যাযাবরের দৃষ্টিপাত
সূর্য ভট্টাচার্য
যদি বলা হয়, মাত্র তিনটি উপন্যাস, আটটি স্যাটায়ারধর্মী প্রবন্ধ ও তেরোটি ছোটবড় গল্প লিখে সাহিত্যের অমরাবতীতে অধিষ্ঠিত হওয়া যায়, তাহলে কথাটা বিশ্বাসযোগ্য না লাগতেই পারে। মনে হতেই পারে, এই অকিঞ্চিৎকর পরিমাণ রচনা কতদিনই বা পাঠকের মনে রাখবে? কিন্তু এটা সত্যি, এক সাহিত্যিক সত্যিই ঐ পরিমাণ সাহিত্য রচনা করেই বাঙালী সুধীসমাজে নিজেকে কায়েম করে নিয়েছেন। বিস্ময়ের পর বিস্ময় এই যে, ঐ লেখক প্রথম উপন্যাসটির পরে আর কিছু না লিখলেও রসজ্ঞ পাঠকের পক্ষে তাঁকে ভুলে যাওয়া দুষ্কর ছিল।
বিরলপ্রতিভা এই লেখকের নাম বিনয় মুখোপাধ্যায়। নামটি অপরিচিত লাগা স্বাভাবিক, কেননা সাহিত্যরচনা তিনি করেছেন ছদ্মনামে। চল্লিশোর্ধ যে কোনও সাহিত্যরসিক বাঙ্গালীর কাছে সেই ছদ্মনামটি অবশ্য অপরিচিত থাকতে পারে না। আজ্ঞে হ্যাঁ, যাযাবরের 'দৃষ্টিপাত' বাংলা গদ্যরচনায় আজ একটি মাইলফলক স্বরূপ! যাযাবরের অপর দুই উপন্যাস, 'জনান্তিকে' ও 'ঝিলম নদীর তীর' যথেষ্ট উচ্চাঙ্গের সৃষ্টি। যদি দৃষ্টিপাতের আগে রচিত হত তাহলে কি হোতো বলা যায় না। কিন্তু দৃষ্টিপাত পড়ে ফেলার পরে এই দুটি উপন্যাসকে এক সুউচ্চ প্রত্যাশার বিরুদ্ধে অসম লড়াইয়ে হার মানতে হয়েছে। যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক যাযাবরের ছোটগল্পগুলোও। শুধু শক্তিশালী ভাষাই নয়, বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য গল্পগুলির থেকে বড় পাওনা। কোথাও সেই নর-নারীর আবহমান প্রেম-পরকীয়ার চর্বিতচর্বণ নেই।
কিন্তু দৃষ্টিপাত-এর অবস্থান এক অন্য উচ্চতায়। গত শতাব্দীর চল্লিশ দশকের গোড়ায় ভারতের স্বাধীনতা-সংক্রান্ত চুক্তির শর্তালোচনা করতে ব্রিটিশ প্রতিনিধি স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রীপ্স ভারতে আসেন। তাঁর ভারত সফর কভার করতে এক বিদেশী সংবাদপত্রের দেশীয় সাংবাদিক হয়ে লেখক দিল্লি যান। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি দিল্লিকে দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে রচিত হয়েছে দৃষ্টিপাত। সাংবাদিকের চোখ বিষয়বস্তুর যোগান দিয়েছে, গভীর রসবোধ ও অনায়াস ভাষায় কাগজে আঁচড় কেটেছে সুসাহিত্যিকের কলম। ফলাফল যা হয়েছে তাতে নালিশ করার আর কিছু নেই। ইতিহাস আছে, ভূগোল আছে, উইট-হিউমার আছে, ব্যঙ্গ-বিষাদ আছে, ব্যক্তি আছে দেশ আছে— আর যে কি কি আছে বলে বোঝানো যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে পাঠকের জন্য আছে এক অত্যুৎকৃষ্ট সাহিত্যব্যঞ্জন।
'বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ'-- এই উদ্ধৃতি কালের সীমা পেরিয়ে আজও আমাদের মনের মণিকোঠায় অনুরণন তোলে, 'তাতে আছে গতির আনন্দ, নেই যতির আয়েশ'। রূপক ও অনুপ্রাস ভাষাকে কতোখানি আনন্দময় করে তোলে, তার অপর্যাপ্ত দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে আছে এই উপন্যাসের ছত্রে ছত্রে। যাযাবরের সালংকৃত চলিত ভাষার কোনও সমান্তরাল আমি দেখিনি, না আগে না এর পরে। 'দৃষ্টিপাত' থেকে কিছু নমুনা পেশ করার লোভ সামলানো গেল না।--
এইরকম অজস্র মণিমুক্তো। তথ্য ও প্যাথোস মিলেমিশে তৈরি করে এক অনন্য পাঠানুভুতি। কিন্তু পুরো আখ্যানের প্রেক্ষাপট জুড়ে আছে এক অননুকরণীয় রসের ধারা।--
আছে তৎকালীন আই.সি.এস-দের নিয়ে সেই ক্লাসিক স্যাটায়ার।--
এবং রয়েছে কথিকার অন্তিমে সেই অমোঘ তিনটি অনুচ্ছেদ--
কলম তো নয়, যেন এস্রাজের ছড়। নবীন পাঠকের কাছে একটু প্রাচীনগন্ধী লাগতে পারে, কিন্তু বলুন তো, চলিত বাংলা ভাষায় শেষ কোথায় শুনেছেন এই দেশরাগের মূর্ছনা? মনে রাখা যেতে পারে, অবশ্য না রাখলেও বিশেষ ক্ষতিবৃদ্ধি নেই, এই ভাষা রচিত হয়েছে আজ থেকে সাত দশকেরও বেশী আগে! উপন্যাস শেষ হলে আধারকারের ভাগ্যহীনতায় সত্যিই দু'দণ্ড স্তব্ধ হতে হয়।
দৃষ্টিপাত অবশ্য শুধুমাত্র আধারকার-সুনন্দার প্রেমকাহিনী নয়। এইরকম অনেক ছোট ছোট খন্ডকাহিনী আছে এতে। সেসব কাহিনী কোথাও অতিক্রম করেছে দিল্লির ভৌগলিক সীমা, কোথাও বা তার কাল। আমরা পেয়েছি নানাবর্ণের ফুলে গাঁথা এক অনবদ্য কথামালা। আগাগোড়া সরস আঙ্গিকে। ভাবতে অবাক লাগে, কতোখানি কলমের জোর থাকলে এতো সরস মোড়কে বিষাদকেও রসোত্তীর্ণ করে পেশ করা যায়।
কিন্তু বাস্তব সত্যি হল, এই ভাষা অনেকের পছন্দ নয়। অনেক প্রাজ্ঞ বোদ্ধাকেও বলতে শুনেছি, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যাযাবরের ভাষার অতিঅলংকরণ ও কথায় কথায় বেকনীয় এপিগ্রামের ঝোঁক একটু ব্যাকডেটেড লাগে। অতীতে প্রবল জনপ্রিয়তা এবং তৎকালীন সমালোচকদের প্রশংসা, দুই-ই পেয়েও বহু লেখক আজ অজ্ঞাত এবং অপঠিত। এঁদের মতে, যাযাবরের ভাষাবয়নের, গ্রন্থনের আবেদন যুগাতিশায়ী নয়। ভাষার বাঁকবদলের সংগে সংগে এই তথাকথিত 'হিট' স্টাইলও অশ্বখুরহ্রদের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। মনকে স্তোক দিই, অমৃতেও অরুচি থাকে লোকের। দৃষ্টিপাতের সঠিক মূল্যায়ন তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা বোধহয় আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ইচ্ছাও নেই। আমার এই লেখা তাঁরা অনায়াসে উপেক্ষা করুন। আমার অমৃত সেবনসুখ তাতে ব্যাহত হবে না।
দৃষ্টিপাত আমি কতবার পড়েছি তার আর সংখ্যা মনে নেই। যতবারই পড়ি, হরিদ্বারের ঘাটে অবগাহন গঙ্গাস্নান করে ওঠার অনুভূতি হয়। দিন দশেকও হয়নি, দৃষ্টিপাত আবার পড়ে শেষ করেছি। এখনো ঘোর কাটেনি। এমতাবস্থায়, নাঃ সত্যিই দৃষ্টিপাতে আমি কোনও কলুষ দেখতে পাচ্ছি না। ত্রুটি কিছু থাকলে তার বিচার আমার চেয়ে যোগ্যতর রিভিউয়ারের জন্য তোলা রইল। দৃষ্টিপাতের নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করা বোধহয় তাই আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সম্ভব যখন নয়, তখন পাততাড়ি গুটোনোই বিধেয়।
প্রবীণ রসজ্ঞের কাছে যাযাবরের সাহিত্যের পর্যালোচনার নামে যে ধৃষ্টতা দেখিয়েছি তার জন্য মার্জনা ভিক্ষায় আপত্তি নেই। বলবেন তাহলে এসব লিখতে যাওয়াই কেন?
কি করি বলুন, অমৃত কি একা খাওয়া যায়?
লেখক পরিচিতি : অধীত বিদ্যা বিদ্যুৎ-প্রযুক্তি, পেশা সরকারি চাকরি। বাংলার বাইরে বিশ বছরের প্রবাসজীবন। যাদবপুরের স্নাতক, খড়গপুরে স্নাতকোত্তরণ। আবার গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো একটা এম-বি-এ ডিগ্রীও আছে। ছোটবেলা থেকে গল্প পড়তে ভাললাগা। বই পড়া ছাড়া প্রিয় অবসর (কোথায়?) বিনোদন ইতিহাস আর অঙ্কে। লেখালিখিটা সম্পূর্ণ শখের, মনের কথা সাদামাটা ভাবে বলার একটা তাগিদ থেকেই এই মতিভ্রম। ছন্দ মেলাতে অক্ষম। মনেপ্রাণে সাবেকী। গদ্যেও প্রাচীনপন্থী, বিমূর্ত আধুনিকতা পছন্দ নয়, আসেও না।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.