অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


চলচ্চিত্র

অক্টোবর ১, ২০১৭

 

বিষণ্ণতার ডেকালগ : কিস্‌লভ্‌স্কি

পার্থপ্রতিম

১৯৬৪ সাল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে কুড়ি বছর পেরোয়নি। পোলান্ডের সুবিখ্যাত ওজ ফিল্ম স্কুল, রোমান পোলানস্কি আর আন্দ্রে ওয়াজদা এককালে পড়েছেন এই স্কুলে; তেইশ বছরের যুবক খ্রিস্টভ কিস্‌লভ্‌স্কি ভর্তি হলেন। কারণ যতটা না শিল্পের প্রতি আকর্ষণ, তার চেয়েও বেশি সেনাবাহিনীতে ঢোকার ভয়। বাধ্যতামূলক মিলিটারি টেস্টে ফেল করার জন্য খাওয়াদাওয়া ছেড়ে ওজন কমানোও শুরু করেছিলেন ওই সময়। শেষমেশ দুবছরের চেষ্টায় ঢুকে পড়লেন ওজ স্কুলে।

খ্রিস্টভ কিস্‌লভ্‌স্কি --- সূত্র - ইন্টারনেট

ছবি বানানো শিখতে শিখতেই লেগে পড়লেন ডকুমেন্টারি তৈরীর কাজে। উপাদান হিসেবে নিলেন বাস্তবতা। তীব্র অর্থনৈতিক মন্দায় আক্রান্ত কমিউনিস্ট পোল্যান্ড, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রায় নেই বললেই চলে। টেলিমুভি বানালেন একটা, ‘ওয়ার্কার্স ‘৭১’।

বিশাল কর্ম যন্ত্রের একদম নীচু তলার কর্মী - যাদের চিরকাল ‘শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত, লাঞ্ছিত ‘ বাক্যবন্ধের ভেতর রাখা হয়েছে - তাদের কথা তাদের মুখ দিয়েই বলালেন কিস্‌লভ্‌স্কি। সেন্সর কাঁচি চালাতে কার্পণ্য করল না। ডকুমেন্টারি করা ছেড়ে দিলেন। কারণ হিসেবে পরে বলেছিলেন -’ স্বেচ্ছাচারী শাসনে সত্যি কথা বলা যায় না’। ফিচার ফিল্ম করা শুরু করলেন। পর পর বানালেন ‘পারসোনেল’, ‘দি স্কার’, ‘ক্যামেরা বাফ’ তৈরী করে পেলেন মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের গ্র্যান্ড প্রাইজ।

পরে বিদেশী ফান্ডের টাকায় বানিয়েছেন শেষ চারটি ছবি। ‘দি ডাবল লাইফ অফ ভেরোনিকা’ বাণিজ্যিক সাফল্য পেল, সেই টাকায় জীবনের সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রজেক্টে হাত দিলেন। ‘থ্রি কালারস ট্রিলজি’ - ফ্রান্সের জাতীয় পতাকা অনুসারে তিনটি সিনেমার নামকরণ - নীল, সাদা, লাল - সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার বিখ্যাত রাজনৈতিক আদর্শকে শিল্পের রঙে রঞ্জিত করে পরদায় আনলেন।

পরে স্বভাবসিদ্ধ রসিকতায় কিস্‌লভ্‌স্কি বলবেন - ‘ ওতো ফ্রাঙ্কে (ফরাসী মুদ্রা) বানানো,অন্য দেশের টাকায় ছবিটা বানালে তাদের জাতীয় পতাকা মেনেই করতাম’।

সত্যজিৎ রায় বা মৃণাল সেনের ‘ক্যালকাটা ট্রিলজি’ থাকলেও বেশিরভাগ দর্শক যেমন প্রিয় ছবি হিসেবে ‘পথের পাঁচালী’ বা ‘বাইশে শ্রাবণ’ এর কথাই বলবেন ; তেমন খ্রিস্টভ কিয়েলভস্কি বললেই কোন সিনেফিলি প্রথমেই ‘ডেকালগ’ এর কথাই হয়তো ভাববেন। একজন ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে ডেকালগ মানে মোজেসের ‘টেন কমান্ডমেন্টস’। কিন্তু সিরিয়াস সিনেমাপ্রেমীর কাছে ডেকালগ একটাই - খ্রিস্টভ কিস্‌লভ্‌স্কির পরিচালনায় সর্বকালের সেরা টিভি সিরিজ। এ ভাবেই প্রকৃত শিল্পীরা সংস্কৃতির নতুন সংজ্ঞা তৈরী করেন।

দশটি ছবির সিরিজ ডেকালগ, বলা যায় একদিন মাঝরাস্তায় বন্ধু খ্রিস্তভ পিয়েউইজের মুখোমুখি হয়ে পড়ার ফলশ্রুতি। পিয়েউইজ একজন ল ইয়ার। এনাকেই পরে পাওয়া যাবে পিটর বালিকি চরিত্রের মাধ্যমে রূপায়িত হতে, ডেকালগ ৫ এ তে।

কিছুদিন আগে টেন কমান্ডমেন্টসের ওপর পঞ্চদশ শতাব্দীর একটি শিল্পকর্ম দেখে খুব আলোড়িত হয়েছেন পিয়েউইজ।পোলিশ সমাজে প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পেয়েছেন। কিস্‌লভ্‌স্কিও তখন নতুন কিছু করতে চাইছেন। মাঝরাস্তায় হঠাৎ দেখা গড়াল ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনায়। দুই দ্রষ্টার কথোপথনে সেই দিনই বলা যায় ডেকালগের কাঠামো গড়া হয়ে গেল।

ডেকালগের পটভূমি হিসেবে কিস্‌লভ্‌স্কি বলছেন দুটো শব্দ- ‘chaos and disorder’ - আশির দশকে সাধারণ পোল্যান্ডবাসীর জীবন। দুশ্চিন্তা , অবসাদ, অনাগত ভয়ঙ্করতর ভবিষ্যতের চিন্তায় ক্লিষ্ট - অকারণে বেঁচে থাকা এক দেশ মানুষ। সমকাল উঠে আসে ডেকালগের দশটি ছবিতে।

‘আমি চেয়েছি পোল্যান্ডবাসীর ভেতরের জগৎটা তুলে ধরতে। সেই জগৎ ভয়াবহ আর নিষ্প্রাণ।মানুষের প্রতি মানুষের কোন মমতা নেই, সবাই সবাইকে ঘৃণা করে।এই জগতে কেউ কাউকে সাহায্য তো করেই না বরং বাধা সৃষ্টি করার প্রাণপণ চেষ্টা করে। পোল্যান্ডের মানুষ একা, নিঃসঙ্গ’ -ডেকালগের চরিত্রায়ন একই কথা বলে ।

একাকীত্ব, অবসাদ ছবিগুলিতে চোরাস্রোতের মত বয়ে চলে -’ মানুষ সবচেয়ে বেশি যাতে কষ্ট পায়, আবার স্বীকার করতে না চাওয়ায় নিজেকে প্রতারিতও করে সবচেয়ে বেশি তা এই একাকীত্ব। দৈনন্দিন জীবনের ক্রমবর্ধমান স্বাচ্ছন্দ্যের আড়ালে জীবনের সব জরুরী মাধ্যমগুলো হারিয়ে যাচ্ছে - চিঠি লেখা,আড্ডা মারা প্রকৃত যোগাযোগ।ভাসা ভাসা হয়ে গেছে সবকিছু। এখন আমরা ফোন করি, বেড়াতে যাওয়ার রোম্যান্টিকতা হারিয়ে গেছে -এক এয়ারপোর্টে টিকিত কেটে, উড়ে গিয়ে, নেমে যাওয়া একই রকম দেখতে একটা এয়ারপোর্টে।

স্ট্যানলি কুব্রিক তাঁর সন্মন্ধে বলতে গিয়ে নিছক ভাবনাকে ছবিতে নাটকীয় করে তোলার বিরল প্রতিভার কথা বলেছেন।কিয়েলভস্কির ছবি চোখে আঙুল দাদা হয় না, একটা মর্মস্পর্শী গল্প বলার পাশাপাশি বোদ্ধা দর্শক ছবিতে লুকিয়ে থাকা বক্তব্যগুলো আবিষ্কার করার দুর্লভ সিনেম্যাটিক খেলায় মেতে উঠতে পারেন।ডেকালগ এই ধারার সার্থক উদাহরণ।

ডেকালগ ১ চলচ্চিত্ররূপ টেন কমান্ডমেন্টসের প্রথম নির্দেশ - ঈশ্বরের একাধিপত্য এবং সর্বৈব আত্মসমর্পণ। পরম নাস্তিক পিতার একমাত্র পুত্রসন্তান স্কিইং করতে গিয়ে বরফের স্তর ভেঙে ঠান্ডা জলে ডুবে গিয়ে মরে কাঠ হয়ে যায়। অতিরিক্ত যন্ত্রনির্ভরতার ওপর বড়ো প্রশ্নচিহ্ন বসিয়ে দেয় মর্মান্তিক এই ছবি।

ডেকালগ ৬ এর গল্প এক কিশোরের প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার।একাকী, অন্তর্মুখী, আধা বেকার, মহিলা আর প্রেম সমার্থক করে ফেলে এক অপার্থিব জগৎ তৈরী করা কিশোর যখন ভালোবেসে ফেলে বহু অভিজ্ঞতায় পোড় খাওয়া, নৈতিকভাবে অধঃপতিত এক তরুণীকে - কি ঘটে? স্বপ্নের প্রথম ডেটিং এর পরেই এপার্টমেন্টে এসে তরুণী সেই কিশোরের হাতটা টেনে স্ত্রী অঙ্গে এনে রাখে - this is love! হঠাৎ ‘বড়’ হয়ে ওঠার অভিঘাত সইতে না পেরে হাতের ধমনী কেটে দেয় উনিশ না পেরোন ছেলেটি।পট পরিবর্তন হয়, দান উলটে যায়। তরুণী ও প্রথমবারের মতো বিশ্বাস করে অন্যরকম ভালোবাসাও হয়, কোন পুরনোদিনে সদ্য কিশোরী মন যেরকম ভালোবাসা পেতে চেয়েছিল, বিনিময়ে হয়তো শুনেছিল স্বপ্ন ভাঙার শব্দ।

ডেকালগ ৫ এর কাহিনী এক যুবকের। সে এক ট্যাক্সিওলাকে হত্যা করে, তারপর দেশের বিচারব্যবস্থা খুন করে সেই যুবককে।

পুরো ছবিটি কিস্‌লভ্‌স্কি তোলেন সবুজ রঙের ফিল্টার ব্যবহার করে। সবুজ সৃজনশক্তির রঙ, সবুজ প্রত্যাশার রঙ। কিন্তু এই রঙই ক্যামেরায় ব্যবহৃত হলে পৃথিবীকে রিক্ত, নির্মম, নিষ্প্রাণ দেখায়। আইন ব্যবস্থা কি তাই নয়! এই ছবির ফলশ্রুতি হিসেবে, নতুন সরকার পোল্যান্ডে পাঁচ বছরের জন্য মৃত্যুদন্ড স্থগিত রেখেছিল।

কিস্‌লভ্‌স্কির জীবনদর্শন ডেকালগের প্রতিটি দৃশ্যে প্রচ্ছন্ন।

বেশিরভাগ চরিত্রের জীবনে অনুভূতির কোন জায়গা নেই। তারা খারাপ কিছু ঘটার ভয়ে ভীত। তাই জীবনটাকে তারা তখুনি উপভোগ করে নিতে চায়। আর কিস্‌লভ্‌স্কির মত - ‘সেটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক’। একবিংশ শতকে পড়ে চারিদিকে আশির দশকের পোল্যান্ডের ছায়াই যেন দীর্ঘতর হচ্ছে, কিস্‌লভ্‌স্কির চরিত্ররা ফিল্মের কৌটো থেকে বেরিয়ে এসে জীবন্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে বা আমরাই কিস্‌লভ্‌স্কির চরিত্র হয়ে উঠেছি বা উঠছি । খ্রিস্টভ কিস্‌লভ্‌স্কির কথা আমাদের মনে আছে কি?

মাত্র ছাপ্পান্ন বছর বয়সে চলে গিয়েছিলেন। বেঁচে থাকলে ২৭ জুন বয়েস হত ছিয়াত্তর।

কিস্‌লভ্‌স্কির কাজ দেখবার, দেখে উপলব্ধি করবার এটাই সঠিক সময়।


লেখক পরিচিত - পার্থপ্রতিম মাইতি, কলকাতা।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.