বইয়ের খবর
জুন ১৫, ২০১৬
"এই সময়ের সবচেয়ে শক্তিমান গদ্যশিল্পীদের মধ্যে যাঁর নাম সসম্ভ্রমে উচ্চারিত হয় সেই সৈকত মুখোপাধ্যায়-এর লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল ‘আনন্দমেলা’ আর ‘কিশোর ভারতী’-র পাতায় পড়া রহস্যের আর মজার গল্প দিয়ে।"
আলোচনা - ঋজু গাঙ্গুলি
- বইয়ের নামঃ রক্তকস্তুরি
- লেখকঃ সৈকত মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশকঃ কথাসত্য
- হার্ডকভার, ১২০ পৃষ্ঠা, প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০১৩
এই সময়ের সবচেয়ে শক্তিমান গদ্যশিল্পীদের মধ্যে যাঁর নাম সসম্ভ্রমে উচ্চারিত হয় সেই সৈকত মুখোপাধ্যায়-এর লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল ‘আনন্দমেলা’ আর ‘কিশোর ভারতী’-র পাতায় পড়া রহস্যের আর মজার গল্প দিয়ে। প্রায় বছর তিনেক আগের ‘দেশ’-এ এক অপেক্ষাকৃত অনামী প্রকাশকের বিজ্ঞাপন থেকে যখন জানতে পারলাম যে সেই লেখকের গল্প-সংকলন প্রকাশিত হতে চলেছে আগামী বইমেলায়, তখন ভেবেছিলাম যে তারিয়ে-তারিয়ে পড়ার মতো এক ঝাঁক সুখপাঠ্য গল্প বইটির মাধ্যমে হাতে আসবে। প্রকাশকের বিপণন ব্যবস্থা এতই ভয়ানক, এবং টেমার লেনে অবস্থিত কাউন্টারের খোলা-বন্ধ এমনই অনিয়মিত, যে বইটা শেষ অবধি হাতে পেতেই প্রায় আড়াই বছর পার হয়ে গেল! শেষ পর্যন্ত, কী পড়ব সেই নিয়ে বিস্তর মাথা ঘামিয়েও সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে প্রায় চোখ বুঁজে বুকশেলফ হাতড়াতে গিয়ে এই বইটা যখন হাতে উঠে এল, তখন আর ভাবাভাবি করতে হয়নি। বই হাতে কাত হলাম। কিন্তু তারপর?
ভূমিকা, প্রথম প্রকাশ-সংক্রান্ত তথ্য, এবং অলংকরণ-বর্জিত এই নিরাভরণ বইটিতে যেসব গল্প আছে তারা হল:
১. রক্তকস্তুরি
২. অবলোকিতেশ
৩. প্লাবনগাথা
৪. লুসিপাসের ললাটলিপি
৫. বারাহী
৬. বামন বিষাদময়ী কথা
৭. বাদল আর জাদুকর সূর্যকুমার
৮. নির্জন উত্সবে
৯. পরিষ্কার আত্মহত্যা
১০. শ্বেতযোষিৎ কল্প
১১. চিরদুয়ার
১২. হাতছানি
১৩. পরি
১৪. স্বর্গবেশ্যার ছেলে
১৫. গুহাচিত্র
১৬. প্রস্তুতিপর্ব
বইয়ের প্রথম গল্প “রক্তকস্তুরি”-তেই সৈকত তথ্যের নির্ভার স্রোত আর শব্দের মোহময়ী গর্জন দিয়ে জানান দেন, তিনি আমাদের তটের নীরব (ও নিরাপদ) শুষ্কতায় রাখবেন না, অবগাহন করাবেনই। আর তারপরেই এই বই বাঁক নিয়ে ঢুকে যায় আমার কমফোর্ট জোনের বাইরে, ক্ষুধা-হিংসা-কামনা-ক্রোধ-দুঃখ আর দেহ-মনের আলো-আঁধারি মিশিয়ে তৈরি এক বিচিত্র জগতের গহনে। কিন্তু আমি পড়া থামাতে পারিনি। এয়ার কন্ডিশনারের আরামপ্রদ শৈত্য, জানলা দিয়ে ভেসে আসা রাস্তা কাঁপানো ট্রাকের গর্জন, মাথার ভেতরে সবসময় দপদপ করে জ্বলতে থাকা অফিসের জটিলতা: এই সব হারিয়ে গেছিল শব্দ-বাক্য-বর্ণনা আর গল্প দিয়ে তৈরি হওয়া এক রঙিন কুয়াশায়। কেমন ছিল সেই কুয়াশা? একটু উদাহরণ দিই:
“স্নানঘরের জানলা দিয়ে বাসবী দেখে সরকার কুঠি’র দোতলার বারান্দায় উঠে এসেছে চামেলির লতা। তখন সন্ধ্যাবেলা। সারাদিন অঝোরে ঝরার পরে তখন বৃষ্টি থেমে জোলো বাতাস বইতে শুরু করেছে। স্তিমিত আলোর এই মফঃস্বল কী করে যেন বড় নির্জন হয়ে গেছে। বাসবীর শীত শীত করে। সে জানলা দিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ওই বারান্দার দিকে। সাদা ফুলের স্তূপ ক্রমশ এক রক্তশূন্য যুবকের অবয়ব ধারণ করে। মৃত্যুর পরে সেই যুবকের চোখে দৃষ্টি ফিরে এসেছে। কী তীব্র, কী কালো, আঃ কী কামুক সেই দৃষ্টি। উষ্ণ তরঙ্গ বয়ে আসে সেই দৃষ্টিপথে। সমস্ত শরীরে সেই ওম নেবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে ওঠে বাসবী।” (অবলোকিতেশ)
ভীষণ ইচ্ছে করছে এই বই থেকে এমনই আরও মণিমুক্তো ছড়িয়ে দিই আমার এই লেখাটায়। দারিদ্র্যের চাবুকে শতছিন্ন আমার এই লেখায় অতুল ঐশ্বর্য ঢেলে দিই গল্পগুলো থেকে চুরি করা যৌবন দিয়ে, তাই:
“মাঝনদীতে তারার আলো ছাড়া আলো নেই, ঢেউয়ের শব্দ ছাড়া শব্দ নেই। সেই স্বল্প আলোতেও ফেলারাম ঠিক দেখতে পেল ভেঙে পড়া পাহাড়চুড়োর মতো ভেসে যাওয়া আকৃতিটাকে। দ্রুত জল কেটে এগিয়ে ফেলারাম ঠাকুরের কাঠামোটা ধরে ফেলল। তারপর শরীরটাকে দু’হাতের চাড়ে তুলে নিল কাঠামোর ওপরে। প্রতিমার মুখের পাশে মুখ রেখে শুয়ে পড়ল নিশ্চিন্তে।
এখন যেন সৃজনদিনের সন্ধ্যা, যখন রয়েছে শুধু আদিগন্ত জল আর একখানা ভেলা। রয়েছে শুধু বিশাল এক জননীমূর্তি আর তার গর্ভ থেকে নিষ্ক্রান্ত এক শিশু। সমুদয় লতাপাতা, বৃক্ষ, প্রাণী, পক্ষী, পতঙ্গ, আদম ও হবার জন্ম এখনও অনেক দূরের ঘটনা। যাবতীয় নীহারিকা এখনও নীলাভ কুয়াশার মতো আকাশে চক্কর কাটছে, ছিটকে পড়ছে দু-একটা সদ্যোজাত তারা। বহুদূরে, কোথাও যেন পৃথিবীর জ্বলন্ত গহ্বরে প্রপাতের মতো প্রবিষ্ট হচ্ছে সমুদ্রের জল, বাষ্প ফাটিয়ে দিচ্ছে পাথরের চাঙর, ধুলো হয়ে উড়ে যাচ্ছে কঠিন ভূত্বক...।
নাকি ও শুধু উল্কাপাতের মতো তুচ্ছ ঘটনা? না কি ও কেবল দূরাগত ঢাকের আওয়াজ?” (স্বর্গবেশ্যার ছেলে)
নাঃ, আর লিখব না, কারণ তাহলে ইচ্ছে করবে সব-সঅঅব গল্প থেকে এমন লাইন তুলে দিতে, কারণ এই বইয়ের প্রত্যেকটা গল্প জুড়ে আছে ভালোবাসার এক অমোঘ আকর্ষণ। জীবনকে ভালোবাসা, শরীরকে ভালোবাসা, নিজের মতো করে নিজের প্রাণের ঠাকুরকে ঘিরে ভালোবাসা, অজস্র না-পাওয়ার জ্বালার মধ্যেও একটু ভালো থাকার জন্যে কালকের দিনটাকে ভালোবাসা...।
আপনি আরও লিখুন, হে লেখক। কারণ আপনার এই গল্প-সংকলন পড়ে আমার শেষ অবধি যে অনুভূতিটা হচ্ছে, তা “চতুরঙ্গ”-র শেষ লাইনে দামিনীর মুখ দিয়ে স্বয়ং রবি ঠাকুর বলে গেছেন, তাই আমি আর কথা বাড়ালাম না।
আলোচক পরিচিতি - আলোচক এক উদ্যমী পাঠক, যিনি বিপ্লব, চোখের জল, মানবচরিত্রের অতলস্পর্শী গভীরতা, সিন্ডিকেট, সারদা, ধোনি, ইত্যাদি তাবড় বিষয় থেকে দূরে, স্রেফ বেঁচে থাকার গল্প পড়তে চান। নিজের ভালবাসা থেকেই দীর্ঘদিন বইয়ের রিভিউ করছেন।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।