প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

সমাজ ও সংস্কৃতি

এপ্রিল ১৫, ২০১৬

 

প্রসঙ্গ : বৈষ্ণব পদাবলীতে সমাজতত্ত্ব

আইভি চট্টোপাধ্যায়


 

‘সই কেবা শুনাইল শ্যাম-নাম ।
কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ ॥‘

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এ এক আশ্চর্য মধুর সাধনা। সিদ্ধি বললেও হয়। সাধারণ বাঙালি পাঠকের কাছে বৈষ্ণব পদাবলীর আবেদন যত না তত্ত্বকথা, রসময় গীতিকবিতা হিসেবে অনেক বেশি। যদিও বৈষ্ণব পদাবলীর পাঠক যাঁরা, তার সিংহভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার্থী। ক্লাসনোট এবং প্রশ্নপত্রের উত্তর লেখার জন্যে ব্যাখ্যা লেখার তাগিদে পড়ার আগ্রহ। আগ্রহ না বলে দায় বলাই ভালো।

অবশ্য পাঠ্যসূচির প্রশ্রয় না থাকলে মাইকেলই বা কতখানি পড়া হত ?  গান বাদ দিলে রবীন্দ্রনাথই বা কতটা ?  সমকালের পরে পাঠক তো ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়েই যায় – এমনকি যাদের ক্লাসিক বলি, তাদের ক্ষেত্রেও তা সত্যি।

এক দল সংখ্যালঘু পাঠক আছেন, যাঁরা বৈষ্ণব-ভক্ত কিংবা কীর্তন-গানের ভক্ত। তাঁরা সাহিত্য হিসেবে পদাবলী পড়েন না, সমগ্র পদাবলীর পাঠও তাঁদের ইচ্ছে নয়, নিজ নিজ গুরুর শিক্ষায় ও বহুল-প্রচারিত পদগুলোর কীর্তনগান হিসেবে পড়েন।

আর নিতান্ত হাতেগোনা গুটিকযেক পাঠক আছেন, যাঁরা বৈষ্ণব-সাহিত্য পড়ার জন্যেই পদাবলী পড়েন। আর মজার কথা হল, এই গুটিকযেক পাঠকের তাগিদেই আজও বৈষ্ণব-সাহিত্য সম্পর্কিত বেশ কিছু বই হচ্ছে। শুধু ভক্তিরস নয়, তত্ত্বকথা নয়, শুধুই একটি দর্শন নয়, এতগুলো শতাব্দী পেরিযেও বৈষ্ণব পদাবলীর যে আগ্রহ পাঠকের কাছে, তার মূল সুরটি মধুর। অক্ষুণ্ণ একটি সাহিত্যরস। কোনো একটি পদ বা গীতি-কবিতার খুচরো বিচারে নয়,  সামগ্রিকতাতেই জুটে যায় পদাবলীর স্থায়ী অনুপ্রাণিত পাঠক। মঙ্গলকাব্য-রূপকথা-লোককথার অনুষঙ্গে স্বদেশি কবিতার একটি মধুর আবেশ, যা চিরকালের বাংলাকে স্পর্শ করে আছে।

আছে নিরন্তর একটি আত্মজিজ্ঞাসা, কেন আজও পদাবলী এত জীবন্ত, কেন এত জরুরি, কেন মনে হয় সমকালীন?

‘পদাবলী’ শব্দটি সংস্কৃত ‘পদাবরিক’(অর্থাত্‍ পদাবরণ, পদাভরণ, নূপুর)শব্দের প্রাকৃত রূপান্তর ‘পআঅরিঅ’ শব্দের পরিবর্তিত রূপ। শব্দটির প্রথম প্রয়োগ হয় জয়দেবের গীতগোবিন্দে।
‘পদাবলী’ বলতে যদিও সম্যক বৈষ্ণব-কবিতা বোঝায়, ‘পদ’ বলতে কিন্তু একটি বৈষ্ণব-কবিতাকেই বোঝায় না। সংস্কৃত সাহিত্যে ‘পদ’ শব্দের অর্থ পদ্যের ছত্র। সেসময় পদ্য ছিল দু’ছত্রের শ্লোক। ‘পদ’ শব্দের অন্য অর্থটি সবার জানা, দুই পা। সেই প্রেক্ষিতে সংস্কৃতে দুই ছত্রের শ্লোক বা পদ্যের নাম হয়েছিল ‘পদ’, গবেষকরা এমনটি মনে করেন। পুরোনো বৈষ্ণব-সাহিত্যেও তাই ‘পদ’ অর্থে দু’ছত্রের গান, কিংবা গানের দুটি ছত্র বোঝানো হয়।

যে ভাষায় আমরা কথা বলি, যে ভাষার মাধ্যমে যোগাযোগ করি এবং তাতেই ভাষিক সম্ভাবনা সম্পূর্ণ বলে মান্য করি, আমরা প্রায়শ: অনুধাবনই করি না, ভাষার অন্তরালে হয়ত অনাবিস্কৃত পড়ে আছে আদি ভাষার অবয়ব। পদাবলী সম্পর্কে আলোচনা করতে বসে এই কথাটি বারবার মনে হয়েছে।

বৈষ্ণব একটি ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে আবির্ভূত হয় একটি বিশেষ সামাজিক বাস্তবতায়, শাস্ত্রীয় ধর্মের সীমাবদ্ধতা ও ক্ষেত্রবিশেষে বাড়াবাড়ির প্রতিক্রিয়ায়। সংস্কারমুক্ত মানুষের এক হবার বাসনা থেকেই প্রতিবাদী ধর্ম-আন্দোলন হিসেবে বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তনা। পৌরাণিক বা শাস্ত্রীয় বৈষ্ণব-আন্দোলন থেকে ক্রমে চৈতন্য প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব এবং আরো পরে সহজিয়া বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের উদ্ভব। 

বৈষ্ণব পদাবলী এই বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্বের রসভাষ্য। ‘কৃষ্ণভজনে নাই জাতিকুলাদি বিচার’..  জাতিভেদে বিভক্ত মানুষকে মনুষ্যত্বের উদারলোকে আহ্বান করেছিল এই নতুন ধর্ম। মানবকেন্দ্রিকতা এই ধর্মের অনন্য গুণ। তাই পদাবলীতে বৈষ্ণবীয়তার আড়ালে মানুষ এবং মানুষের প্রতি মানুষের প্রেমের ছবি বারবার। মধ্যযুগের ধর্মসম্পৃক্ত মানস কাঠামোর মধ্যে এমন মানব-মাহাত্ম্যের প্রকাশ সত্যিই বিস্ময়কর।

যদিও ধর্মীয় তত্ত্বকথা হিসেবে বৈষ্ণব পদাবলীর যত না আবেদন, মধুর এক সাহিত্যরস বহনকারী গীতিকবিতা হিসেবে পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। গান হলেও সাধারণ গানের মতো আকারে ছোট ও নির্দিষ্ট বাঁধনে নয়, পদাবলীর গানগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ সুষম ছন্দের ভাবময় কবিতা। সংস্কৃত প্রকীর্ণ কবিতার সঙ্গে পদাবলীর বেশ মিল। পদের প্রথম ছত্রে অল্প কিছু অক্ষর, দ্বিতীয় পদ হল ধুয়া, এবং কবির স্বাক্ষর থাকবে শেষ পদে। নিজের নাম-স্বাক্ষর, যেমন ‘ভণই বিদ্যাপতি শুন বরনারী’। এমনটি না করে অনেকে গুরুর নামও স্বাক্ষর করতেন। যেমন রূপগোস্বামী তাঁর পদাবলীতে গুরু সনাতন গোস্বামীর নাম রাখতেন। স্বাক্ষরহীন বহু পদাবলীও আছে, যেগুলোকে ‘ধুয়া পদ’ বলা হয়ে থাকে।

বাংলায় বৈষ্ণব পদাবলীর জন্ম জয়দেবের গীতগোবিন্দ থেকে। এমনও বলা হয় যে, গীতগোবিন্দ লক্ষণসেনের রাজসভায় অভিনীত হয়েছিল। গীতগোবিন্দের অনুসরণে চোদ্দ-পনেরো শতকে মিথিলা ও বাংলায় যে পদাবলী রচনা হয়, তা রাজ-আনুকূল্যে। মিথিলায় উমাপতি ও বিদ্যাপতি রাজসভার কবি ছিলেন। ত্রিপুরায় ‘রাজপণ্ডিত’ যশোরাজ খান, ‘বিদ্যাপতি’ কবিশেখর দুজনেই রাজসভার কবি। গীতগোবিন্দের গান শুধু মিথিলা বা বাংলায় নয়, আসাম, গুজরাট, পাঞ্জাব, রাজস্থানেও প্রচলিত হয়েছিল। রাজসভায় শ্রীকৃষ্ণের নামগান বহু পুরোনো রীতি।

বৈষ্ণব পদাবলীর বিষয় তিনটি : কৃষ্ণলীলা, প্রার্থনা, চৈতন্যলীলা। চৈতন্যের আবির্ভাবের আগে পর্যন্ত কৃষ্ণ-উপাসনা ছিল প্রধানত বালগোপালের উপাসনা। শ্রীচৈতন্যের গুরু মাধবেন্দ্র-পুরী বালগোপালের উপাসক ছিলেন। মাধবেন্দ্র-পুরীর প্রধান শিষ্য ঈশ্বর-পুরী চৈতন্যদেবকে দশাক্ষর গোপাল-মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন। চৈতন্যের আধ্যাত্মিক জীবনের শুরু এখান থেকেই।

বালগোপালের আরাধনা হলেও বৈষ্ণব-পদাবলীতে বাত্‍সল্য রস তেমন পাওয়া যায় নি তখন। ভক্তিরসই ছিল প্রধান। বাত্‍সল্য রস এল ষোড়শ’ শতকে, যখন চৈতন্যের সাধনসঙ্গীরা মহাপ্রভুর শিশুজীবনের ছবি বৈষ্ণব-পদাবলীতে নিয়ে এলেন।

এইখান থেকেই আমার ভাবনার শুরু। সমকালীন সমাজ ও তার প্রভাবে বৈষ্ণব-পদাবলী কিভাবে গড়ে উঠেছে বারবার। সাহিত্যে দেশের অবস্থা এবং জাতীয় চরিত্রের প্রতিফলন থাকেই। সাহিত্যের সঙ্গে সমাজের আভ্যন্তরিক সম্বন্ধ গভীর। সাহিত্যের আরশিতে বিম্বিত হয় গোটা জাতি এবং জাতির জীবন প্রণালী। প্রতিফলিত হয় সেই দেশের সামাজিক,  রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমি। ভারতবর্ষীয় সাহিত্যের প্রকৃত গতি ঠিক কেমন, সে নিয়ে বিস্তর লেখালেখি, গবেষণা। বৈষ্ণব সাহিত্যে সমাজতত্ত্বের আলোচনায় তার সামান্য উল্লেখ করা যেতেই পারে।

রামায়ণ রচনার সময়কাল নিয়ে যতই মতভেদ থাক, একটি যুক্তি সর্বজনগ্রাহ্য যে রামায়ণ এক যুগসন্ধিক্ষণের কাব্য। যে যুগসন্ধিতে বৈদিক আচার ও অনাচারের গভীর প্রভাব, আর্য অভ্যুত্থান ও ভারত-মননের উপলব্ধি। ভারতীয় আর্যরা যখন অনার্য আদিবাসীদের সঙ্গে লড়াইয়ে রাজ্যবিস্তারে ব্যস্ত, ভীতিশূন্য, দিগন্তবিচারী, বিজয়ী বীর জাতি। সেই জাতীয় চরিত্রের ফল রামায়ণ। কাব্য, নাটক, গদ্য, পদ্য ইত্যাদি কাব্যরচনার যে ক’টি ধারা প্রাচীন ভারতে প্রচলিত ছিল, তার প্রত্যেকটির মধ্যেই রামায়ণ নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েছে।

তারপর ভারতবর্ষের অনার্য শত্রু ক্রমে বিজিত। ভারতবর্ষ আর্যদের আয়ত্ত, ভোগ্য এবং মহা সমৃদ্ধিশালী। তখন আর্য বাহ্য শত্রুর ভয় থেকে নিশ্চিন্ত  ।  আর্য্কুল আভ্যন্তরিক সমৃদ্ধি সম্পাদনে সচেষ্ট। দেশের ধনবৃদ্ধি শ্রীবৃদ্ধি ও সভ্যতাবৃদ্ধি। রোমক থেকে যবদ্বীপ ও চৈনিক পর্য্যন্ত ভারতবর্ষের বাণিজ্য বিস্তার লাভ করেছে। প্রতি নদীকূলে এক একটি অপরূপ মহানগরী। তখন আর্য পৌরুষ চরমে, অন্য শত্রুর অভাবে সেই পৌরুষ নতুন প্রশ্নের মুখে, হস্তগত ঐশ্বর্যশালী এই সুন্দর দেশটি কার ভোগ্য হয়ে থাকবে ? শুরু হল আভ্যন্তরিক বিবাদ। আর্য রাজাদের নিজেদের মধ্যে একের পর এক যুদ্ধ, রক্তক্ষয়। এই সময়ের সাহিত্য মহাভারত।

অবশেষে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ধর্মের জয়। কুরুক্ষেত্র একটি রূপক। ধর্ম নামের এক শৃঙ্খল প্রযোজন হয়েছিল দুর্দম রক্তস্পৃহা থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করার জন্য। সুখ শান্তি এসেছিল বৈকি। এই সুখ ও তৃপ্তির ফসল ভক্তিশাস্ত্র ও দর্শনশাস্ত্র। যদিও কাব্য বা গীতিকাব্যে এই দুই শাস্ত্রের তেমন প্রকাশ হয় নি। কিন্তু ধর্মচেতনায় আচ্ছন্ন হতে বেশি সময় লাগে নি সমাজের। এমনকি মানুষের স্বাভাবিক বোধ ও বিচারশক্তি ধর্ম নামক মোহে লুপ্তপ্রায়। সাহিত্যও ধর্ম-রজ্জুতে বদ্ধ। ধর্মানুসারী সাহিত্য। এই প্রবল ধর্ম-স্রোতের ফল বিভিন্ন পুরাণ।
আর একই সঙ্গে বিলাসিতা ও ভোগের যে বিপুল অসংযম, তার ফসল কাব্য, নাটক, নাটিকা।

বাংলার সামাজিক ইতিহাসের সঠিক সংবাদ, সেন রাজবংশের পতনের পর চৈতন্যযুগের সময় পর্যন্ত ঠিক কিভাবে বাংলাদেশে হিন্দুধর্ম বিবর্তিত, সে সম্পর্কে ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিক তথ্য অনেক ক্ষেত্রেই পরস্পরবিরোধী। তুর্কি-মুসলমান আক্রমণের পর চতুর্দশ শতাব্দী থেকে ষোড়শ’ শতাব্দী পর্যন্ত ধর্ম-আন্দোলন সারা ভারতেই। ‘শ্রী’ সম্প্রদায়ের রামানন্দ উত্তর-ভারতে নিয়ে এলেন। এই ধর্ম-আন্দোলন উত্তর-ভারতে ‘সন্ত-আন্দোলন’ নামে খ্যাত। এই বিপুল ধর্ম-আন্দোলনের ফল হয়েছিল অভূতপূর্ব এক সমাজ-সংস্কার। বাংলায় চৈতন্যদেবের নব্য-আন্দোলন এই ভারতব্যাপী স্পন্দনের প্রকাশ। চৈতন্যদেব একজন যুগ-প্রবর্তক সমাজ-সংস্কারক।

প্রাচীন কৌমগত ধর্ম, আদিবাসীদের সর্বপ্রাণবাদ বা ‘animism’ বা বাংলার নানা জায়গায় নানা লৌকিক ধর্ম এবং পরবর্তী জৈনধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, বেদপ্রসূত ব্রাহ্মণ্যধর্ম,  পূজা এবং লোকাচার সেন রাজবংশের আগে থেকেই বাংলায় ছিল। গুপ্তযুগের ব্রাহ্মণ নাথস্বামী ও তাঁর স্ত্রী রামী, শ্বেতবরাহস্বামী, কোকামুখ স্বামী, নানা বিগ্রহ ও প্রতিমার বিবরণ তাম্রলিপিতে আছে। সপ্তম শতাব্দীতে চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন-সাঙ বাংলার ধর্মবিষয়ে নির্গ্রন্থ জৈন মঠ ও বৌদ্ধমঠের উল্লেখ করেছিলেন। বৌদ্ধ ইতিহাস আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প অনুসারে, ব্রাহ্মণ্যধর্ম-অনুসারী রাজা গোপালদবের পুত্র সম্রাট ধর্মপালদেব বৌদ্ধ ছিলেন।

এর পর পালবংশের শেষপর্যন্ত বৌদ্ধধর্ম বাংলার প্রধান ধর্ম ছিল। কিন্তু পরে এই মহাযান বৌদ্ধধর্ম মূলত তন্ত্র-ধর্ম হয়ে ওঠে। তাই সেনবংশের রাজত্বকালে বাংলায় তান্ত্রিক প্রাধান্য ছিল। লক্ষ্মণসেনদেবের প্রধান ধর্মাচার্য হলায়ুধ ‘ব্রাহ্মণ সর্বস্ব’ গ্রন্থে লিখেছেন, বৈদিক ব্রাহ্মণ ছাড়া সবাই, এমনকি রাঢ়ী ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণরাও তান্ত্রিক ছিলেন। বৌদ্ধরা তান্ত্রিকধর্ম নিয়ে এলেন, ব্রাহ্মণ সে ধর্ম গ্রহণ করলেন। লক্ষ্মণসেনদেব তাঁর রাজত্বকালে পণ্ডিত পশুপতির সাহায্যে ‘মত্স্য সূক্ত তন্ত্র’ প্রচলন করেছিলেন, তান্ত্রিকধর্মের নানা কদাচার থেকে মানুষকে নিবৃত্ত করার উদ্দেশ্যে।

এইভাবে তুর্কি-আক্রমণের সময় বাংলায় ‘animism’ বা বৃক্ষ-পর্বত-সর্প-বাসুলি-মনসা ইত্যাদির পুজো, লৌকিক ধর্ম, তান্ত্রিকধর্ম, মহাযানের একটি শাখা নাথধর্ম, নিরাকারবাদী নিরঞ্জন-পূজা বা ‘ধর্ম ঠাকুরের পূজা’ এমন নানা ধর্মকান্ড। এইসঙ্গে যোগ হল ইসলাম।

অনতি ভবিষ্যতে বৌদ্ধধর্মের এই বিশাল কর্মকাণ্ড লোপ পাবে বাংলায়। ড: মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছেন,

‘যে দেশে বৌদ্ধধর্মের এত নিবিড় প্রভাব ছিল, সে দেশ হইতে বৌদ্ধধর্ম লুপ্ত হইল কিভাবে?.. মোটের ওপর বাংলার বিশাল হিন্দু ও মুসলমান মণ্ডলী এই বৌদ্ধগণকে গ্রাস করিয়া লইয়াছে।.. মুসলমানগণের মধ্যে যাহাদিগকে বেদাতী ফকির বা নেড়া ফকির বলা হয়, তাহাদের মধ্যে অনেকটা সহজসিদ্ধির ভাব দেখা যায়। আমার মনে হয়, সত্যপীর নিরঞ্জনের এবং মানিকপীর গোরক্ষনাথেরই প্রকারভেদ।‘

প্রসঙ্গত উল্লেখ করি, নাথপন্থীরা উত্তরভারতে এইভাবেই মুসলমান সমাজে প্রবেশ করেছে। এরা নিজেদের ‘জুগী’ বা যোগী বলে পরিচয় দেয়, পেশা বস্ত্র-বয়ন। এরাই মুসলমান হয়ে ‘জোলাহা’। জুগী জোলা। একইভাবে ‘কাণ-ফট্টা যোগী’ সমাজে শিশু জন্ম নিলে গোরক্ষপুরে গোরক্ষনাথের মন্দিরে নিয়ে মন্ত্র দেওয়া হয়। উত্তরভারতে হিন্দু রাজাদের রাজত্ব তখন শেষ, রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এই ধর্ম-বদলের কারণ। বাংলায় চৈতন্যদেবের সময় এইভাবেই বৌদ্ধধর্ম লুপ্ত। প্রাচীন নাথ-সম্প্রদায় এবং বর্তমান যোগী-সম্প্রদায় এখন গৌড়ীয় বৈষ্ণব। মুষ্টিমেয় কিছু শাক্ত হিন্দু, বাকিরা সবাই বৈষ্ণব। হিন্দু সমাজের ধর্মে এই বিশাল পরিবর্তন এইভাবেই অন্য ধর্মমত গুলোকে নির্জীব করেছে, বৈষ্ণব অন্য ধর্মকে গ্রাস করেছে যে কোনো  ধর্ম-আন্দোলনের মতই। পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হিসেবে বৈষ্ণব ধর্মেও বেশ কিছু কদাচার ঢুকছে।

গবেষকদের মতে, বৈষ্ণব ধর্মমত আরো প্রাচীন। বৈদিক কর্মকাণ্ডের বিপরীতে যেসব অহিংস মত ছিল, বৈষ্ণবমত তাদের মধ্যে প্রধান। ‘History of Sanskrit literature’ বইয়ে Weber লিখছেন যে এই অহিংসমতের দলকে তখন ‘ভাগবতের দল’ বলা হত। চতুর্থ শতাব্দীর গুপ্তরাজারা বৈষ্ণব ছিলেন। শ্রীমদ্ভাগবত, হরিবংশ এমন অনেক কৃষ্ণ-বিষয়ক বই সংস্কৃত ভাষায় অনেক আগে থেকেই পাওয়া যায়। শ্রীমদ্ভাগবতে রাধা নেই, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে রাধা ‘হ্লাদিনী শক্তি’।
বাংলায় রাধা-কৃষ্ণ প্রণয় বিষয়ে প্রথম লেখা জয়দেবের। এই জয়দেবই সংস্কৃত ভাষায় দশ অবতার স্তোত্র লেখেন। জয়দেবের কৃষ্ণ গুপ্তযুগের কৃষ্ণের চেয়ে আলাদা নন। তিনি কেশী মুর ইত্যাদি দৈত্য-নাশক, একজন যোদ্ধা। জয়দেবের কাব্যে নিবৃত্তির কথা নেই, ভোগই আসল। তাঁর কৃষ্ণ যোদ্ধা, ধনুর্ধর, এবং প্রেমিক। আর জয়দেবের রাধা শ্রীকৃষ্ণের প্রণয়িণী, তিনি সাধিকা সন্ন্যাসিনী নন।

জয়দেব, রাজা লক্ষণসেনের সভাকবি। সেই লক্ষণসেন, যিনি গৌড় জয় করেছেন, কাশীর রাজাকে যুদ্ধে পরাজিত করেছেন, প্রয়াগে জয়স্তম্ভ স্থাপন করেছেন। সেই সময়ের বাংলার অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার ছবি জয়দেবের এই গীতিকাব্যে। জয়দেব ছাড়াও অনেক গীতিকারের lyric-কাব্য সেইসময় পাওয়া যায়। বেশ বোঝা যায়, এইসময় সমাজে একটা অলস পরিতৃপ্তি ছিল।

যে কোনো কবিতার একটা মূল ব্যাপার হল,  সমকালীন জীবনের, দেশ ও কালের, রাজনীতি ও সমাজের প্রতিধ্বনি। গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর ভাবতরঙ্গ বলি কিংবা চৈতন্যদেবের ভক্তি-আন্দোলন, আজকের পাঠক সেসব ঘটনা থেকে দূরবর্তী। তাঁদের কাছে সেসব কানে শোনা বা বইয়ে পড়া। তাঁদের কাছেও কি সে-সময়ের ঘটনার প্রত্যক্ষ চাপে বা প্রেরণায় লেখা কবিতাগুলি সমান সাড়া জাগাবে আজও ?  তা ছাড়া ওইসব ঘটনা বা আন্দোলনের ব্যাপারে যে ব্যাপক সম্মতি ছিল,  আজ অনেকক্ষেত্রেই তো তা আর নেই। মূল্যায়ন বদলেছে। যে-মতবাদের প্রেরণায় সমকালীন কবিরা দেখছেন,  তার অর্থান্তর ঘটেছে। যে ঘটনা বা মতবাদের বাতাবরণে পদাবলী লেখা হয়েছে,  সেই কবিতাগুলো আজ নতুন পরিস্থিতিতে আজকের পাঠককে কীভাবে নাড়া দেবে ?

চৈতন্যের জন্মসময়ের পারিপার্শ্বিক অবস্থা একটু আলোচনা করি। বাংলায় তখন মুসলমান শাসন। চৈতন্যের জন্মের আগেই রাজা গণেশ ও তারপর তাঁর পুত্র যদু গৌড়ের সিংহাসনে আসীন হয়েছেন। ঐতিহাসিকদের মতে, যদু মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার শুরু করেন। দলে দলে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা গৌড় ছেড়ে চলে যেতে থাকেন।

‘আচম্বিতে নবদ্বীপ হইল রাজভয়
ব্রাহ্মণ ধরিঞা রাজা জাতিপ্রাণ লয় ॥‘ (চৈতন্যমঙ্গল : জয়ানন্দ)

অন্তত দু’টি বৈষ্ণবগ্রন্থে এই ঘটনার উল্লেখ আছে। সম্ভবত হোসেন শাহ-র আগে হাবশী বাদশাহদের সময়কার কথা।

এই রাজনীতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে নবদ্বীপে বৈদিক-ব্রাহ্মণ বংশে চৈতন্যের জন্ম। তাঁর জন্মের ঠিক আগেই নবদ্বীপের হিন্দু মনীষীরা বাঙলাকে তুর্কি-মুসলমানের হাত থেকে পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনাও করেছিলেন। এইসময়ের একজন খ্যাতনামা মানুষ অদ্বৈতাচার্যের উল্লেখ ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’ ও ‘গৌড়ের ইতিহাস’ বইতে পাওয়া যায়।

শ্রীচৈতন্যের জীবনীতে বেশ কিছু সমাজতাত্ত্বিক সংবাদ পাওয়া যায়। যেমন, অল্প বয়সেই চৈতন্য টোল খুলে অধ্যাপনা শুরু করেন। সেসময় টোলে কায়স্থ বা অন্যজাতির ছাত্র পড়ত না। তবে বৈদ্য ছাত্র ছিল। ব্রাহ্মণ-শিশু জন্ম গ্রহণ করার এক মাস পর তার নিষ্ক্রমণ-সংস্কার পালন হত। শিশু বা বালকের অসুস্থতার সময় ‘ষষ্ঠীর খেলা’ বলে তাকে নিমগাছের ওপর রেখে দেওয়া হত। এইসব কুসংস্কার এখন আর নেই।

দিগ্বিজয়ী কেশব কাশ্মীরীর নবদ্বীপে পরাজয় বা মাধবপুরীর শিষ্য শ্রীরঙ্গপুরীর নবদ্বীপে জগন্নাথ মিশরের বাড়িতে নিমন্ত্রণ ইত্যাদি থেকে বোঝা যায় ভারতে পণ্ডিতদের মধ্যে যোগাযোগ ও ভাব-বিনিময় ছিল। সেসময় ছেলেরাও মাথায় লম্বা চুল রাখত। চৈতন্যের সন্ন্যাস-গ্রহণের সময় কাটোয়ায় লম্বা চুল কাটা হয়েছিল। মেগাস্থিনিসের ভারত-ভ্রমণেও এ তথ্য পাওয়া যায়। এইসময় বাঙ্গালীদের ‘গৌড়ীয়া’ বলা হত। চৈতন্যদেবের শিষ্যদের মধ্যে মুসলমান শিষ্যও ছিল। বৈষ্ণব সাহিত্য থেকে মনে হয়, তখন ব্রাহ্মণ্যবাদীদের সঙ্গে বৌদ্ধদের বার্তালাপ বা সম্পর্ক ছিল না। ‘যদ্যপি অসম্ভাস্য বৌদ্ধ অযুক্ত দেখিতে, তথাপি মিলিল প্রভু তাদের উদ্ধারিতে ..’
ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্ম থেকে যে এক পৃথক সম্প্রদায় গঠন করেছিলেন, তার প্রমাণ হল ‘হরিভক্তিবিলাস’ নামের একটি বিধি-পুস্তক। চৈতন্যের প্রধান দুই অনুচর গোপাল ভট্ট ও সনাতন গোস্বামী বৈষ্ণব-সমাজ পরিচালনের এই বই রচনা করেছিলেন।

এমন বহু সমাজতাত্ত্বিক খবর বৈষ্ণব-সাহিত্যে। আমাদের আলোচনা যেহেতু পদাবলী-ভিত্তিক, তাই বিশদ বিবরণ থাক। পদাবলী নিয়েই আরো দু’চারটি কথা। সখ্য-রস, রাধা-কৃষ্ণের অনুরাগ, অভিসার, মিলন, বিরহ চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দীর অবহটঠ ভাষায় লেখা প্রাচীন পদাবলীর সময় থেকেই আছে। বাংলায় বৈষ্ণব-পদাবলীর দুই ভাষা। একটি বাংলা, অন্যটি ব্রজবুলি। একটি মিশ্র ভাষা, মিথিলার প্রাচীন কবিদের ভাষা।

আরো আগে চর্যাপদের সময় থেকেই প্রাচীন বঙ্গভূমির যে সমাজচিত্র পাওয়া যায়, আদিবাসী ও বাঙালি সমাজের অসাধারণ সম্পর্ক, তাতেও এই বাংলা পদাবলীর ছন্দের চরিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। গবেষকদের মতে, বাংলা ছন্দের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠেছে সাঁওতাল মুণ্ডাদের syllabic metre বা দলবৃত্তরীতির উপর, যা হল কিনা বাংলার মাটির ছন্দ বা ছড়ার ছন্দ। এই ছড়ার ছন্দের অন্য নাম হল ‘ধামালী’। চণ্ডীদাসের পদাবলী এই ধামালী ছন্দে রচিত। বাংলা সাহিত্যের এক আদিকবি বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা-কৃষ্ণ আদিবাসী সমাজের চরিত্র থেকেই আঁকা। যদিও কৃষ্ণলীলার সুর চর্যাপদের পদাবলীতে পাওয়া যায় না।

আশ্চর্য হবার কারণ এই যে, কৃষ্ণের কংস-বধ, বিষ্ণুর বীরলীলা, কৃষ্ণের গোবর্ধন পাহাড় উত্তোলন, পুতনা-বধ ইত্যাদি বিষ্ণুপুরাণ ও হরিবংশে আগে থেকেই ছিল। ঋগ্বেদে বিষ্ণুর রাখালগিরির উল্লেখ আছে। নারদের সহযোগিতায় মহাদেব রাধা-বিরহ গাইছেন, আর বিষ্ণু এবং সমস্ত দেবতাকুল তার শ্রোতা, পুরাণে এমন ইঙ্গিত আছে। কিন্তু রাধা-কৃষ্ণ প্রণয়ের স্বীকৃতি গুপ্তযুগের আগেকার সাহিত্যে পাওয়া যায় না। কালিদাসের রঘুবংশের ষষ্ঠ সর্গে বৃন্দাবন ও গোবর্ধনের যে উল্লেখ, তা থেকেই ব্রজধাম-লীলার লৌকিক ঐতিহ্য প্রমাণ হয়। কালিদাসের মেঘদূতেও কিশোর বিষ্ণুর নাম আছে। কিন্তু বৈষ্ণব-পদাবলীর প্রধান বিষয়, রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা, তার প্রকাশ ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দীতে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অনেক গবেষকই মনে করেন, কৃত্তিবাস রচিত রামায়ণে দস্যু রত্নাকরের যে মানসজগতে বিপ্লব তার সঙ্গে চৈতন্যদেবের ভক্তি-আন্দোলনের যোগ রয়েছে। সে যা-ই হোক, রতিবিলাস থেকে উচ্চ একটি আধ্যাত্মিক স্তরে রাধা-কৃষ্ণ লীলার যে উত্তরণ প্রক্রিয়া, সেটি সম্পূর্ণ হয়েছিল চৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাবের পরে। জয়দেব বিদ্যাপতি চণ্ডীদাসের পদাবলী-গান শুনতে ভালবাসতেন চৈতন্যদেব। তাঁর ঈশ্বর-প্রিয় মন স্বভাবতই বিরহ-ব্যাকুলতায় রাধা-বিরহকে নতুন প্রাণ দিয়েছিল। চৈতন্যের সহচর অনুচর অনেকেই নতুন করে পদাবলী রচনা শুরু করেছিলেন। এ পদাবলীর ভাষা আরো জীবন্ত, প্রাণের পরশে উষ্ণ, বিশ্বাসের অনুভূতিতে মরমীয়া।

রূপগোস্বামী, প্রথম জীবনে সুলতান হোসেন শাহ’র দবীর-খাশ ছিলেন এবং চৈতন্যের নির্দেশে সংসার ত্যাগ করে ব্রজবাসী, সংস্কৃত সাহিত্যের কাব্যের আধারে পদাবলী রচনা করলেন, রাধাকৃষ্ণের লীলার তত্ত্ব সহযোগে। এই থেকেই ভারতে গৌড়ীয় ধর্মের এক সর্বজনগ্রাহ্য রূপ। এইসময় থেকে বৈষ্ণব কবিরা রূপগোস্বামীর মত করেই ভক্তিরস-আশ্রিত পদাবলী রচনা করতে শুরু করেন। এর ফল হল দু’রকম।
এক, যাঁরা এই রীতি মেনে পদাবলী রচনা করতে চাইলেন না, তাঁদের রচনা তেমন প্রচার পেল না। ছোট ছোট গ্রামীণ গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেল।
দুই, পদাবলীতে যে স্বাধীন স্বত:স্ফুর্ত একটি আনন্দের ভাব ছিল, সে অবকাশ রইল না।

পদাবলী-কীর্তন বরং বহুল জনপ্রিয়তা পেতে লাগল। প্রার্থনা-পদাবলী। মৃদঙ্গ, তাল, বোল, সুর, আর ছন্দ।
ষোড়শ’ শতাব্দীর শেষদিকে নরোত্তম দাসের হাত ধরে পদাবলী-কীর্তনের বৈঠকী রূপটি শুরু। কৃষ্ণলীলা-কাহিনীতে বালগোপাল-লীলা, গোচারন, অনুরাগ, অভিসার, জলকেলি, রাস, মিলন, বিরহ, মানভঞ্জন এমন নানা ঘটনার গীতবদ্ধ পালাগান রীতি শুরু হল। প্রতি পালার গান শুরুর আগে বিষয় অনুসারে চৈতন্য-বন্দনা আর নিত্যানন্দ-বন্দনা রীতিও এইসময় শুরু। এই আবাহন গানটির নামই গৌরচন্দ্রিকা; চৈতন্যের গার্হস্থ্য-নাম গৌর বা গৌরাঙ্গ থেকে এই নামকরণ। বাঙালির বৈষ্ণবভাব-আশ্রয় ছাড়াও কীর্তনগান তার নিজের রস-মাধুর্যেই একটা স্থায়ী জায়গা করে নিল। বৈষ্ণব ধর্মের উত্‍সবে ও শ্রাদ্ধ ইত্যাদি অনুষ্ঠানে পদাবলী কীর্তনের রীতি একটা সামাজিক ব্যবস্থা।

এবার জয়দেব পরবর্তী সময়ের কথায় আসা যাক।

চণ্ডীদাস। সম্ভবত চতুর্দশ শতাব্দীর শেষের দিকে জন্ম। এইসময় বাংলায় হিন্দুরা বিজিত জাতি, সামান্য প্রলোভনে স্বধর্ম ত্যাগ করে মুসলমানের ধর্ম গ্রহণ করছে। অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদ সমাজের মূল বিষয়। চণ্ডীদাস ও রজকিনী রামীর প্রেমকথা অমর হয়ে আছে এই কারণেই। চণ্ডীদাসের বিখ্যাত পদাবলী, ‘সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেল...’

কোনো কোনো গবেষক মনে করেন, এ যেমন একদিকে বিরহের গাথা তেমনই এক ভগ্নহৃদয় সামাজিক মানুষের আক্ষেপ। রাধাকে রাঙা-বসন যোগিনী সাজিয়েছেন চণ্ডীদাস।

‘বিরতি আহারে, রাঙা বাস পরে
যেমন যোগিনী পারা..’

‘দশাবতার’ কাব্যে চণ্ডীদাসের সুর জয়দেবের তুলনায় অনেক নরম। বিজিত বাঙালি যে শাসকের অধীনে, শাসকের মনোমত কাব্য রচনা করতেই হবে। চণ্ডীদাসের ‘কৃষ্ণকীর্তন’ কবিতা সুরুচির পরিচয়ও দেয় না। ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্থে শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন বলছেন, ‘রাজসভায় যে ভাববিকার আরম্ভ হয়, সমাজের নিচের স্তরে তাহা যখন আসিয়া পৌঁছয়, তাহা অতি বিকট হয়।‘ এইসময়ের গীতিকাব্যগুলো তার প্রমাণ।
গৌড়ের বাদশাহের আদেশে হাতীর পিঠে বেঁধে জর্জর প্রহরে চণ্ডীদাসের মৃত্যু। বড় নিষ্ঠুর হত্যা। একজন কবির এই করুণ পরিণতি একটি সমাজ-ব্যবস্থাকেই প্রকট করে।

এইসময়েরই মিথিলাবাসী কবি বিদ্যাপতি। বিদ্যাপতির কবিতায় কিন্তু হাহাকার বা কান্নার ভাব নেই।

‘হরি কি মথুরাপুর গেল.. কৈন ধাবই মাথুর মুখে..
বিদ্যাপতি কহ নীত, অব রোদন নহে সমুচিত ॥‘

তাঁর রাধা বরং বেশ আগ্রাসী নায়িকা। বিদ্যাপতির রাধা

‘গেলি কামিনী গজহুগামিনী বিহসি পালটি চায়’..

কিংবা রাধার রূপবর্ণনা প্রসঙ্গে

‘তুহারী ভয়ে সব দূরে পলায়ল..’

কিন্তু এই বিদ্যাপতিরই একটি পদ এইরকম –

‘এখন তখন করি দিবস গোঞাইনু
দিবস দিবস করি মাসা..’

একজন হতাশ প্রেমিকের মর্মবেদনা, নাকি পরাধীন মানসিকতার চাপ ? বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কমলকান্তের দপ্তর’ মনে করি, ‘দিন গুনিতে গুনিতে মাস.. কিন্তু আমার মা কই?

এই পদাবলিতে যেমন হতাশ-প্রেমিকের আক্ষেপ পাওয়া যায়, তেমনি দেশপ্রেমিকেরও আক্ষেপ.. বিদ্যাপতি পঞ্চগৌড়াধিপ শিবসিংহ ভূপের পারিষদ ছিলেন এবং এই রাজাকে তিনি ‘দিগ্বিজয়ী মহারাজাধিরাজ’ বলিয়া অভিহিত করিয়েছেন। কিন্তু এই রাজা শেষে দিল্লির বাদশাহের নিকট পরাজিত হইয়া বন্দী অবস্থায় তথায় নীত হন। এইসমায় হইতে তাঁহার গীত বন্ধ হইয়াছিল। বিদ্যাপতি হয় সামন্ত অথবা এক অর্ধ-স্বাধীন রাজার পারিষদ ছিলেন এবং এই রাজার শোচনীয় পরিণাম দেখিয়া অনুমান হয় যে, পরাধীনতার ছাপ হইতে তিনিও বিমুক্ত ছিলেন না।‘

বাংলায় চণ্ডীদাসের পর বড় বৈষ্ণব কবি জ্ঞানদাসের একটি পদ এইরকম :

‘দিবস দিবস করি মাস বারিখ গেল
বরিখে বরিখে কত ভেল।‘

ষোড়শ’ শতাব্দীর শেষভাগের বাংলার এই কবি নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর দ্বিতীয় স্ত্রী জাহ্নবী দেবীর মন্ত্রশিষ্য ছিলেন। জ্ঞানদাস যখন পদাবলী লিখতে শুরু করেন, তখন বাংলায় নবীন বৈষ্ণব ধর্মের পূর্ণ জোয়ার। এই সময়ের পদাবলীর কৃষ্ণ দশ-অবতারের কৃষ্ণ নয়। এই কৃষ্ণ ‘কোটি ইন্দু জিনি বরন মনোহর.. অধরে মুরলী রসাল ॥‘
রাধিকার কপালে সিঁদুর; ‘সুরঙ্গ সিন্দুর ভালে অতি অনুপম..’
চণ্ডীদাসের সময় থেকে প্রেম ও বিরহের এই স্রোত জ্ঞানদাসেও প্রবাহিত।

এরপর এলেন গোবিন্দদাস। ইনি চৈতন্যের অনুচর ছিলেন। কৃষ্ণ-বন্দনা গাইছেন ‘জয় শচীনন্দন ত্রিভুবন বন্দন’ এবং তাঁর কৃষ্ণ ‘চিকনকালা গলায় মালা, বাজয় নূপুর পায়..’
তাঁর পদাবলী মূলত গৌরলীলা বিষয়ক। চৈতন্য প্রতিষ্ঠিত এই নতুন ধর্মে তাঁর তিরোভাবের পরই শ্রীকৃষ্ণের জায়গায় তাঁকে বসানো হয়। শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলার অনুকরণেই তাঁর ‘গৌরাঙ্গ ভক্তি পদাবলী।‘

আমরা জানি, বিপ্লব প্রথমে চিন্তাক্ষেত্রে হয়, তারপরে তার ব্যবহারিক প্রতিফলন। চৈতন্য-ধর্ম-আন্দোলনেও তাই। সনাতনবাদীদের গোঁড়ামি ভেঙে, আপামর বাঙালিকে নতুন মত ও পথে জড়িয়ে নিলেন যে মহাজীবন, পদাবলীতে তার অনেক নজির।

‘চণ্ডালে ব্রাহ্মণে করে কোলাকুলি
কবে বা ছিল এ রঙ্গ..’

কিংবা

‘আচণ্ডালে দিল প্রেম আলিঙ্গন
জাতিবিচার তার না ছিল কখন..’

গণজাগরণের এই যে অভূতপূর্ব ইতিহাস তৈরী হল, তা ভারতের অন্য প্রদেশের মতো রাজনীতিক্ষেত্রে যদি চালিত হত ? তবে এই অপরূপ ধারাটি শুধু বিশেষ একটি ধর্মে এবং সীমাবদ্ধ একটি সমাজ-সংস্কারে থেকে যেত না। এই গণ-আন্দোলনটি আদর্শ ভাবুক নেতার অভাবে এবং জাতীয় রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বঞ্চিত হয়ে কেবল ‘কীর্তন’ ও ‘নাম-সংকীর্তন’ ধর্ম হয়ে রইল।

এভাবেই যে-কোনো একটি উপলক্ষ্য, কোনো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, সামাজিক-রাজনৈতিক বিক্ষোভের এক-একটি অধ্যায় বাস্তবের বা খণ্ডিত সময়ের সীমাকে ছাপিয়ে যায়,  কবিতার সেই রহস্যকেই খুঁজে পাই বৈষ্ণব পদাবলীর মধ্যে। এই একটি কারণেই মনে হয়, এই গীতি-কবিতাগুলো সমকালীন পাঠককে এক রকমের তৃপ্তি দিয়েছে নিশ্চয়ই,  কিন্তু তাদের মধ্যে যেগুলি উপলক্ষ্যকে ছাপিয়ে বড়ো ও স্থায়ী কোনো সত্যের কথা বলেছে,  সমকালের অনুভবের সমান্তরালে পরবর্তীকালের কোনো অনুভবকে টেনে আনতে পেরেছে,  সেগুলোর জন্যেই সাহিত্য হিসেবে পদাবলী আজও প্রাসঙ্গিক।

উচ্চারণের স্বকীয়তায় পরের যুগের একজন পাঠকের উচ্চারণে নিবিড়ভাবে ঢুকে যেতে পারছে এইসব পদ-কাব্য, ঘরোয়া উচ্চারণে দৈনন্দিনকে স্পর্শ করে চকিতে ছুঁয়ে যাচ্ছে একটা বড়ো অভীপ্সাকে,  পাঠককে পৌঁছে দিতে পারছে ভাবজগতে, স্বপ্ন-জগতে। তরল নির্মল স্রোতের ছন্দ পাঠককে নিয়ে যাচ্ছে প্রতীক্ষার একটি গাঢ় এবং অনায়াস অনুভবে।

নিজের পথ খোঁজার দুরন্ত তাগিদেই হয়তো পুনরাবৃত্তি ঘটেছে – শব্দের পুনরাবৃত্তি, ভাবনার পুনরাবৃত্তি, বাকচাতুর্যের পুনরাবৃত্তি। কিন্তু আজকের পাঠক অনেক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বুঝতে শিখেছে, সাহিত্যের গ্রহণ বা বর্জন ঠিক তত্ত্ব বা তথ্যের গ্রহণ-বর্জনের মতো নয়। হয়তো গত কয়েক দশকের সামাজিক বা রাজনৈতিক মতামত বা বিশ্বাস বা ধারণার জগতে যে ওলট-পালট ঘটেছে, সেটাই শেষপর্যন্ত নান্দনিক রুচির ক্ষেত্রে উদারতার রাস্তা ক্রমশ পরিষ্কার করে দিচ্ছে।

সমাজ ও রাজনীতির গঠন ও পুনর্গঠনের সাফল্য ও ব্যর্থতা, ব্যক্তির আশা ও নিরাশা কেমন করে ছড়িয়ে পড়েছে পদাবলীর এইসব কবিতায়,  অনুভবের পুঙ্খানুপুঙ্খে ও বিস্তারে। তাকে তথ্য দিয়ে যেমন চেনা যায়,  তেমনই আবার তথ্যের পরোয়া যিনি করেন না,  তিনিও অনুভব করেন এই তরঙ্গ। এক চোরাটানে পাঠ ও পুনঃপাঠ। এই নিরন্তর পাঠ-প্রক্রিয়ায় ক্রমে জীবন্ত হয়ে ওঠে বৈষ্ণব পদাবলী।

 

তথ্যঋণ:
বৈষ্ণব পদাবলী – সাহিত্য আকাদেমি
বিদ্যাপতি পদাবলী – বসুমতী সংস্করণ
বৈষ্ণব সাহিত্যে সমাজতত্ত্ব – ড: ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত
রামায়ণ : প্রকৃতি পর্যাবরণ ও সমাজ – ধূর্জটিপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
বঙ্গভাষা ও সাহিত্য – দীনেশচন্দ্র সেন
আদিবাসীদের ভাষা ও বাংলা - ড: >সুহৃদ কুমার ভৌমিক
বঙ্গ সংস্কৃতিতে প্রাক-বৈদিক প্রভাব – ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে

 


লেখক পরিচিতি - আইভি চট্টোপাধ্যায়ের জন্মস্থান–জামশেদপুর, ঝাড়খণ্ড। পেশায়– ব্যাঙ্ককর্মী আর নেশা- লেখালেখি, বেড়ানো ও বাগান করা। গদ্য, ছোটগল্প, বড়গল্প,উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণ-কথা লিখতে ভালবাসেন। প্রকাশিত বই – নিরবলম্ব (উপন্যাস), রাতপাখি এবং অন্যান্য (ছোটগল্প সঙ্কলন), ছায়াতে আলোতে (ছোটগল্প সঙ্কলন),অপারেশন স্বর্গদ্বার (উপন্যাস), অনির্বাণ এবং (ছোটগল্প সঙ্কলন), রামধনুর দেশে (ছোটদের জন্যে গল্প সঙ্কলন),ভাবনার নানা প্রসঙ্গ (প্রবন্ধ সঙ্কলন) নদী যেমন (ছোটগল্প সঙ্কলন) মহাজীবন (ছোটগল্প সঙ্কলন)।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।