বিবিধ প্রসঙ্গ

মার্চ ১, ২০১৭
কে আর পাবে এমন জীবন, এমন মধুর বোল!
নাহার তৃণা
বাংলাদেশী মাত্রেই বুকের ভেতর "আমার সোনার বাংলা আমি তোমায়
ভালোবাসি" বড় বেশি আবেগে গুনগুনিয়ে তোলে। বলা বাহুল্য এটা
আমাদের জাতীয় সঙ্গীত, যা পৃথিবীর মধুরতম সঙ্গীত বলে প্রতিটি বাঙ্গালীর
মনে অনুরণন তোলে, সরবে কিংবা নীরবে। যখন আমাদের সামনে স্থানকাল
বিশেষে "The Star-Spangled Banner,” “Himno Nacional,” “God
Save the Queen,” “Deutschlandlied,” বা "song of the German,"
“Nkosi Sikolel’ iAfrika,” বা “God Bless Africa,” “Kimigayo,”
“Marseillaise,” কিংবা খানিকটা পরিচিত "জন গণ মন অধিনায়ক
জয় হে," স্বীয় মাতৃভূমির বন্দনা সমৃদ্ধ জাতীয় সঙ্গীতগুলো
বেজে ওঠে, তখন ভাষাগত সীমাবদ্ধতা নয়, কেমন এক বোঝা না বোঝার মাঝে
আমাদের বোধ দোল খায়। আমাদের অনুভূতি, স্পর্শের বাইরেই থেকে যায়
যেন! ভিনদেশি এসব গান আমাদের ভেতর বাড়িতে সেভাবে আলোড়ন তোলে না,
যেমনটা তোলে "আমার সোনার বাংলা!" মায়ের সাথে সন্তানের
যেমন নাড়ীর টান, এ গানের সাথে সব বাংলাদেশ-অন্তঃপ্রাণের সেরকমই
টান আছে যে! নইলে এই গান কোথাও বেজে উঠতে শুনলে বুকের ভেতর এমন
গুড়গুড় করবে কেন! কেন কান্নাদের মধ্যে শোরগোল পড়ে যাবে কে কোথায়
লুকোবে তার জায়গা খুঁজতে?
পৃথিবীর প্রতিটি স্বাধীন দেশেরই আছে নিজ নিজ জাতীয় সঙ্গীত। যার
যার মা তার কাছে শ্রেষ্ঠ। কিন্তু আমাদের মা, সর্বশ্রেষ্ঠা! এ যে
শুধুই গান নয়! এ এক অবাক পবিত্রতায় ধুয়ে যাওয়া অস্তিত্বের নাম,
যা সবুজের বুকে লাল হয়ে মিশে আছে আমাদের সত্তার অনেকখানি আনন্দ
বেদনা হয়ে, যা আমাদের পথ দেখায় হাজারো গানের সুরে সুরে ছড়িয়ে গিয়ে।
যে সুরে এই গানের বোল প্রাণ পায় তার নাম বাংলা। আহা এমন মধুর ভাষা
পৃথিবীর আর কোথাও নেই, এই সত্যিটা আমরা যারা প্রবাসে থাকি তারা
বুঝি বা একটু বেশি করে অনুভব করি। একটা কাল্পনিক দৃশ্যকল্প ভাবুন।
প্রচণ্ড শীতে ধড়াচূড়া পরে বেরিয়ে সারাদিন পরদেশী এক ভাষা কপচে
বাড়িমুখো হচ্ছেন আপনি। সেই ঘরে ফিরছেন আপনি যেখানে আপনার জন্য
শুধুমাত্র ধড়াচূড়া ছেড়ে আরামদায়ক পোশাকের হাতছানি নেই, আছে নিজস্ব
শেকড়ের কাছে ফেরার আনন্দ। এ আনন্দে খই হয়ে ফোটে বাংলা মায়ের বোল
- তাকডুম তাকডুম আনন্দে যা আমাদের মনকে নাচিয়ে দেয় বেদম নাচন।
তবে এ বোলে প্রবাসী বাঙ্গালী মাত্রই আনন্দে নেচে ওঠেন এমনটা ভাবা
বেশ ভুল। একবার এয়ারপোর্টে কানেকটিং ফ্লাইটের অপেক্ষায় আছি, এমন
সময়ে এক বাঙ্গালি দম্পতি আর তাদের মিষ্টি দুষ্টু বাচ্চার সাথে
আলাপ হল। আমার সামনের দিকে ছিলেন ওঁরা। বাচ্চাটা আমার দিকে হাসিমুখে
তাকাতে আমি জিভ ভেংচে দিলাম। সে দারুণ চমৎকৃত এবং দুষ্টুমির সঙ্গী
পাওয়ায় আহ্লাদিত। বাচ্চার লাফাঝাঁপায় অস্থির মায়ের মুখ থেকে এক
পর্যায়ে "আহ কী হচ্ছে এসব!" শুনে আমি তো অবাক। এম্মা!
এরা তো বাঙ্গালী। এতক্ষণ ওদের খটাখট ইংরেজি শুনে ভেবেছিলাম অন্যভাষী
হবেন।
সটান তাঁদের সামনে গিয়ে বিগলিত মুখে জানান দিলাম আমিও বাঙ্গালী।
"তাতে হলটা কী বাপু!" এমন একটা ভঙ্গি করে বাচ্চাটির
মা-জননী তার পালিশ করা ঠোঁট বেঁকিয়ে চুরিয়ে ইংরেজিতে আলাপ শুরু
করলেন, যা আমার মাতৃভাষা নয়। সম্ভবত তাঁরও না। কিন্তু কী এক দারুণ
অবজ্ঞায় তিনি বাংলা বলা থেকে নিজেকে বিরত করলেন। জানা গেলো এই
পরিবারটি শুধু বাঙ্গালীই নয়, বাংলাদেশীও বটে। দুষ্টু মিষ্টি বাচ্চাটার
কারণে কিছুক্ষণ ওদের সাথে হাঁফধরা আলাপের কুস্তি সেরে নিজের ফ্লাইটের
খোঁজে উঠে এলাম। কেমন একটা অজানা আশঙ্কা আর কষ্ট হয় বাচ্চাটার
কথা ভেবে। ওর হয়ত সেভাবে জানা হবে না বাংলা নামের ভাষায় কতটা মিষ্টতা,
কী তার অবাক ঐশ্বর্যময় ইতিহাস। তবে আমার ভাবনাটা ভুল হলে ভীষণ
ভালো হয়।
এর উল্টো পিঠে দারুণ আনন্দময় আরও গল্প আছে। একটা বলি। গেল গরমের
ছুটিতে দুই বোনে চুটিয়ে শপিং মলের সেল দেখে বেড়াচ্ছি। এক জুতোর
দোকানে দু'বোনে ‘এটা কেমন?’ ‘ওটা মানাচ্ছে?’ ইত্যাদি বাঙ্গাল আলাপে
জুতো দেখছি, পরছি, খুলছি। আমার বোনটি ভীষণ হাসিখুশি মিশুকে শিশু।
আমরা তেমন ফিসফিসিয়ে বকবকানি করছিনা, বরং তা অন্যের শ্রবণগোচর
হলেও বোধের বাইরে বলে লাগামছাড়া হা হা হি হি হচ্ছে। জুতোর সেলফগুলো
পর পর সাজানো। হঠাৎ একটা সেলফের জুতো সরে গিয়ে সেখানে একটা হাসিতে
ঝলমল মুখ বলে উঠলো "বাঙ্গালী!" ওপাশের হাস্যমুখী আর
এপাশের লাস্যময়ী দু'জনের মাঝখানে জুতোর সেলফ তো নয় যেন কাঁটাতারের
বেড়া। তা ভেদ করেই পারলে তারা একে অন্যকে আলিঙ্গন করে আর কি! প্রাথমিক
আবেগের উত্তেজনা সরে গিয়ে বুদ্ধিমতী দুই বাঙ্গালি মুখোমুখি হলেন।
বোনের পাশে আমি, আর ওপাশে বয়স্কা মহিলার পাশে এক সুদর্শন তরুণ।
জানা গেলো এঁরা ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ভাইয়ের কাছে বেড়াতে এসেছেন।
আদি নিবাস পশ্চিমবঙ্গ। ভারী চমৎকার সময় কেটেছিল ওঁদের সাথে সেদিন।
আসলে মাতৃভাষা এমন এক জিনিস যা এক পলকে দূরকে কাছে টেনে আনে।
তোমার আমার মাঝের যাবতীয় লক্ষণরেখা ভুলিয়ে দিতে পারে এই ভাষা।
একটা বিশেষ দিনকে স্মরণ করবার তাগিদটুকু থাকনা সরকারী দপ্তরের
অধীন। আমরা বরং আমাদের প্রতিদিনের আড্ডায় এ ভাষাতে বলে কয়ে সেটাকে
প্রাণবন্ত রাখি। এভাবে হয়ত ভাষার প্রতি ভালোবাসাটা জানান দেয়া
যায়। শ্রদ্ধার্ঘ দেওয়া যায় এ ভাষার জন্য বুকের রক্ত দেওয়া অবাক
মানুষগুলোর প্রতি। শ্রদ্ধা ভালোবাসার দেখানেপনায় না গিয়ে আমরা
কতভাবেই ছড়িয়ে দিতে পারি এ ভাষার অপার আনন্দটুকু। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম
মধুর সঙ্গীত "আমার সোনার বাংলা" আর এক পৃথিবী সমান দুঃখ-দ্রোহে
ভরা ভাষার গান, "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি,"
আমাদের ভেতর-বাড়িতে নিরন্তর বেজে যাক। এমন গান, এতটা ঐশ্বর্যময়
ইতিহাস আর কার আছে? আর কে পায় এমন মধুর ভাষা, এমন বাঙ্গালী জীবন!
লেখক পরিচিতি - আমার জন্ম ঢাকায়। বর্তমানে উত্তর আমেরিকায় বসবাস করছি।
নানান ধরনের বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসি।
শখের বশে লেখালিখি করলেও খুব ইচ্ছে করে যে জীবন আমার নয়, কিন্তু হতেও তো পারতো,
এমন মানুষের পাশে নিজেকে দাঁড় করিয়ে সে জীবনটা দেখি।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।