প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

খেলার দুনিয়া

মার্চ ৩০, ২০১৭

 

স্মৃতির সরণী বেয়েঃ পেস-শাসিতদের দুর্ভেদ্য ওয়াকা দখল

অনীশ মুখোপাধ্যায়


গোড়ার কথাঃ

এক অদ্ভুত উদাসী সন্ধ্যা নেমে এসেছে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে।একটা দুটো ফ্লাডলাইট জ্বলে উঠছে। গ্রাউন্ডসম্যানরা ইতিউতি কাজে ব্যস্ত। চারপাশে কেমন একটা শান্ত ভাব। এখন যেখানে ভিক্টর ট্রাম্পার বার তখনো সেখানে ছিলো বিখ্যাত সিডনি হিল।তাতে অল্পকিছু দর্শক বিয়ার মাগে তৃপ্তির সীপ দিচ্ছেন। পাশেই মেম্বার স্ট্যান্ড। সেখানে নিচু গলায় ম্যাচ নিয়ে আলোচনা চলেছে। কমেন্ট্রি বক্সের সামনে গেলে দেখবেন চ্যানেল নাইনের ঘর থেকে দিনের কাজ শেষে হাস্যোজ্জ্বল মুখে একে একে বেরোচ্ছেন টনি গ্রেগ, বিল লরি আর মার্ক টেলর। একটু অপেক্ষা করলে দেখা মিলবে আরেকজনের।

বিল, উই হ্যাভন্ট ডান এনিথিং রং।হ্যাভ উই? বলতে বলতে আগের তিনজনের সঙ্গে যোগ দিলেন ইয়ান চ্যাপেল।

সার্টেনলি নট!! বিলের সহাস্য প্রত্যুত্তর।

পাশাপাশি স্টারের বক্স থেকে থমথমে মুখে এদিকেই আসছেন সুনীল গাভাসকার, রবি শাস্ত্রী। প্রাণপণ স্বাভাবিক মুখ নিয়ে হর্ষ ভোগলে। হাঁটার গতি তুলনায় কম। পাছে এখুনি আগের চারজনের সংগে দেখা হয়ে যায়!

তা উদাসী সন্ধ্যা কেন?

না, এই যে একটু আগে গত দিন পাঁচেকের যুদ্ধটা এসসিজি দেখলো, তাতে হয়ত অস্ট্রেলিয়া জিতে গেছে। কিন্ত সেটা তো ক্রিকেটকে কলংকিত করে। ভারতের সিরিজ জেতবার আশা নেই। অথচ যেভাবে সেই সম্ভাবনাকে এখানে পিষে মারা হলো সেটা দেখেও ইয়ান চ্যাপেলরা কি করে পন্টিংদের হয়ে গলা চড়াচ্ছেন এটা ভেবেই অবাক লাগছে। এসসিজিতে কেউ তখন থাকলে অনুভব করবে দুঃখ ও পৈশাচিক আনন্দের এক আশ্চর্য সহাবস্থান, আলো এবং অন্ধকারের সহাবস্থান আর ক্রিকেট মাঠে থেকেও ক্রিকেট থেকে সাময়িক এক মেন্টালি উইথড্রয়াল সিন্ড্রোম। এরপরেও যদি সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে নেমে আসা সন্ধ্যাকে দেখে উদাসী মনে না হয় তবে কাকে দেখে মনে হবে?

কী কী ঘটনাই না দেখতে হয়েছে এই ক’দিনে!! অজিদের ৫০০রানের জবাবে টিম কুম্বলের পালটা ৫০০।
তার আগে ভাজ্জি-সাইমন্ডস মাংকিগেট ইস্যু। বরাবর বিতর্ক থেকে বহুদূরে থাকতে চেয়েও (এখানে ১৫৪ নট আউট ) আচমকা বিতর্কের শিরোনামে তেন্ডুলকার। অজি মিডিয়ার সাইমন্ডসকে নির্লজ্জভাবে সমর্থন। ভাজ্জির পাশে থাকার জন্য ম্যাথু হেডেনের শচীনকে ভার্বাল আসল্ট। আর সর্বোপরি ভারতের দ্বিতীয় ইনিংসে সৌরভএর ক্যাচ ধরা নিয়ে মাইকেল ক্লার্ক আর রিকি পন্টিংএর কুরুচিকর নাটক।এর সঙ্গে যোগ করুন আরো গোটা তিনেক ভুল আউটের সিদ্ধান্ত যা ভারতের বিপক্ষে গেছে।কারটেসি দুই কুখ্যাত আম্পায়ার স্টিভ বাকনার আর মার্ক বেনসন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে পরের দিন প্রথম পাতার হেডলাইন হল, "Team India c Benson b Bucknor আর টাইমস অফ ইন্ডিয়া আরো একধাপ এগিয়ে লিখে দেয় "Bhajji banned for three Tests, umpires give oz 0-2 lead".

ঠিকই ধরেছেন। ফিরে গিয়েছি নয় বছর আগে। ২০০৮-এর নিউ ইয়ার্স টেস্ট।

তখন সবে একমাস হলো এক অনিয়মিত চাকরিতে ঢুকেছি। দু-মাসের মধ্যে একটা প্রোজেক্টের ডেডলাইন। নর্থ বেংগলে প্রোজেক্ট সার্ভের ডেট পাকা, ট্রেনের টিকিট কাটা হয়ে গিয়েছে। ওদিকে থিসিস সাবমিট করার তাড়া।গাইড বলে দিয়েছেন মার্চে সই করবেন।তারপর তিন মাসের জন্য বিদেশে চলে যাবেন। তার বাইরে এই মাসের শেষে একটা বড় কনফারেন্স আছে। তার প্রেজেন্টেশন বানানো,সঙ্গে সেই পেপার রিভিশন আর কারেকশন। এককথায় পাহাড় প্রমাণ কাজ। কোনটা ছেড়ে কোনটা ধরি অবস্থা। কিন্ত কাজ করবো কীভাবে! আমি তো মানসিকভাবে তখন আজ মেলবোর্ন, কাল সিডনি,পরশু ব্রিসবেন, তারপরের দিন পার্থে। প্রথম দুই টেস্টের জন্য ভোর পাঁচটায় এলার্ম দিয়ে রাখছি। বক্সিং-ডে টেস্ট মানে সেবারে সৌরভের শততম টেস্ট। কলকাতা আবেগের হিস্টিরিয়ায় কাঁপছে। কী এসে যায় দেশ হারলো কী জিতলো তাতে? তারপর সিডনি। তার কথা লিখেছি। এরপরে আসবে পার্থ। সবশেষে অ্যাডিলেড। একেকটা দিন মানে সেই সিরিজ নিয়ে উপন্যাস লিখলে তার এক-একটা চ্যাপ্টার হয়ে যাবে।

আজ এতদিন বাদে ফিরে তাকালে মনে হয় কী এক অসাধারণ আবহেই না শুরু হয়েছিলো সে বছরটা! ২০০৮ আমার কাছে চিরস্মরণীয়। ক্রিকেটের বাইরে জীবনের বাইশ গজে। আবার ক্রিকেট মাঠেও। একদিকে সুখের, আনন্দের। অন্যদিকে দু:খের, বেদনার, টেনশনের। একদিকে আলোর রেখা। আরেকদিক আঁধারে ঢাকা। ঠিক যেমন একটা আদর্শ ক্রিকেট ম্যাচে হয়ে থাকে।ভারতীয় দলের পরিপ্রেক্ষিতেও এ বছরটা মনে রাখার মতন। তো সেই মন কেমন করে ওঠা জানুয়ারির সন্ধ্যায় এরপরেই শোনা যাবে ভারত অধিনায়কের অভূতপূর্ব প্রেস মিট যেখানে তিনি একটু বাদেই অমর উক্তিটি করবেন-

“আমার মনে হয় ক্রিকেটের সব নিয়ম মেনে এখানে একটা দলই খেলছে।”

চমকে উঠেছিলাম। কে বলছেন? কোথায় দাঁড়িয়ে?

অনিল কুম্বলের এই শান্ত প্রতিবাদ ক্রিকেটের ইতিহাসে যে চিরকালের জন্য রয়ে গেলো , এ আমার কাছে পরম সুখের আর চরম অবাক করা অনুভুতি।

“৭৫ বছরের পুরনো ইতিহাস কি অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে আসতে কুম্বলেকেই বেছে নিল? বডিলাইন-পীড়িত বিল উডফুল আর সিডনি-পীড়িত অনিল কুম্বলের মধ্যে যে ৭৫ বছরের ব্যবধান। কিন্তু কি আশ্চর্য, গলায় তাঁদের দুজনেরই এক সুর, এমনকি, পরমাশ্চর্য এই যে, একই ভাষা!”

কিন্তু এখানেই শেষ নয়। কারণ সিডনি বিপর্যয়ের পরে দৃশ্যত মানসিকভাবে ভেংগে যাওয়া দলকে
পাল্টা লড়াই দেওয়ার স্টিমুল্যান্ট কুম্বলেই এরপরে যোগান দেন। যেন বুঝিয়ে দেন, সিরিজ নয় জিততে পারবো না। কিন্তু ড্র-তো করা যেতেই পারে। চলো সেই চেষ্টা করি। লেটস গো ফর দ্যাট। লেট পিপল রিয়ালাইজ হোয়াট উই আর কেপেবল অফ। লেটস মুভ টু ওয়াকা।

আসল গল্পঃ

তখনো পার্থের পিচ থেকে ফাস্ট বোলাররা যা যা চাইতেন তার অনেকাংশই পেতেন। পিছিয়ে থাকা দলের সামনে চারটে তাজা ফাস্ট বোলারকে লেলিয়ে দেন রিকি। তিনটে স্লিপ, দুটো গালি, ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট, শর্ট মিড অন, ফরোয়ার্ড শর্ট লেগ, ডিপ ফাইন লেগ।

অনেকটা এই ধরনের ফিল্ড সেট করা আছে।

পন্টিং যেন বলতে চান-

ওহে এসো, কোলে বোসো।
বাস করে যাও মিনিট কয়।
আমরা বলি, তোমরা শোনো।
বড্ড বেশী পাচ্ছো ভয়?

তো তাতে শুধু পন্টিংএর কাছে ব্রেট লিই যথেষ্ট মনে হয়নি। যোগ্য দোসর হয়ে দেখা দেন শন টেইট। আরো
দুই বিশিষ্ট ভদ্রলোক ছিলেন। মিচেল জনসন আর স্টুয়ার্ট ক্লার্ক। গতি। আরো গতি। আরো আরো গতি। সংগে বাউন্স। চোখে অন্ধকার দেখাও ইন্ডিয়ানদের। বোঝাও ওয়াকা পিচে আগে ব্যাট করতে কেমন লাগে।
আর বলিহারি কুম্বলেকে। এখানে টসে জিতে আগে ব্যাট?!

আহা! এ কেমনে ভুলি?



দ্রুত লেগের দিকে হেলে



পেটেন্ট নেওয়া স্ট্রেট-ড্রাইভ

দ্রুত ভারতের ওপেনারেরা ফিরে গেছেন। আর খেলাটা যেন শুরুই হলো তারপর থেকে। বদলা কাকে বলে সেটা রিকি পন্টিং এরপরে টের পেয়ে থাকবেন। অফ ফর্মের রাহুল দ্রাবিড় আর ফুল ফর্মের তেন্ডুলকার। সেই মাঠে বেপরোয়া ফাস্ট বোলিং-এর সামনে আমার দেখা অন্যতম সেরা টেস্ট ব্যাটিং পার্টনারশিপ। লি-এর শর্টপিচ অফ-মিডল লাইনে শচীনের বুকের হাইটে ধেয়ে আসছে। দ্রুত লেগের দিকে হেলে গিয়ে স্লিপের ওপর দিয়ে বারকয়েক আপার কাট করলেন শচীন। বিস্মিত লি এবারে ফুল লেংথে তীব্র গতিতে ডেলিভারি করলেন। কয়েক সেকেন্ডে সেই পেটেন্ট নেওয়া স্ট্রেট-ড্রাইভটা সাইট স্ক্রিনে এসে আছড়ে পড়লো। অবিশ্বাস আর বিরক্তি নিয়ে লি-এর মুখটা ছিল দেখবার মতন। আর শুধু তো লি নন। লি-এ কাজ হচ্ছে না দেখে পন্টিং নিয়ে এলেন মিচেল (ফিচেল!) জনসন আর শন টেইটকে। শুরু হল ব্যাটসম্যানদের গায়ে বল করা আর স্লিপ কর্ডন থেকে টিপিক্যাল অজি স্লেজিং। ক্রিকেট পিচে বাকযুদ্ধ তো কম দেখলাম না। তবে ওয়াকায় যা দেখেছি সেটা বোধহয় সবকিছুর উর্ধ্বে থেকে যাবে। দ্রাবিড়ের মতো শান্ত মানুষকেও পাল্টা মুখ চালাতে দেখেছিলাম। কতটা উত্যক্ত হলে তিনি, রাহুল দ্রাবিড়, মুখ খুলে ফেলেন। এমনিতে চোয়াল শক্ত করে মাটি কামড়ে একদিক আটকে আছেন। সামনে তখন দুটো লড়াই। এক, নিজের ফর্মে ফেরা আর দুই, দলকে খাদের ধার থেকে তুলে আনতে শচীনের সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করা। ঠিক এই সময় থেকে আমার ফ্ল্যাশব্যাক শুরু হলো। মনের মধ্যে ঘুরে ফিরে আসছে ২০০৬-এর জো’বার্গ টেস্ট। সেদিন শন পোলক আর এনটিনি ভেজা সবুজ বাউন্সি উইকেটে বল হাতে যা ইচ্ছে তাই শুরু করেছিলেন না? সৌরভ তো আরো খানিকবাদে আসবেন।তার আগের লড়াই তো এই দু’জনের। কে বলে হারানো দিন আর খোয়ানো প্রেম ফিরে আসে না?

মাসখানেক আগে রাহুলের অস্ট্রেলিয়ান কন্ডিশনে তুলনামূলক কম গড় (৪০) নিয়ে অনেক তর্ক শুনেছি।এই স্টোরিটা করতে গিয়ে হঠাৎ করে মনে চলে এলেন ডাগ ওয়াল্টার্স। অজিরা যাদের “দ্বিতীয় ব্র্যাডম্যান” আখ্যায় ভূষিত করেছে ইনি তাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। রান, শতরান, গড় এসব দিয়ে যদি আপনি ওয়াল্টার্সকে মাপতে যান তবে বিশ্বের প্রথম তিরিশে তিনি আসেন না। ওয়াল্টার্স হলেন স্ট্রোক প্লেয়ার। উদাহরণ চান? ওয়াকাতেই ৭৪-৭৫ এর অ্যাসেজ সিরিজে দিনের শেষ বলে বব উইলিসকে সোজা সাইট স্ক্রিনের ওপর তুলে দিয়ে সেঞ্চুরি করে বসেন তিনি। এক সেশনে সেঞ্চুরি করেছেন বোধহয় বার তিনেক।ফ্ল্যামবয়েন্স চরমে। তার একটা স্পেশিমেন হলো, প্যাভিলিয়নে ফিরে গিয়ে প্যাড খোলার আগে হাতে উঠে আসতো বিয়ারের গ্লাস আর ঠোঁটে ঝুলতো বেনসন-হেজেস সিগারেট। সময় সময় ইয়ান চ্যাপেলকেও ওর পাশে গ্ল্যামারে ফিকে লাগে। আজো অজিরা ওয়াল্টার্স বলতে সবিশেষ সশ্রদ্ধ। তো এহেন ওয়াল্টার্সের ইংল্যান্ডের মাঠে চারবার খেলতে গিয়ে গড় নাকি মোটে ২১। অথচ বাকি সর্বত্র তিনি দাপিয়েছেন। মজার ব্যাপার, তাঁর এত বড় ব্যর্থতার কথা কোনোদিন জানতামই না। অজি মিডিয়া এ নিয়ে উচ্চরব তোলেইনি। আশ্চর্য কথা হলো, রাহুল সেভাবে ওদেশে ব্যর্থ না হয়েও দেশজ পণ্ডিতের কাছে সমালোচিত।

ফিরে আসি ওয়াকা টেস্টে। আমার স্থির বিশ্বাস, অস্ট্রেলিয়ার মাঠে রাহুল দ্রাবিড়ের এটাই সেরা ইনিংস। ৯৩ রানটা বড় কথা নয়। সেটা যেভাবে এলো তা দেখতে হবে। এই টেস্ট যে ভারত ৭২ রানে জিতে গিয়েছিলো তার পেছনে রাহুলের ইনিংস বিরাট গুরুত্ববহন করে। এর সংগে রাখুন লক্ষণের দ্বিতীয় ইনিংস, ইরফান পাঠানের অলরাউন্ড শো, আর পি সিংএর দ্বিতীয় ইনিংসের স্পেল, শচীনের ওই কাউন্টার এটাকিং ৭১ রান যা এবার আসাদ রউফের ভুল সিদ্ধান্তে শেষ হয়, লক্ষ্মণের প্রথম বারের ২৭, কুম্বলের দ্বিতীয় ইনিংসে বল হাতে হাল না ছাড়া মনোভাব আর এখানেই ৬০০ উইকেট প্রাপ্তি। স্কোর হয়তো সব বলে না। তবু কিছু নিশ্চয় বলে। অথচ অনেকেই তার সবকিছু খেয়াল রাখেন না।

কিন্ত সেকথায় আসার আগে জানা দরকার, অস্ট্রেলিয়া হেরেছিল কেন? মূলত তাদের ব্যাটিং ব্যর্থতার জন্য। ভারতকে ৩৩০-এ শেষ করে দেওয়ার পরে নিজেরা এত দ্রুত ৬১/৫ হয়ে যাবে এটা কেউ ভাবেনি। টার্নিং পয়েন্ট জিজ্ঞেস করলে এই টেস্টে অনেক ক’টার কথা মনে আসে, যার মধ্যে এটি একটি। সাইমন্ডস আর গিলক্রিস্টের কল্যাণে তাদের রান ২১২-তে পৌঁছলেও সেটা মোটেও খুব বেশী নয়। আর এখান থেকেই ভারত খেলাটা্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। একটা সিদ্ধান্ত- যদি একে ফাটকা বলেন তবে তাই- দারুণ ভাবে খেটে যায়। দ্বিতীয় ইনিংসে নাইটওয়াচম্যান হিসেবে ইরফান পাঠানকে পাঠানো। পরেরদিন পাঠান-শেহবাগ জুটি অনেকটা লিড বাড়িয়ে দেন (শেহবাগের দুই ইনিংসে ২৯ আর ৪৩ ভুলি কিভাবে?)। এরপরে শচীন-সৌরভ-রাহুল তিনজনেই ব্যর্থ হলেও খুব অসুবিধা হয়নি, কারণ অস্ট্রেলিয়ার যম ভিভিএস লক্ষ্মণ দাঁড়িয়ে যান। ঐ ৭৯টা সোনায় মোড়া রান, তার সঙ্গে ধোনির নাছোড় ৩৮ আর শেষে আরপি সিং-এর ৩০ রানের ক্যামিও-ওয়াকায় এ যাবৎ অজিদের বিপক্ষে সর্বোচ্চ রানের টার্গেট (৪১৩) সেট করে দেয়। এরপরে কেবল সময়ের অপেক্ষা। যদিও অজিরা দ্বিতীয় ইনিংসে লড়েছিলো ভালো।

এই পর্বে একটা কথা না বললেই নয়। রিকি পন্টিং বনাম ইশান্ত শর্মা এপিসোড এখান থেকেই শুরু হয়। পন্টিংকে তরুণ ইশান্ত ওয়াকার দ্বিতীয় ইনিংসে এক রকম নাচিয়ে ছেড়ে দেন। কিন্ত টানা আট ওভার বল করার পরেও যখন পন্টিং-এর উইকেট পড়লো না কুম্বলে বোলিং চেঞ্জ করবেন ঠিক করে ফেলেন। আর তখনি টিমে কামব্যাক করা বীরু শেহবাগের সেই বিখ্যাত উক্তি বেরিয়ে আসে-

শেহবাগ ইশান্তকে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, লম্বু অউর এক ওভার ডালেগা?

ইশান্ত রাজি হয়ে যান।

কুম্বলেকে মানিয়ে নেন বীরুই। আর পন্টিং-এর ড্রেসিংরুমে প্রস্থান এই ওভারেই। বলা হয়ে থাকে, অজিদের রান তাড়া করার হিম্মত আসলে এখানেই প্রায় অর্ধেক হয়ে যায়। ইরফান পাঠান হয়তো খুব যুক্তিগ্রাহ্য ভাবেই ম্যান-অফ-দ্য ম্যাচ হয়েছিলেন। কিন্ত এই সিরিজের সবচেয়ে কম রানের ম্যাচ ভারত জিততে পেরেছিলো একটাই কারণে। আর তা হল, বহুদিন বাদে দলের গরিষ্ঠাংশ খেলোয়াড়ের সক্রিয় অবদান। এভাবেও যে ফিরে আসা যায়, তা সাত বছর বাদে নিজেদের দেশে পন্টিংদের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়েছিলো। প্রিয় পাঠক, মনে রাখুন আগের টেস্টের ওই মারাত্মক গণ্ডগোলের পরেও সাইমন্ডস ছাড় পেয়ে যান। হরভজন পাননি। উলটে তিন ম্যাচের জন্য সাসপেন্ড করা হয় তাকে।

ফিরে আসি ১৯শে জানুয়ারীর কথায়। সেদিন আমদের ফিল্ড সার্ভের শেষদিন। কিন্ত সার্ভে হবে কেমন করে? প্রোজেক্ট অফিসার তো তখন মানসিকভাবে ওয়াকায়। সেদিন রাতে কলকাতায় ফেরার ট্রেন। তাই সন্ধ্যার পরেও সময় থাকছে। খেলাটা তো তার অনেক আগেই শেষ হয়ে যেতে পারে। দেড়টায় আমার সার্ভে টিমের লাঞ্চ হওয়ার কথা। প্রোজেক্ট অফিসারের কথায় সেটা আধঘন্টা এগিয়ে এল। কারণ তিনি ততক্ষণে হোটেলে ফিরে গেছেন। সেটা স্মার্ট ফোনের যুগ নয়। কিন্ত মোবাইল তো আছে। দ্রুত উইকেট পড়ছে শুনে লাঞ্চ প্রি-পোন করো। এখনো মনে আছে খেলার শেষ কয়েক ওভার দেখে তারপরে ফিরেছিলাম কাজ করতে।

অনেকেই বলেন ১৯৮১-এর লিলি বনাম সানির সেই কুখ্যাত বা বিখ্যাত মেলবোর্ন টেস্টেই অজিদের মাঠে আজও ভারতের সেরা জয়। এ নিয়ে তর্ক থাকতে পারে। এতদিন বাদে জানলাম পঞ্চম দিন নাকি মেলবোর্নে উইকেট খুব খারাপ ছিল। খেলার অযোগ্য প্রায়। তাই ১৪৩ রান তাড়া করতে গিয়ে চ্যাপেলের দল ৮১তে কাত হয়ে যায়। ইউটিউব দেখে যদিও খারাপ উইকেট বলে মনে হয়না। কিন্ত ওয়াকাতে কুম্বলেরা সেদিন যা করে দেন এবং সেটাও যে প্রেক্ষাপটে তাতে এই টেস্টকেই বা খুব পিছিয়ে রাখি কীভাবে? পার্থে সেই প্রথম এবং সম্ভবত ওই একবারই এশিয়ার কোনো দল টেস্ট ম্যাচ জিতে এসেছে। আর সেটাও এভাবে। সেই কোন ছোটবেলা থেকে জেনে আসছি যে বিদেশি দল অস্ট্রেলিয়াতে নামলে তাকে প্রথম স্বাগত জানানো হত ওয়াকায়। লাইলাক হিল ইলেভেন বা এসিবি চেয়ারম্যান'স ইলেভেন বনাম ট্যুরিং টিমের প্র্যাকটিস ম্যাচ। তাতে যে দল খেলতে নামতো তারা একটা আন্দাজ পেয়ে যেত বাকি সফরে কতখানি সুমধুর আতিথেয়তা তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। প্রথম দুটো টেস্ট অবশ্যই ওয়াকা আর ব্রিসবেনে হত। বিদেশি দলকে পেস আর বাউন্সে নাকানিচোবানি খাইয়ে তাদের মনোবল দুমড়ে-মুচড়ে আস্তে আস্তে অপেক্ষাকৃত কম কঠিন পিচ যেমন মেলবোর্নে ফেলা হত। অথবা অ্যাডিলেডে। ততক্ষণে সিরিজের কন্ট্রোল নিজেদের হাতে নিয়ে নিয়েছে অজিরা।

সেবারে প্রথম টেস্টটাই শুরু হয়েছিলো বক্সিং ডেতে, মেলবোর্নে। এ ঘটনা আগে দেখিনি। ব্রিসবেনে কোনো টেস্ট ফেলাই হয়নি। পার্থে ছিলো তিন নম্বর টেস্ট। প্রথমে এই ফিক্সচার দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। এমনকি লাইলাক হিলের বিরুদ্ধেও ওই প্র্যাকটিশ ম্যাচটা ছিল না। আজ মনে হয়, ভারত হয়ত ওয়াকায় নেমেছিলো ০-২ অবস্থায়। কিন্ত কোনভাবে তার আগে প্রয়োজনীয় আত্নবিশ্বাস তারা পেয়ে গিয়েছিলো। ব্রিসবেন নয়। পার্থকে বলা হত অস্ট্রেলিয়ার দুর্ভেদ্য দুর্গ। পার্থে কিছু করে দেখানো মানে আপনি জাতে উঠে গেলেন । শচীন যেমন। ১৯৯১-৯২তে প্রথম অজি সফরে পার্থের ১১৪কে আজো সবার আগে রাখেন। আর তাই এতদিন ধরে প্রথমেই সেই সম্ভাবনা সমূলে নষ্ট করে দিয়ে এসেছে অজিরা। ফ্লাইট থেকে নামো। আর পেস এবং বাউন্সের কড়াইতে ভাজাভাজা হও। আজ ফিরে তাকালে মনে হয় তবে কি বাড়তি আত্নবিশ্বাস পন্টিংদের সুখের বাসরে কালনাগিনী হয়ে ঢুকে গেলো? না হলে এহেন ফিক্সচার কেন? ভেবে ভারি অদ্ভুত লাগে। সেই বছরে আরো একবার অজিরা এই মাঠে হারে। এবারে বিপক্ষ ছিলো দক্ষিণ আফ্রিকা। গত দশ বছরের হিসেব বলছে পার্থ এখন অজিদের কাছে হানিমুন গ্রাউন্ড নয়। গ্রাউন্ড অফ নাইটমেয়ার। যেখানে এখন দুর্গরক্ষা করাই তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে উঠেছে।

 

শেষের কথাঃ

ইডেনের ওই খেলা ১৪০ বছরের ইতিহাসে মাত্র তিনবার দেখা গেছে। আমার কাছে ইডেন টেস্ট এক এমন স্তরের, যাকে দূর থেকে অনুভব করা যেতে পারে। ছোঁয়া অসম্ভব। ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাসের লিমিট-এর মতন। লক্ষ্মণ, রাহুল, হরভজনদের পারফরমেন্স যেন একেকটা টেমপ্লেট। সেসব কেবল “ভরা থাক স্মৃতিসুধায়”। জীবনের কোন অখন্ড অবসরে ইচ্ছে মতন হৃদয়ের হার্ড ডিস্কে পার্মানেন্টলি সেভড সেই ভিডিওগুচ্ছ অন করে নেবো।

কিন্ত তার বাইরে?

সেখানে গড়পরতা যেসব খেলা সাধারণত দেখে থাকি তাতে পার্থের জয়কেই সেরা মনে হয়েছে। আজ থেকে আরও অনেকদিন বাদে কোন ক্রিকেট ঐতিহাসিক যদি ভারতের সেরা টেস্ট জয়গুলি নিয়ে লিখতে বসেন তবে তাঁর হয়ত মনে হবে যে খেলাটা শুধু মাঠেই হয়নি। মানসিকভাবেও মাঠের বাইরে একটা যুদ্ধ চলেছিল। আগের টেস্টে অন্যায়ভাবে পায়ের তলায় পিষে মারার পরে ওয়াকার বাইশ গজে অজিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার, মারের বিরুদ্ধে পাল্টা মার দেওয়ার কাহিনি মঞ্চস্থ হয়েছিলো ১৬-১৯ জানুয়ারী,২০০৮-এ। হরভজন হয়ত খাতায় কলমে সিডনি টেস্টের তিন টেস্ট বাদে ছাড়া পেয়েছিলেন। কিন্ত খেলা শেষ হওয়া মাত্রই জাতীয় পতাকা নিয়ে তাঁর দৌড় বোধহয় এটাই প্রমাণ করে যে আসলে বিনা অপরাধে গারদে ঢোকার শাস্তি থেকে তিনি ওয়াকাতেই মুক্ত হলেন। মুক্ত করলেন তাঁর দলের বাকি সবাই। বাইশ গজ যে অন্যায় বরদাস্ত করে না।

আর ঐ লেখাটা?

সেই ক্রিকেট ঐতিহাসিকের লেখার প্রথম লাইনটা হয়ত এরকম হতে পারে - সে এক টেস্ট যে ছিলো বটে!



তথ্যসূত্রঃ
www.espncricinfo.com
https://www.scoopwhoop.com/Throwback-India-Australia-Perth-Test-Match-2008/
"India halts Australian juggernaut once again". The Hindu. Chennai, India. 20 January 2008.
"'My best win ever' - Kumble". ESPNcricinfo. 19 January 2008
Picture Courtesy: www.gettyimages.com/event/third-test-australia-v-india-day-3-77566953



লেখক পরিচিতি -পেশায় অর্থনীতির অধ্যাপক। ন'হাটা কলেজে কর্মরত। লেখালেখি নিয়ে চিন্তাভাবনার শুরু ২০১০-এ। প্রথম উপন্যাস 'জগতরত্ন রক্তনীল' আনন্দমেলায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় ২০১৪-২০১৫ সালে। ক্রিকেট নিয়ে লেখালেখিতে আগ্রহী। ফেসবুকে এ ব্যাপারে নিজস্ব পেজ 'বাইশ গজের ডাইরি'তে নিয়মিত লিখে থাকেন।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2015 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।