অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


বইয়ের খবর

অক্টোবর ১, ২০১৭

 

হলদে সাবমেরিন

ঋজু গাঙ্গুলী


পুজো শেষ!

পাক্কা একটি বছর ধরে আমরা অপেক্ষা করে থাকি যে ক’টা দিনের জন্য, সেগুলো হুশ করে কেটে গেল। রেখে গেল প্রচুর অম্বল, অতি(এবং অপ)ভোজনের অনুতাপ, সিনেমা দেখে (যাদের মধ্যে অধিকাংশই আমাদের স্টকের গালাগালিগুলো ঝালিয়ে নেওয়ার ভরপুর সুযোগ করে দিয়েছে) খেপচুরিয়াস হওয়া মেজাজ, ভিড়ে সেলফি তুলতে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে মোবাইল হারানোর ব্যথা, সাহসিকাদের বাজে ফিটিঙের পোশাক পরার পরের এফেক্ট, সাহসীদের ফুচকার মধ্যে অন্য তরল ভরে খাওয়ার পরের এফেক্ট, ইত্যাদি। আর রেখে গেল ফেলে আসা ছোটোবেলার পুজো, এবং সেই অভাবী অথচ অন্য রকম সম্পদে ধনী দিনগুলোর জন্য একরাশ নস্ট্যালজিয়া।

এমনিতে পেছন দিকে তাকানোর পক্ষপাতী না হলেও অতীতের সেই কালচে-সবুজ, ঘোলাটে, ঠাণ্ডা জলে ডুব দেওয়ার জন্য আমি বেছে নিলাম একেবারে সাম্প্রতিক, প্রায় সর্বাঙ্গে ছাপাখানার গন্ধ মেখে রাখা একটি নাতিস্থূল বই, যার নামটা আমার ‘মিশন’-এর সঙ্গে খুব মানানসই ছিল।

  • বইয়ের নাম: হলদে সাবমেরিন
  • লেখক: অপূর্ব নাথ
  • প্রকাশক: দ্য কাফে টেবল
  • প্রকাশকাল: সেপ্টেম্বর ২০১৭
  • পেপারব্যাক, ১২৮ পৃষ্ঠা
  • মূল্য ১৫০/- টাকা

ফেসবুক তথা সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের এমন বেশ কিছু লেখক উপহার দিয়েছে যাঁদের মুক্তগদ্য আমাদের কাছে পেশ করেছে স্মৃতিচারণের ছদ্মবেশে অসামান্য নানা রম্যরচনা, নানা যুক্তি-তক্কো-গপ্পো, এবং চাওয়া-পাওয়ার বিবিধ খতিয়ান। অভীক সরকার-এর “মার্কেট ভিজিট এবং অন্যান্য”, বিমোচন ভট্টাচার্য-র “তোমার পরশ আসে”, বিরাজ মুখোপাধ্যায়-এর “ছড়িয়ে ছিটিয়ে”, রাজা ভট্টাচার্য-র “ভারতবর্ষ”, নন-ফিকশনের মধ্যে এই স্মরণীয় উদাহরণগুলো অনেক পাঠকেরই মনে পড়বে অত্যন্ত সহজে।

কিন্তু, একতা ভট্টাচার্য-র চমৎকার প্রচ্ছদে শোভিত, অপূর্ব নাথ-এর এই অ-পূর্ব বইটির সঙ্গে চট করে অন্য কোনো বইয়ের তুলনা করা মুশকিল।

কেন?

এই বইয়ের গদ্য সমকালীন অন্য অনেক লেখকের ধারালো বা মসৃণ কথনের চেয়ে এক্কেবারে আলাদা রকমের। তাতে ভরা আছে লেখকের একান্ত নিজস্ব মৃদু, নরম, সুরেলা ভাব, যার ফলে সেই গদ্য পড়লে মনে হয় যেন, কোনো কবিতাই পড়ছি।

কিন্তু ঠিক কী আছে এই বইয়ে?

একেবারে ছোট্ট-ছোট্ট কিছু স্মৃতি, কিছু ভাবনা, কিছু আকাশকুসুম, আর সদ্যোজাত কিছু অনুভব ও দৃশ্য, এইসব ভিনিয়েট শব্দ-বাক্য-অনুচ্ছেদের নাটবল্টুতে বাঁধা পড়ে তৈরি করেছে এই হলদে সাবমেরিন।

পৌনে এক পাতা থেকে বড়োজোর তিন পাতা জুড়ে ব্যাপ্ত এই লেখাদের নামগুলো পেশ করা যাক: - ১. বালা-মুসিবত ২. অনুরোধের আসর ৩. গন্ধের সুর ৪. মন খারাপের দিস্তা ৫. মাধুরী, ও মাধুরী ৬. লতা মঙ্গেশকর ৭. খুশিয়াল পাকঘর ৮. পিছুটান, অভিমান ৯. খুশবু ১০. গোবিন্দভোগ ১১. সময়, আমার সময় ১২. ঝুমকা গিঁরা রে ১৩. বালকের গ্রাম ১৪. গোবর-ছড়া, হ্যারিকেন-কাচ ১৫. কাঁটা, উল ১৬. পায়ে পায়ে আনন্দ ১৭. দশমীর পর ১৮. ভাড়াবাড়ি ১৯. বিশ্বাস ২০. মায়া ২১. পঁচিশে বৈশাখ ২২. সহজিয়া ২৩. বালিঘড়ি ২৪. ডিডি-ওয়ান, ডিডি-টু ২৫. অ্যালবাম ২৬. আয়নাভরা দিন ২৭. স্নেহের দান ২৮. ছোটোদিদা ২৯. ইউজ অ্যান্ড থ্রো ৩০. আদরে-অনাদরে ৩১. মিক্সচার ওষুধ ৩২. অ্যাকিলিস হিল ৩৩. লজ্জাকবচ ৩৪. স্লেট ৩৫. মলাট ৩৬. আজান ৩৭. প্রিয়াঙ্কা ভট্টাচার্য ৩৮. আঁক-কষা ৩৯. জ্যামিতি বক্স ৪০. রিস্ট ওয়াচ ৪১. টাইপ ইশকুল ৪২. বিজয়া সম্মিলনী ৪৩. পুজোর জামা ৪৪. টিফিনবেলা ৪৫. Dxing ৪৬. তুমি তুমি তুমি ৪৭. ওড়াউড়ি ৪৮. হাওয়ার মতো পাগল, চাওয়ার মতো অবুঝ ৪৯. অবোধ-অবরোধ ৫০. জল ৫১. বিভাজন ৫২. আদর ৫৩. পিত্তি পড়ে গেছে ৫৪. ফিরতি ঘুম ৫৫. মনোহারী-ইচ্ছে ৫৬. আসন ৫৭. রিঠা, শিকাকাই ৫৮. মায়া-বই ৫৯. ও জ্বর, তুমি এসো না এক্ষুনি ৬০. সাক্ষাৎ

আর, ঠিক কী আছে এই লেখাগুলোয়?

ক্ষমা করবেন, কিন্তু এই লেখাগুলোর বিষয়ভিত্তিক বর্গীকরণ করতে আমি অক্ষম। শুধু এটুকু বলতে পারি যে মমতা, স্নেহ, বিস্ময়, মুগ্ধতা, সরলতা, মুচকি হাসির ঝিলমিল, অভিমান, আর মায়া, সোনালি ধুলো হয়ে জড়িয়ে রয়েছে এদের সর্বাঙ্গে।

অবান্তর জ্ঞানে আমরা এদের তুচ্ছ করতে পারি। অকাজের বলে গালাগাল-ও দিতে পারি। কিন্তু ঝটকা মেরে তাদের সরিয়ে দিতে গেলেই আমাদের ঘোলাটে দিন হয়ে ওঠে ঝলমলে, বা ক্লান্ত সূর্যাস্ত হঠাৎ হয়ে ওঠে আগ্নেয়গিরির মতো দেদীপ্যমান।

না, এই লেখাগুলোর সবগুলো আমার ভালো লাগেনি।

আমার বুকের ভেতরে মাঝেমধ্যেই দানা বেঁধেছে লেখকের বিরুদ্ধে নিঝুম অভিমান, যে এমন এক সঙ্কলন প্রকাশের সুযোগ পেয়েও কেন তিনি তাতে বেছে নেননি তাঁর সেই লেখাগুলো, যাতে রসবোধ এবং সমকালীনতা লেগে থাকে আষ্টেপৃষ্ঠে, ঠিক যেমন শিঙাড়ার তাকত বাড়িয়ে তোলে তার স্বাদ আর মুখ-পোড়ানো তাপ?

কিন্তু তারপর আমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছি।

এই বইয়ে সেই লেখাগুলোই রাখা হয়েছে যাদের পড়তে গেলে, দিনগত পাপক্ষয়ে পিষ্ট এই জীবনেও সেই শিউলি গাছটার কথা আপনার মনে পড়বে, যেটা অনাদরে-অবহেলাতেও ভরিয়ে রাখত আপনার পুরোনো বাসভূমির উঠোন। আর, নতুনের পথে পা বাড়ানোর সময় যার দিকে অন্তত একবার তাকিয়েছিলেন; অন্য কাউকে শুনিয়ে নয়, শুধু নিজের বুকের ভেতর থেকে যার উদ্দেশে বলেছিলেন, “আসি”।

রয়ে যাওয়া কিছু অলস মায়া, মনের মাটিতে খেলা করা মেঘেদের সেইসব ছায়া, এরাই ‘হলদে সাবমেরিন’-এর উপজীব্য।

তাই, হে পাঠক, আপনি কি শষ্পমূলে ঘিরে রাখা আদরের সম্পূর্ণ মর্মর ছুঁয়ে দেখতে চান? চান অজস্র কথার ভিড়ে চাপা পড়া দিনরাত্রির বাইরে এক আয়ুর শব্দহীন লিখন পড়তে? তাহলে হাতে তুলে নিন ‘হলদে সাবমেরিন’।

আর তলিয়ে যান সেই সমুদ্রের বুকে, যেখানে ঢেউ তুলছে আপনারই স্মৃতি আর চেতনা।

পাঠ শুভ হোক।

 


লেখক পরিচিতি: এক উদ্যমী পাঠক, যিনি বিপ্লব, চোখের জল, মানবচরিত্রের অতলস্পর্শী গভীরতা, সিন্ডিকেট, সারদা, ধোনি, ইত্যাদি তাবড় বিষয় থেকে দূরে, স্রেফ বেঁচে থাকার গল্প পড়তে চান। নিজের ভালবাসা থেকেই দীর্ঘদিন বইয়ের রিভিউ করছেন।                   

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.