অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


বিবিধ প্রসঙ্গ

নভেম্বর ১, ২০১৭

 

রাখেন ভিভিএস মারে কে!

অনীশ মুখোপাধ্যায়

(১)

১৮ই আগস্ট , ২০১২। উপ্পলে রাজীব গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামের কনফারেন্স রুমে হুট করে এক সাংবাদিক সম্মেলন ডাকা হয়েছে। মাস পাঁচেক আগে এমন করেই বেঙ্গালুরুতে সাংবাদিকদের ডেকেছিলেন এক বিখ্যাত ক্রিকেটার। দোলের সময়ে রাঙিয়ে দিয়ে যাওয়ার বদলে তিনি ভক্তদের কাঁদিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন।

“ইফ উইন্টার কামস ক্যান স্প্রিং বি ফার বিহাইন্ড?”

রাম যদি চলে যান তবে কি লক্ষ্মণও বেশিদিন…?

বুকটা কেমন যেন করে উঠল। কালো স্যুটে সুসজ্জিত হয়ে সপরিবারে তিনি এলেন। ক্রিজে এসে প্রাথমিক জড়তা কাটাতে যেটুকু সময় লাগত এদিনও সেটুকুই নিলেন। যেই জন্য সবাইকে ডাকা হয়েছে সেটা বলতে গিয়ে খুব সামান্য সময় যেন গলাটা চোক করে এল। না , না! কোন ভুল নেই। ‘ভেরি ভেরি অর্ডিনারি’ভাবে বঙ্গিপুরাপ্পু বেংকটসাঁই লক্ষ্মণ অবসর নিয়ে ফেললেন।

পাঁচ বছর বাদেও কিছু প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া মনে আসছে।

আরে লোকটা বলছে কী! পাঁচদিন বাদে নিউজিল্যান্ড সিরিজ শুরু। ও তো টিমেও আছে। তারপরে ইংল্যান্ড সিরিজ। কতদিন বাদে পাঁচটা টেস্ট খেলবে ওরা। সেটা হলেই তো ওর ফেভারিট অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ঘরের মাঠে চারটে টেস্ট। ছাড়তে হলে এই ক’টা খেলে ছাড়ুক! পাগল হয়ে গেল নাকি?

এটা যদি সার্কিটে একাংশের মতবাদ হয় তবে দ্বিতীয়টা আরো বেশি প্রাণ আকুল করা।

হায়দরাবাদ টেস্টটা অন্তত খেলুক। ঘরের মাঠে একটা স্ট্যান্ডিং ওভেশন-ফেলিশিটেসন এসব তো হবে। এত বড় একটা প্লেয়ার! আর এই তো নিউজিল্যান্ডের হাল! একটা বড় রান করে দিলেই-!

তিন নম্বর থিয়োরি- আচ্ছা ওকে কি ধোনি কিছু বলেছে?এই দেশটায় একটু বাজে খেলা মানেই এত কাটাছেঁড়া হয়! আরে ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ায় গোটা টিম ফেল করেছে। ও তো একা নয়! ওর এত ইনসিকিওরড ফিল করার কী আছে!

চার নম্বরটা যেন আর্তনাদ। রাহুল রিটায়ার করে গেল মার্চে। এবার যদি এই লোকটাও চলে যায় তাহলে মিডল অর্ডারটা সামলাবে কে?কোহলি?শচীন তো কবে কী করবে নিজেও জানে না। সব্বোনাশ হয়ে যাবে। ওকে যে করেই হোক আটকাও।

কিছুতেই কিছু হয়নি। কারণ ভারতীয় ক্রিকেটে পঞ্চপ্রদীপ একে একে নেভার যে পর্ব ২০০৮-এর মহাষ্টমীর রাতে শুরু হয়েছিল সেই তালিকায় শেষের আগের প্রদীপটি ততক্ষণে বাইশ গজের বাইরে এসে নিভে গিয়েছে। কোনভাবেই ভিভিএস তাঁর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করেননি। কোন এক অমিতকে নিয়ে রবি ঠাকুর লিখেছিলেন

“পাঁচজনের মধ্যে ও যে-কোনো একজন মাত্র নয় , ও হল একেবারে পঞ্চম। ”

ভিভিএস লক্ষ্মণও কি ভারতীয় ক্রিকেটের পঞ্চপাণ্ডবদের মধ্যে তেমনই কেউ?

(২)

লক্ষ্মণ সম্পর্কে নতুন কিছু লিখতে পারা মুশকিল জেনেও যে কি-প্যাডে হাত দিতে হল তার প্রধানতম কারণ বোধহয় এই যে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের ওই সোনার ভারতীয় দলের এক নম্বর ম্যাচ উইনার হিসেবে নতুন করে ওঁকে আবিস্কার। গড়পড়তা ধারণা বলে , এই পুরস্কার দু’শো টেস্ট খেলা মুম্বাইকরই পাবেন। না হলে সহবাগ। তা-ও না হলে অন্তত সৌরভ। লক্ষ্মণ মানে তো কেবল ইডেন আর অস্ট্রেলিয়া। এবং কেবলই অস্ট্রেলিয়া। যদি কেউ এই ভাবনায় এখনো বুঁদ হয়ে থাকেন তবে সেটা ভুল হবে। কারণ ভিভিএস তার বাইরেও জিতিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকায় , শ্রীলংকায় , ওয়েস্ট ইন্ডিজে। ম্যাচ বাঁচিয়েছেন নিউজিল্যান্ডে। ক্রিকেট আজকাল এত বেশি খেলা হয় যে ছয় মাস আগে কী হয়েছে কেউ মনে রাখে না। তাই ভিভিএসের অন্তত হাফ ডজন ম্যাচ জেতানো দামি ইনিংসের কথা হয়ত অনেকেরই খেয়াল নেই।

অমর চিত্রকথা

অস্ট্রেলিয়ার প্রসঙ্গে আলাদা করে আসব। সেটা বাদ দিয়ে এই সিরিজের শুরুটা তো সেই সৌরভ গাঙ্গুলীর আমলে পোর্ট অফ স্পেনে(২০০২) ৬৯ নট আউট আর ৭৪ দিয়ে। জো’বার্গে সৌরভের কাম-ব্যাক টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ৭৩(২০০৬) , পার্থের সেই অবিশ্বাস্য জয়ের মূলেও ফের দ্বিতীয় ইনিংসে ৭৯(২০০৮) , কলম্বোয় চতুর্থ ইনিংসে ২৫০ প্লাস তাড়া করে ৬২/৪ থেকে ১০৩ নট আউট থেকে ম্যাচ বের করে নেওয়া(২০১০) , ধোনির আমলে ডারবানে ফের দ্বিতীয় ইনিংসে ৯৬(২০১০) করে ৩০০ প্লাসের টার্গেট বানিয়ে দেওয়া। এই ইনিংসটা নিয়ে একটু আলাদা করে বলতে হয় এইজন্য যে উল্টোদিকে ধোনির সঙ্গে একটি পঞ্চাশ রানের কাছাকাছি আর জাহির খানের সঙ্গে সত্তর রানের একটি পার্টনারশিপ ছাড়া প্রায় কেউই ওঁর সঙ্গে সেদিন দাঁড়াতে পারেননি। স্টেইন , মর্কেলদের সামনে সহবাগ , দ্রাবিড় , শচীন , পুজারারা চূড়ান্ত ব্যর্থ হন।

তিনি , ভিভিএস , আউট হয়েছিলেন সবার শেষে।

এবার অস্ট্রেলিয়া প্রসঙ্গে আসা যাক। লক্ষ্ণণের সেঞ্চুরির শুরু সেই ২০০০ সালে সিডনিতে। হারা ম্যাচে একা কুম্ভ হয়ে ১৬৭-এর ইনিংস। অজিদের বিরুদ্ধে তাঁর সেঞ্চুরি থাকা সত্ত্বেও ভারতের হার-এই একমাত্র টেস্টে। হ্যাঁ , সেটাও দ্বিতীয় ইনিংসে। যত বড় বিপদ তত চওড়া ব্যাট-এই পরিস্থিতির পেটেন্ট সেই আমলে রাহুল দ্রাবিড় প্রথম নেন। কে জানত , রাহুলের কাছে সেটা বেশিদিন থাকবে না! এমন দিন দ্রুত আসবে এবং বেশ ঘনঘন আসবে যেদিন রাহুল নন লক্ষ্মণ খেলে দেবেন! অথবা যেদিন লক্ষ্মণকে যোগ্য সহায়তা দেবেন রাহুল। ইডেন যার সবথেকে বড় উদাহরণ। কিন্তু আজ ১৪ই মার্চ , ২০০১ নিয়ে কথা নয়। সে নিয়ে অনেক বলা হয়েছে। আজ সেই দিন যখন রাহুল সবসময় লক্ষ্ণণের পাশে নেই। উদাহরণ কি কম?

সবথেকে প্রিয় এবং কঠিন প্রতিদ্বন্দী দলের বিরুদ্ধে

স্টিভ ওয়ার সেই টিমের বিরুদ্ধে ইডেনের পরের টেস্ট চেন্নাইতে। প্রথম ইনিংসের নায়ক সেই রাহুল। পাশে এবারে শচীন। লক্ষ্মণ স্পেশাল অ্যাপিয়ারেন্স সেরে গেছেন ৬৫ করে। কিন্তু ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসে?যখন ১৫৫-এর পুঁজি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন স্টিভ?যখন ঠিক করে নিয়েছেন যে আজ হয় মারব নয় মরবো , কিন্তু কোনটাই বিনা যুদ্ধে হবে না। স্টিভ নির্ঘাত ভেবেছেন এই হয়ত শেষ ভারত সফরে মরণকামড় কেমন করে দিতে হয় দেখিয়ে দেবেন। দেখিয়ে দিয়েওছিলেন তিনি। ভিভিএস বাদে তুলে নিয়েছিলেন ভারতের বাকি তারকা ব্যাটসম্যানদের। লক্ষ্মণকে যখন তুললেন ততক্ষণে তিনি ৬৬টি রান করে প্রায় ডুবে যাওয়া নৌকো পাড়ের কাছে এনে দিয়েছেন। স্টিভ কার্যত আটকে গেলেন এই লোকের কাছেই।

২০০৩-এর অ্যাডিলেড। দ্রাবিড়ের অমর ২৩৩ আর ৭২ নট আউট এবং ভারতের অবিশ্বাস্য জয়। কিন্তু তারও আগে স্টিভের অজি টিমটার সাড়ে পাঁচশোর জবাবে ভারত তো ধুঁকছে ৮৫/৪-এ। ফের রাম(নাকি রাহুল! )। ফের লক্ষ্মণ। ফের বিরাট পার্টনারশিপ যার শুরুটা লক্ষ্ণণের কিছু অসাধারণ বাউন্ডারি দিয়ে। চাপ হালকা হওয়ার সেই শুরু , যা উলটে পরেরদিন ফাঁস হয়ে বসল অজিদের গলায়। এবারেও স্টিভ ওয়া হারলেন।

পরের বছরে মুম্বাইয়ের ঘূর্ণি পিচে আধা ফিট শচীনকে পাশে নিয়ে লছুভাইয়ের ৬৯। ওই পার্টনারশিপ না হলে ১০৭-এর লিডও হয় না। ভারতের জেতারও প্রশ্নই আসে না। সিরিজ হারতে হয় ০-৩ যা আসলে হয়ে দাঁড়ায় ১-২।

বড়বাবুর সঙ্গেও কয়েকবার জুটিতে লুটেছেন

সবশেষে রূপকথার মোহালি(২০১০)। আমার মনে হয় ইডেনকে এক পাশে রেখে এই লিস্টের বাকি ইনিংসগুলির মধ্যে পরিস্থিতির বিচারে কঠিনতম যুদ্ধ লক্ষ্মণকে মোহালিতেই লড়তে হয়েছে। একে চতুর্থ ইনিংস। তায় ২০০ এর ওপরে টার্গেট , যেখানে ১২৫-এ আটজন ফিরে গেছেন। আপনি যদি আপনার নায়ককে নিয়ে উপন্যাস লিখতে বসেন তাহলেও তাকে দিয়ে এমন ম্যাচ জেতানোর আগে দু’বার ভাববেন। বেশি অবাস্তব হয়ে যাচ্ছে না তো?এসব লিখলে উপন্যাস মনোনীত হবে তো?সম্পাদকমশাই বলবেন না তো এইটা বড্ড বেশি কল্পনাপ্রবণ হয়ে যাচ্ছে মশাই! বাস্তবে দেখান দেখি একটা এমন কেস! লক্ষ্মণ কিন্তু দেখিয়ে দিয়েছিলেন। টেস্টে ভারতীয় ক্রিকেটে এমন জয় আর বোধহয় একটিও নেই যেখানে রান তাড়া করতে গিয়ে নবম উইকেটে ৮০ রান উঠছে। কোন এক ইশান্ত শর্মাকে নিয়ে এই অলৌকিক পার্টনারশিপ করার সময়ে লক্ষ্মণকে সামলাতে হয়েছে বেন হিলফেনহাউস , ডাগ বোলিঞ্জার এবং মিচেল জনসনের গোলাগুলি। ইশান্ত আউট হলে শেষ ব্যাটসম্যান প্রজ্ঞান ওঝার সাহায্যে লক্ষ্মণ ‘ভেরি ভেরি স্পেশাল’ ভিক্টরি এনে দেন। ইসপিএন ক্রিকইনফোর সিনিয়র এডিটর শারদা উগরা ভিভিএস অবসর নেওয়ার পরে লিখেছিলেন ,

“To borrow from JK Rowling , in a dressing room of muggles - of varying and outstanding gifts , achievements and records - Laxman was always the only wizard.”

যা একদিক থেকে বড় বেশী সঠিক বলে মনে হয়।

গড় , শতরান এসব ছাড়া যাক। এতগুলো শক্ত জয় এই ভদ্রলোক এনে দেওয়ার পরে তিনি ২০০০ সালের পর থেকে(নাকি আগেও?)ভারতের সেরা ম্যাচ উইনিং ব্যাটসম্যান - এই নিয়ে সন্দেহ থাকা উচিৎ কিনা এটা খুব স্বাভাবিক তথা সঙ্গত প্রশ্ন। ভাবীকাল নয় সেই বিচার করবে।

জয়ের পরে আসে ড্র। কিছু উদাহরণ হাতেই আছে। নেপিয়ারে(২০০৯)ভারত ফলো অন করে। তিনশোর বেশি রানে পিছিয়ে থাকার পরে ১২৪ রান করে নট আউট থেকে ভারতকে বিপদসীমার বাইরে টেনে আনেন লক্ষ্মণ। যদিও গৌতম গম্ভীরও ১৩৭ করে যান। কিন্তু তিনি যথেষ্ট করেও দলকে একেবারে নিরাপদ স্থানে আনতে পারেননি। লক্ষ্মণ সেখানে ড্র নিশ্চিত করে দেন।

পরের বছর ফের নিউজিল্যান্ড। এবারে দেশের মাঠে , আহমেদাবাদে। প্রথম ইনিংসে ২৮ রানে এগিয়ে থেকে ব্যাট করতে নেমে ভারত ১৫/৫। খেলা ধরলেন লক্ষ্মণ। সেখান থেকে ৬৫/৬। এবারে দীর্ঘকালের সঙ্গী হরভজন সিং যিনি এরপরে ১১৫ রান করে দেবেন। লক্ষ্মণ আউট হলেন ব্যক্তিগত ৯১ রানের মাথায়। ততক্ষণে ভারত ২২৮/৭। খেলা ড্র-এর মুখে।

আরেকটা ইনিংসের কথা বলি। ২০০১-এর সেই বিতর্কিত দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে(মাইক ডেনেস পর্ব)পোর্ট এলিজাবেথ টেস্ট। রাহুল দ্রাবিড় আর দীপ দাশগুপ্তের দ্বিতীয় ইনিংসের মরীয়া লড়াই টেস্টটা ড্র করে দেয়। কিন্তু তার আগে ভারতের প্রথম ইনিংস শেষ হয় দু’শো রানে। যেটা উঠেছিল মূলতঃ লক্ষ্ণণের একটা অসামান্য ৮৯ রানের সুবাদে। ১১৯/৮ থেকে ১৯৯/৯-এ লক্ষ্মণ আউট হলেন। মাঝের ৮০টা রানের সঙ্গী বহু যুদ্ধের আরেক নায়ক অনিল কুম্বলে। খুব ভুল না হলে এই ইনিংসের কথা গত দশ বছরে প্রায় কোথাও আলোচিত হয়নি। উল্টোদিকে শন পোলক , ন্যান্টি হেওয়ার্ড , মাখায়া এনটিনি আর জ্যাক কালিস পোর্ট এলিজাবেথের আধা সবুজ পিচে আগুন ঝরাচ্ছিলেন। পোলক একাই যথেষ্ট। তাঁর কৃপায় অর্ধ্বেক টিম সাজঘরের পথ দেখে। সৌরভ দ্রুত ৪২ রান করে ফিরে যাওয়ার পরে বাকিটা ‘ভেরি ভেরি স্পেশাল’ শো চলেছিল। তবে বলে রাখা দরকার যে বাইশ গজে আরো অন্তত বার চার-পাঁচেক এই ভূমিকায় ভিভিএস অবতীর্ণ হয়েছেন। লক্ষ্মণ দ্বিতীয় ইনিংসে ভারতের উদ্ধারকর্তা হিসেবে সেই যে ইডেনে আবির্ভূত হলেন বাকি কেরিয়ারে সেটাই বোধহয় দলে থাকাকালীন ওঁর প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়াল।

(৩)

সত্তরের দশকে এবং আশির দশকের গোড়াতেও গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথকে বলা হত ‘ম্যান ইন ক্রাইসিস’। যেদিন গাভাসকার আহত হয়ে খেলতে না পেরে দলে নেই অথবা ব্যর্থ হয়েছেন , বাকিরাও আয়ারাম-গয়ারাম স্ট্যাটাস নিয়েছেন সেদিন ভিশি আছেন। আর আছেন মানে তিনি ম্যাচ জেতাবার ব্যবস্থাও করে দেবেন , ম্যাচ বাঁচাবারও। এই ঘটনা যে কতবার ঘটেছে ইতিহাস তার সাক্ষী আছে। ভিশির অবসরের অব্যবহিত পরে তাঁর ঘরানার ব্যাটিং স্টাইলের নব্য ধারক হয়ে এলেন আজহার। আর লক্ষ্মণকে বলা হত আজহারেরই আধুনিকতম ভার্সন। ঐ কব্জির মোচড় , অপার্থিব লেগ গ্লান্স , ফ্লিক আর অন ড্রাইভ , সামান্য শর্ট বল পেলে চোখ জুড়নো পুল , দৃষ্টিনন্দন স্কোয়ার ড্রাইভ , অনায়াস মন ভরানো স্ট্রেট ড্রাইভ- লক্ষ্মণ বলকে আঘাত কম করতেন , ব্যাটকে বলের ওপরে যেন বেশি ছুঁইয়ে দিতেন। বল দেখে অনেক দেরি করে খেলার একটা অদ্ভূত ক্ষমতা ছিল তাঁর। শেন ওয়ার্ন ২০০১-এর সেই সিরিজে লেগ স্টাম্পের বাইরে রাফে ফেলে বল ঘোরাতে চেষ্টা করে গেছেন। ১৯৯৮-এ এসেও একই কাজ করেছিলেন। সেবারে শচীন এবং আরো অনেকে মিলে সেই চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেন। এবারে ওয়ার্ন সবথেকে বেশি জব্দ হন লক্ষ্ণণের কাছে। লেগে সামান্য সরে কভার-এক্সট্রা কভার দিয়ে ইনসাইড আউট খেলতে শুরু করেন। আর আরো বাইরে পেলে ফাইন লেগ দিয়ে গ্লান্স বা সুইপের রাস্তা তো খোলাই ছিল। একেক সময় মনে হত ব্যাট করছেন না তুলি দিয়ে বাইশ গজে দাঁড়িয়ে একেকটি অমূল্য ছবি আঁকছেন! শুনেছি টেনিসে আগে কেউ কেউ টাচ- প্লেয়ার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তো ক্রিকেটের সেরা টাচ প্লেয়ারদের লিস্টের একেবারে ওপরে লক্ষ্মণকে না রাখলে আর কাকে রাখবেন?অফ সাইডে টাইমিং নিয়ে রাহুল দ্রাবিড়ের তাঁর একদা বন্ধুর প্রতি সেই অমর উক্তি মনে রেখেও সামান্য অনুযোগ-তিনি কি লক্ষ্মণকে ভুলে গিয়েছিলেন?হায়দরাবাদী ঘরানার এমএল জয়সীমার নাম ষাটের দশকের শেষের দিকে কিছুকাল এসেছিল। এরপরে একে একে কর্নাটকি ভিশি হয়ে আজ্জুকে ধরে লক্ষ্ণণের জমানা শুরু। আমার কোথাও মনে হয় এদের সবার গুণগুলো যেন নিজের ব্যাটিং-এ ঢুকিয়ে নিয়েছিলেন ভিভিএস। একটা অদ্ভূত মাধুর্য ছিল ব্যাটিং-এ। একদিনের ম্যাচে হয়ত যুগোপযোগী হয়ে উঠতে পারেননি। কিন্তু পাঁচদিনের খেলায় কখনো অতি আক্রমণাত্বক না হয়েও যে ওভার পিছু চারের আশেপাশে রান তোলা যায় ‘সিল্কেন টাচ’ দিয়ে লক্ষ্মণ দেখিয়ে গিয়েছেন। কেবল ইংল্যান্ড ছাড়া আর প্রায় সব জায়গায় তিনি মোটামুটি সফল। কোথাও খুব বড় সাফল্য নেই। কিন্তু কোথাও অগ্রাহ্য করার মতনও পারফরমেন্স করেননি। ইংল্যান্ড ভিভিএসের কাছে ওয়ার্টারলু হয়ে না গেলে ওঁর সামগ্রিক কেরিয়ার আরো ভাল দেখাত। ৪৫-এর বেশি কেরিয়ার গড় যাঁর তাঁর ইংল্যান্ডে তিন বার গিয়ে একটাও সেঞ্চুরি নেই এবং ৩৫-এর আশেপাশে গড়-ভেবে একটু অবিশ্বাস্যই লাগে। আবারো এই প্রসঙ্গে ডাগ ওয়াল্টার্সের কেরিয়ার স্মর্তব্য। বোঝা যায় না যিনি বিশ্বের সর্বত্র বাঘা বাঘা ফাস্ট বোলারদের অবলীলায় সামলেছেন , সিম-বাউন্স-সুইং দিব্যি খেলে এসেছেন তাঁর বিলেতের সুইং হজম করতে অসুবিধা হল কেন?এখন অবধি এর কোন ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যা পাইনি।

লক্ষ্মণকে নিয়ে লিখতে গিয়ে আরেকটি প্রসঙ্গ এখানে না আনলে অন্যায় হবে। সেটা হল ওঁর কেরিয়ারের প্রথম চার বছরের টালমাটাল হাল। না ছিল সঠিক ব্যাটিং পজিশন না ছিল নিরাপত্তা। আজ বলা হল গোটা সিরিজ ওপেন করো। সেটা করার পরে বলা হল তুমি পরের ম্যাচে ফোর্থ ডাউন নামবে। সেখানে ব্যর্থ মানে পরের সিরিজে বাদ। আবার কিছুদিন বাদে ফিরে আসা। শচীন-রাহুল-সৌরভ-সহবাগ কারুর কেরিয়ারের প্রথম চার বছরে ব্যাটিং পজিশন এত নড়বড়ে যায়নি। এইজন্য লক্ষ্মণকে দায়ী করা অনুচিত। নির্বাচক এবং তখনকার অধিনায়কদের কিছু দায়িত্ব অবশ্যই থাকে। এই যে ইডেনে দ্বিতীয় ইনিংসে ওঁকে তিন নম্বরে তুলে আনা হল(যিনিই তুলে আনুন)সেখানে সাফল্য পাওয়ার পরে ফের ফোর্থ ডাউনে নামিয়ে দেওয়াটা জরুরি ছিল কিনা নিশ্চিত নই। ছয় নম্বরে যিনিই নামুন তাঁর কিছু আত্মত্যাগ অনিবার্য হয়ে ওঠে। এইক্ষেত্রে টিম ম্যানেজমেন্ট মনে করেছে প্রথম নতুন বল খেলার জন্য রাহুল দ্রাবিড় অনেক বেশি কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারেন এবং দ্বিতীয় নতুন বলের জন্য লক্ষ্মণকে তাঁদের বেশি পছন্দ। স্টিভ ওয়া যেটা দিনের পর দিন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে করে গেছেন। স্টিভের তবু একটা সুবিধা ছিল এই যে তাঁর পরে গিলক্রিস্ট ছিলেন। লক্ষ্মণ তো ধোনিকে পেয়েছেন ২০০৫-এ এসে। তা-ও ধোনির টেস্ট ম্যাচে নিয়মিত বড় রান আসতে কিছু বছর গেছে। ততদিনে লক্ষ্মণ ওই পজিশনে খেলতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। লোয়ার মিডল অর্ডার বা টেইল এণ্ডারদের নিয়ে অগুনতি ম্যাচে দলকে বিপন্মুক্ত করতে একটা আলাদা স্কিল লাগে। ২০০০ সাল বা তৎপরবর্তীকালের ওই টিমটায় বোধহয় লক্ষ্ণণের মধ্যেই সেটা ছিল। নাকি তিনি সবার অজান্তে নিজের মতন করে এই গুণ অর্জন করে নেন? যেটাই হয়ে থাক পেস এবং স্পিনের বিরুদ্ধে সমান স্বচ্ছন্দ ব্যাটসম্যান ওই সময়ে যে ক’জনকে মনে করতে পারছি ভিভিএস তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

হে বন্ধু হে প্রিয় , স্লিপে আমায় গোটাকতক ক্যাচ নিতে দিও

টিমে তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সেটা হচ্ছে স্লিপ ক্যাচিং। কট দ্রাবিড় বোল্ড কুম্বলে/হরভজন-এর মতনই কট লক্ষ্মণ বোল্ড কুম্বলে/হরভজন- এও নেহাত কম হয়নি। ১৩৫টা টেস্ট ক্যাচ ১৩৪টা টেস্ট খেললে হয়ত নেওয়ারই কথা। কিন্তু ক্যাচগুলো ধরতে তো হয়েছে। সেখানেও তো এক নম্বর দৃশ্যমান প্রতিদ্বন্ধীর নাম রাহুল দ্রাবিড়। ক্যাচ ভাগাভাগির খেলা। তবু লক্ষ্মণ নিজের মতন করে ঠিক আরেকটি ভূমিকায় যাকে বলে ‘সিগনিফিক্যান্ট’ অবদান রেখে দিয়েছেন। আজ বা পরেও ওঁকে নিয়ে ক্রিকেটাড্ডায় এই দিকটা বাইশ গজের বাইরের কাব্যে উপেক্ষিতই থাকে/হয়ত থাকবেও।

(৪)

ঠিক কোন কারণে ভিভিএস অবসর নিলেন?এই ব্যাপারে অনেক মত শুনেছি। রাহুল দ্রাবিড়ের মতন ওঁর অবসর নেওয়ার খবরে প্রবল দুঃখও হয়েছে। কিন্তু আবেগহীন মন বলে এর থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত বোধহয় আর হয় না। এটা ঘটনাই যে ইংল্যান্ড থেকে আট ইনিংসের ব্যর্থতা নিয়ে ফিরে ২০১১-এর শেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ইডেনে সেঞ্চুরি করেছিলেন। কিন্তু যেটা ভিভিএস-এর প্রিয়তম মৃগয়াভূমি সেই অস্ট্রেলিয়ায় আটটি ইনিংসে একবার পঞ্চাশ পেরোনোটা বোধহয় ওঁর মস্তিষ্কে প্রাথমিক সঙ্কেত পাঠায়।

ভেবে দেখো। আরো টানবে?

কিন্তু তাহলে তিনি নিউজিল্যান্ড সিরিজের আগে নিজেকে ট্রেনিং-এ রেখেছিলেন কেন?কেন নেটে যেতেন?এটা প্রমাণ করতেই তো যে সামনের লম্বা ঘরোয়া মরসুমে কিছু একটা করে দেখিয়ে তারপরে ২০১৩-এর মার্চে ছেড়ে দেবেন? অন্যথায় এই সিদ্ধান্ত দ্রাবিড়ের মতনই অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরেই তো নেওয়া যেত?পাঁচ মাস অপেক্ষা কেন? তাহলে কি বোর্ড নির্দেশ দিল?একজন আপাদমস্তক ভদ্রলোক কোথাও কি চোরা আঘাতে সাংঘাতিক আহত হলেন?নাকি ‘ফিয়ার অফ ফেলিওর’ জিতে গেল?অথবা মন জানতে চাইল কী হবে যদি ঐ তিনটের প্রথম দুটো সিরিজে তুমি বড় রান না পাও?বাদ গেলে কি ফিরে আসতে পারবে?অসংখ্য নামি খেলোয়াড়ের মতন বাদ গিয়ে পরে চুপচাপ অবসর নেবে?তাহলে আর তুমি বাকিদের থেকে আলাদা কোথায়?তার থেকে এটাই ভাল হবে না যে তুমি নির্বাচিত হয়েছিলে এবং তারপরে বিনীতভাবে সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে সরে গেলে?এর মানে কোথাও তুমি এখনও যোগ্য যার জন্য কিছু মূল্য পাচ্ছ। কেউ কেউ এখনো বলছেন এখুনি নয় , অন্তত হায়দরাবাদ টেস্ট বা এই দুই টেস্টের সিরিজটা খেলে দাও।

শ্রীলঙ্কায় চতুর্থ ইনিংসে শতরান করে জেতাবার মুহুর্তে , সঙ্গে রায়না আর শেহবাগ

ব্যস। এটাই তো খেলোয়াড়ের কাছে কাম্যতম সময়। ওই ঘরের মাঠে খেলা , বাড়তি আবেগ , মানে বাড়তি চাপ , কিছু সংবর্ধনা , মেকি প্রশংসাবাণী , হাততালি , উপহার-এই তো? না , না ভিভিএস। এসব তুমি অনেক পেয়েছ। ওয়ান মোর টাইম ইজ নট রিকোয়ার্ড ফর ইউ। ঐ ফ্ল্যাশলাইটের ঝলকানি , মিডিয়ার তারাবাজি , একটা যেন ডিজাইনার ফেয়ারওয়েলের অমোঘ আকর্ষণ , গ্ল্যামারাস এক্সিট-এই এত আপাত লুজ বল খেলবেন না ছাড়বেন এই দ্বিধায় চার থেকে পাঁচটি দিন কাটিয়ে মনস্থির করে নিলেন। নিতেই হত। তারপর বাঁ পা বাড়িয়ে দেখেশুনে ব্যাট তুলে অফ স্টাম্পের লাইনে দাঁড়িয়ে তাঁকে ব্যাটটা উপরে তুলে ফেলতে দেখা গেল। বোধহয় কেরিয়ারের সবথেকে ভয়ঙ্কর আউট সুইং ডেলিভারিটায় সবথেকে আত্মবিশ্বাস সমেত জাজমেন্ট দিলেন। এককথায় অসাধারণ জাজমেন্ট। মধ্যবিত্ত পরিবারের মূল্যবোধ কোথাও কাজ করছিল হয়ত। আজ অন্তত তাই মনে হয়।

তথাকথিত ‘গ্রেট’ তকমাওয়ালা ব্যাটসম্যান তিনি হয়ত নন। টেস্টে গোটা কুড়ি শতরান নেই , হাজার দশেক রান নেই , কেরিয়ার গড় পঞ্চাশের ধারে কাছে নয় , শচীনের গ্ল্যামার নেই , রাহুলের দুর্ভেদ্য দেওয়াল নেই , শচীন/সৌরভ/সহবাগদের মধ্যে কারুর কাছাকাছি স্তরেও আক্রমণাত্বক নন। তবু ওই দলে তিনি এতটাই অপরিহার্য ছিলেন যে অধিনায়ক থাকাকালীন শচীন , সৌরভ , দ্রাবিড় এবং ধোনি-কেউই তাঁকে প্রথম এগারোর বাইরে রেখে নামার কথা বড় একটা বোধহয় ভাবেননি। লক্ষ্মণ ব্যাট করতে থাকার সময় একটা যেন অনুচ্চারিত বার্তা ছড়িয়ে যেত সাজঘরে যে আমি তোমাদের কারুর মতন না হয়েও স্বীয় ক্ষমতায় দলের কাছে নিয়ত নির্ভরতার প্রতীক হয়ে থাকব।

আইপিএল শুরু হওয়ার সময় নিজের আইকন স্ট্যাটাস ছেড়ে দেন শুধু এইজন্য যে আইকন হলে যে বাড়তি ১৫% অর্থ তাঁর পাওয়ার কথা সেটা দিয়ে নিলাম থেকে ডেকান চার্জার্স অন্য খেলোয়াড় কিনতে পারবে। এটাও তো একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা যা তাঁর কোন সতীর্থ করে দেখাননি।

বলছিলাম না শিল্পী ভিভিএস ওই পাঁচজনের একজন নন।

একেবারে পঞ্চম।


লেখক পরিচিত - পেশায় অর্থনীতির অধ্যাপক। ন'হাটা কলেজে কর্মরত। লেখালেখি নিয়ে চিন্তাভাবনার শুরু ২০১০-এ। প্রথম উপন্যাস 'জগতরত্ন রক্তনীল' আনন্দমেলায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় ২০১৪-২০১৫ সালে। শারদীয় আনন্দমেলায় ওঁর সাম্প্রতিক উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। ক্রিকেট নিয়ে লেখালেখিতে আগ্রহী। ফেসবুকে এ ব্যাপারে নিজস্ব পেজ 'বাইশ গজের ডাইরি'তে নিয়মিত লিখে থাকেন।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.