অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


পাঠ-প্রতিক্রিয়া

মে ৩০, ২০১৭

 

On the trail of a woman – শেখর মুখোপাধ্যায়

ভাস্কর বসু

শেখর মুখোপাধ্যায় লব্ধপ্রতিষ্ঠ সাহিত্যিক। কিছুদিন আগেই ওঁর গোয়েন্দা কাহিনী "গজপতি নিবাস রহস্য" সম্প্রতি ধারাবাহিক ভাবে "দেশ" পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছে, সম্প্রতি বইটির আলোচনাও হয়েছে ‘বইয়ের দেশ’ পত্রিকাতে।

ওঁর আগের একটি কাহিনী "অন্য কোনোখানে" দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক রূপে প্রকাশিত। এছাড়া অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে বৈবস্বত, জিয়ন নদী, অনিকেত ইত্যাদি। শেষ শারদ সংখ্যাতে প্রকাশিত উপন্যাস - জন হাওয়ার্ড পেনের ডায়েরি। সেটিও আমার বেশ ভালো লেগেছিল, যদিও "অন্য কোনোখানে" আমার অনেক বেশী পছন্দের।

• Paperback: 398 pages
• Published (April 13, 2017)
• Language: English
• ISBN-10: 1521048274
• ISBN-13: 978-1521048276
• Available at Amazon.com

এবার লেখক হাত দিয়েছেন তাঁর প্রথম ইংরেজি উপন্যাসে, “On the trail of a woman” । এই কাহিনীর নায়ক অনাগত। অবিবাহিত মানুষটির নিঃসঙ্গ, অনাড়ম্বর জীবনে হঠাৎ একদিন এক পুরনো বন্ধুর আগমন ঘটে। তাইতে খুব দ্রুত পালটে যায় অনাগতর জীবন। শুরু হয় এক বিচিত্র অন্বেষণ। অনাগতর জীবনে এমন এক নারী ছিল যে অনন্যা। প্রায় কুড়ি বছর আগের ঘটনা আলোড়ন তোলে তার জীবনে।

কাহিনীর শুরু একটি স্বপ্নদৃশ্যে। এখানে একটু অসুবিধে হয়েছে, অনাগতকে না চেনার জন্য। দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে একেবারে সুন্দর বহমান।

শেখরের অন্যান্য গ্রন্থগুলির মতই এও একেবারে নতুন ধরনের কাহিনী। ভালই করেছেন লেখক ইংরেজিতে লিখে। আমার মনে হয় নব্য পাঠকদের কাছেও সমাদৃত হবে। দীর্ঘদিন প্রবাসে থেকে আমার মনে হয় প্রবাসী ছেলেমেয়েদের বাংলার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে এ ধরনের উপন্যাস বড় প্রয়োজন। এছাড়াও সর্বভারতীয় পাঠকের কাছে বাংলা সাহিত্যিকদের পরিচিতি বাড়াতে এই প্রয়াসের প্রয়োজন বলে মনে করি।

বেশ কিছু বাঙালী সাহিত্যিক ইংরেজিতে লিখেছেন। তবে একমাত্র গত শারদীয়াতে কুণাল বসুর বাংলা উপন্যাস (রবি-শংকর) ছাড়া তাঁদের আর কেউ বাংলাতে উপন্যাস লিখেছেন বলে মনে পড়ছে না। আবার কোন প্রখ্যাত বাঙালী সাহিত্যিক একেবারে ইংরেজিতেই একেবারে মৌলিক উপন্যাস লিখছেন তাও মনে পড়ে না।

লেখার যা শৈলী ও বিষয় তা আমার ব্যক্তিগত ভাবে খুবই পছন্দের। মূল চরিত্র দুটি। তার আশেপাশের চরিত্রগুলি এসে তাদের অবয়বটিকে আরো পরিস্ফুট করেছে। মূল চরিত্র তো বটেই, প্রত্যেকটি পার্শ্ব-চরিত্রের গঠনে লেখকের যত্নের মাত্রা অনুধাবন করা যায়। কাহিনীর গতিও বেশ মন্দমধুর, ফলে আমার মত ধীর-স্থির পাঠকের কাছে পাঠ খুব সুখকর হয়েছে।

অনাগতর এই অন্বেষণ আমাকে বারে বারে মনে করিয়েছে রবিঠাকুরের একটি বিশেষ গানের কথা।

"স্বপনচারিনী' কে যেভাবে খুঁজেছে অনাগত, বারে বারে আমার কানে এসে বেজে গেছে - "দিন চলে গেছে খুঁজিতে খুঁজিতে"!! প্রায় নিজের জীবনকে বাজি রেখে সে খুঁজছে এমন কারুকে যাকে খুঁজে পেলে সে নিজেকেই খুঁজে পাবে - কাহিনীর প্রতি ছত্রেই এই ইঙ্গিত রেখেছেন লেখক। আর একেবারে শেষের দিকে, বামাপদর বাড়িতে যখন অনাগত ভাবছে কি করবে –

"এ নিরন্তর সংশয় হায় পারি নে যুঝিতে / আমি তোমারেই শুধু পেরেছি বুঝিতে"!!

লেখকের ভাবনা কি ছিল জানিনা, পাঠক হিসেবে আমি তো ভীষণভাবে অনুভব করেছি গানটিকে অনাগতর অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে।

লেখক শেখর মুখোপাধ্যায়ের "গজপতি নিবাস রহস্য" আলোচনাতে সিজার বাগচি লিখেছেন চরিত্র নির্মাণে তাঁর যত্নের কথা। “অন্য কোনোখানে” তেও সেই পরিচয় পেয়েছি, এই কাহিনীতেও তা লক্ষণীয়।

পার্শ্বচরিত্রগুলির সব কজনই মনোগ্রাহী। তবু বিশেষ করে বলবো বামাপদর কথা - এরকম এক নিঃসঙ্গ, নির্বান্ধব মানুষের অনাড়ম্বর, সরল অথচ পরোপকারী জীবনযাত্রা যেভাবে অনাগতকে প্রভাবিত করেছে তাও ভারী সুন্দর। বিশেষত তাঁর অনাগতকে ‘ভীমসেন’ বলে ডাকটি ভারী সুমধুর। তাঁর বাড়ি থেকে যখন বিদায় নেয় অনাগত, বাসের মাথা থেকে হাত নাড়ছে, তিনি তাঁর প্রিয় ভীমসেনকে অনুরোধ করেন, “সাবধানে যেও, শরীরের যত্ন নিও, চিঠিপত্তর দিও মাঝে মধ্যে, আমার তো আবার ফোনও নেই।” লেখার গুনে এই মুহূর্তটি যেন আমাদের চোখে খুব জীবন্ত হয়ে যায়, স্পষ্ট দেখতে পাই বামাপদ ও তাঁর প্রিয় ভীমসেন, দুজনেরই ‘চক্ষু লবণাক্ত’।

এছাড়া অনাগতর বন্ধু, বন্ধু স্ত্রী, দাদা সদৃশ অভিভাবক, প্রমার বান্ধবী মিতা, ডাক্তার সান্যাল– এই কজন মানুষ কিভাবে ছাপ ফেলেছে অনাগতর অপেক্ষাকৃত নিঃসঙ্গ জীবনে এবং তার অন্বেষনে, তাও সুচিত্রিত। পড়তে পড়তে পাঠক বেশ কিছু চরিত্রের মধ্যে নিজেকে বা নিজের পরিচিত কোন চরিত্রকে মিলিয়ে নিতে পারবেন, এমন আশা করাই যেতে পারে।

তবে নারী সন্ত্রাসবাদীদের হাতে পড়ে সর্বস্ব খোয়ানো - ঐ জায়গাটিকে তুলনামূলক ভাবে দুর্বল লেগেছে। যেভাবে খুব স্বাভাবিক গতিতে অনুসন্ধান এগোচ্ছিল সেখানে অনাগতর ঐ মুহূর্তে অতটা তাড়াহুড়ো এবং দুর্ঘটনা - একটু আরোপিত বলে মনে হয়েছে। এটা ঠিক অনাগতর ‘মুক্ত মানুষ’ হওয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এখানে কিছুটা মুনশিয়ানার অভাব লেগেছে। এই জায়গাতে কেন যেন মনে হয় লেখক আর একটু ধৈর্যশীল হলে পুরো কাহিনীর সঙ্গে খুব মানানসই হত।

তবে কাহিনীর সেরা ঘটনা ও কথোপকথন বলতে গেলে নিঃসন্দেহে ডাক্তার সান্যালের বাড়ীতে 'প্রমা'র দুই প্রাক্তন প্রেমিকের কথাবার্তার দৃশ্যকেই মনে রাখতে হবে। দুই প্রেমিক সম্পূর্ণ ভাবে দুজন ভিন্ন মানুষ, আর প্রমা তো অন্যরকমই। তাদের কথোপকথনেই 'প্রমা' সবচেয়ে বেশী উন্মোচিত। তার দুর্জ্ঞেয় রহস্য জানতে দুটি মানুষ এরকমভাবে নিজেদের অজান্তেই কাছে এসে পড়ল - এটা কাহিনীর সব থেকে বড় সন্ধিক্ষণ বলে মনে হয়েছে আমার। বেশী লিখলে পাঠকের কাছে কাহিনী উন্মোচিত হওয়ার সম্ভাবনা, তাই থামছি।

সংলাপ একটু দুর্বল মনে হয়েছে কয়েক জায়গাতে, বিশেষ করে প্রথম দিকে। ভাবনা বাংলাতে এবং তা যে অনুদিত হয়েছে সেটি কতকগুলি বাক্যতে বিশেষত কথোপকথন এ খুব পরিষ্কার। জটিল ইংরেজি দেখেই সহজ বাংলাটি অনুমান করা খুব সহজ। তবে কাহিনী যতই এগিয়েছে, লেখকের আত্মপ্রত্যয় বেড়েছে এবং ধীরে ধীরে তাঁর ভাষা ও সংলাপ দুইই খুব সাবলীল এবং প্রাণবন্ত হয়েছে।

অনেক সময় বাঙালী লেখকরা দুঃখ করেন যে তাঁদের লেখা ঠিকমত ইংরেজিতে অনুবাদ না হওয়ার জন্য তাঁদের পাঠক পরিচিতি বাংলার বাইরে হচ্ছে না। তুলনাতে অপেক্ষাকৃত নিরেস লেখাও শুধু ইংরেজি ভাষাতে লেখা বলে প্রচুর কাটতি। শেখর মুখোপাধ্যায়ের এই উপন্যাস কিন্তু সে অর্থে এক পরীক্ষামূলক ঘটনা।

বাংলা সাহিত্যের এক অনুরাগী পাঠক হিসেবে আশা করব, অন্যান্য লেখকরাও মাঝে মধ্যে এই পরীক্ষাতে সামিল হবেন। সর্বক্ষেত্রে সাফল্য নাই বা এল, তবু পরীক্ষাতে সামিল হওয়ার একটা আলাদা আনন্দ তো থেকেই যায়। তাই বা কম কি?


লেখক পরিচিতি :জন্ম কলকাতায়, বেড়ে ওঠা দক্ষিণ চব্বিশ-পরগনার রাজপুর-সোনারপুর অঞ্চলে। ১৯৮৩ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেক্ট্রনিক্স ও টেলিকম্যুনিকেশন ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে কর্মসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে। শখের মধ্যে অল্প-বিস্তর বাংলাতে লেখা - অল্প কিছু লেখা রবিবাসরীয় আনন্দবাজার, উনিশ-কুড়ি, নির্ণয়, দেশ, ইত্যাদি পত্রিকায় এবং বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিন (সৃষ্টি, অবসর, ইত্যাদিতে) প্রকাশিত। ।                 

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.