নারী
অগাস্ট ১৫, ২০১৬
মা-কে নিয়ে
তুষ্টি ভট্টাচার্য
‘মা’ শব্দটা শোনার জন্য সব মেয়েরাই বোধহয় মুখিয়ে থাকে। কেউ ‘মা’ বলে ডাকবে না, কচি কচি হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরবে না, তার জন্য আমার বুকে ধারা নামবে না... এমন ভাবনা বোধহয় কোন মেয়েই পোষণ করে না। কিন্তু আমি ব্যক্তিগত ভাবে একটি মেয়েকে জানি, যে শুধু নিজের সংসারে টাকার জোগান দিতে হবে বলে সন্তান নেয় নি ইচ্ছে করে। এক্ষেত্রে নিজের সংসার মানে তার নিজের মা-বাবাকে দেখভাল ও এক ছোট ভাইকে লেখাপড়া শিখিয়ে যা হোক কিছু রোজগারের পথ দেখানো। সেই শর্তে সে বিয়ে করে একটি ছেলেকে। যুক্তি এটাই, যে পয়সা ও সন্তানের জন্য ব্যয় করবে, সেটা নিজের বাপ-মা-ভাই-বোনকে দেবে। মেয়েটি বিউটি পার্লারে কাজ করে। বাবার কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যা কিছু টাকা পয়সা বহুদিন ঘুরে ঘুরে আদায় করতে পেরেছে, তার সঙ্গে নিজের উপার্জন জুড়ে একটি মাথা গোঁজার মত পাকা বাড়ি করেছে। ক্লাস সিক্স থেকে ভাইকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়িয়েছে বিকম পর্যন্ত। সঙ্গে কম্পিউটার ট্রেনিংও। নাহ, তার ভাই দিদির মুখ রাখে নি অবশ্য। সে দিব্যি ফান্ডা মেরে এখনও বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছে আর দিদির কাছে কথায় কথায় হাত পাতছে। মেয়েটির বাবা মারা গেছে ইতিমধ্যে। এরপর ও ছোট বোনকে বিয়ে দিয়েছে নিজের খরচায়। এখনও এভাবেই কাঁচি হাতে আর ক্রিমের কৌটো নিয়ে সেই সকাল থেকে রাত অবধি খেটে যাচ্ছে। তবুও কোনদিন ওর মুখে মা না হতে পারার দুঃখ দেখি নি। এখন তার মা হওয়ার বয়স গেছে। জানি না ওর অন্তরে কোথাও ইচ্ছাকৃত ভাবে মা না হওয়ার যে ত্যাগ সে করেছে, তার জন্য আফসোস হয় কিনা এখন।
চিত্রশিল্পী - পিকাসো
|
খুঁজলে ওই মেয়েটির মত উদাহরণ খুঁজলে হয়ত কম পাওয়া যাবে। কিন্তু যে মেয়েরা মা হয়নি প্রকৃতিগত কারণে, তাদের অভিজ্ঞতা কম বেশি প্রায় এক। আর তারা যে স্তরেরই মানুষ হোক না কেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে একটি মেয়ের কথা বলি। বিয়ের পাঁচ বছর পরেও তার সন্তান না হওয়ায় এ যুগে তাকে কী নিদারুণ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে সেটাই বলি। মেয়েটির প্রথম সন্তানের মিসক্যারেজ হওয়ার পরে স্বামীর দাঁত খিঁচুনির সামনে কেঁচো হয়ে থাকতে হয়েছিল। কারণ সেই মিসক্যারেজের দায়টা নাকি তারই! কিছুদিন বাদে পুনরায় সে সন্তান সম্ভাবনা না হওয়ায় ডাক্তারের কাছে গেল তারা। একজন বললেন, এক বছরেই ধৈর্য হারাচ্ছ! আরও এক বছর দেখ তোমরা। কীই বা বয়স তোমাদের। শুধু মনে রাখবে, পিরিয়ডের ১২ থেকে ১৭তম দিনগুলি যেন বাদ না যায়। যেহেতু ১৫তম দিনে ডিম্বাণু নিঃসরণের নিয়ম, তাই প্লাস মাইনাস তিনদিন ধরে ওই হিসেব। এরপর কিছুদিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা। প্রতি মাসে রক্ত দেখার পর মেয়েটি মুষড়ে পড়ছে আর তার স্বামী কপাল চাপড়াচ্ছে। এদিকে প্রতি মাসের ওই নির্দিষ্ট দিন গুলির সেই ওষুধের মত করে পাওয়া সঙ্গম, ওদের ধৈর্যহারা করে তুলছিল। অতঃপর, দ্বিতীয় আর একজন ডাক্তারের কাছে গেল তারা।
তিনি সব ইতিহাস শুনে টুনে কিছুক্ষণ গম্ভীর মুখে চিন্তা করলেন আর তারপর বললেন, খুব চিন্তার বিষয়। অনেক কিছুর সম্ভাবনা রয়েছে। ততক্ষণে ওদের মুখ শুকিয়ে, গলা শুকিয়ে এসেছে। যেমন, যেমন? ছিটকে বেরনো প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, ফ্যালোপিয়ান টিউবের মুখ বন্ধ হয়ে যেতে পারে, ওভারিতে টিউমার হতে পারে, ইউটেরাসের ধারণ ক্ষমতা চলে যেতে পারে...... বলে তিনি পস্ দিলেন। দুজোড়া উদ্বিগ্ন চোখ তখন ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে। এরপর তিনি বললেন, তবে প্রথমেই দেখতে হবে ইউটেরাস ওয়াশ করে কিছু সুরাহা হয় কিনা। অতএব তোমরা কালকেই আমার নার্সিং হোমে পেশেন্টকে অ্যাডমিট করে দাও। ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে এসে ওদের কানে তখন ফ্যালোপিয়ান টিউব, ওভারি, ইউটেরাস, নার্সিং হোম এসব ছাপিয়ে নিজেদের হার্ট বিটের শব্দ। এবার অন্যরা পরামর্শ দিল, ওসব একদম করতে যাস না। ওই ডাক্তারের কাছে গেছিস তোরা? আর লোক পেলি না... ও তো রক্ত চোষা। জানিস না ওর নার্সিং হোমে একবার ভাংচুর হয়েছিল এই জন্য। ওহ্ এ যাত্রা খুব বেঁচে গেল বলে তারা টেনশন উড়িয়ে দিয়ে অন্য কার কাছে যাওয়া যায়, এ বিষয়ে হাজার জনের হাজার উপদেশ কান পেতে শুনতে লাগল।
এই ডাক্তারি পরামর্শ আর নিয়ম করে ওষুধের মত করে চলা সঙ্গমের বাইরে আর যা যা মেয়েটিকে সামনা সামনি করতে হল, এবার সেগুলোর কথা বলি। মেয়েটির সমসাময়িক ওর যে সব বন্ধুদের বিয়ে হয়ে গেছে, তাদের বেশির ভাগেরই কোলে কাঁখে একটি করে বাচ্চা। তাদের বাচ্চাটি কতখানি দুষ্টু হয়েছে, বা কতখানি বুদ্ধিমান বা বুদ্ধিমতী, আর তাদের ক্রিয়াকলাপের সবিস্তার বর্ণনা (যেন এই বাচ্চাই জীবনে প্রথম আঙুল চুষল, বা হাঁটতে শিখল, বা দুষ্টুমি করল) দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ত ওর সামনে। এরপর অবধারিত প্রশ্ন, কি রে তোর কিছু খবর হল না এখনও? না বাবা, বেশ আছিস খালি হাতে ঝরঝরে। একটা হলে হাড়ে হাড়ে টের পাবি। আত্মীয়ের মাঝে বা কোন জমায়েতে যদি সে কোন বাচ্চাকে আদর করে, অনেক গুলো সমবেদনা উপচে পড়ে তার দিকে চেয়ে। আহা রে, বেচারি মা হতে পারল না! একটু বয়স্কা আত্মীয়া হলে তো কথাই নেই, বলে ফেলবেন মুখের ওপর- আজকাল তোদের এই সব বাচ্চা আটকানোর কত ওষুধ-বিষুধ, ওই সবেই কাল হয়েছে তোদের। নে এবার থাক বাঁজা হয়ে। এই রকম পরিস্থিতিতে মেয়েটি মানসিক ভাবে নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে ক্রমশ। কোথাও যেতে চায় না, কোন বিয়েবাড়ি, পার্টি বা পিকনিকে গেলেই এক ঝাঁক প্রশ্ন আর সহানুভূতির তির তার দিকে ছুটে আসবে আর তার সমস্ত মজা মাঠে মারা যাবে।
এবার ধরুন মা হওয়ার পরে যে যে অভিজ্ঞতা প্রায় সকল মায়েদেরই হয় তার মধ্যে একটা কমন হল – ‘ছেলে/মেয়েটা মায়ের মত দেখতে হয় নি ভাগ্যিস!’ এবং বক্তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মহিলা! এরপর যখন তারা একটু বড় হল, দুরন্তপনা, বেয়াড়াপনা বাড়তে থাকল, মায়েদের শুনতে হল – শাসন নেই গো একটুও! আদরে আদরে বাঁদর করে দিচ্ছে। আর যে মা কর্মসূত্রে বাড়ির বাইরে যান, তাদের ক্ষেত্রে তো এই অভিযোগ আরও প্রবল হয়ে ওঠে। কখন দেখবে ছেলেটাকে! সে তো তার কাজ নিয়েই ব্যস্ত। আয়ার কাছে কী আর ছেলেমেয়ে মানুষ হয়! পড়াশুনোতেও মন নেই দেখেছ কেমন! মা তো বাড়ি ফিরে ক্লান্ত। কখন ছেলেকে পড়াবে! সঙ্গে বাবার টিপ্পনী – এই তোমার আস্কারায় ছেলেটা উচ্ছন্নে গেল! এরপরও যদি ছেলে/মেয়ে বেশ নামী দামী কিছু করে ফেলল, তখন তার পিছনে মায়ের যে অক্লান্ত ভূমিকা সেটাকে পাত্তাই দেওয়া হবে না। বলা হবে, কেমন বংশের ছেলে/মেয়ে দেখতে হবে না! যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তান।
মা মানেই সেই যুগ যুগ ধরে চলে আসা একটা ছবি – লাল পাড় শাড়ি, কপালে বড় করে লাল টিপ, আঁচলে চাবির গোছা, যার কাছে এলেই কপালে একটা শান্তির ঠাণ্ডা ছোঁয়া – ঠিক এই ধারণাটা থেকে বাঙালি কতটা বেরিয়ে এসেছে এ নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এখনকার কোন নব্য যুবক নিশ্চয়ই ওই পুরনো ধরনের আউটলুকের স্ত্রী চাইবেন না, বা তার সন্তানের মা হিসেবেও অমন দেখন-দারী চাইবেন না। কিন্তু সেই মেয়ে শাড়িই পরুক বা জিন্স, মনে মনে যেন সেই সর্বংসহা মা-ই থাকে, এই চাওয়ার থেকে মেয়েদের নিস্তার নেই। সন্তানের জন্য তার খিদে থাকবে না, তেষ্টা আসবে না, নিজস্বতা থাকবে না, হাজার রকমের বায়নাক্কা মিটিয়েও তার একটু স্পেস, একটুখানি নিজেকে দেখার মত, নিজের কাছে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার মত সময় তার থাকতে নেই। তাহলেই স্বার্থপরের তকমা জুটবে। দৃশ্যত অনেক কিছুই বদলেছে। আধুনিক মায়েদের জন্য কিন্তু অন্তর থেকে উদারতা ততটা আসে নি। নিশ্চয়ই কিছু উদার মানুষ আছেন, যাঁরা মায়েদেরও একজন স্বতন্ত্র মানুষ হিসেবেই ভাবেন। কিন্তু এই সংখ্যাটা মোটেই বেশি নয়। এখনও পাড়ায় অমুকের মা এই বলেছে, তমুকের মা ওই করেছে বা অমুক/তমুকের বউ - এভাবেই মেয়েদের পরিচিতি।
পরিচিতি অন্যের থেকেই আসুক বা নিজের, সেটা অবশ্য বিষয় না। আমার দেখার বিষয় ‘মা’। যে মা তার সন্তানের জন্য নিজের কাজ ছেড়ে দিলেন, দেখা গেল সেই সন্তান যখন বড় হয়ে গেল, নিজের জগৎ খুঁজে পেল, মাকে তার আর দিবারাত্রি প্রয়োজন নেই, বরং মা কিছু বলতে এলেই সে ভীষণ বিরক্ত, সেই মা এখন কী করবেন? মাঝবয়সে পৌঁছে সেই মা তখন অনেকখানি উদ্যম হারিয়ে ফেলেছেন, আবার নতুন কিছু কাজকর্ম জুটিয়ে ফেলা তার পক্ষে সম্ভব না, তার এখন দিনরাত কি নিয়ে কাটবে? টিভি সিরিয়াল! বই! সিনেমা, নাটক!! এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে এক মায়ের কথা, ছেলেকে হস্টেলে পাঠানোর পর তিনি প্রায় মাস ছয়েক অবসাদ রোগে ভুগেছেন। কিছু রান্না করতে গেলেই ছেলের মুখ মনে পড়ছে, ছেলে ওখানে অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে আছে শুনে তিনি রাঁধতে পারছেন না নিজের জন্য আর! একদিন কোন কারণে ক্যান্টিন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ছেলের রাতের খাওয়া জোটে নি, বিস্কুট খেয়ে থাকতে হয়েছে শুনে তিনিও জল খেয়ে শুয়ে পড়লেন। এরকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। তো সেই মাও ধাতস্থ হয়েছেন। তবু সেই আগের ছন্দে ফিরতে পারেন নি। একাকীত্ব তাঁকে কুরে কুরে খেয়েছে।
সে বয়স্ক মায়েরা একা একা বাড়িতে রয়ে গেলেন, তাঁদের দেখভাল করার কেউ থাকুক আর না থাকুক, তাঁরা নিজের ভিটেতেই মরতে চাইলেন, তাঁদের থাকল নিজের অতীতের স্মৃতিটুকু। আর যাঁরা নিজেদের ভাল লাগার কিছু খুঁজে পেলেন, তাঁদের শেষ দিন গুলো হয়ে উঠল কিছুটা স্বস্তির। অনেকেই আর ক্লান্তির জন্যই হোক বা উদ্যমের অভাবে সেই চেষ্টা টুকু করেন না। আর দুপুর ও সন্ধ্যেগুলো ওঁচাটে সিরিয়াল তাঁদের মস্তিষ্ক খেয়ে ফেলতে থাকে। আর তাঁরা সেটা টেরও পান না। এখনকার মায়েরা কখনই চান না যে তাঁদের সন্তান দুধে ভাতে থাকে। তাঁরাই সন্তানকে বৃহত্তর পৃথিবীর দিকে এগিয়ে দেন। কিন্তু নিজেরা সেই পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। আর ব্যস্ত সন্তান হয়ত সময়ের অভাবে মাকে সেভাবে সময় দিতে পারেন না, তাই তাঁদের একাকীত্ব ক্রমশ বাড়তে থাকে। অনেক সময় লোকবলের অভাবে বা নিজেদের আস্তানা দেখভালের অক্ষমতায় বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয়। এই বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা তাই বাড়ছে। ফুলে ফেঁপে উঠছে এই ব্যবসা। ছেলেমেয়েরাও বিড়াল পার করে নিশ্চিন্ত, আর বাপ-মায়েরা অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের পুরনো বাড়িঘর বা স্মৃতির জন্য কিছুদিন ভারাক্রান্ত থাকলেও বৃদ্ধাশ্রমে এসে নতুন সঙ্গ পেয়ে নতুন ভাবে বাঁচতে শিখছেন। এটা ভাল নাকি মন্দ, সেটা বিচার করবে সময়। আমি দেখার লোক মাত্র। যা দেখি, তাই লিখি।
লেখক পরিচিতি : শ্রীরামপুর কলেজ থেকে বটানিতে স্নাতক। একটু দেরিতেই লিখতে আসা। গত বছর চারেক ধরে বিভিন্ন ছোট কাগজে ও ওয়েবম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখছেন। গদ্য ও কবিতা দুটোই লিখতে পছন্দ করেন।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।