ধর্ম
নভেম্বর ১৫, ২০১৫
চার বৌ - শারিয়া কি বলে...
হাসান মাহমুদ
[ইসলাম ও শারিয়া - হাজার বছরের ওপর হয়ে
গেল ইসলাম প্রচারকদের দেয়া শান্তির ইসলাম দিয়ে আমাদের পূর্বপুরুষেরা
ইসলামি জীবন কাটিয়েছেন, কারো সাধ্য হয়নি এ-কথা বলার যে তাঁরা
মুসলমান ছিলেন না বা কারো চেয়ে কম মুসলমান ছিলেন। তাঁরা নিজেরাও
কখনো বলেননি বৃটিশের রাজত্বে মুসলমান থাকতে তাঁদের কোন অসুবিধে
হয়েছে। কিন্তু এখন বাংলায় এক নূতন ধরণের ইসলাম শক্তভাবে ঘাঁটি
গেড়ে বসেছে। এর অনুসারীরা বিশ্বাস করেন ইসলামি রাষ্ট্র না
হলে পুরোপুরি ইসলাম পালন করা যাবে না, ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা
করতেই সব নবী-রসুলেরা দুনিয়ায় এসেছিলেন, রাজনীতি হল ইসলামের
অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, শারিয়া-আইন হল ইসলামের প্রাণ, শারিয়া-আইন
প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক চেষ্টা না করলে আলাহ্কে খুশী করার “আর
কি উপায় আছে আমি জানি না” (মওলানা মওদুদি) ইত্যাদি।
এই ইসলাম এবং আমাদের হজরত নিজামুদ্দীন আওলিয়া, মঈনুদ্দীন চিশতি,
শাহজালাল, শাহ মখদুম, শাহ পরাণ, হাজী দানেশমন্দ বায়েজীদ বোস্তামীর
ইসলামের নাম এক হলেও এ-দু’টো সম্পূর্ণ দুই ধরণের ইসলাম–এদের মধ্যে
সংঘর্ষ আছে। একটা শারিয়া-ভিত্তিক ; অন্যটায় শারিয়া, রাষ্ট্র, ফতোয়া
এ-সব নেই। সুফি-ইসলামের অনেক কিছুকেই শারিয়া-ইসলাম অনৈসলামিক ও
ইসলাম-বিরোধী মনে করে। সে-জন্যই শারিয়া-ইসলাম সুফি-ইসলামকে আঘাত
করে এবং শক্তি পেলেই সে সুফি-ইসলামকে উচ্ছেদ করে দেবে। এ নিয়ে
আলোচনা করা দরকার কারণ যা কিছু দিয়ে জীবন নিয়ন্ত্রিত হয় সে-সব
নিয়ে ক্রমাগত আলোচনার দরকার আছে যেমন ওষুধ, দ্রব্যমূল্য, রাষ্ট্র,
আইন, অপরাধ, শাস্তি, আদালত, খাদ্য-ওষুধে ভেজাল ইত্যাদি।
কারণ এ-গুলো দিয়ে জীবন মানবাধিকার রক্ষা হয় অথবা ধ্বংস হয়। মানবাধিকার
তো কোন দর-কষাকষির ব্যাপার নয়, এমনকি ধর্মের নামেও নয়। তাই প্রতিটি
মানুষের দায়িত্ব দুনিয়ার যে-কোন জায়গার অন্যায়ের প্রতিবাদ করা।
যে-কোন জায়গায় অন্যায় হলে তা সর্বত্র ন্যায়ের ওপর হুমকি। তাই আমরা
বাংলাদেশে বসে প্যালেস্টাইন, কাশ্মীর, চেচনিয়া, গুজরাটের মুসলিম-নিধনের
প্রতিবাদ করি, আফগানিস্তান-ইরাকে আমেরিকা-বৃটেনের হামলা-গণহত্যার
প্রতিবাদ করি।
অন্যান্য ধর্মের মত ইসলামের নামেও কিছু অত্যাচার চিরকালই
হয়েছে তা সবাই স্বীকার করেন। ভুলটা করেছে মানুষ, আর তার দায়
পড়েছে ইসলামের ওপর। দলিল জানা নেই বলে সাধারণ মানুষ এ-অত্যাচারের
প্রতিবাদ করতে পারেন না। তাই আমি মূল ইসলামি কেতাব থেকে দু’পক্ষের
কিছু দলিল দেখাব যাতে জনগণের মনে বিশ্বাসের শক্তি দৃঢ় হয়।
মনে রাখতে হবে, “মানুষ তার স্রষ্টাকে তুষ্ট করতে যত সার্বিকভাবে
ও যত উলাে সর সাথে মানুষের ওপর নিষ্ঠুরতা করেছে ততটা সে অন্য
কোন কারণে করেনি” (প্যাস্কেল “?”). ভারতের মন্দির-রাষ্ট্র,
, ইউরোপের গীর্জা-রাষ্ট্র তার উদাহরণ। এইসব “স্রষ্টার সৈন্যেরা”
কখনোই মানবতার ডাকে সাড়া দেয়নি, অত্যাচারিতের ব্যথা বোঝেনি।
ওদেরকে সর্বদাই রাষ্ট্রীয় আইন ও গণরোষের কালবৈশাখী দিয়ে উৎখাত
করতে হয়েছে। বাংলার ঈশানে সেই কালবৈশাখীর মেঘ এখন দ্রুত ঘনায়মান।
তাই এ-ব্যাপারে দলিলগুলো দেখার দরকার আছে ॥]
চার বৌ
শারিয়ার তালাক এবং লেয়ান আইনে স্বামী তাৎক্ষণিকভাবে বৌকে তালাক
দিতে পারে, কাউকে তার কারণ বলতে হবে না। আবার ওই শারিয়া আইনেই
পুরুষ ইচ্ছেমত চারটে পর্যন্ত বিয়ে করতে পারে, কাউকে তার কারণ বলতে
হবে না। অর্থাৎ সকাল-সন্ধ্যায় তালাক-বিয়ের নাটক চালিয়ে যাবার একটা
চমৎকার ফ্রী লাইসেন্স দেয়া আছে স্বামীকে। লাইসেন্সটার ফায়দা অতীত-বর্তমানে
অনেকে তুলেছেও বেশ। তার মানেই হল ব্যাপারটার মধ্যে কোথাও নিশ্চয়ই
নারী-বিরোধী একটা ফাঁক আছে। যে নারীর মাথায় সেটা পড়ে বজ্রাঘাত
হয়েই পড়ে। এ-আইনের ঘোর সমথর্ক রাও নিজের মেয়ে- বোনের জন্য অবশ্যই
অবিবাহিত বর খোঁজেন। তাতে করে আবারও প্রমাণ হল এতে নারীদের প্রতি
অমানবিকতাও আছে। কিন্তু ইসলাম তো কোন অমানবিক প্রাকে সমর্থন করতে
পারে না। তাহলে ফাঁকটা কোথায় ?
ফাঁকটা বহুবিবাহে নয়, বহুবিবাহের পদ্ধতিতে। ফাঁকটা কোরাণের পুরুষতান্ত্রিক
স্বার্থপর ব্যাখ্যায়। প্রতিটি মুসলিম নারীকে সারাটা জীবন এ-আশঙ্কা
বা সম্ভাবনার মধ্যে কাটাতে হয় এটা অবশ্যই তাদের অপমান। এগুলো কোরাণের
নির্দেশ হবার কথা নয়। সেজন্যই বহু মুসলিম দেশে শক্ত আইন করে বহুবিবাহকে
কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। ওখানকার মওলানারা তো আর জেনেশুনে
ইসলামের বিরুদ্ধে যাননি। যেমন সেনেগাল, মরক্কো, তিউনিসিয়া ইত্যাদি
(WLUML পৃঃ ৭০), ওসব দেশে বহুবিবাহ করতে গেলে রীতিমত সরকারের কাছে
দরখাস্ত করতে হয়, তদন্ত হয়, তারপর অনুমতি মেলে বা দরখাস্ত নাকচ
হয়। পাকিস্তানেও প্রেসিডেণ্ট আয়ুব খান এরকম কিছু আইন করেছিলেন
(১৯৬১) যা এখনও বলবৎ আছে কিন্তু শুধু কাগজে-কলমে।
চলতি প্রথা কেন ইসলাম-বিরোধী তা দেখার আগে দেখা যাক অনিয়ন্ত্রিত
চার বিয়ের সমর্থনে কি কি যুক্তি দেখান হয়।
১ - মেয়েরা বাঁজা হতে পারে।
২ - মেয়েদের এমন অসুখ হতে পারে যাতে শারীরিক সংসর্গ সম্ভব নয়।
৩ - মাসে এক সপ্তাহ এবং বাচ্চা জন্ম দেবার ব্যাপারে লম্বা সময়
ধরে মেয়েদের সাথে শারীরিক সংসর্গ সম্ভব নয়।
৪ - মেয়েরা আগেই বুড়িয়ে যায়।
৫ - পুরুষের শারীরিক চাহিদা নারীর চেয়ে ৯৯গুণ বেশী − বড়পীর সাহেবের
বই “গুনিয়াতুত ত্বালেবীন” পৃঃ ৯৮।
৬ - কোন কোন মেয়ে এটা পছন্দ করেন − (আমেরিকার বিখ্যাত ইসলামি নেত্রী
আমিনা আস্সিলমির ভিডিও)।
৭ - সমাজের ভালোর জন্য পাশ্চাত্যের উন্মুক্ত-যৌনতার চেয়ে এ-ইসলামি
আইন ঢের ভালো।
৮ - দুনিয়ায় মেয়েদের সংখ্যা পুরুষের চেয়ে বেশি।
১ ও ২ নম্বর কারণ দু’টো ধোপে টেকে না কারণ ওগুলো পুরুষের ক্ষেত্রেও
হতে পারে। ৩ নম্বরটা কোন যুক্তিই নয়। ও-কারণটা পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ
স্বামীদের ক্ষেত্রেও ঘটেছে, আমাদের বাবা-মায়ের ক্ষেত্রেও ঘটেছে।
কিন্তু তাঁরা ইন্দ্রিয়পালনের চেয়ে কবিতার মত নিজের পরিবার গড়ে
তোলার আনন্দেই জীবন কাটিয়েছেন। ৪ নম্বরটা কুযুক্তি ছাড়া আর কিছু
নয়। ৫ নম্বরটা নিয়ে আলোচনা-বিতর্ক অর্থহীন। কে কার চেয়ে কত চাঙ্গা
তা সংখ্যা গুনে বলা সম্ভব নয়। এর সাথে নারীর হরমোন ইঞ্জেকশন আর
পুরুষের ভায়াগ্রা যোগ করলে ও-যুক্তির হালে আরোই পানি থাকবে না।
৬ নম্বরটার কথা মেয়েরাই ভাল বলতে পারবেন, তবে আমার ছোট বোনকে প্রশ্নটা
করায় সে রান্না করার গরম হাতা নিয়ে সগর্জনে আমাকে তাড়া করেছিল।
৭ নম্বর এক-কথায় সেরে নিচ্ছি। কোন মুসলিম সমাজেই বহুবিবাহ দিয়ে
কোনকালেই অবৈধ সম্পর্ক কমেওনি, বন্ধও হয়নি। সেই অবৈধ সম্পর্ক,
আর পশ্চিমের অবাধ যৌনতা, এ-দু’টোই হল গিয়ে পচা ডিম। দু’টো পচা
ডিমের মধ্যে কোনটা বেশি পচা তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। পরীক্ষায়
একশ’র মধ্যে পাঁচ পাওয়া ছাত্রের চেয়ে পঁচিশ পাওয়া ছাত্র “ঢের ভালো”
কিন্তু দু’জনেই ফেল। পাশ্চাত্যের চেয়ে “ঢের ভালো” হবার জন্য ইসলাম
আসেনি, চরম ভালো দাবি নিয়েই এসেছে।
এবারে ৮ নম্বর। জাতিসঙ্ঘের ১৯৬৪ সালের তালিকায় আছে কোরিয়া, রাশিয়া,
বিলাত, ফ্রান্স, জার্মানী, চেকোস্লোভাকিয়া, পোল্যাণ্ড, রুমানিয়া,
হাঙ্গেরী, এবং আমেরিকায় মেয়েরা গড়পড়তায় ৫২%, পুরুষ ৪৮% (“উয়োম্যান
অ্যাণ্ড হার রাইট্স্” পৃঃ ২৪৬ − আলামা মুতাহ্হেরি), কিন্তু এ-তত্ত্ব
মানলে তো চার পর্যন্ত যাবার দরকারই নেই, ৫২কে ৪৮ দিয়ে ভাগ করলে
যা হয় সেই ভগ্নাংশ বিয়ে করতে হয়। সেটা কিভাবে সম্ভব ? ইরাণের মত
দেশে কি হবে ? কারণ : “ইরাণ ব্যতিক্রম। সেখানে গত জরীপে পুরুষের
সংখ্যা নারীর চেয়ে বেশি দেখা গেছে” (পৃঃ ২৪৭), কিন্তু তবু ইরাণে
বহুবিবাহ নিষিদ্ধ তো নয়ই বরং গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত মু’তা১ বিয়েও
সরগরম চালু আছে। তাই, হিসেবে মিলছে না বলে ৮ নম্বরটা নিজে থেকেই
বাতিল হয়ে যায়।
সতীনের সংসার মানে প্রায়ই নরক। তবু যেহেতু কখনো কখনো এটা ছাড়া
চলে না তাই কোরাণ একে শর্ত-সাপেক্ষে অনুমতি দিয়েছে মাত্র একটা
জায়গায়, সুরা নিসা’র ৩ নম্বর আয়াতে ২ − “এতিমদের ৩ তাদের সম্পদ বুঝাইয়া
দাও। খারাপ মালামালের সাথে ভালো মালামালের অদল-বদল করিও না। আর
তাহাদের ধনসম্পদ নিজেদের ধনসম্পদের সাথে সংমিশ্রিত করিয়া তাহা
গ্রাস করিও না। নিশ্চয় ইহা বড়ই মন্দ কর্ম।
আর যদি তোমরা ভয় কর যে এতিম মেয়েদের হক যথাযথভাবে পূরণ করিতে
পারিবে না, তাহা হইলে সেই সব মেয়েদের মধ্য হইতে যাহাদিগকে ভাল
লাগে তাহাদিগকে বিবাহ করিয়া নাও দুই, তিন বা চারিটি পর্যন্ত। আর
যদি এরূপ আশঙ্কা কর যে তাহাদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গত আচরণ বজায় রাখিতে
পারিবে না তবে একটিই।"
আয়াত ১২৯ − “তোমরা কখনও নারীদিগকে সমান রাখিতে পারিবে না যদিও
ইহা চাও” -এর ভিত্তিতে কিছু মওলানা চিরকাল দৃঢ়ভাবে দাবি করেছেন
যে, কোরাণ বহুবিবাহ বাতিল করে এক স্ত্রী বহাল রেখেছে। কারণ “ন্যায়সঙ্গত”
অর্থাৎ “আদ্ল”-এর মধ্যে প্রেম-ভালবাসাও অন্তর্ভুক্ত যা সমান ভাগে
ভাগ করা যায় না। তাঁরা বলেন বিত্তশালী স্বামী চার বৌকে ওজনদরে
সমান বাড়ি-গাড়ি দিয়ে রাখলেই বা কি? সেখানে কি ভালবাসার তাজমহল
গড়ে ওঠা সম্ভব ? ভালবাসা কি ভাগাভাগি করার জিনিস? প্রেমে ভাগীদার
গজালে তো মানুষ খুন পর্যন্ত করে ফেলে।
হাজার বছর ধরে নারী ছিল বস্তুসমান। ওরাও যে মানুষ, ওদেরও যে কিছু
স্বপ্ন কিছু অধিকার থাকতে পারে তা শুধু পুরুষ কেন, নারীর মাথায়ও
ছিল না। যত খুশি বিয়েতে অভ্যস্ত পুরুষ ওতে খারাপ কিছু দেখতেও পেত
না। তাই আয়াত ৩ নাজিল৪ হলে তারা কিছুটা ছাড় চেয়েছিল নবীজীর কাছে।
কিন্তু তাদের এই আবদার পাত্তা দেয়নি কোরাণ, তখনই নাজিল হয় আয়াত
১২৭ − “আর তাহারা আপনার কাছে নারীদের বিবাহের অনুমতি চায়। বলিয়া
দিন : আলাহ তোমাদিগকে তাহাদের সম্পর্কে অনুমতি দেন এবং কোরাণে
তোমাদিগকে যাহা পড়িয়া শোনানো হয় তাহা ঐ-সব পিতৃহীনা নারীদের বিধান
যাহাদিগকে তোমরা নির্ধারিত অধিকার প্রদান কর না অথচ বিবাহ করিবার
বাসনা রাখ।”
শব্দগুলো খেয়াল করুন − “বিবাহের অনুমতি চায়…যাহা পড়িয়া শোনানো
হয়।” বিয়ে সম্পর্কে কি পড়ে শোনানো হয়েছে আগে ? শোনানো হয়েছে “সেই
সব মেয়েদের মধ্য হইতে বিবাহ করিয়া নাও।” এই যে “সেই সব মেয়ে” −
এরা কারা ? এরা “ঐ-সব পিতৃহীনা নারী” ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।
পিতৃহীনা নারী মানে বাপ-মরা মেয়ে ছাড়া আর কিছুই নয়। ওহুদ যুদ্ধে
অনেকে নিহত হলে এতিমের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল, তাদের স্বার্থরক্ষা
করার দরকার ছিল। কিন্তু ইরাণের বা ক্যানাডার মেয়েকে বিয়ে করলে
তো আর বাংলাদেশের এতিমের স্বার্থরক্ষা হল না। তারই সমাধান দিয়েছিল
এই আয়াত। দেখুন মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ মুহসিন খানের বোখারি-অনুবাদ
৭ম খণ্ড, হাদিস ৩৫, ৫৯ ও ৬২ , কিংবা দেখুন বাংলাদেশ লাইব্রেরীর
প্রকাশিত আবদুল করিম খানের সঙ্কলিত সহি বোখারি পৃঃ ৬৭৮, হাদিস
২৪২৮, প্রতিটি শব্দ খুব খেয়াল করে পড়বেন : −
“আয়েশা (রাঃ)-কে আয়াতটি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি বলিলেন
− অনেক সময় এতিম মেয়ে ধনশালী ও সুন্দরী হইলে অভিভাবক নিজেই উপযুক্ত
মোহর না দিয়া তাহাকে আপনার হওয়ার সুবাদে বিবাহ করে কিন্তু এতিম
বালিকা ধনবান না হইলে বা
সুন্দরী না হইলে সেইরূপ করে না। এই অন্যায় রহিত করণার্থেই এই আয়াত
নাজেল হইয়াছে। এতিম মেয়ে সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা নাজেল হওয়ার পর লোকেরা
রসুল (দঃ)-কে শিথিলতার আশায় জিজ্ঞাসা করিলে পূর্ব কড়াকড়ি বহাল
থাকার ঘোষণা করিয়া আয়াত নাজেল হইল (আয়াত ১২৭) − “তাহারা আপনার
নিকট মেয়েদের সম্পর্কে মসআলা জিজ্ঞাসা করিতেছে। আপনি বলিয়া দিন,
− আলাহ তোমাদিগকে তাহাদের সম্বন্ধে ব্যবস্থা দান করিতেছেন এবং
পিতৃহীনা নারীগণ সম্বন্ধে তোমাদের প্রতি কেতাব হইতে পাঠ করা হইয়াছে
যে, তাহাদের জন্য যাহা বিধিবদ্ধ তাহা তোমরা প্রদান কর না এবং তাহাদিগকে
বিবাহ করিতে বাসনা কর।” (উদ্ধৃতি শেষ)
“এই অন্যায় রহিত করণার্থেই এই আয়াত নাজেল হইয়াছে” কথাটার মানেই
হল যেখানে “এই অন্যায়” নেই সেখানে খাটাবার জন্য কোরাণ এ-নির্দেশ
দেয়নি। তাছাড়া − “তাহাদের জন্য যাহা বিধিবদ্ধ তাহা তোমরা প্রদান
কর না ”− এ-কথাটা দুনিয়ার অন্যান্য নারীর ক্ষেত্রে খাটে না কাজেই
বহুবিবাহের নির্দেশটা এতিম বালিকাদের বাইরে খাটে না। খোদ আলাহ’র
রসুল এই একই উদাহরণ রেখে গেছেন আমাদের জন্য। দেখুন একই বাংলা-সহি
বোখারি, পৃঃ ৬৮৭, উদ্ধৃতি :
হাদিস ২৪৭২ − “আলী (রাঃ) আবু জহলের কন্যাকে বিবাহ করার পয়গাম পাঠাইয়াছে
জানিতে পারিয়া ফাতেমা (রাঃ) রসুলুলাহ (দঃ)-এর নিকট গিয়া বলিলেন
− আপনার আত্মীয়স্বজনগণ বলিয়া থাকে যে আপনি আপনার মেয়েদের পক্ষ
হইয়া একটু রাগও দেখান না। ঐ দেখুন আলী (রাঃ) আবু জহলের কন্যাকে
বিবাহ করিতে চাহিতেছে। রসুলুলাহ (দঃ) বলিলেন…‘নিশ্চয় ফাতেমা আমার
কলিজার টুকরা। তাহার ব্যথায় আমি ব্যথিত হই। নিশ্চয়ই আমি হালালকে
হারাম বা হারামকে হালাল করিতে চাহি না। অবশ্য এই কথা বলিতেছি যে,
আলাহর কসম ! আলাহর রসুলের কন্যা এবং আলাহর শত্রুর কন্যা একই ব্যক্তির
বিবাহে একত্রিত হইতে পারিবে না।’ এই ভাষণের পর আলী (রাঃ) বিবাহের
প্রস্তাব পরিত্যাগ করিলেন।”
এটা আছে মুহসিন খানের অনুদিত বোখারী
৪র্থ খণ্ড হাদিস ৩৪২ ও ৫ম খণ্ড হাদিস ৭৬।
এখানে বিবি ফাতেমা’র আপত্তি স্পষ্ট। কোরাণ অনিয়ন্ত্রিত বহুবিবাহ
জায়েজ করলে তিনি অবশ্যই আপত্তি করতেন না। তাছাড়া “তাহার ব্যথায়
আমি ব্যথিত হই” নবীজীর নিজের মুখের কথা। অর্থাৎ সতীনের ঘরে মেয়েদের
ব্যথা আছে, নিশ্চয়ই আছে। যে-কারণে সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গম্বর আলাহ’র
কসম খেয়ে “হারাম”-এর মত কঠিন শব্দে দ্বিতীয় বিয়ে নাকচ করেছিলেন,
কি কারণ সেটা ? সে কি আলাহর শত্র“র মেয়ে এই কারণে ? না, তা অবশ্যই
নয়। নীচে দেখুন : −
হাদিস ২৪৭৩, সূত্র হজরত মেসওয়ার ইবনে মাখরামা (রাঃ)। “আমি রসুলুলাহ
(আঃ)-কে মিম্বরে বসিয়া বলিতে শুনিয়াছি − হিশাম ইবনে মুগীরা আলী
ইবনে আবু তালেব (রাঃ)-এর নিকট তাঁহার মেয়ে বিবাহ দেওয়ার জন্য আমার
নিকট প্রস্তাব করিয়াছে। কিন্তু আমি অনুমতি দিই নাই এবং আলী (রাঃ)
আমার কন্যা ফাতেমা (রাঃ)- কে তালাক না দেওয়া পর্যন্ত আমি অনুমতি
দিব না। কেননা ফাতেমা হইতেছে আমার শরীরের অংশ। আমি ঐ জিনিস ঘৃণা
করি যাহা সে ঘৃণা করে এবং তাহাকে যাহা আঘাত করে তাহা আমাকেও আঘাত
করে।” হাদিসটা এখানেও পাবেন, মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ মহসিন খানের
অনুদিত সহি বুখারি, ৭ম খণ্ড, ১৫৭।
যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ রসুল বিশ্বনবী, দুনিয়ার প্রতিটি মুসলিম নারী
তাঁর কলিজার টুকরা। তিনি তাঁর অনাগত অগণিত সমস্ত কলিজার টুকরাকে
সতীনের সম্ভাবনায় ঠেলে দেবেন এবং নিজের মেয়েকে রক্ষা করবেন এমন
ব্যাখ্যা যাঁরা দেন তাঁরা নবীজীর মর্যাদার খেলাফ করেন। বিবি ফাতেমা
কোরাণের বিরুদ্ধে যাবেন এটাও অসম্ভব। এ-দু’টো মিলিয়ে আমরা কি পাচ্ছি
? মুগীরা নিজেই বিয়ের প্রস্তাব করেছিল কাজেই সে মেয়ে তখনো এতিম
হয়নি, মুগীরা তখনো বেঁচেই ছিল। হজরত আলী অতুলনীয় মর্যাদা ও শান-এর
অধিকারী বলেই বুঝি মুগীরা তাঁকে জামাই করতে চেয়েছিল। কিন্তু নবীজী
অনুমতি দেননি। এটা জানার পরেও টাকাকড়ি-জমিজমা বা বাহ্যিক শান-শওকতের
লোভে কোন লোভী পিতা তাঁদের আদরের কন্যাকে সতীনের ঘরে পাঠালে সেটা
সরাসরি ইসলাম-বিরোধী হতে বাধ্য। শুধু টাকার জোরে কেউ শখের বহুবিবাহ
করলে সেটাও ইসলাম-বিরোধী হতে বাধ্য। নীচে কয়েকটা উদ্ধৃতি দিচ্ছি
:
১ - এ.ভি.মীর আহমেদের কোরাণ-অনুবাদে ব্যাখ্যা
: “আয়াত ১২৭ সরাসরি আয়াত ৩- এর সহিত সম্পর্কিত। এইখানে নারীদের
যে অধিকারের কথা বলা হইয়াছে উহা আয়াত ৩-এ বলা আছে, … ইয়াতামান-নিসা
অর্থ হইল “পিতৃহীনা বালিকা।”
২ - “মওলানা ওমর আহমদ ওসমানীর মতে সুরা নিসার ৩ নম্বর আয়াতে বলা
হইয়াছে শুধু পিতৃহীনা বালিকা ও বিধবার কথাই, অন্যান্য নারীগণের
নহে। ‘আল্ নিসা’ শব্দের বিশেষ ‘আল্’ শব্দটি ‘শুধুমাত্র ইয়াতাম’
অর্থাৎ এতিমের নির্দেশ করে। নতুবা শুধু ‘নিসা’ শব্দটিই অন্যান্য
নারীগণকে বুঝানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। এই বিবাহ করিতে হইলে শুধুমাত্র
বিধবা বা এতিমের মধ্য হইতেই করিতে হইবে। একমাত্র এই পটভূমিতেই
বহুবিবাহের অনুমতি দেওয়া হইয়াছে।” (Women’s Rights in
Islam – Mohd. Sharif Chowdhury).
৩ - “বহুবিবাহের অনুমতির প্রকৃতি কিছুতেই অবাধ নহে” − জাস্টিস
আফতাব হোসেন। (“Status of Women in Islam”).
৪ - কোরাণের আয়াত ১২৯ − “তোমরা কখনও নারীদিগকে সমান রাখিতে পারিবে
না যদিও ইহা চাও।” অন্যান্য আয়াতের পরে এর ভিত্তিতে কোরাণ বহুবিবাহ
বাতিল করে এক স্ত্রী বহাল রেখেছে। কারণ “ন্যায়সঙ্গত” অর্থাৎ “আদ্ল্”এর
মধ্যে প্রেমভালবাসাও অন্তর্ভুক্ত যা সমান ভাগে ভাগ করা যায় না।”
আমীর আলী − স্পিরিট অব্ ইসলাম − ইউনিভার্সিটি প্রেস লণ্ডন, ১৯৬৪,
পৃঃ ২২৯-২৩২।
অষ্টম শতাব্দীর কট্টরপন্থী খলিফা মুতাওয়াক্কিল যুক্তিভিত্তিক
মু’তাজিলা মুসলিম সম্প্রদায়কে উচ্ছেদ করে সমাজকে যুক্তিহীন ভক্তিবাদের
আত্মঘাতী পথে চালিত করেন। সেই গোলকধাঁধায় আমরা আজও এমনভাবে অন্ধ
হয়ে ঘুরে মরছি যে আমাদেরই মা- বোনের অশ্রু চোখে পড়ছে না। অথচ শারিয়ার
হাজার বছর আগের মানুষ কি গভীর মমতায়, কি কঠোর হস্তে মাতৃজাতিকে
সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছিল তা দেখলে প্রশংসা না করে পারা যায় না।
নিয়ন্ত্রিত বহুবিবাহের উদ্ধৃতি দিচ্ছি আসিরিয়ান (প্রায় ২০০০ থেকে
২৫০০ বছর আগে) ও ব্যাবিলনিয়ান হাম্মুরাবী আইন (প্রায় চার হাজার
বছর আগে) থেকে − সূত্র : ড্রাইভার অ্যাণ্ড মাইল্স-এর “ল’জ ফ্রম
মেসোপটমিয়া অ্যাণ্ড এশিয়া মাইনর” এবং ওমস্টেড-এর “হিস্ট্রি অব্
আসিরিয়া”; উৎস আইনের অধ্যাপক ডঃ আনোয়ার হেকমত-এর “উইমেন অ্যাণ্ড
দ্য কোরাণ” পৃঃ ১৫৩ ও ২৪১-২৪৩।
সাধারণ আইন :
ক. যদি স্ত্রী সন্তানধারণ করিতে পারে তবে স্বামী
তাহাকে তালাক দিতে পারিবে না।
খ. যদি স্ত্রী সন্তানধারণ না করে তবে স্বামী
তাহার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারিবে কিন্তু স্বামী তাহাকে ঐ সকল
কিছুই ফিরাইয়া দিবে যাহা কিছু সেই স্ত্রী বিবাহকালে আনিয়াছিল,
এবং সারাজীবন স্ত্রীর খরচ বহন করিবে।
গ. যদি স্ত্রী সন্তানধারণ না করে তবে সে স্বামী
বিবাহ করিতে পারে কিন্তু দ্বিতীয় স্ত্রী কোন ব্যাপারেই মর্যাদায়
প্রথম স্ত্রীর সমান হইবে না।
ঘ. যদি স্ত্রী সন্তানধারণ না করে তবে সেই স্ত্রী
স্বামীকে মাত্র একবার একটি দাসী উপহার দিতে পারে। যদি সেই দাসী
সন্তানধারণ করে, তবে সেই ব্যক্তি দ্বিতীয় বিবাহ করিতে পারিবে না।
ঙ. যদি কেহ স্ত্রীকে ত্যাগ করিয়া উধাও হইয়া যায়
তবে সে স্ত্রী যখন ইচ্ছা দ্বিতীয় বিবাহ করিতে পারিবে এবং প্রথম
স্বামী ফিরিয়া আসিয়া স্ত্রীকে দাফব করিতে পারিবে না।
চ. স্ত্রী যদি বন্ধ্যা, পঙ্গু বা অনারোগ্য ব্যাধিতে
আক্রান্ত হয় তবে স্বামী অন্য নারীকে বিবাহ করিতে পারে কিন্তু প্রথম
স্ত্রীর মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত একই বাড়িতে থাকিবে এবং তাহার যত্ন
লইবে।
ছ. স্ত্রী যদি অনারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়
ও নিজের গোত্রে ফিরিয়া যাইতে চায় তবে স্বামী তাহাকে ঐ সকল কিছুই
ফিরাইয়া দিবে যাহা কিছু সেই স্ত্রী বিবাহকালে আনিয়াছিল।
এই হল মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার সত্যিকারের উদাহরণ, মুখে মিষ্টি উপদেশ
আর আইনে হিংস্রতার ঠকবাজি নয়। তাই বুঝি ওরা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল
তাদের সেই প্রাচীন সভ্যতাগুলোকে। ওরা জানত, মাতৃজাতিকে অপমান করে
পঙ্গু করে জাতির উন্নতি অসম্ভব। কারণবিহীন শখের বহুবিবাহ এক মারাত্মক
সামাজিক অভিশাপ। স্বামী বহুবিবাহ করুক বা না করুক, তার এই ফ্রী
লাইসেন্সটাই নারীর অপমান। তাই, একে নিয়ন্ত্রণ করে কোরাণে ফিরে
আসতে হবে। দেখুন একটা এলাকার চেহারা “বহুবিবাহ প্রথা আজও বিদ্যমান।
এলাকায় বেশির ভাগ লোকের একাধিক স্ত্রী। যে-বছর গোলায় বেশি ধান
মেলে নূতন বিয়ের আকাঙ্ক্ষাও বেড়ে যায়। বিয়ে করতে হবে এমন মানসিকতা
বিরাজ করে। (প্রথম) স্ত্রী বাধা দিলে উচ্চারিত হয় তালাক” − পৃঃ
৬৩, ফতোয়া ১৯৯১-১৯৯৫ − শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র, ঢাকা।
নারী-নিপীড়নের এই অভিশাপ ইন্দোনেশিয়াতে সম্প্রতি ফিরে এসেছে “পলিগ্যামী
রেস্টুরেণ্ট”-এর চার-তরকারির খাবারে আর চালু হয়েছে চার টপিং দিয়ে
‘পলিগ্যামী পিজা।’ ঠাট্টা আর বলে কাকে !
অথচ বহুবিবাহকে আমরা মুসলিম দেশ সেনেগাল, মরক্কো, তিউনিসিয়ার
মতো আইন দিয়ে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, ইজতহাদ করে আমরা বহুবিবাহের
মধ্যে এতিম ছাড়াও অনাথ দরিদ ্র নারী অন্তর্ভুক্ত করতে পারি। তাতে
ইসলামের নাম উজ্জ্বলই হবে। দুনিয়ার তাবৎ মুসলমান পুরুষ মহান হৃদয়
নয়, এ কলিকালে বহু কুলাঙ্গার সব সমাজেই আছে। পুরুষ যেখানে পুরুষ,
সেখানে নারীদেহে তার চূড়ান্ত স্বার্থ আছে।
কোরাণ সেটা জানে, রসুল সেটা বিলক্ষণ জানতেন। তাই তাঁরা নারী-
অত্যাচারের ফ্রী লাইসেন্স কাউকে দেননি। আজ ইসলামের নামে যত অনৈসলামিক
বিধান আমরা দেখি, সবগুলো নবীজীর অনেক পরে পুরুষতন্ত্রের বানানো
॥
১ ‘মু’তা’ বিয়ের নিয়মানুযায়ী - একজন পুরুষ কোনো মেয়ের
সাথে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে বিয়ের চুক্তি করে অনায়াসে তার সাথে
সহবাস করতে পারে। যদিও সুন্নী সমাজে এই ধরনের বিয়ে নিষিদ্ধ করা
হয়েছে, শিয়াদের মাঝে এখনও তা চালু আছে।
২ মুসলিম ধর্মগ্রন্থ আল-কুরআনের সূরাসমূহের পংক্তি বা বাক্যকে
বহুবচনে আয়াত বলা হয়।
৩ যাদের পিতা মারা গিয়েছে।
৪ উদয় বা প্রকাশিত
সূত্র - শারিয়া কি বলে, আর আমরা কি করি
লেখক পরিচিতি - গহন গহীন গ্রাম বাংলার জলে জঙ্গলে বেড়ে ওঠা বাংলার গর্বিত সন্তান।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।