অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


খেলা‘ঘর’ বাঁধতে লেগেছি

অবসর বিশেষ সংখ্যা সেপ্টেম্বর ১, ২০১৭

 

স্বপ্নের ফেরিওয়ালা

ঈশানী রায়চৌধুরী

আমার ছোটবেলার একটা বড় সময় জুড়ে ছিল আমার ঠাম্মা আর দিদু। সারা সপ্তাহ ঠাম্মার হেফাজতে থাকলেও শনি-রবিবার দিদুর কাছে ঘাঁটি গেড়ে বসাটা মোটামুটি নিয়মিত অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। দু-জনের বাচ্চা রাখার ধরন ছিল দুই মেরুর। ঠাম্মা দুপুরবেলায় কোলের কাছটিতে শুইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে গল্প শোনাত যত ভূত-পেত্নী-দত্যি-দানোর আর দিদু মানেই রবি ঠাকুরের কবিতা মুখস্থ, পুরোনো হারমোনিয়ামের বেলো টিপে প্যাঁ-পোঁ করার চেষ্টা কিংবা ট্রানজিস্টারে কান লেপটে ক্রিকেটের ধারাবিবরণী শোনা। আমার জগৎটা তাই কেমন দু-ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল । রূপকথার আর অ-রূপকথার।

তখন তো মাত্র দুটো খেলারই নাম জানতাম। ক্রিকেট আর ফুটবল। ক্রিকেট নিয়ে দু-বাড়িতে কোনো সমস্যা নেই। সবাই দেশপ্রেমে টইটম্বুর। সবাই "ভারত মাতা কী জয়" বলে লাফালাফি করা পার্টি। কিন্তু ফুটবল নিয়ে সমস্যা খুব। মামারবাড়িতে সবাই লাল -হলুদ আর এ বাড়িতে মেরুন-সবুজ। আমার কচিবয়সের চোখে লাল -হলুদটাই দিব্যি জমকালো লেগেছিল। ব্যস, সেই থেকে বিয়ের আগে পর্যন্ত বাবা আর আমি আকচাআকচি করে গেলাম আর বিয়ের পরে তো পুরো শ্বশুরবাড়ি আমার বিরুদ্ধপক্ষ।

তখন তো আর টেলিভিশনের যুগ নয়। তাই আমার যা কিছু প্রথম দিকের খেলার স্মৃতি , সবটুকুই ওই রেডিও আর ট্রানজিস্টার -নির্ভর।

আমাদের বাড়িতে একটা ফিলিপসের রেডিও ছিল। ভুষো জালির এরিয়াল দেওয়া । সেটাতে সুইচ মেরে নব ঘোরালে স্টেশন ধরার লাল কাঁটাটা থিরথির করে কাঁপতে কাঁপতে এ-মাথা থেকে ও-মাথা যেত, আর ভেতরে একটা হলদে আলো জ্বলত । কলকাতা ক, খ আর বিবিধ ভারতীর আমল সেটা । দু-স্টেশনের মাঝে আবার ঘ্যাসঘ্যাস আওয়াজ । মান্ধাতার বাবার আমলও বলা যেতে পারে । অত বড় ঢ্যাপসা জিনিস থাকত বৈঠকখানা ঘরে । বহু নির্জন দুপুরে আমি একটু বেশি ছোটবেলায় রেডিওর পেছনে লুকোনো মানুষ খুঁজে, তার থেকে একটু বড় বেলায় ঘ্যাসঘ্যাসে আওয়াজে রেডিওর গায়ে কান লেপটে ভূতের গলা খুঁজে আর তারও পরে ক্রিকেট কমেন্টারি শুনে ( কমল-অজয়-পুষ্পেন) কাটিয়েছি ।

অজয় বসু, কমল ভট্টাচার্য, পুষ্পেন সরকার ও অজ্ঞাত

আমাদের বাড়িতে একটা মারফি ট্রানজিস্টার এসেছিল বটে, কিন্তু সেটার দখলদারি ছিল মোটামুটি দাদুর । দাদু দুপুরে ঘুমোত, ফুরফুর করে নাক ডাকত, ট্রানজিস্টার চলত অবিরাম..কিন্তু বন্ধ করলে কিংবা স্টেশন পাল্টালে ধুন্ধুমার কাণ্ড শুরু হয়ে যেত । ওটা ছিল গান থেকে কৃষিকথার আসর ...সব কিছুর জন্য, শুধু খেলা বাদ !

ট্রানজিস্টার শুনতে গেলে দিদুর কাছে যেতে হত । দিদুর গায়ের সঙ্গে এঁটুলির মতো লেগে থেকে ক্রিকেটের ধারাভাষ্য শোনা । দিদুর সে ছিল সর্বনেশে নেশা ! তখন এমন ঘরে ঘরে ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ, কুকিং রেঞ্জের জমানা নয় । দিদু উবু হয়ে বসে তরকারি কাটছে নিপুণ হাতে, ধুচ্ছে , রান্না চাপাচ্ছে, তারপর গামছায় ভিজে হাতটি মুছে রান্নাঘরের পিঁড়ির পাশে ঘাপটি মেরে বসে থাকা ট্রানজিস্টারের নব ঘোরাচ্ছে । দাদুভাইয়ের কোমল চোখজোড়া আনন্দবাজারের সম্পাদকীয়তে আর রাগী চোখের চাউনি দিদুর দিকে । মেয়েমানুষের এমন ছেলেলি খেলায় মন ? সংসারের আর লাটে উঠতে বাকি রইল কী ? দু-জনের কথার চাপানউতোরের মাঝে আমার এঁচোড়ে-পাকা গুল্লি গুল্লি চোখজোড়া শাটল ককের মতো এদিক ওদিক করছে ।
-- কী একেবারে ক্রিকেট বোঝো তুমি, কনক ? আউট হলে তো এমন হা-হুতাশ করছ, যেন নিজে ব্যাট করতে নামলে বলে বলে ছক্কা মারতে !
--মারতাম তো ! বলে বলে ছক্কাই মারতাম যদি তোমার মতো বোলারের হাতে বল থাকত !

প্রথম আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকী (১৯৭১)

এরপরেই কিন্তু এক অদ্ভুত জাদুমন্ত্রবলে আমার ওই রেডিও আর ট্রানজিস্টারে খেলা শোনার বেরং দুনিয়ায় রঙের হৈ-হুল্লোড় লাগল । না না, রঙিন টিভি তো কোন ছার, সাদা কালো টিভিও তখন আসেনি আমাদের বাড়িতে । এল আনন্দমেলা । আনন্দবাজার গ্ৰুপের ছোটদের পত্রিকা । একেবারে অন্যরকম তার রূপ-রস-গন্ধ । এবং সেই সুবাদে আনন্দমেলা পুজোবার্ষিকী । সত্তরের দশকের শুরুতে (১৯৭১ – প্রথম পূজাবার্ষিকী) যারা ওই পত্রিকা হাতে নিয়ে পাতা উল্টোনোর রোমাঞ্চ অনুভব করেনি, তাদের জন্য আমার দু:খ হয় ।

যদিও আমাদের বাড়িতে বইঘরে কোনোদিনই চৌকিদার ছিল না বলে আমি ওই ছোট বয়সেই যাবতীয় 'বড়দের বই' গোগ্রাসে গিলতাম, নিয়মিত অপেক্ষা থাকত 'দেশ', 'অমৃত' আর 'বেতার জগৎ'-এর জন্য, কিন্তু আনন্দমেলা পড়ার ওই স্বাদই আলাদা । মনে হত, প্রচণ্ড শীতে বেনারসী ল্যাংড়া খাচ্ছি বা চাঁদিফাটা গ্রীষ্মে দার্জিলিং-এর মিঠে কমলালেবু ।

আনন্দমেলায় তো অনেক বাঘা বাঘা লেখকই হাজির হতেন পসরা নিয়ে । কিন্তু পুজোর সময়ে শিউলির গন্ধ আর ঢাকের বাদ্যি বুকে নিয়ে যে মানুষটি অন্তত আমার মনের দরজায় কড়া নাড়তেন, তিনি মতি নন্দী ।

সম্ভবত ১৯৭২ সালের পুজোয় প্রথম তিনি আমাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন দ্য ক্রিকেট ক্লাব অফ হাটখোলার একচ্ছত্র নায়ক ননীদার সঙ্গে । এই উপন্যাসের আগে আমি কোনো ক্রীড়া-উপন্যাস পড়িনি । আমার মনের একটা ভালো লাগার জায়গা এতদিন একেবারে ফাঁকা মাঠ হয়ে পড়েছিল । সেই মাঠে সবুজ মখমলী ঘাস বুনে তাতে রোলার চালিয়ে পিচ তৈরী করে মাঠে নেমেই ছক্কা হাঁকালেন ননীদা । অবাক হয়ে দেখলাম..বলটা কেমন শরতের ঝকঝকে নীল আকাশে মিলিয়ে গেল । যাবার আগে শুধু আমাকে চোখ টিপে বলে গেল, "আসছে বছর আবার হবে ।"

এই ননীদা মানুষটা ভারী অদ্ভুত । মানে আমার চেনাও বটে, আবার চেনা ননও বটে । যদিও মুখে বলেন যে ক্রিকেট লরি-ড্রাইভারদের খেলা নয়, ধোপাদের, এমনকি চাষাদেরও খেলা নয়, ক্রিকেট নির্ভেজাল ভদ্রলোকের খেলা ...কিন্তু খেলার মাঠে হাটখোলাকে জেতানোর জন্য এমন সব 'ট্যাকটিক্স' ব্যবহার করেন, যা খুব নিপাট ভদ্রজনোচিত নয় । এই সব ট্যাকটিকসের নাম আসলে 'ননীটিক্স' । ননীদা এই কৌশল কাজে লাগিয়ে কতবার যে হাটখোলাকে বাঁচিয়েছেন, তা গুনে শেষ করা যায় না । এই ননীটিক্সের একটা ছোট্ট নমুনা দেওয়া যাক । অংশটি বই থেকেই হুবহু তুলে দিই বরং :

"নতুন ব্যাটসম্যান উইকেটে এসে দেখত ননীদা ভুরু কুঁচকে গম্ভীর মুখে গুডলেংথের কাছাকাছি একটা জায়গার দিকে তাকিয়ে । তারপর ব্যাটসম্যানকে শুনিয়ে আমাকেই বলতেন, 'একই রকম আছে হে মতি, ঠিক সেই রকম । কালও দুর্যোধনকে পইপই করে বলেছি, ভালো করে রোলার টানবি, নয়তো কোনদিন যে মানুষ খুন হবে কে জানে !'
এই সময় আমার কাজ হল লক্ষ করা--ব্যাটসম্যান উৎকর্ণ হয়েছে কি না । যদি হয়, তাহলে বলব, 'সত্যিই খেলা যায় না । তপনের কথা ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে ...ভালো কথা, ননীদা কাল হাসপাতালে গেছলেন?'
'না গেলেই ভালো ছিল, চোয়ালটা ভালোমতো সেট হয়নি, মুখটা বেঁকে আছে । সামনের দাঁত দুটোরও কিছুই করার নেই ।'
'তাহলে চিত্তকে আস্তে বল করতে বলুন !' আমি ভীষণভাবে উদ্বেগ দেখাই ।
'এখনও তো বল লাফায়নি । আগে দেখি লাফায় কি না ।'
এরপর ব্যাটসম্যানের টিকে থাকা বা না থাকা নির্ভর করে তার নার্ভের ক্ষমতার উপর । তবে প্রায় ক্ষেত্রেই দু-ওভারের মধ্যেই তারা ফিরে যায় । ননীদা তাঁর এই ট্যাকটিক্সকে বলেন প্রোপ্যাগান্ডা । "

এই সব কাণ্ডকারখানার নামই ননীদা । আমি অবাক হই, হেসে অস্থির হই । ননীদার প্রত্যুৎপন্নমতিত্বকে কুর্নিশ করার কথা ভাবি । আবার এও ভাবি, ক্রিকেট তো 'ভদ্রলোকের' খেলা । এ যেন কেমন ঠকিয়ে দিয়ে জয় হাসিল করা ।

ননীদার মতে দু-রকমের ক্রিকেটার হয় । একদল ব্যাটকে কোদাল ভাবে, অন্যদল সেতার । কিন্তু ননীদা নিজে কতটা দক্ষ সেতারী ? সে বয়সে ঠিকঠাক বুঝিনি, এখন বুঝি...ননীদা ছিলেন সেই বিরল সেতারবাদক, যিনি তাঁর বিশাল কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে অদৃশ্য একজোড়া ডানার নীচে আশ্রয় দিয়েছিলেন তন্ময়ের মতো ক্রিকেটারদের । তাদের একমুখে গালমন্দ করে সেই মুখটি আড়াল করে একেবারে অন্য মুখের এক অন্য মানুষ হয়ে পরলোকগতা স্ত্রীর কানপাশা বিক্রির টাকায় ক্রিকেট ব্যাট কিনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতেন, যাতে তন্ময়দের মতো অভাবী কিন্তু সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়দের দিয়ে ম্যাচ খেলানো যায় । তিনি ঠিক সেই রকম সেতারী , যিনি যুগলবন্দী জমে ওঠার তুঙ্গমুহূর্তটিতে অক্লেশে নিজের যন্ত্রটি হাত থেকে নামিয়ে রেখে জুড়িদার শিষ্যটিকে সমস্ত প্রশংসা ঝুলি ভ'রে কুড়িয়ে নিয়ে যেতে দেন অকুণ্ঠে । আর তাই শেষ দৃশ্যে দেখা যায় দক্ষ শিষ্যটিও বিনা প্রতিবাদে গুরুবাক্য বেদবাক্য জ্ঞান করে ম্যাচ জেতার পরেও বিজয়োল্লাসে সামিল না হয়ে ফেন্সের ধারে কাল্পনিক বলে ফরোয়ার্ড ডিফেন্সিভ খেলে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে আর ননীদা বলেন, "দ্যাখো, পা-টা কোথায় ? বলের লাইনের কত বাইরে ? কাল থেকে দু 'শো বার রোজ শ্যাডো প্র্যাকটিস করবে । দু 'শো বার!"

এর পরের বার আনন্দমেলা আমাকে উপহার দিল স্ট্রাইকার । সে বয়সটা আমার এমন, যে রোজই চোখের পাতায় স্বপ্নরা লেগে থাকে আঠার মতো । স্ট্রাইকার এক ফুটবলারের গল্প । প্রসূন ভট্টাচার্য । সে এক হেরে যাওয়া ফুটবলার অনিল ভট্টাচার্যর সন্তান, যিনি ঘুষ খেয়ে দলকে হারানোর মিথ্যে অভিযোগের কাঁটার মুকুট মাথায় পরে ময়দান ছেড়েছিলেন । ছেঁড়া কার্টিলেজ নিয়েই তাঁকে মাঠে নামতে বাধ্য করেছিল যুগের যাত্রী ।

আই এফ এ শিল্ডে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে ওপেন নেট মিস করেছিলেন অনিল ভট্টাচার্য , মাত্র ছ'গজ দূর থেকে বাইরে মেরে । অভাবের সংসার , কারখানা বন্ধ । প্রসূন কিন্তু পেটে খিদে নিয়েও স্বপ্ন দেখে ঠিক । বড় ক্লাবে খেলার স্বপ্ন । এবং এই উপন্যাস শুরুই হয় একটি অনবদ্য স্বপ্নদৃশ্য দিয়ে । ব্রাজিলের স্যান্টোস ক্লাব পেলের জায়গায় খেলাতে চাইছে প্রসূনকে । এ গল্পে চাঁপাফুলের মতো খুব হালকা ভালোবাসার সুরভি নিয়ে আসে প্রসূনের বান্ধবী, পাড়ারই নুটুবাবুর মেয়ে নীলিমা । যার কাছে ধার করে খিদেয় ছটফট করতে করতে বদুর দোকানের চারটে গরম কচুরি আর মুচমুচে জিলিপি খেয়ে জল খেতে গিয়েই প্রসূনের মনে পড়ে যায় তার নিজের ছোটভাই পিন্টুর মুখ আর পেটের ভেতরটা অমনি কেমন মুচড়ে উঠে জানান দেয়, পিন্টুটারও কিছু খাওয়া হয়নি !

ফুটবলারের জীবন বড় টালমাটালের । দুই ফুটবলার বন্ধু নিমাই আর আনোয়ার শক্ত হাতে হাত ধরে রেখেছিল প্রসূনের । অনিলবাবু স্ত্রীকে বলেছিলেন, ''ফুটবল আমাকে ফোঁপরা করে দিয়েছে, খোকাকেও দেবে । ওকে বারণ করো । "

কিন্তু স্বপ্নের নেশা বড় সর্বনেশে । আর স্বপ্নের সেই ধিকিধিকি তুষের আগুনে অজান্তেই হাওয়া দিয়ে যায় বাবার অপমান আর বাবার কপালের একটা টিপের মতো কাটা দাগের জ্বলজ্বলে অস্তিত্ব । সেই আগুনে পা ফেলে প্রসূন শোভাবাজার টেন্টের সীমানা পেরিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল যুগের যাত্রীতে । এরপর আবার শিল্ড ফাইনাল । এবার বিপক্ষ রেঙ্গুন ইউনাইটেড । কে আওয়াজ তুলেছিল প্রসূনের বুকের মধ্যে ? অনিল ভট্টাচার্য , দারিদ্র্য , খিদে না কি স্বপ্ন ? প্রসূন শুধু শুনতে পেয়েছিল, "স্ট্রাইকার, এবার ঘা মারো , সর্বশক্তি দিয়ে মারো । "

তারপর রেঙ্গুন ইউনাইটেডের গোলকিপার কুড়িয়ে নিয়েছিল সাদা-কালো ফুটকি আঁকা পৃথিবীটাকে । তুবড়ির আলোয় ভেসে গিয়েছিল ময়দান । আর “সেই চালচিত্রের মতো আলোর ঝাড়ের ঠিক মাঝখানে অনেক লোকের ভীড়ে এক প্রৌঢ়ের কপালে চিকচিক করছিল একটা টিপ । অত্যন্ত উজ্জ্বল , মর্যাদাবান । ”

স্ট্রাইকার যখন পড়েছি, প্রথম প্রথম নিজেকে খুঁজতাম নীলিমার মধ্যে । নীলিমার মতো জীবনযুদ্ধ ছিল না আমার, কিন্তু কোথাও যেন নিজেকে দেখতে পেতাম । মনে হত, প্রসূনের মতো লড়াকু বন্ধু কেন কেউ নেই আমার ? ছবির মতো ফুটে উঠত অভাবের সংসারে বিছিয়ে থাকা সোনালি জরির কারুকাজ করা স্বপ্ন । নীলিমার স্কুল ইউনিফর্মের ওই নীল পাড় সাদা জমির শাড়িতে একটি দুটি করে তারা ফুটে উঠত । পিন্টুর মতো একটা ভাই থাকলে কী তাকে হিংসে করতাম আমি, না কি ভালোবাসতাম ? কচুরি-জিলিপি ছিল আমাদের বাড়ির রবিবারের অভ্যস্ত প্রাতরাশ । মুখে তুলতে গিয়ে চোখে জল এসে যেত । ঠিক এতটাই মতি নন্দী আমার অস্তিত্বে মিশিয়ে দিয়েছিলেন প্রসূনের গোটা পরিবারকে ।

যৌবন সব সময়েই মোহময় । স্ট্রাইকার আমাকে আচ্ছন্ন করেছিল । কিন্তু স্টপার আমাকে ঝাঁকুনি দিয়ে বুঝিয়ে দিল, পড়ন্ত সূর্যের আলোকরশ্মিও ঋজু, সরলরৈখিক এবং মনোমুগ্ধকর । কমল গুহ । এককালের ময়দান-কাঁপানো স্টপার , যাঁর নামে বিপক্ষ দল কেঁপে উঠত । মানুষটি চরিত্রে কেমন ? রাগী, ভোঁতা, সেন্টিমেন্টাল ? পাতা উল্টে যাই । আসেন পল্টু মুখার্জি, কমল গুহ যাঁর হাতে তৈরী । যে বৃদ্ধ গুরুর চিকিৎসার জন্য আত্মসম্মান শিকেয় তুলে রেখে শোভাবাজারের বয়স্ক স্টপার কমল গুহ হাত পেতে একশ' টাকা নেন ছেড়ে আসা ক্লাব যুগের যাত্রীর তাঁবু থেকে । পল্টু মুখার্জীর একদা মারের দাগ লুকিয়ে থাকে কমলের চুলের আড়ালে । যৌবনে পল্টু মুখার্জীর লাঠির ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে যেমন দৌড় প্র্যাকটিস করতেন কমল, কুড়ি বছর পরে বৃদ্ধ বয়সেও যখন অসুস্থ পল্টু তাঁর সন্তানপ্রতিম শিষ্যের কাছে বল কন্ট্রোল দেখার আবদার করেন , কমল গুহ নিজের অজান্তেই ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মতো কুঁজো হয়ে যান । তারপর প্রমত্ত নটরাজ যেন সর্বাঙ্গে ওই বলকে নিয়ে খেলা করতে থাকেন । পল্টু মুখার্জিকে এ ছাড়া আর অন্য কোনোভাবে শেষ নমস্কার জানাতে পারতেন কি কমল ?

কমলের স্ত্রী মানিয়ে নিতে পারেননি নিজেকে ফুটবলার স্বামীর জীবনের সঙ্গে । তিনি যখন মারা যান, কমল তখন কলকাতার বাইরে , যুগের যাত্রীর হয়ে রোভার্সে খেলতে । যুগের যাত্রী স্ত্রীর অসুস্থতার খবর চেপে গিয়েছিল, পাচ্ছে কমল না খেলেই ফিরে আসেন । তাঁর ছেলে অমিতাভ মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী করত কমলকেই । বাবা দূরের মানুষ, ফুটবল আরোই দূরের ।

পল্টুর যেমন কমল , কমলের তেমন সলিল । এই সলিল আর অমিতাভ ..কী অদ্ভুত এক বোঝাপড়ায় দু-জন সমবয়স্ক, অসম মানসিকতার মানুষ বন্ধু হয়ে ওঠে । অদৃশ্য যোগসূত্রটি শুধু কমল । সত্যিই তো, পিতা এবং গুরু সমার্থক !

অফিসে সকলে কমলকে নিয়ে হাসাহাসি করে । শেষবারের মতো সবুজ ঘাসে পা রেখে যেদিন ফুটবলে বুট ছোঁয়ান কমল , সেদিন কি শোভাবাজার শেষ হাসি হেসেছিল যুগের যাত্রীর মুখের ওপরে ? হেসেছিল । কারণ কমল গুহ সেদিন একাই একটা “প্রাচীন অশ্বত্থ গাছ” হয়ে শোভাবাজারের পেনাল্টি এরিয়ার মধ্যে ডালপালা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন । আবার সেই একই গাছ মুহূর্মুহূ ভোল পাল্টে “কখনো হয়ে উঠেছিল বুনো মহিষ, কখনো বনবিড়াল, আবার কখনো বা বিষধর গোখরো সাপ ।” সে ছোবল দিল , আবার আশ্রয়ও । বুড়ো বাতিল স্টপার কমল গুহর গোলে জিতে শোভাবাজার ছিনিয়ে নিয়েছিল যুগের যাত্রীর মুখের গ্রাস ।
পল্টু খালি শিষ্যকে বলতেন, "কখনও ব্যালান্স হারাস না । " জীবনের শেষ খেলা খেলে মাঠের মাঝে সেন্টার সার্কেলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে প্রাচীন গাছটি ফিসফিস করে বলেছিল, "আমি যেন কখনও ব্যালান্স না হারাই । আমার ফুটবল যেন সারা জীবন আমাকে নিয়ে খেলা করে ।"

আর অমিতাভ ? সে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলেছিল, "তোমার জন্য আমার গর্ব হচ্ছিল বাবা !" 

তখন একভাবে ভাবতাম । কিছুটা রোমাঞ্চ, কিছুটা সেন্টিমেন্ট, কিছুটা মুগ্ধতা মেশানো পাঠ-প্রতিক্রিয়া । এখন এই বয়েসে এসে যখন পড়ি আবার, বুঝি যে এই শেষ কথাটাই সার কথা । সন্তানদের কৃতিত্বে আমরা গর্ব করি । কিন্তু আমাদেরও আমৃত্যু কিছু দায়দায়িত্ব  থেকে যায় সন্তানের কাছে...নিজেকে প্রমাণ করার । শুধু জন্ম দিলেই বাবা-মা হওয়া যায় না । বাবা-মা হয়ে উঠতে জানতে হয় । অমিতাভর জায়গায় নিজেকে বসিয়ে দেখি, সত্যিই তো ! মা একটা নির্ভরতার জায়গা । কিন্তু সব সন্তানের কাছেই বাবা রোল মডেল । বাবাকে সামনে রেখেই আমাদের প্রথম হিরো ওয়রশিপ । তাই সন্তানের কাছে যখন কমল গুহ জিরো থেকে হীরো হয়ে ওঠেন, সেই দুর্গম উত্তরণের পথে আমরাও অমিতাভর হাত ধরেছিলাম, মনে মনে ! তাই কাহিনির শেষে আমরাও এই প্রাচীন বৃক্ষের কাছে নির্দ্বিধায় নতজানু হই । 

আমার পিসতুতো দাদা মাত্র এগারো বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিল । ওর ডাকনাম ছিল আনন্দ । তাই মতি নন্দী যখন লিখলেন 'অপরাজিত আনন্দ' , আমার বুকটা কেঁপে উঠেছিল । গল্পের আনন্দরা অপরাজিত হয়; বাস্তবে তা হয় না কেন ? এই আনন্দ স্কুলের ছাত্র, সে ফাস্ট বোলার হতে চায় । ঠিক অ্যান্ডি রবার্টস যেমন । ছেলেটি মাতৃহীন । তার বড়দা বিদেশে । বাড়িতে সে, তার উকিল বাবা , তার ক্রিকেট-পাগল কিন্তু খেলায় তেমন কিছুই করে উঠতে না পারা চাকুরে মেজদা আর দুটো কাজের লোক । আনন্দর আলাপ হয়েছিল একটি ছেলের সঙ্গে , যার ডান পা পোলিওতে শীর্ণ । সে পা টেনে দুলে দুলে হাঁটে, তার চোখ দুটো সর্বক্ষণ হাসে । অমল নামের এই পঙ্গু ছেলেটি কিন্তু “খেলে” ! সে লন টেনিসের বল কুড়িয়ে এনে হোক, ইট তুলে ফেলে বা লোহার শট কুড়িয়ে দিয়েই হোক অথবা উইয়ে কাটা ব্র্যাডম্যানের বই পড়ার মাধ্যমেই হোক । আনন্দ ফাস্ট বোলার হতে চেয়েছিল । কিন্তু তার বুকে ব্যথা , হাঁফ ধরে , জ্বর হয় ....অবশেষে তার শরীরের একটা দিক অসাড় হয়ে যায় ।  
পড়তে পড়তে আমার খুব দাদাভাইয়ের কথা মনে পড়ত । তার মানে আনন্দরা হেরেই যায় ! জীবনের কাছে । কোথাও আবার মিল পেতাম 'ডাকঘর'-এর অমলের সঙ্গে । জানলা দিয়ে একটুকরো রুমালের মতো আকাশ থাকে , অসফল ইচ্ছে আর স্বপ্ন থাকে...শুধু রাজার চিঠি থাকে না ।  

স্বপ্ন । স্বপ্নে যা খুশি করা যায় । স্বপ্ন তারাই দেখে, যাদের মন আর ইচ্ছে আছে । যে স্বপ্ন দুর্বলতাজনিত কারণে পূরণ করা সম্ভব নয়, তা স্বপ্নে পূরণ করা শিখে নিতে হয় । পঙ্গু অমল তাই এমন একটা পৃথিবী গড়ে নিয়েছিল নিজের জন্য, যেখানে সে ইচ্ছেমতো নিজেকে জিতিয়ে দিতে বা হেরে যেতে পারে । বাস্তবে সে পাঁচ বছরের বাচ্চাকে দৌড়ে হারাতে না পারলেও স্বপ্নে সে মিউনিখ অলিম্পিকে বোরজভকে হারিয়ে দেয় অবলীলায় । অমল স্বপ্ন গড়ার কারিগর । অমলকে আমার এক রূপক চরিত্র বলে মনে হয় । যার হাত ধরে আনন্দরা স্বপ্নে যুদ্ধগুলো জিতে যেতে পারে । অমলের হাত ধরে রিউম্যাটিক হার্টের রোগী আনন্দ কখনো লন টেনিস খেলে জিমি কোনর্সকে হারায় , কখনো ফাস্ট বোলিং করে হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ।  

অমল চলে যায় পাড়া ছেড়ে । কিন্তু স্বপ্নগুলো রেখে যায় শয্যাবন্দী আনন্দর চোখের পাতায় । তাই দোতলার ঘরে বিছানায় শুয়ে দুপুরবেলায় জানলা দিয়ে মেঘেদের ভেসে বেড়ানো দেখতে দেখতে আনন্দর ঠোঁটেও হাসি ফুটে উঠেছিল । তার অসুস্থ বুকের খাঁচার অন্ধকার কাটিয়ে রোদ্দুর উঠেছিল । মতি নন্দী অক্ষরের খেলায় বাজিমাত করেছিলেন । স্বপ্নের কাছে হেরে গিয়ে হতাশা মাথা নীচু করে সরে গিয়েছিল আড়ালে । 

খিদে, দারিদ্র্য, বঞ্চনা...কখনো কখনো আপনা থেকেই মনে একটা জেদ তৈরী করে দেয় মনে ।  যেমন স্ট্রাইকারের প্রসূন । আর কখনো কখনো বাইরে থেকে একটা আগুনের ফুলকি লাগে । সাঁতারের কোচ ক্ষিতীশ যেমন  কোনির কাছে ওই আগুনের ফুলকির মতো । কোনি হাঁটছিল । নেতাজি বালক সংঘের উদ্যোগে কুড়ি ঘন্টা অবিরাম ভ্রমণ প্রতিযোগিতা । বৈশাখের চাঁদিফাটা রোদ্দুর মাথায় নিয়ে । ক্ষিতীশের চোখ অনুসরণ করছিল তাকে । ক্ষিতীশ নিখাদ সোনা চেনে ।  সে জানে, কোনি হাঁটবে এবং শেষও করবে । ওকে সাঁতারে আনা দরকার । গঙ্গায় কোনিকে এপার-ওপার করতে দেখেছে সে । কোনির স্কুলের বিদ্যে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত । গরীবের ঘরের সাঁতারু ছেলেমেয়ের তোয়ালে বা সুইমিং কস্টিউম থাকে না । কিন্তু কোনিকে তা অর্জন করে নিতে হবে । এটাই শর্ত । জুপিটার ক্লাব কোনিকে জায়গা দেয়নি । ক্ষিতীশ তার হাত ধরে ঢুকেছিল প্রতিপক্ষ ক্লাব অ্যাপোলোতে । কারণ, কখনো কখনো শিষ্যকে শীর্ষে দেখতে গেলে গুরুকে বাস্তবের কাছে মাথা নোয়াতে হয় , অপমানের সঙ্গে আপস করতে জানতে হয় । কোনিকে ক্ষিতীশ বীজমন্ত্র দিয়েছিল কানে ।  

" যন্ত্রণা কী জিনিস , সেটা শেখ । যন্ত্রণার সঙ্গে পরিচয় না হলে, তাকে ব্যবহার করতে না শিখলে, লড়াই করে তাকে হারাতে না পারলে কোনোদিনই তুই উঠতে পারবি না ।" 
"যন্ত্রণায় ঝিমঝিম করে উঠবে শরীর, টলবে, লুটিয়ে পড়তে চাইবে যন্ত্রণার পাঁচিলের সামনে । আর তখন জেনেশুনেই চ্যালেঞ্জ দিতে হবে ওই পাঁচিলটাকে । এজন্য চরিত্র চাই, গোঁয়ার রোখ চাই ।"  

চ্যালেঞ্জ দেওয়া । এই চ্যালেঞ্জ শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন স্টপার কমল গুহর কোচ পল্টু মুখার্জি । অর্থাৎ ক্রিকেট বা ফুটবল, লন টেনিস বা সাঁতার... চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতেই হবে । আর চাই প্রতিদ্বন্দ্বীকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার তীব্র আক্রোশ । ওটাকে পুষে রাখতে হবে, নড়াচড়া করতে দিতে হবে বুকের মধ্যে । তারপর আসল সময়ে বোমাটা ঠিক ফেটে যাবে বুকের মধ্যে । 

ঠিক কথা কিন্তু ! আমি জানি, কারণ আমারও একজন ক্ষিতীশদা বা ক্ষিদ্দা ছিল । যে আমার মধ্যেও ওই চ্যালেঞ্জ নেওয়ার নেশাটা চারিয়ে দিয়েছিল । খেলায় নয়, পড়াশুনোয় । কিন্তু দিনের শেষে গল্পটা তো সেই একই রয়ে যায় ! তাই আমার পার্ট টু অনার্সের পরীক্ষার পরে আমি যখন ভীষণ রেগে গিয়ে বলেছিলাম, "কোথায় ছিলেন আপনি ? আমি যখন হল থেকে বেরিয়ে আপনাকে খুঁজছিলাম ?" 

আমার মাস্টারমশাই বলেছিলেন, "ওই পরীক্ষার হলেই তো ! তোমার পাশে । কেন, তুমি দেখতে পাওনি ?" 

আমি ঈষৎ কেঁপে উঠেছিলাম । কোনির কথা মনে পড়েছিল । কতদিন আগে পড়া উপন্যাস ।  

" কিচ্ছু দেখিনি , কিচ্ছু শুনিনি । যন্ত্রণায় তখন আমি মরে যাচ্ছিলুম ।'' 
"ওইটেই তো আমি রে, যন্ত্রণাটাই তো আমি ।" 

গল্প আর বাস্তব ...দুটো সমান্তরাল রেললাইন যেমন অনেক দূরে তাকালে কেমন মিলে গেছে বলে মনে হয় ... মতি নন্দীর ভাবনা আর কলমের কারিকুরিতে কোনি ঠিক তেমনভাবেই আমার অস্তিত্বের অংশ হয়ে গিয়েছিল । এবং আমার ব্যর্থতা আর সাফল্যের ।   

খবরের কাগজের অফিসের বেয়ারা নারানের জন্ম দৌড়বাজ এমিল জ্যাটোপেকের সঙ্গে একই দিনে । বছর দুয়েকের ফারাকে । এমিল আর ডানা জ্যাটোপেক । অলিম্পিক ইতিহাসে সবচেয়ে বর্ণময় দম্পতি । নারানও দৌড়োতে পারে খুব । খবরের কাগজের ভ্যানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে । সে সারারাত ডিউটি করে ভোরের ট্রেনে বাড়িতে এসে সাইকেলে অন্তত আঠাশ মাইল পথ পেরিয়ে কাগজ বিলি করে , মাত্র তিরিশ টাকা বাড়তি আয় হবে বলে । তার পায়ের পেরেক বিঁধে গেলেও সে খালি পায়ে দৌড়োয় । সে চোখ বুজলেই তার ভগবানকে দেখে, যে ভগবানের সঙ্গে সে একই দিনে জন্মদিন ভাগ করে নিয়েছে । কলকাতায় জ্যাটোপেক আসার খবর পেয়েছে নারান । সাইকেল বিকল হতে শুধু ঈশ্বরকে একবার চোখের দেখা দেখবে বলে আলের ওপর দিয়ে, চষা জমি মাড়িয়ে , ভাঙাচোরা রাস্তায় ঠোক্কর খেতে খেতে ছুটে যায় নারান । সে কি তবে অন্য ধাতুতে গড়া ছিল ? এমন ধাতু, যাতে তৈরী হলে মানুষের যৌবন শুরু হয় চল্লিশ বছর বয়স থেকে ? নারান বলেছিল, "ধাতুটাতু তো বুঝি না ...লোহা, অ্যালমুনি ছাড়া অন্য কোনো ধাতুই আমার ঘরে নেই । আমি কখনো 'দিতে হবে, দিতে হবে' বলে ভিক্ষে করিনি । যতটুকু করেছি, নিজের ক্ষমতায় করেছি । সে জন্য পরিশ্রম করেছি...টুকে কী মানেবই মুখস্থ করে পাশ হয়তো করা যায়, কিন্তু শিক্ষিত হওয়া যায় না । জ্যাটোপেকের সঙ্গে দেখা হয়নি ...দৌড়ে গিয়ে ট্রেন ধরেছি, ট্রেন থেকে নেমেও দৌড়েছি..তাও দেখা হয়নি । তাও কিন্তু আমি ভেঙে পড়িনি । জ্যাটোপাক আমাকে দৌড় শেখায়নি, দৌড়োবার জন্য বলেওনি । আমি নিজেই নিজের জন্য দৌড়োচ্ছি ।" 

গল্প এরপর নিজের খাতিরেই দৌড়েছে, দৌড়েছে নারানও । ম্যারাথন দৌড় । এবং ছেষট্টি বছর বয়সে । নারান সে দৌড়ে পুরস্কার পায়নি , তিরিশ বছর বাদে জ্যাটোপেককে আর একবার শুধু চোখে দেখার ইচ্ছেও অপূর্ণ থেকে গেছে, কিন্তু নারান তার দৌড় শেষ করেছে । শুরু করাটা জরুরী, শেষ করাটা কিন্তু আরও অনেক বেশি জরুরী । নারান শিখিয়ে দিয়েছে যে মানুষের সব আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয় না । পূরণ হলে আর সেটাকে "জীবন" বলা যায় না । নারানদের পাশে পাশে মনে মনে দৌড়োতে দৌড়োতে তাই আমরাও জীবন চিনতে শিখি । বুঝে যাই, যতদিন পারা যায় “হুসহুস করে আগ্নেয়গিরির মতো" জ্বলতে হয় । জীবন আমাদের যেমন কিছু কিছু ইচ্ছে পূরণ করে না, তেমন আবার অনেক কিছু দেয়ও ।  

নারান স্পোর্টসম্যান, নারান অ্যাথলিট । 

"অ্যাথলিট দরজায় দরজায় ঘুরে ডাকপিওনের মতো কড়া নেড়ে চিঠি পৌঁছে দেবে, মানে খবর পৌঁছে দেবে । কী খবর পৌঁছে দেবে ? স্পোর্টসম্যান হও ।" 

আমরা সবাই জীবনের কোনো না কোনো ইভেন্টে নারানের মতো অ্যাথলিট । দৌড়োচ্ছি, হুমড়ি খেয়ে পড়ছি, পিছিয়ে যাচ্ছি..কিন্তু ফিনিশিং লাইন ছুঁতেই হবে ! শেষ করাটাই শেষ কথা । 

১৬ই অগাস্ট, ১৯৮০ । কলকাতা, তথা ভারতীয় ফুটবল ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে অন্ধকার দিন । সেই ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ । মোহনবাগান খেলতে নেমেছিল কম্পটন দত্তের নেতৃত্বে , লাল-হলুদ টিমের অধিনায়ক ছিলেন সত্যজিৎ মিত্র । ম্যাচের ফলাফল ছিল ১-১ । ময়দান সেদিন দু-দলের সংঘর্ষে রক্তে স্নান করেছিল । রেফারির কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে এই ভয়াবহ ঘটনা । শেঠ সুখলাল কারনানি হাসপাতালে উপচে পড়েছিল মানুষ । নিহত হয়েছিলেন ষোলো জন ফুটবলপ্রেমী মানুষ, আহতের সংখ্যা অসংখ্য । ইডেনের গ্যালারির আগুনের হলকা উত্তপ্ত করে তুলেছিল কলকাতার আকাশ । 

ফুটবলার তো দেবতা নয়, তারা রক্তমাংসের মানুষ । তাদেরও ভুলভ্রান্তি হয় ! কিন্তু ভক্তদের কাছে সে ভুলের ক্ষমা চাওয়া নিরর্থক । তাই কয়েক বছর পরে যখন মতি নন্দী লেখেন "ফেরারি", তখন আমরা দেখতে পাই রক্তাক্ত ময়দানের চেনা ছবি আর সারথির স্টার ফুটবলার অনুপমকে । যার পেনাল্টি শট গোলে ঢোকেনি বলে  গোয়ার ডেম্পোকে হারিয়ে প্ল্যাটিনাম জুবিলী কাপ ঘরে তুলতে ব্যর্থ হয়েছিল সারথি আর জনরোষের শিকার হয় ময়দান । আটটি লাশ পড়েছিল, অগুনতি মানুষ আহত হয়ে যন্ত্রণায় কাতরেছে, মফস্বলের বহু ফুটবলপ্রেমী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন । অন্ধকারে মুখ লুকিয়েও বাড়িমুখো হওয়া দায় হয়ে উঠেছিল অনুপমের । চেনা পাড়া..যা নিরাপদ আশ্রয় ছিল এতকাল , যেখানকার বাসিন্দারা এতদিন ফুল মালা দিয়ে পুজো করেছে, তাদের উদ্যত ক্ষোভ আর আঘাত এড়াতে ফেরারি ফুটবলার আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় বেপাড়ার আত্মীয়গৃহে । যেখানে এক সময়ে তাকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিল, যেখানে সে উদ্ধত অহমিকায় একটি ছোট ছেলের অটোগ্রাফ-খাতার বদলে কুড়িয়ে নেওয়া হ্যান্ডবিলের পেছনে সই করতে প্রত্যাখ্যান করেছিল, সেখানেই তাকে চোরের মতো আত্মগোপন করে থাকতে হয় । এই লুকিয়ে থাকতে থাকতে একটা প্রশ্ন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, খেলা দেখতে গিয়ে এই যে মানুষগুলো মারা গেল, ফুটবলকে ভালোবেসে এই যে মানুষগুলো আর ঘরে ফিরল না ....ঠিক কেন এবং কার জন্য ? তখনই আত্মগ্লানিতে অস্থির হয়ে ওঠে অনুপম । তার নিজেকে একটা খুনি বলে মনে হয় । সে পলাতক, সারা মহল্লা তার অনুসরণকারী । পালাতে হবে, পালাতে হবে ...। পালাতে গিয়ে চোট পায় সে । তাকে বাঁচায় কে ? সেই অটোগ্রাফ চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হওয়া বালকটি, যে এতদিনে কিশোর । ক্লান্ত, বিধ্বস্ত অনুপম অনুভব করেছিল...ফুটবলার নয়, তাকে মানুষ হয়ে উঠতে হবে । ‘ফেরারি’ আমাদের সেই মনুষ্যত্ব অর্জনের কাহিনি শুনিয়েছিল । আর সেজন্যই অনুপম মুখোমুখি হতে চেয়েছিল সত্যের, দাঁড়াতে চেয়েছিল একটি চার বছরের পিতৃহীন বালকের পাশে, যার বাবা প্রদীপ হালদার সেদিন খেলা দেখতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি । ফেরারি সেই উত্তরণের বিবরণ । এই পালিয়ে যাওয়া , এই আত্মগোপন, এই আত্মসমীক্ষা এবং আত্ম-বিশ্লেষণ ....এই সব কিছুই অনুপমের মধ্যে দিয়ে আমাদেরও কোথাও না কোথাও জীবন আর জীবনের লক্ষ্যকে চিনিয়ে দেয় । ব্যর্থতার অন্ধকার দূর হয়ে যায় চেতনার আলোয় । 

ময়দানে দলবদল । এ এক বিচিত্র ব্যাপার । ভালো প্লেয়ারদের দিকে তাকে করে থাকে নামী ক্লাবগুলো । দরকার হলে হাইজ্যাক করে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে নজরবন্দী করে রাখে একেবারে সই না করানো পর্যন্ত । এই নিয়েই লেখা "দলবদলের আগে" । প্লেয়ারদের সঙ্গে কর্মকর্তাদের লুকোচুরি খেলা । এই উপন্যাসটি বরং অপেক্ষাকৃত হালকা চলে লেখা । এই এতদিন বাদে যখন পড়ছি, মনে এল আমার বাবা একদিন দলবদল বা প্লেয়ারদের রংবদল খবরের কাগজে পড়তে পড়তে বলেছিল, "ছ্যা ছ্যা, তোরা কি ঠিকে কাজের লোকেরও অধম হয়ে গেলি ? তারা দু-দশ টাকা বাড়তি মাইনে পেলে পুরোনো মনিববাড়ি ছেড়ে মায়া কাটিয়ে ড্যাং ড্যাং করে নতুন বাড়িতে ঢোকে জানি । সেটা মাপ করে দেওয়া যায় কারণ তাদের অভাবের সংসার । আনুগত্য ধুয়ে খেলে পেট ভরবে না । কিন্তু তোরা ? ক্লাবের প্রতি একফোঁটা মায়া নেই ? টাকাটাই সব হল ?" 

বুঝতেই পেরেছিলাম, নির্ঘাত নামী দামী কেউ মেরুন সবুজ জার্সি খুলে রেখে সেবার লাল-হলুদ রং গায়ে চড়িয়েছে । বাবা বলেছিল, "শোন, একটা কথা জেনে রেখো, দল যেমনই হোক, প্লেয়ার যেমনই হোক, সমর্থকরা কক্ষনো দলবদল করে না ।"  আমি, বেজায় পিতৃভক্ত আমি, তাই বিয়ের আগে-পরে কক্ষনো ভুলেও মেরুন-সবুজ রং দেখে ভুলিনি । এমনকি মেরুন-সবুজ কম্বিনেশনের শাড়িও পরিনি ।  

এই দলবদল, এই সমর্থকদের উল্লাস বা উষ্মা , এই ফুটবলপ্রেমী মানুষগুলোর নিজের প্রিয় দলের প্রতি তীব্র ভালোবাসা আর সমর্থন চিনে এসেছি সেই কবে থেকে ! আমার মনে আছে, সেই যেবার ইস্টবেঙ্গলের কার্তিক শেঠ মেরুন-সবুজের গোলে দু-বার বল ঢুকিয়ে দিয়েছিল, আমি আহ্লাদে আটখানা হয়ে খেলা দেখছি টিভিতে ..বাবা গম্ভীর মুখে এসে ঘটাং করে টিভি বন্ধ করে দিয়ে বলল, "আমার বাড়িতে আমার কেনা টিভিতে ইস্টবেঙ্গল জিতছে...দেখা চলবে না । যাও, মামারবাড়ি গিয়ে দ্যাখো গে ! তোমাকে বলেছি না, সাপোর্টাররা কক্ষনো উদার আর নিরপেক্ষ হয় না, হতেই পারে না ?"  

শিবার ফিরে আসা । মতি নন্দী এলেন পূর্বপল্লী কলোনির ছেলে বক্সার শিবাকে নিয়ে । মিডলওয়েট বক্সার শিবার দাদা নিতুর পাঁউরুটি আলুর দমের দোকান । তার মা ডেকচি ভ'রে আলুর দম বানান আর শিবা সেই ডেকচি ঘাড়ে করে দোকানে নিয়ে যায় । শিবাকে আবিষ্কার করেছিলেন ফ্র্যাঙ্ক গোমস । তিনিই বলেছিলেন প্রথম , "ইউ হ্যাভ আ বিউটিফুল লেফট হুক ।" তারপরেই শিবা ফেঁসে গিয়েছিল বেটিং দুনিয়ার জালে । সেই সব রাঘব বোয়ালদের সঙ্গে দুর্বুদ্ধিতে টক্কর দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না কলোনির ছেলে শিবার । সে ফালতু মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে দীর্ঘদিন ঘরবন্দী ছিল । কিন্তু শিবারা ফিরে আসেই । তাই যখন সে আবার খুঁজে খুঁজে গোমসকে নোংরা বস্তির ঘরে আবিষ্কার করে, গোমস বলেছিলেন, " তুমি এখানে কেন এসেছ ? আই অ্যাম গ্র্যাজুয়ালি ফেডিং ফ্রম লাইফ । শিবা যায়নি । সে ফিরতে চেয়েছিল বক্সিং রিং -এ । নিজের মতো করে শিষ্য গুরুকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল জীবনে । তখন ফ্র্যাঙ্ক বলেছিলেন, "তুমি বাইবেল পড়নি । তাতে রেজারেকশন বলে একটা ব্যাপার আছে । ক্রাইস্টকে কবর দেওয়ার পড় তিনি উঠে এসেছিলেন । এর একটা ডিপার মিনিং আছে । জীবন মরে পড়ে থাকে না, সে উঠে আসে ।" কোচিং-এ ফিরেছিলেন ফ্র্যাঙ্ক । শিবাকে সঙ্গে নিয়ে । শিবাকে শিখিয়েছিলেন সাফল্যের মন্ত্রগুপ্তি,

"ফাইটার্স আর ডিস্কভারার্স । তারা খুঁজে বার করে । অপোনেন্টের ক্ষমতা আর গলদ । তারা নিজেদেরও তখন ডিসকভার করে, নিজেদের ভালোমন্দও তখন জানতে পারে । একটা কথা মনে রেখো, রিঙের মধ্যে কীভাবে ফাইট করবে এটা বাইরে থেকে তোমার ট্রেনার বলে দিতে পারে না । তোমাকে নিজে সেটা ঠিক করে নিতে হবে । এ জন্য তোমার বুদ্ধি, মন তৈরী করতে হবে । সবার আগে চাই জেতার ইচ্ছা , ডিজায়ার ।" 

আমি প্রথম যেমন বক্সার শিবাকে চিনেছিলাম, তেমনি প্রথম যেন আবিষ্কারও করেছিলাম ''ডিজায়ার" কথাটার সত্যিকারের অর্থ । শুধু “ইচ্ছে” বললে সেই জোরের জায়গাটা পুরোপুরি তৈরী হয় না । ডিজায়ার মানে বুকের মধ্যে ফুঁসে ওঠা একটা অদম্য ইচ্ছের নদী । উচ্চাকাঙ্ক্ষী কিশোর আর তরুণ অগণিত পাঠকের মনে সেই ইচ্ছে-নদী তৈরী করে দিয়েছিলেন মতি নন্দী । একের পর এক এই সব "ইনস্পিরেশনাল" কাহিনির মাধ্যমে ।  

একের পর এক বিভিন্ন খেলা নিয়ে লিখেছেন মতি নন্দী । রণক্ষেত্র বদলে গেছে শুধু । এর পরে এসেছে তুলসী । সে মেয়ে এবং দৌড়োয় , সাইকেলও চালায়  । তুলসী পুরোনো খবরের কাগজ কিনে ঠোঙা বানায় সপরিবারে । তার বাবা শিক্ষকতা করতেন, অসুস্থ ও শয্যাশায়ী । প্রতিদিন দশ কেজি কাগজ সাইকেলে ঝুলিয়ে তুলসী বাড়ি ফেরে মাইলচারেক পথ পাড়ি দিয়ে । তার অসমবয়সী শুভাকাঙ্ক্ষী সুহৃদ বলরাম । বয়স ষাট । তুলসীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাঁতার কাটেন হৃষ্টপুষ্ট বলরাম । তাঁকে দেখে ছেলেপুলে হাসে, দু-নম্বরী ফুটবলের সঙ্গে তুলনা করে । এ সব বাঁদরামি বন্ধ করতে হবে । সস্তায় পেয়ে যান রেসিং সাইকেল । আর তুলসী ? সে দৌড়োয় রেলওয়ে ট্র্যাকের মাঝের স্লিপারের ওপর দিয়ে । তুলসীর সঙ্গে তার পাতানো মেসোমশাই বলরামও  নিজের মতো করে লক্ষ্য স্থির করে নেন । তুলসীর একটা চাকরির খুব প্রয়োজন । ট্রায়াথলনে নাম দিলে একটা হিল্লে হতে পারে । তিনটে বিষয়ে স্পোর্টস পরপর করতে হবে । সাঁতার, সাইক্লিং, দৌড় । তুলসী কি পারবে ? চীনে এশিয়ান জুনিয়র ট্রায়াথলন জিতেছিল সতেরো বছরের মেয়ে সি. আমুদা । তার মা ঠেলাগাড়ি করে আখের রস বেচতেন মেরিনা বীচে । আমুদাকে কে যেন বলেছিল, "হয় মেডেল নিয়ে ফিরবি, নয় মরবি ।" আমুদা প্রথমটিকে বেছে নিয়েছিল । তাহলে তুলসী নয় কেন ?  

গল্প এগিয়েছে । ট্রায়াথলনে অংশ নিয়েছেন তুলসীর সঙ্গে সঙ্গে বলরামও । সবচেয়ে বয়স্ক প্রতিযোগীর সম্মান হয়ত আসবে তাঁর ঝুলিতে । তুলসীর কপাল খারাপ । ভাঙা সাইকেল মেরামত করে কাজ চালানো । ঠিক মুখ থুবড়ে পড়ল সাইকেল । নির্দ্বিধায় তার হাতে নিজের সাইকেল তুলে দিয়েছিলেন বলরাম । মেয়েটা জিতুক । লড়াকু তুলসী জয় "ডিজার্ভ" করে । বলরামের জন্য প্রতিযোগিতাটা জীবন মরণ সমস্যা নয় । কিন্তু তুলসীকে অনেকটা পথ পেরোতে হবে জীবনে । বলরাম আর কীই বা করতে পারতেন এই নিজের সাইকেলটুকু ওকে দিয়ে জয়ের পথ সুগম করা ছাড়া ? এখানে সম্পর্ক গুরু- শিষ্যার নয় । অসম সখ্যের । যে সখ্যের স্বীকৃতি দু-পক্ষকেই দিতে জানতে হয় । তুলসী মর্যাদা দিয়েছিল বলরামের ইচ্ছার । বলরাম চেয়েছিলেন, তুলসী জিতুক । প্রবীণ এভাবেই নবীনকে জায়গা করে দেয় । তবেই সাফল্যের ব্যাটন এক হাত থেকে অন্য হাতে ঠিকঠাক ট্রান্সফার্ড হয় । এই গল্প প্রবীণ আর নবীনের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার । দুটি অনাত্মীয় মানুষের পরমাত্মীয় হয়ে ওঠার । যে আত্মীয়তার গ্রন্থিসূত্রটি খেলা এবং যে খেলার অন্য নাম "জীবন" ।   

দুই ভাইয়ের গল্প । লন টেনিস । মিনু চিনুর ট্রফি । সন্তানের শুধু প্রতিভা থাকলেই হয় না, তাকে ঠিকঠাক পরিচর্যা করে চারাগাছ থেকে মহীরুহ করে তুলতে জানতে হয় । আর জন্মদাত্রী মা ছাড়া আর কেই বা পারেন সন্তানদের ঠিক পথে চালনা করতে ? ঠিক সেটাই করেছিলেন তপতী, মিনু-চিনুর মা । ছেলেদের তৈরী করতে নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন অযত্নে এতকাল বাক্সে পড়ে থাকা টেনিস র‍্যাকেট । 

আসেন কোচ সহদেব, যিনি বলেছিলেন, "যন্ত্রণার সঙ্গে সড়গড় হও  যন্ত্রণাকে হেসে উড়িয়ে দাও " বলেছিলেন, "যখন তোমার শরীরের প্রতিটি ইঞ্চি যন্ত্রণায় টাটাচ্ছে, তখন তা সহজ করে নিতে পারবে যদি আগেই যন্ত্রণার সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায়, যদি বুঝে নাও এটা কোনো বড় ব্যাপার নয়, এটা থাকবে না ।" 

সহদেব মিনু-চিনুকে বলেছিলেন, "তোমরা হয়ত ভাবতে পারো চার মাইল পর্যন্ত দৌড়োবার ক্ষমতা তোমাদের আছে । কিন্তু একটা কথা শুনে রাখো, যদি একটা বন্দুক তোমাদের মাথায় ঠেকাই, তা হলে আবিষ্কার করবে আরও একটা মাইলও দৌড়োতে পারো । এটা টেনিস ম্যাচেও খাটাও । বড় বড় প্লেয়াররা যখন খেলে, তখন একে অপরকে যন্ত্রণায় বিঁধোয়, তখন শুধু একটাই প্রশ্ন, কে আর একটু বেশি যন্ত্রণা দিতে ইচ্ছুক, আর কে প্রথম পালাবে । হারতে যতটা সময় লাগে, জিততেও ততটা সময় লাগে । ব্যাপারটা যদি তাই হয় তা হলে না জোটে শুধু শুধু যন্ত্রণার শাস্তিটা নেবে কেন ? জেতার জন্য নিজেদের তৈরী করো ।" 

মিনু-চিনুর কাছে তাদের মা ট্রফি, আর মায়ের কাছে দুই সন্তান দুই ট্রফির সামিল ।  

পড়াশুনোই হোক বা খেলাধুলো, ছবি আঁকা হোক বা বেহালা বাজানো, প্রতিভার সঙ্গে দুটি বস্তু সমমাত্রায় থাকা খুব জরুরী । কঠোর অনুশীলন আর তীব্র ইচ্ছেশক্তি । এর প্রতিটি একে অন্যের পরিপূরক, একে অন্যকে ছাড়া অসহায় । এই সহজ সত্যিটুকুই "খেলা"চ্ছলে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন মতি নন্দী । আমার তো মনে হয়, শুধু এটুকুই নয়, বাঙালি বাবা-মায়ের একটা অংশ, যাদের কৈশোরে আর যৌবনে মতি নন্দী এই সব উপন্যাসের মাধ্যমে চেতনা জাগ্রত করেছিলেন, তাদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীকালে পড়াশুনোর গণ্ডিটুকুর মধ্যেই সন্তানকে আবদ্ধ রাখার আগে ভেবে দেখেছিলেন, অনেকেই নিজেদের গোপন লালিত স্বপ্নগুলো সন্তানের মাধ্যমে পূরণ করতে উৎসাহী হয়েছিলেন । অনুভব করেছিলেন, সফল মানুষ হতে গেলে তা জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রেই হওয়া যেতে পারে । বাবা মা হয়ে শুধু সন্তানের স্বপ্নের চারাগাছটিকে তার পাশেপাশে থেকে যত্ন করতে হয় ।  

এবার আসব শেষ উপন্যাসে । জীবন অনন্ত । অনন্ত আর জীবন , দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধু । দু-জনেই ক্রিকেটার । বান্ধব সমিতির হয়ে খেলে দুজনেই । অনন্ত মূলত বোলার, জীবন ব্যাটসম্যান । দু-জনেরই স্বপ্ন একটাই । ইন্ডিয়ার জার্সি । দেশের হয়ে খেলার সুযোগ।  জীবনের জেদাজেদিতে অনন্তর সামান্য অন্যমনস্কতাজনিত ক্ষণিকের ভুলের মাশুল দিয়েছিল জীবন । স্কুটার দুর্ঘটনায় তার একটা হাতের কব্জি থেকে আঙুলের অংশ...পুরোটাই বাদ পড়ে । সেখানে জায়গা নেয় নকল হাতের পাতা । অনন্ত প্রচুর প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে দেশের হয়ে খেলার সুযোগ পায় । কিন্তু তার নানা ওঠাপড়া , মানসিক দ্বন্দ্ব, অবসাদ ..সব কিছুতেই তার পাশে ছায়া হয়ে রয়ে গিয়েছিল জীবন । অনন্তর মধ্যে দিয়ে সে নিজের খেলাকে, স্বপ্নকে, বেঁচে থাকার ইচ্ছেকে ...আসলে বলতে গেলে নিজের অস্তিত্বকেই বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিল  । অনন্ত যতবার  জীবনকে দেখে, সে ওই নকল হাতের উপস্থিতি  অনুভব করে শিউরে ওঠে, কিন্তু জীবন তাকে এগিয়ে নিয়ে যায় নিজস্ব ধরনে ..কখনো ভালোবেসে , কখনো  অভিযোগ - অনুযোগ করে, কখনো  বা রাগারাগি, অভিমান করেও । আসলে জীবন আর অনন্ত..অনন্ত আর জীবন..এরা যেন একটি অস্তিত্বেরই দুটি অংশ । তাই সাফল্য আর ব্যর্থতা, যখন যেভাবে আসে, তা বহনের দায়ভাগও  দুজনেরই । এই উপন্যাস আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় এক অন্য উপলব্ধির মুখোমুখি : জীবন সত্যিই অনন্ত,  তাকে ক্ষুদ্র অনুভূতির ঘেরাটোপে আবদ্ধ রাখা যায় না ।   

মতি নন্দী

এই লেখা লিখতে বসে ভারী আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, যদিও ভেবেছিলাম বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমার মনটাও কেমন পলি পড়ে শক্ত হয়ে গেছে, আসলে তার নীচে ঠিক তিরতির করে একটা চেনা নদী বয়েই চলেছিল । সময় যেটুকু শুকিয়ে দিয়েছিল নদীর জলকে... প্রসূন ভট্টাচার্য,  কমল গুহ, নারান, কোনি, আনন্দ এবং অন্য সবক'টি চরিত্র .... সেই কমে যাওয়া নদীর জলকে আমার চোখের জল দিয়ে ঠিক পূরণ করিয়ে দিতে পেরেছে । আজ এতো বছর পেরিয়ে গেল, এত এত লেখা হল ক্রীড়াসাহিত্যের দুনিয়ায়, কিন্তু মতি নন্দীর ম্যাজিক কলম আজও কোনো উপযুক্ত উত্তরসূরী পেল না ।  

এই যে স্বপ্ন নামের ফুটবলটাকে বাস্তবের মাঠে ড্রিবল করতে করতে আশেপাশের সমস্যা নামের বিপক্ষের খেলোয়াড়গুলোকে কাটিয়ে গোলপোস্টের সামনে পৌঁছে যাওয়া আর তারপর স্বপ্নটাকে লক্ষ্যে বা অন্যভাবে বলতে গেলে গোলে ওই তে-কাঠির জালে আটকে দিয়ে  একটা সাধারণ সাদা-কালো পৃথিবীকে  অলৌকিক আলোয় উদ্ভাসিত করে এমন রঙিন ভুবন করে তোলা... শুধু এই অত্যাশ্চর্য ভাবনাগুলোকে বর্ণমালায় বন্দী করতে পারার জন্যই বাংলা ক্রীড়াসাহিত্য মতি নন্দীর কাছে আকণ্ঠ ঋণী হয়ে থাকবে । 



লেখক পরিচিত - কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিওফিজিক্স অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স বিভাগের ছাত্রী | প্রথম ভালোবাসা সাহিত্য | তিন দশক ধরে ভাষান্তরের কাজে যুক্ত | বেশ কিছু অনূদিত বই প্রকাশিত হয়েছে সাহিত্য অকাদেমি , ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট , প্রতিভাস ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে | ভাষান্তরের পাশাপাশি নিজস্ব অনিয়মিত লেখালেখির ফসল হিসেবে টুকরো গদ্য, ছোট গল্প , কবিতায় এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত বই ন'টি |

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.