অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


পুরনো বইয়ের আলোচনা

মে ১৫, ২০১৭

 

যাযাবরের দৃষ্টিপাত

সূর্য ভট্টাচার্য

যদি বলা হয়, মাত্র তিনটি উপন্যাস, আটটি স্যাটায়ারধর্মী প্রবন্ধ ও তেরোটি ছোটবড় গল্প লিখে সাহিত্যের অমরাবতীতে অধিষ্ঠিত হওয়া যায়, তাহলে কথাটা বিশ্বাসযোগ্য না লাগতেই পারে। মনে হতেই পারে, এই অকিঞ্চিৎকর পরিমাণ রচনা কতদিনই বা পাঠকের মনে রাখবে? কিন্তু এটা সত্যি, এক সাহিত্যিক সত্যিই ঐ পরিমাণ সাহিত্য রচনা করেই বাঙালী সুধীসমাজে নিজেকে কায়েম করে নিয়েছেন। বিস্ময়ের পর বিস্ময় এই যে, ঐ লেখক প্রথম উপন্যাসটির পরে আর কিছু না লিখলেও রসজ্ঞ পাঠকের পক্ষে তাঁকে ভুলে যাওয়া দুষ্কর ছিল।

বিরলপ্রতিভা এই লেখকের নাম বিনয় মুখোপাধ্যায়। নামটি অপরিচিত লাগা স্বাভাবিক, কেননা সাহিত্যরচনা তিনি করেছেন ছদ্মনামে। চল্লিশোর্ধ যে কোনও সাহিত্যরসিক বাঙ্গালীর কাছে সেই ছদ্মনামটি অবশ্য অপরিচিত থাকতে পারে না। আজ্ঞে হ্যাঁ, যাযাবরের 'দৃষ্টিপাত' বাংলা গদ্যরচনায় আজ একটি মাইলফলক স্বরূপ! যাযাবরের অপর দুই উপন্যাস, 'জনান্তিকে' ও 'ঝিলম নদীর তীর' যথেষ্ট উচ্চাঙ্গের সৃষ্টি। যদি দৃষ্টিপাতের আগে রচিত হত তাহলে কি হোতো বলা যায় না। কিন্তু দৃষ্টিপাত পড়ে ফেলার পরে এই দুটি উপন্যাসকে এক সুউচ্চ প্রত্যাশার বিরুদ্ধে অসম লড়াইয়ে হার মানতে হয়েছে। যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক যাযাবরের ছোটগল্পগুলোও। শুধু শক্তিশালী ভাষাই নয়, বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য গল্পগুলির থেকে বড় পাওনা। কোথাও সেই নর-নারীর আবহমান প্রেম-পরকীয়ার চর্বিতচর্বণ নেই।

কিন্তু দৃষ্টিপাত-এর অবস্থান এক অন্য উচ্চতায়। গত শতাব্দীর চল্লিশ দশকের গোড়ায় ভারতের স্বাধীনতা-সংক্রান্ত চুক্তির শর্তালোচনা করতে ব্রিটিশ প্রতিনিধি স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রীপ্স ভারতে আসেন। তাঁর ভারত সফর কভার করতে এক বিদেশী সংবাদপত্রের দেশীয় সাংবাদিক হয়ে লেখক দিল্লি যান। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি দিল্লিকে দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে রচিত হয়েছে দৃষ্টিপাত। সাংবাদিকের চোখ বিষয়বস্তুর যোগান দিয়েছে, গভীর রসবোধ ও অনায়াস ভাষায় কাগজে আঁচড় কেটেছে সুসাহিত্যিকের কলম। ফলাফল যা হয়েছে তাতে নালিশ করার আর কিছু নেই। ইতিহাস আছে, ভূগোল আছে, উইট-হিউমার আছে, ব্যঙ্গ-বিষাদ আছে, ব্যক্তি আছে দেশ আছে— আর যে কি কি আছে বলে বোঝানো যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে পাঠকের জন্য আছে এক অত্যুৎকৃষ্ট সাহিত্যব্যঞ্জন।

'বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ'-- এই উদ্ধৃতি কালের সীমা পেরিয়ে আজও আমাদের মনের মণিকোঠায় অনুরণন তোলে, 'তাতে আছে গতির আনন্দ, নেই যতির আয়েশ'। রূপক ও অনুপ্রাস ভাষাকে কতোখানি আনন্দময় করে তোলে, তার অপর্যাপ্ত দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে আছে এই উপন্যাসের ছত্রে ছত্রে। যাযাবরের সালংকৃত চলিত ভাষার কোনও সমান্তরাল আমি দেখিনি, না আগে না এর পরে। 'দৃষ্টিপাত' থেকে কিছু নমুনা পেশ করার লোভ সামলানো গেল না।--

'একই বস্তু কেমন করে শুধু মাত্র আবেষ্টন ভাষা ও পরিবেশের তফাতে শ্লীল ও অশ্লীল ঠেকে তার আরও সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত আছে সিনেমায়। শ্বশুর, ভাশুর, পুত্রবধূ ও কন্যা-জামাতা একসঙ্গে মেট্রোতে বসে গ্রেটা গার্বো ও চার্লস বোয়ারের দীর্ঘস্থায়ী চুম্বন আর আলিঙ্গন দেখতে যাঁরা কিছু মাত্র সঙ্কুচিত হন না, বাংলা ছবির নায়ক-নায়িকার নিরামিষ প্রণয় নিবেদন দৃশ্য তাঁদেরই অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে দেখেছি। শরীরতত্ত্বের আলোচনায় যে কথা বাংলায় বলতে বাধে, ইংরেজিতে তা নিয়ে গুরুজনের সঙ্গে তর্ক করা অনায়াসে।'

'মেয়েদের চুল ও ছেলেদের দাড়ি দু-এরই সমান প্রসাধন প্রয়োজন, সমান সময়সাপেক্ষ। তফাৎ শুধু এই যে, প্রথমটির যত্ন বৃদ্ধিতে, দ্বিতীয়টির বিনাশে। চুল রোজ বাঁধতে হয়, দাড়ি রোজ কামাতে।'

'গিয়াসুদ্দিনের রাজধানী তোগলকাবাদ আজ বিরাট ধ্বংসস্তূপে পরিণত।... নিজামুদ্দিনের দরগায় আজও মেলা বসে প্রতি বছর।... সেদিনের রাজধানী তার অভ্রভেদী অহংকার নিয়ে বহুদিন আগে মিশেছে ধূলায়; দীন সন্ন্যাসীর মহিমা পুরুষানুক্রমে ভক্তজনের সশ্রদ্ধ অন্তরের মধ্য দিয়ে রয়েছে অম্লান।'

'হিন্দুরা তপস্বী, তারা দিয়েছে বেদ ও উপনিষদ। মুসলমানেরা শিল্পী, তারা দিয়েছে তাজ ও রংমহল। হিন্দুরা সাধক, তারা দিয়েছে দর্শন। মুসলমানেরা গুণী, তারা দিয়েছে সঙ্গীত। হিন্দুর গর্ব মেধার, মুসলমানের গৌরব হৃদয়ের। এই দুই নিয়েই ভারতবর্ষের অতীত; এই দুই নিয়েই হবে তার ভবিষ্যৎ।' 

'নব শ্যাম দূর্বাদল ছেয়ে আছে ক্ষুদ্র নিরলঙ্কার (জাহানারার) সমাধি। নির্মল আকাশ থেকে প্রত্যহ নিশীথে সঞ্চিত হয় বিন্দু বিন্দু শিশির, প্রভাতে স্পর্শ করে তরুণ অরুণের প্রথম কিরণ রেখা, সন্ধ্যায় ছড়িয়ে পড়ে গোধূলি আলোকের সোনালী আভা। তারা কি পায় শতাধিক বর্ষ পূর্বে সমাধিস্থ সেই অঙ্গের ললিত সুবাস? পায় তাঁর সুকুমার বক্ষের নীচে ভক্তিনত হৃদয়ের মৃদু স্পন্দন ধ্বনি?'

এইরকম অজস্র মণিমুক্তো। তথ্য ও প্যাথোস মিলেমিশে তৈরি করে এক অনন্য পাঠানুভুতি। কিন্তু পুরো আখ্যানের প্রেক্ষাপট জুড়ে আছে এক অননুকরণীয় রসের ধারা।--

'সাধ্বী স্ত্রী, পিতৃভক্ত পুত্র, ভ্রাতৃবৎসল অনুজ এবং প্রভুপ্রাণ সেবকের দৃষ্টান্ত আছে আমাদের পুরাণ ইতিহাসে একাধিক। ... কিন্তু পত্নী-অনুগত স্বামীর উদাহরণ জানতে চাও তো সর্বাগ্রে দেখে আসা প্রয়োজন ন'মাসীমার বান্ধবী ইন্দুমতী রায়ের বর প্রিয়নাথবাবুকে। ইন্দুমতীচরণ-চারণ শ্রী প্রিয়নাথ রায়। ... ইন্দুমতীর বাবার সিন্দুকে রূপা ছিল প্রচুর, কিন্তু নিজের দেহে রূপ ছিল না একটুকুও। ফলে কয়েক বছর আই.সি.এস, বিলাত ফেরত, ডেপুটি প্রভৃতির জন্য অযথা অপেক্ষার পর অবশেষে যৌবনের প্রান্ত সীমায় পৌঁছে এক শুভ মাঘে মাসি শুক্লপক্ষে পঞ্চম্যাং তিথৌ কণ্ঠলগ্না হলেন প্রিয়নাথবাবুর। বিয়ের পর কনের বদল হল পদবী, বরের বৃদ্ধি পেল পদ। ...'

'প্রাচীনারা হাতে ধরতেন সম্মার্জনী। ঘরে মেঝে থেকে অবাধ্য স্বামীর পৃষ্ঠ পর্যন্ত সর্বত্র তার অপক্ষপাত ব্যবহারের দ্বারা সংসারযাত্রাকে তাঁরা নিরঙ্কুশ রাখতেন। আধুনিকাদের হস্তে শোভে ভ্যানিটি ব্যাগ। তার গর্ভে নিহিত প্রসাধন সামগ্রী নিজের স্বামীর হৃদয়ে ত্রাস এবং পরের স্বামীর হৃদয়ে চাঞ্চল্যের সঞ্চার করে। অতি আধুনিকারা যদি ধরেন ফরসেপস তবে বেচারী পুরুষ জাতিকে আত্মরক্ষা সমিতি স্থাপন করতে হবে অচিরে।'

'সকালবেলায় ঘুম ভাঙলো একটি মেয়ের চেঁচানিতে। ... অবশ্য আমি বলি চেঁচানি। মেয়ের মা বলেন গান। মেয়েটি গান শিখছে।

'পৃথিবীতে সঙ্গীত কে কখন সৃষ্টি করেছেন জানিনে। কিন্তু এতকাল এইটুকু বিশ্বাস ছিল, যিনিই করুন, তাঁর মনে কোনো নিষ্ঠুর অভিপ্রায় ছিল না। কিন্তু সে ধারণা বজায় রাখা ক্রমেই শক্ত হয়ে উঠছে।
'মেয়েটির গলায় সুরের লেশমাত্র নাই, অথচ জোর আছে অসুরের।' ইত্যাদি।

আছে তৎকালীন আই.সি.এস-দের নিয়ে সেই ক্লাসিক স্যাটায়ার।--

'শাস্ত্রকারেরা বলেছেন, রাজদর্শনে পুণ্যলাভ। অমাত্যদর্শনে পুণ্য আছে কিনা জানিনে। বোধ হয় আছে। নইলে এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলরদের বাড়িতে প্রত্যহ ভিড় জমে কেন। ভিড় জনতার নয়, আই.সি.এস-এর।...

'ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অপূর্ব সৃষ্টি।... অসাধারণ মোহ আছে ইংরেজি বর্ণমালার তিনটি অক্ষরে। নামের পিছনে তাদের অবস্থিতি দ্বারা... ভারতীয় হলে বোঝাবে,-- উচ্চ বংশ, কলেজে ভালো ফল, পুলিশের সন্দেহাতীত, স্বদেশীর স্পর্শলেশশূন্য নিষ্কলঙ্ক ছাত্রজীবন, বিলাতের প্রতি ভক্তি এবং চাকরিতে বিচার বিভাগের বদলে এক্সিকিউটিভ বিভাগে কায়েমির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা। এদের জন্যই বারোয়ারি পূজার মণ্ডপে চেয়ারের ব্যবস্থা, বিদ্যালয়ে পুরস্কার বিতরণী সভার সভাপতিত্ব, মাসিক পত্রিকায় অপাঠ্য গল্প রচনার সুযোগ এবং অনূঢ়া বয়স্থা কন্যার উদ্বিগ্না জননীর আকুলি বিকুলি। ...

'প্রচুর অর্থ, প্রভূত প্রতিষ্ঠা এবং বৈদেশিক পরিবেশের ফলে একটি বিশেষ শ্রেণীতে পরিণত হন তাঁরা। দেশের দায় বিমুক্ত, দশের থেকে বিযুক্ত। আই.সি.এস একটা পেশা নয়, আই.সি.এস একটা জাত। হোলি রোমান এম্পায়ার যেমন না ছিল হোলি, না ছিল রোমান এবং বলা যায় না এম্পায়ার; ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস তেমনি ইন্ডিয়ান নয়, সিভিল তো নয়ই এবং সার্ভিসের বাষ্প মাত্র নেই তাতে।'

এবং রয়েছে কথিকার অন্তিমে সেই অমোঘ তিনটি অনুচ্ছেদ--

'কোমলহৃদয় বলে আমার খ্যাতি নেই। কিন্তু আধারকারের জন্য সত্যিকারের বেদনা বোধ করলেম হৃদয়ে। সুনন্দা ব্যানার্জী আজ কোথায় আছেন জানিনে। অনুমান করছি, এতদিনে তাঁর যৌবন গত, দেহ বিগতশ্রী, দৃষ্টি বিদ্যুতহীন এবং কপোলের রেখাগুলি প্রচুর প্রসাধনপ্রলেপের দ্বারাও আজ আর কোনমতেই গোপনসাধ্য নয়। কোন দিন কোন অবকাশ মুহূর্তে বহু বর্ষ আগেকার এক মারাঠি ব্রাহ্মনের চরম নির্বুদ্ধিতার কথা স্মরণ করে ক্ষণেকের জন্যও তাঁর মন উন্মনা হয় কিনা, সে কথা আজ জানার উপায় নেই। অথচ তাঁরই জন্য আধারকার দিলেন চরম মূল্য। নিজেকে বঞ্চিত করলেন সাফল্য থেকে, খ্যাতি থেকে, ঐহিকের সর্ববিধ সুখ স্বাচ্ছন্দ্য থেকে! সব চেয়ে বড় কথা, নিজেকে বঞ্চিত করলেন সম্ভবপর উত্তরপুরুষ থেকে, বংশের ধারাকে করলেন বিলুপ্ত।

'কোনো দিন সন্ধ্যাবেলায় তাঁর কুশল কামনা করে তুলসীমঞ্চে কেউ জ্বলবে না দীপ, কোনো নারী সীমন্তে ধরবে তাঁর কল্যাণ-কামনায় সিন্দুরচিহ্ন, প্রবাসে অদর্শনবেদনায় কোন চিত্ত হবে না উদাস উতল। রোগশয্যায় ললাটে ঘটবে না কারও উদ্বেগকাতরহস্তের সু্খস্পর্শ, কোন কপোল থেকে গড়িয়ে পড়বে না নয়নের উদ্বেল অশ্রুবিন্দু। সংসার থেকে যেদিন হবেন অপসৃত, কোন পীড়িত হৃদয়ে বাজবে না এতটুকু ব্যথা, কোন মনে রইবে না ক্ষীণতম স্মৃতি।

'প্রেম জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য, মৃত্যুকে দেয় মহিমা। কিন্তু প্রবঞ্চিতকে দেয় কী? তাকে দেয় দাহ। যে আগুন আলো দেয় না অথচ দহন করে, সেই দীপ্তিহীন অগ্নির দাহনে পলে পলে দগ্ধ হলেন কাণ্ডজ্ঞানহীন হতভাগ্য চারুদত্ত আধারকার।'

কলম তো নয়, যেন এস্রাজের ছড়। নবীন পাঠকের কাছে একটু প্রাচীনগন্ধী লাগতে পারে, কিন্তু বলুন তো, চলিত বাংলা ভাষায় শেষ কোথায় শুনেছেন এই দেশরাগের মূর্ছনা? মনে রাখা যেতে পারে, অবশ্য না রাখলেও বিশেষ ক্ষতিবৃদ্ধি নেই, এই ভাষা রচিত হয়েছে আজ থেকে সাত দশকেরও বেশী আগে! উপন্যাস শেষ হলে আধারকারের ভাগ্যহীনতায় সত্যিই দু'দণ্ড স্তব্ধ হতে হয়।

দৃষ্টিপাত অবশ্য শুধুমাত্র আধারকার-সুনন্দার প্রেমকাহিনী নয়। এইরকম অনেক ছোট ছোট খন্ডকাহিনী আছে এতে। সেসব কাহিনী কোথাও অতিক্রম করেছে দিল্লির ভৌগলিক সীমা, কোথাও বা তার কাল। আমরা পেয়েছি নানাবর্ণের ফুলে গাঁথা এক অনবদ্য কথামালা। আগাগোড়া সরস আঙ্গিকে। ভাবতে অবাক লাগে, কতোখানি কলমের জোর থাকলে এতো সরস মোড়কে বিষাদকেও রসোত্তীর্ণ করে পেশ করা যায়।
কিন্তু বাস্তব সত্যি হল, এই ভাষা অনেকের পছন্দ নয়। অনেক প্রাজ্ঞ বোদ্ধাকেও বলতে শুনেছি, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যাযাবরের ভাষার অতিঅলংকরণ ও কথায় কথায় বেকনীয় এপিগ্রামের ঝোঁক একটু ব্যাকডেটেড লাগে। অতীতে প্রবল জনপ্রিয়তা এবং তৎকালীন সমালোচকদের প্রশংসা, দুই-ই পেয়েও বহু লেখক আজ অজ্ঞাত এবং অপঠিত। এঁদের মতে, যাযাবরের ভাষাবয়নের, গ্রন্থনের আবেদন যুগাতিশায়ী নয়। ভাষার বাঁকবদলের সংগে সংগে এই তথাকথিত 'হিট' স্টাইলও অশ্বখুরহ্রদের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। মনকে স্তোক দিই, অমৃতেও অরুচি থাকে লোকের। দৃষ্টিপাতের সঠিক মূল্যায়ন তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা বোধহয় আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ইচ্ছাও নেই। আমার এই লেখা তাঁরা অনায়াসে উপেক্ষা করুন। আমার অমৃত সেবনসুখ তাতে ব্যাহত হবে না।

দৃষ্টিপাত আমি কতবার পড়েছি তার আর সংখ্যা মনে নেই। যতবারই পড়ি, হরিদ্বারের ঘাটে অবগাহন গঙ্গাস্নান করে ওঠার অনুভূতি হয়। দিন দশেকও হয়নি, দৃষ্টিপাত আবার পড়ে শেষ করেছি। এখনো ঘোর কাটেনি। এমতাবস্থায়, নাঃ সত্যিই দৃষ্টিপাতে আমি কোনও কলুষ দেখতে পাচ্ছি না। ত্রুটি কিছু থাকলে তার বিচার আমার চেয়ে যোগ্যতর রিভিউয়ারের জন্য তোলা রইল। দৃষ্টিপাতের নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করা বোধহয় তাই আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সম্ভব যখন নয়, তখন পাততাড়ি গুটোনোই বিধেয়।

প্রবীণ রসজ্ঞের কাছে যাযাবরের সাহিত্যের পর্যালোচনার নামে যে ধৃষ্টতা দেখিয়েছি তার জন্য মার্জনা ভিক্ষায় আপত্তি নেই। বলবেন তাহলে এসব লিখতে যাওয়াই কেন?

কি করি বলুন, অমৃত কি একা খাওয়া যায়?


লেখক পরিচিতি : অধীত বিদ্যা বিদ্যুৎ-প্রযুক্তি, পেশা সরকারি চাকরি। বাংলার বাইরে বিশ বছরের প্রবাসজীবন। যাদবপুরের স্নাতক, খড়গপুরে স্নাতকোত্তরণ। আবার গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো একটা এম-বি-এ ডিগ্রীও আছে। ছোটবেলা থেকে গল্প পড়তে ভাললাগা। বই পড়া ছাড়া প্রিয় অবসর (কোথায়?) বিনোদন ইতিহাস আর অঙ্কে। লেখালিখিটা সম্পূর্ণ শখের, মনের কথা সাদামাটা ভাবে বলার একটা তাগিদ থেকেই এই মতিভ্রম। ছন্দ মেলাতে অক্ষম। মনেপ্রাণে সাবেকী। গদ্যেও প্রাচীনপন্থী, বিমূর্ত আধুনিকতা পছন্দ নয়, আসেও না।                   

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.