, অন্যদিকে
তাঁর শরীরে আসে শেষের-ইঙ্গিতবাহী পরিবর্তন। গল্পের শেষে কী হবে,
এই নিয়ে রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় থাকা পাঠক কিন্তু নিজের অজান্তেই
হুমায়ূনের জড়িয়ে পড়েন চরিত্রগুলোর সঙ্গে, বুঝে ফেলেন: সুন্দর আর
অসুন্দরের যে বর্গীকরণ দিয়ে আমরা দুনিয়াদারি করি তা কত ঠুনকো।
এমনই লেখকের কলমের জাদু, যে আদ্যন্ত ফ্যান্টাসি জেনেও আমরা গল্পে
নিজেদের খুঁজি, ইচ্ছাপূরণ করি, শেষ লাইনটা পড়ার পরেও প্রশ্নের
উত্তর খুঁজতে থাকি।
(২) নি:
১৯৯২-এ প্রকাশিত এই উপন্যাসকে অদ্ভূত রসের লেখা বলাই যেত, কারণ
সেটির বিষয় কল্পবিজ্ঞান হয়ে ফ্যান্টাসি ঘুরে অতিলৌকিক দিকে বেঁকেছে|
এক নিঃসঙ্গ সায়েন্স টিচার নানা ঘটনার মাধ্যমে আবিষ্কার করেন যে
তিনি একজন ‘নি’, অর্থাৎ ৪৭টি ক্রোমোজম সংখ্যার এক মানুষ যিনি স্বপ্নকে
মুক্ত করতে পারেন| কিন্তু গণিত, দূরবীন, আর একাকিত্ব নিয়ে থাকা
সম্পূর্ণ নির্লোভ সেই মানুষটি কী করলেন তাঁর সেই শক্তি দিয়ে? এক
আশ্চর্য মায়ায় আচ্ছন্ন, অথচ প্রায় নিখুঁত বিবরণে সমৃদ্ধ এই সুখপাঠ্য
লেখাটি একবার নয়, বারবার পড়তে ইচ্ছে হয়, আর মনে হয়, মানুষটার ওই
শেষ স্বপ্নটুকু কি সত্যি হল শেষে?
(৩) পোকা:
১৯৯৩-এ প্রকাশিত এই উপন্যাসকে বিজ্ঞান-সুবাসিত অদ্ভূত রসের কাহিনি বলে বর্ণনা করাই ঠিক হবে। মামার সংসারে আশ্রিত, এক আপাতদৃষ্টিতে অত্যন্ত সাধারণ যুবকের প্রায় অতর্কিত বিয়ের সময় থেকে ঘটনা শুরু। তারপর অবশ্য আমরা একে-একে জানতে পারি তার শৈশবের ঘটনা, যেমন আমরা দেখি অফিসে তার সহকর্মী ও ঊর্ধ্বতন ও সহকর্মীদের সঙ্গে তার এক বিচিত্র সম্পর্ক গড়ে উঠতে। কিন্তু গল্পের শেষে গিয়েও যেটা আমরা বুঝিনা সেটা হল, সবটাই কি নায়কের ও অন্যদের বিভ্রম, নাকি সত্যিই...। কিন্তু এর মধ্যেও মনে থেকে যায় অতি সংক্ষেপে আঁকা চরিত্রদের বর্ণনা, আর প্রশ্ন জাগে: অদ্ভূত রসের আড়ালে এটাও কি অপূর্ণ প্রেমের আখ্যান?
(৪) শূন্য:
আর এক নিঃসঙ্গ এবং গণিতের রহস্য নিয়ে পাগল শিক্ষককে নিয়ে লেখা এই উপন্যাস হুমায়ূনের অদ্বিতীয় কলমে গাণিতিক হয়েও জাদুবাস্তবতার এক আশ্চর্য স্তরে পৌঁছে যায়, যেখানে আমরাও ভাবতে শুরু করি: ফিবোনাক্কি সিরিজের (নমুনা দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না: ১,১,২,৩,৫,৮,১৩,২১,৩৪,৫৫, ৮৯.... যাতে প্রথম সংখ্যা ১-কে একাদশ সংখ্যা ৮৯ দিয়ে ভাগ করলে পাওয়া যায়: ০.০১১২৩৫৮১৩২১..... অর্থাৎ এই সিরিজটাই ফিরে আসে) মধ্যেই কি তাহলে লুকিয়ে আছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কূটতম প্রশ্নের উত্তর? ফিবোনাক্কি ভেবে যার সঙ্গে চলছে মনসুর সাহেবের কথোপকথন সে কি সত্যি না কল্পনা? আর এরই মধ্যে গল্প এগোয় তার অনিবার্য পরিণতির দিকে, কিন্তু তার মধ্যে সবথেকে বেশি করে থেকে যায় গল্পের শেষটা, যা সত্যি নয় বলেই বোধহয় সবচেয়ে বড়ো সত্যি।
(৫) দ্বিতীয় মানব:
২০০২-এ প্রকাশিত এই উপন্যাসের শুরুতে আমরা দেখি যে চৈত্র মাসের
এক দুপুরে মাহতাব উদ্দিন সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে এল খলিলুল্লাহ
নামে এক অশিক্ষিত মানুষ, যে মাটি-কাটার কাজ ছাড়া আর কিছুই জানে
না, কিন্তু নীলগঞ্জ হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত হেডমাস্টার মনে করেন
যে তার কিছু অস্বাভাবিক ক্ষমতা আছে। নিতান্ত হালকা চলে শুরু হওয়া
এই উপন্যাস এরপর অন্য মাত্রা পেল যখন একের-পর-এক পরীক্ষা থেকে
বোঝা গেল যে আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ হলেও এই মানুষটি বিবর্তনের ধাপে
হয়তো বা মানুষের থেকে কয়েক কদম এগিয়ে থাকা এক অন্যতর সম্প্রদায়ের
মানব। কিন্তু বাড়ির ক্ষুদ্রতম সদস্য টুনটুনির জন্যে একটা যন্ত্র
বানাতে গিয়ে সে একটি গোপন কথা জেনে ফেলল। আর তারপর? বিজ্ঞানের
হযবরল নয়, বরং প্রশ্নের আর সম্ভাবনার এক রুদ্ধশ্বাস সংকলন এই লেখাটি।
শুধু এমন কল্পবিজ্ঞান-ফ্যান্টাসি-বিজ্ঞান নিয়েই নয়, বাংলায় যে
ধারায় অনীশ দেব ছাড়া বিশেষ কেউ ধারাবাহিক ভাবে লেখেননি, সেই ভয়ের
(ভূতের নয়, যদিও দুর্ভাগ্যজনক বিষয় এটাই যে এদ্দিনেও বাংলা সাহিত্য
যে সাবালক হয়নি সেটা বোঝা যায় যখন ভয়ের, এমনকি মনস্তাত্ত্বিক গল্পকেও
‘ভূতের গল্প’ নামে চালানো হয়) গল্প এবং সাইকোলজিকাল থ্রিলার লিখেছেন
হুমায়ূন, আর তাদের মধ্যে কয়েকটির অতি সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরলাম
এই লেখায়:
(১)
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ:
২০০১-এ প্রকাশিত এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু এমনই অভিনব যে সংক্ষিপ্তসার পেশ করলে তার সর্বনাশ হবে। এটুকুই শুধু লেখার যে গল্পের শেষ পর্যন্ত কথকের সঙ্গে পাঠকও ভেবে চলে যে সে কি কোন ক্রাইম থ্রিলারের মধ্যে আটকে পড়েছে, নাকি এটা ভূতের গল্প, নাকি এর সবটাই মনের ভুল? শুধু গল্পের শেষে গিয়ে যখন হঠাৎ টের পাই যে চোখটা জ্বালা করছে, তখন বুঝি কী অসামান্য এক প্রেমের উপাখ্যান পড়ে উঠলাম।
(২)
কুটু মিয়া:
২০০৪-এ প্রকাশিত এই উপন্যাসটি সম্ভবত হুমায়ূনের লেখা একমাত্র বিশুদ্ধ ভয়ের উপন্যাস, যাতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক অমঙ্গলের অন্ধকারে ঢাকা থাকে অসহায় চরিত্রগুলো, আর শেষে গিয়েও লেখাটা “হইল না শেষ” থেকে যায় বলে মনে হয়, এরপর কী?
(৩)
পারুল ও তিনটি কুকুর:
এই গল্পে অলৌকিক উপাদান নেই, নেই কোন কল্পবিজ্ঞান, এমনকি ফ্যান্টাসিও একে বলা যাচ্ছে না। আবার প্রেম ও ভালোবাসা, এবং হুমায়ূনের নিজস্ব নায়িকা পারুল (সুন্দরী, সাহসী, স্বাধীন, খেয়ালি, কিন্তু দৃঢ়চেতা) থাকলেও এটি প্রেমের উপন্যাস নয়, বরং একে বলা যায় ভয়াল রসের ইচ্ছাপূরণের গল্প।
(৪)
আমি এবং কয়েকটি প্রজাপতি:
বাংলায় বিশুদ্ধ সাইকোলজিকাল থ্রিলার খুঁজতে গিয়ে আমাদের যেখানে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে ২০০৩-এ প্রকাশিত এই উপন্যাসটি নিয়ে কেউ এখনও হুলুস্থুল করেননি: এটাই পরম আশ্চর্যের বিষয়। অতুলনীয় লেখনী এবং কাব্যিক অথচ রুদ্ধশ্বাস ন্যারেটিভ দিয়ে গড়ে ওঠা এই বইটি যেকোন রহস্যমোদীর অবশ্যপাঠ্য।
দুঃখের হলেও একথা স্বীকার্য যে এপার বাংলার এক বড়ো সংখ্যক পাঠক এখনও হুমায়ূন আহমেদের লেখার সঙ্গে তেমন পরিচিত নন, আর পরিচয় যদিও বা ঘটে থাকে তবে তা একান্তই আংশিক (হিমু, মিসির আলি, এবং কিছু প্রেমের বা সামাজিক উপন্যাসের মাধ্যমে)। এই বহুমাত্রিক ও সর্বার্থে অতুলনীয় সাহিত্যিকের কয়েকটি ব্যতিক্রমী রচনার বিবরণ দিলাম মূলত তাঁদের জন্যে, আর অনুরোধ রইল আগামী বইমেলায় বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে গিয়ে ঝটপট এদের ব্যাগস্থ করার, ও পড়ার।
আলোচক পরিচিতি - আলোচক এক উদ্যমী পাঠক, যিনি বিপ্লব, চোখের জল, মানবচরিত্রের অতলস্পর্শী গভীরতা, সিন্ডিকেট, সারদা, ধোনি, ইত্যাদি তাবড় বিষয় থেকে দূরে, স্রেফ বেঁচে থাকার গল্প পড়তে চান। নিজের ভালবাসা থেকেই দীর্ঘদিন বইয়ের রিভিউ করছেন।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।