অবসরের পাতায় আগে আমরা হুঁহাউ দ্বীপপুঞ্জে এসেছিলাম। সেখানে দুজাতের লোক থাকে, সজ্জাত আর বজ্জাত। যুক্তিশাস্ত্রে তাদের সবায়ের অগাধ বিশ্বাস, তারা কখনো অযৌক্তিক কিছু বলে না, বোঝেও না -- তাদের কথাবার্তার সব কিছুই হয় সত্যি নয় মিথ্যা, 'এও হতে পারে, ওও হতে পারে' বলে কিছু নেই। এমনিতে সবাই খুব বশংবদ, প্রশ্ন করলে জবাব দেয়, তবে বেশীর ভাগ সময়েই 'হ্যাঁ' বা 'না' গোছের কাজ-চালানো উত্তর। মজাটা এই যে সজ্জাতেরা সদা সত্যি কথা বলে আর বজ্জাতেরা সদা মিথ্যে (যুক্তিশাস্ত্র মাফিক
True বা False) -- এর কোনো ব্যত্যয় নেই।
হুঁহাউয়ের আইনকানুন একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক। ধরা যাক 'ক' আর 'খ' দুটো বাক্য, সত্যিও হতে পারে, মিথ্যেও হতে পারে। এখন এ দুটোকে যোগ করে আর একটা যৌগিক বাক্য করলে তার সত্যি-মিথ্যে কি হবে?
১) ক এবং/আর খ -- কেবল যদি ক আর খ দুটোই সত্যি হয় তবেই সত্যি। একটা মিথ্যে হলেই সবটা মিথ্যে।
২) ক বা/অথবা খ -- কেবল যদি ক আর খ দুটোই মিথ্যে হয় তবেই মিথ্যে । একটা সত্যি হলেই সবটা সত্যি।
৩) যদি ক তাহলে খ -- কেবল যদি ক সত্যি আর খ মিথ্যে হয় তবেই মিথ্যে । অন্যরকম হলে সত্যি --এমনকি ক যদি মিথ্যে হয় তাহলেও।
৪) ক--খ সমান, লেখা হয় ক ≡ খ, এটা সত্যি হতে গেলে ক আর খ, হয় দুটোই সত্যি নয় দুটোই মিথ্যে -- -- একটা সত্যি আর একটা মিথ্যে হলে চলবে না।
বুদ্ধির গোড়ায় একটু ধোঁয়া দিয়ে শুরু করা যাক। সজ্জাত যুধিষ্ঠির আর বজ্জাত শকুনি একসঙ্গে যাচ্ছে। দুজনের কেউই কিন্তু "আমি বজ্জাত" বলতে পারবে না। "তোমার কী জাত হে", -- প্রশ্ন করলে দুজনেই বলবে "আমি সজ্জাত" অথচ "তোমার সঙ্গীর কী জাত"-এর উত্তরে দুজনেই বলবে "ও বজ্জাত"।
(কেন? সত্যবাদী বলে যুধিষ্ঠির কী বলতে পারেন আর পারেন না, সেটা হিসেব করুন।
মিথ্যেবাদী শকুনির বেলায়ও।)
এবার আমরা হুঁহাউ দ্বীপে যাচ্ছি তুখোড় গোয়েন্দা একেন সেনের সঙ্গে, ভদ্রলোক রহস্যভেদ করে করে পাপীদের বুকে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছেন। তাঁকে হুঁহাউতে পাঠানো হচ্ছে, গুজব যে সেখানে চরসের আড়ৎ আছে, তারই হদিশ করতে। দ্বীপে নেমেই একেনবাবু কয়েকটা প্রশ্ন করে দ্বীপের হালচাল জেনে নিলেন। গোয়েন্দা একেন বলে কথা!
ধাঁধা ১
প্রথমেই ধরেছেন দ্বীপবাসী ঙ, ঞ আর ৎ-কে, ঙ-কে শুধিয়েছেন, "তুমি কোন জাত হে"। ঙ-র মুখভর্তি জর্দাপান, সে হাঁউমাউ করে কী বলেছে, বুঝতে না পেরে ঞ-কে ধরেছেন, "ও কী বললো হে"। ঞ-র উত্তর, "ও বললে ও বজ্জাত"। ৎ আর থাকতে পারলো না, সে বললো "ঞ-র
কথা বিশ্বাস করবেন না, একেবারে ঘোর মিথ্যে।"
ৎ কোন জাতের?
উত্তরের জন্যে ক্লিক করুন : জানতে চাইলে একবার, লুকোতে হলে আর একবার
হুঁহাউতে কেউই নিজেকে বজ্জাত বলতে পারেনা, কাজেই ঞ যা বললো (অর্থাৎ ঙ নিজেকে বজ্জাত বলেছে) তা মিথ্যে হতেই হবে। ৎ কিন্তু ঞ-কে মিথ্যুকই বললো, তাহলে ৎ সজ্জাত!
ধাঁধা ২
এই গল্পটার আর একটা সংস্করণ চালু আছে। একেনবাবু ঙ-কে জিজ্ঞাসা করেছেন, "তোমাদের তিনজনের মধ্যে কজন বজ্জাত", উত্তর বোঝা যায়নি, ঞ বলেছে "ও বললো ঠিক দুজন", ৎ বলেছে "ঞ-র
কথা বিশ্বাস করবেন না, একেবারে ঘোর মিথ্যে।"
ৎ-র জাত কী?
উত্তরের জন্যে ক্লিক করুন : জানতে চাইলে একবার, লুকোতে হলে আর একবার
মজা হচ্ছে যেহেতু ৎ ঞ-কে মিথ্যুক বলেছে সেই কারণে ঞ আর ৎ-র জাত ভিন্ন হতেই হবে-- একজন সজ্জাত আর একজন বজ্জাত। এখন ঙ যদি সজ্জাত হয় তাহলে সজ্জাত হলো দুজন, অর্থাৎ বজ্জাত মাত্র একজন। আর ঙ সত্যবাদী তাই ঞ ওর নামে যা বলছে (অর্থাৎ ঠিক দুজন বজ্জাত) ঙ তা বলতে পারবে না। আবার ঙ যদি বজ্জাত হয়, তাহলে বজ্জাতের সংখ্যা দুজন হলো বটে, কিন্তু সে মিথ্যেবাদী বলে এক্ষেত্রেও ঞ ওর নামে যা বলছে ঙ তা বলবে না। তার মানে ঙ সজ্জাতই হোক আর বজ্জাতই হোক, দুক্ষেত্রেই ঞ-র কথা ভুল (মিথ্যে), অতএব ঞ-কে বজ্জাত হতে হবে। সেই কথাই তো ৎ বললো, তাই ৎ সজ্জাত। ঙ-কে নিয়ে কিছু বলা যাবে না।
এ ধাঁধার সমাধান করতে কিন্তু ৎ কী বললো সেটা জানা দরকার। আগের ধাঁধাটায় সে কথা জানার আগেই ঞ যে বজ্জাত সেটা আমরা জেনে গেছি।
ধাঁধা ৩
ঙ আর ঞ একসঙ্গে চলেছে, ঙ বললে "আমরা দুজনেই বজ্জাত।"
ওদের দুজনের কী জাত?
উত্তরের জন্যে ক্লিক করুন : জানতে চাইলে একবার, লুকোতে হলে আর একবার
ঙ-র কথা সত্যি হতে পারে না, সত্যি যদি হয় তাহলে ঙ-ও বজ্জাত আর বজ্জাতেরা সত্যি কথা বলে না। তার মানে ঙ মিথ্যে কথা বলেছে। তাই ঙ বজ্জাত আর ঞ সজ্জাত।
এখানে একটা ব্যাপার খেয়াল করতে হবে। বজ্জাত ঙ "আমি বজ্জাত" বলতে পারে না কিন্তু "আমরা বজ্জাত" বলতে পারে। তার কারণ হলো "আমরা বজ্জাত" মানে "আমি বজ্জাত আর ও বজ্জাত", তাই ও যদি বজ্জাত না হয় তাহলে ওপরের ১নং সূত্রমাফিক সবটা মিথ্যে। মিথ্যে কথা ঙ বলতে পারে।
ধাঁধা ৪
আবার ঙ, ঞ আর ৎ। ঙ বললে, "আমাদের মধ্যে ঠিক একজন বজ্জাত"; ঞ বললে, "আমাদের মধ্যে ঠিক দুজন বজ্জাত"; আর ৎ, "আমরা তিনজনই বজ্জাত"।
এরা প্রত্যেকে কী জাত?
উত্তরের জন্যে ক্লিক করুন : জানতে চাইলে একবার, লুকোতে হলে আর একবার
আগের ধাঁধার যুক্তি অনুসরণ করে বলা যাবে যে ৎ-র কথা, অর্থাৎ "আমরা তিনজনই বজ্জাত", এটা মিথ্যে হতেই হবে। এদিকে ঙ আর ঞ, দুজনে ভিন্ন কথা বলেছে তাই দুজনের কথা একসঙ্গে সত্যি হতে পারে না, তাহলে এদের একজন বজ্জাত।
অর্থাৎ ৎ আর এটাকে নিয়ে বজ্জাত দুটো। ঞ তো তাই বলেছে, অতএব সে সজ্জাত আর বাকী দুজন বজ্জাত।
ধাঁধা ৫
ষ আর স যমজ, চেহারা এক, জাত ভিন্ন। এদের হাড়হদ্দ একেনবাবুর জানা দরকার। চৌরাস্তার মোড়ে এদের একজনের সঙ্গে দেখা। মাত্র তিনটে শব্দের হ্যাঁ/না প্রশ্ন (মানে যে প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ কিংবা না) করে তিনি বার করে ফেললেন সে ষ না স। কী প্রশ্ন?
উত্তরের জন্যে ক্লিক করুন : জানতে চাইলে একবার, লুকোতে হলে আর একবার
"ষ কি সজ্জাত?"
সে যদি ষ হয়, সে বলবে হ্যাঁ, তা সে সজ্জাতই হোক বা বজ্জাতই হোক। স আর ষ ভিন্ন জাতের, কাজেই একই প্রশ্নের তারা ভিন্ন উত্তর দেবে, অর্থাৎ এই প্রশ্নটার উত্তরে স 'না' বলবে, তা সে বজ্জাতই হোক আর সজ্জাতই হোক। তাহলে 'হ্যাঁ' বললে ষ, আর 'না' বললে স।
ধাঁধা ৬
সে তো হলো, কিন্তু ষ সজ্জাত না বজ্জাত, সেটাও একেনবাবুর জানা দরকার, কিন্তু একটা উত্তর দিয়েই সে তো ভেগেছে। দশ মিনিট পরে একেনবাবু আবার এদের একটাকে পাকড়েছেন,এবারেও সেই তিনটে শব্দের হ্যাঁ-না অব্যর্থ প্রশ্নবাণ -- জানতে চান ষ-র কী জাত। গোয়েন্দাশ্রী উপাধি পেয়েছেন কি সাধে?
উত্তরের জন্যে ক্লিক করুন : জানতে চাইলে একবার, লুকোতে হলে আর একবার
"তুমিই কি ষ?"
ধরা যাক সে উত্তর দিলো হ্যাঁ। এখন যদি উত্তরটা ঠিক হয় তাহলে সে-ই ষ, আর ষ সত্যি কথা বলেছে অতএব ষ সজ্জাত। এদিকে উত্তরটা যদি মিথ্যে হয় তাহলে সে ষ নয়, সে স, সে মিথ্যে উত্তর দিয়েছে, অতএব সে বজ্জাত। তার মানে ষ সজ্জাত। মোট কথা 'হ্যাঁ' উত্তর হলে ষ
সজ্জাত, তা ষ বা স, উত্তর যেই দিক না কেন। 'না' উত্তর দিলে এর পাল্টা যুক্তি করে দেখা যাবে যে ষ বজ্জাত। তাহলে 'হ্যাঁ' = ষ সজ্জাত, 'না'=ষ বজ্জাত।
এই দুটো ধাঁধার একটা চমৎকার যুগ্মতা আছে। নাম জানতে চাইলে জিজ্ঞাসা করো জাত, আর জাত জানতে চাইলে জিজ্ঞাসা করো নাম। এইটা আবিষ্কার করার জন্য একেনবাবুর পদোন্নতি না হোক, মিনুবৌদিকে আংটি কিনে দেবার মতো বোনাস নিশ্চয় পাবেন।
ধাঁধা ৭
সজ্জাত আর বজ্জাতেরা ভিন্ন পাড়ায় থাকে, যথাক্রমে সজ্জাতপল্লী আর বজ্জাতগঞ্জ। জন্মাষ্টমীর সন্ধ্যেয় একেনবাবু এক তেমাথায় পৌঁছে কিছুতেই মনে করতে পারলেন না কোন রাস্তাটা গেছে সজ্জাতপল্লীতে,সেইখানে একেনবাবুর হোটেল। মোড়েই এক মক্কেল দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে কান চুলকোচ্ছিল,দিশে চাইতে হবে তার কাছ থেকেই। হুঁহাউতে আবার জন্মাষ্টমীর দিন কেবল একটি হ্যাঁ/না প্রশ্নের একুশে আইন চালু। "সে ভয়ে কম্পিত নয় একেনের হৃদয়।" ঠিক হদিশ বার করে ফেললেন। কী প্রশ্নে?
একেনবাবু যে প্রশ্ন দাগলেন তার অত্যাশ্চর্য যুক্তি আবিষ্কারের জন্য একেনবাবুকে পদ্মভূষণ দেবার কথা উঠেছিলো।
উত্তরের জন্যে ক্লিক করুন : জানতে চাইলে একবার, লুকোতে হলে আর একবার
"এই বাঁদিকের রাস্তাটা কি তোমার পাড়ায় গেছে?"
ধরা যাক সে রাস্তা সজ্জাতপল্লীতে গেছে। যদি মক্কেল সজ্জাত হয়, তাহলে সজ্জাতপল্লীই তার পাড়া, সে বলবে 'হ্যাঁ'। যদি সে বজ্জাত হয়, তাহলে সেটা তার পাড়া নয়, আর সে মিথ্যে করে বলবে "হ্যাঁ"। যদি সে রাস্তা বজ্জাতগঞ্জে যায়, তাহলে ঠিক এর পাল্টা যুক্তিতে উত্তর আসবে 'না', তা সে মক্কেল যে জাতেরই হোক। অর্থাৎ 'হ্যাঁ' বললে সজ্জাতপল্লী, 'না' বললে বজ্জাতগঞ্জ।
একেনবাবুর মতো কম কথার মানুষ না হলে আরেক ভাবে প্রশ্ন করা যেতে পারতো:
"আমি যদি তোমাকে জিজ্ঞাসা করতাম যে বাঁদিকের রাস্তাটা সজ্জাতপল্লীতে গেছে কিনা তুমি কি তার উত্তরে 'হ্যাঁ' বলতে?"
ফলম্ একই -- এর উত্তরে 'হ্যাঁ' বললে রাস্তা সজ্জাতপল্লীর, 'না' বললে বজ্জাতগঞ্জের।
খেয়াল করলে দেখা যাবে যে এখানে দুটো প্রশ্নকে কায়দা করে একটা খাপে ভরা হয়েছে -- (প্রশ্ন-উত্তর) - (উত্তর নিয়ে প্রশ্ন) তার উত্তর। আর কৌশলটা "বিষে বিষক্ষয়ম্" -- পিঠোপিঠি দুটো উত্তর সত্যি, মানে শেষ উত্তরটা সত্যি আর দুটো উত্তর মিথ্যে মানেও শেষ উত্তরটা সত্যি। এই কৌশলের বিশদতর প্রয়োগ দেখবো পরের ধাঁধায়।
ধাঁধা ৮
একেনবাবুকে আর কে থামায়, তিনি ভাবলেন এবার চরসের আড়তের ব্যাপারটাও খোলসা করে ফেলা যাক। জন্মাষ্টমী, -- শুধু একটি হ্যাঁ/না প্রশ্ন -- সে কথাটা মনে ছিলো, মাথার মধ্যে প্রশ্নটা বানিয়ে ফেললেন। কী প্রশ্ন?
উত্তরের জন্যে ক্লিক করুন : জানতে চাইলে একবার, লুকোতে হলে আর একবার
আগের ধাঁধার উত্তরটা যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানবেন যে "আমি যদি তোমাকে প্রশ্ন করতাম যে এ দ্বীপে কি চরসের আড়ৎ আছে, তাহলে তুমি কি তার উত্তরে হ্যাঁ বলতে?" প্রশ্ন এখানে চলবে। ধরা যাক আড়ৎ আছে, তাহলে সজ্জাত মক্কেলকে 'আড়ৎ আছে কি' প্রশ্ন করলে সে হ্যাঁ বলতো, আর 'তাহলে কী বলতে' তার উত্তরেও 'হ্যাঁ' বলবে। বজ্জাত মক্কেলকে 'আড়ৎ আছে কি' প্রশ্ন করলে সে কিন্তু মিথ্যে করে 'না' বলতো, 'হ্যাঁ' বলতো না, আর 'তাহলে কী বলতে' -র উত্তরে মিথ্যে করে আবার 'হ্যাঁ' বলবে। আড়ৎ থাকলে সে 'হ্যাঁ' বলবে, তা সে সজ্জাতই হোক আর বজ্জাতই হোক। এদিকে আড়ৎ যদি না থাকে তাহলে এই যুক্তিরই পাল্টা (হ্যাঁ-য়ের জায়গায় না আর না-য়ের জায়গায় হ্যাঁ) প্রয়োগ করে দেখা যাবে সে 'না' বলবে, যে জাতেরই হোক।
পদ্মবিভূষণের সুযোগটা ছাড়া যায় না, তাই একেনবাবু প্রশ্নটা আর একটু জটিল করে বানালেন (গোড়ার দিকের ৪নং সূত্রটা একবার দেখে নিন):
"তুমি সজ্জাত আর দ্বীপে চরসের আড়ৎ আছে, এদুটো কি সমান? [তুমি সজ্জাত ≡ দ্বীপে চরসের আড়ৎ আছে]" -- 'হ্যাঁ' বললে আড়ৎ আছে, 'না' বললে নেই।
কী করে? ৪নং সূত্রমতে প্রশ্ন করা হচ্ছে যে সমীকরণের দুধারই সত্যি বা দুধারই মিথ্যে কিনা। অর্থাৎ
১) তুমি সজ্জাত আর এখানে আড়ৎ আছে, (দুটোই সত্যি) বা
২) তুমি বজ্জাত আর এখানে আড়ৎ নেই (দুটোই মিথ্যে)
এ দুটোর মধ্যে একটা ঠিক কিনা।
ধরা যাক উত্তর এলো 'হ্যাঁ'। তার মানে, মক্কেল যদি সজ্জাত হয় তাহলে হয় ১নং নয় ২নং সত্যি। ২নং হতে পারে না কেননা আমরা ধরেছি যে মক্কেল সজ্জাত, আর ১নং সত্যি মানে সত্যই আড়ৎ আছে। বজ্জাত মক্কেল হলে ১নং বা ২ নং, দুটোর কোনোটাই সত্যি নয়, বিশেষত ২নং। সেখানে "তুমি বজ্জাত"-টা ঠিক,কেননা আমরা বলেছি যে মক্কেল বজ্জাত। তাহলে "আড়ৎ নেই"-টা মিথ্যে হতে হবে, অর্থাৎ আড়ৎ আছে। তাহলে ব্যাপার এই দাঁড়ালো যে, যে জাতই বলুক না কেন, 'হ্যাঁ' বললে আড়ৎ আছে।
আর সজ্জাত মক্কেল যদি 'না' বলে তাহলে ১নং বা ২ নং, দুটোর কোনোটাই সত্যি নয়, বিশেষত ১নং। ১নংয়ের প্রথম অংশটা সত্যি আমরা জানি, তাহলে দ্বিতীয় অংশটা মিথ্যে হতে হবে, অর্থাৎ আড়ৎ নেই। বজ্জাত মক্কেল 'না' বললে সে মিথ্যে করে 'না' বলেছে, তার মানে হয় ১নং নয় ২নং সত্যি। ১নং হতে পারে না, কেননা আমরা জানি যে মক্কেল বজ্জাত, তাহলে ২নং সত্যি, অর্থাৎ আড়ৎ নেই। আবার দেখা যাচ্ছে, যে জাতই বলুক না কেন, 'না' বললে আড়ৎ নেই।
ধাঁধা ৯
একেনবাবু এই ধাঁধার এমন খানদানী উত্তর আবিষ্কার করেছেন জেনে আমরা আহ্লাদে আটখানা, একেনবাবুর তো সরাসরি পদ্মবিভূষণ পাবার
কথা। দুঃখের কথা যে একেনবাবুর এক চেলা, বাপি নাম, সে তার নতুন আইফোন টিপেটুপে গুগল করে বার করলো এই সূত্রটা নাকি আগেই এক সায়েব বার করে ফেলেছেন, তাঁর নাম নেলসন গুডম্যান, গণিতজ্ঞ বলে তাঁর বিশ্বজোড়া নাম।
নেলসন গুডম্যান গত শতাব্দীর এক বিখ্যাত আমেরিকান দার্শনিক। দর্শনের অনেক ধারাতেই তাঁর কাজ, তার মধ্যে একটি হলো গণিত আর যুক্তিশাস্ত্রের ভিত্তির ওপর। "আরোহ" প্রণালীর (logical induction) ওপর তাঁর কাজ একসময়ে খুব সাড়া জাগিয়েছিলো। তিনি এক কূটাভাস (paradox) আবিষ্কার করেন, গ্রু কূটাভাস (grue paradox) বলে সেটা খ্যাত, তা এই দুই শাস্ত্রের ভিত্তিকে নাড়া দিয়ে যায়। এখানকার স্বল্প পরিসরে সে কূটাভাসের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। তবে আলোচ্যমান এই সূত্রের পরিপ্রেক্ষিতে একটি হ্যাঁ/না প্রশ্ন করে সত্যি-মিথ্যে বিচারের যে প্রণালীটা (ওপরের ধাঁধার উত্তর দেখুন) আমরা ব্যবহার করেছি (আমরা সেটাকে নেলসন-গুডম্যান-প্রণালী বলবো) সেটা আপাতদৃষ্টিতে একটু ঘোরালো মনে হতে পারে কিন্তু খুব শক্তিশালী প্রণালী, অনেক রকম পরিস্থিতিতে সঠিক উত্তর বার করে নিতে পারে। যথা, আমাদের সজ্জাত/বজ্জাত বিভাজন ছাড়াও যদি আবার তাদের মধ্যে পুরুষ/মহিলা অথবা সুস্থ/উন্মাদ ভেদ থাকে,তারা যদি কথায় হ্যাঁ/না না বলে ভিন্ন ভিন্ন রঙের তাস দেখায়, এমনই আরো কিছু জটিলতা যোগ করলেও শেষ পর্যন্ত ওই নেলসন-গুডম্যান-প্রণালী ব্যবহার করে সমাধান পাওয়া যাবে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সহজতর পদ্ধতি থাকতে পারে বটে কিন্তু এই প্রণালী সর্বপ্রযোজ্য। গণিতজ্ঞদের এমন প্রণালীই বেশী পছন্দ।
পদ্মবিভূষণ ফস্কে যাবার দুঃখে আমরা জন্মাষ্টমীর রাত আর্দ্র হয়েই কাটালাম। পরদিন সেই বাপির আইফোন মারফৎই লালবাজার থেকে বার্তা এলো যে হুঁহাউ দ্বীপের হেড আপিসে তিনটে লোক ধরা পড়েছে, তার দুজন এই দ্বীপের বাসিন্দা কিন্তু তৃতীয় জন চরসের আড়ৎদার স্বয়ং। সে কোনজন তা ঠিক করে ধরতে পারা যাচ্ছে না কেননা সে অন্য দ্বীপ থেকে এসেছে যে দ্বীপের বাসিন্দারা বেমক্কা বেনিয়ম সত্যি বা মিথ্যে বলে থাকে।
আমরা সবাই চললাম একেনবাবুর সঙ্গে। জন্মাষ্টমী নয়, কাজেই মাত্র একটা প্রশ্নের একুশে আইনটা নেই। একেনবাবু গিয়ে সেই তিন মূর্তিকে মাত্র দুটি হ্যাঁ/না প্রশ্ন করেই(যদিও একই লোককে নয়) আড়ৎদার কে তা বার করে দিলেন।
উত্তরের জন্যে ক্লিক করুন : জানতে চাইলে একবার, লুকোতে হলে আর একবার
এই ঠকবাজ আড়ৎদার সত্যি-মিথ্যের নিয়ম মানে না কাজেই ওর ওপর নেলসন-গুডম্যান-প্রণালী কাজ করবে না। অন্য দুজনের ওপর কিন্তু কাজ করবে। তাই সরাসরি এক প্রশ্নে কে আড়ৎদার বার করা যাবে না বটে, কিন্তু প্রথম প্রশ্নেই নেলসন-গুডম্যান-প্রণালী ব্যবহার করে কে আড়ৎদার নয়, সেটা বার করা যাবে। তারপর সে লোকটাকে আবার নেলসন-গুডম্যান-প্রণালীর প্রশ্ন ঝাড়লে আসল আড়ৎদারের পরিচয় ফাঁস। তিনজনের নাম যথাক্রমে 'ক', 'খ' আর 'গ' ধরে নিয়ে একটা উদাহরণ দেখা যাক।
একেনবাবু ক-কে প্রথম প্রশ্ন করলেন "তুমি সজ্জাত ≡ খ আড়ৎদার?"। ধরা যাক সে বললো 'হ্যাঁ'।
এখন ক যদি হুঁহাউদ্বীপী হয় তাহলে তার ওপরে নেলসন-গুডম্যান-প্রণালী খাটবে, অর্থাৎ খ-ই আড়ৎদার। তার মানে গ আড়ৎদার নয়, গ হচ্ছে হুঁহাউদ্বীপী। আবার ক যদি আড়ৎদার হয় তাহলেও গ আড়ৎদার নয়, গ হুঁহাউদ্বীপী। অর্থাৎ হ্যাঁ উত্তর পেলে আমরা জানি যে গ নিশ্চিত হুঁহাউদ্বীপী, তা সে ক যাই হোক না কেন। এটা জানার পর আমরা এবার নির্ভয়ে গ-কে নেলসন-গুডম্যান-প্রণালীর প্রশ্ন করতে পারি,
"তুমি সজ্জাত ≡ খ আড়ৎদার?"। এবার খাঁটি উত্তর পাওয়া যাবে, হ্যাঁ বললে আড়ৎদার খ, না বললে ক।
আর গোড়ার উত্তরটা যদি 'না' হয়ে থাকে, তাহলে গ-এর বদলে খ ব্যবহার করতে হবে।
একসঙ্গে আড়ৎ এবং আড়ৎদার প্রাপ্তি, লালবাজার তো একেনবাবুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ভারতরত্নটা একেনবাবুর মিস হয়ে গেলো বটে কিন্তু তিনি স্বয়ং দিদির হাত থেকে 'গোয়েন্দারত্ন' উপাধি নিলেন। বোনাসটাও মন্দ হলো না, সেটা মিনুবৌদির হীরের কানপাশার ঝিলিক থেকে বোঝা গেলো। তাঁর রহস্যকাহিনীর বিক্রি বাড়লো, সেটা একটু নেপোয় মারে দইয়ের মতো ব্যাপার। কী আর করা যাবে, কলিযুগ!
[রেমণ্ড স্মালিয়ানের Knights and Knaves -দের নিয়ে লেখা ধাঁধা গুচ্ছের অনুপ্রেরণায়]
লেখক পরিচিতি: পাঁচ দশক হোলো আমেরিকাবাসী। চাকরীজীবনে তথ্য- ও সংযোগপ্রযুক্তি বিপ্লবী, যদিও পদাতিকমাত্র। অবসর নেবার পর কিছু লেখালেখি করে থাকেন। ঘোর রবীন্দ্রপ্রেমী, নিউ জার্সিতে এক রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার স্কুল ও তিনটি সফল রবীন্দ্রমেলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। গীতবিতান.নেট রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর জ্ঞানকোষ মাত্রার এক বিস্ময়কর ওয়েবসাইট, সার্ধশতবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাঞ্জলি। "অবসরের" সঙ্গে জন্মকাল থেকে নানাভাবে যুক্ত।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।