বিবিধ প্রসঙ্গ
জুলাই ৩০, ২০১৬
আমার ইলশে স্মৃতি
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
টিপটিপ, টুপটাপ, ঝমঝম, ঝিরঝির... অপেক্ষার অবসান, বর্ষা এসেছে। আবার এসেছে আষাঢ় আমাদের শহরে। মেঘকালো করা সকালে মন বলে আয় কবিতা লিখি, উজাড় করি ফেসবুকের দেওয়ালে বৃষ্টিকাব্য। ওদিকে রান্নাঘর ডাকে আয়, ছুটে আয়। টেষ্টবাড গুলো লকলক করে বলে খিচুড়ি আর ইলিশমাছ ভাজা।
ইলিশমাছের গন্ধে ভাতের খিদে একধাপ বেড়ে যায়। ভাত খেয়ে ছুটির দিনে দিবানিদ্রা কিম্বা অলসদুপুরে মাছের স্তুতিগান, এও বাঙালির আরেক রসনা। মনে হয় কি এমন স্নেহ আছে এই ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিডে? যার মোহে ইলশে পদ্যরাও ধরা দেয় ইলশেগুঁড়ির সাথে। বলে উঠি নিজের মনে
ভাই ইলিশ, তুই খলবল কর জলে,
বড় হয়ে ওঠ, তারপর আয় দেখি !
রান্নাঘরে সর্ষে বাটি, নুন-হলুদ-তেলে
জমিয়ে রাঁধি, তোকে ভাপাই লঙ্কা দুটি ডলে;
ভাতের হাঁড়ির মুখে কৌটো বন্দী ইলিশভাপা
নরম চালের গরম ভাতে মাছের কৌটো চাপা ।
সরষে ঝাঁঝে পরাণ গেল ইলিশ ম’ল দুখে
বেজায় কাঁটা, রূপোর মাছে তবুও খাব সুখে ।
কথায় বলে হালকা হাওয়া দেবে, ঝিরঝির করে অবিরাম ইলিশেগুঁড়ি বৃষ্টি পড়তেই থাকবে আর ঠিক তখনি ঝাঁকেঝাঁকে গভীর জলের এই ইলিশমাছ সমুদ্রের নোনা জল সাঁতরে, জোয়ারের অনুকূলে স্বল্প পরিশ্রমে, নদীর কাছে আসবে, আমাদের ধরা দিতে।
ছোটবেলায় সবচেয়ে মজা ছিল রেনিডেতে হঠাৎ ইলিশের গন্ধটা। হঠাৎ ছুটির সাথে বৃষ্টি আর হঠাৎ পাওয়া ইলিশের অনুষঙ্গে মন কানায় কানায় !
মায়ের সারপ্রাইজ। উনুনের পিঠে হাঁড়ির মধ্যে গরম ভাত আর তার মুখে চাপা দেওয়া একটা টিফিনকৌটোর মধ্যে বন্দী ইলিশমাছের ভাতে বা ভাপা। হলুদ পড়বেনা এই পদে।টাটকা মাছের গন্ধ নষ্ট হয়ে যাবে। কৌটোর মধ্যেই নুন মাখানো ইলিশের গাদা-পেটি সর্ষে, কাঁচালঙ্কা বাটা, কাঁচা সর্ষের তেল আর বেশ কয়েকটি চেরা কাঁচালঙ্কার সাথে জারিয়ে ভাত ফোটবার সময় হাঁড়ির মুখে মিনিট দুয়েক রেখে দিলেই এই অমূল্য পদ তৈরী। আমার রন্ধন পটিয়সী দিদিমা তার বিশাল সংসারে বিরাট এক হাঁড়ির মুখে বিশাল এক কচুপাতার মধ্যে মাছগুলিকে ম্যারিনেট করে পাতাটি সুতো দিয়ে বেঁধে ভাত ফোটবার সময় হাঁড়ির মুখে রাখতেন। মা বলত, সে ভাপা ইলিশের নাকি অন্য স্বাদ। দিদিমার নাতনী মানে এহেন আমি একটু ইম্প্রোভাইজ করে এই কায়দাটি করি লাউপাতায় মুড়ে এবং ননস্টিক প্যানে অর্থাত পাতুড়ির স্টাইলে। যাই করো এ কানুর তুলনা নেই। কাঁচা তেলঝাল, ভেজে ফোড়ন দিয়ে ঝাল, গায়ে মাখামাখা হলুদ সর্ষেবাটার ঝাল, বেগুন দিয়ে কালোজিরে, কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে বাঙালদেশের পাতলা ঝোল...সবই যেন এই বর্ষায় দৌড়তে থাকে গরম ভাতের সঙ্গে।
ইলিশমাছের কথায় মনে পড়ে ছোটবেলার কথা। আমার বাড়ী গঙ্গার ধারে। বর্ষা এলেই মোটা, কালো, দশাশয়ী চেহারার এক হিন্দুস্তানী বুড়ো ধবধবে পোষাকে "হিলিস মাছ গোঙ্গা' বলে চিল চীত্কার করতে করতে আমাদের পাড়ায় ঢুকত । বুড়োটা কুচকুচে কালো । দুকানের কালো লতিতে সোনার চকচকে মাকড়িটা দেখতে বড্ড ভাল লাগত । সে বাড়ির সামনে এলেই আমরা ভাইবোনে মিলে মাকে ধরে এনে ইলিশমাছ কিনিয়েই ছাড়তাম । ইলিশ মাছ আমাদের দুজনেরি ভীষণ প্রিয়। সেই হিন্দুস্তানী মাছওয়ালা শীতকালে সন্ধ্যের ঝুলে গান ধরত,
"বাদাম ভাজা খাইও, আউর ভুখে গুণ গাইও, ইয়ে ঝাল বানানেওয়ালা, ইসমে নমক ডালা হুয়া ...... ইয়ে গরম মুমফালি-ই-ই-ই "
তখন বুঝতামনা শীতকালে বাদাম আর বর্ষায় ইলিশের কেমিস্ট্রিটা । মা বলেছিল, শীতে ইলিশ পাওয়া যায়না তাই পেট চালানোর জন্যে বাদাম ভাজতে হয় তাকে।
বাবার মুখে শুনেছি বিস্ময়কর ইলিশ উপাখ্যান। বাবা বলেছেন,
" প্রতিবছর বর্ষা শুরু হলেই ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি মাথায় করে চানে বেরোতাম ছুটির দিনে। যাবার সময় মা চার আনা পয়সা দিয়ে বলতেন নদী থেকে সদ্য ওঠা ইলিশ মাছ কিনে আনতে। সেই চার আনাটিকে অতি সন্তর্পণে ট্যাঁকে গুঁজে ঝাঁপিয়ে পড়তাম জলে। মাঝ নদীতে সাঁতার কেটে গিয়ে যখন মাছধরার জেলের নৌকো দেখতে পেতাম তখন উঠে পড়তাম নৌকায়। চার আনা পয়সা দিয়ে ইয়া বড় এক ইলিশ কিনে নৌকায় করে আবার ঘাটে ফিরে এসে বাড়ি যেতাম নাচতে নাচতে।
পরবর্তী আকর্ষণ ইলিশের ভোজবাজি। যা দেখাতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন আমার মাতাঠাকুরাণী। এখন সে বড় ইলিশও আর নেই আর নেই সেই দামও।
প্রতিবছর আমার ছোটপিসিমা আসতেন বিহারের দ্বারভাঙা থেকে। বাবা তাঁর আবদারে দুটি বড় বড় ইলিশমাছ কিনে আনতেন। মা তাঁর ননদিনীর জন্য আহ্লাদে আটখানি হয়ে বঁটি নিয়ে বসে পড়তেন সেই মাছ নিজে কাটতে। জলে ধুয়ে নিয়ে এই মাছ কাটার রীতি নয়ত স্বাদ নষ্ট হয়। তারপর সেই মাছ একটি হাঁড়িতে করে নুন, হলুদ দিয়ে ম্যারিনেট করে রাখা হত। পিসিমা তা নিয়ে মহানন্দে ট্রেনে উঠতেন। বিহারে ইলিশমাছ অপ্রতুল আর পিসিমা ইলিশের বড়ই ভক্ত। তাই এরূপ ব্যাবস্থা। এর দিন দশেক পর একখানি পোষ্টকার্ডে সেই ইলিশের জয়গান করে বার্তা আসত পিসিমার কাছ থেকে। টাটকা ইলিশ নাকি একরকম আর এই নোনা ইলিশ নাকি আরেক রকম। অনেকদিন রেখে খাওয়া যায়।
বিশ্বে ইলিশমাছের সর্বোচ্চ উত্পাদন নাকি হয় বাংলাদেশে। কিন্তু একবার বিদেশ থেকে বাংলাদেশ হয়ে ফিরছিলাম। ভেবেছিলাম সত্যি পদ্মার ইলিশের স্বাদ নেব ভাগ করে। ট্রানজিট ভিসায় দুপুরবেলা ঢাকার একটি বেশ উচ্চমানের হোটেলে গিয়ে শ্রাবণের বৃষ্টিভেজা দুপুরে ইলিশ মাছ চেয়ে পাইনি। তার বদলে বাঙালির "চিলি চিকেন' খেয়ে পেট ভরাতে হয়েছিল।
বহুবার বাঙালবাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়ে সরস্বতী এবং কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোতে জোড়া ইলিশের পুজো দেখেছি। ধানদুব্বো, তেল-সিঁদুর মাখিয়ে বরণ করে নতুন শাড়ি পরিয়ে জোড়া ইলিশের পুজোর পর জমিয়ে ইলিশমাছ ভোগ দেওয়া হয়। আগে বলা হত সরস্বতীপুজোর দিনে শুরু আর ঐ লক্ষ্মীপুজোর দিনে শেষ। মধ্যিখানে আশ্বিন থেকে মাঘ অবধি আর ইলিশ খাওয়া যাবেনা। এর বিজ্ঞানসম্মত কারণটি হল মাছকে সংরক্ষণ করা। মাছকে আকারে বাড়তে দেওয়া।বৈশাখ থেকে জ্যৈষ্ঠের মধ্যে যুবতী থেকে গর্ভবতী হয়ে তবে সে বর্ষার জল পেয়ে নধর হবে। আর গুটিগুটি সেই পোয়াতি মাছ সাঁতরে সাঁতরে জোয়ারের সময় সমুদ্রের নোনা জল থেকে যত নদীর দিকে এগিয়ে আসবে তত তার শরীর থেকে আয়োডিন আর নুন ঝরে ঝরে মিষ্টতা বাড়বে। সেই অর্থে ইলিশ হল পরিযায়ী মাছ।মরশুমি সজীব শস্য। বর্ষার বিশেষ তিথিতে ধরা দেয়। বাকী সময় থাকে গভীর জলে। তখন তার মনের তল পাওয়া দুষ্কর। এইসময় সে খায় বিশেষ ধরণের জলজ শ্যাওলা। খেতে খেতে যত বাড়তে থাকে তত সে পুষ্ট ও নধর হয়। রূপে লাবণ্যে থৈ থৈ তার গর্ভিণী যৌবন যেন স্নেহ পদার্থের আধিক্যে ঢলঢল হয়। সেই বিশেষ ধরণের স্নেহপদার্থ বা ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড সব মাছে থাকেনা তাই বুঝি ইলিশের এত কদর, অনন্য স্বাদ। হৃদরোগী থেকে ছোট শিশু সকলেই খেতে পারে এই মাছ।
আজকাল খোকা ইলিশ ধরে নেওয়া হয় বলে আগেকার সেই বড় ইলিশের রমরমা নেই অন্ততঃ কলকাতার বাজারে। আর পাওয়া গেলেও তার দাম আকাশছোঁয়া। তাই বলতে ইচ্ছে করে
অধরা এই জলজ শস্য, রূপোলী রঙের রূপসী পোষ্য
খেতেন পিতামহরা তস্য, পরিবেদনা কা কস্য !
খাচ্ছি যদিও চর্ব্যচূষ্য, তবুও অধরা বর্ষাশষ্য !
মনে পড়ে যায় রবিঠাকুরের গান "মেঘ বলেছে যাব যাব, রাত বলেছে যাই......' এই যাই যাই করতে করতে বর্ষাও ফুরিয়ে যাবে আমাদের । আবারো হাপিত্যেশ করে বসে থাকা পরের বছরের তরতাজা ইলিশের জন্যে।
আমার ঠাম্মা ছিলেন সাতখীরার মেয়ে। উনি বলতেন বর্ষার ক্ষুধামান্দ্য কাটাতে, ডিপ্রেশান কাটাতে ইলিশের জুড়ি নেই। তিনি ছিলেন রসেবশে ৫০% বাঙাল ও ৫০% ঘটি। তাই ছ্যাঁচড়া, অম্বল, কচুশাক দিয়ে ইলিশমাছের সব পদই সমান তালে রাঁধতেন জমিয়ে। আর বলতেন, যতদিন না দুগ্গাপুজো আসছে বর্ষায় হয় দুগ্গারুচি। দুর্গার জন্য উতলা, পুজোর জন্য এই পথ চাওয়ার প্রতীক্ষা আর একঘেয়ে খাওয়াদাওয়ার অরুচির দাওয়াই হল ইলিশ মাছ। এখন শুনছি ডাক্তারবাবুরাও এইকথা বলছেন....."যতদিন পারুন এই মাছ খেয়ে নিন। এ হল সোনার গৌর। একবার ছেড়ে দিলে আর পাবেন না। হৃদমাঝারে লালন করুন একে। হার্ট ভাল থাকবে, মন ও ভাল হবে' ।
কয়েকবছর আগে গঙ্গাবক্ষে এক ইলিশ উত্সবে গান গাইবার সুযোগ পেয়ে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম এই রূপোলী শস্যবিলাসে। সেদিন ছিল শ্রাবণের ঘন মেঘাচ্ছন্ন সকাল। কখনো ইলশেগুঁড়ি কখনো ঝমঝম বৃষ্টি। কেউ মিলেনিয়াম পার্ক, কেউ কয়লাঘাটা, কেউ আবার বাবুঘাট থেকে এসে সোজা জমায়েত হল ঐ জেটির কাছে। স্টীমারে উঠে পড়লাম আমরা। স্টিমারের নীচে ইলিশমাছ ভাজার গন্ধে ম ম করছিল আশপাশ। আমরা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলাম। শুরু হল ঘাট পরিক্রমা আর সাথে লোকগান, বর্ষার কাজরী গান, বাউলগান । চোখ রাখতে থাকলাম গঙ্গার দুপাশের ঘাটে। কোনোটি ভগ্নপ্রায়, কোনোটি নিয়মিত সংস্কারের ফলে সেজেগুজে, বর্ষার জল পেয়ে ঝকঝকে । কোনোটি আবার ভেঙেচুরে নিশ্চিহ্ন। মনে হল বর্ষা, বৃষ্টি, ইলিশমাছ আর গঙ্গা এই অনুষঙ্গগুলি বাঙালির প্রাণের। কিন্তু সেই গঙ্গার ঘাট আর সেই ইলিশের স্বাদ আজ আর অবশিষ্ট নেই । সেটাই বড় কষ্টের। ছোট ছোট মাছগুলিকে ধরে ফেলার নিষেধাজ্ঞা কেউ মানছেনা। গঙ্গার ঘাটগুলিরও সংস্কার প্রয়োজন। নদীর নাব্যতা নিয়েও সংশয় রয়েছে। তবে কি ইলিশও অবলুপ্তির পথে? এই দোলাচলে বাড়ি ফিরে শান্তি পাইনি। তারপর বছর তিনেক কেটে গেছে। গঙ্গা ও ইলিশ দুইকে বাঁচা তে কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ দেখলাম কি আমরা? গঙ্গাই তো সুস্বাদু ইলিশের ঘরবাড়ি। গঙ্গার জলেই তার সঙ্গীর সাথে প্রতিনিয়ত মৈথুন, জীবনযাপন ও সহমরণ। তবুও বাঙালির কোনো হেলদোল নেই।
লেখক পরিচিতি - বেথুন কলেজ ও পরে রাজাবাজার
সায়েন্স কলেজ থেকে অর্গ্যানিক কেমিস্ট্রিতে স্নাতকোত্তর। লেখালেখিতে
ঝোঁক বহুদিনের। ২০০৭ থেকে বাংলায় ব্লগ লেখার শুরু। ২০১১ তে দেশ
পত্রিকায় প্রথম গল্প প্রকাশ। তারপর আনন্দমেলা, এবেলায় ছোটগল্প
এবং আনন্দবাজার পত্রিকায় অনেক ভ্রমণকাহিনী প্রকাশিত। আনন্দবাজার
ইন্টারনেটের শুরু থেকেই লিখে চলেছেন পাঠক কলমে ও হাওয়াবদলে। প্রথম
উপন্যাস "কলাবতী কথা" সানন্দা পুজোসংখ্যায় ( ২০১৫ )
প্রকাশিত। এছাড়াও বহু প্রিন্ট পত্রিকা ও ওয়েব পত্রিকার নিয়মিত
লেখক। এযাবত প্রকাশিত বই চারটি।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।