‘মল্ল-বীরত্বর’ স্বর্ণালী অতীত –
ভাস্কর বসু
মুখবন্ধ
ছায়ার সাথে নয়, মানুষের সাথেই যুদ্ধ করে ‘গাত্রে হল ব্যথা’ যে খেলাতে সেই খেলাটির এক রীতিমতো গর্ব করার মত অতীত ও ঐতিহ্য আছে। সারা ভারতে তো বটেই, এমনকি আমাদের বঙ্গদেশেও। “মল্লযুদ্ধ” যা আমাদের কাছে ‘কুস্তি’ বলেই বেশী পরিচিত তা ইদানীং কালে আবার বেশ জনপ্রিয় হতে চলেছে। এর পেছনে আমাদের অলিম্পিক পদক জয় ও বলিউডি সিনেমা দুইয়েরই প্রভাব রয়েছে।
রামায়ণের কথা আমরা সকলেই জানি। বালি আর সুগ্রীবের সেই বিখ্যাত মল্লযুদ্ধের কথা - কৃত্তিবাস যার বিবরণ দিয়েছেন এভাবে-
আমরা আমাদের ঐতিহ্যের শুরু বলতে রামায়ণ – মহাভারতকেই বুঝি। সুতরাং এই ক্রীড়াটির ঐতিহ্য যে খুব সুপ্রাচীন এই মন্তব্য খুব অযৌক্তিক হবে না। আমরা এই প্রবন্ধের অল্প পরিসরে সচেষ্ট হব সেই রামের সময় থেকে আজকের মল্লযুদ্ধের যে উদ্বর্তন হয়েছে তাকে ছুঁয়ে যাবার। সেই ‘মল্লযুদ্ধ’ তে অন্যায় ভাবে অবশ্য বালি বধ হয়, যা কৃত্তিবাসেরও মনঃকষ্টের কারণ হয়েছে। তাই পর্বটি শেষের মুখে তিনি লিখতে বাধ্য হন -
এই ক্রীড়াটির প্রতিও কি আমরা সুবিচার করেছি? বা আরো কিছু কি করা যায়? দেখা যাক। আমরা খুব আনন্দিত যে আজ এই ক্রীড়াটি তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে চলেছে। কিন্তু এর স্বর্ণোজ্জ্বল অতীতের কথা হয়তো অনেকের সেভাবে জানা নেই। আমাদের লেখার অভিমুখ তাই অতীতের দিকেই।
গোড়ার কথা
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গাতে এবং কলকাতাতেও কুস্তির চর্চার খবর পাওয়া উনবিংশ শতকেই। ১৮ই আগস্ট, ২০১২ সালে গণশক্তি পত্রিকাতে প্রকাশিত এমনি একটি প্রবন্ধে আমাদের সামনে বেশ কিছু তথ্য এনেছেন শ্রী অনন্ত মণ্ডল। সেখানে দেখি –
আর জীবনস্মৃতি তো আমাদের সকলের পাঠ্য ছিল – খোদ রবিঠাকুরকেও নানা বিদ্যার আয়োজনের ভোজে কুস্তি শিখতে হয়েছিল –
সেযুগে কুস্তির আদর বোঝাতে এ দুটি উদাহরণ খুব কার্যকরী। এমনকি সুকুমারের ‘ষষ্ঠীচরণ’ যে পুরোপুরি কাল্পনিক নয় একথাও সহজেই অনুমান করা যেতে পারে।
গামা
গামা |
ভারতের সর্বপ্রথম বিশ্ববিখ্যাত কুস্তিগির পালোয়ান বলতে যাঁর কথা মনে পড়ে তিনি বড় গামা। গুলাম মুহাম্মদ গুজার (১৮৭৮ / ৮০ – ১৯৬৩) এর ডাক নাম যে ‘গামা’ কে রেখেছিল সেটা জানা যায়না। অবশ্য তাঁর নাম নিয়েও একটু সংশয় থেকে যায়, গামা বক্স না গুলাম মহম্মদ, কি নাম রাখা হয়েছিল জন্মের সময়। জন্মসাল ও ঠিকমতো জানা যায়না, তবে ১৮৭৮ – ৮০র মধ্যে সেটা অনুমান করা যেতে পারে। বাবা আজিজ বক্স নিজেও ছিলেন এক কুস্তিগির, যেমন ছিলেন পরিবারের অন্যান্যরাও। এই মুসলিম পরিবারটির বাস ছিল ভারতের উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে, পাঞ্জাবে। বিশেষ শিক্ষা দীক্ষা ছিল না তাঁদের। কিন্তু এই পরিবার থেকেই এসে এবং এক পরাধীন দেশে জন্মেও গামা যে ১৯১০ – ১৯৪০ প্রায় চার দশক ধরে সারা পৃথিবীতে নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে পেরেছেন তা খুবই আশ্চর্যজনক।
বাবা আজিজ খুব প্রিয় মানুষ ছিলেন গামার, তাঁর গুরুও বটেই। তাঁর হাত ধরেই দাতিয়ার রাজা ভবানী সিং এর কুস্তির আখড়াতে যেতেন। খুব দুঃখজনকভাবে গামার প্রায় শৈশবেই, মাত্র ছ বছর বয়সেই বাবার হঠাৎ মৃত্যু ঘটে। খুব মুষড়ে পড়েন তিনি। তাঁর আত্মীয়রা অবশ্য তাঁকে জানান, বাবার স্মৃতিকে জাগিয়ে রাখার একমাত্র উপায় হল তাঁর কুস্তির মাধ্যমে বিশ্বজয়। মাত্র দশ বছর বয়সেই যে তাঁর যোধপুরের রাজার আখড়াতে কুস্তির অনুমতি মিলেছিল, তা বাবার নামের জোরেই। তবে এই প্রতিযোগিতাতে তিনি জয়ী হলেও এক সপ্তাহের জন্য অসুস্থ হয়ে পড়েন।
জীবনের শুরুতেই কঠোর ব্যায়াম ও শরীর চর্চা করতেন। প্রথমে নিরামিষাশী হলেও পরে শারীরিক প্রয়োজনে, ১৪ – ১৫ বছর বয়সে তিনি আমিষ খাওয়া শুরু করেন। জনশ্রুতি তাঁর রোজকার শরীরচর্চার মধ্যে থাকত হাজার তিনেক ডন- বৈঠক আর ১২০ পাউন্ডের পাথর গলায় ঝুলিয়ে মাইলখানেক দৌড়।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদে ভারতবর্ষ অনেকগুলি ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল। দাতিয়া রাজ্যের রাজা ভবানী সিং এর আখড়াও ছিল কুস্তির জন্য বিখ্যাত। মাত্র পনেরো বছর বয়েস পার হতে না হতে গামার নাম ছড়িয়ে পড়ল – পরিবার ও রাজার বদান্যতায় তাঁর খোরাকও জুটতে লাগলো নিয়মিত – প্রতিদিন ২০ লিটার দুধ, আধ লিটার সর, কেজি চারেক ফল। সঙ্গে আমিষ, প্রয়োজনমত।
১৯০৪ - ১৯০৭ - এই সময় বেশ অনেক নামী দামী মল্লবীরকে হারিয়ে ভারতশ্রেষ্ঠর মর্যাদা লাভ করলেন গামা। এঁদের মধ্যে খুব উল্লেখ্য হলেন রহিম সুলতানিয়া। রহিমের সঙ্গে গামার লড়াই একেবারে বিশ্বপর্যায়ের ছিল, প্রায়শই ঠিক কে জিতছে বোঝা যেতনা। লাহোরে তাঁদের লড়াই একবার ২ ঘন্টা ২০ মিনিট চলেছিল, কিন্তু বিজয়ী অমীমাংসিতই থাকে। ১৯১০ এ তাঁর বিশ্ববিজয় শুরু করার আগে বেড়ে গেল তাঁর রোজকার শরীরচর্চার বহর, পাল্লা দিয়ে খাওয়ার পরিমাণও। এই সময় দৈনন্দিন আহার ছিল খান ছয়েক বড়সড়ো মুর্গি বা কেজি পাঁচেক পাঁঠার মাংস, দশ লিটার দুধ ইত্যাদি।
ভাবতেও ভাল লাগে যে ১৯১০ সালে চারজন মল্লবীরের দল লন্ডনে বিশ্বজয় করতে গেছিলেন, তাঁদের পৃষ্ঠপোষক কিন্তু কোন রাজা রাজড়া ছিলেন না। ছিলেন একজন ধনী বাঙালি – শ্রী শরৎ কুমার মিত্র। আর চিন্তাভাবনা ছিল যাঁর তিনি হলেন – শ্রী আর বি বেঞ্জামিন। এই দুজনের চিন্তা ছিল দুই রকমের, শরৎবাবু চেয়েছিলেন ভারতীয়রা পরাধীন হয়েও বৃটিশ রাজের ওপর কোন ব্যাপারে আধিপত্য কায়েম করুক। অন্যদিকে বেঞ্জামিন সাহেব চাইছিলেন আর্থিক লাভ। সুতরাং গামা ও তিন মল্লবীর, গামু জলন্ধারিওয়ালা, আহমেদ বক্স আর গামার সহোদর, ইমাম বক্স– সৌভাগ্যবশতঃ সাগরপাড়ি দিয়ে ইউরোপে এসে পৌঁছে গেলেন।
এখানে একটু তথ্য নিয়েও বিভ্রান্তি আছে। রুদ্রনীল সেনগুপ্তর “Enter The Dangal” বইটিতে তিনি পরিষ্কার জানাচ্ছেন এই শরৎ চন্দ্র মিত্র হলেন গোবর গুহর ভগ্নীপতি। ১৯০৯ সালে তিনিই মিত্র মশাইকে নিয়ে লাহোর যান গামার সঙ্গে রহিম সুলতানিয়ার লড়াই দেখতে। দু ঘন্টার সেই লড়াই শেষ হয় অমীমাংসিত ভাবে। এরপরেই ভাবনা শুরু হয় গোবরের। ১৯১০ সালে সেই বিখ্যাত সফরের সঙ্গীও ছিলেন গোবর, কিন্তু বাড়ির আদেশে তাঁকে ফিরে আসতে হয়।
গামা ও জিবিস্কো |
অন্যদিকে রণজয় সেন, তাঁর “Nation at Play” তে জানাচ্ছেন এই বাঙালী ব্যবসায়ীর নাম শরৎ কুমার মিশ্র। এবং তাঁর সঙ্গে গোবরের কোনরকম সম্পর্কের উল্লেখ নেই। এমনকি অজয় বসুর বইটিতে গোবর ও শরৎ বাবুর সম্পর্কের কোন উল্লেখ নেই।
সে যাই হোক, গামার আসা নিয়ে সবাই একমত। কিন্তু গামা এসে পড়লেন অন্য সমস্যাতে। তখন এত খবর পাওয়া যেত না, তাঁরা জানতেনই না যে বিশ্বস্তরে মল্ল-যুদ্ধ হয় শুধু হেভীওয়েটদের জন্য। মাত্র (?) ১৯৬ পাউন্ডের গামা তাতে ভাগ নিতে পারবেন না। কিন্তু গামার ম্যানেজার হাল ছাড়লেন না, একটি থিয়েটার বুক করে সব মল্লবীরদের উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ জানালেন। উদ্দেশ্য সফল হল।
প্রথম দিনেই তিনজন ইংরেজ মল্লবীর কুপোকাত হলেন। পরের দিল আরো দশজন। এরপরে মার্কিন চ্যাম্পিয়ন রোলারকে কাত করতে গামা সময় নেন মাত্র তিন মিনিট। তিরিশজন হেভীওয়েট জাপানী মল্লযোদ্ধা মাত্র একঘণ্টায় নতি স্বীকার করেন। সেই সময়কার ভারতীয় সংবাদ অনুযায়ী এরকম অবস্থায় বিশ্ব মল্লযুদ্ধের কর্মকর্তাদের আর কিছু করার ছিলনা, সব নিয়ম ভেঙে তৎকালীন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবার লক্ষ্যে তাকে লড়তে দেওয়া হল তৎকালীন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন পোলিশ মল্লযোদ্ধা তানিস্লাউস জিবিস্কোর (Stanislaus Zbyszko) সঙ্গে।
১৯১০ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর, লন্ডনের হোয়াইট সিটির স্টেডিয়ামে এই মহাযুদ্ধ হয়। মহাযুদ্ধই বটে! তিলধারণের জায়গা ছিল না, লক্ষাধিক দর্শক সাক্ষী ছিল। দর্শকের মধ্যে প্রথম সারিতেই উপস্থিত ছিলেন ইটালি, ফ্রান্স, জাপান, আমেরিকার বিভিন্ন কুস্তিগিররা। নির্ধারিত পুরস্কার মূল্য ছিল ২৫০ ব্রিটিশ পাউন্ড।
জব্বর লড়াই হয় এই দুজনের মধ্যে। ব্রিটিশ মিডিয়া তখনকার দিনেও খুব ভাল রকম কভারেজ দিয়েছিল এই লড়াইয়ের। গামা অনেকটাই পর্যুদস্ত করেছিলেন প্রতিপক্ষকে। দুর্ভাগ্যবশতঃ, দীর্ঘ ১৫৪ মিনিট লড়াইয়ের পর আলোর অভাবে খেলা বন্ধ হয়। ঠিক হয় এক সপ্তাহ পর আবার খেলা হবে। কিন্তু জিবিস্কো ১৭ই সেপ্টেম্বর উপস্থিত হলেন না। কর্তৃপক্ষ গামাকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করলেন। তিনি পেলেন একটি রজত কোমরবন্ধ আর চ্যাম্পিয়ন মেস। ভারতীয় বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের অর্থাৎ রুস্তম ই জামানের প্রতীক হল এই মেস।
এর পরেই গামা পরাধীন ভারতে প্রায় ‘জাতীয় বীরের’ সম্মান লাভ করলেন। তাঁর কাছে একমাত্র অপরাজিত ছিলেন রহিম সুলতানিয়া। ইংল্যান্ড থেকে ভারতে ফিরে তাঁর সংগে আবার লড়াই হল। এবারে গামা জয়লাভ করলেন, তবে অকপটে স্বীকার করেছিলেন তাঁর সবচেয়ে জোরালো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কোন বিদেশী নয়, রহিমই।
গামার ওপর গবেষণাকারী পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোসেফ এটলারের মতে গামা যে শুধু বীরই ছিলেন তাই নয়। তাঁর মধ্যে অনেক গুণের সংমিশ্রণ ছিল। একাধারে সৎ, সহজ সরল, অনাড়ম্বর আবার প্রকৃত পরিশ্রমী, প্রতিভাশালী ও গরিমাতে পরিপূর্ণ। আজকের দিনে তিনি যে কোন সফল ভারতীয়ের কাছে এক উজ্জ্বল আদর্শ বলে গণ্য হবেন। শুধু ভারতীয়রাই নন, তাঁর এক বিখ্যাত ফ্যান ছিলেন, কুংফু সম্রাট ব্রুস লি। গামার অনুশীলন পদ্ধতির বিরাট ভক্ত ছিলেন তিনি। তার আদর্শে নিজের ব্যায়ামচর্চা করতেন।
দেশভাগের পর গামা পাকিস্তানে চলে যান। ১৯৬০ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। আজ পর্যন্ত তিনি একমাত্র বিশ্বমানের মল্লযোদ্ধা যিনি একবারও পরাজিত হননি।
কুস্তি সংক্রান্ত দুটি চলচ্চিত্র বহুল জনপ্রিয়তা লাভ করার পর এখন আবার ‘গামা’র ওপর ছায়াছবির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। প্রথমে জন আব্রাহাম করার কথা থাকলেও হয়ে ওঠেনি। এখন সলমন খানের প্রযোজনাতে দূরদর্শনের পর্দায় দেখা দিতে পারেন, “গামা”!
গোবর গুহ ও ভীম ভবানী – মূর্তিমান ‘ষষ্ঠীচরণ’
উনবিংশ শতাব্দীতে “বাঙালীর বাহুবল” প্রবন্ধে স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র আশা রাখছেন,
অর্থাৎ তিনি আশা রেখেছিলেন, সম্ভাবনা আছে।
গোবর গুহ |
সুখের কথা, তাঁর আশা পূর্ণ হয়েছিল। তখনকার অনেক ধনী পরিবার শুধু মাত্র বিলাস ব্যসনে মাথা না ডুবিয়ে রীতিমত শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্যচর্চাতেও মনোনিবেশ করতেন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। এই সময়ে অর্থাৎ উনবিংশ শতাব্দীর শেষে আর বিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশের সর্বত্রই কুস্তির রীতিমতো চর্চা ছিল। তা না থাকলে কি আর গামার কপালে ঐ ইউরোপ যাত্রা হত?
বাংলাতে কুস্তিগির রূপে সর্বাধিক খ্যাতি ছিল গোবর গুহর। আসল নাম যতীন্দ্রচরণ গুহ। তাঁর জন্ম কিন্তু গামার মত গরীব পরিবারে নয়, রীতিমতো ধনী পরিবারে।
এই সময়কার রাজা বা জমিদাররা নিজেদের ধনসম্পত্তি রক্ষা করার জন্য যে বাহিনী রাখতেন তাদের সবাইকেই দেহচর্চাতে পারদর্শী হতে হত। এই সময় তাঁদের নিজেদের পালিত কুস্তিগিরদের সংগে অন্য রাজা জমিদারের কুস্তিগিরের লড়াইয়ের ও এক ঐতিহ্য ছিল। তা ছাড়াও ছিল স্বাদেশিকতার বাতাবরণ। ব্রিটিশদের কাছে শারীরিক শক্তির অভাবের জন্য সমালোচিত বাঙালীদের মধ্যে হীনমন্যতা কাটানোরও এক পথ ছিল শরীর চর্চা। এই সময় বিশ্বের অন্যান্য দেশ, চীন, জাপান, জার্মানিতেও শরীরচর্চা জনপ্রিয় হচ্ছিল। চীনেও মাও সে তুং চৈনিকদের শারীরিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য উৎসাহিত করছিলেন।
গোবর গুহর পরিবারেও খ্যাতিমান কুস্তিগির ছিলেন। তাঁর দুই কাকা, অম্বিকাচরণ ও ক্ষেত্রচরণ ছিলেন স্বনামধন্য যাঁদের ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ। মাত্র তের বছর বয়সেই কুস্তিতে হাতে খড়ি হয়ে গিয়েছিল গোবরের। তবে গোবর আবার একসঙ্গে স্বর-সাধনাও করছিলেন। লেখক হেমেন্দ্রকুমারের আলাপচারিতাতে এর কিছু উল্লেখ আছে। মান্না দে তাঁর আত্মজীবনী ‘জীবনের জলসাঘরে” তেও প্রথম জীবনে গোবর গুহর কাছে কুস্তি শেখার কথা উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ সেই সময় একসঙ্গে শরীর-সাধনা ও স্বর-সাধনার আমরা তিনটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পাই – রবিঠাকুর, গোবর গুহ ও মান্না দে।
১৯১০ সাল। সেই যে বছর গামা বিশ্ববিজয় করেন। সেবারই গোবরও প্রথম বার তাঁর পেশাদার পেশীর জোর দেখান। আসলে এই সময়কার ঘটনাবলীর সঠিক তথ্য পাওয়া একটু মুশকিল। একজনের কথানুযায়ী গামা যখন বিলেত যান তখন গোবরও তাঁর সঙ্গে ছিলেন।
১৮৯২ সালের ১৩ই মার্চ, দোল পূর্ণিমার দিন তাঁর জন্ম। যশোরের বিরাটির বিখ্যাত গুহ পরিবারে, যাঁরা চার প্রজন্ম ধরে চর্চা করছেন মল্লযুদ্ধের।
তবে জীবনের শুরুতে কিন্তু বেশ নাদুস নুদুসই ছিলেন তিনি। তাঁর পিতামহ সেই বাড়ন্ত অথচ থলথলে শরীর দেখে রেগে গিয়ে নাম দিয়েছিলেন ‘গোবর ডেলা’!! তাঁর শাসনে তিনি পরবর্তী জীবনে শরীর চর্চায় উদ্যোগী হন। আর এরপরে শালপ্রাংশু “ষষ্ঠীচরণ” হতে তাঁর আর বেশী দেরী লাগেনি। মাথায় ছ ফুট বিশাল দেহী পালোয়ান। “উনিশটি মন” হয়তো নয়, তবে তাঁর ওজন ছিল প্রায় তিন মনের বেশী।
গোবর গুহ সম্পর্কে কিন্তু বাঙালীরা একেবারেই সচেতন নন। শ্রদ্ধেয় ধারাভাষ্যকার ও ক্রীড়া সাংবাদিক অজয় বসু তাঁর সান্নিধ্যে এসেছিলেন। তাঁর কথাতেই অনেক কিছু জানা যায়। তিনি জানিয়েছেন গোবরের গুণগ্রাহীদের মধ্যে ছিলেন, বিজ্ঞানী সত্যেন বসু, সাহিত্যিক হেমেন্দ্রকুমার রায়, সুধীন দত্ত, চিত্র পরিচালক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী – এঁরা সকলেই ছিলেন তাঁর পরিচিত ও গুণগ্রাহী।
তখন সারা পৃথিবীতেই পালোয়ানরা শরীরচর্চা করলেও মস্তিষ্কের চর্চা কমই করতেন। এদিক থেকে গোবর ছিলেন বিরাট ব্যতিক্রম। আসলে যে সময় তিনি বড় হচ্ছিলেন, তা বাংলার সত্যকারের স্বর্ণ যুগ। সাহিত্যে, শিল্পে, বিজ্ঞানে, খেলাধুলোতে – সবদিক থেকেই তা এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। সেই সময়কার সব শিক্ষিত বাঙালীর মত তাঁর মনের গভীরেও রয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ, যিনি সমান গুরুত্ব দিয়েছেন মল্লযুদ্ধকে। ডেকে এনেছেন জাপানী কুস্তিগির কে জুজুৎসু শিক্ষার জন্য, মেয়েদের মল্ল-যুদ্ধে অনুপ্রাণিত করতে লিখে ফেলেছেন গান, “সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান”! গোবর ইউরোপে গিয়ে বিভিন্ন জায়গাতে মল্লযুদ্ধের সঙ্গে বিভিন্ন আলোচনাতেও অংশ নেন। বিষয় ছিল – ভাবলে অবাক হতে হয়, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজী, বার্নাড শ। বিভিন্ন জায়গাতে তিনি ভারতের স্বাদেশিকতাকেও তুলে ধরেন, লন্ডনে একটি ব্রিটিশ বক্তৃতা তাঁকে ব্যথিত করে। The Standard Examiner এ তার একটি প্রতিবাদী চিঠি পাঠিয়ে ভারতের স্বাধীনতার স্বপক্ষে আওয়াজ তোলেন।
এড স্যানটেল |
গোবর গুহর প্রসঙ্গে অনেক কথাই বলা যেতে পারে – বস্তুত: তাঁর মত উজ্জ্বল চরিত্র একটি পূর্ণাঙ্গ পুস্তকের দাবিদার। কিন্তু ছোট করে তাঁর সম্পর্কে বলতে গেলে উল্লেখ করতে হবে দুটি – তিনটি লড়াই এর কথা।
১৯২১ সালের ৩০শে আগস্ট সানফ্রানসিসকোতে তাঁর সঙ্গে মল্লযুদ্ধ হয় মার্কিন কুস্তি চ্যাম্পিয়ন এড স্যানটেলের (১৮৮৭ – ১৯৬৬)। তাঁর আসল নাম কিন্তু এডলফ আর্ন্সট (Adolf Ernst), জন্মসূত্রে জার্মান। এটি একটি বিখ্যাত যুদ্ধ। আয়োজক ছিলে কাউফম্যান নামে এক জার্মান।
দু ঘন্টার বেশী যুদ্ধ হয়। দুই রাউন্ডের এই যুদ্ধে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর স্যানটেল হার মানেন এই বাঙালীর কাছে। তখন স্যানটেল ছিলেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, তাঁকে হারিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের খেতাব পেলেন গোবর। ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম। এবং তিনি শেষ। তাঁর এই কীর্তি এখনো অক্ষত।
এই জয়ে গুরুদোয়ারা থেকে সমর্থন করতে আসা পাঞ্জাবী দেশোয়ালি ভাইয়ারা আনন্দে উত্তাল হন। জনশ্রুতি – এরপর নাকি তাঁকে বারংবার তাঁদের কাছে শুনতে হয়েছিল, ‘আপ বঙ্গালী – কভি নেহি’!
তাঁরা তো জানেন না, পারিবারিক ঐতিহ্যের কথা। এও হয়তো জানতেন না, স্যানটেলের সঙ্গে লড়াই করার যোগ্যতা অর্জন করতে তাঁকে এর আগে হারাতে হয়েছে বেশ কিছু নামকরা মল্লবীরকে। চষে বেড়িয়েছেন ইউরোপ, হারিয়েছেন স্কটল্যান্ডের ক্যাম্পবেল, খোদ মার্কিন মুলুকের জ্যাক জনসনকে।
পাঠকের মনে স্বাভাবিক ভাবেই একটি প্রশ্ন আসতে পারে। গামার সঙ্গে গোবরের কি লড়াই হয়েছে? দুর্ভাগ্যবশতঃ না। তবে ১৯২০ সালে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু তার দিন আটেক আগে গোবর ডিপথেরিয়াতে আক্রান্ত হলে তা বানচাল হয়ে যায়।
তবে ছোট গামার সঙ্গে গোবরের লড়াই হয়। সেই লড়াই তাঁর জীবনে এক মর্মান্তিক কাহিনী। দিনটি ছিল ১৯২৯ সালে ২০শে জানুয়ারি। ঘটনাস্থল পার্ক সার্কাস ময়দান। কংগ্রেসের অনুষ্ঠানের সঙ্গে ছিল বিভিন্ন ক্রীড়া প্রদর্শনী – অসি যুদ্ধ, বক্সিং, লাঠিখেলা, কুস্তি। সবচেয়ে বেশী উৎসাহ ছিল ছোট গামা ও গোবর গুহর কুস্তির লড়াই নিয়ে। এই ছোট গামা হলেন গামার শিষ্য কালু পালোয়ান। বিভিন্ন দামের, ১টাকা থেকে ২৫টাকার টিকিট ছিল, তখনকার দিনের তুলনাতে যথেষ্ট দামের। কিন্তু তাতেও দর্শকদের উদ্দীপনাতে ভাটা পড়েনি।
গোবর গুহর মূর্তি |
বিকেল চারটের সময় লড়াই শুরু হতেই হাত মেলাতেই ছোট গামা অন্যায় ভাবে ধাক্কা মেরে দড়ির ওপর ফেলে দেন। দুই বিচারক তাঁদের আবার আলাদা করে দিয়ে আবার লড়াই শুরু করতে বললেও ছোট গামা গোবরকে দড়ির ওপর ফেলে দিয়ে তাঁকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থাকেন। এরপরে বিচারকেরা তাঁদের আলাদা করে দিয়ে ছোট গামাকে সতর্ক করে বলেন এটা ঠিক হয়নি। ততক্ষণে গোবর উঠে দাঁড়িয়েছেন, গামা বিচারকদের কথা না শুনেই লাফিয়ে উঠে জয়োচ্ছ্বাস করতে থাকেন। বিরক্ত গোবর রিং ছেড়ে চলে যান। বিচারকদের ডাকেও আর কর্ণপাত করেননি। পরের দিন ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকাতেও লেখা হয় গামা অন্যায় ভাবে জিতেছেন। কিন্তু কিছু মানুষ ও পত্রিকার হাতে তাঁকে হেনস্থা হতে হয়। সাংবাদিক অজয় বসুর ‘ফিরে ফিরে চাই’ বইটিতে এর এক মর্মস্পর্শী বিবরণ আছে। জানা যায়, এতই ক্ষুব্ধ ছিলেন তিনি, নিজে কুস্তি তো ছেড়েই দিলেন, এই অপমান তাঁর সারা জীবনের সঙ্গী হয়ে রইল। এমনকি পঞ্চাশের দশকে কংগ্রেস তাঁকে সম্বর্ধনা দিতে চাইলে তাকে অস্বীকার করেন।
ভীম ভবানী |
অবশ্য এই কলকাতা শহরে তাঁর একটু ঠাঁই হয়েছে। গোয়াবাগানে যেখানে তাঁর আখড়া সে রাস্তার নাম হয়েছে গোবর গুহ সরণী। আর আজাদ হিন্দ বাগে তাঁর একটি মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তবে একাই গোবরবাবু নন, কলকাতার আরো একজন কুস্তিগির নাম করেছিলেন। তিনি গোবরবাবুর চেয়ে বছর দুয়েকের বড়, নাম ভবেন্দ্রমোহন সাহা, যাঁর ডাক নাম ছিল ভবানী। “ভীমভবানী” প্রবাদটি তাঁর নাম থেকেই। রেখেছিলেন রসরাজ অমৃতলাল বসু। সম্ভাবনাময় এই কুস্তিগির রামমূর্তি নাইডুর সার্কাসে যোগ দেন, পরে নিজের সার্কাস ও ফেঁদে ফেলেন। খুব নামও করেছিলেন, - নিজের বুকের ওপর দুটি হাতি কে চড়াতে পারতেন, দাঁত দিয়ে তিন – তিনটি চলন্ত জীপ গাড়ীকে দাঁত দিয়ে টানতে পারতেন। তাঁর যখন ৩১ বছর বয়েস, সেই সময়, বাঙালী বীর ভীম ভবানী, নাম দিয়ে শ্রীবিজয় রত্ন মজুমদার, মানসী ও মর্মবাণী, ভাদ্র – ১৩২৯ সংখ্যাতে এক বিস্তারিত প্রবন্ধ লেখেন। তাতে তিনি ভীমভবানীর নানান কার্যকলাপের বিবরণ দেন। এর থেকে বোঝা যায়, সেকালেও তিনি বেশ কিছু প্রচার পেয়ে থাকবেন। এমনকি সেখানে এও লেখা ছিল যে তিনি গোবরবাবুর মত আমেরিকা যাওয়ার চেষ্টাতে আছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মাত্র ৩২ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।
হামিদা বানু – ‘সংকটের কল্পনাতে’ আদৌ ‘ম্রিয়মাণ’ নন
হামিদা বানু |
হামিদা বানুর খবর |
পঞ্চাশের দশকে ভারতীয় ক্রীড়াক্ষেত্রে এমন এক মহিলার আবির্ভাব হয় যাঁকে নিয়ে আজও আমাদের গর্বের শেষ থাকবে না। তিনি হামিদা বানু। উত্তর প্রদেশের আলিগড় শহরের নিবাসী হামিদা বলেছিলেন যে, যদি কোন পুরুষ কুস্তিগির তাঁকে হারাতে পাবেন তবে তিনি তাঁর অর্ধাঙ্গিনী হবেন! কি সাংঘাতিক চ্যালেঞ্জ! তাও আবার এমন খেলাতে যা নাকি পুরুষেরই দখল! এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে সম্মত হন বাবা পালওয়ান। ১৯৫৪ সালের মে মাসে এক লড়াইতে বাবাকে দু মিনিটের মধ্যেই কাত করেন। একই অবস্থা হয় আরো দুই প্রতিযোগীর, একজনের নাম কেদার সিং আর একজনের নাম জানা যায়না, কলকাতার এক হিন্দু কুস্তিগির নামেই নথিভুক্ত।
কিন্তু মহিলাদের পক্ষে এতটা “বেড়ে ওঠা” কি সমস্যা নয়? খুব হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল। পুনাতে এক মহারাষ্ট্রীয় কুস্তিগির হামিদা আর রামচন্দ্র সালুঙ্কের মধ্যে লড়াই অনুষ্ঠিতই হতে পারলো না, ‘অভিভাবক’দের হস্তক্ষেপে। কদিন পরে আবার কোলাপুরেও বানুকে এক পুরুষ প্রতিদ্বন্দীকে পরাজিত করেও অপমানের সম্মুখীন হতে হল। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মোরারজী দেশাইও জড়িয়ে পড়েছিলেন। বানু আর পুরুষ প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে না লড়তে পারলেও বিদেশী মহিলা কুস্তিগিরদের সাথে লড়াই বহাল থাকলো। ভেরা চিস্টিলিন নামে এক রাশিয়ান প্রতিদ্বন্দীকে তিনি এক মিনিটের মধ্যেই কুপোকাত করেছিলেন। সিঙ্গাপুরে তিনি আহূত হন তাঁদের মহিলা চ্যাম্পিয়ন রাজা লায়লার সঙ্গে কুস্তি লড়ার জন্য। ব্যস, এরপর তিনি যেন প্রায় কুস্তির জগৎ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমরা জানতেও পারি না, শেষপর্যন্ত তিনি তাঁর যোগ্য পাণিপ্রার্থী পেয়েছিলেন কিনা।
কে ডি যাদব – মূর্ত অবহেলা
১৯৯৬ সালে লিয়ান্ডার পেজ টেনিসে ব্রোঞ্জ পাওয়ার পর যেন নবজন্ম হল তাঁর। সেই সময়ই অনেক মানুষ জানতে পারলেন খাশাবা দাদাসাহেব যাদবের কথা। কারণ ব্যক্তিগত পদক লিয়ান্ডারের আগে পেয়েছিলেন তিনিই, দীর্ঘ ৪৪ বছর আগে। ১৯৫২র হেলসিঙ্কি অলিম্পিকে, ব্যান্টমওয়েট বিভাগে।
কে ডি যাদব |
সত্যিই বিস্মৃতির আড়ালে চলে গিয়েছিলেন তিনি। মহারাষ্ট্রের এই কুস্তিগিরের বাবা দাদাসাহেব ছিলেন নিজেও একজন কুস্তিগির এবং তাঁর প্রথম গুরু। ১৯৪৮ সালে লন্ডন অলিম্পিকে ফ্লাই ওয়েট বিভাগে তিনি কুস্তিতে ষষ্ঠ স্থানের অধিকারী হন। তখন সেটা ছিল খুবই প্রশংসনীয় ব্যাপার। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া দেশের আর্থিক অবস্থা সেরকম ভালো ছিলনা, সৌভাগ্যবশতঃ তাঁর সহায় হয়েছিলেন কোলাপুরের মহারাজ।
পরের চারবছর নিজেকে তৈরী করেছিলেন যাদব। ফ্লাই ওয়েট বিভাগ থেকে এলেন ব্যন্টম ওয়েট বিভাগে। কিন্তু হেলসিঙ্কি অলিম্পিকে যাওয়ার জন্য অর্থ সংস্থান হচ্ছিল না। তৎকালীন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী মোরারজী দেশাই ও কিছু করে উঠতে পারলেন না, ৪০০০ টাকার সংস্থান কি এতই দুরূহ ছিল? যাদবের বন্ধুরা ও পরিবারবর্গ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর নিরাশ হচ্ছেন। আশ্চর্যভাবে এই সময় ভাগ্য সুপ্রসন্ন হল। অপ্রত্যাশিত ভাবে তাঁর রাজারাম কলেজের অধ্যক্ষ, ব্যারিস্টার বালাসাহেব খারদেকার, নিজের বাড়ি বন্ধক রেখে ৭০০০ টাকা যোগাড় করে যাদবের খরচার সংস্থান করলেন।
বালাসাহেব নিঃসন্দেহে গর্ব অনুভব করে থাকবেন যে তাঁর প্রিয় ছাত্র তাঁকে নিরাশ করেননি। এমনকি এও ভাবা হয়, যাদব যদি আরো ভালো সুযোগ পেতেন বা আধুনিক প্রশিক্ষণ পেতেন, তাঁর পক্ষে স্বর্ণপদক জিতে আনাও অসম্ভব ছিল না।
জাতীয় সংবাদপত্র কিন্তু এই কৃতিত্বকে সেভাবে সম্মান জানায়নি, হকির স্বর্ণপদকের জন্য যত জায়গা ব্যয়িত হয়েছিল, তার একটি সামান্য অংশ, একটি ছোট্ট স্তম্ভ, খবরটি প্রচার করেছিল।
তবে তাঁর গ্রামবাসীরা, করাদের গোলেশ্বর গ্রামের লোকজন বিপুল ভাবে সম্বর্ধনা জানিয়েছিলেন। বিরাট বড় বিজয় সম্মেলন করে তাঁকে করাদ স্টেশনে থেকে সসম্মানে গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
এর পরের ইতিহাস কিন্তু খুব করুণ। আজকাল “পদ্মশ্রী”র ছড়াছড়ি, এই ব্যতিক্রমী মানুষটির ভাগ্যে কিন্তু তাও জোটেনি। ১৯৫৫ সালে তিনি রাজ্য পুলিশে যোগ দেন, সাব ইন্সপেক্টর পদে। সেখানে বিভিন্ন জাতীয় ক্রীড়াতেও তিনি অনেক পুরস্কার আনেন। কিন্তু আর পদোন্নতি হয়নি, ১৯৮২ সালে অবসরের ছয়মাস আগে তাঁকে এসিস্ট্যান্ট কমিশনার করে দেওয়া হয়। এর ঠিক বছর দুয়েক পরে এক পথ দুর্ঘটনাতে প্রাণ হারান তিনি, সম্ভবত তাঁর হতাশার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই। ২০০১ সালে তাঁকে আবার একটি ‘মরণোত্তর’ অর্জুন পুরস্কার দিয়ে কর্তব্য শেষ করেন সরকার বাহাদুর।
তাঁর ওপর গবেষণা করতে গিয়ে দারুণ চমক খান সাংবাদিক ফয়জল শরিফ। ভেবেছিলেন অলিম্পিক পদকধারীর খবর পেতে বেশী কাঠ খড় পোড়াতে হবে না! কিন্তু দেখলেন তাঁর কর্মক্ষেত্র, মহারাষ্ট্র পুলিশের অনেকেই এই বীর সম্পর্কে অবহিত নন।
শেষ খবর পাওয়া অবধি তাঁর ১৯৫২ সালে প্রাপ্ত ব্রোঞ্জ পদকটি নিলামে চড়ানোর হুমকি দিয়েছেন তাঁর পরিবার।
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! কুস্তির ওপর কৃত ভারতীয় কাহিনীচিত্রটি যখন সারা পৃথিবীতে তোলপাড় তুলেছে, তখন কুস্তির এক প্রবাদ পুরুষের প্রতি চরম অবহেলা প্রদর্শিত হচ্ছে!!
দারা সিং
দারা সিং |
যাদবের তুলনাতে অনেক বেশী পরিচিত ছিলেন তিনি। পেশাদার কুস্তিতে তিনি ভারতের প্রায় বীরের মর্যাদা পান তিনি। পেশাদার কুস্তিতে দীদার সিং রনধাওয়া (১৯২৮ – ২০১২) যে একজন প্রায় মহানায়ক, ‘দারা সিং’ – শব্দবন্ধটির বহুল প্রয়োগ শুনলেই তা বোঝা যায়। ছোট্ট দারা তাঁর গ্রাম থেকে সিঙ্গাপুর যান ভাগ্যান্বেষণে। সেখানেই তাঁর নাম হতে থাকে – পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি যখন তিনি ভারতে ফেরেন, তিনি পেশাদার কুস্তিতে এক উজ্জ্বল নাম। তাঁর কুস্তির লড়াইয়ের জনপ্রিয়তা অনেক সময় ক্রিকেটের জনপ্রিয়তাকেও ছাড়িয়ে যেত। ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়, সেই পাঁচের দশকেই, কিংকং এর বিরুদ্ধে বোম্বের বল্লভভাই স্টেডিয়ামে তাঁর লড়াই দেখতে প্রায় পঞ্চাশ হাজারের ওপর জনসমাগম হয়। শুধু বোম্বে নয়, শঙ্করলাল ভট্টাচার্যর স্মৃতিচারণে জানা যাচ্ছে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে কলকাতার রণজি স্টেডিয়ামে পেশাদার কুস্তির দঙ্গল বসত। সেই আসরে দারা সিং ছিলেন খুব জনপ্রিয়।
২৯শে মে, ১৯৬৮। তৎকালীন মার্কিন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন লৌ থেজ কে হারিয়ে ‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন’ খেতাব জয় করেন। বোম্বেতে এই লড়াই দেখতে জড় হয়েছিলেন অনধিক ৬০,০০০ এর মত দর্শক। হেরে গেলেও লৌ থেজ কিন্তু প্রভূত প্রশংসা করেছেন দারা সিং এর। ভারতীয় কুস্তির ইতিহাসে সর্বাধিক জনপ্রিয় নাম যে দারা সিং তা নিঃসন্দেহ। ২০১২ তে তাঁর মৃত্যুর পর সাংবাদিক ভীর সাংভি তাঁকে ভারতের প্রথম সুপারহিরো বলে উল্লেখ করেন। তাঁর বলিউড পরিচিতিও খুবই জনপ্রিয়।
এশিয়াড ও কমনওয়েলথ
পঞ্চাশের দশকে, ১৯৫৪র ম্যানিলার দ্বিতীয় এশিয়াডেই কুস্তি অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু ১৯৫২ সালে অলিম্পিকে ব্রোঞ্জপদক প্রাপ্ত কে ডি যাদব তাতে ভাগ নেন নি। তবে ভারত দুটি পদক পায়, একটি রূপো ও একটি ব্রোঞ্জ। কিন্তু ১৯৫৮র এশিয়াড থেকে ফিরতে হয় একেবারে শূন্য হাতে। তুলনাতে তিনটি রূপো ও ২টি ব্রোঞ্জ, পাঁচটি পদক পায় পাকিস্তান!! সম্ভবত গামা পাকিস্তানে গিয়ে তাঁর শিক্ষাতে পাকিস্তানী কুস্তির উন্নতি ঘটান।
তবে বড়সড় সাফল্য এল ১৯৬২র জাকার্তা গেমসে। মারুতি মানে নামে এক মারাঠি লিট হেভি ওয়েট (৯৭কেজি) তে ফ্রি স্টাইলে সোনা আর গ্রেকো রোমানে রূপো। আর মালওয়া সিং লাইট ওয়েট (৫২ কেজি), গ্রেকো রোমান। কিন্তু অধরা থেকে যাচ্ছিল অলিম্পিক পদক।
অলিম্পিক পদক
যোগেশ্বর |
সুশীল কুমার |
শেষমেশ সুশীলকুমারের হাত ধরে এল সেই যাদবের মত অলিম্পিক ব্রোঞ্জ পদক, ২০০৮ সালে, বেইজিং অলিম্পিকে। পরের ২০১২র লন্ডন অলিম্পিকে তিনি উন্নত করলেন রেকর্ডকে, এবারে রূপো। ২০১২ তে যোগেশ্বর দত্তও ব্রোঞ্জ পেলেন। দু-দুটি পদক, কুস্তিতে।
সাক্ষী মালিক |
সাম্প্রতিক কালে উল্লেখযোগ্য হল মহিলা কুস্তিগিরদের অনবদ্য প্রদর্শন। চলচ্চিত্রের সুবাদে গীতা ফোগটের নাম সর্বজনবিদিত। ২০১০ এ দিল্লি কমনওয়েলথ গেমসে সোনা আনেন তিনি। অলিম্পিকে মহিলাদের পদক প্রাপ্তি শুরু করেন সাক্ষী মালিক। এছাড়াও গীতার বোন ববিতা, কাজিন ভিনেশ, গীতিকা জাখর, ললিতা শেরাওয়াত এঁরাও উন্নতি করতে শুরু করেছেন। বড় সম্মান সময়ের অপেক্ষা।
উত্তরকালের ভাবনাকোন একটি সাফল্য পাওয়া ও ধরে রাখার মধ্যে তফাৎ অনেক। ২০১২ তে পুরুষদের দুটি পদকের পর ২০১৬ অলিম্পিক থেকে ফিরে আসতে হল শূন্যহাতে। যোগেশ্বর পারেননি, সুশীলকুমার – তিনি তো যেতেই পারলেন না। ২০১৪র কমনওয়েলথ এ স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ২০১৫ তে তিনি সেভাবে কোন প্রতিযোগিতাতে অংশগ্রহণ না করাতে তাঁর জায়গাতে যাওয়ার জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন নরসিং যাদব। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে ডোপিং এর অভিযোগে বিতর্ক শুরু হয়। শেষ অবধি তাঁর যাওয়া হয়। কিন্তু শেষমেশ তাঁর আর ভাগ নেওয়া হয় না, কারণ ডোপিং বিতর্ক। এদিকে সুশীলকুমারেরও যাওয়া হয়নি। হয়তো এইভাবে একটি পদক ভারতের হাতছাড়া হল। এর পেছনে কর্মকর্তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
আজকের যুগে আমরা ডিজিটাল ইন্ডিয়ার কথা বলেই থাকি। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নতি করার জন্য খুবই জরুরী। কিন্তু ভারতীয় কুস্তির ফেডারেশনের ওয়েবসাইটটি (http://wrestlingfederationofindia.com/index.html) দেখলে আমাদের হতাশ ও বিমর্ষ হতে হয়। ওপরে ভারতীয় কুস্তির যে সোনালী অতীতের কথা লিখেছি, তার বিন্দুমাত্রও উল্লেখ নেই। স্বাধীন ভারতের প্রথম ব্যক্তিগত পদকের দাবিদার খাশাবা দাদাসাহেব যাদবের একটি ছবি অবধি নেই। উল্লেখ নেই হামিদাবানুর, যিনি আজকের মহিলা মল্লবীরদের কাছে অনুপ্রেরণা হতে পারতেন।
ভারতীয় কুস্তির হাত ধরে যে পদক প্রাপ্তির সম্ভাবনা খুব উজ্জ্বল, তা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত। কিন্তু তাকে বাস্তবায়িত করতে গেলে প্রয়োজন পরিকল্পিত পদ্ধতির। প্রয়োজন কুস্তিগিরদের সম্মাননার। এগিয়ে আনতে হবে গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে।
আমরা মর্মাহত হই যখন দেখি কে ডি যাদবের পরিবার স্বাধীন ভারতের প্রথম ব্যক্তিগত প্রাপ্ত অলিম্পিক পদকটিকে নিলামে বেচে দিতে চাইছেন। আশা করব ভারতীয় কুস্তি দপ্তরের এবারে টনক নড়বে। সরকারও হস্তক্ষেপ করবেন। যাদবের হতাশা দূর করা হয়তো সম্ভব হবেনা, কিন্তু ভারতীয় কুস্তির ইতিহাসে তাঁর বলিদানের ভূমিকা উত্তরকাল তো জানতে পারবে। তাই বা কম কি?
তথ্যসূত্র
লেখক পরিচিত - জন্ম কলকাতায়, বেড়ে ওঠা দক্ষিণ চব্বিশ-পরগনার রাজপুর-সোনারপুর অঞ্চলে। ১৯৮৩ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেক্ট্রনিক্স ও টেলিকম্যুনিকেশন ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে কর্মসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে। শখের মধ্যে অল্প-বিস্তর বাংলাতে লেখা - অল্প কিছু লেখা রবিবাসরীয় আনন্দবাজার, উনিশ-কুড়ি, নির্ণয়, দেশ, ইত্যাদি পত্রিকায় এবং বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিন (সৃষ্টি, অবসর, ইত্যাদিতে) প্রকাশিত। ।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.