প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

খেলার দুনিয়া

মার্চ ৩০, ২০১৭

 

বনেদি ক্রিকেটের দুই গোলার্ধ

আবেশ কুমার দাস



Cricket to us was more than play,
It was a worship in the summer sun.

৪৬-৩৩-২৬-২। বাপু নাদকার্নি নয়, রবীন্দ্র জাডেজার বোলিং খতিয়ান। দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলা ময়দানে সফরকারী দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ২০১৫-১৬ ঘরোয়া সিরিজের চতুর্থ তথা শেষ টেস্টের (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ২১৯১) চতুর্থ ইনিংসে। পঞ্চম দিন চা-বিরতির সামান্য পরে ১৪৩ রানে যখন শেষ হল অতিথিদের ইনিংস ততক্ষণে ভারতকেও হাত ঘুরিয়ে ফেলতে হয়েছে ১৪৩.১ ওভার। অল্প বিদ্যের ভয়ঙ্করী পুঁজিতে আজ থেকে কয়েক দশক পরে এই টেস্টের স্কোরকার্ডে চোখ রাখলে মনে হতেই পারে যে চতুর্থ ইনিংসে পর্বতের সামনে পড়ে গিয়েই সেদিন মূষিক প্রসব করেছিল প্রোটিয়ারা। কিন্তু প্রকৃত ক্রিকেটপ্রজ্ঞায় সেই একই স্কোরকার্ডে চোখ রাখলে ভাবীকালের খাঁটি ক্রিকেটরসিক ঠিকই উপলব্ধি করে নেবে সেই অশরীরী হাওয়ার বিদেহী অস্তিত্বটুকুকে। ক্রিকেট দেবতার আকস্মিক খেয়ালে শতাব্দীর ওপার থেকে বয়ে এসেছিল যে হাওয়াটুকু সেদিন আচমকা মধ্য অঘ্রানের কোটলার বুকে। উড়ে আসা বুড়ির সুতোর মতোই আপন অস্তিত্বের ভাঁজে ভাঁজে যে কিনা সযত্নে সম্পৃক্ত করে এনেছিল সেই টাইমলেস টেস্টের কালের লাল চেরির গন্ধকে। হারজিতের মামুলি বিচারে বরাবর এগিয়ে থাকবেই কমার্স। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ অস্তিত্ববান হয়ে উঠে এভাবেই আপন অমরত্বের প্রমাণ রেখে যায় রোমান্স। অযুত লক্ষ মধ্যবিত্তের ভিড়ে যেভাবে আচমকাই একদিন জন্ম হয় এক নীল রক্তের জিনিয়াসের।

সিরিজের গোড়া থেকেই চলছিল প্রোটিয়াদের নাস্তানাবুদ হওয়া। ব্যাঙ্গালোর টেস্ট বৃষ্টিতে ভেস্তে গেলেও মোহালি আর নাগপুরে অতিথিদের যাবতীয় জারিজুরি খতম হয়ে গিয়েছিল মাত্র তিন দিনেই। কোটলায় চতুর্থ দিন মধ্যাহ্নভোজনের বিরতির কিছু আগে আগে ভারতের দ্বিতীয় ইনিংসের দান যখন ছেড়ে দিলেন বিরাট কোহলি ততক্ষণে ৪৮০ রানে পিছিয়ে পড়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। দেওয়ালের লিখন একেবারে দিনের আলোর মতোই জ্বলজ্বল করছে। যেটুকু দেখার বাকি ছিল—প্রথম ইনিংসে মাত্র ৪৯.৩ ওভারে মুড়িয়ে যাওয়া অতিথিরা এই যাত্রাতেও সিরিজের পরম্পরা বজায় রেখে একদিন আগেই খেলার ফয়সালা ‘ঘটিয়ে’ ফেলতে পারে কিনা!

পৌঁনে দু’দিনের অবশিষ্ট সময়ে তখনও বাকি কমবেশি একশো ষাট ওভার। চতুর্থ ইনিংসে ৪৮১ তাড়া করে জেতার নজির যেমন টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসেই অমিল তেমনই শেষ পৌঁনে দু’ দিনে কোটলার পিচে ভারতীয় স্পিনারদের সামলে চতুর্থ ইনিংসকে টিকিয়ে রাখার ভাবনা— বিশেষত এই কুড়ি ওভারের ধামাকার যুগে— গামছার ধোপার বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছেরই সামিল। আরও বিশেষ করে ভৌগোলিক অর্থে উপমহাদেশের বাইরের এমন একটি ক্রিকেট দলের পক্ষে যাদের ঐতিহাসিক ভাবেই তেমন একটা সুনাম নেই ঘূর্ণি পিচে খেলার বিষয়ে। ইংরেজ, অস্ট্রেলীয়, ক্যারিবিয়ান, এমনকি কিউয়িদের মতো সাগরপাড়ের অন্যান্য ক্রিকেট সভ্যতাগুলির তাও যদি বা দীর্ঘ ঐতিহ্যগতভাবে কিছু কিছু অভিজ্ঞটা থাকে ভারতের মাটিতে চার স্পিনারের মহড়া নেওয়ার, দীর্ঘ একুশ বছরের নির্বাসন সেই সুযোগও রাখেনি প্রোটিয়াদের।

অতিথিদের হাবেভাবে অচিরেই কিন্তু মালুম হল সংশপ্তকের অমানুষিক ব্রত নিয়েই এই যাত্রায় ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছেন তাঁরা। প্রথম ইনিংসে ৪৯.৩ ওভারেই সমাধা হয়েছিল যাঁদের অন্তর্জলী যাত্রা এই দফায় সবে তাঁদের দ্বিতীয় উইকেটের পতন ঘটল ৪২.৪ ওভারের মাথায়। রান যে এমন কিছু উঠছে তা মোটেও নয়। ওভারের পর ওভার কেটে যাচ্ছে স্রেফ মেডেন হিসেবেই। বোলারকে সোজা ব্যাটে খেলাই ছিল যে যুগের দস্তুর এবং প্রায় নির্বিঘ্নতার সুবাদে লং অন ও ডিপ মিড উইকেটের মধ্যবর্তী এলাকাটির নামই যে যুগে হয়ে গিয়েছিল কাউ কর্নার (সোজা ব্যাটে খেলে মাঠের এই জায়গায় বল পাঠানো অসম্ভব। এই অঞ্চলে শট নিতে হলে আড় করতেই হয় ব্যাটের মুখ। আঢাকা পিচ, আন্ডারস্টেপিং নো-বল বিধি বা বোলিং নিয়ন্ত্রণবিহীন ধ্রুপদী ক্রিকেটের যুগে টেকনিক্যাল কারণেই ব্যাটসম্যানদের খুব বেশি আড়াআড়ি খেলার প্রবণতা থাকত না। পরিণামে মাঠের এই অঞ্চলটি সারাদিনে প্রায় নিরুপদ্রবই থাকত। কোনও ফিল্ডারও রাখা হত না সচরাচর। মনে করা হত সারা মাঠের মধ্যে নিরুপদ্রব এই এলাকায় গরুরা দিনভর নির্বিঘ্নেই ঘাস খেয়ে বেড়াতে পারবে। উক্ত ধারণা থেকেই ‘কাউ কর্নার’ নামটির উৎপত্তি। সীমিত ওভারের ক্রিকেটের হাত ধরে ক্রস-ব্যাটের রমরমার যুগে অবশ্য এলাকাটি— বিশেষত অধুনা কুড়ি ওভারের ক্রিকেটে— ব্যাটসম্যানদের পছন্দের মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে) মুহূর্মুহূ ফিরে আসছে সেই বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ব যুগের নস্টালজিয়া। ভেতরে ঢুকে আসা যাবতীয় ডেলিভারিকে রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে ব্যাটে (এবং স্লিপ-কর্ডন বা ক্লোজ-ইনে বিন্দুমাত্র সুযোগ না তুলে স্রেফ ব্যাটের মাঝখান দিয়ে) খেলে যাওয়া যে কত কঠিন এবং কী অপার মনোযোগের বিষয়, কুড়ি-ওভারি জমানাকে আবার মনে পড়াতে শুরু করলেন হাসিম আমলা-আব্রাহাম বেঞ্জামিন ডেভেলিয়ার্সরা। ঋষির তপস্যা ভঙ্গ করতে পাঠানো দেবতার প্রলোভনের মতো লোপ্পা লোপ্পা বলের ফাঁদ নিয়ে মাঝেমধ্যে হাত ঘোরাতে এলেন শিখর ধাওয়ান, মুরলী বিজয়, বিরাট কোহলি, এমনকি চেতেশ্বর পূজারাও। তবুও দলের দ্বিতীয় উইকেটের পতনের পর থেকে চতুর্থ দিনের অবশিষ্ট প্রায় তিরিশ ওভারের মামলা নির্বিঘ্নেই কাটিয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে গেলেন ডেভেলিয়ার্স-আমলা।

শেষ অবধি দেওয়ালের লিখন পাল্টাতে পারল না বটে দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু পৌঁনে নয় ঘণ্টার সেই অনমনীয় প্রতিরোধে ঘটিয়েই ফেলল আরও বড়সড় এক ওলোটপালোট। শিল্প-সাহিত্য-সমাজনীতিতে ঘোরতর অর্থেই স্কোরকার্ডের বস্তুবাদে বিশ্বাসী হয়ে ওঠা একটি সময়কে মীমাংসাহীনতার নিরুত্তাপ রোমান্টিসিজমের হদিশ ফিরিয়ে দিতে পারত বোধহয় এক চৌষট্টি খোপের স্টেলমেট পরিস্থিতি আর নয়তো বাইশ গজের এমনতর কোনও চতুর্থ ইনিংসই।

প্রশ্ন উঠতে পারে, যে যুগে দর্শকের অভাবে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়তে লেগেছে পাঁচদিনের ক্রিকেটের সংগঠকদের, যত বেশি সংখ্যক খেলার ফয়সালা পেতে নানাবিধ উদ্যোগ শুরু হয়ে গেছে সর্বস্তরে, সেই কালে দাঁড়িয়ে স্রেফ সাবেক রোমান্টিসিজমে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকার যৌক্তিকতা কতখানি? এহেন নিরুত্তেজ ব্যাটিং কি আখেরে আরও টেস্ট-বিমুখই করবে না আজকের দর্শককে? আর খেলাটারই যদি বেজে যায় মৃত্যুঘণ্টা, তবে কোথায়ই বা থাকবে এত শিল্পের অহঙ্কার, এত শৈলীর অভিজ্ঞান, এত ব্যাকরণের আতিশয্য?



গাভাসকারের সেই মহাকাব্যিক ২২১

কিন্তু খেলার অন্তর্লীন উত্তেজনাও কি কোনও অর্থেই অন্তিম মীমাংসাময়তার সমানুপাতিক? প্রহরে প্রহরে রং বদলাতে থাকা তুমুল উত্তেজক একটি টেস্ট ম্যাচও যে অন্তিমত অমীমাংসিত থেকে যেতে পারে এবং তারপরেও অন্তর্নিহিত আবেদনে যে সে হয়ে যায় কালজয়ী, গাভাসকারের সেই মহাকাব্যিক ২২১-এর সৌজন্যে চিরস্মরণীয় ১৯৭৯-র ওভাল টেস্টই (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৮৫৪, একইসঙ্গে গাভাসকারের পঞ্চাশতম টেস্ট) তো তার সার্থকতম উপমা। ক্রিকেটের দর্শকের কাছে আসলে ব্যাট বলের সমানে সমানে শেয়ানে শেয়ানে মহড়ার আকর্ষণ বরাবরই অন্তহীন। আর ঠিক এই প্রেক্ষিত থেকে বিবেচনা করলেই ভারত তথা উপমহাদেশের পটভূমিতে পাঁচদিনের ক্রিকেটের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ হেতুর খোঁজ মিলবে।

নাইডু থেকে উমরিগর, মার্চেন্ট থেকে গাভাসকার, পাতৌদি থেকে বেঙ্গসরকার— ঐতিহাসিক ভাবেই ভারতবর্ষে চিরদিন ব্যাটসম্যানদেরই রমরমা। ভারতের ‘নিউ সাউথ ওয়েলস’ বোম্বে দশকের পর দশক জাতীয় ক্রিকেটকে সরবরাহ করে গেছে ঝাঁকে ঝাঁকে ব্যাটিং নক্ষত্র। অন্যদিকে আবার সেই অমর সিং-মহম্মদ নিসারের পর আর কোনও কুলীন গতির পেস আক্রমণই পায়নি ভারত। বরং ভিনু মানকড়-গোলাম আহমেদ-সুভাষ গুপ্তের আমল থেকেই ভারতীয় বোলিং আক্রমণ একান্তভাবেই স্পিন মুখাপেক্ষী। টাইগার পাতৌদির আমলে জাতীয় দলে মিডিয়াম পেসারদের দায়িত্বই ছিল শুরুর কয়েক ওভারে বলের পালিশ যথাসম্ভব চটিয়ে দেওয়া। যাতে বেদী-চন্দ্রশেখর-প্রসন্ন-বেঙ্কটরাঘবনকে দ্রুত আক্রমণে আনা যায়। বসন্ত রঞ্জনের (৭টি টেস্টের ১৩ ইনিংসে ১২৬৫টি ডেলিভারিতে ৬৪৯ রান দিয়ে ৩৪.১৫ গড়ে সংগৃহীত উইকেট ১৯টি, সেরা বোলিং ৭২ রানে ৪ উইকেট, ব্যাট হাতে উক্ত ৭ টেস্টের ৯ ইনিংসে ৩ বার অপরাজিত থেকে সংগৃহীত রান ৪০, সর্বোচ্চ ১৬, গড় ৬.৬৬, ক্যাচ ১টি) মতো ইতিহাসের এই পর্বে অস্তিত্ববান সম্ভাবনাময় ভারতীয় পেসাররা স্রেফ এই দেশে জন্মানোর ভাগ্যদোষেই পাদপ্রদীপের আলো থেকে নির্বাসিতই রয়ে গিয়েছেন চিরকাল। এই ঐতিহাসিক প্রবণতার দৌলতেই এদেশে সেই মানকড়-আহমেদ-গুপ্তের যুগ থেকেই হয় ব্যাটিং সহায়ক নয়তো নিখাদ ঘূর্ণি পিচ নির্মাণেরই চল।

১৯৮৩-১৯৯৩ সময়পর্বে পরের পর বেশ কয়েকটি সীমিত ওভারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় ভারতের সাফল্যের সূত্রে ক্রমে এদেশে জনপ্রিয়তা পেল উক্ত ধারার ক্রিকেট। সীমিত ওভারের খেলার জন্মই হয়েছিল ক্রিকেটের আবেদনকে ‘ক্লাস’ থেকে ‘মাস’-এর দিকে নিয়ে যেতে। এবং এই বিশেষ প্রক্রিয়াটির স্বার্থে সব দেশে সব কালেই কিছু না কিছু আপস করতেই হয় আর্টকে। ধারক দেশকাল যত শিক্ষিত, যত রুচিশীল হয়, বাজারের সঙ্গে শিল্পকে সমঝোতা করতে হয় তত কম— এই যা। বক্স অফিস মাত করতে চটুল নাচগানের দৃশ্য গুঁজে দিতে হয় সিনেমায়। বইয়ের কাটতি বাড়াতে দু’-একটা অপ্রয়োজনীয় রগরগে বর্ণনা ঢুকিয়ে দিতে হয় উপন্যাসে। সীমিত ওভারের ক্রিকেটেও অনুরূপে চার-ছক্কার অফুরান মস্তি বজায় রাখতে একেবারে প্রথমদিন থেকেই বোলিং-এর উপর জারি হয়েছিল এটা-সেটা বিধিনিষেধ। ১৯৯৩-এর পর যখন এই ধাঁচের ক্রিকেট তুমুল জনপ্রিয়তা পেল ভারতের বাজারে তখন দেখা গেল, যে দেশ থেকে একদিন একজন ক্রিকেটারও যোগ দেননি কেরি প্যাকারের জলসায়, আসলে সেই দেশের মাটিতেই আক্ষরিক অর্থেই লুকিয়ে রয়েছে এই ধারার ক্রিকেটের সোনালি সম্ভাবনা। ইডেন গার্ডেনের মতো দু’-একটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম বাদ দিলে ভারতের পিচগুলি প্রকৃতিগত ভাবেই অসবুজ। বল হাঁটুর ওপরে উঠতেই চায় না। ব্যাটধারীদের প্রতি বাৎসল্যরসে টইটম্বুর। ওদিকে আবার সার্বিকভাবেই উপমহাদেশের বৃহত্তর জনরুচি কোনওকালেই ঠিক মহৎ আর্টের পৃষ্ঠপোষক নয়। সুতরাং অচিরেই সীমিত ওভারের ক্রিকেটের ভরবেগ নাড়িয়ে ফেলল আমাদের সনাতন ক্রিকেটের জাড্যকে। পাঁচদিনের খেলার পিচগুলিও দিনকে দিন আরও আরও বেশি করে ব্যাটিং বৎসল হয়ে উঠতে লাগল। দু’দিনেও খতম হতে না চাওয়া প্রথম ইনিংসের একঘেয়েমি ও পরিণামে নিরস মীমাংসাহীনতায় ক্রমে ক্রমে পাঁচদিনের খেলার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে লাগল দর্শক।

গাভাসকারের শেষ টেস্টের (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১০৭৩) মতো সেই আদ্যন্ত ঘূর্ণি পিচও যদি নির্মিত হত পাঁচদিনের খেলাগুলিতে, তাহলেও ব্যাট বলের লড়াইটা এত ক্লান্তিকর হয়ে উঠত না ভারতের মাটিতে। ইকবাল কাসিম-তৌসিফ আহমেদদের সামলে ১৯৮৬-৮৭ মরসুমের সেই ব্যাঙ্গালোর টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে করা গাভাসকারের ৯৬-এর গোত্রের ইনিংস বরং যেমন ব্যাটসম্যানের জাত চেনাত তেমনই বনেদি ক্রিকেটের মৌতাতকেও অক্ষুন্ন রাখতে পারত দর্শকের মনে। কিন্তু বিগত শতকের নয়ের দশকের ঠিক ওই সময়টায় আসলে বিভিন্ন মহল থেকে আমাদের ব্যাটধারীদের এক একজন অতিমানব হিসেবে তুলে ধরার একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কাজেই...

পরবর্তীকালে ব্যারি রিচার্ডস একবার মন্তব্য করেছিলেন যে উপমহাদেশে জন্মালে মহত্তর ব্যাটিং গড়ের সুবাদে স্টিফেন ফ্লেমিং-ও (১১১টি টেস্টের ১৮৯ ইনিংসে ১০ বার অপরাজিত থেকে সংগৃহীত ৭১৭২ রানের সুবাদে ব্যাটিং গড় ৪০.০৬, সর্বোচ্চ অপরাজিত ২৭৪, শতরান ৯টি ও অর্ধশত ৪৬ বার) হয়তো কুলীন ব্যাটসম্যানের গোত্রেই অন্তর্ভুক্ত হতেন। মনে হয় না খুব একটা ভুল ছিল রিচার্ডস সাহেবের পর্যবেক্ষণে।

এই সামগ্রিক পরিস্থিতির বিচারে বরং সংশয়ই জাগে প্রকৃত প্রস্তাবেই ক্রিকেট আমাদের দেশে জাতীয় ধর্মস্বরূপ তো? নাকি যেভাবে সিনেমার বদলে আসলে বলিউডে মজে রয়েছি আমরা তার আদলেই ক্রিকেটের পরিবর্তে নিছক বিনোদনেই বুঁদ হয়ে নেই তো এদেশের অশিক্ষিত জনরুচি? সাম্প্রতিক আইপিএল ধামাকা এবং তার কয়েক মাসের ব্যবধানেই ছুটির দিনেও মেরেকেটে পাঁচ হাজারি হাজিরার টেস্ট কেন্দ্রের ছবি এই সংশয়কেই তীব্রতর করে।

সুখের কথা, সাহেব কবি যেভাবে ক্রিকেটকে মনে করেছেন গ্রীষ্ম দিবসের উপাসনার সমার্থক, যেন তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই ইংরেজ ও তার ভিনদেশীয় বংশধরদের জীবনে এই খেলা আজও এক অন্তর্লীন সংস্কৃতি। লোক-দেখানো ‘ধর্ম’-র বাহ্বাস্ফোট নয়। মনে রাখা ভাল, লোক-দেখানো ‘ধর্ম’ যেখানে মানুষে মানুষে দাঙ্গা বাধায়, তলোয়ারের কোপে মুণ্ডু কাটে (অধুনা ‘ধর্ম’-র এই শব্দার্থ গ্রাহ্য করলে অবশ্য ক্রিকেটকে উপমহাদেশের ধর্মস্বরূপই মনে হবে), সেখানে সংস্কৃতি বেঁচে থাকে স্রেফ পরকে আপন করার শিষ্টতায়, সৌজন্যে। বাইশ গজে উক্ত সৌজন্যবোধেরই অনবদ্য প্রকাশ ঘটেছিল ১৮ জানুয়ারি, ২০০০ তারিখে সেঞ্চুরিয়নের সুপারস্পোর্ট পার্কে সফরকারী ইংরেজ ও প্রোটিয়াদের তরফে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী অধিনায়ক নাসের হোসেন ও হ্যান্সি ক্রোনিয়ের (কেবল কলঙ্কের বিচারেই একজন মানুষকে সর্বদা মূল্যায়িত করতে না যাওয়াটাই বোধহয় ভাল) পারস্পরিক বোঝাপড়ায়। যে গোত্রের বোঝাপড়াকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘জেন্টলমেনস এগ্রিমেন্ট’, ১৯৯৯-০০ মরসুমের দক্ষিণ আফ্রিকা-ইংল্যান্ড টেস্ট সিরিজের উক্ত পঞ্চম টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১৪৮৩) হোসেন ও ক্রোনিয়ের তরফে যেন কার্যকর হয়েছিল অবিকল সেই ঘরানার চুক্তি।

বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়া প্রথম দিনের অর্ধেক এবং নিষ্ফল দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ দিনের শেষে একটি মৃতপ্রায় টেস্টকে বাঁচাতে যেন বনেদি ক্রিকেটের খাঁটি কপিবুক শটের আদলেই একেবারে আভিধানিক ভদ্রতাবোধের পথে হাঁটলেন দুই অধিনায়ক। প্রথম দিনের খেলায় হতে পারা ৪৫ ওভারের হিসাব ধরে যাতে উভয় দলই নিজেদের একটি ইনিংসে মোটামুটি একই সময় হাতে পায় তা মাথায় রেখে ৭২ ওভারের শেষে ৮ উইকেটে ২৪৮ রানে প্রথম ইনিংসের সমাপ্তি ঘোষণা করল প্রোটিয়ারা। নির্দিষ্ট সময়ের ইনিংস বিরতির পর মাঠে না নেমেই প্রথমে ইংরেজরা এবং তারপর প্রোটিয়ারা যথাক্রমে নিজেদের প্রথম ও দ্বিতীয় ইনিংসের দান ছেড়ে দিল। অবশিষ্ট দিনের খেলায় জেতার জন্য ২৪৯ রানের লক্ষ্য নিয়ে এরপর নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নামল ইংরেজরা। শেষ অবধি ৭৫.১ ওভারে ৮ উইকেটের বিনিময়ে ২৫১ রান তুলে এই টেস্ট ২ উইকেটে জিতল বটে ইংরেজরা। কিন্তু সেই জয়-পরাজয়ের খুঁটিনাটি ততক্ষণে নিছকই স্কোরকার্ডের নিয়মতান্ত্রিকতায় পরিণত হয়েছে। হোসেন ও ক্রোনিয়ের সৌজন্যে যে তখন জিতে গেছে জেন্টলমেনস গেমের চিরন্তন আবেদন।

জেন্টলমেনস এগ্রিমেন্টের এই অনবদ্য ক্রিকেটীয় দৃষ্টান্তের সুবাদেই মনে পড়বে টেস্ট ইতিহাসের আরও এক সুবিখ্যাত ইংরেজ-প্রোটিয়া দ্বৈরথকে। দীর্ঘ দশ দিনব্যাপী (৩-১৪ মার্চ) অনুষ্ঠিত ১৯৩৮-৩৯ মরসুমের সেই ডারবান টেস্টকে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ২৭১)। টেস্ট ক্রিকেটের সুদীর্ঘ ইতিহাসে একাধারে দিনের বিচারে খেলা হওয়া দীর্ঘতম টেস্ট (অথবা প্রথম শ্রেণির খেলা) এবং আজ পর্যন্ত খেলা হওয়া শেষ টাইমলেস টেস্টের অভিধায় যা কিনা কিংবদন্তি হয়ে আছে। কোনও একটি টেস্টের পরিণতির ঘোষণায় ‘এগ্রিমেন্ট’ শব্দটিও সেই শেষবারের (তথা দ্বিতীয়বার) জন্যই লেখা হয়েছিল স্কোরকার্ডে। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, ‘ম্যাচ ড্রন (বাই এগ্রিমেন্ট)’  কথাটি স্কোরকার্ডে প্রথম লেখা হয় ১৯২৯-৩০ মরসুমে ইংল্যান্ডের প্রথম ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের চতুর্থ টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১৯৩)। কিংস্টোনের সাবাইনা পার্কে অনুষ্ঠিত সেই টেস্ট চলেছিল নয় দিন (৩—১২ এপ্রিল, মাঝে ৬ এপ্রিল ছিল বিশ্রামের দিন) এবং তারপর সেই মরসুমের শেষ ইংল্যান্ডগামী জাহাজ ধরতে আর মাঠে নামা হয়নি অনারেবল ফ্রেডারিক ক্যালথর্পের নেতৃত্বাধীন ইংরেজ বাহিনীর।



দীর্ঘতম টেস্ট ম্যাচে এড্রিক ব্যাট করছেন

ফিরে আসি দীর্ঘতম টেস্ট ম্যাচটির প্রসঙ্গে। চতুর্থ ইনিংসে ৬৯৬ রানের লক্ষ্য নিয়ে ব্যাট করতে নেমে দশম দিনের (৫ ও ১২ মার্চ ছিল বিশ্রামের দিন, অষ্টম দিন ১১ মার্চ খেলা হতে পারেনি) খেলা শেষে ৫ উইকেটে ৬৫৪ অবধি এগিয়েছিল ইংরেজরা। এদিকে বাতাসে ততদিনে লেগে গেছে ভরপুর যুদ্ধের গন্ধ। মনে রাখা প্রয়োজন, সময়টা ১৯৩৯-এর মার্চ। আসন্ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাজারে ঘরে ফেরার তাড়ায় হ্যামন্ড, ভেরিটি, এড্রিকরা আর ৪২ রান তাড়া করতে একাদশ দিন মাঠে নামতে চাননি। পরিণামে খেলার শুরুতে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল— ফয়সালা না হওয়া অবধি অনন্তকাল ধরে চলবে এই টেস্ট— দুই দলের বোঝাপড়াতেই তার নড়চড় ঘটিয়ে স্কোরকার্ডে সেই শেষবারের জন্য লেখা হল ‘ম্যাচ ড্রন (বাই এগ্রিমেন্ট)’ কথাটি।



দীর্ঘতম টেস্ট ম্যাচের স্কোরকার্ড

ক্রিকেট ধমনীতে মহাজাগতিকতার এই সুদীর্ঘ ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারের দৌলতেই কি সেদিন কোটলার ময়দানে চতুর্থ ইনিংসে প্রায় একশো ষাট ওভার ব্যাট করে নিজেদের অক্ষত রাখার কথা চিন্তা করতে পেরেছিলেন আমলা, ডেভেলিয়ার্স, ডু প্লেসিসরা? হয়তো। হয়তো স্কোরকার্ডের ফলাফলে বিশ্বাসী ভারতীয় উপমহাদেশের সার্বিক মনন কোনওকালেই তল পাবে না অন্য ক্রিকেট গোলার্ধের এই ঋদ্ধ ক্রিকেটবোধের। উক্ত মননশীলতার চোরাস্রোতেই যে অন্তর্লীন হয়ে থাকে সাহেব কবি এডমন্ড ব্লন্ডেনের সেই গভীর উপলব্ধি,

The game which made me write at all, is not terminated at the boundary, but is reflected beyond, is echoed and varied out there among the gardens and the barns, the dells and the thickets, and belongs to some wider field.

আর তাই সুইপার, ডিপ কভার, ডিপ এক্সট্রা কভার, লং অফ, লং অন, কাউ কর্নার, ডিপ মিড উইকেট, ডিপ স্কোয়ার লেগ, ডিপ ব্যাকওয়ার্ড স্কোয়ার লেগ, লং লেগ, ফাইন লেগ, লং স্টপ, থার্ড ম্যানের সেই নিটোল পরিসীমাকে অতিক্রম করতে করতে বনেদি ক্রিকেট সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হাজারো প্রতিশব্দেরা বারে বারে নিজেদের আসন করে নেয় সাহেবদের কথার ভাষা, সাহেবদের প্রাণের ভাষা ইংলিশের অন্তরমহলে। ৬ মার্চ ও ৭ মার্চ, ২০১৫— কোটলা টেস্টের অন্তিম দু’ দিনেও আমলা-ডেভেলিয়ার্সদের তরফ থেকে ভারতীয় বোলিং আক্রমণের বিরুদ্ধে জারি হওয়া পৌঁনে নয় ঘণ্টার সেই সুদীর্ঘ (ম্যারাথন) প্রতিরোধে (ব্লকিং) শেষ অবধি পুনরাবৃত্ত হল বনেদি ক্রিকেট ইতিহাসের সেই পরম্পরাই। ‘ম্যারাথন ব্লকিং’ শব্দবন্ধটুকুই ব্যাকরণের নিয়মে সমাসবদ্ধ হয়ে অভিধানে যুক্ত করল একটি নব্য ইংরেজি শব্দ— ‘ব্লকাথন’। একটি ক্রিকেট দলের তরফে জারি হওয়া সেই এক ইনিংসের আপ্রাণ প্রতিরোধ যে এভাবে সর্বকালীন মান্যতা পেয়ে গেল একটি আন্তর্জাতিক ভাষার অভিধানে—যে ভাষার ব্যাপ্তি একেবারে নিঃসন্দেহেই সাহেবি খেলা ক্রিকেটের তুলনায় অনেক অনেকগুণে বিস্তৃততর— বনেদি ক্রিকেটের পক্ষে এর থেকে বৃহত্তর পাওনা আর কী হতে পারত?



হাসিম আমলার ব্লকাথন


লেখক পরিচিতি - জন্ম নৈহাটিতে। মোবাইল কম্যুনিকেশন ও নেটওয়ার্ক টেকনোলজির স্নাতকোত্তর। তবে পছন্দের বিষয় সাহিত্য। মূলত ছোটগল্পকার। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা চার— তিনটি ছোটগল্প ও একটি নিবন্ধ-সংকলন। ভালবাসেন সিনেমা ও ক্রিকেট। সাহিত্য, সিনেমা ও ক্রিকেট— এই তিনটি বিষয়েই রচনা করেছেন বেশ কিছু নিবন্ধ।।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2015 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।