প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিবিধ প্রসঙ্গ

অগাস্ট ৩০, ২০১৬

 

পুরোনো ‘অবসর’

দিলীপ দাস


‘অবসর’ বলে আরো একটা পত্রিকা ছিল, মাসে মাসে বের হত। আজ থেকে একশ বছরেরও বেশী আগে। চলেও ছিল, প্রায় বছর বারো। শুরু হয়েছিল এক উৎসাহী ব্যক্তির হাতে, আর শেষ হয়েছিল এক দুঃখজনক পরিস্থিতিতে। আজকে সেই পুরোনো ‘অবসর’ পত্রিকার ঝাঁপি খুলে তার কিছু কথা আপনাদের শোনাতে বসেছি।
আসলে ‘অবসর’ নামটাই খুব আকর্ষণীয়। তাই এই নামটি অনেকে সুযোগ মতন তাদের বই-পত্রে কাজে লাগাতে চেয়েছেন। ১৮৯৫ সালে ‘অবসর’ বলে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন জনৈক বরদাচরণ মিত্র। তার আগে ‘অবসর সরোজিনী’ (রাজকৃষ্ণ রায়, ১৮৭৬) ও ‘অবসর-চিন্তা’ (মহেন্দ্রনাথ ঘোষ, ১৮৮৬) নামে দুটি কবিতার বই বেরিয়েছিল। কিন্তু এগুলির কোনোটাই মনে রাখার মতো নয়। আসলে বাঙালীদের কবি কবি ভাব, তখনও ছিল, এখনও আছে।  

শতাব্দীর প্রাচীন অবসর পত্রিকা প্রথম ছাপাখানার আলো দেখে ১৯০৪ সালে। কিন্তু প্রথম চার বছরের কোনো সংখ্যাই আমি খুঁজে পাই নি, তার সাথে আমার যখন মোলাকাত হল তখন তার বয়স পাঁচ (ইং ১৯০৯), কিন্তু হাবে-ভাবে জন্মভারিক্কি। আমি অবশ্য পাঁচের পরেও সব সংখ্যাগুলি খুঁজে পাইনি। যেগুলি পেয়েছি সেগুলি হল, পঞ্চম (বাংলা ১৩১৫-১৬১৬), নবম (১৩১৯-২০), দশম (১৩২০-২১), একাদশ (১৩২১-২২) ও দ্বাদশ খণ্ড (১৩২২-২৩)। তারপরে আর তার দেখা পাইনি। তবে আমার ধারণা বাংলা ১৩২৩ (ইং ১৯১৬) এর পরে আর বেশীদিন পত্রিকা চলে নি, কারণ শেষের দিকে পত্রিকার মালিকানা নিয়ে যেরকম ঝামেলা শুরু হয়েছিল, বেশীদিন টিকে না থাকারই কথা।

এই কথায় বিশদ ভাবে পরে আসছি। পুরোনো অবসর-এর প্রথম সম্পাদক নবকুমার দত্তের জীবন সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানতে পারি নি। তাঁর মৃত্যুর পর ১৯১২ সালে তাঁর পুত্র সুরেনচণ্ডী দত্ত যখন অবসর-এর সম্পাদক হন, তখন তাঁর বয়েস কুড়ি বছর। সুরেনচণ্ডী মাত্র তেইশ বছর বয়েসেই মারা যান। এর পর ১৯১৫ সালে অবসর-এর সম্পাদক হন সুরেনচণ্ডীর কাকা লালবিহারী দত্ত। তার পরের বছর শরচ্চন্দ্র ঘোষ, এটর্নী-এট্‌-ল এক বছরের জন্য সম্পাদকের দায়ভার নেন।

যাকে নিয়ে এই প্রবন্ধের অবতারণা সেই প্রাচীন অবসর ও যাতে এই লেখা পড়ছেন সেই নবীন অবসর, এই দুই প্রজন্মকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে আমরা দেখে নেব, এরা এক জিন-পুল থেকে এসেছে কি না। সেই জন্য ফিরে দেখব সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ইত্যাদি বিষয়ে পুরোনো অবসরের দৃষ্টিভঙ্গী কি ছিল। বর্তমান অবসরে নারীদের সমস্যা তার সমাধানের জন্য আলোচনা হয়, নারীদের সাহায্যের জন্য একটা আলাদা বিভাগ আছে। কিন্তু পুরোনো অবসর নারীদের কেমন চোখে দেখত? আর বাঙালীর হৃদয়ে, শোণিতে যিনি অঙ্গাঙ্গী ভাবে মিশে আছেন সেই কবিগুরুর প্রতি প্রাচীন অবসরের কি মনোভাব ছিল? তাঁর কোনো লেখা অবসরে ছাপা হয়েছিল কি? এই প্রশ্নগুলি আমরা এক এক করে আলোচনা করব।

আমাদের বর্তমান অবসর মূলত তথ্য ও বিনোদনের পত্রিকা। কিন্তু পুরোনো অবসরের তালিকা ছিল পাঁচমিশেলী; গল্প, কবিতা, ধারাবাহিক উপন্যাস, ইতিহাস, উপদেশ-ভারাক্রান্ত প্রবন্ধ, টুকরো-টাকরা হালফিলের খবর এবং আবশ্যিক ভাবেই হিন্দু ধর্ম চর্চা। পুরোনো অবসর ছিল রক্ষণশীল ও প্রাচীনপন্থী। তার দৃষ্টিতে যা প্রাচীন সেগুলি সবই ভালো আর যেসব চিন্তাধারা পুরোনোকে ভেঙ্গে নতুন করে গড়ার রসদ যোগাচ্ছে, সেসব এক্কেবারে বর্বর, ছি ছি। সেজন্যই পুরোনো অবসরে কালের গতিতে সনাতন হিন্দু ধর্মের অবনতির বিলাপ করে সংস্কৃত শ্লোকের কাঁটা বিছানো প্রবন্ধ নিয়মিত প্রকাশ হতে দেখেছি। যেমন -

“কেহ কেহ বলেন……… হিন্দুদিগের যশঃসূর্য্য চিরদিনের মতো অস্তমিত হইয়াছে। শত সহস্র চেষ্টা করিলেও ভারত বক্ষে যশোরবি আর উদিত হইবে না।…………… (সুতরাং) সকলে একতা বন্ধনে বদ্ধ হইয়া উন্নতি বিষয়ে প্রাণপণে সচেষ্ট হউন। ”     (ভাদ্র, ১৩১৫)।
“ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণ শাস্ত্র অধ্যয়ন, বেদপাঠ, যাগ-যজ্ঞ ও পৌরহিত্য কর্ম্মে নিয়োজিত ছিলেন, কিন্তু আজকাল প্রায় সকল সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণ কৃষিকার্যে মনোযোগী হইয়াছেন। তাঁহারা শাস্ত্র অধ্যয়নের পরিবর্ত্তে, কৃষকের নিকট কৃষিকার্য্য অধ্যয়ন, বেদপাঠ বিনিময়ে কৃষকের অশ্লীল ভাষা শিক্ষা ও পৌরহিত্যের পরিবর্ত্তে সার, মাটি দিয়া জমীর অর্চ্চনা করিয়া থাকেন। …… পূর্ব্বে বৈদ্যেরা রোগ চিকিৎসা করিত। তাঁহাদের পূর্ব্বপুরুষ হইতে চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শী বলিয়া, বংশপরম্পরায় সেই কাজ করিত। আজকাল বৈদ্যের নাম লোপ পাইয়া ঘরে ঘরে কবিরাজ, ডাক্তার বিরাজ করিতেছে।”     (আশ্বিন-কার্তিক, ১৩২০)

পাশ্চাত্য শিক্ষা ছিল পুরোনো অবসরের দু-চক্ষের বিষ। এক লেখক অবসরের পাতায় জোর সওয়াল করেছেন,

“প্রকৃত কথা পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুকরণ করিতে গিয়া আমাদের সর্ব্বনাশ উপস্থিত হইয়াছে। ”     (শিক্ষা ও শিক্ষার আদর্শ, শ্রাবণ ১৩২২)।

আর একজন বলতে চাইছেন, পাশ্চাত্য শিক্ষা পড়াবো, কিন্তু অল্প-স্বল্প।

“…… যদি শুভঙ্করী মানসাঙ্কের সঙ্গে সঙ্গে একটু স্বাস্থ্য-শিক্ষা একটু উদ্ভিদ বিদ্যা চলিয়া যায়, - আমাদের আপত্তি নাই। রামায়ণ-মহাভারতের পুণ্য কথার সঙ্গে সঙ্গে যদি, হামির গারিবলডির পুণ্য চরিতকাহিনী জড়িত হইয়া যায়, তাহা হইলেও আমরা অসংলগ্ন বলিব না; - শিক্ষা তো বটে।”     (শিক্ষা-সমস্যা, শ্রাবণ, ১৩২১)

এর থেকে আশা করি আপনারা ধারণা করতে পারছেন যে প্রাচীন ও নবীন অবসরের লক্ষ্য এবং সাংবাদিক দৃষ্টিভঙ্গী একেবারে বিপরীত মেরুতে। তবুও যেহেতু দুটোই পত্রিকার পর্যায়ে পড়ে, তাই তাদের বিষয়সূচীতে কিছু মিল তো থাকবেই। যেমন, দুই অবসরেই লেখা হয়েছে ভ্রমণ কাহিনী, বিবিধ প্রসঙ্গ, ইতিহাস, বইয়ের খবর, জীবনী এবং সাহিত্য আলোচনা। তবে দৃষ্টিভঙ্গীর এত ফারাকের মধ্যেও আশ্চর্যের ব্যাপার যে, পুরোনো অবসর ঘাঁটতে ঘাঁটতে এমন কয়েকটি বিষয় পেয়েছি যা নিয়ে পুরোনো ও বর্তমান দুই অবসরেই লেখা হয়েছে। যেমন - বর্তমান অবসরে দীপক সেনগুপ্ত পুরোনো সাময়িকী নিয়ে নিয়মিত লিখে থাকেন ও জ্যোতিষ বিদ্যা প্রবেশিকা নিয়ে একসময় প্রচুর লিখেছেন। পুরোনো অবসরে ‘বঙ্গের প্রাচীন সংবাদ পত্র’ নিয়ে লিখেছেন শ্যামলাল গোস্বামী (আশ্বিন-কার্তিক, ১৩১৬ এবং আশ্বিন-কার্তিক ১৩২০)। জ্যোতিষ বিষয়ে লিখেছেন কালীকণ্ঠ কাব্যতীর্থ ‘পঞ্জিকা সংস্কার’ (আষাঢ় ১৩১৯), সতীশচন্দ্র আচার্য লিখেছেন ‘হিন্দু জ্যোতিষ’ (আশ্বিন-কার্তিক ১৩১৫)। জানুয়ারী ২০১৬ তে বর্তমান অবসরে ‘মালবিকা ও মল্লিনাথ’ লিখেছেন শিবাংশু দে। আর পুরোনো অবসরে একই বিষয় নিয়ে ‘বাজবাহাদুর ও রূপমতী’ লিখেছেন লালগোপাল মিত্র (১৩১৫, চৈত্র)। পাঁচকড়ি দে’র লেখা ‘নীলবসনা সুন্দরী’ কয়েকবছর আগে বর্তমান অবসরে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছিল, আর স্বয়ং পাঁচকড়ি দে ‘খুন না আত্মহত্যা’ বড়ো গল্পটি লিখেছিলেন পুরোনো অবসরে (ভাদ্র ১৩১৯)।

সেযুগের অন্যান্য পত্রিকার মতো পুরোনো অবসরে প্রায় প্রতি সংখ্যাতেই একটা ভ্রমণ কাহিনী লেখা হত, যদিও সেই ভ্রমণের চৌহদ্দি হাতের কাছাকাছিই হতো। যেমন, পলাশী ও মুর্শিদাবাদ (শ্রাবণ ১৩২১), বিষ্ণুপুর (ভাদ্র ১৩২১), চিল্কা (১৩২২ বৈশাখ), ইত্যাদি। ভ্রমণপিপাসুরা সরল মনে যা দেখেছেন তাই লিখেছেন, বেড়াতে যাবার প্রস্তুতি থেকে আরম্ভ করে, টিকিট কাটিলাম, ট্রেনে চড়িলাম, স্টেশন আসিল, ইত্যাদি কোনো খুঁটিনাটিই বাদ যেতনা। একটি উদাহরণ দিলাম,

“ … পার্বতীপুর ষ্টেশনটি বেশ জাঁকাল রকমের। আমরা অবতরণপূর্ব্বক ওভারব্রীজ পার হইয়া পরপারে গৌহাটির গাড়ীর জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। অল্পক্ষণ পরে গাড়ী আসিলে তাহাতে নিজেদের বিছানাপত্র পাতিয়া ঘুমাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। ”     (কামাখ্যা ও চন্দ্রনাথ ভ্রমণ – পৌষ, ১৩২১)।

মাঝে মাঝে অল্পস্বল্প ভুলভালও দেখি, যেমন একজন হাওড়া থেকে খড়্গপুর রেলে যেতে ‘শোন’ নদী পেরিয়েছেন (সম্ভবত রূপনারায়ণের সাথে গুলিয়ে ফেলেছিলেন)। তবে ভ্রমণ কাহিনী গুলি পড়ে একটা কথা স্পষ্ট বোঝা যায় -  জায়গাগুলি সেই সময় এখনকার মতো ভীড়াক্রান্ত ছিল না আর একটা নির্ভেজাল সৌন্দর্য জড়ানো ছিল।  

এবারে আসি গল্প-কবিতা-উপন্যাসের জগতে। এতো বছরের পুরোনো অবসর ঘেঁটে আমি খালি একটি মাত্র লেখা পেয়েছি, যা চলিত ভাষায় লেখা। অন্যগুলি শুধু বঙ্কিমি ভাষায় ও স্টাইলে লেখাই নয়, তাদের অনেকগুলিতে বঙ্কিমি প্রভাব স্পষ্ট। অনেক স্থানে তা বঙ্গিমচন্দ্রের অক্ষম অনুকরণ (দেবীগড় - সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য) বা সোজাসুজি চুরি। মনোমোহন মজুমদার নামে জনৈক লেখক ‘রমণী’ নামের প্রবন্ধে বঙ্গিমচন্দ্রের মনুষ্যফল থেকে কেমন নির্দ্বিধায় চুরি করেছিলেন তার একটি নমুনা নীচে দিলাম।

“চারিটি পদার্থ লইয়া নারিকেল; জল, শস্য, মালা ও সিটি। নারিকেলের প্রথমাবস্থা ডাবের ন্যায়……নারিকেলের জলে নারীস্নেহের পীযুষধারা……… নারিকেলের শস্য স্ত্রীবুদ্ধি, কবি বলিয়াছেন করকচি বেলায় বড়ো থাকে না…… অবশেষে মালা, ইহা নারীর বিদ্যা……খণ্ডিতাবস্থায়ই ইহার পূর্ণাবয়ব।…”

আর একটি নমুনা, যা পড়ে দুর্গেশনন্দিনীর শুরুটা মনে পড়ে যায়,

“আজি হইতে প্রায় পাঁচশত আশী বৎসর পূর্বে এই দুর্গম অরণ্য পথে এক অশ্বারোহী ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতে ছিল।…বেলা অবসান প্রায়। ভগবান মরীচিমালী অস্তাচল চূড়াবলম্বী হইবার উপক্রম করিতেছেন……বনপ্রান্তে নীল গিরিমালা অন্ধকারে মেঘমালার ন্যায় দৃষ্ট হইতেছে। ”     (বীরবালা, মণিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, আষাঢ়, ১৩১৬)

বাংলা সাহিত্য নিয়ে মাঝে মধ্যে পুরোনো অবসরে যা লেখা হত, তাতেও দেখেছি সেই পুরোনোকে আঁকড়ে ধরে থাকার চেষ্টা। লেখক সারদাচরণ চৌধুরী তাঁর ‘ইতিহাস ও জীবনচরিত পাঠের উপকারিতা’ (ফাল্গুন ১৩১৫) প্রবন্ধে লিখছেন,

“আজকাল বঙ্গদেশে উপন্যাসের বড়ো ছড়াছড়ি দেখা যায়। অসার উপন্যাসে বঙ্গ-সাহিত্যে আবর্জনা জমিয়া গিয়াছে। ”

তাঁর মতে বঙ্কিমচন্দ্র ও বিদ্যাসাগর মশাইয়ের পরে বাংলা সাহিত্যে আর কোনো পড়ার উপযুক্ত উপন্যাস লেখা হয় নি।

হেমেন্দ্রকুমার রায় গুপ্ত তাঁর লেখা ‘বঙ্গভাষার ক্রমোন্নতি’ (বৈশাখ – জ্যৈষ্ঠ ১৩১৬) প্রবন্ধে ফোর্ট উইলিয়ামের বাংলা থেকে শুরু করে, বিদ্যাসাগর মশাই, গিরীশ ঘোষ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, প্যারীচাঁদ মিত্র সকলের প্রসঙ্গ এনেছেন এবং বঙ্গিমচন্দ্রের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কপালে জুটেছে ব্যঙ্গ। ঈশ্বর গুপ্তের একটি অনুপ্রাস-কণ্টকিত লেখার তুলনা করতে গিয়ে লেখক বলেছেন এই ভাষা ‘মরি হায় হায়’ শ্রেণীর!
পুরোনো অবসরে ‘অন্তে’ নামের একটা কবিতা পেয়েছি (ভাদ্র-আশ্বিন ১৩২০), কবির নাম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কবিতাটির ছবি দিলাম। আমি বঙ্কিম রচনাবলীতে এই কবিতা খুঁজে পাই নি। এটি কি তাঁর কোনো অপ্রকাশিত কবিতা, যা তাঁর মৃত্যুর কুড়ি বছর পরে ছাপা, নাকি এর লেখক অন্য কোনো বঙ্কিমচন্দ্র? পাঠকদের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি, যদি কেউ আলোকপাত করতে পারেন, ভালো হয়।

পুরোনো অবসরে ইতিহাসভিত্তিক গল্প-উপন্যাস প্রচুর লেখা হয়েছে। ইতিহাস নিয়ে নিয়মিত লিখে গেছেন শ্যামলাল গোস্বামী, ‘প্রাচীন ভারতে শাসন প্রথা’ (ভাদ্র ১৩১৯), ‘সম্রাট অশোক ও বৌদ্ধধর্ম’, (জ্যৈষ্ঠ ১৩২০), ‘প্রাচীন ভারতে গভর্নমেন্ট’ (শ্রাবণ ১৩২০)। কিন্তু আমার ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে প্রামাণ্য মনে হয়েছে হেমেন্দ্রকুমার রায়ের লেখা ‘আর্য্য স্থাপত্য’ (আশ্বিন-কার্তিক ১৩১৫)। প্রবন্ধটি প্রচুর গবেষণা করে লেখা ও এতে সেযুগের কয়েকজন বিখ্যাত পণ্ডিতের লেখার থেকে রেফারেন্স দেওয়া আছে।

বর্তমান অবসরে ঋজু গাঙ্গুলি নিয়মিত ‘বইয়ের খবর’ বিভাগে লিখে থাকেন। পুরোনো অবসরেও একটা পুস্তক সমালোচনা বিভাগ থাকত, তবে সেখানে বইয়ের নৈর্ব্যক্তিক আলোচনার চেয়ে পরস্পরের পিঠ চুলকানিই বেশী হত। দু-একটা উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য নামের এক পণ্ডিত সম্পাদকের উপদেষ্টা হিসেবে অবসরের সাথে শুরু থেকে শেষ অবধি জড়িত ছিলেন। তাঁর রচনা অবসরে প্রায়ই বেরোত, কখনো বা একই সংখ্যায় একাধিক। তাঁর ‘ব্রহ্মচর্য্য বিদ্যা’ বইয়ের আলোচনায় পুরোনো অবসর পত্রিকা লিখছে

“এই মহাগ্রন্থ মানুষের সহচর……। আশা করি এই মহান উজ্জ্বল পবিত্র গ্রন্থ প্রত্যেক গৃহস্থের বাড়ীতে বাড়ীতে সুশোভিত হইবে। ”

অতুলকৃষ্ণ গোস্বামীর লেখাও পুরোনো অবসরে প্রায় প্রকাশিত হতো। ইনি ছিলেন সম্পাদক সুরেনচণ্ডীবাবুর মন্ত্রদাতা গুরু। গুরুনিন্দা মহাপাপ বলে তাঁর লেখার ভূয়সী প্রশংসা করা হতো। অতুলকৃষ্ণবাবুর লেখা ‘ভক্তের জয়’ সমালোচনা করে সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য লিখেছেন

“সাহিত্য হিসাবে ভক্তের জয় শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ।”

তাঁর লেখা ‘পূজার গল্প’ (১৩২১) সম্বন্ধে পুরোনো অবসর উচ্ছ্বাসিত ভাবে লিখেছিল

“অতুলকৃষ্ণের অতুল ভাষা সম্পদ আজ বঙ্গ জুড়িয়া বিজ্ঞাত। সেই ভক্তির ভাষায়, ভক্তের ভাবে ভক্তিময় এই চারিটি আখ্যান বিরচিত। পড়িতে পড়িতে ভাব-নদীতে তুফান ওঠে।”

অন্য আর এক কবি হরিপদ মুখোপাধ্যায়ের ‘গীতিকোচ্ছ্বাস’ নামের গানের বইটি সম্বন্ধে পুরোনো অবসর লিখেছিল,

“ভাবশূন্য কেবল শব্দ ঝংকার কবিতা ও গান শুনিয়া কান ঝালাপালা হইয়া যাইতেছে। এ সময় এমন সরস রস-রচনা বড়ই দুর্ল্লভ।”

রবীন্দ্রসংগীত বোধহয় সমালোচকের মনে ধরেনি!!

আচ্ছা, ডায়েরী কি পুস্তকের মধ্যে পড়ে? পুস্তক আলোচনা বিভাগে অবসর লিখছে,

“যাঁহারা ডায়েরী ব্যবহার করেন তাঁহারা ঘোষের ডায়েরী ব্যবহারে নিশ্চয় পরিতুষ্ট হইবেন।”

মাঝে মাঝে বেশ কিছু মজার জিনিসও খুঁজে পেয়েছি, যেমন

“প্রবন্ধ প্রকাশে দেরী হইল, সেজন্য লেখকই ষোল আনা দায়ী।”     (চৈত্র ১৩১৫)

স্ত্রীলোকের অভিমান নিয়ে এক গুরুগম্ভীর প্রবন্ধের অবতারণা করে অবশেষে লেখক রণে ভঙ্গ দিয়েছেন

“যদিও এই প্রবন্ধে মানের কোনো উপায় করিতে পারিলাম না।”বলে     (মাঘ ১৩১৫)।

‘ভালোবাসা ও প্রেম’ (বৈশাখ ১৩২৩), প্রবন্ধের সমালোচনাতে লেখা হয়েছে -

…যেমন জল জমিয়া বরফ হয়, সেইরূপ ভালোবাসা রূপান্তরিত হইয়া অর্থাৎ গাঢ়ত্ব প্রাপ্ত হইয়া প্রেমে পরিণত হয়।”

টুকরো খবরের মধ্যে ছিল গড়ের মাঠে স্পেন্সার সায়েবের বেলুন বিহার দেখতে প্রচণ্ড ভীড়, লোকে ট্রামে, গাড়ীতে বাদুড়ঝোলা, শোভাবাজার থেকে গড়ের মাঠে গাড়ী ভাড়া ১৫ টাকা, ইত্যাদি (ভাদ্র ১৩২০)।  

পুরোনো অবসরে বিজ্ঞান বিভাগ বলে কিছু ছিল না, তবে বিজ্ঞানের বিষয়ে যা ছাপা হতো তাতে অনেক সময় শাস্ত্রের উপদেশ বা আজগুবি কিছু লেখা হতো। যেমন ‘মঙ্গল গ্রহে মানবের অস্তিত্ব’ (অগ্রহায়ণ, ১৩২২), প্রবন্ধে লেখা হয়েছে মঙ্গল গ্রহ যখন পৃথিবীর কাছে এসেছিল তখন কয়েকজন মঙ্গল বাসী সেখানে থেকে ছিটকে এসে পড়েছিল, তারাই পৃথিবীর বর্তমান মানবকুলের পূর্বপুরুষ। ১৩১৯ সালে এক লেখক ‘নারিকেল’ প্রবন্ধে বাংলার লোকজনকে নারকেলের চাষ করতে অনুরোধ করেছেন। তবে বিজ্ঞান বিষয়ক ‘প্রস্তর হইতে সীসা নিষ্কাশন প্রণালী’ (মাঘ ১৩২২) লেখাটি ভালো হয়েছিল।

 আমার পুরোনো অবসর পড়ে মনে হয়েছে যে এই পত্রিকাটি সমসাময়িক ঘটনার স্রোত থেকে নিজেকে দূরে রাখতে ভালোবাসতো। আমার সমীক্ষার সময়টুকুতে (১৯০৯ – ১৯১৬) বাংলা এবং ভারতের সমাজ ও ইতিহাসে কত কি ঘটে গেছে, প্রাচীন অবসর সেবিষয়ে উদাসীন ছিল। ১৯১১ সালে ভারতের রাজধানী বদল, হার্ডিঞ্জের ওপর বোমা, মোহন বাগানের আই এফ এ শিল্ড জয়, ১৯১২ তে বঙ্গভঙ্গ রদ, ইত্যাদি ঘটনা সম্বন্ধে পুরোনো অবসর নীরব এবং সবচেয়ে বড়ো কথা ১৯১৩ তে রবিঠাকুরের নোবেল জয়ের খবর অবসরের পাতায় অবহেলিত, কোনো উল্লেখই নেই! ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরু হওয়ার পর একচিলতে লেখা বেরিয়েছিল অস্ট্রিয়ার যুবরাজ ও যুবরানীর সারাজেভো শহরে হত্যার খবর দিয়ে। তবে সেই যুগের ভারতে ঘন ঘন দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর উল্লেখ করে পুরোনো অবসরে কিছু লেখা পেয়েছি।

পুরোনো অবসর অন্তরে ব্রিটিশ শাসনের বিরোধী ছিল কিনা জানিনা, প্রকাশ্যে ইংরেজ বিরোধী কোনো কথা বলতে দেখিনি। প্রথম সম্পাদক নবকুমার দত্তের আমলে তবুও ‘বিবিধ প্রসঙ্গ’ বিভাগে দেখি কেমনভাবে মেদিনীপুর বোমার মামলায় আসামীরা জামিন পাওয়াতে জুনিয়র বিচারক কক্স সাহেবের ‘থোঁতা মুখ ভোঁতা হইয়া যায়”, অথবা “বিলাতের সৈন্যদের জন্য ভারতবাসীদের ৮৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ভার” চাপানো নিয়ে সম্পাদকের বক্রোক্তি। কিন্তু তাঁর পরের সম্পাদকদের আমলে সেটুকুও ছিল না। পুরোনো অবসর ভারত সম্রাট পঞ্চম জর্জ ও রানী মেরীর ছবি ছেপেছে, লর্ড রিপন ও চেমসফোর্ডের জীবনী সবিস্তারে ছেপেছে, প্রচুর পৌরাণিক কাহিনীর ছবি ছেপেছে, কিন্তু সেই যুগের ভারত-গৌরব মানুষগুলির ছবি দেয় নি।

পুরোনো অবসরে যেসব ভারতীয়র জীবনী প্রকাশ পেয়েছে তাদের মধ্যে ছিলেন, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস (ভাদ্র, ১৩২০), গুরু অর্জুন সিংহ (আশ্বিন/কার্তিক ১৩১৫), স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী (১৩১৫, পৌষ), সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন (বৈশাখ/ জ্যৈষ্ঠ ১৩১৬) ও টিপু সুলতান।

এবারে পুরোনো অবসর নারীদের কেমন চোখে দেখত তার আলোচনা করব, কিন্তু তার আগে একটা সাবধানবাণী দিয়ে রাখি। কেউ যদি নীচের অংশটুকু পড়ে খড়্গহস্ত হন, তাহলে বলে রাখি যে মুজরিম একশো বছর আগেই বেপাত্তা, আমি গরীব এক বার্তা-বাহক মাত্র।

পুরোনো অবসরের মতো রক্ষণশীল পত্রিকার চোখে সমাজে নারীদের স্থান ছিল গৃহকোণে। মেয়েদের অল্পবয়সে বিয়ে হওয়া উচিত, বেশী পড়াশুনো না করে গেরস্থালী শেখা উচিত - এই ছিল তার বক্তব্য, আর সেগুলি পেশ করা জন্য সাথে থাকত শাস্ত্রের থেকে কুযুক্তির আঁকশি দিয়ে পাড়া কিছু শ্লোক। কয়েকটি উদাহরণ এখানে দিলাম।

“… এদেশের মেয়েদের বাল্যাবস্থাতেই বিবাহ হওয়া ন্যায়সঙ্গত। কেন না এ দেশ গ্রীষ্ম প্রধান, বালিকারা অল্প বয়েসেই ঋতুমতী হয়। সুতরাং ঋতুমতী হইবার পূর্ব্বে বালিকাকে সম্প্রদান করা নিতান্ত কর্ত্তব্য। …………পুরুষ হইতে স্ত্রীর পবিত্রতা রক্ষা করা অধিক পরিমাণে কর্ত্তব্য। যে হেতু প্রকৃতিই উৎপত্তির মূল কারণ। সেই প্রকৃতি যদি কোন কারণে দূষিত হয়, তাহা হইলে সেই দোষের ভাগ পরবর্ত্তী সন্তানে প্রবর্ত্তিত হইবে। কিন্তু পুরুষ যদি আচার বিহীন ও ভ্রষ্ট হয়, তাহা হইলে যতটা অনিষ্ট হইবে, একটি স্ত্রীলোক সেই দোষে দোষী হইলে তাহা অপেক্ষা অধিক পরিমাণে নিন্দার, ঘৃণার ও লজ্জার কারণ হইবে। …স্ত্রীলোকের প্রধান কর্ত্তব্য স্বামী সেবা। স্বামীই স্ত্রীর একমাত্র গতি। তিনি যা’ই হোন না কেন, প্রত্যেক স্ত্রীর স্বামী আপন স্বামীর অনুবর্ত্তিনী হইবে।” (ভারতে বাল্য বিবাহ – গোবিন্দ চন্দ্র রায়, চৈত্র ১৩২১।

এর কয়েক সংখ্যা পরেই নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় নামে আর এক লেখক বলতে চাইছেন যে নারীদের সীতা-সাবিত্রীর মতো প্রাচীন মহীয়সী নারীদের জীবনী ছাড়া আর কিছু পড়া উচিত নয় (বিশেষ করে ‘বিষবৃক্ষ’- এর ওপরে একটু বেশী রাগ)। গয়না-গাঁটি পরা বা প্রসাধন না করে প্রাচীনাদের মতোই ‘খোল’ দিয়ে গা পরিষ্কার করা উচিত, ইত্যাদি।  

মনে রাখতে হবে যে এগুলি যখন লেখা হয়েছিল (মার্চ-এপ্রিল ১৯১৫ সালে), তার প্রায় দুই দশক আগের থেকেই বাঙ্গালী মহিলারা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডী টপকেছেন, বিদেশে গেছেন, ডাক্তার হয়েছেন, লেখক হয়েছেন, এবং অনেক মহিলারাও পুরোনো অবসরে নিয়মিত লিখেছেন। বিজনবালা বসু, স্বর্ণপ্রভা মজুমদার (এঁর মাতৃপূজা কবিতার প্রথম কয়েকটি ছত্রের ছবি নীচে দিলাম), সুশীলাবালা দে, এঁরা নিয়মিত পুরোনো অবসরে কবিতা লিখেছেন। পঙ্কজকুমারী দেবী সুনন্দা নামে একটি প্রাচীন বৌদ্ধ আখ্যায়িকা লিখেছেন। চোখের সামনে এত উদাহরণ সত্ত্বেও কিছু গোঁড়া মানুষের চিন্তাধারা তখনও প্রাচীন খাতে বইত, আর এখনো বইছে।

বোধহয় এঁদের মতো মানুষগুলির কথা মনে রেখেই কবিগুরু লিখেছিলেন

“বাহিরপানে তাকায় না যে কেউ
দেখে না যে বাণ ডেকেছে
জোয়ার-জলে উঠছে প্রবল ঢেউ।”

রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে পুরোনো অবসরের এক বিচিত্র দৃষ্টিভঙ্গী ছিল। সুরেনচণ্ডী দত্ত সম্পাদক হবার পর পাঁচকড়ি দে, জলধর সেন প্রমুখের লেখা প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তার কথা মনে রেখে, অন্য সব রচনা বাদ দিয়ে খালি তাঁর গান প্রকাশ করার কথা লিখেছেন।

“এতদ্ভিন্ন বঙ্গবাসী সম্পাদক শ্রী যুক্ত বেহারীলাল সরকার মহাশয়ের এবং কবি-রবি শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের নূতন নূতন গান অবসরে প্রকাশ হইবে।”     (সম্পাদকীয়, ভাদ্র ১৩১৯)।

এ যেন চাঁদ সদাগরের পেছন ফিরে বাঁ হাতে ফুল দিয়ে মনসার পূজো করা।

রবি ঠাকুরের প্রতি ব্যঙ্গ কটাক্ষ কেমন স্তরে পৌঁছে ছিল তার উদাহরণ স্বরূপ অমূল্যচরণ ঘোষ বিদ্যাভূষণ নামের এক লেখকের প্রবন্ধের একাংশ তুলে দিলাম।

“……বঙ্গভারতীর অঙ্গে নব্য সাহিত্য চিকিৎসকদের ছুরিকাঘাত দেখিয়া, প্রত্যহই আমাদের চোখ দিয়া জল বাহির হইতেছে। ……অক্ষয়, বিদ্যাসাগর, ভূদেব, বঙ্কিম, কালীপ্রসন্ন প্রমুখ সাহিত্য মহারথীদের সাধনার ধন, বড়ো আদরের ধন, তাঁহাদের প্রাণাপেক্ষা গরীয়সী জননীর এ দুর্দ্দশা দেখিয়া বোধহয় তাঁহারা স্বর্গ হইতেও অশ্রুপাত করিতেছেন। এখনও ভারত-গগনের চির উজ্জ্বল রবি রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য গগন আলোকিত করিয়া রহিয়াছেন। এখনও আমরা বঙ্কিম মণ্ডলের শেষ জ্যোতিষ্ক অক্ষয় চন্দ্রের দিকে চাহিয়া আছি, সাহিত্য-ধুরন্ধর পণ্ডিত প্রবর হরপ্রসাদের দিকে চাহিয়া আছি, তাঁহারা কি ইহার প্রতিকারের চেষ্টা করিবেন না। ………… আধুনিক কবিদিগের কবিতা আমরা ঠিক বুঝিতে পারিনা। বঙ্গের রবীন্দ্রনাথ বিদেশ হইতে Mystic কবিতার চারা আনিয়া সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা বাঙ্গালাদেশে যেদিন রোপণ করিলেন, যেদিন তিনি “সোনার তরী” প্রথম ভাসাইলেন, জানি না সেদিন বাঙ্গালার সুদিন কি দুর্দ্দিন। তারপর যখন “দিনের শেষে ঘুমের দেশে……কাজ ভাঙানো গান” গায়িলেন, শেষ ‘খেয়ায়’ পাড়ি দিলেন, সেই দিন হইতে তাঁহারই চরণে স্মরণ লইয়া বঙ্গের আধুনিক কবিকুল ছুটিলেন। …উর্ব্বর বাঙ্গালা দেশের মাটির ও আবহাওয়ার গুণে অল্প দিনের মধ্যে শত সহস্র দুর্ব্বোধ্য কবিতার সৃষ্টি হইল। এই শ্রেণীর কবিতার ভাষার শিঞ্জিনী আছে, নূপুরের গুঞ্জন আছে, কিন্তু প্রাণ মাতিতে চায় না – ভাব কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিতে চায় না ভাবের অভাবে, প্রাণের অভাবে, এগুলি যন্ত্রচালিত পুত্তলিকার ন্যায় শব্দ করিতে সত্য। এই সকল Mystic কবিতা দেহী আত্মার সহিত চিরসুন্দর পরমাত্মার সংযোগ মূলক বলিয়া কোন কোন সমালোচকদের মুখে শুনিয়া থাকি, কিন্তু আমরা এগুলিতে যোগের কিছুই দেখিতে পাই না – দেখি বিয়োগ – ভাবের অভাব।”     (ভাদ্র-আশ্বিন ১৩১৯)।

প্রবন্ধটি মালদা সাহিত্য সভাতে পঠিত। এই আলোচনা প্রকাশের প্রায় একবছর পরে কবির নোবেল প্রাইজ পাবার সুসংবাদ জানতে পেরেছিল পৃথিবীবাসী। কিন্তু নোবেল প্রাইজ পাবার পরেও অবসরের দৃষ্টিভঙ্গীর যে বিশেষ কিছু বদল হয় নি, তার প্রমাণ হচ্ছে বৈশাখ ১৩২৩ সংখ্যায় টুকরো খবর বিভাগে এই অংশটি।

“কবিবর স্যার রবীন্দ্রনাথ জাপানে গমন করিতেছেন। জনরব তথা হইতে আমেরিকা গমন করিবেন। ভরসা করি বিদেশী সম্মান আমদানী করিয়া বঙ্গ সাহিত্যকে বাধিত করিবেন।”

এতকিছুর পরেও কবিগুরু কিন্তু সম্পাদক সুরেনচণ্ডীবাবুর অনুরোধ ফেলতে পারেন নি। তাঁর একমাত্র লেখা পুরোনো অবসরে প্রকাশ পেয়েছিল ভাদ্র, ১৩২০ সংখ্যাতে। লেখাটি ছিল ‘কতবার ভেবেছিনু …” গানটি, ‘অবচিত’ নামের কবিতারূপে। গানটির ছবি নীচে দিলাম।

সব সফল-অসফল পত্রিকারই একদিন শেষ সংখ্যা বের হয়। পুরোনো অবসর কিন্তু শেষ হয়েছিল পারিবারিক উত্তরাধিকারের মামলার জন্য। আগেই বলেছি সুরেনচণ্ডীবাবু অল্প বয়সে মারা যাবার পর, তাঁর কাকা লালবিহারী দত্ত পুরোনো অবসরের সম্পাদক হন। কিন্তু সুরেনচণ্ডীবাবু্র নাবালিকা স্ত্রী ও শাশুড়ি লালবিহারী দত্তের বিরুদ্ধে মামলা করেন। আদালতের আদেশ অনুযায়ী শরচ্চন্দ্র ঘোষ, এটর্নী-এট্‌-ল, অবসরের দায়ভার নেন। কিন্তু তিনি একবছর পরেই ছেড়ে যান। যাবার আগে একটি মর্মস্পর্শী সম্পাদকীয়তে লেখেন

“সম্পর্ক এক দিনের হউক বা এক বৎসরের হউক, বিচ্ছিন্ন করিতে স্বতঃই কষ্ট অনুভব হয়। কিন্তু নিরুপায় হইয়াই আমাকে এই বন্ধন ছিন্ন করিতে হইতেছে।……বিদায়কালে আমি গ্রাহক ও পাঠকদিগের নিকট আমার কৃত জ্ঞানতই হউক আর অজ্ঞানতই হউক, সকল অপরাধের জন্য ক্ষমা চাহিতেছি। ……সর্ব্বশেষে সাহিত্যদেবতার চরণে সহস্র প্রণিপাত করিয়া আজ আমি সকলকার নিকট হইতে অবসর চাহিতেছি।…… যিনি বিশ্বনিয়ন্তা ও বিশ্বদেবতা তিনি “অবসর”কে অক্ষয় জীবন দান করুন।”    (শ্রাবণ ১৩২৩)।

শরচ্চন্দ্রবাবুর প্রার্থনা সফল হয় নি। তাঁর বিদায়ের পরে আমি অবসরের আর কোনো সংখ্যা খুঁজে পাই নি। হয়তো আরো কিছুদিন চলেছিল, কিন্তু তাঁর প্রার্থনা মতো মহাকাল পুরোনো অবসর-কে অক্ষয় করেন নি।

শুরুতে প্রশ্ন রেখেছিলাম প্রাচীন ও নবীন এই দুই অবসর-কি একই জিন পুলের অন্তর্গত? এর উত্তর কঠিন, কারণ এদের মধ্যে একশ বছরের ফারাক, তাই আমের সঙ্গে আমড়ার তুলনা হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। পুরোনো অবসর সমকালীন পত্র-পত্রিকাগুলির তুলনায় কতটা রক্ষণশীল বা উদারমনা ছিল সেসব বিচার করতে হয়। সেটা এই প্রবন্ধের পরিধির বাইরে। তাই এর মীমাংসা আমি পাঠকদের কাছেই ছেড়ে দিচ্ছি। (পুরোনো বানান অপরিবর্তিত)

কৃতজ্ঞতা স্বীকার- দীপক সেনগুপ্ত অবসর-এ ‘পুরোনো সাময়িকী ও সংবাদপত্র’ বিভাগে নিয়মিত লিখছেন। তাঁর লেখা থেকেই এই প্রবন্ধের অনুপ্রেরণা। বন্ধুবর ভাস্কর বসু রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজ সম্বন্ধে কিছু জরুরী তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন। এঁদের দুজনের কাছেই আমি কৃতজ্ঞ।


লেখক পরিচিতি - যাদবপুর ও ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্‌টিটিউট অফ সায়েন্সের প্রাক্তনী। বর্তমানে আমেরিকার সেন্ট লুইস্‌ (মিসৌরী) শহরবাসী। ইতিহাস পেশা নয়, নেশা। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসও Indology নিয়ে নাড়াচাড়া করতে ভালবাসেন।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।