প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

ভ্রমণ

মার্চ ১৫, ২০১৭

 

সোনারুন্দি রাজবাড়ি, একদিন প্রতিদিন।।

জাহির রায়হান


একটাই উপায় ঠাহর হল, পালাতে হবে। পালানোতেই সাময়িক স্বস্তি। টাকা নিয়ে একঘেয়ে কচকচানি আর একই মোদি’র নাগাড়ে মুণ্ডপাত করতে করতে হতক্লান্ত। ছোট একটি কাজ আছে, আছে হাতছানিও। তাই বাইকিং। এমনিতে বাইকের প্রতি আমার প্রীতি এবং প্রতিহিংসা কোনটাই নেই। বাবার মতে, মোটর সাইকেল হল শয়তানের চাকা। কিন্তু বাস পথে গেলে গন্তব্য প্রায় ৭০, কিন্তু ঐ শয়তানের চাকা এবং প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা’র কল্যাণে সেই পথই মেরে কেটে ৪০-৪৫ কিমি। সুতরাং চরৈবতি।

যেতে হবে বর্ধমানের কেতুগ্রাম। বেলডাঙ্গা থেকে বেরলাম সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ। সঙ্গে অনুগত ছাত্র ওয়াসিম। রুট যা ঠিক করেছি তাতে যাযাবর জাতীয় প্রাণীর প্রচুর রসদ রয়েছে। নবাব সিরাজের সহ সেনাপতি মীরমদনের সমাধি, নবাবি ফৌজের হাতিশাল দাদপুর ও পিলখানা অঞ্চল, বাবলা নদী, অট্টহাস এবং সোনারুন্দি রাজবাড়ি। প্রকৃতিগত ভাবে আমি ষ্টেশন সংলগ্ন এলাকায় তাঁবু খাটিয়ে অস্থায়ীভাবে যেসব মানুষ বাস করেন এবং কিছুদিন পর পর চলে যান অন্যত্র, তাদের গোত্রীয়, শুধু ভাগ্যের ফেরে ইট, কাঠ, পাথর নির্মিত বাড়িতে জন্মেছি। কাজেই দুর্দান্ত সিনিক বিউটি, মারকাটারি কুইজিন এবং বাড়ির স্বাচ্ছন্দ্য ছাড়া যাদের চলে না, এ পাঠ তাদের জন্য নয়। নিছক গঙ্গাফড়িং দেখে খুশি হওয়ার মানসিকতা যদি আপনার থাকে, অথবা হন টো টো কোম্পানির সক্রিয় সদস্য, পদ্মপাতায় জল ধারণের কসরৎকারী বা উঠল বাই তো কটক যাই-এর প্রবক্তা, তাহলেই এ লেখাটি আপনার খোরাক হতে পারে।

ভাগীরথী পেরলাম নারকেলবাড়ি ঘাটে। এ ঘাটেই একবার পারাপারের সময় যাত্রীভর্তি একটি টাটা সুমো তলিয়ে গিয়েছিল নদীতে, মারা গিয়েছিল আটটি প্রাণ। খবরের কাগজে হয়ত দুর্ঘটনাটি পড়েছেন কখনও। নদী পারাপারের আগে দেখে নিয়েছি মীরমদনের কবর। পলাশী যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি মীরজাফর লড়াই করতে অস্বীকৃত হলে, মীরমদন তাঁর নিয়ন্ত্রিত বাহিনী নিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আহত, ক্ষতবিক্ষত সেই অনুগত বীর যুদ্ধপ্রান্তর থেকে ফেরার পথে, এখানেই মৃত্যু মুখে পতিত হন, মৃত্যু হয় তাঁর ঘোড়াটিরও। এখানে এক পীরের সমাধিও রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ভূতপূর্ব রাজ্যপাল শ্রীগোপালকৃষ্ণ গান্ধী মহাশয় এসেছিলেন একবার সেই বীরযোদ্ধাকে শ্রদ্ধা জানাতে।

মধ্যবাংলার মাঠে ঘাটে সবুজের অভাব হয় না কখনও, যেদিকেই যান, যখনই যান সবুজের উপস্থিতি সর্বত্র। এখন পৌষ মাস, সে সবুজের সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে বিস্তৃত হলুদ সর্ষেক্ষেত, সঙ্গে সোনারোদ আর আপাত ঠাণ্ডা বাতাস। বাইকের পিছনে বসে রীতিমতো উপভোগ্য মাধুকরী। মিল্কি, ঘোল্লা পেরিয়ে বাবলা নদীর দিকে যেতে যেতে দেখলাম প্রত্যন্ত গ্রামের রাস্তার ধারেও ডিজিটাল ইন্ডিয়া উপস্থিত, মোটা কেব্‌ল পোঁতার কাজ চলছে। বাবলা তীরবর্তী বাবলা গ্রাম সম্পর্কে পাঠক নিশ্চয় জানেন। এ গ্রামেরই আবুল বরকত বাংলাদেশের মাতৃভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ, সে সময় উনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা, বাঙালির অবশ্য কর্তব্য।

সালার থেকে পাঁচুন্দির পথে মসৃণ রাস্তার পাশেই একটি খেজুর গুড়ের আখড়া চোখে পড়ল, চেখে দেখব ফেরার সময়। ওয়াসিম বলল, স্যার চোলাইয়ের ঠেক নয় তো !! সে কপাল কি আর হবে রে, বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, ওয়াসিম হেসে ফেলল। কাজ বেশীক্ষণের ছিল না, ফলত অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা সেই ঠেক-এ হাজির হলাম। না, চোলাই নয়, গুড়েরই কারখানা। টাটকা, খাঁটি এবং টেস্টি, মাত্র ৭৫ টাকা কিলো। মিষ্টিমুখেই ছোট বাজারটিকে ছাড়িয়ে ভাঙা দরজার মধ্যদিয়ে প্রবেশ করলাম বনয়ারিবাদ বা সোনারুন্দি রাজবাড়ি চত্বরে। পাশের জেলা বর্ধমানের রাজাদের বাড়ি। ভগ্নপ্রায় বাড়িটি অযত্নে, অবহেলায় পড়ে রয়েছে। পড়ে রয়েছে দুটি কামানও। বাড়ি সংরক্ষণ করা সম্ভব না হলেও, কামান দুটিকে সংরক্ষণ কেন করা হয় না, দিনের পর দিন ওখানে ওভাবে পড়েই বা আছে কেন, তাও অজ্ঞাত। কোনও মিউজিয়ামে দিব্যি ও দুটিকে রাখা যায়, সেখানেও কি তবে সার্জিক্যাল ষ্ট্রাইক ?? বছর চারেক আগেও শুনেছিলাম, এখনও শুনলাম ছোট রাণীমা নাকি এখানেই বাস করেন, সেবারও তাঁর হদিস পাইনি, এবারও পেলাম না।



সোনারুন্দি রাজবাড়ি চত্বর



পড়ে রয়েছে দুটি কামানও

তবে রাজবাড়ি সংলগ্ন দীঘিটির মাছগুলি ভালো আছে, দিব্যি আছে। এক সময় নাকি সোনার নথ পড়া মাছের দেখা মিলত এখানে। এ মাছ নাকি কেউ ছাড়েও নি, কেউ ধরেও না। কেউ একজন ধরতে গিয়েছিল কোনও একসময় এবং যথারীতি আপনার জ্ঞাত মিথ গল্পের মতোই, এখানেও সেই দুর্জন মুখে রক্ত উঠে মারা গিয়েছিল। দর্শনার্থীদের দেওয়া বিস্কুট এবং মুড়ি খেয়ে তারা রীতিমতো নধর। আপনি ভয় না পেলে তারা দিব্যি আপনার হাত থেকে বিস্কুট খেয়ে যেতে পারে। শুনলাম কেউ কেউ মানতও করে থাকে আর রাজবাড়ি থেকে মাছেদের জন্য দুবেলা ভোগেরও ব্যবস্থা রয়েছে।



সুনসান রাজদালান আমাদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে

সোনারুন্দি থেকে কিছুটা গেলেই বর্ধমানের নিরোল গ্রামে রয়েছে ওষ্ঠহাস। দেবীর একান্ন সতীপীঠের একটি। শোনা যায় ওখানে দেবীর ঠোঁট বা ওষ্ঠ পড়েছিল। ওষ্ঠহাস কালক্রমে আমাদের উচ্চারণ দোষে হয়ে গেছে অট্টহাস। বনয়ারিবাদ রাজবাড়ি চত্বরেই সাদা চুনকাম করা একটি মন্দির দেখলাম, তালাবন্ধ। রয়েছে একটি উচ্চ বিদ্যালয়ও। এই বিদ্যালয়েরই কোন শিক্ষক সম্ভবত ছিলেন ছোট রাণীমার পোষ্যপুত্র। রাজ ইতিহাসের প্রমাণ স্বরূপ এই সুনসান রাজদালান আমাদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তবে নেই অনেক কিছুই। নেই রাজ পরিবারের কলরব। নেই কোনও হাঁকডাক, সৈনিক, বরকন্দাজ। পরিবারের অশীতিপর মানুষের মতোই ডিজিটাল যুগে ওবাড়ির প্রয়োজন ফুরিয়েছে। মৃত্যু ঘটেছে অনেকদিন, এখন শুধু বিলীন হওয়ার অপেক্ষা। কালগর্ভে সে হারিয়ে যাওয়ার বাস্তবতা মনে পড়তেই মন ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। মনে হল আমি যেন ঐ রাজপরিবারের কোনও ক্ষয়িষ্ণু সন্তান, প্রিয়জনের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি নিশ্চিত জেনেও, অসহায় !!

কিভাবে যেতে পারেন –

হাওড়া-আজিমগজ্ঞ সেকশনের সালার ষ্টেশন নামুন, সেখান থেকে টুকটুক চেপে টুকটুক করে। বাসও আছে, কাটোয়াগামী। গঙ্গাটিকুরি নেমেও যাওয়া যায়, কিন্তু যানবাহনের একটু সমস্যা হবে। সর্বভুক হলে সালারের নাঁদ রুটি (সম্ভবত ‘নান’-এর অপভ্রংশ) ও শিক্ কাবাব খেয়ে দেখতে পারেন।



লেখক পরিচিতি - পাওয়া যায়নি।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2015 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।