“এ পথে আমি যে গেছি বারবার -”
প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য্য
এ খেলায় জিত মানে সোনার মেডেল নয়, পোডিয়ামের আপেক্ষিক উচ্চতা নয়, দু’হাতে আঁকড়ে ধরে পরমাকাঙ্খিত ট্রফিতে গভীর আশ্লেষে চুম্বন নয়, বা স্টেডিয়াম-ভর্তি জনতার হাততালির পায়রা উড়িয়ে দেওয়াও নয়। এমনকি জিত মানে শুধু প্রাণটুকু নিয়ে বেঁচে ঘরে ফেরবার নিশ্চিতিও নয়। বরং জিত মানে নিঃসীম একাকীত্ব, শুধু কানের পাশে নীহারবিন্দুবাহী সুতীক্ষ্ণ বাতাসের অভিবন্দনা। জিতলে সুযোগ আছে মরলোকে দাঁড়িয়ে অমরাবতী দর্শনের, হারলে আছে ফিরে ফিরে আসবার কালান্তক নিশির ডাক। আর, শেষ পর্যন্ত হয়তো আছে নির্জনতম মহামরণ। একে কি নিছকই খেলা বলা চলে ?
*****
বেসক্যাম্প
চতুর্দশ রোমসম্রাট হ্যাড্রিয়ান (চিত্র উইকিপিডিয়া) |
খুঁজে পেতে জানা যাচ্ছে, চতুর্দশ রোমসম্রাট হ্যাড্রিয়ান স্রেফ সূর্যোদয় দেখবেন বলে সিসিলি দ্বীপে মাউন্ট এটনার (৩,৩৫০ মি.) চুড়োয় চড়েছিলেন! হ্যাড্রিয়ানের কীর্তিকলাপ কিছুটা আলাদা হওয়া স্বাভাবিক, কারণ ইতিহাস বলছে ভদ্রলোক ঠিক কাঠখোট্টা রাজদন্ডধারী অত্যাচারী শাসক ও পররাজ্যলোভী যুদ্ধবাজ ছিলেন না। সৈন্যসামন্তের সঙ্গ পছন্দ করলেও, রাজ্যাভিষেকের পরে পরেই পূর্ববর্তী সম্রাট ট্রাজানের জয়-করা মেসোপটেমিয়া, আসিরিয়া ও আর্মেনিয়া থেকে সৈন্য তুলে নেন। বলা যায় খানিক মানবতাবাদী ছিলেন, কবিতাও লিখতেন, মধ্যযুগের ইতালীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নিকোলো ম্যাকিয়াভেল্লি ওঁকে রোম সাম্রাজ্যের পাঁচ-‘সু’সম্রাটের একজন বলে অভিহিত করেন (১৫০৩)।
এহেন হ্যাড্রিয়ানের ওই ‘এটনা’-শৃঙ্গারোহণই যদ্দুর জানা যাচ্ছে, পর্বতারোহণের ইতিহাসের সূচনাবিন্দু হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। তখনকার কালে নিশ্চিতভাবেই দুর্গম পাহাড়পর্বতে চড়াটা খেলা ছিল না, বরং ছিল বিপুলা এ পৃথিবীর অনাবিষ্কৃত ও দুরারোহ অংশে পা ফেলবার অকৈতব অন্বেষা। এবং, অচিরেই আবহগত, ভূতাত্ত্বিক ও জীবতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ এহেন কর্মের মূল উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে কিছু প্রকৃতিবিজ্ঞানী (ব্রিটানিকা বলছেন Natural Scientists) ক্ষেত্রসমীক্ষার উদ্দেশ্যে নিয়মিত আল্পস ও সন্নিহিত দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে ঘোরাঘুরি শুরু করেন। এঁদের কাছে ইওরোপের উচ্চতম শৃঙ্গ মঁ ব্লা-র (Mont Blanc, ৪৮০৭ মি.)পাদদেশে দক্ষিণ-পূর্ব ফ্রান্সের শ্যামোনি (Chamonix) জনপদটি বিশেষ আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, মুলতঃ আল্পসের বিখ্যাত হিমবাহগুলির নৈকট্যের কারণে। ১৭৬০এ জেনেভাবাসী বৈজ্ঞানিক হোরাস বেনেডিক্ট-দ্য-স্যসার (Horace Benedict-de-Saussure) প্রথমবার শ্যামোনিতে আসেন ও ছোট্ট পাহাড়ি জনপদটির মাথায় পটে আঁকা ছবির মত মঁ ব্লা-কে দেখে প্রতিজ্ঞা করেন ওর মাথায় চড়বার। কয়েকবারের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে তিনি ঘোষণা করে বসেন, যিনি প্রথম মঁ ব্লা আরোহণ করবেন তাঁকে তিনি পুরষ্কৃত করবেন। নয় নয় করে সিকি শতাব্দী কেটে যায় সে পুরষ্কারের দাবীদার পেতে। শেষে ১৭৮৬তে শ্যামোনিরই এক ডাক্তারবাবু মিশেল-গ্যাব্রিয়েল পেকার্ড (Michel-Gabriel Peccard) পোর্টার জ্যাক বালমাকে (Jacques Balmat)সঙ্গে নিয়ে প্রথম মঁ ব্লা জয় করেন। পরের বছরই স্যসারের নিজের স্বপ্নপূরণ হয়, উনিও মঁ ব্লা আরোহণ করতে সমর্থ হন।
বলা যায়, পেকার্ড এবং বেনেডিক্ট-দ্য-স্যসারের উপর্যুপরি এই মঁ ব্লা অভিযান থেকেই নিছক ‘অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস’ হিসেবে আধুনিক পর্বতারোহণের সূচনা। ১৮৫৭ সালে লন্ডনে পর্বতপ্রেমী ও অভিযাত্রীদের নিয়ে “অ্যালপাইন ক্লাব” স্থাপিত হ’ল। এর পরেই ব্রিটেন, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড ও ইতালির অভিযাত্রীরা সুইস আল্পস চষে ফেলে একের পর এক তার শৃঙ্গগুলি জয় করতে শুরু করেন। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ১৮৬৫ সনে ব্রিটিশ শিল্পী এডোয়ার্ড হোয়াইম্পারের পুরোদস্তুর দলবল নিয়ে ম্যাটারহর্ন (৪৪৭৮ মি.) শৃঙ্গজয়। পেকার্ড থেকে হোয়াইম্পার – এই আশি বছরের মধ্যে পর্বতারোহণ একটি অতি রোমাঞ্চকর খেলা হিসেবে ইওরোপে মূলতঃ ‘এলিট’ সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। ওই অ্যালপাইন ক্লাবের সদস্যদের পর্বতারোহণ পদ্ধতি বিখ্যাত হয় ‘অ্যালপাইনিস্ট ক্লাইম্বিং টেকনিক’১ নামে, যাতে পর্বতারোহী স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবে আরোহণ করবেন, সঙ্গে বয়ে নিয়ে যাবেন পর্বতারোহণের যাবতীয় সামগ্রী, রসদ ইত্যাদি। ১৮৭০ নাগাদ আল্পসের কোন শৃঙ্গই আর বাকি রইল না যখন, তখন ইওরোপের এই অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীর দল দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ, উত্তর আমেরিকার রকি মাউন্টেন, আফ্রিকা ও ককেশাস এবং এশিয়ার সুউচ্চ পর্বতগুলির দিকে নজর ঘোরানো শুরু করেন। এবং, বলাই বাহুল্য, পৃথিবীর বুকে সর্ব অর্থেই মহত্তম পর্বতমালা হিমালয় দুনিয়ার সমস্ত পর্বতারোহীদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে ওঠে ঊনবিংশ শতকের শুরু থেকেই। এ ব্যাপারে সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানী, অস্ট্রিয়া ও ব্রিটেনের পর্বতারোহী দলগুলিই অগ্রণী। সুউচ্চ পর্বতারোহণ অভিযান সংগঠন সেই কালে ওই প্রথম বৈশ্বিক দেশগুলির একচেটিয়া; স্থানীয় পথপ্রদর্শক, মালবাহক যাদের সাহায্য ব্যতিরেকে সে সব অভিযান কিছুতেই সফল হ’ত না, তাদের কথা ইতিহাস তেমন গুরুত্ব সহকারে লিখে রাখেনি। এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ব্রিটিশরা হিমালয় ও প্রধানতঃ পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয়কে পাখির চোখ করে ফেলে।
হিমালয়ে প্রথম সফল পর্বতারোহণ অভিযান অবশ্য এক জার্মান দলের, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধার ঠিক আগে ১৯৩৬এ ৬৮৮৮ মি. উঁচু সিনিয়লচুতে। একই বছরে ইংরেজরাও নন্দাদেবী (৭৮১৭ মি.) জয় করে। প্রথম আট-হাজারি (মিটার) শৃঙ্গে অভিযানের ইতিহাস ব্রিটিশ অ্যালবার্ট মামেরি ও নরম্যান কুলির, পাকিস্তানের (ব্রিটিশ ভারত) নাঙ্গাপর্বতে কোন সেই আদ্দিকালে ১৮৯৫ সালে। অসফল সেই অভিযানের পরিণতি বিয়োগান্তক, স্বয়ং মামেরি ও দুই গোর্খা পোর্টার রাঘোবীর আর গোমান সিং বরফের ধ্বসে (avalanche) প্রাণ হারান। যুদ্ধ শেষ হতে ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ - দশ বছরের মধ্যে অন্নপূর্ণা দিয়ে শুরু করে পর পর নাঙ্গাপর্বত, কাঞ্চনজঙ্ঘা, লোৎসে, তারপর কারাকোরামে গডউইন অস্টিন ওরফে কে-২, চো-ইও, ব্রড পিক এবং মোট যে চৌদ্দটি২ আট-হাজারি শৃঙ্গ আছে পৃথিবীতে (সব ক’টি হিমালয় ও কারাকোরাম পর্বতমালায় অবস্থিত) তার মধ্যে একমাত্র শিশোপাংমা (১৯৬৪তে চীনা পর্বতারোহী দল প্রথম সফল শৃঙ্গারোহণ করে) বাদে বাকি তেরোটিই বিভিন্ন ইওরোপীয়, আমেরিকান ও জাপানী পর্বতারোহী দল জয় করে ফেলেছিল। এবং, পৃথিবীর সর্বোচ্চ শিখর মাউন্ট এভারেস্ট (৮৮৪৮মি.)৩। ১৯২১ থেকে লাগাতার একের পর এক ব্যর্থ অভিযান, দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর মূল্যে শেষ পর্যন্ত ১৯৫৩র ২৯শে মে নিউজিল্যান্ডের এডমুন্ড হিলারি ও স্থানীয় শেরপা তেনজিং নোরগে এভারেস্ট জয় করেন, পৃথিবীর মুকুটশীর্ষে বুঝি সেই প্রথম (তাই কি? ক্রমশঃ প্রকাশ্য) মানুষের পা পড়ল!
ভারত, হিমালয় ও এভারেস্টঃ কিছু ঐতিহাসিকতা
ভারতে পর্বতারোহণের সুত্রপাতের কাহিনীর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে ১৯৩৫এ স্থাপিত ভারতের প্রথম পাব্লিক স্কুল, দুন স্কুল। স্কুলের প্রথম হেডমাস্টারমশাই আর্থার ফুট নিজে ছিলেন আলপাইন ক্লাবের সদস্য ও অত্যুৎসাহী এক পর্বতারোহী। জন মার্টিন, জ্যাক গিবসন আর রোমিলি লেসলি হোল্ডসওয়ার্থ (ওরফে হোল্ডি) নামে আরো তিন-তিনজন অভিজ্ঞ পর্বতারোহী ও আলপাইন ক্লাবসদস্য আর্থার ফুটের অবিমিশ্র পর্বতপ্রেমের ডাকে সাড়া দিয়ে দুন স্কুলে হাউজমাস্টার হিসেবে যোগ দেন। তা এই ব্যাচেলর তিন পাহাড়প্রেমী হাউজমাস্টারমশাইরা যে স্কুলের আবাসিক ছাত্রদের নিয়ে ছুটিছাটা পড়লেই দেহরাদুন ও আশপাশের পাহাড়ি এলাকা চষে ফেলতে শুরু করবেন, তাতে আর আশ্চর্য কি? এ নেশার টান যে মারাত্মক, একটু লম্বা গোছের ছুটি পেলেই গাড়ওয়াল হিমালয়ের অন্তঃপুরে হানা দেওয়া শুরু করলেন তাঁরা। ১৯৪২এ ইস্কুলের তিন ছাত্র নন্দু জয়াল, রবি মাথাই আর বলরাম সিং আর তাঁদের তিন পাহাড়চষা শিক্ষক বদ্রিনাথ পেরিয়ে ঊনিশ হাজার ফিট উঁচুতে একেবারে আরওয়া হিমবাহের উপর ক্যাম্প পাতলেন। উদ্দেশ্য ছিল আশেপাশের বিশ হাজার ফিটের দু’ চারটে শিখরে চড়ে হাত পাকাবেন। কিন্তু, সে যাত্রায় বিধি বাম, বর্ষা এসে ব্যাগড়া দেয়। কিন্তু দেশে পর্বতারোহণ বস্তুটার সূচনাটা হয়েই যায়। তিন বছর পরে দুন স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন গুরদয়াল সিং, আরেক নিখাদ পর্বতপ্রেমী। ততদিনে ইস্কুলের ছাত্ররাও পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে পাহাড়ের অমোঘ আকর্ষণে বাঁধা পড়ে গেছে। পরের বছরই তাঁরা ছাত্র-শিক্ষকের দল গাড়ওয়ালের বান্দরপুঞ্চ (৬৩২৫ মি.) শৃঙ্গজয়ে লেগে পড়েন। এ অভিযানে বিশেষ তাক-লাগানো খবর হল, তাঁদের সেই দলে শেরপা হিসেবে ছিলেন দাওয়া থান্ডুপ, ধ্যান সিং এবং তেনজিং নোরগে! সেবারেও একবারে মাথা নোয়ায়নি বান্দরপুঞ্চ। দুন ইস্কুলের দলও নাছোড়বান্দা, তারা শিক্ষক জ্যাক গিবসনের নেতৃত্বে আবার ফিরে আসে ১৯৫০এর জুনে, এবং ২০শে জুন তেনজিং ও রয় গ্রীনউড বান্দরপুঞ্চ শৃঙ্গ জয় করেন। তেনজিং পরবর্তীকালে তাঁর আত্মজীবনীতে বান্দরপুঞ্চ শিখরকে “দুন ইস্কুলের পাহাড়” (The Doon School Mountain) নামে অভিহিত করেছেন। ভারতে পর্বতারোহণের ইতিহাসে দুন স্কুল হল সূতিকাগার। বান্দরপুঞ্চ দিয়ে শুরু করে দুন স্কুলের ছাত্ররা পরবর্তী কয়েকবছরের মধ্যেই ত্রিশুল, কামেট, মৃগথুনি প্রভৃতি শৃঙ্গগুলি জয় করে ফেলেন।
এভারেস্টের পথে প্রথম ভারতীয় দল (১৯৬৫) |
‘দুনে’র ধারায় ভেসে ভারতের প্রথম পূর্ণাঙ্গ পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ১৯৫৪ সালের ৪ঠা নভেম্বর দার্জিলিং-এ জন্ম নিল হিমালয়ান মাউন্টেনীয়ারীং ইন্সটিটিউট (HMI)। দশ বছর পরে ১৯৬৫তে উত্তরকাশীতে স্থাপিত হয় নেহেরু ইন্সটিটিউট অফ মাউন্টেনীয়াং (NIM)। ভারতীয়দের পুরোদস্তুর সুপ্রশিক্ষিত পর্বত-অভিযাত্রা এই দুই সংস্থার হাত ধরে শুরু হয়ে গিয়েছে সেই পঞ্চাশ-ষাটের দশক থেকেই। নৌসেনার ক্যাপ্টেন মোহন সিং কোহলির নেতৃত্বে সম্পূর্ণ ভারতীয় (ফৌজি) দলের হয়ে এভারেস্টের শীর্ষে প্রথম পা রাখেন অবতার সিং চিমা, সাথে শেরপা নোয়াং গোম্বু। ১৯৬৫ সালের সেই ২১ সদস্যের ভারতীয় দলের নয়জনই এভারেস্টের চুড়োয় পৌঁছতে সক্ষম হ’ন, মে মাসের ২০ থেকে ২৯ তারিখের মধ্যে, চার খেপে। সেটা ছিল সেই সময়ে বিশ্বরেকর্ড! নোয়াং গোম্বুর বিশ্বরেকর্ড আরো রোমহর্ষক, উনি আগে ১৯৬৩র আমেরিকান দলের সঙ্গে একবার এভারেস্টে চড়েছিলেন। উনি হলেন পৃথিবী প্রথম ব্যক্তি যিনি দু’ দুবার এভারেস্ট জয় করেন! দল ফিরে আসলে ভারত সরকার তাঁদের কৃতিত্বের স্বীকৃতি হিসেবে দলের নয়জন এভারেস্টজয়ী ও দলনেতা, উপনেতাসহ মোট এগারোজনকে ‘অর্জুন’ পুরষ্কারে ভূষিত করবেন মনস্থ করেন। বেঁকে বসেন দলনেতা মোহন সিং কোহলি, প্রকৃত অধিনায়কের মতই বলেন, হয় তাঁদের পুরো ঊনিশজনের দলকেই এই পুরষ্কার দিতে হবে, নয়তো কাউকেই দেওয়ার দরকার নেই। এই গৌরবে দলের ঊনিশজন সদস্যের প্রত্যেকের অবদান সমান। ভারত সরকার বেশ খানিক টানাপোড়েনের পরে কোহলির যুক্তি মেনে গোটা দলকেই অর্জুন পুরষ্কারে ভূষিত করেন। ভারতে দলগত ‘অর্জুন’-প্রাপ্তির এটাই একমাত্র ঘটনা!
নর্থ কল থেকে সাউথ কল – ‘কলস আর কলিং’!
মোটামুটি এই অবধি পড়ে পাঠকের ধারণা হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে পর্বতারোহণ মূলতঃ সম্পন্ন শ্রেণীর শখের খেয়াল, আর ভারতে সেটা ফৌজি দলগুলোর একচেটিয়া। শুরুতে তাই ছিল বটে। তবে সারা পৃথিবী জুড়েই হাই অল্টিচিউড মাউন্টেনীয়ারিং (এবং হাই অল্টিচিউড ট্রেকিং) নিতান্ত সাধারণের মধ্যেও অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করেছে সত্তরের দশকের শেষভাগ থেকে। প্রথম সব ক’টি আট হাজারি (মিটার) শৃঙ্গজয়ী ইতালির রেইনহোল্ড মেসনার ছিলেন সাধারণ স্কুলশিক্ষকের পুত্র। প্রথম মহিলা এভারেস্টজয়ী (১৯৭৫) জাপানের জুনকো তাবেই ফুকুশিমায় মোটেও রূপোর চামচ মুখে নিয়ে জন্মাননি। জুনকোর প্রতিষ্ঠিত জাপানী লেডিজ ক্লাইম্বিং ক্লাবের যে পনেরোজন সদস্যা এইকো হিসানোর নেতৃত্বে ১৯৭৫এ এভারেস্ট অভিযানে যান, তাতে ছিলেন স্কুলটিচাররা, ছিলেন কম্পিউটার প্রোগ্রামার।
বিদেশ ছেড়ে ভারতের দিকে নজর ফেরালেও দেখা যাবে, গত চার দশকে পর্বতারোহণ জনপ্রিয়তার অভূতপূর্ব মাত্রা স্পর্শ করে ফেলেছে। ভারতের প্রথম মহিলা এভারেস্টজয়ী বাচেন্দ্রী পাল (১৯৮৪) গাড়ওয়ালের প্রত্যন্ত গ্রামের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সন্তান। মানালি থেকে রোটাং যেতে পলচন গাঁয়ের ডিকি দোলমা বিশ্বের কনিষ্ঠতমা হিসেবে এভারেস্ট জয় করেছিলেন ১৯৯৩ সালে মাত্র ঊনিশ বছর বয়েসে! আমাদের বাঙালীদের প্রথম ‘এভারেস্টার’ দেবাশিস বিশ্বাস, বসন্ত সিংহরায়েরাও তো বলতে গেলে পাশের বাড়িরই বাসিন্দা। দেবরাজ দত্ত, দেবব্রত মুখার্জী, প্রদীপ সাহু ও তাঁর স্ত্রী মিসেস চেতনা সাহু – এঁরাও কেউ দূরের নীহারিকা নন। এই বছরই এভারেস্টজয়ী শেখ সাহাবুদ্দিন ইছাপুর গান ও মেটাল ফ্যাক্টরির সাধারণ কর্মী, সাহাবুদ্দিনের সঙ্গী ছিলেন কুন্তল কাঁড়ার। বমডিলার অংশু জামশেনপা যিনি দু’ দুবার এভারেস্টে চড়ে বসলেন এই ক’দিন আগে মে মাসে, তিনি আবার দুই ছেলেমেয়ের মা! হাওড়ার মেয়ে, থুড়ি, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘাদুহিতা’ ছন্দা গায়েন, টুশি দাস বা মনিদীপা দত্তদেরও তো প্রতিদিনই পথেঘাটেই দেখি। আলাদা করে চিনিয়ে না দিলে এঁদের কাউকেই অতিমানবীয় কোনো কীর্তি স্থাপন করে এসেছেন বলে বোঝা দুষ্কর। তবে হ্যাঁ, আটপৌরে সংসারী মানুষদের চেয়ে এঁদের তফাৎ কি নেই? আছে বই কি। তফাৎটা তো সেই কবে জর্জ ম্যালোরিই বলে গিয়েছেন -
বেহালা, বরানগর, দুর্গাপুর, আসানসোল, শিলিগুড়ি, কৃষ্ণনগরের মত জায়গায় মাউন্টেনীয়ারিং ক্লাব এখন অনেকগুলো, তাঁদের সদস্যরা প্রতি বছরই পর্বতারোহণে নতুন নতুন কীর্তি স্থাপন করে চলেছেন, কিছুটা যেন অগোচরেই। যদিও পর্বতারোহণ ইদানীং সংবাদমাধ্যমের আনুকুল্য একেবারে যে পাচ্ছে না, বলা যাবে না।
‘ওরে বাবা দেখো চেয়ে কত সেনা চলেছে সমরে -’ |
বছর কয়েক আগে একটি ছবি পত্রপত্রিকায়, স্যোসাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল মনে পড়ে। এক ঝকঝকে সকালে মাউন্ট এভারেস্টের চুড়োর (Summit Pyramid)পথে সর্বশেষ গিরিশিরাটির ঢালে শৃঙ্গ-জয়েচ্ছু অগণিত পর্বতারোহীর সারি! পর্বতারোহণের অত্যাধুনিক সরঞ্জামে আপাদমস্তক সজ্জিত নানান দেশ থেকে আগত পর্বতারোহীরা প্রায় পিকনিক-মুডেই সার দিয়ে অপেক্ষা করছেন একে একে এভারেস্টের মাথায় পা রাখবেন বলে। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার খবর অনুযায়ী ২০১২র সেই বিশেষ দিনটিতে (১৯শে মে) ৭৯০০ মিটার উচ্চতায় এভারেস্টের চুড়োর পথে লোৎসের দিকের ঢালে(সাউথ কল) ৩৯টি আলাদা আলাদা অভিযাত্রীদলের প্রায় ৬০০ জন সার দিয়েছিলেন এভারেস্ট জয় করবেন বলে! প্রবীণ জার্মান পর্বতারোহী র্যালফ দ্যুমোভিটস (Ralf Dujmovits) সেদিন অকুস্থলে উপস্থিত ছিলেন। তিনি ফিরে এসে ব্যথিত হয়ে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে ৪ বলেছেন, এই নব্য পর্বতারোহীর দলের বেশিরভাগই “Hobby Climber”, শখের পর্বতারোহী! আরো বলছেন,
সুত্রে প্রকাশ, সেই একদিনে এভারেস্টের মাথায় উঠেছিলেন ২৩৪ জন! প্রবাদপ্রতিম দুই শেরপা আপা শেরপা ও ফুর্বা তাশি দু’জনেই বিভিন্ন দলকে নিয়ে এভারেস্টে চড়েছেন নয় নয় করে ২১ বার! এভারেস্টের পথে ট্র্যাফিক জ্যাম হতে আর কি বাকি রইল, অভিযাত্রীদলের ফেলা-আসা আবর্জনার পাহাড়ের বিষাক্ত প্রসঙ্গ না হয় না-ই বা তুললাম। পোড়-খাওয়া পর্বতারোহীরা অনেকেই সখেদে বলেছেন, পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এখন যাকে বলে “Tourist Peak”, পর্যটকের টিলা মাত্র! সর্বোচ্চ শৃঙ্গেরই যদি এই হাল হয়, বাকিদের কথা (কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে) আর কি বলব।
একটি অকিঞ্চিৎকর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে ইচ্ছে করছে এইখানে। পশ্চিম সিকিমের জোংরি (হাই অল্টিচিউড ট্রেকারদের অন্যতম প্রিয় একটি জায়গা) পেরিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার পায়ের কাছে রাথোং গ্লেসিয়ারের নীচে HMI-এর বেস ক্যাম্পের পথে জিরোতে বসেছি, ২০১২র অক্টোবরের এক রোদ-ঝলমলে দিনে। মালবাহক পোর্টারের দলও আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে, চুট্টা জ্বালিয়েছে কেউ কেউ। সেই সময় নানান কথায় এক পোর্টার ছোকরা আমায় বলে কি, আপ মাউন্ট এভারেস্ট যাওগে স্যার? আমি চোখ কপালে তুলে বলি, বেটা পাগল হ’লি, নাকি হাই অল্টিচিউড সিকনেস হল তোরও? সে নিরুত্তাপ ও শীতল আত্মবিশ্বাসের স্বরে আমায় বলেছিল, কোনো ব্যাপারই নয় স্যার। থোড়া ফিটনেস বাড়হাকে আউর সাত-আট লাখ রূপেয়া লেকে চলে আনা, ম্যায় আপকো আরামসে চড়া দুঙ্গা এভারেস্টকে উপর! ম্যায় তো ‘সামার’ মে এভারেস্টপেই কাম করতা হুঁ, পু্রা রাস্তামে রোপ লাগা হুয়া হ্যায়, চড়নে মে কোই দিককত নেহি হোগা আপকো! ছেলেটির বয়েস কত আর হবে, বছর কুড়ি-বাইশ, নাম কেইসাং। বাড়ি সিকিমেই, তবে শীতের শেষেই ও এভারেস্টের পথে নেপালের নামচেবাজার চলে যায়। বিভিন্ন অভিযাত্রী দলের সঙ্গে শেরপা হয়ে বার দুয়েক এভারেস্টে চড়া হয়ে গিয়েছে ওর সেই বয়েসেই। সেপ্টেম্বর থেকে ওদিকে আর তেমন কাজ থাকে না (এভারেস্টে শীতেও অভিযান চলে আজকাল, তবে সংখ্যায় বসন্তের তুলনায় অনেক কম, ফলে ওদের কাজের সুযোগও কম) তাই এদিকটায় চলে আসে এবং বিভিন্ন ট্রেকিং টিমের গাইড বা পোর্টারের কাজ করে দু’ পয়সা কামায় কেইসাং। শুধু উঁচু উঁচু শিখর চড়িয়ে সম্বৎসর সংসার চালানো অসম্ভব কিনা!
ক্রিভাস
তথ্যে পাওয়া যাচ্ছে, আজ অবধি (Spring 2017) মাউন্ট এভারেস্টে চড়ে ফেলেছেন প্রায় ৭৩০০ জন, অথচ দ্বিতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ কে-টুতে সেই সংখ্যা ৩৫০-এর আশেপাশে, তৃতীয় কাঞ্চনজঙ্ঘায় ৩০০-ও নয়। কে-টুকে সবচেয়ে দুরারোহ শৃঙ্গ মানা হয়ে থাকে, বিশেষতঃ ওর পাদদেশের বেসক্যাম্প অবধি পৌঁছনোটাই একটা বিরাট শ্রমসাধ্য ব্যাপার বলে, সঙ্গে ভয়ানক অনিশ্চিত আবহাওয়া তো আছেই। কাঞ্চনজঙ্ঘায় শুনেছি শেরপা পাওয়া ঝামেলার, ওটিকে পবিত্র শৃঙ্গ মানা হয় কিনা। কিন্তু এভারেস্টেরও তো তিব্বতী নাম ‘চোমোলাঙমা’ যার অর্থ ‘ধরিত্রীর দেবীমাতা’ (Goddess Mother of Earth), ওতে এই প্রবল ভিড় কেন? তাহলে কি এভারেস্ট চড়ায় বিশুদ্ধ প্রকৃতি ও পর্বতপ্রেম নয়, আরো অন্য ভেজাল এসে মিশেছে আজ? যথা, গ্ল্যামার; যথা, স্পনসরশিপ ও ভবিষ্যত অভিযানে অর্থসহায়তা বা জীবিকার ক্ষেত্রেও সুবিধা? ফলস্বরূপ পর্বতারোহণে পুরোদস্তুর প্রশিক্ষিত ও সর্বরকমে তৈরি না হয়েই চলে আসছেন নানান দেশের মানুষ, এবং ভারতীয়রাও? তাই কি দুর্ঘটনা বাড়ছে দিন কে দিন? শুধু এভারেস্টেই অদ্যাবধি মৃত্যুর সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়েছে, যার মধ্যে ১২০টির বেশি দেহ আজও উদ্ধার করা যায়নি। অন্নপূর্ণায় গড়ে প্রতি শৃঙ্গজয়-পিছু মৃত্যুর হার ৩। গত বছরই পশ্চিমবঙ্গের চার অভিযাত্রীর দুর্ঘটনার খবর মিডিয়াতে তোলপাড় ফেলেছিল। এভারেস্ট থেকে নামবার সময় তুষারঝড়ে পড়েছিলেন তাঁরা। হেলিকপ্টারে করে উদ্ধার-করে-নামিয়ে-আনা বারাসতের সুনীতা হাজরা ফ্রস্টবাইটের ছোবল খেয়েও ফিরে এসেছিলেন, সুভাষ পাল কাঠমান্ডুর হাসপাতালে মারা যান। ব্যারাকপুরের গৌতম ঘোষের দেহ এই মে মাসে খুঁজে পাওয়া গেছে, আর দুর্গাপুরের পরেশ নাথ এভারেস্টের তুষাররাশির মধ্যে আজও রয়েই গেছেন। ছন্দা গায়েন এভারেস্ট ও লোৎসে জয় করেছিলেন একই অভিযানে ২০১৩এ। পরের বছর কাঞ্চনজঙ্ঘার মূল শিখরটি জয় করেও বেসক্যাম্পে ফিরে না এসে একই টানে পশ্চিম শিখরটি (ইয়েলুঙ কাং) জয় করতে গিয়ে চিরতরে কাঞ্চনজঙ্ঘার ক্রোড়ে আশ্রয় নিয়েছেন। সঙ্গী শেরপা ফিরে এসে বলেছেন, প্রথম শিখরটি জয়ের পর তাঁর নিষেধ সত্ত্বেও ছন্দা ক্লান্তি ও আরো নানা বিষয়কে উপেক্ষা করে জেদ করেন ইয়েলুঙ কাং জয় করবেন। এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত কেন?
অভিজ্ঞ পর্বতারোহীদের অভিমত, এতে আর যাই হোক, নিখাদ পর্বতপ্রেম কিন্তু অনুপস্থিত। কারণ প্রকৃতির কোলে যে কোন অভিযানের প্রথম শর্ত, প্রকৃতির নিয়ম মান্য করে চলা। আধুনিক পর্বতাভিযানের বেশিরভাগ সে শর্ত মেনে হচ্ছে বলে মনে হয় না। নেপালের কথাই ধরা যাক। ওদিক দিয়েই এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, লোৎসে প্রভৃতি তথাকথিত গ্ল্যামারাস শৃঙ্গ অভিযান হয় বেশি। আর তা থেকেই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এই দেশটির, বড়সড় শিল্প কিছু নেই ও দেশে। এভারেস্টের দক্ষিণ ঢালে ছ’শো লোককে লাইন দিতে দেখে র্যালফ দ্যুমোভিটস যতই দুঃখ করুন না কেন –
নেপাল ওইসব পাহাড়-চড়ায় কড়াকড়ি করে নিজের বহুমূল্য ডলার আয়ের পথ আটকাতে যাবে কোন দুঃখে?
সেই কোডাক ক্যামেরাটি
জর্জ হার্বার্ট লেই ম্যালোরি |
১৯৯৯এ কনরাড অ্যাঙ্করদের এভারেস্ট অভিযানটি ছিল ‘ম্যালোরি অ্যান্ড আরভিন রিসার্চ এক্সপেডিশান’। দলে আরো ছিলেন এরিক সিমনসন, জোক্যেন হোমেলব, ডেভ হান, জেক নর্টন, অ্যান্ডি পোলিটজ, ট্যাপ রিচার্ডস ইত্যাদি বাঘা বাঘা পর্বতারোহী। বিশ্বের পর্বতারোহণের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত রহস্য উদ্ঘাটনের মানসে বেরিয়েছিল দলটি। যে রহস্য বিশ্বের সমস্ত পর্বতপ্রেমীদের বিশ্বাসকে দ্বিধান্বিত করে রেখেছে আজও, তেনজিং আর হিলারিই কি এভারেস্টের চুড়োয় পৌঁছানো প্রথম মানব(যুগল)? নাকি, সেই কবে ১৯২৪এ চার্লস ব্রুসের নেতৃত্বে ব্রিটিশ অভিযানে সেকালের শ্রেষ্ঠতম পর্বতারোহী জর্জ হার্বার্ট লেই ম্যালোরি ও বাইশ বছরের এঞ্জিনীয়ারিং ছাত্র অ্যান্ড্রিউ ‘স্যান্ডি’ আরভিনই সে গৌরবের প্রকৃত দাবীদার?
৮ই জুন ১৯২৪, দুপুর ১২.৫০ নাগাদ ছয় নম্বর ক্যাম্পের (২৭০০০ ফিট) কাছ থেকে সেই ব্রিটিশদলের আরেক সদস্য ভূতাত্ত্বিক নোয়েল ওডেল ম্যালোরি আর আরভিনকে শেষ দেখেন সাদা বরফের উপর দু’টি সচল বিন্দুর মত, এভারেস্টের চূড়া থেকে মাত্র হাজারখানেক ফিট নীচে, ওই ফার্স্ট বা আরো উপরে সেকেন্ড স্টেপের কাছে। তারপরেই মেঘের ঝাঁক এসে দৃশ্যপট মুছে দেয়। আগে দু’ দু’বার শৃঙ্গজয়ের প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে খারাপ আবহাওয়ার কারণে। কিন্তু নোয়েল নিশ্চিত ছিলেন, এ যাত্রায় ম্যালোরিরা বিজয়ী হবেনই হবেন, বিজয়শিখর যে প্রায় হাত-বাড়ালেই-ছোঁয়া-যাবে এমন দূরত্বে! বিকেল গড়িয়ে রাত নামে, এক সময় ভোরও হয়, ৯ই জুনের ভোর। কিন্তু ম্যালোরিরা আর কখনো ফিরে আসেননি।
১৯৯৯এর ‘ম্যালোরি অ্যান্ড আরভিন রিসার্চ এক্সপেডিশান’এর মূল লক্ষ্য ছিল অ্যান্ড্রিউ আরভিনের দেহ ৫ আর হাওয়ার্ড সামারভেলের সেই কোলাপসিবল ভেস্টপকেট মডেল কোডাক ক্যামেরাটা খুঁজে বার করা, যেটা ম্যালোরি আর আরভিন সঙ্গে নিয়েছিলেন শৃঙ্গজয়ের ছবি তুলে রাখবার জন্য। অত্যন্ত হিসেব কষে পরিকল্পনা করে আটঘাট বেঁধে অত্যাধুনিক সরঞ্জাম, কম্পিউটার, স্যাটেলাইট ফোনে বলীয়ান হয়ে কাজে নামে ‘ম্যালোরি অ্যান্ড আরভিন রিসার্চ এক্সপেডিশান’।
ম্যালোরি (বাঁয়ে) ও আরভিনের (ডাইনে অক্সিজেন সিলিন্ডার পিঠে) শেষ ছবি – শৃঙ্গজয়ের উদ্দেশ্যে ক্যাম্প ছেড়ে বেরোচ্ছেন |
পঁচাত্তর বছর ধরে অজস্র সন্ধানী অভিযানে আত্মপ্রকাশ না করা জর্জ লেই ম্যালোরি এই অভিযানে যেন সহজেই ধরা দিলেন। অভিযানের তৃতীয় দিনেই কনরাড অ্যাঙ্কর খুঁজে পেলেন জর্জ ম্যালোরির প্রায় অবিকৃত মরদেহ, এভারেস্টের উত্তর-পূবের ঢালে প্রায় ২৬,৭৬০ ফিট উচ্চতায়। অভিযান শেষে ফিরে এসে অভিযানে সংগৃহীত তথ্য ও বিগত সাত দশকের জমা হওয়া নথিপত্র ঘেঁটে ১৯৯৯এর দলের দৃঢ়মূল ধারণা, এভারেস্টের চুড়োয় প্রথম মানুষ ম্যালোরি ও আরভিন! তাঁদের স্থির বিশ্বাস, ৮ই জুন সন্ধ্যের মুখে দু’জনেই শৃঙ্গারোহণ করেন। তারপর ফিরতি পথে সূর্য যায় ডুবে, ম্যালোরি তাঁর বরফচশমা চোখ থেকে খুলে ভেস্টপকেটে রাখেন। তারার আলোয় পদে পদে মৃত্যুময় সে পথে নামতে নামতে শ্রান্ত অভিযাত্রীর পা পিছলে যায়। ছিঁড়ে যায় পরস্পরের সঙ্গে বাঁধা দড়ি, বরফের খাড়া ঢাল বেয়ে হড়কে বহু নীচে সেন্ট্রাল রংবুক গ্লেসিয়ারের দিকে নেমে আসতে আসতে সজোরে পাথরে আছড়ে পড়েন ম্যালোরি, পাঁজরের হাড় চূর্ণ হয়ে যায়, বুটজুতোর ঠিক উপরে ডান পা’য়ের টিবিয়া-ফিবুলা ভেঙ্গে যায়। অসহ্য যন্ত্রণাতেও সম্ভবত জ্ঞান হারাননি হিমালয়পুত্র ম্যালোরি, আপ্রাণ শক্তিতে আঁকড়ে ধরবার চেষ্টা করেন পাহাড়ের গা। এমন সময় তাঁর মাথা ঠুকে যায় আরেকটি তীক্ষ্ণ পাথরখন্ডে। অবশেষে চুড়ো থেকে প্রায় সোয়া দু’ হাজার ফিট নীচে স্তব্ধ হয় অধোগতি। নিঃসীম বরফে উপুড় হয়ে শোয়া ম্যালোরি যখন শেষবারের মত শ্বাস নেন বুক ভরে, তখনো তিনি সর্বশক্তি দিয়ে তাঁর প্রিয়তম পাহাড়ের শরীর আঁকড়ে ছিলেন। সদ্য যুবা আরভিনের পরিণতিও প্রায় একই। সবচেয়ে বেদনার বিষয়, ১৯৯৯এর দল নিশ্চিত, ম্যালোরিদের দুর্ঘটনাস্থল থেকে ছয় নম্বর ক্যাম্পের নিরাপদ আশ্রয় ছিল মাত্র শ’ চারেক গজ দূরে!
১৯৯৯এর দলের এই ধারণা অকাট্যভাবে প্রমাণের জন্য প্রয়োজন ছিল ওই কোডাক ক্যামেরাটা। কোডাক কোম্পানী বলেছে, সেটা পাওয়া গেলে সম্ভবত এখনো তার ফিল্ম ডেভেলাপ করা সম্ভব হবে তাদের ল্যাবরেটরিতে। আরভিনের বরফ-কুড়ুলটি পাওয়া গেছিল ১৯৩৩ সালেই, পাওয়া গিয়েছে ম্যালোরি-আরভিনের শেষ ব্যবহৃত ৯-নম্বর অক্সিজেন সিলিন্ডারটিও। এসবই পাওয়া গেছে ৮৩০০ মিটারের বেশি উচ্চতায়। ম্যালোরিরা এভারেস্ট-শীর্ষ স্পর্শ করে থাকুন আর না থাকুন, তাঁরা যে সেই ১৯২৪ সালে মান্ধাতার আমলের সাজসরঞ্জাম নিয়ে তখনো অবধি অজানা উত্তর-পুবের পথ ধরে এভারেস্টের কাঁধে অন্তত ৮৫০০ মিটার অবধি উঠতে সক্ষম হয়েছিলেন, সে সম্পর্কে তথ্যাভিজ্ঞ মহল নিশ্চিত। ১৯৫৩এ তেনজিং-হিলারির সফল অভিযানের আগে অবধি আর কোনো নশ্বর মানব ওই উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেননি। কিন্তু সামারভেলের দেওয়া সেই কোডাক ক্যামেরাটা সব রহস্যের অন্তিম সমাধান বুকে নিয়ে আজও যে নিরুদ্দেশ!
এবং খুঁজে-না-পাওয়া একটি ছবি
১৯৯৯এর দল ম্যালোরির জ্যাকেটের ভেস্ট পকেটে খুঁজে পেয়েছেন একটি অটুট বরফচশমা, পকেট-ছুরি, এখনো ব্যবহার করা চলে এমন এক বাক্স দেশলাইকাঠি, মনোগ্রাম-করা একটি রুমালে মোড়া একগুচ্ছ চিঠি ও আরো টুকিটাকি জিনিসপত্র। ম্যালোরির পকেটে যেটা খুঁজে পাননি ওঁরা সেটাই বোধহয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রমাণের অভাব নেই যে সেই ৮ই জুন সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ ম্যালোরি শৃঙ্গজয়ের জন্য আরভিনের সঙ্গে যখন ক্যাম্প-৬ থেকে বেরোচ্ছেন, সযত্নে পকেটে ভরে নিয়েছিলেন প্রিয়তমা পত্নী রুথ ম্যালোরির একটি সাদাকালো ফোটোগ্রাফ। ১৯২৪এর অভিযানে বেরোবার আগে জর্জ রুথকে কথা দিয়ে আসেন, রুথের এই ছবিটি রেখে আসবেন পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু জায়গায়! শিখরমুখী মানুষের আকাশছোঁয়া প্রেমপ্রতিজ্ঞা! কনরাড অ্যাঙ্করদের জানা ছিল এ কাহিনী, তাই ম্যালোরির মরদেহের পরণে পোষাক আতিপাতি করে খুঁজেছিলেন তাঁরা। মিলেছিল অনেক কিছুই, কিন্তু রুথের ছবিটি পাওয়া যায়নি। আর তা থেকেই ১৯৯৯এর দলের বিশ্বাস, জর্জ তাঁর স্ত্রীকে দেওয়া কথা রেখেছিলেন এবং একদিন নিশ্চয়ই এভারেস্টের চুড়োয় কেউ-না-কেউ খুঁজে পাবেনই রুথের সেই সাদাকালো ছবিটি। আর তাতেই এত বছর ধরে বরফের গভীরে চাপা পড়ে থাকা সত্য প্রকাশিত হবে পৃথিবীর সামনে, পর্বতারোহণের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়টি হয়তো বা নতুন করে লিখতে হবে সেই দিন।
সামিট
পর্বতারোহণের কথকতায় কত ভাবে যে জীবন হামেশাই অতিক্রম করে যায় আটপৌরে মরণের গন্ডী, কতভাবে যে বর্তমানের সামনে ইতিহাস তার নীরব বাঙ্ময়তা নিয়ে উপস্থিত হয়! ম্যালোরির নাতি ও ‘নেমসেক’ জর্জ ম্যালোরি তাঁর পিতামহেরই চিনিয়ে-দেওয়া উত্তরের পথে এভারেস্টের শীর্ষে পৌঁছান ১৯৯৫ সালে। এবং, ‘ছোট’ ম্যালোরি এভারেস্টের চুড়োয় রেখে এসেছেন তাঁর দিদিমা রুথ ও দাদুভাই জর্জ ম্যালোরির একটি যৌথ ফোটোগ্রাফ! তর্পণ হিসেবে। এ তর্পণ যেন বর্তমানের হাতে ইতিহাসের অনাদায়ী ঋণমোচন।
১৯২১ ও ১৯২২ পর পর দু’বার এভারেস্ট অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পরেও ১৯২৪এ যখন জর্জ ম্যালোরি আবার এভারেস্ট অভিযানের তোড়জোড় করছেন, এক সাংবাদিক তাঁকে জিজ্ঞেস করেন – কেন ওখানে বারবার ফিরে ফিরে যান ? উত্তরে ম্যালোরি যা বলেছিলেন, সেটা প্রায় প্রবাদবাক্যের স্তরে চলে গিয়েছে আজ। অদ্যাবধি ও ভবিষ্যতেও দুনিয়ার সকল পর্বতপ্রেমীদের শত বিপদ-বিঘ্ন, শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও পর্বতের নিশির ডাকে সাড়া না দিয়ে পারবার অমোঘ যুক্তি যুগিয়ে আসা ম্যালোরির সেই প্রবাদপ্রতিম উত্তর – Because it is there !
পাদটীকা
তথ্যপঞ্জীঃ
লেখক পরিচিত - পেশা - কলকাতার উপকন্ঠে একটি কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপনা, নেশা - হিমালয় আর থিয়েটার। বাংলায় লেখালেখির অভিজ্ঞতা - না-থাকার মত, ইদানীং দু'চারটি পত্রপত্রিকায় অনিয়মিত কিছু লেখা ছাপা হয় বলে উত্তরোত্তর স্পর্ধা বাড়ছে। তবে সময়ের দাম সম্পর্কে ধারণা না থাকায় উত্তরণ হ'বার নয়। একটা পাহাড়-জঙ্গল জায়গায় হলুদ পাতায় ছাওয়া বনে মরবার ইচ্ছে।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.