প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিবিধ প্রসঙ্গ

সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৬

 

দৈলিপী।

সুমিত রায়


দৈলিপী? দৈলিপী??

কি, ধাঁধায় পড়ে গেলেন তো? দৈলিপী চলন, দৈলিপী বলন! 
তাতেও ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে না। এই দেখুন 'দিলীপ' শব্দ, তাতে ষ্ণিক্‌জাতীয় কোনো প্রত্যয়, এই হলো দৈলিপী [দিলীপকুমারের বানান]।

আর সেই দিলীপ হলেন দিলীপকুমার রায়। বাংলার প্রখ্যাত নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র, দিলীপকুমার, একসময়ে দিলীপ রায় (পণ্ডিচেরী) বলেও তাঁর পরিচয় দেওয়া হতো। ডাকনাম মণ্টু, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে এই বলেই ডাকতেন।

দৈলিপী বিশেষণটা তাঁর নিজেরই সৃষ্টি। ভেবে দেখুন একবার। আমরা রাবীন্দ্রিক কথাটা শুনেছি। যতোদূর জানি এ কথাটি রবীন্দ্রনাথের নিজের সৃষ্টি নয়, অনুরাগীকুলের কেউ প্রথম তৈরী করে ব্যবহার করেন তারপর বিশেষণটি লেগে যায়। আমরা কিন্তু নাজরুলিক শুনিনি, বঙ্কিমী আছে বটে, কিন্তু শরচ্চান্দ্রেয় নেই। এমন বিশেষ বিশেষণ সৃষ্টি করার এবং সেই বিশেষণে বিশিষ্ট হবার মতোই মানুষ ছিলেন তিনি একসময়ে। সুদর্শন, সুশিক্ষিত, সুভাষ, সুকণ্ঠ, সুলেখক -- বিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে তিনি ছিলেন চোখ-ধাঁধানো ঔজ্জ্বল্যে দীপ্যমান এক তরুণ। সঙ্গীতে যদি রাবীন্দ্রিক সৌক্ষ্ম থাকতে পারে, আর বলনে রাবীন্দ্রিক সৌকর্য, তাহলে তানে দৈলিপী চমক আর চলনে দৈলিপী আভিজাত্য স্বীকার করতে আমাদের কোনো ক্লেশ হবার কথা নয়।

দিলীপ রায়

দিলীপকুমারের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় প্রায় সাত দশক আগে। আমার বয়স যখন আট-দশ হবে, দিলীপকুমার পঞ্চাশ ছুঁচ্ছেন। ঠাকুরদা আমার নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ, যদিও বৈষ্ণব ভাবাপন্ন, ভক্তিগীতিতে বিশেষ আসক্ত, তা সে ভজন, কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত যাই হোক, ভক্তি থাকলেই চলবে। সাল ১৯৪৭ হবে, এক রবিবার দুপুরে ঠাকুরদা বড় নাতিকে নিয়ে গানের আসরে গেলেন। এমনটি প্রায়ই হতো, বিশেষ করে পালাকীর্তনের আসরে। এবারে শুনলাম গাইবেন ভারী এলেমদার লোক, দ্বিজুবাবুর ছেলে (দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ছিলেন ঠাকুরদার প্রিয়, বিশেষ করে হাসির গান নিয়ে) দিলীপ রায়। মনে হয় কোনো বড় বাড়ীতে, রায়বাহাদুর খগেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়ী হতে পারে (সম্প্রতি এখানে '৬ বালিগঞ্জ প্লেস' নামের একটা রেস্টুরেন্ট চালু হয়েছে), এমন সব আসরের ব্যবস্থা করায় তাঁর খ্যাতি ছিলো। এতোদিন পরে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া টুকরো টুকরো ছবির মধ্যে কিন্তু পরিষ্কার মনে আছে দিলীপকুমারের আনন্দোজ্জ্বল সৌম্য চেহারা আর অনেক গানের মধ্যে প্রায় পূর্ণ গরিমায় মনে আছে একটি গান -- "রাঙাজবা কে দিল তোর পায় মুঠো মুঠো"। তখন গানের কৌশল বা সুরের খেলা কীই বা বুঝি কিন্তু এটা বুঝি এই যে "জবা"-র শেষ পৌঁছতে চায় না "কে দিল"-তে, "মা"-র পরে "বলে" আর বলা হয়ে উঠছে না, এখানে কিছু একটা ঘটে চলেছে যা নিঃসন্দেহে প্রাণকাড়া। পরে খবর করে জেনেছি গিরিশ ঘোষ-রচিত এই গানটি দিলীপকুমারের প্রথম রেকর্ড হয়ে প্রকাশিত হয় ১৯২৫ সালে। সুরটাকে বলা হয় প্রচলিত, তবে দিলীপকুমারের গলায় সে গানের হতো দৈলিপী-চলন, সেই চলনের প্রচলন করার মতো জোর গলা পাওয়া ছিলো দুষ্কর। এ গান যখন প্রথম প্রকাশিত হয় তখন দিলীপকুমার চশমা পরতেন এক বিশেষ ধরণের। তো এই গানের সঙ্গে সঙ্গে সেই দৈলিপী চশমার ফ্রেমও "রাঙাজবা ফ্রেম" নাম নিয়ে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিলো, এমন গল্পকথা আছে। প্রসঙ্গত, ওই ১৯৪৭ সালটাও ঠিক, সে বছরই তাঁর পঞ্চাশতম জয়ন্তী উপলক্ষ্যে কলকাতাবাসীরা তাঁকে বেশ ঘটা করে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন, সে কারণে কলকাতায় এসে তিনি কিছুদিন কাটিয়ে আর জলসায় গান গেয়ে আবার পণ্ডিচেরী ফিরে যান। আমরা সে রকমই কোনো জলসায় যাবার সুযোগ পেয়েছিলাম।

এই গানটি নিয়ে আমার জীবনে এক আশ্চর্য সমাপতন আছে। আমার বাবাও প্রথম দিলীপকুমারকে দেখেছিলেন আর যে গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন, সেটিও এই গান। তাঁর আত্মকথা থেকে এই উদ্ধৃতি দেবার লোভ সামলানো গেলো না। তিনি লিখছেন, 

"ওই সময় [১৯৩০-এর কাছাকাছি হবে] স্কুলে একটা অপূর্ব অভিজ্ঞতা হয়েছিল মনে আছে। দিলীপকুমার রায় মশায়ের গান শুনেছিলাম। ... সেই অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ে—দিলীপকুমার-এর অসম্ভব সুন্দর চেহারা, আর তাঁর কণ্ঠে কত গান। তার মধ্যে একটি গান ‘রাঙা জবা কে দিল তোর পায় মুঠো মুঠো’—সেই গানের আসরে এক অনাস্বাদিত প্রশান্তিতে আমার বালকমন ভরে গিয়েছিল। " [১] 

প্রায় দুদশকের ব্যবধানে একই গানের জোরে তিন প্রজন্মকে দিলীপকুমার জোর নাড়া দিয়ে গেলেন। অবশ্য গানের রাজ্যে তিনি যে মাপের ঐন্দ্রজালিক ছিলেন, তাঁর পক্ষে এটা বিলক্ষণ সম্ভব।

 স্কুলে থাকতে থাকতেই দিলীপকুমার আমার মজ্জায় ঢুকে গেলেন, সাক্ষাতে নয়, কলের গান মারফৎ। মামার বাড়ীতে অকৃতদার ভাড়াটে ছিলেন বিভুমামা, সায়েব কোম্পানীর বড়োবাবু, মাইনে পেতেন ভালো, নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ, বেশী খাইখরচের বালাই নেই। খরচ করতেন অগণতি সিনেমা দেখে আর কলের গানের রেকর্ড কিনে। গভীর অপত্যস্নেহে দেখতেন আমাদের ভাইদের, শনি-রবিবার দুপুরে ভাতঘুম কাটলেই কলের গান চালিয়ে শোনাতেন। সেখানে একদিন প্রথম শুনলাম দিলীপকুমারের 'তুনে কেয়া কিয়া মুঝে বতা দো সহী", শুধু একবার নয়, বারবার, যতোক্ষণ না বিভুমামা বিদ্রোহ করে গানের কল বন্ধ করলেন। মনে রাখতে হবে কলের গান, অর্থাৎ স্বর আসছে চোঙার ভিতর দিয়ে, কথা এমনিতেই বোঝা দায়, তার ওপর দৈলিপী উচ্চারণ। তাছাড়া এসব ভাব বোঝার বয়সও নয় তখন, তবু দিলীপকুমারের 'বহর খুদা মুঝে কতল করো"-র নিখুঁত উচ্চারণ আর বত্রিশ মাত্রার তিন সপ্তক ঘুরে আসা তান -- সব মিলে এখানে যে গভীর কিছু একটা বলা হলো সেটা বুঝতে অসুবিধে হয়নি। তারপর "কুঞ্জন বন ছাড়ি ", "সেই বৃন্দাবনের লীলা অভিরাম", "তোমার আঁধারনিশাই", শুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারণে শিহরণ-জাগানো "ন তাত ন মাতা" -- দিলীপকুমারের সৃষ্টিক্ষমতায় তখন বান ডেকেছে -- বিভুমামার কল্যাণে দিলীপকুমার আমার অন্তরের গভীরে পৌঁছে বসে রইলেন। [এখানে উল্লেখ করা সব গানের লিঙ্ক পাওয়া যাবে এইখানে এবং   এইখানে]

দিলীপকুমারকে সাক্ষাৎ দেখেছি আর মাত্র একবার। সত্তরের দশকে দেশে এসে দালাই লামার অভ্যর্থনায় এক জলসায় দিলীপকুমার আসেন, তার একটা টিকিট জোগাড় করা গিয়েছিলো। তখন তাঁর গলা বেশ ভারী হয়েছে, ভীমসেন যোশীর যেমনটি হয়েছিলো সেই কথা আমার মনে পড়ে। দিলীপকুমারের গানের অভিব্যাক্তিতে, এক্সপ্রেশনে, তখন গভীরতা এসেছে আরো, দৈলিপী তান আছে বটে, কিন্তু সংখ্যায় কম আর কম সেই ফুলঝুরির চমকও। অনেকক্ষণ গাইলেন, সবই ভজন, আর অঝোরে কাঁদলেন, তখন তিনি পূর্ণমাত্রার সাধক। সমঝদারেরা বিরক্ত হবেন, আমার মন কিন্তু ব্যাকুল হয়েছিল সেই পুরোনো দৈলিপী চলনের জন্য। রবীন্দ্রশতবার্ষিকীতে কলকাতায় এসেছিলেন, গেয়েছিলেন, বিপুল আকাঙ্ক্ষা ছিলো দেখার আর শোনার, বিশেষত তা যখন দিলীপকুমার এবং তা রবীন্দ্রসঙ্গীত ঘিরে. ভাগ্যবিপর্যয়ে ঘটে ওঠেনি। প্রত্যক্ষদর্শী কাউকে খুঁজেও পাইনা যে কিছু বিবরণ জেনে নেবো। অদৃষ্ট!

তারপর থেকে দিলীপকুমার মাঝে মাঝে আমার ওপর ভর করেন। আমিও প্রশ্রয় দিই কেননা সাধারণত দিলীপকুমার যখন ভর করেন তখন আমি রোগক্লিষ্ট। যথা সাম্প্রতিক দুষ্ট গলব্লাডার নিয়ে কষ্ট পাবার কালে। তিনি হঠাৎ এসে উপস্থিত হন, একের পর এক তাঁর গান আমার মাথায় ঘুরতে থাকে। রোগযন্ত্রণার মধ্যে সেটা মন্দ নয়, মনকে অন্যদিকে ব্যস্ত করে রাখে, কষ্টটা লাগে কম। হাসপাতাল থেকে বাড়ী আসার পর বা অপেক্ষাকৃত সুস্থ হলে যখন গানগুলো বাজিয়ে শুনতে পারি তখনই হয় মুস্কিল, শুধু আমার নয়, আমার চারধারের লোকেদেরও, কেননা দিলীপকুমার তখন আর থামতে চান না। হয়তো চারটি কী পাঁচটি গান, তিনচার হপ্তা ধরে তাই বারবার বাজিয়ে আর আশ মেটে না, মাথায় সব সময় ওই তানকারী ঘুরছে, "বাড়ীর কর্ত্রী রুক্ষমূর্তি"। তারপর একদিন যেমন এসেছিলেন তেমন নেমে যান, যাবার সময় রোগভোগের কষ্টটা সব না হোক, কিছুটা নিয়ে যান। তাই বা কম কী, তাই দিলীপকুমারের ওপর ঠিক রাগ করে উঠতে পারি না। প্রসঙ্গত রবীন্দ্রনাথেরও এমন বদ অভ্যাস আছে, আমার ওপর ভর করার, বিশেষ করে দুঃখের দিনে, তবে তাঁর গান নিজের মাথার মধ্যে গেয়েই কাজ চালানো যায়, উচ্চৈঃস্বরে পাড়া কাঁপিয়ে শুনতে হয় না। এ নিয়ে পরে আরো কিছু বলা যাবে। সম্প্রতি ইউটিউব আর কিছু দিলীপ-আসক্তদের কৃপায় বহু দৈলিপী সঙ্গীত হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে। প্রযুক্তির অশেষ কৃপা!

গান তাঁর বংশাণুগত, দিলীপকুমার এমনই লিখছেন। আত্মজীবনীমূলক " স্মৃতিচারণ" বই শুরু করেছেন ঠাকুরদা কার্তিকেয়চন্দ্র রায়ের কথা বলে। কার্তিকেয়চন্দ্র নদীয়ারাজের দেওয়ান হিসেবে নাম কিনেছিলেন, কিন্তু তার বদলে দিলীপকুমার প্রথমেই লিখেছেন তাঁর সঙ্গীতপ্রতিভার কথা, তিনি ওস্তাদী গান গাইতেন, বাংলা গান লিখতেন, সুর দিতেন, গাইতেন, বই করে ছাপাও হয়েছিলো। পিতা দ্বিজেন্দ্রলালের গলা ছিলো "দরাজ আর মধুর", তবে তিনি ছিলেন গায়কের থেকে বেশী সুরকার (composer শব্দের আরো বিস্তৃত অর্থে সুরকার কথাটা প্রথম দিলীপকুমার ব্যবহার করেন -- গায়ক "গানের জাতিধর্মকে ফুটিয়ে তোলে", সুরকার সুরবৈশিষ্ট্যকে [২])। দিলীপকুমারে এই দুইয়ের মেলবন্ধন হয়েছিলো। "স্মৃতিচারণ" বইতে দিলীপকুমার তাঁর পিতার সঙ্গীতপ্রতিভার যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে পরবর্তীকালে দিলীপকুমার কেমন সঙ্গীতজ্ঞ হবেন তার পূর্বাভাস পরিষ্কার। বড়ো হলেন পাগলের মতো গান শুনে (জানকী বাইয়ের গান শুনতে গিয়ে ম্যাট্রিকে প্রথম শ্রেণীর জলপানিটা ফসকে যায়), বাবা, গ্রামোফোন রেকর্ড, আর স্থানীয় ওস্তাদদের কাছে গান শিখে। ভগবদ্দত্ত স্মৃতিশক্তি ছিলো, যাকে প্রডিজি বলে তাই, সুরলয়ে ভুল হতো না।

কেম্ব্রিজে স্নাতক হবার জন্য দিলীপকুমার দেশ ছাড়লেন ১৯১৯ সালে, ফিরে এলেন ১৯২২ সালে। এর মধ্যে তিনি পাশ্চাত্যসঙ্গীত শুনবেন আর শিখবেন বলে সারা ইউরোপ ঘোরেন। তার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ভারতীয় সঙ্গীতের প্রচার করতেও ব্রতী হয়েছিলেন নানা গানের আসর আর বক্তৃতার মারফৎ। এমন অনুষ্ঠানে প্রচলিত গান তো হতোই, এছাড়াও তিনি অনেক সংস্কৃত শ্লোক আর স্তোত্রতে সুর লাগিয়ে গাইতেন। এর ফলে বিদেশে তাঁর খ্যাতি হয়েছিলো খুব আর দেশে ফেরার পর গায়ক হিসেবে সেই খ্যাতিই খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ে। লিখছেন: "শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে আমি দেখতে দেখতে জনপ্রিয় গায়ক হয়ে উঠলাম -- বিশেষ করে নানা সভায় কংগ্রেসে গান করে। " প্রথম দিকের অনুষ্ঠানে তিনি হয় হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত -- খেয়াল, ঠুংরি, গজল -- বা অন্যের রচিত বা প্রচলিত কথা আর সুরের গানই গাইতেন, তবে সবসময়েই তাঁর অসাধারণ আলাপ আর তানকারীর প্রয়োগে সেসব গান দৈলিপী গান হয়ে দাঁড়াতো। উদাহরণ কাজী নজরুল আর অতুলপ্রসাদের গান। দ্বিজেন্দ্রগীতি তো ছিলোই।

দেশে ফেরার পরই দিলীপকুমার ভারত পর্যটনে বার হন, সেই ভ্রমণের বৃত্তান্ত লিখেছেন তাঁর "ভ্রাম্যমাণ" বইতে। এই পর্যটনের উদ্দেশ্যটা একটু বিচিত্র, বইটির ভূমিকায় প্রমথ চৌধুরীর ভাষায়: "শ্রীমান্‌ দিলীপ দেশ দেখতে যাননি, গিয়েছিলেন শুধু গান শুনতে। " আরো বলছেন, "দিলীপকুমার দেদার ওস্তাদের সাক্ষাৎ পেয়েছেন, কিন্তু দুই চারটি ছাড়া আর্টিস্টের সাক্ষাৎ পাননি।"  অবশ্য যা পেয়েছেন তা খুব কম নয়, -- আবদুল করিম, ফৈয়াজ খান, চন্দন চৌবে, ভাতখণ্ডে প্রমুখ -- এবং তাঁদের কাছ থেকে শিক্ষাও নিয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশী লাভ হয়েছে যেটি, সেটি হলো সঙ্গীত আর আর্ট সম্বন্ধে, কী করলে সঙ্গীত আর্ট হয়ে দাঁড়ায় সেই সম্বন্ধে তাঁর ঘনীভূত চিন্তা। তারই প্রভাব টেনে তিনি তখন থেকে তাঁর গানে আর সুরে নানা বৈচিত্র্য আনতে শুরু করলেন। তার মধ্যে একটা হলো দেশী রাগের সঙ্গে পাশ্চাত্য সুরের মিশ্রণ, কিছু উদাহরণ এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না: 'মা তোর ঐ হাসি' (ইতালীয়), 'ঘুম যাই মা' (জার্মান ঘুমপাড়ানি), 'আকুলি সদাই' (রুশ জিপসি), 'ভারতরাত্রি প্রভাতিল' (ফরাসী জাতীয়সঙ্গীত 'মার্সাই'), 'বুলবুল মন' (জার্মান), 'ধাও প্রাণ' (রুশ)। আরো অনেক।

সাহানা দেবীর সঙ্গে

১৯২২ সালে গয়ায় কংগ্রেস অধিবেশনে গান গাইতে গিয়ে দিলীপকুমার সাহানা দেবীর (ঝুনু) গান শোনেন, শুনে মুগ্ধ হন। সাহানা দেবী তখন গায়িকা হিসেবে নাম করছেন, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের গান করে। সাহানা দেবীও ছিলেন দিলীপকুমারের মতো সঙ্গীতঅন্তপ্রাণ, কাজেই দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে দেরী হয়নি। দিলীপকুমার সাহানাকে গান শেখাতে আরম্ভ করেন, বিশেষত তাঁর নিজের সৃষ্ট গান, তাঁর সঙ্গে নানান আসরে সাহানা সেসব গান গেয়ে খ্যাতিলাভ করেন। সাহানার গলায় বিশেষ খোলে সেকথা ভেবে সেসময় অনেক গান দিলীপকুমার রচনা করেছেন। অনেকটা অমিতা সেনের (খুকু) কথা ভেবে রচিত রবীন্দ্রসঙ্গীতের কথা মনে পড়ে যায়। যাঁরা রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে চর্চা করেন তাঁদের "চিরসখা হে"-র মতো গানের কথা মনে পড়তে পারে। তাঁর গান কণ্ঠে নিতে পারে, দিলীপকুমার সবসময় এমন মানুষের খোঁজ করতেন। সেই সন্ধানে চরম সাফল্য এসেছিলো আরো কয়েক বছর পরে। ১৯২৫ সালে দিলীপকুমার প্রথম রেকর্ড করলেন, একদিকে "রাঙাজবা কে দিল তোর পায়", যার কথা আগে বলেছি আর অন্যদিকে দ্বিজেন্দ্রগীতি "ছিল বসি কুসুমকাননে"।

তখন গায়ক বলে তো বটেই, সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবেও দিলীপকুমারর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিলো। শান্তিনিকেতনের জন্য রবীন্দ্রনাথ আর বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির জন্য মদনমোহন মালব্য, দুজনেই দিলীপকুমারকে আহ্বান জানান সঙ্গীতশিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে। দিলীপকুমার পায়ে শিকলি পরতে রাজী নন, তিনি সে আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯২৭ সালে আমেরিকা থেকে তাঁর ডাক আসে, সেখানে গিয়ে কিছু গান রেকর্ড করার। দিলীপকুমার যাত্রা শুরু করলেন, ফ্রান্সের নিস শহরে আর ইংল্যাণ্ডে লণ্ডন আর এডিনবরায় গানের জলসা করলেন, ভারতীয় সঙ্গীত নিয়ে বক্তৃতা দিলেন। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে বৈরাগ্যের যে দ্বন্দ্ব তাঁর মনে চলছিলো তা প্রবল হয়ে উঠলো, তিনি আমেরিকা না গিয়ে দেশেই ফিরে এলেন।

১৯২৮ সালে শ্রীঅরবিন্দের সাক্ষাৎ পেয়ে দিলীপকুমার অভিভূত হয়ে তাঁকে গুরু বলে মেনে পণ্ডিচেরীতে তাঁর আশ্রমে যোগ দিলেন। প্রসঙ্গত ওই একই সময়ে সাহানা দেবীও আশ্রমে আসেন। তখন আশ্রমবাস ছিলো প্রায় অজ্ঞাতবাসের মতো,কাজেই ওঁরা দুজনেই সাধারণের চোখের আড়ালে চলে গেলেন। সুখের কথা এই যে শ্রীঅরবিন্দ ও মাদার তাঁর সঙ্গীত প্রচারকর্মে নেতি করে দিলেও সঙ্গীত সৃজনের পথে বাধা দিলেন না। যোগজীবন নেবার পর তাঁর মন সরে যায় ওস্তাদি গানের দিক থেকে -- যথা, "আবদুল করিমের কণ্ঠস্বরের আশ্চর্য কালোয়াতি আমার মনে বিস্ময জাগালেও এমন কোনো রসাবেশ জাগাতে পারেনি যাতে আমার হৃদয় সাড়া দিতে পারে। " তার ফল হলো দুটি। প্রথম, দিলীপকুমার সব ছেড়ে এখন ভক্তি গীতিতে মন দিলেন, সুর নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষাও ছাড়লেন না। তাঁর গীতিরচনা এক নির্দিষ্ট খাতে বাঁধা পড়লো বটে কিন্তু শ্রীঅরবিন্দের সহায়তায় গানের বাণীতে আরো উৎকর্ষ এলো। বৈচিত্র্য আনার জন্য তিনি বেশ কিছু প্রচলিত ভজন, -- যথা, মীরা, কবীর, সুরদাস --বাংলায় রূপান্তরিত করলেন। বাংলায় ভক্তিমূলক গান অনেক ছিলো, কিন্তু ঠিক ভজন বলতে যা বোঝায় তা ছিলো না, দিলীপকুমার সেই অভাব পূরণ করলেন। এই মুহূর্তে একটা মনে পড়ছে: মীরাবাইয়ের 'গিরিধর আগে নাচুঙ্গি' থেকে লিখলেন 'আমি গিরিধারীর নয়নতলে নাচিবো'। সংস্কৃত স্তোত্র তো রইলোই। আর তিনি সখ্য পাতালেন সাধক-নিশিকান্ত বলে খ্যাত একজন আশ্রম-আবাসিকের সঙ্গে। শ্রীঅরবিন্দ ও মাদারের স্তুতিতে নিশিকান্ত অজস্র গীত রচনা করলেন আর অনুপ্রাণিত দিলীপকুমার তাতে সুর লাগালেন -- তাঁর শ্রেষ্ঠ গানের অনেকগুলিরই -- যথা 'পূজা আমার সাঙ্গ হলো', 'এই পৃথিবীর পথের পরে', 'তোমার আঁধারনিশাই', 'জ্বলবার মন্ত্র দিলে' -- এভাবে সৃষ্টি।

উমা বসুর সঙ্গে

১৯৩৭ সালে গুরুর অনুমতি নিয়ে দিলীপকুমার কলকাতায় এলেন, এসেই গানের জগতে আলোড়ন তুলে দিলেন। আসর তো হলোই, এইচ-এম-ভি থেকে তাঁর গানের রেকর্ডও একের পর এক বার হতে লাগলো, বিশেষ করে মাত্রাহীনভাবে জনপ্রিয় ভৈরবী কীর্তন, "সেই বৃন্দাবনের লীলা অভিরাম"। দিলেন যেমন, পেলেনও যা তাঁর বহুদিনের প্রার্থিত-- পেলেন ছাত্রী উমা বসুকে, ডাকনাম হাসি, যাঁর কণ্ঠে দিলীপকুমার তাঁর সৃষ্ট সুর ধরে রাখতে পারবেন। হরেন চট্টোপাধ্যায়ের কাছে উমা গান শিখে কয়েকটা রেকর্ডও করেছিলেন, তাঁর বয়স তখন ষোলো। "গান তো অনেক শোনা যায়, কিন্তু এমন কণ্ঠলাবণ্য! মাধুর্যে পরিপূর্ণ সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর কোনো নারীর এর আগে শুনিনি" -- লিখছেন গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়। কন্যাস্থানীয়া উমাকে দিলীপকুমার তাঁর ভাণ্ডার থেকে সব উজাড় করে দিয়েছিলেন, তখন তিনি গান বেঁধেছেন শুধু উমার গলায় ফোটার কথা মনে রেখে। উমাকে নিয়ে সারা ভারত গানের আসর করে বেড়িয়েছেন, উমাও তার প্রতিদান দিয়েছেন সর্বস্থানে প্রশংসা কুড়িয়ে। ১৯৪২ সালে উমার অকলমৃত্যু পর্যন্ত এই সময়টা দিলীপকুমারের সঙ্গীতজীবনে শ্রেষ্ঠ সময় বলা যায়। তাঁদের দুজনের এই সময়ের জনপ্রিয় গান আর রেকর্ডের তালিকার এখানে স্থান সংকুলান হবে না। কেবল বলি দিলীপকুমারের তত্ত্বাবধানে উমার প্রথম রেকর্ডের একটি গান ছিলো বিখ্যাত রামপ্রসাদী "মন তুমি কৃষি কাজ জানোনা" -- গাওয়া হয়েছে দৈলিপী সুরে, যাঁরা শুনেছেন তাঁরা ভুলতে পারেননি।

উমার মৃত্যুর পর দিলীপকুমার ভেঙে পড়েছিলেন কিন্তু আবার শক্ত হয়ে গানের জগতে ফেরৎ এলেন, এবার মন দিলেন চ্যারিটি শো করে পণ্ডিচেরী আশ্রমের জন্য অর্থসংগ্রহে। ইতিমধ্যে ভারতীয় সঙ্গীত, বিশেষত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ওপর দুটি বইও লিখেছেন --'গীতশ্রী' আর 'সাঙ্গীতিকী', তাতে সঙ্গীত নিয়ে তাঁর তত্ত্বমূলক চিন্তাও লিপিবদ্ধ হয়েছে। 'হাসি'কে আর পাচ্ছেন না কিন্তু গান শেখাচ্ছেন -- এম এস সুব্বুলক্ষ্মীকে মীরা ভজন, মঞ্জু গুপ্তাকে অতুলপ্রসাদী। "মীরা" চলচ্চিত্রে দিলীপকুমারের সুরে সুব্বুলক্ষ্মী মীরা ভজন গাইলেন, কর্ণাটিক সঙ্গীতে মীড়ের স্থান কম, তাই দিলীপকুমার শুধু সুরের হেরফের করে বিস্তার করলেন তাঁর জাদু, এম-এসের কিন্নরীকণ্ঠে কর্ণাটিক ট্রেমেলোগন্ধী সেসব গান আজও রসিকদের রোমাঞ্চ আনে। ইউটিউব থেকে "মোরে তো গিরিধর গোপাল" শুনে যাচাই করে নিতে পারেন।

১৯৪৬ সালে মধ্যপ্রদেশ থেকে জনককুমারী নামে এক মহিলা স্বপ্নাদ্য আদেশ পেয়ে পণ্ডিচেরীতে আসেন দিলীপকুমারের কাছে দীক্ষা নেবার জন্য। দিলীপকুমার তাঁকে দীক্ষা দেন ১৯৪৯ সালে, নতুন নাম দেন ইন্দিরা দেবী। ইন্দিরা দেবীর কিছু অলৌকিক ক্ষমতা ছিলো, তিনি দীর্ঘ সমাধিতে থাকতে পারতেন আর তখন তাঁর মতে মীরাবাই স্বয়ং এসে তাঁকে ভজনের বাণী শিখিয়ে যেতেন। পরে দিলীপকুমার সেই বাণীতে সুর দিতেন। এ নিয়ে সুব্বুলক্ষ্মীর পৌত্র এক সুন্দর বিবরণ লিখেছেন:

"কল্কি গার্ডেনসে বসে সমাধিস্থা দিদির [ইন্দিরাকে অনেকে দিদি বা দিদিজী বলে ডাকতেন] মুখ থেকে এই গানটির বাণী [হে গোবিন্দ হে গোপাল] ঝর্ণার মতো ঝরে পড়ছে, যেন তিনি গোবিন্দের সঙ্গে কথা বলছেন। আমার মা রাধা বিশ্বনাথন সেই বাণী লিখে নিয়ে দিলীপকুমারকে দিয়েছেন, দিলীপকুমার সেই গীতিতে সুর দিয়ে আমার ঠাকুমা এম এস সুব্বুলক্ষ্মীকে শিখিয়েছেন।"

দিলীপকুমারের গণনায় তিনি এভাবে প্রায় সাত-আটশো গান পেয়েছেন, সুর দিয়েছেন, এইভাবে পাওয়া গানের নাম দিয়েছেন মীরাভজন। সেগুলোকে আবার বাংলায় অনুবাদ করে সুর দিয়ে গাইতেনও, ছটি সঙ্কলনও প্রকাশ করেছেন।

আমেরিকা থেকে বক্তৃতা করার আমন্ত্রণ পেয়ে ইন্দিরাকে সঙ্গে নিয়ে দিলীপকুমার ১৯৫৩ সালে আমেরিকা তথা বিশ্বভ্রমণে বার হন, ফেরেন প্রায় আটমাস পরে। এই ভ্রমণে গান অবশ্যই ছিলো, প্রায় সর্বত্রই অধ্যাত্মসঙ্গীত গেয়েছেন আর শ্রোতৃবর্গও উচ্ছ্বসিত হয়ে শুনেছেন। শ্রীঅরবিন্দ তখন গতাসু, কিন্তু তাঁর শিক্ষায় দিলীপকুমার ঋদ্ধ তাই ধর্ম ও দর্শন, বিশেষত শ্রীঅরবিন্দের দর্শন, নিয়ে বক্তৃতা আর আলোচনাই এই ভ্রমণপর্বটির প্রধান অংশ। সে বছরের শেষদিকে তিনি ও ইন্দিরা পণ্ডিচেরী ছেড়ে পুণে চলে যান। সেখানে দেখছি লেখাপড়ার কাজই বেশী করেছেন। ইন্দিরা দেবীর মীরাভজন তখন তাঁর গানের রাজ্যে প্রায় একাধিপ, রেকর্ডও যে তেমন কিছু হয়েছে তার সাক্ষ্য দেখিনা। তাঁদের ভক্তরা অবশ্য সেখানে ভীড় করে আসেন, তাঁদেরই সাহায্যে ১৯৫৯ সালে দিলীপকুমার পুণেতে হরিকৃষ্ণ মন্দির স্থাপন করেন। বাকী জীবন সেখানেই কাটিয়েছেন।

এই সময় গানের জগৎ থেকে দিলীপকুমার সরে যেতে থাকেন। যদিও তখনও গান লিখেছেন, সুর দিয়েছেন, গেয়েছেন কিন্তু আগের সেই দোর্দণ্ড প্রতাপ আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে এসেছে। তাঁর গানের খবর তখন থেকে আর পাওয়া যায় না বললেই হয়, যদিও অনেক পোষাকী খেতাব আর পুরস্কার, যথা সুরসুধাকর উপাধি, ডিলিট খেতাব ইত্যাদি তিনি তখন পেয়েছেন। তখন আধ্যাত্মিক চিন্তা আর ঈশ্বরদর্শনের তপস্যায় তাঁর মনপ্রাণ সমর্পিত। বিশেষ বিশেষ আসরে আমন্ত্রিত হয়ে তিনি গাইতেন, দালাই লামার সংবর্ধনা আসরে আমি যেমন দেখেছিলাম। সেখানে আমার মনে হয়েছিলো তাঁর গানে তানকর্তব আর উচ্ছ্বাস কমে এসেছে, গান হয়েছে অন্তর্মুখী, তিনি আর শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের জন্য গান করেন না। এভাবে আস্তে আস্তে তিনি আমাদের সঙ্গীতচিন্তা থেকে বিদায় নিয়েছেন, আমরা তাঁকে হারিয়ে ফেলেছি। উন্নত প্রযুক্তিতে অভ্যস্ত মানুষ তাঁর পুরনো আটাত্তর পাকের রেকর্ড আর শুনতে চায়নি, চায়নি নিছক ভক্তিগীতিতে মন ভরাতে। ১৯৮০ সালে পুণের মন্দিরেই দিলীপকুমার প্রয়াত হন।

 

গানকে আর্ট হতে হবে, এই তত্ত্ব ছিলো দিলীপকুমারের ধ্রুবক -- "গানের মধ্যে intellectual আবেদন না থাকলে গান উচ্চ সঙ্গীত হয় না। ... বুদ্ধিকে উসকে দেওয়া আর হৃদয়কে আর্দ্র করা।"  গানের মধ্যে বৈচিত্র্য এনে এই আবেদন সৃষ্টি করা যায়, আর বৈচিত্র্য আনার এক পন্থা তানালাপ, বিশেষ কারে বোলতান,  দিলীপকুমার এই বিশ্বাস করতেন -- যতোক্ষণ তা "প্রাণহীন তানালাপ নয় --একঘেয়ে মূর্চ্ছনার অনবদ্য পুনরাবৃত্তি নয়। " দিলীপকুমারের গানে অসাধারণ তানের অপ্রত্যাশিত আবির্ভাবে যাঁরা মুগ্ধ হয়েছেন তাঁরা স্বীকার করবেন যে এই বিশ্বাস তিনি খুব সফলভাবে কাজে লাগিয়েছেন। এই প্রসঙ্গ একটু টেনে বলি, দিলীপকুমার গানের সঙ্গে গায়কের নিজের হাতে হারমোনিয়াম সঙ্গতের পক্ষপাতী ছিলেন, তার বিশেষ কারণ তানে সঠিক ও দৃঢ় সহযোগিতা পাওয়া যায় বলে।

সফল সুরকার কী ভাবে এ বৈচিত্র্য আনতে পারেন তার একটা উদাহরণ দিয়েছেন তাঁর বিখ্যাত "বুলবুল মন" গানটির সুরযোজনার বিশ্লেষণ করে। রুশ গানের সুরে গাওয়া জার্মান গান ভিত্তি করে, ইমন ঠাটে সুর লাগিয়ে, খরজ বদলে, শেষে ভৈরবীর ছোঁয়া এনে, তারপর উমা বসুর কণ্ঠে নানা তানের সমাহার করে তৈরী এই গান কেসরি বাইয়ের মতো খ্যাতিমান শিল্পীর কাছেও সুখ্যাতি পেযেছিলো।

সাধারণ লোকসঙ্গীতকে দিলীপকুমার খুব একটা উচ্চ সঙ্গীত বলতেন না, "লোকশিল্পের মধ্যে হয়তো শিল্পকলা কিছু কিঞ্চিৎ থাকতে পারে কিন্তু বিকশিত অনবদ্য রূপসৃষ্টির দেখা মিলতেই পারে না। " প্রথমদিকে তাঁর কাছে কীর্তন ছিলো এই লোকসঙ্গীত গোত্রের গান, খুব একটা উৎসাহী ছিলেন না কীর্তন নিয়ে। পরে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি কীর্তনে আর্টের আরেকটি উপাদান আবিষ্কার করেন, সেটি হলো শুধু শ্রুতিমাধুর্য নয়, তাকে উত্তরণ করে ভাবমাধুর্য-- ভক্তিভাব। এদিকে হিন্দি ভজনের বাণী তাঁর কাছে লেগেছে ভাবহীন, কাজেই তাদের দৈলিপী করতে তাঁকে লাগাতে হয়েছে তান, একেবারে ঠিক পরিমিতির তান। অর্থাৎ সঙ্গীতের তত্ত্ব নিয়ে তিনি যা লিখেছিলেন ক্রিয়াতেও তার প্রয়োগ করেছেন একনিষ্ঠভাবে -- তানালাপে "বুদ্ধিকে উসকে দেওয়া" এক রকম আর বাণী ও ভাবময় গীতরীতিতে "হৃদয়কে আর্দ্র করা" আর এক রকম। শেষটির নমুনা "বৃন্দাবনের লীলা অভিরাম"।

সঙ্গীতের নানা দিক নিয়ে দিলীপকুমারের বেশ দৃঢ় মতামত ছিলো, তা নিয়ে তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে তুমুল আলোচনা আর তর্ক চালাতেন। তার মধ্যে একটি বিষয় ছিলো গায়কের স্বাধীনতা সম্পর্কিত, দিলীপকুমার মনে করতেন যে সুরকারের দেওয়া সুর গায়ক মর্জিমতো একটুআধটু বদলাতে, বিশেষ করে তান আদি অলঙ্কার প্রয়োগ করতে পারেন, এতে দোষের কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথ সে মত সমর্থন করতেন না, বিশেষ করে তাঁর নিজের গানের ক্ষেত্রে। এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে বহু তর্কবিতর্ক, চিঠি চালাচালি এবং কিছু মনোমালিন্যও হয়েছিলো। রবীন্দ্রনাথ চাইতেন না যে দিলীপকুমার তাঁর গান করেন, তা সত্ত্বেও দুয়েকবার তা রোধ করতে পারেননি, রবীন্দ্রনাথ কষ্ট পেয়েছিলেন, দিলীপকুমারেরও এ নিয়ে বদনাম হয়। সেজন্য দিলীপকুমারের কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে পাওয়া যায় না।

যাঁদের কাছে দিলীপকুমার গান শিখেছেন, তাঁর নিজের বয়ানে তাঁদের সংখ্যা ত্রিশ। শিখেছেন ধ্রুপদ, খেয়াল, ঠুংরি, গজল, টপ্পা, টপ্‌খেয়াল, কীর্তন, ভজন। সবচেয়ে বেশী ঋণী যাঁদের কাছে তাঁরা হলেন সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার, উপেন্দ্রনাথ মজুমদারের ভাইপো বকুবাবু (নাড়া বেঁধে), সুরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ওরফে সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মচারী, বামাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এই সমস্ত অঙ্গের গানই তিনি সৃষ্টি করেছেন, গেয়েছেন, গাইয়েছেন। তার মধ্যে কয়েকটি বিশেষ ধারার নাম করা প্রয়োজন। প্রথম বাংলা ভজন, বিশেষ করে প্রচলিত হিন্দি ভজনের বাংলা রূপ। মীরা ভজন ছিলো তাঁর বিশেষ প্রিয়, তাঁর ব্যক্তিগত কৃষ্ণপ্রেমের সঙ্গে এই ভজনের গভীর মিল ছিলো। বাংলা ঠুংরি হিসেবে অতুলপ্রসাদের গানের তিনি প্রচার করেছিলেন। বিদেশী সুরের ছোঁয়া-লাগা গানের কথা আগেই বলেছি। তাঁর সঙ্গীতশৈলী নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: "তোমার সুকণ্ঠে হিন্দি, গৌড়ীয় এবং কীর্তন বাউল ধারায় ত্রিবেণীসঙ্গম হয়েছে -- এর প্রভাবের কথা চিন্তা করে আমার মন আনন্দিত। " এর থেকে আরো সঠিক বর্ণনা স্বল্প পরিসরে দেওয়া সম্ভব নয়।

বাংলা গানের জগতে দিলীপকুমারের একটা অনন্য আসন পাবার কথা, তিনি গান লিখতেন, সুর দিতেন এবং, -- অনন্যতার যেটা আসল কারণ হতে পারে বলে আমার মনে হয়-- তিনিই সে গান শ্রোতাদের কাছে গেয়ে পৌঁছে দিতেন। আমরা যাঁদের বাংলা গানের দিশারী বলে থাকি, দ্বিজেন্দ্রলাল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আদি গুণীদের, তাঁদের সবাইকেই গীতিকার-সুরকার বলা যাবে কিন্তু ঠিক গায়ক বলা যাবে না। তাঁদের গান গাইতেন অন্যরা। সভাসমিতিতে অবশ্য জনতার অনুরোধে রবিবাবু গান শোনাতেন, কিন্তু তাঁর স্বকণ্ঠের গান শোনানোর জন্য কোনো জলসা হতো না। দিলীপকুমারের ক্ষেত্রে হতো। দিলীপকুমারের গান আমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন দিলীপকুমার নিজেই, কিছু ব্যতিক্রম অবশ্য আছে, তাতে নিয়মরক্ষাই হলো। তার ফলে দিলীপকুমারের গান আর দিলীপকুমারের গায়কীকে ভিন্ন করে দেখা যায় না। তার একটা উপরি পাওনা হলো যে তাঁর এক গান তিনি বারবার একই ভাবে গাইতেন না, রসিক শ্রোতার কাছে এর দাম অনেক। যদিও যাঁরা তাঁর কাছে এই গান শিখতেন, তাঁদের অবস্থা করুণ। প্রত্যক্ষদর্শী বনানী ঘোষের কাছে শোনা, গান শিখতে এসে মঞ্জু গুপ্তা কান্নাকাটি করতেন -- "ও দিলীপমামা তুমি যদি এমন সুর পাল্‌টাতে থাকো তাহলে আমরা কোন সুরে গাইবো", "তাইতো রে বেটি, ভুল হয়ে গেছে।" দুই ফেরতার পর আবার যে কে সেই। এর ওপরে দিলীপকুমার নিজের সৃষ্টি ছাড়াও আরো অনেক সুরকার, গীতিকারদের গান দৈলিপী গায়কীতে গাইতেন, তারই ভীড়ে সুরকার, সুরস্রষ্টা, দিলীপকুমার কেমন যেন হারিয়ে গেছেন বলে মনে হয়। তাঁর দেওয়া সুরে আখর-তানের সুযোগ তো আছেই, কিন্তু কাঠামোটিও যে কত বলিষ্ঠ, সূক্ষ্ম আর মধুর কারুকার্যে ভর্তি, কতো রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার নিদর্শন আছে -- সেটা সাধারণত আমাদের নজর এড়িয়ে যায়। শতকরা একশো ভাগ মিলবে না যদিও , তবু সাদৃশ্যের কথা ভাবলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নাম মনে আসা উচিত -- তিনি যে সুরকার হিসেবেও অসাধারণ সফল ছিলেন, গায়ক হেমন্তকে নিয়ে মুগ্ধ আমরা সে কথা ভুলে যাই। এর বিপরীতে আমরা যখন না-গাইয়ে সলিল চৌধুরী বা রাহুল দেববর্মণের সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা করি তার কথা ভেবে দেখুন।

একদিন দিলীপকুমার বাঙালীর মন থেকে সরে গেলেন। তবে সে তো বাঘা বাঘা কীর্তনীয়াদের নিয়ে কীর্তন গানের পুরো ধারাটাই কোথায় হারিয়ে গেলো। আপসোস হয়, জানতে ইচ্ছা হয় কেন এমন হলো। শেষের দিকের দুই দশকে যদি ওঁর গানের রেকর্ড করা থাকতো তাহলে ভালো হতো, তখন প্রযুক্তি কলের গান ছাড়িয়ে আরো উন্নত হয়েছে এবং বয়সের ভার তাঁর গানকে ব্যাহত করতে পারেনি। কিন্তু তখন তিনি অন্য রত্নের সন্ধানী। অর্থাৎ দিলীপকুমারের যে সব গান যে সব "হৃদয় আর্দ্র" করে থাকতো, সে সব হৃদয় হয় মরে গেলো নয় পাথর হয়ে গেলো, আর তার সঙ্গে সে সব গানেরও প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলো। আশ্চর্যের কথা যে বাউল কিন্তু এখনো ঠিক টিকে আছে বেশ হৃষ্টচিত্তে। প্রসঙ্গত, দ্বিজেন্দ্রলালও আজকাল কেউ গায়ও না শোনেও না, আমি তার ব্যত্যয় নয়। ভজন অবশ্য আম-ভারতবর্ষে এখনো খুব চালু, অনুপ জালোটা তো রেকর্ড বিক্রির সম্রাট। তবে ভজন ব্যাপারটা বাঙালীর ঠিক ধাতের জিনিষ নয় কাজেই সেটা টিকবে না এটা জানা কথা। বাকী রইলো "বুদ্ধিকে উসকে" দেবার গান। আমার মনে হয় সেখানে দিলীপকুমারের সর্বনাশ দিলীপকুমার নিজেই করেছেন, লোকরঞ্জক গান বেঁধেছেন বটে কিন্তু তারপর তা তাঁর ঈশ্বরদত্ত এবং অনন্য প্রতিভার বলে এমনভাবে গেয়েছেন যে আর কেউ সে গান গাইতে পারে না, সাহসও করে না। তাঁর বিখ্যাত "বৃদ্ধ হলেন" গানে কবীর সুমন গাইছেন, "ছিল দিলীপকুমার রায়ের কণ্ঠ/ সমস্ত সুর হন্তদন্ত /হারমোনিয়াম" -- সেই হন্তদন্ত আর কী! এদিকে আবার দৈলিপী সেই ইন্দ্রজাল বাদ দিলে সে সব গান আর দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। লোকে যে গান গাইতে পারে না, সে সব গান গাওয়া হয় না, আর যে সব গান গাওয়া হয় না সে সব গান আর জীবিত থাকে না। ব্যাপারটার একটু বেশী মাত্রায় সরলীকরণ হয়ে গেলো বোধহয় তবে কথাটা একেবারে ফেলে দেবার মতো নয়।

বাকী যে কয়েকদিন আমি আর আমার প্রজন্মের লোকেরা আছেন ততোদিন অন্তত দিলীপকুমার ভর করতে চাইলে ভর করার জায়গা পাবেন, এইটুকু স্বস্তি!

লেখাটির একটি সংক্ষিপ্ত রূপ 'দুকূল' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

চিত্র সূত্র - ওভারম্যান ফাউন্ডেশন

সূত্রঃ
[১: বিকাশ রায়, কিছু স্মৃতি, কিছু কথা, করুণা প্রকাশনী, ২০১৩]
[২: দিলীপকুমার রায়, স্মৃতিচারণ, রচনাসংগ্রহ ১, আনন্দ পাবলিশার্স ১৯৯৭]

 


লেখক পরিচিতি - পাঁচ দশক হোলো আমেরিকাবাসী। চাকরীজীবনে তথ্য- ও সংযোগপ্রযুক্তি বিপ্লবী, যদিও পদাতিকমাত্র। অবসর নেবার পর কিছু লেখালেখি করে থাকেন। ঘোর রবীন্দ্রপ্রেমী, নিউ জার্সিতে এক রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার স্কুল ও তিনটি সফল রবীন্দ্রমেলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। গীতবিতান.নেট রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর জ্ঞানকোষ মাত্রার এক বিস্ময়কর ওয়েবসাইট, সার্ধশতবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাঞ্জলি। "অবসরের" সঙ্গে জন্মকাল থেকে নানাভাবে যুক্ত।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।