(শিরোনামে ‘কাননবালা’ নামটাই ব্যবহার করেছি । ১৯২৯-এ তাঁর প্রথম গানের রেকর্ডের লেবেলে শিল্পীর নাম লেখা ছিল ‘মিস কাননবালা’। প্রথম যুগের সিনেমাতেও তাঁর পরিচিতি ছিল ‘কাননবালা’। তারপর কাননবালা থেকে দীপ্তিময়ী কানন দেবী – দীর্ঘ পথচলা আর অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার বিস্ময়কর অধ্যায়। আমি সেদিকে যাইনি। আমি শুধু কাননের গানের সূত্রে সেই সময়টাকে ফিরে দেখতে চেয়েছি। ২২ এপ্রিল ২০১৬ তিনি পূর্ণ করেছেন জন্মের শতবর্ষ )
তখন নিতান্ত শৈশব আমার, সাত কি আট বছর বয়স। বাড়িতে রেডিও বা গ্রামোফোন রাখার মত বিলাসিতা তখন আমাদের সংসারে ছিল না। একদিন পাশের এক ধনি পরিবারের বাড়ি থেকে ভেসে এসেছিল একটা গান, বোধহয় কলের গান বাজছিল- ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ’। কার গান, কার কন্ঠস্বর এইসব তখন আমার জানার কথা নয়, জানতামও না। কিন্তু গানের সুর আর প্রথম কলিটি কিভাবে মনে গেঁথে গিয়েছিল জানি না। তারপর সেই দম দেওয়া কলের গান আর গ্রামোফোন রেকর্ড কবেই অচল হয়ে গেছে। গানটা আর শোনা হয়নি। বছর পঁচিশ আগে হঠাৎ একদিন ভোরের এফ.এম. রেডিওতে আধোঘুম চোখে আবার শুনতে পেলাম শৈশবে শোনা সেই গানটির রি-মেক ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ’। ‘সাপুড়ে’ ছায়াছবিতে নজরুল ইসলামের সুরে গেয়েছিলেন কানন দেবী- তখনকার কানন বালা। শৈশবের একটা খণ্ড মুহুর্ত সময়ের সীমা পেরিয়ে ধরা দিল যেন।
কানন দেবী
দশ বছরের বালিকা কানন পিতার মৃত্যুর পর মাকে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিলেন। পরিচারিকার কাজ জুটিয়ে, নির্যাতন সহ্য করে অবশেষে এক সহৃদয় ব্যক্তির হাত ধরে ম্যাডান স্টুডিওতে পা রেখেছিলেন। তারপর আর পেছন ফিরে তাকানোর প্রয়োজন হয়নি। সেটা চলচ্চিত্রের প্রথম যুগ, ছায়াছবি তখন নির্বাক। কাননের কথা জানার সময় পঞ্চাশ বছর আগের একটা মুখ ভেসে আসে। তিনি নটী বিনোদিনী। দু’জনের জীবনযুদ্ধ শুরু হয়েছিল একই ধারায়। দুজনেই পঙ্কজা থেকে মহিয়সীতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন আপন মেধা ও তন্ময় সাধনায়। তফাৎ একটাই যে বিনোদিনী বাংলা থিয়েটারে তাঁর খ্যাতি ও যশের সর্বোচ্চ শিখর স্পর্শ করেও মাত্র ২৩ বছর বয়সে মঞ্চ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন প্রবঞ্চনাবিদ্ধ অভিমানে। আর কানন, অনাদরের কাননবালা থেকে দীপ্তিময়ী কাননদেবী হয়ে উঠে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অনন্য মর্যাদায় বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পের অভিভাবকের আসনে আসীন ছিলেন।
নিজের মেয়েবেলা সম্পর্কে তেমন কিছু লিখে যাননি কানন। তাঁর জন্মের তারিখটিও জানা যায় না। তবে অনেকে বলেন ২২শে এপ্রিল। সমাজের অন্ধকার স্তর থেকে উঠে আসা জন্ম পরিচয়হীন এক বালিকার মেয়েবেলার কথায় কারই বা আগ্রহ থাকে! কাননের জন্ম পরিচয় নিয়ে নানান গল্প ছড়িয়ে আছে মাত্র। সে সব গল্পে আমার আগ্রহ নেই। কাননের মুখ থেকে আমরা শুধু এটুকুই জেনেছি যে পিতা বলে আশৈশব যাকে জেনে এসেছিলেন, মা তার বিবাহিত স্ত্রী ছিলেন না, ছিলেন রক্ষিতা। (সূত্র- ‘সবারে আমি নমি’ / কাননদেবী)। দশ বছর বয়সে বিনোদন জগতে আসার পর বহু গুণী সঙ্গীতজ্ঞের কাছে কানন গানের তালিম নিয়েছেন। পন্ডিত আল্লারাখা, কৃষ্ণচন্দ্র দে, কাজী নজরুল, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, পঙ্কজ কুমার মল্লিক প্রমুখের কাছে নানা ধরণের গানের তালিম নিয়েছেন তিনি। কিন্তু সিনেমায় আসার আগে সঙ্গীতের প্রাথমিক পাঠ নিয়েছিলেন কী না, এমন কোন লেখা-জোখা নেই, কানন নিজেও বলেননি । সুতরাং এটা মনে করাই সঙ্গত, যে গান ছিল কাননের সহজাত প্রতিভা। আত্মকথা ‘সবারে আমি নমি’-তে কানন এক আধাবয়সী প্রৌঢ় ‘ভোলাদা’র কথা বলেছেন। তাদের পাড়াতেই থাকতেন তিনি । কানন লিখছেন– “গান শোনার লোভেই অবসর পেলেই তাঁর কাছে গিয়ে বসতাম। ওঁর কাছে দু-চারটি গানও শিখেছিলাম। মীরার ভজন, রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদের কিছু গান কীর্তন ও ভাটিয়ালীর কয়েকটি গানই ছিল তাঁর সম্বল।” কানন তাঁর আত্মকথায় জানিয়েছেন- “ভালো করে জ্ঞান হবার আগেই গানকে ভালো বেসেছি ... যেখানেই গান হতো, মন্ত্রমুগ্ধের মত অজান্তেই কখন সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান শুনতে শুরু করেছি হুঁশই থাকত না। ...”
কানন যখন চলচ্চিত্রে আসেন তখন ভারতীয় সিনেমারই শৈশবকাল। কাননের জন্মের মাত্র তিন বছর আগে ভারতীয় সিনেমা তার পথচলা শুরু করেছে। দাদা সাহেব ফালকে ‘রাজা হরিশচন্দ্র’ নামে প্রথম কাহিনি চিত্র নির্মাণের ছয় বছর পরে, ১৯১৯-এ ম্যাডান থিয়েটার কোম্পানী নির্মাণ করেন প্রথম বাংলা কাহিনি চিত্র ‘বিল্বমঙ্গল’। আর এর সাত বছর পরে, ১৯২৬-এ এই ম্যাডান থিয়েটার কোম্পানীর সিনেমা ‘জয়দেব’-এ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে কানন পা রাখলেন চলচ্চিত্র জগতে। তখনও চলচ্চিত্র নির্বাক, কথা বলা শুরু করবে আরো পাঁচ বছর পরে। বাংলা গানের ভুবনটিরও তখন শৈশব না হলেও বাল্যাবস্থা। প্রথম ধ্বনিবদ্ধ বা গ্রামোফোন রেকর্ডে গান গাইলেন বারাঙ্গনাপল্লী থেকে উঠে আসা থিয়েটারের সখীর দলের দুই নাচবালিকা শশীমুখী ও ফণিবালা। মেয়েরা তো বটেই, সম্ভ্রান্ত পরিবারের পুরুষদেরও রেকর্ডে গান গাওয়া সেদিনের সমাজ অনুমোদন করতো না। পরিশীলিত গায়নরুচি তৈরি হতে লেগে গেলো আরো কুড়ি-পঁচিশ বছর। আর গানের রেকর্ডও তো বছরে বেরতো হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক অর্থাৎ ১৯২০ থেকে ৩০ সময়কালকে বাংলা গানের স্বর্ণযুগের প্রস্তুতি পর্ব বলা যায়। অগস্ট ১৯২৭-এ কলকাতা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বেতার সম্প্রচার শুরু হয়েছে, নজরুল ইসলাম গ্রামেফোন কোম্পানীর সঙ্গীত বিভাগের প্রধান হয়েছেন, বাংলা গানের ভুবনে উঠে এসেছেন পঙ্কজকুমার মল্লিক, দিলীপকুমার রায়, কমলা ঝরিয়া, ধীরেন দাস, হরিমতী, ইন্দুবালা, আঙ্গুরবালা, মৃণালকান্তি ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী প্রমুখ। এই ইতিহাসটুকু বলে নেওয়া এইজন্য যে প্রায় সমকালে কাননের বাংলা গানের কাছে আসার আবহটুকু বুঝতে চেয়ে ।
১৯৩১-এ বাংলা চলচ্চিত্র কথা শুরু করলো আর ১৯৩৫-এ নীতিন বসু পরিচালিত ‘ভাগ্যচক্র’ ছবিতে সঙ্গীত পরিচালক রাইচাঁদ বড়াল প্রথম প্রয়োগ করলেন নেপথ্য সঙ্গীত বা ‘প্লে-ব্যাক’- কৃষ্ণচন্দ্র দের কন্ঠে। ১৯৩৩-এ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘শ্রী গৌরাঙ্গ’ ছায়াছবিতে কাননের গান সিনেমার দর্শকদের আগ্রহের কেন্দ্রে চলে আসে তারপর ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ মুক্তি পাওয়ার পর কাননের খ্যাতি আরো প্রসারিত হয়। এই সময় থেকে কাননের কর্মক্ষেত্র প্রসারিত হয় সিনেমা থেকে গ্রামোফোন কোম্পানী পর্যন্ত। এই সময় থেকেই কাননের উত্থানেরও শুরু। কাননের নিজের কথায় “...গান এসে আমার অভিনয়ের পাশে দাঁড়াতেই মনে হল আমার জীবনের এক পরম পাওয়ার সঙ্গে শুভদৃষ্টি ঘটল। ...নিজেকে যেন নতুন করে চিনলাম।”
সে কালের রুপোলি জগতের দস্তুর– অনেক ক্লেদ আর গ্লানি স্পর্শ করেছিল কিশোরী কাননকে। সেই ক্লেদ আর গ্লানি থেকে মুক্তির নিঃশ্বাস নিতেই যেন গানকেই আঁকড়ে ধরেছিলেন কানন। তিনি তাঁর আত্মকথায় সে কথা বলেছেনও। লিখেছেন “... নিজের কন্ঠে রেকর্ডে যখন প্রথম শুনি সে যে কী রোমাঞ্চ তা বলে বোঝাতে পারবো না। নিজেকে যেন নতুন করে চিনলাম ...এই ভয়াবহ জীবনের নাগপাশ যখন সকল আনন্দের টুঁটি চেপে জীবনকে দুঃসহ করে তুলত, তখন গানের এই স্পর্শটুকুই আমায় যেন বাঁচিয়ে দিত। মনে হত এই তো আমার সত্যি করে বাঁচা।”
সেই সময়ে সিনেমার গানে কাননের পাগলকরা লোকপ্রিয়তার পেছনে দু’জন মানুষের অবদান সম্ভবত সর্বাধিক। তাঁরা এদেশের সঙ্গীত জগতের দুই কিংবদন্তী- রাইচাঁদ বড়াল ও পঙ্কজকুমার মল্লিক। অভিজাত সাঙ্গীতিক পরিবারের সন্তান ছিলেন রাইচাঁদ। পিতা লালচাদ বড়াল ছিলেন এদেশের প্রথম অভিজাত পরিবারের সন্তান যিনি সর্বপ্রথম গ্রামোফোন রেকর্ডে গান করার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন। আর রাইবাবু বাংলা সিনেমায় নেপথ্য সঙ্গীতের প্রথম প্রয়োগ করেন। রাইবাবুকে বলা হত ভারতের সিনেমা-সংগীতের ভীষ্ম পিতামহ। ১৯৩১-এ সিনেমা-সঙ্গীতে আসার আগে অগস্ট ১৯২৭-এ কলকাতায় বেতার সম্প্রচার শুরু হওয়ার প্রথম দিন থেকেই তিনি রেডিওর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৩১ থেকে ১৯৬০ দীর্ঘ ২৯ বছরের সিনেমা-সংগীত জীবনে বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে ৭৯টি ছায়াছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন তিনি, তিনিই প্রথম ‘অর্কেষ্ট্রা’র স্রষ্টা । এহেন রাইচাঁদ বড়ালের মত সুরস্রষ্টার সংস্পর্শে এসে পরিণত হয়েছিলেন কানন। স্বীকারও করেছেন যে গায়িকা রূপে তাঁর বৈপ্লবিক প্রতিষ্ঠার মূলে যাঁদের অবদানের কথা মনে আসে, তাঁদের মধ্যে প্রথমেই আসে রাইচাঁদ বড়ালের নাম।
‘স্ট্রীট সিঙ্গার’ (১৯৩৮)-এর একটি গান
কানন বা রাইচাঁদ বড়ালের কথা বলতে গেলে আরো একজনের কথা বলতে হয়, তিনি কুন্দনলাল সায়গল। ভগ্যান্বেষণে কলকাতায় আসা পঞ্জাবী যুবক সায়গল রাইবাবুরই আবিস্কার। অসংযমী যাপন মাত্র ৪৩ বছর আয়ুতেই তাঁর জীবনকে কেড়ে নেয় সত্য, কিন্তু যে চোদ্দ বছর সিনেমা-সঙ্গীত জগতে ছিলেন অননুকরণীয় কন্ঠ ও গায়কীর ঐশ্বর্য নিয়ে, তাতেই প্রবাদ হয়ে আছে ‘সায়গল কন্ঠ’। রাইবাবুর সুরে ‘স্ট্রীট সিঙ্গার’ (১৯৩৮) ছবিতে কানন- সায়গল দ্বৈতকন্ঠের রাগাশ্রয়ী গান ‘বাবুল মোরা নৈহর ছুট যায়’ আজও তন্ময় সঙ্গীতপ্রেমীরা মুগ্ধ বিস্ময়ে শোনেন। কিংবা রাইবাবুর সুরে ‘বিদ্যাপতি’ ছবিতে কনন-কন্ঠে ‘অঙ্গনে আওত যব রসিয়া’ আর এক প্রবাদ-প্রতিম গান। সে কালে কৃতবিদ্যরা নতুন প্রতিভার অন্বেষণ ও তার প্রতিভার স্ফুরণ ঘটানোর নিরন্তর প্রয়াস চালাতেন, এ যুগে যা দেখা যায় না। কানন, সায়গলরা সেই প্রয়াসেরই ফল।
রাইচাঁদ বড়াল কাননকে গড়লেন, ‘বিদ্যাপতি’তে কাননের গান সারা ভারতে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেছিল। ‘বিদ্যাপতি’র পর ‘মুক্তি’ (১৯৩৭)। ‘মুক্তি’তে কাননের গানের ভুবন যেন পরিপূর্ণ হল ভারতীয় সংগীতের আর এক কিংবদন্তী পঙ্কজকুমার মল্লিকের ছোঁয়ায়। কানন-কন্ঠের ঐশ্বর্য ঠিকই চিনেছিলেন পঙ্কজকুমার। রবীন্দ্রনাথের অনুমোদন নিয়ে কাননকে দিয়ে গাওয়ালেন রবীন্দ্রনাথের গান ‘আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে’
ও ‘তার বিদায় বেলার মালাখানি’
( শুনতে চাইলে গানের পাশে বক্সে ক্লিক করুন,
থামাতে চাইলে দ্বিতীয় বার ক্লিক করুন)। কানন হয়ে গেলেন রবীন্দ্রকাহিনি নয়, এমন চলচ্চিত্রে রবীন্দ্র-গানের প্রথম শিল্পী। কাননের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। রবীন্দ্রনাথ আশীর্বাদ করেছিলেন তাঁকে। বলেছিলেন শান্তিনিকেতনে এসে তাঁকে গান শোনাতে। সেই যাওয়া আর হয়নি কাননের। কাননের বিবাহ উপলক্ষে কবিগুরু তাঁকে শুভেচ্ছাবার্তা সহ একটি ছবি উপহার দিয়েছিলেন। ‘মুক্তি’ ছাড়াও ‘শেষ উত্তর’ ‘পরাজয়’ ‘অনন্যা’, ‘অনির্বাণ’ প্রভৃতি আরো অনেক ছবিতে রবীন্দ্রগান গেয়েছিলেন কানন।
চলচ্চিত্রে নেপথ্য সঙ্গীত বা ‘প্লে-ব্যাক’ প্রথা প্রবর্তনের পর ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ ছবিতে গানের কাননের গৌরবময় প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। ‘বিদ্যাপতি’ (১৯৩৮) তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে আসে ও সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠা দেয়, আর মুক্তি তাঁকে প্রতিষ্ঠা দেয় রবীন্দ্রগানের সার্থক শিল্পী রূপে। কিন্তু তার অনেক আগেই নিতান্ত বালিকা বয়সেই কাননের গান রসিকজনের নজর কেড়েছিল । ১৯২৬-এ প্রথম ‘জয়দেব’ ছবিতে শিশুশিল্পী রূপে অভিনয়ের পর চারবছর আর সিনেমায় ডাক পাননি। এই সময় ১৯২৯ ও ৩০এ গ্রামোফোন কোম্পানী কাননের ছটি গান এইচ.এম.ভি. লেবেলে প্রকাশ করে । (সূত্র– দি ওয়ার্ল্ড অফ কাননদেবী / ডঃ জ্যোতিপ্রকাশ গুহ)। নজরুল ইসলাম তখন গ্রামোফোন কোম্পানীর মাসমাইনের সঙ্গীত প্রশিক্ষক। সম্ভবত নজরুল ইসলামের আগ্রহে কাননের সঙ্গে জে.এন. ঘোষের সঙ্গে পরিচিত হন। জে.এন. ঘোষ তখন সবে মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানীর পত্তন করেছেন। পত্তনের পর তাদের ৫ নম্বর রেকর্ডটাই ছিল কাননের। তারপর দীর্ঘকাল কানন মেগাফোন রেকর্ডসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখানেই কানন রাগপ্রধান বাংলা গানের প্রখ্যাত সংগীত সাধক ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে সঙ্গীত শিক্ষা করেন।
চলচ্চিত্র ও সঙ্গীতের সর্বোচ্চ সম্মাননা দাদাসাহেব ফালকে সম্মাননা, স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ থেকে বহু পুরস্কার পেয়েছেন কানন, তবু এক মহার্ঘ্য মুহূর্তের কথা নিশ্চিতভাবেই মনে রেখেছিলেন কানন, সেটি হল ১৯৪৭-এর ১৫ই অগস্ট দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির দিনে লন্ডনে ভারতীয় হাই কমিশনার ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন হয়েছিল তাঁর কন্ঠে ‘আমাদের যাত্রা হল শুরু, এখন ওগো কর্ণধার তোমারে করি নমস্কার’ গানটির সঙ্গে।
অভিনেত্রী কানন না গানের কানন- কাকে মনে রাখবে মহাকাল ? এ প্রশ্নের মিমাংসা হবার নয়। কানন নিজে যদিও আত্মকথায় লিখে গিয়েছেন “আজ আমার অভিনেত্রী পরিচয়টাই সকলের কাছে বড়। কিন্তু আমার নিজের কাছে সবচেয়ে দামী আমার গানের মহল ...আমার নিজের সঙ্গে গানের পরিচয়ের নিবিড় মুহূর্তটির যে মাধুর্য জীবনের অনেক তিক্ততাকে ভুলিয়ে দিতে পেরেছিল ... তার মধ্যেই যে আমার জীবনবিধাতার স্নেহস্পর্শের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি ঘটেছে”। আমরা বলি, এই দুইয়ে মিলিয়েই কানন।
কাননবালা থেকে কানন দেবী। আলোহীন জগৎ থেকে উঠে আসা এক নারী আপন প্রতিভা ও তন্ময় সাধনায়, অনেক অবহেলা, লাঞ্ছনা, চিত্র জগতের ক্লেদ, আর গ্লানি অতিক্রম করে দীপ্তিময়ী হয়ে উঠেছিলেন। সে এক বিস্ময়কর আলোয় ফেরার কাহিনি। আমৃত্যু নিজেকে তিনি বিজড়িত রেখেছিলেন চলচ্চিত্র শিল্পে তার অভিভাবকের মর্যাদায়। ১৯৯২-এর ১৭ই জুলাই ৭৬ বছর বয়সে কলকাতায় প্রয়াত হল ভারতীয় সিনেমার প্রথম মহানায়িকা কানন দেবী।
লেখক পরিচিতি - প্রবীণ সাহিত্যকর্মী। বাংলা
গদ্যসাহিত্যে তাঁর অবাধ বিচরণ। মূলত প্রাবন্ধিক। ছোট গল্প ও নাটকও
লেখেন। বিভিন্ন অন্তর্জাল ও মুদ্রিত পত্রিকায় তাঁর বহু মননশীল
প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। আঠেরো ও উনিশ শতকের বাংলার সামাজিক ইতিহাস
ও বিবর্তন তাঁর বিশেষ আগ্রহের যায়গা। প্রায় চুয়াত্তর পেরনো বয়সে
দুটি অন্তর্জাল পত্রিকা – ‘অন্যনিষাদ’ ও ‘গল্পগুচ্ছ’ প্রকাশ করে
চলেছেন গত পাঁচ বছর ধরে ।