বাংলা সাহিত্যে ফেসবুকের প্রভাব
ঋজু গাঙ্গুলী
“বাংলা সাহিত্যে ফেসবুকের প্রভাব” এই শীর্ষকে এখনও অবধি কোনো রিসার্চ পেপার লেখা হয়েছে কি? না হয়ে থাকলে আমি বাংলার তামাম গবেষক ও তাদের গাইডদের স্কলারলি নজর এদিকপানে ঘোরাতে চাইছি, কারণ কলকাতা বইমেলা ২০১৭ যদি কোনো সূচক হয় তাহলে বলতেই হচ্ছে যে বস্তাপচা ও ফুরিয়ে যাওয়া লেখকদের বদলে আজকের পাঠকদের জন্য নতুন লেখক উঠে আসার বীজতলা তথা সূতিকাগৃহ হিসেবে কাজ করছে ফেসবুক-ই। এক্ষেত্রে প্রকাণ্ড ভূমিকা নিচ্ছে দুটি নবীন প্রকাশনা সংস্থা, যাঁরা বড়ো নামের পেছনে ধাওয়া না করে বরং ভালো লেখা, এবং সেই লেখার জন্য পাঠকের মনে তৈরি হওয়া আকুলতার ওপর ভরসা করেই এগোতে চাইছেন। আজকের ‘বইয়ের খবর’ সেই দুই সংস্থা থেকে প্রকাশিত দুই অপেক্ষাকৃত নতুন, অথচ ফেসবুকে সুপরিচিত লেখকের বই নিয়ে, যাতে ফেসবুকে তাঁদের পোস্টাবলির নির্বাচিত কিছু অংশ শামিল হয়েছে।
আমি-তুমি তুমি-আমি পারম্যুটেশন আর কম্বিনেশনের বাইরে এই লেখাগুলোর মধ্যে সাদৃশ্য একটাই: এদের প্রত্যেকটিকেই স্মৃতিচিত্রণ বলা যায়। সাধারণত আমি পুরোনো কথা নিয়ে জাবর কাটার ঘোর বিরোধী, কিন্তু আলোচ্য বইদুটির সরস, অথচ আন্তরিক কথনের টানে কখন যে আমি লেখকদের সঙ্গেই পুরোনো কলকাতা, জানা-অজানা মানুষ, আর তাদের সহজ বা জটিল জীবনের আবর্তে জড়িয়ে পড়েছিলাম, বুঝতেই পারিনি।
আপাতভাবে মনে হতেই পারে, যে লেখা বিনামূল্যে পড়েছি ও পড়ছি, তাদেরকেই আবার দু’মলাটের মাঝে ধরব আর পড়ব কেন? উত্তরটা খুব সহজ: ফেসবুক, বা সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন অনেক লেখা পড়ার সুযোগ আমাদের হয়, যাদের স্রেফ ‘ফিল ইট, শাট ইট, ফরগেট ইট’ পর্যায়ে ফেলা যায় না। এই লেখারা কুয়াশামাখা ভোরে সূর্যোদয় দেখার অনুভূতির মতোই আমাদের সঙ্গে থাকে অনেকক্ষণ, অনেক দিন। আর তেমনই কিছু লেখা পাঠকের কাছে পেশ হয়েছে এই দুটি বইয়ের মাধ্যমে।
প্রথমে আসা যাক ‘দ্য কাফে টেবল’ থেকে প্রকাশিত, বিরাজ মুখোপাধ্যায় লিখিত, এবং একতা ভট্টাচার্যের অসামান্য প্রচ্ছদে শোভিত ৯৬ পৃষ্ঠার পেপারব্যাক “ছড়িয়ে ছিটিয়ে”-র কথায়।
বইটির সূচিপত্র পাঠকের কাছে তুলে ধরা যাক: -
রাঢ় বাংলার উন্মুক্ত প্রান্তর থেকে উত্তরবঙ্গের জঙ্গলঘেরা গা-ছমছম, হোস্টেলের খুনসুটি থেকে চাকরিসন্ধানীর একটি দিন, এমন অজস্র ছোটো-ছোটো ভিনেট ধরা পড়েছে এই অংশে। লেখকের রসবোধ এবং স্বচ্ছন্দ বাচনভঙ্গি একটি বারের জন্যও একথা ভাবায়নি যে আমি অন্য কারো ছানাকাটা স্মৃতি বা নষ্ট লজিকের বোঝা বইছি। লেখককে ধন্যবাদ দেব এই অংশটির শেষে এই বইয়ের অন্যতম সেরা লেখাটা রেখে মধুরেণ সমাপয়েৎ করার জন্য।
বইয়ের এই অংশটি মিশ্র, কারণ এতে ‘গল্প হলেও সত্যি’ যেমন আছে, তেমনই আছে সত্যি আর কল্পনা মিশিয়ে বলা কিছু মর্মন্তুদ কথা, এবং কিছু গা-শিউরানো কাহিনি। লেখাগুলো হুশ করে শেষ হয়ে যায় ঠিকই, তবে তাদের রেশ থেকে যায়, বিশেষ করে ওস্তাদি মার-তুল্য শেষ গল্পটায়।
চলিত গদ্যে পৌরাণিক কাহিনি নয়, এগুলোকে বরং হালকা চালে লেখা কিছু মিথের আধুনিক ভাষ্য বলা চলে। পড়তে বেশ লাগে, তবে গোটা বইয়ের তুলনায় এর শেষ লেখাটিকে বেমানান ও কমজোরি লাগে।
সামগ্রিকভাবে এটাই বলার যে, এই সময়ের একজন গদ্যকারের তরতরে ভাষা, আর সত্যিকে তাঁর নিজের দর্পনে বিম্বিত করে পেশ করার অনন্য ভঙ্গিমার সঙ্গে যদি পরিচিত হতে চান, তাহলে জানুয়ারি ২০১৭-য় প্রকাশিত, ১২৫ টাকা মূল্যের এই বইটি হাতে তুলে নিন।
এবার আসছি সোশ্যাল মিডিয়া তথা ব্লগ হয়ে ফেসবুকে ছড়িয়ে থাকা মণিমুক্তো পাঠকের কাছে তুলে ধরার ক্ষেত্রে মহাজনপন্থা দেখানো সংস্থা ‘সৃষ্টিসুখ’ থেকে প্রকাশিত, বিমোচন ভট্টাচার্য-র স্মৃতিকথা “তোমার পরশ আসে” প্রসঙ্গে।
পার্থপ্রতিম দাস-এর সুশোভন প্রচ্ছদসম্বলিত, সুমুদ্রিত এই ১৪৯ টাকা মূল্যের, ১৩১ পৃষ্ঠার পেপারব্যাকটিও এবছর বইমেলায় প্রকাশিত হয়। ফেসবুকে প্রকাশিত এই লেখাগুলোর অধিকাংশের সঙ্গেই আমরা আগে থেকেই পরিচিত, এবং ডায়াগনস্টিক টুল নিয়ে ঘাঁটতে বসলে দেখা যাবে, এদের অধিকাংশই আমাদের লাইক/হার্ট/চোখের জল/হা-হা প্রভৃতি ইমোজির দ্বারা লাঞ্ছিত হয়ে আছে। তবুও এই লেখাগুলো বই আকারে কেন প্রকাশিত হল? উত্তরটা লুকিয়ে আছে লেখাগুলোর মধ্যেই।
এই বইয়ের পাতায়-পাতায় ছড়িয়ে আছেন রেড টেরর বনাম হোয়াইট টেররের জতুগৃহে জ্বলে যাওয়া বাংলার নকশাল নেতা সরোজ দত্ত-র কবিতা, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়-এর চোখে সুকুমার রায়, শ্যামল মিত্র আর ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য-র মান-অভিমান-গান, সলিল চৌধুরী, অসামান্য নাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, তারাপদ রায়, পীযূষকান্তি সরকার, কর্মসূত্রে লেখকের সান্নিধ্যে এসেছিলেন এমন কিছু বর্ণময়, আক্ষরিক অর্থে অদ্বিতীয়, এবং/অথবা বিশালহৃদয় মানুষ, সর্বোপরি লেখকের বোন, মা, ও মাতৃসমা নানা মানুষ। এঁদের একান্ত মানবিক ছোটো প্রাণ, ছোটো কথা, ছোটো-ছোটো দুঃখব্যথায় উষ্ণ এই লেখাগুলো পড়তে গিয়ে কখন যে নিজের অজান্তেই চোখের কোণে জল জমে উঠে গড়িয়ে আসে, আবার কখন হাসির চাপে ঠোঁটটা বেঁকে গিয়ে পিছিয়ে যায় যতক্ষণ না নিজের ভাঙাচোরা দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়ে, তা টেরই পাওয়া যায় না। নমুনা চাহিয়া বিব্রত করিবেন না, কারণ তাহলে আমাকে অর্ধেক বই তুলে দিতে হবে।
তবে স্মৃতিকথা বা হাসি-কান্না নয়, এই বইয়ের আসল জোরের জায়গা হল সেই লেখাগুলো, যেখানে এক অভাবী মা তাঁর ছেলেকে খাওয়াতে না পারলেও তার মধ্যে গুঁজে দিচ্ছেন আত্মসম্মানের বীজ, বা প্যান্ডেলে দাঁড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ জগজ্জননী শুনছেন আজ থেকে প্রায় পাঁচ দশক আগে আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়া পান্নালাল ভট্টাচার্য-র গলায় “মায়ের কোলে ঘুমায় ছেলে, সেই শান্তি মা কোথায় বল”।
আমি ছোটোবেলা থেকেই মানুষের ছদ্মবেশে পশ্বতর শ্বাপদদের নানা কীর্তিকলাপ দেখে অভ্যস্ত, তাই আমার কাছে স্মৃতি মানে একটা কুয়ো, যার নিচ থেকে জ্যোৎস্না বুকে নিয়ে জল নয়, বরং লাশের স্তূপ হাতছানি দেয়। তাই আমি কোনো মতেই একথা বিশ্বাস করি না যে ‘স্মৃতি সততই সুখের’। কিন্তু এই লেখাগুলো পড়ে কয়েকটা লাইন বড়ো বেশি সত্যি ঠেকল, আর তাই সেগুলো তুলে দিয়ে, সঙ্গে এই গভীর, বিষাদচিহ্ন বয়ে বেড়ানো, অথচ রসসিক্ত বইটির প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আবারো আকৃষ্ট করে, আমার লেখা থামাচ্ছি:
পাঠ শুভ হোক।
লেখক পরিচিতি: এক উদ্যমী পাঠক, যিনি বিপ্লব, চোখের জল, মানবচরিত্রের অতলস্পর্শী গভীরতা, সিন্ডিকেট, সারদা, ধোনি, ইত্যাদি তাবড় বিষয় থেকে দূরে, স্রেফ বেঁচে থাকার গল্প পড়তে চান। নিজের ভালবাসা থেকেই দীর্ঘদিন বইয়ের রিভিউ করছেন।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.