প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

শিল্প ও সাহিত্য

নভেম্বর ১৫, ২০১৬

 

রবীন্দ্র সমালোচনার প্রবণতা

খালিকুজ্জামান ইলিয়াস


বাংলা সাহিত্যের প্রধান ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে এ পর্যন্ত যতো সমালোচনা গ্রন্থ, প্রবন্ধ, ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে, এই সাহিত্যের অন্য কোনো শিল্পী সম্পর্কে তেমন হয়নি। প্রায় এক শতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী এই সমালোচনা সাহিত্য। মোটা দাগে বিচার করলে স্পষ্টতই এর একটি গতিশীল,  দ্বান্দিক রূপ প্রতীয়মান হয়। একটি ধারার সমালোচক (এঁরা প্রধানতঃ কৈবল্যবাদী। এঁদের সংখ্যা অন্যান্য ধারার সমালোচকদের চেয়ে বেশী) রবীন্দ্রশিল্পকর্ম সম্পূর্ণ ভাববাদী দর্শনের সমর্থনে পর্যালোচনা করে মানুষ ও শিল্পী রবীন্দ্রনাথকে একটি অতিমানবিক,  ঈশ্বরতুল্য অধিষ্ঠানে স্থাপন করেন। এঁদের কাছে রবীন্দ্রনাথ এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়া অতীত এক অত্মগত আনন্দলোক অবস্থান করে বিশুদ্ধ শিল্পসাধনায় নিরত ছিলেন। আর এক ধারার সমালোচক যাঁরা প্রধানতঃ ষাট ও সত্তর দশকের নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রভাবে রবীন্দ্রনাথকে ভ্রান্ত মার্কসবাদী শিল্পতত্বের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করে একেবারেই খারিজ করতে উদ্যত হন। রবীন্দ্রনাথ যেহেতু মূলতঃ একজন ভাববাদী শিল্পী যিনি রূপ-অরূপ,  সাকার-নিরাকার,  সীমা-সীমাহীনতা ইত্যাদি বায়বীয় ভাবধারায় নিয়ত অবগাহন করতেন,  সেজন্য এঁদের কাছে রবীন্দ্রশিল্প প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া শিল্প এবং সমাজ পরিবর্তনের জন্য কৃষক শ্রমিক সংগ্রামে একেবারেই অকেজো। রবীন্দ্রসাহিত্য মূল্যায়নে দ্বিতীয় ধারার এই সমালোচকদের বক্তব্য প্রভূত স্তব বহন করলেও একে প্রকৃত বৈজ্ঞানিক বলে গ্রহণ করা যায় না। এই সমালোচকদের একদেশদর্শী নিন্দাবাক্য রবীন্দ্রপ্রতিভার বিকাশে ঠাকুর পরিবারের পারিবারিক এবং তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষিত তথা মানবমননে প্রতিবেশিক প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণের বৈজ্ঞানিক সত্য উপেক্ষা করে। পরিপ্রেক্ষিতই চেতনসত্বার স্রষ্টা ও নিয়ামক,  এর উল্টোটি সত্য নয়। যাই হোক, দুই মেরুতে অবস্থানকারী প্রথোমোক্ত ও দ্বিতীয়োক্ত সমালোচনাপ্রবণতা উভয়েই আবেগসজ্ঞাত এবং এজন্য রবীন্দ্র সৃষ্টিশীলতার প্রকৃত মূল্যায়নে অক্ষম।

উপরোক্ত দুই ধারার সমালোচনার মধ্যবর্তী আরেকটি সমালোচনাপ্রবণতা লক্ষ্য করা  যায়। প্রধানতঃ মার্কসবাদী সাহিত্যসমালোচকরাই এই তৃতীয় ধারার স্রষ্টা ও বাহক। ভবানী সেন,  প্রদ্যোত গুহ,  নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়,  মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়,  নরহরি কবিরাজ,  নারায়ণ চৌধুরী,  অমরেন্দ্র প্রসাদ মিত্র প্রমুখ লেখক 'পরিচয়',  'মার্কসবাদী',  'নতুন সাহিত্য' প্রভৃতি পত্রপত্রিকায় মাক্র্সীয় দৃষ্টিতে বাংলা সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের যে মূল্যায়ন করেন তাতে অপ্রতুল হলেও রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ ও বর্জনের প্রশ্নে একটা সমঞ্জস্য বিধানের প্রয়াস লক্ষ করা যায়। এঁদের দৃষ্টিভঙ্গি যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক,  তবে এঁরা মার্কসীয় কলাতত্বের প্রয়োগে রবীন্দ্রনাথের ব্যাপক পর্যালোচনা দ্বারা তাঁর শিল্পকর্ম ও ব্যক্তিবিশ্বাসের প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রগতিবাদী উপকরণসমূহ চিহ্নিত করে একটি সুস্পষ্ট ও শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক সমালোচনার ধারা সৃষ্টি করতে সক্ষম হননি। উপরন্তু এঁদের কেউ কেউ (ভবানী সেন,  প্রদ্যোত গুহ) যেমন পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে নিজেদের পূর্ববর্তী মূল্যায়নের বিপক্ষে পুনর্মূল্যায়ন করেন এবং করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করতেও দ্বিধা করেন না (প্রদ্যোত গুহ),  তেমনি কেউ কেউ (নারায়ণ চৌধুরী) রবীন্দ্রসৃষ্টিশীলতার প্রতি অপরিণত আক্রমণ করে নিজের পূর্ববর্তী সামঞ্জস্যবিধায়ক পর্যালোচনার বিরোধিতাই করেন। নারায়ণ চৌধুরীর 'রবীন্দ্রমূল্যায়নে নূতন দৃষ্টিকোণ'  ('সাহিত্য ভাবনা' ১৯৭৫) এবং 'রবীন্দ্রনাথ: আমাদের সংস্কৃতি জগতের একটি অমীমাংসিত সত্তা'  ('অগ্রণী জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৯৮৬ সংখ্যা থেকে 'সংস্কৃতি'  ফেব্রুয়ারী ১৯৮৭ সংখ্যায় পুনর্মুদ্রিত) প্রবন্ধ দুটির তুলনামূলক বিচার করলে বক্তব্যের ও দৃষ্টিভঙ্গির বৈপরিত্য দেখে বিস্মিতই হতে হয়। প্রথোমোক্ত প্রবন্ধে নারায়ণ চৌধুরী রবীন্দ্রনাথকে উগ্র বামপন্থী সমালোচনা থেকে রক্ষার চেষ্টায় বলেন যে রবীন্দ্রনাথকে "বুর্জোয়া শ্রেণীস্বার্থের একজন শোধনাতীত প্রতিনিধি" হিসেবে চিহ্নিত করা,  তাঁর শেষ বয়সের মানবতাবাদী রচনাবলীর এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভূমিকার সততা সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করা ইত্যাদি নিতান্তই স্থূলত্বের পরিচায়ক,  "হাস্যকর সরলীকরণের প্রয়াস" কারণ রবীন্দ্রনাথ "প্রথম ও মধ্য বয়সের কাব্যসাধনার অপূর্ণতা শেষ বয়সের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার দ্বারা...। সুদে আসলেই পূরণ করে গিয়েছিলেন" ('সাহিত্য ভাবনা'  ২৭, ৩৩)। অথচ দ্বিতীয় প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের মানবতাকে তিনি "বুর্জোয়া ঘরানার মানবতা,"  রবীন্দ্রমানসিতাকে তাঁর কাব্যের সৃষ্টিক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন একটি নীচুস্তরের চৈতন্য হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এমনকি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের সক্রিয় অংশগ্রহণ সত্বেও পুলিশী সতর্কতায় ভীত হয়ে ঐ আন্দোলনের বৃত্ত থেকে সরে আসা, প্রকাশ্যে বিপ্লবীদের সমালোচনা করা,  প্রাচীন ভারতের জয়গাথায় এবং স্বাবলম্বনের আদর্শে নিয়োজিত হওয়া, বিভিন্ন প্রবন্ধে সামন্তসুলভ মনোভাব নিয়ে বদান্য জমিদারতন্ত্রের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন দান ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে নারায়ণ চৌধুরী প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়াশীলতার নিদর্শন খুঁজে পান। উৎসবিহীন বক্তব্যে রবীন্দ্রনাথে তিনি তলস্তয়  বনার সাধও আবিষ্কার করেন এবং রাশিয়া থেকে বেড়িয়ে আসার পর অমিয় চক্রবর্তীর অনুরোধ সত্বেও তলস্তয় অনুগামী হয়ে নিজের ভূমিস্বত্ব কৃষকদের দান করে "কলঙ্কমুক্ত" হননি বলে রবীন্দ্রনাথকে কপটতার দায়ে অভিযুক্ত করেন। শেষে ভবানী সেনের দুটি প্রবন্ধর ('বাংলা প্রগতি সাহিত্যের আত্মসমালোচনা' এবং 'একজন মনস্বী ও একটি শতাব্দী')  বৈপরীত্যের বিস্ময় প্রকাশ করে নারায়ণ চৌধুরী যা বলেন, পরিহাসক্রমে তা তাঁর নিজের সম্পর্কেই বেশী প্রযোজ্য:

"হাওয়ামোরগের মত বায়ুর গতি বুঝে কেবলই যদি দিক বদলাতে হয় তাহলে তার মূল্যায়ন নামক অনুশীলনীর কোন সার্থকতা থাকে না" (সংস্কৃতি'  ৭১)।

রবীন্দ্রনাথ যে মূলতঃ একজন ভাববাদী এবং বুর্জোয়া শ্রেণীস্বার্থের কবি,  সে তথ্য তাঁর বিপুল সংখ্যক বেদান্তবাদী কাব্যকর্মে স্বতঃ প্রমাণিত। রবীন্দ্রনাথ নিজেও নিজেকে "জাত বুর্জোয়া" বলে মনে করতেন। সামন্ত যুগের অবক্ষয় ও ধনিক সভ্যতার অগ্রযাত্রা -- এই দুই সংঘাতময় যুগের ক্রান্তিলগ্নে প্রতিষ্ঠিত বুর্জোয়া পারিবারিক পরিবেশে তাঁর সাহিত্যজীবনের শুরু। আবার পঞ্চাশোর্ধ বয়সে তিনি বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সফলতা ও সমাজতান্ত্রিক যুগের সূচনাও প্রত্যক্ষ করেন। এইসব ক্রান্তিকাল যে কোনো সংবেদনশীল মানসে পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের উপকরণ সঞ্চার না করে পারে না। রবীন্দ্রনাথের অতিসংবেদনশীল মনে এইসব যুগপরিবর্তনের সংঘাত স্বভাবতই গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। প্রথম ও মধ্যবয়সের কিছু কিছু লেখায় এবং বিশেষ করে শেষ বয়সের রচনায় তিনি স্পষ্টতই নিজের মত পরিবর্তনের লক্ষণ প্রদর্শন করেন। তিনি তলস্তয় হতে চেয়েছিলেন কিনা সে প্রশ্ন অবান্তর হলেও যুগসন্ধিক্ষণের প্রতিক্রিয়া বিষয়ে তলস্তয়ের সঙ্গে তাঁর কিছু কিছু সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। সামন্ত ও বণিক যুগের নেতিবাচক দিকগুলো তলস্তয় ও রবীন্দ্রনাথ উভয়েই যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন। রবীন্দ্রনাথে অবশ্য জমিদারতন্ত্রের চেয়ে উঠতি বুর্জোয়ার এবং আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধেই বেশী বিষোদগার লক্ষ্য করা যায়। দুজনেই বিচারীবাস্তববাদী দৃষ্টিতে উভয় যুগের সমালোচনা করেন যদিও দুজনের সমাধানের পথ ভিন্ন। ব্যক্তিগত জীবনে এবং প্রধানতঃ 'পুনরুত্থান' (১৮৯৬) উপন্যাসে তলস্তয় যেখানে নির্দেশ করেন খৃস্ট নির্দেশিত মহাত্যাগের,  রবীন্দ্রনাথ সেখানে রাশিয়া ভ্রমণের পর সমবায় পদ্ধতিতে বাংলার গ্রামগুলির ভাগ্যোন্নয়নের কথা বলেন। তলস্তয়ের মতো তিনি জমিদারী ত্যাগ না করলেও নিজের লেখার স্বত্ব,  নোবেল পুরস্কারের অর্থ -- সমস্তই শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীকে দান করে যান। জমিদারী প্রথার অন্যায়ের কথা এবং সমবায় প্রণালীর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে 'রাশিয়ার চিঠি'-তে প্রকাশ্যেই তিনি এই বলে ঘোষণা করেন যে, "জমির স্বত্ব ন্যায়ত জমিদারের নয়... চাষীর" ('রবীন্দ্ররচনাবলী' ২০শ খণ্ড: ২৮৪)। আবার চাষীকে জমির স্বত্ব দিলেও যে চাষের দুঃখভার কমবে না সে বিষয়েও তিনি ছিলেন সচেতন। শিলাইদহে থাকতে তিনি চাষীদের জন্য সমবায় প্রথার প্রয়োজনীয়তা একান্তভাবে অনুভব করেন এবং সেই সঙ্গে এ ব্যাপারে তাঁদের সাহায্য করতে নিজের সীমাবদ্ধতা ও অপারগতা ব্যক্ত করেন তাঁর স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে:

শিলাইদহে আমি যে বাড়িতে থাকতুম তার বারান্দা থেকে দেখা যায়, খেতের পরে খেত নিরন্তর চলে গেছে দিগন্ত পেরিয়ে। ভোরবেলা থেকে হাল লাঙল এবং গোরু নিয়ে এক একটি করে চাষী আসে,  আপন টুকরো টুকরো খেতটুকু ঘুরে ঘুরে চাষ করে চলে যায়। এইরকম ভাগকরা শক্তির যে কতটা অপচয় ঘটে প্রতিদিন সে আমি স্বচক্ষে দেখেছি। চাষীদের ডেকে যখন সমস্ত জমি একত্র করে কলের লাঙলে চাষ করার সুবিধার কথা বুঝিয়ে বললুম,  তারা তখনই সমস্ত মেনে নিল। কিন্তু বললে, আমরা নির্বোধ,  এত বড়ো ব্যাপার করে উঠতে পারবো কী করে। আমি যদি বলতে পারতুম, এ ভার আমিই নেব, তাহলে তখনই মিটে যেতে পারতো। কিন্তু আমার সাধ্য কী। এমন কাজের চালনাভার নেবার দায়িত্ব আমার পক্ষে অসম্ভব;  সে শিক্ষা,  সে শক্তি আমার নেই। (২৮৪-২৮৫)

রবীন্দ্রনাথ যেমন প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সর্বতোভাবে জড়িত ছিলেন না,  তেমনি রাজনৈতিক নেতৃত্বের শ্রেণীচরিত্র সম্পর্কেও ছিলেন না যথেষ্ট সচেতন। এজন্য স্বাভাবিকভাবেই সমাজপরিবর্তনে তাঁর ক্ষমতা ছিলো সীমিত। সমবায় প্রণালীর প্রচলন সুষ্ঠুভাবেই করতে পারে যে রাজনৈতিক শিক্ষা,  শক্তি তথা নেতৃত্ব তার পরিচয় রবীন্দ্রসাহিত্যে অনুপস্থিত। তবে প্রত্যক্ষ রাজনীতির বাইরে নিজস্ব শিক্ষা ও পরিবেশের প্রেক্ষিতে তাঁর পক্ষে সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভূমিকা গ্রহণ,  নতুন শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে যতোটুকু জড়িত হওয়া সম্ভব ছিলো তা তিনি হয়েছিলেন। 'রাশিয়ার চিঠি'-তে তিনি লেখেন,  

"আমি দেশের মধ্যে একটি কাজকেই শ্রেষ্ঠ বলে মেনে নিয়েছিলুম; জনসাধারণকে আত্মশক্তিতে প্রতিষ্ঠা দেবার শিক্ষা দেব বলে এতকাল ধরে আমার সমস্ত সামর্থ  দিয়েছি" (২৮২)।

এই আত্মশক্তিতে প্রতিষ্ঠিত করার প্রধান উপায় শিক্ষার ওপরই রবীন্দ্রনাথের সর্বাত্মক গুরুত্ব। শান্তিনিকেতনে তিনি ঔপনিবেশিক শিক্ষাপদ্ধতির বাইরে দেশী জীবনযাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি অভিনব শিক্ষাপদ্ধতিই প্রচলিত করতে চেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ যথার্থই উপলব্ধি  করেছেন যে,  জীবনযাত্রা থেকে বিচ্ছিন্ন করলে শিক্ষা 'ভাণ্ডারের সামগ্রী হয়, পাকযন্ত্রের খাদ্য হয় না" (২৯৭)। তাঁর সোভিয়েত ভ্রমণের মূল কারণও ছিলো সেদেশের শিক্ষাপদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করা। সোভিয়েত রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থা, বিশেষতঃ এই ব্যবস্থায় ব্যষ্টির চেয়ে সমষ্টিকে বেশী গুরুত্ব দেওয়া,  "জবরদস্ত লোকের একনায়কত্ব" ইত্যাদি সম্পর্কে তিনি বিশেষ আশাবাদী না হলেও সোভিয়েত শিক্ষা প্রণালীর যে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা তিনি করেন তার প্রধান কারণ হলো সেখানে শিক্ষাকে জীবনযাত্রার সঙ্গে মিলিয়ে চালু করা হয়েছে (৩২৭-৩২৮)।

কিন্তু শিক্ষাকে জীবনধারার সঙ্গে মেলাতে পারে যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভারতে সে ধরণের রাজনৈতিক নেতৃত্বের অসম্ভাব্যতার কিংবা সম্ভাবনার কথা রবীন্দ্রনাথের রচনায় নেই। অবশ্য রাজনৈতিক শক্তি তথা সংগঠিত ও সুপরিচালিত সমষ্টিশক্তি ব্যতিরেকে ব্যষ্টির ক্ষুদ্রশক্তি যে সমাজ পরিবর্তনে নিতান্তই অপ্রতুল সে বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ একেবারে অসচেতন ছিলেন না। নতুন শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলনে কর্তৃপক্ষের আনুকুল্য তিনি চেয়েছেন। যৎসামান্য যা পেয়েছেন তা প্রত্যাখ্যান করেননি। কিন্তু বার বার তাঁকে হতাশ হতে হয়েছে। 'রাশিয়ার চিঠি'-তে তিনি দুঃখ করে লেখেন:

প্রায় সত্তর বছর আমার বয়স হলো;  এতকাল আমার ধৈর্যচ্যুতি হয়নি। নিজেদের দেশের অতি দুর্বহ মূঢ়তার বোঝার দিকে তাকিয়ে নিজের ভাগ্যকেই বেশি করে দোষ দিয়েছি। অতি সামান্য শক্তি নিয়ে, অতি সামান্য প্রতিকারের চেষ্টাও করেছি,  কিন্তু জীর্ণ আমার রথ যত মাইল চলেছে, তার চেয়ে বেশি সংখ্যায় দড়ি ছিঁড়েছে, চাকা ভেঙেছে। ...কর্তৃপক্ষের কাছে সাহায্য চেয়েছি; তাঁরা বাহবাও দিয়েছেন;  যেটুকু ভিক্ষে দিয়েছেন তাতে জাত যায়,  পেট ভরে না। সবচেয়ে দুঃখ এবং লজ্জার কথা এই যে, তাঁদের প্রসাদলালিত আমাদের স্বদেশী জীবরাই সবচেয়ে বাধা দিয়েছে (৩১১)।

রবীন্দ্রনাথকে একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে এবং তাঁর সামাজিক আবহের প্রেক্ষিতে স্মরণে রেখে বিচার করলে দেখা যায় যে তাঁর মনস্বিতায় যথেষ্ট প্রগতিশীল উপকরণ সন্নিবেশিত হয়েছিলো। কাব্যসাধনায় তিনি প্রধানতঃ আশাবাদী ভাববাদে কিংবা সর্বাস্তিবাদী ধ্যানধারণায় অভিষিক্ত হলেও উপন্যাস,  প্রবন্ধ,  চিঠিপত্র,  এবং রাজনৈতিক বিশ্বাসে তিনি পাশ্চাত্য যুক্তিবাদ ও বাস্তববাদের অনুসারী। তাঁর পক্ষে মার্কসবাদী হওয়া সম্ভব হয়নি,  কিন্তু কংগ্রেসের প্রধান নেতা মোহনদাস গান্ধীর অহিংসা,  সত্যব্রত,  ব্রহ্মচর্য ইত্যাদি প্রতিক্রিয়াশীল দর্শনও তাঁকে কখনো আকৃষ্ট করেনি। বিভিন্ন রাজনৈতিক নিষ্পেষণের ঘটনায় তিনি যতোটা স্বতঃস্ফুর্তভাবে প্রতিবাদ করেছেন, অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও তেমন করেননি। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাযজ্ঞের  প্রতিবাদে তিনি সামাজ্যবাদী 'নাইট'  উপাধি বর্জন করেন যদিও গান্ধী তখনও তাঁর 'কাইজার-ই-হিন্দ'  উপাধিটি আঁকড়ে ছিলেন। এসব প্রসঙ্গ বিচার করে বাংলা সাহিত্যের প্রধান ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া স্বার্থের প্রতিনিধি হিসেবে এক কথায় বাতিল করতে চাইে তা হবে নিতান্ত অবৈজ্ঞানিক ও অমার্কসবাদী কাজ। পুশকিন ও তলস্তয়ের রচনায় পর্যাপ্ত প্রতিক্রিয়াশীলতার উপাদান থাকা সত্বেও লেনিন বিভিন্ন প্রবন্ধে ও চিঠিপত্রে তাঁদের ভূয়সী প্রশংসা করেন। কমিউনিস্ট মতবাদের একনিষ্ঠ সমর্থক, ভাষ্যবাদী মায়াকোভস্কির চেয়ে তিনি পুশকিনকে অনেক বড়ো কবি হিসেবেই মনে করতেন। তলস্তয়ের প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন লেনিন প্রত্যাখ্যান করলেও রাশিয়ার মুঝিকদের জীবনচিত্র এবং রুশ সামন্তসমাজের অবক্ষয় তলস্তয় যে বস্তুনিষ্ঠভাবে শিল্পায়িত করেছেন লেনিন তার যথোপযুক্ত প্রশংসা করে তাঁকে ১৯০৫-৩৪ বিপ্লবের দর্পণ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। একইভাবে মার্কস এবং এঙ্গেলস,  হোমার,  সফোক্লিস,  সেক্সপীয়র,  ও বালজাকের অনুরাগী পাঠক ছিলেন এজন্যই যে তাঁদের রচনায় তাঁদের সমাজের বাস্তবচিত্র সম্পূর্ণ বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। শুধু তাই নয়,  মহৎশিল্পের কালোত্তীর্ণতার প্রতিও মার্কস-এঙ্গেলেসের ছিল শ্রদ্ধাবোধ। সম্পূর্ণ ভিন্ন উৎপাদন ব্যবস্থা ও সামাজিক সম্পর্কের আওতায়রচিত প্রাচীন গ্রীক কবিদের রচনা কি করে আড়াই হাজার/দু হাজার বছর পরেও একজন পাঠককে আলোড়িত,  অনুপ্রাণিত,  ও স্পর্শ করতে পারে সেকথা ভেবে মার্কস বিস্ময় প্রকাশ করেন এবং,  কিছুটা দ্বিধার সঙ্গে হলেও শিল্পসাহিত্যের সর্বজনীনতার প্রসঙ্গ মেনে নেন। দাস কিংবা সামন্ত কিংবা ধনিক সমাজব্যবস্থায় লালিত কালোত্তীর্ণ শিল্পীদের যথোচিত স্বীকৃতিদানে কমিউনিস্ট মতবাদের পুরোধা দার্শনিকরা কিছুমাত্র কার্পণ্য করেননি। এজন্য মার্কসবাদী সমালোচকদেরও উচিত রবীন্দ্রনাথকে তাঁর সামগ্রিকতায় বিচার করে,  সমাজবিবর্তনে তাঁর প্রগতিশীল ভূমিকা এবং সাহিত্যকর্মে এই ভূমিকার প্রতিফলন সম্পর্কে ব্যাপক ও সূক্ষ্ম পর্যালোচনা করে তাঁর বিশাল শিল্পভাণ্ডার থেকে প্রগতিশীল উপকরণ আহরণ এবং প্রতিক্রিয়াশীল উপাদান বর্জন করা। এভাবেই রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর শিল্পের কালোপযোগী তাৎপর্য প্রদর্শন ও মূল্যায়ন সম্ভব।

বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব মাধ্যমকেই রবীন্দ্রনাথকে যতোটা গড়ে নিতে হয়েছে এবং কেবল গড়ে নিতেই নয়,  একটা পরিণত রূপ ও উৎকর্ষও সাধন করতে হয়েছে,  তেমন অন্য কোনো সাহিত্যে কোনো একক ব্যক্তিত্ব করেছেন বলে নজীর নেই। আবার নিজ সাহিত্যের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ নিজেও ছিলেন সচেতন। জীবনে জীবন যোগ করার তাঁর যে আর্তি,  কৃষাণের জীবনের শরিক এবং মাটির কাছাকাছি রয়েছে যে অনাগত কবি তার বাণীর জন্য রবীন্দ্রনাথের যে উদগ্রীব হয়ে থাকা,  এবং পূর্ণশক্তি কাজের নৈপুণ্যে এবং আনন্দকে কর্মরত চীনা শ্রমিকের দেহসৌষ্ঠবে দেখতে পেয়ে জনতার সংগঠিত শক্তিতে তাঁর যে আস্থাস্থাপন ইত্যাদি তাঁর প্রগতিশীল মনস্বিতার প্রকৃষ্ট প্রকাশ। বদরুদ্দীন উমর তাঁর একটি প্রবন্ধে ("শিল্পী সাহিত্যিকের সমাজচেতনা ও সৃষ্টিশীল শিল্প সাহিত্য" 'সংস্কৃতি',  জুন ১৯৮২:২১-৫৩) এ বিষয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা করে দেখিয়েছেন যে রবীন্দ্রনাথে কাজের কাব্য এবং মানুষের শ্রমের ছন্দমিলনের যে আকুলতা 'জাপান যাত্রী'-র একটি দিনের বর্ণিত হয়েছে তা কৃষক শ্রমিকের জীবনের শরিক শিল্পীর দিগন্ত প্রসারণের স্পষ্ট ইঙ্গিতবহ হিসেবে প্রয়ালোচিত হতে পারে। রবীন্দ্রসাহিত্য, বিশেষতঃ তাঁর জাতীয়তাবাদী ও দেশাত্মবোধক গান ও কবিতা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এবং আরও তীব্রভাবে ষাটের দশকে বাংলাদেশের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এবং ১৯৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রভূত প্রেরণা ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। কৃষক শ্রমিকের প্রকৃত স্বাধীনতা সংগ্রামের কিছু কিছু উপাদান যে এইসব কাব্য ও গানে, প্রবন্ধে ও পত্রগুচ্ছে,  গ্রামীণ জীবনের গল্পে ও উপাখ্যানে প্রচ্ছন্নভাবে নিহিত নেই সেকথা ব্যাপক গবেষণা কিংবা অনুসন্ধান না করে বলা যায় না। এসব কারণে প্রকৃত মার্কসবাদী সমালোচকদের কর্তব্য হলো রবীন্দ্রসাহিত্যে প্রতিক্রিয়াশীল দর্শনের মাংস-কৃমি না খুঁটে বরং তাঁর সাহিত্যের প্রগতিশীল উপাদান সন্ধান করা এবং এভাবে রবীন্দ্রনাথের যতোটুকু সম্ভব ততোটুকুই কৃষক-শমিক তথা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত জনতার স্বার্থে নিয়োজিত করা। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিতে রবীন্দ্রশিল্প মূল্যায়নের ক্ষেত্র অবারিত। রবীন্দ্রসমালোচনার এই প্রবণতাই হল আবেগবর্জিত এবং সেজন্য যত্যার্থ বৈজ্ঞানিক।

 

রচনাটি ১৯৮৯ সালে নিউ জার্সিতে অনুষ্ঠিত রবীন্দ্রমেলার স্মারকগ্রন্থ রবিবর্ণালী থেকে নেওয়া। কৃতজ্ঞতা স্বীকার - শ্রীমতী বনানী ঘোষ।


লেখক পরিচিতি - খালিকুজ্জামান ইলিয়াস: পড়াশুনো বাংলাদেশে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়ার্ড ইউনিভার্সিটিতে। বাংলাদেশের জাহাঙ্গীর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের অধ্যাপক। মূলতঃ প্রবন্ধকার, তবে অনুবাদের কাজ কিছু কিছু করেছেন। যেমন, মিখাইল শোলোকভের ছোটগল্পের সংকলন, রিউনো সুকে আকুতাগাওয়ার ছোটগল্পের সংকলন এবং ছোটদের জন্য গালিভার ট্র্যাভেলস।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।