নারীবাদের বুনিয়াদ – আশাপূর্ণা দেবীর ‘সত্যবতী’
শমীতা দাশ দাশগুপ্ত
বাংলায় নারীবাদী সাহিত্য নিয়ে চিন্তা করতে গেলে প্রথমেই মনে আসে আশাপূর্ণা দেবীর ত্রয়ী উপন্যাস, প্রথম প্রতিশ্রুতি (১৯৬৪), সুবর্ণলতা (১৯৬৭), এবং বকুলকথা (১৯৭৪)। অবশ্য নারীবাদী সাহিত্য বলতে আশাপূর্ণা দেবীর সঙ্গে আরও অনেকের রচনাই উল্লেখযোগ্য - মহাশ্বেতা দেবী, প্রতিভা বসু, সুচিত্রা ভট্টাচার্য্য, তিলোত্তমা মজুমদার। তাও বলব, আশাপূর্ণা দেবীর এই ট্রিলজি বাংলা সাহিত্যে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছে।
ধরে নেওয়া হয় ১৯৭৫ সালে ভারতে নারীর পরিস্থিতি সম্পর্কিত প্রথম রিপোর্ট (Status of Women in India) প্রকাশিত হবার পর পরই ভারতীয় নারীবাদী আন্দোলন শুরু হয়েছিল। তখনই জমাট বাঁধতে আরম্ভ করে ভারতীয় নারীবাদের তত্ত্ব ও দাবী। কিন্তু এই নারীবাদী আন্দোলন সূচনার বেশি কিছু আগেই, বহু প্রাসঙ্গিক সমস্যা ও প্রশ্নে চোখ রেখে, এই ট্রিলজির আত্মপ্রকাশ। তিনটি উপন্যাসের কেন্দ্রে রয়েছে তিন প্রজন্মের নারী - ঔপনিবেশিক সময় থেকে স্বাধীন ভারতে বাঙালি সমাজে নারীর অবস্থিতির সাক্ষ্য বহন করে। বাংলা সাহিত্যে আমার প্রিয় চরিত্র ভাবতে গিয়ে তাই এই তিনটি উপন্যাসের কথাই মনে এল।
সত্যবতী, সুবর্ণলতা, এবং বকুল – মা, মেয়ে ও নাতনি – ট্রিলজির তিন নায়িকা। তিনটি বিশেষ সময় ও সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে গল্পগুলি লেখা। তিনিটিকে যৌথভাবে নারীবাদ বিবর্তনের আলেখ্য বলা যায়। এই তিন নারীর মধ্যে সত্যবতীর চরিত্রই নারীবাদের যুক্তি তর্ক পরিষ্কার করে প্রকাশ করেছে। নারী-জীবনের প্রাত্যহিক নির্যাতন আর শোষণের উলঙ্গ মূর্তির মুখোমুখি সত্যবতীই আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়; বাধ্য করে নারী-জীবনে ঘটা সামাজিক অন্যায়কে স্বীকৃতি দিতে। সত্যবতীর মধ্যেই আমরা পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী এক নারীকে পাই। এই তিন মহিলার মধ্যে পিতৃতন্ত্রকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে একমাত্র সেই পেরেছে।
![]() |
আশাপূর্ণা দেবী নিজে বারবার বলেছেন, সত্যবতীই তাঁর সবচেয়ে প্রিয় নারী চরিত্র। সে আমারও প্রিয় চরিত্র।
প্রথম প্রতিশ্রুতির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশ । নায়িকা সত্যবতী বুদ্ধি, যুক্তিবাদ, প্রাণপ্রাচুর্যে মেয়েবেলা থেকেই সমৃদ্ধ। বাড়ির সকলের প্রিয়পাত্রী এই মেয়ে। বিশেষ করে তার পণ্ডিত, বিজ্ঞ বাবার প্রশ্রয়ে সে বড় হতে থাকে। কিন্তু তার প্রতি মা-বাবার যত স্নেহই থাকুক না কেন, সংস্কারের গণ্ডী তাঁরা ডিঙোতে পারেন না। মেয়েকে স্কুলে পড়াবার কথা ভাবতে পারেন না - তার লিঙ্গ বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সত্যবতীর অদম্য জ্ঞানপিপাসা মেটে ভাইদের পড়া শুনে শুনে – সেইভাবেই ঘটে তার বিদ্যাশিক্ষা। তারপর, সেই সময়ের সামাজিক রীতি অনুসারে তাঁরা সত্যবতীর গৌরীদান করলেন।
বলা বাহুল্য, ততদিনে সত্যবতীর মানসিকতা তার চারদিকের মানুষদের অনেক পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে। গ্রামীণ শাসনের নাগপাশ এড়াতে গ্রামের শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে, স্বামী নবকুমার, দুই ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে সত্যবতী কলকাতায় এসে সংসার পাতে। এই মেয়েই সুবর্ণলতা, যার জীবন নিয়ে লেখা হয়েছে দ্বিতীয় উপন্যাস - সুবর্ণলতা।
![]() |
সত্যবতী ছেলেদের পড়াশোনা শিখিয়ে সভ্য, সুশিক্ষিত নাগরিক গড়তে চায়। সুবর্ণলতাকে নিয়েও তার অপরিসীম আশা। নিজে মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করে, মেয়েকে স্বাধীন, ক্ষমতাশীল করে তুলতে সে বদ্ধপরিকর। বাধ সাধল শাশুড়ি আর স্বামী। ছল করে মেয়েকে গ্রামের বাড়িতে এনে, সত্যবতীকে না জানিয়ে, তারা সুবর্ণলতাকে গৌরীদান করল। সত্যবতী যখন জানতে পারল, তখন আট বছরের মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে – বাধা দেওয়ার আর উপায় নেই। স্বামীর এই বিশ্বাসঘাতকতার প্রত্যুত্তর সত্যবতী দিল চিরদিনের মত সংসারত্যাগ করে।
এই প্রথম প্রতিশ্রুতির গল্প। গল্পের নায়িকার মধ্যে দিয়ে লেখিকা নিয়ে এসেছেন পরবর্তীকালের নারীবাদের বহু বিতর্ক – নারীশিক্ষা, বাল্যবিবাহ, অর্থনৈতিক উত্তরাধিকার, যৌথ পরিবারের সমস্যা, মেয়েদের স্বাধীন সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতায়ন। মেয়েদের দৈনন্দিন জীবনের বঞ্চনা, উপেক্ষা, অবহেলা, এবং অত্যাচারের বিবরণ এতে রয়েছে; সেই সঙ্গে রয়েছে যে পুরুষতন্ত্র এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, তার প্রতি সত্যবতীর জ্বলন্ত, কৈফিয়তহীন বিদ্রোহ।
![]() |
প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আশাপূর্ণা দেবীর সাক্ষাৎকার নেবার। সেই সময়ে এই ত্রয়ী উপন্যাস নিয়েই বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা হয়েছিল। তাঁর কথা থেকে বোঝা গেছিল সত্যবতীর জীবনের অনেকটাই লেখিকার নিজের জীবনের প্রতিফলন। পার্থক্য, লেখিকা বলেছিলেন, তাঁর স্বামী তাঁর পড়াশোনার প্রতি উৎসাহী এবং লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাঁকে লেখার অপর্যাপ্ত সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তবে তার জন্যে কোনদিন সংসারের কোন কাজে ক্ষতি লেখিকা হতে দেননি।
সারাদিন বাড়ির কাজ করে, সারা রাত জেগে লিখতেন। এই ব্যবস্থা কি পরিবারের অনুশাসনে না স্বেচ্ছায়, তা পরিষ্কার করে তিনি বলেননি। আশাপূর্ণা দেবী বলেছিলেন, ‘আমি যা চারদিকে দেখেছি, তাই লিখেছি।’ মহাশ্বেতা দেবীর ঠিক বিপরীত, তিনি নিজেকে সমাজ পরিবর্তনের ব্রতী ভাবেননি - নিজেকে কখনও প্রতিবাদী হিসেবে চিহ্নিত করতে চাননি। বরং সমাজ পরিবর্তনের সাক্ষী হিসেবে দেখেছেন।
তবে সত্যবতী যদি লেখিকার মানসকন্যা হয়, তাহলে বুঝতে হবে নিজের জীবনে আশাপূর্ণার স্বরহীন প্রতিবাদ সোচ্চারে ঘোষিত হয়েছে তাঁর নায়িকার মধ্য দিয়ে। সত্যবতীর ন্যায়ের দণ্ড ঋজু, সমাজের অসম বিধানের প্রতি সে ক্রুদ্ধ, এবং পরম্পরাগত সংস্কারের প্রতি ধিক্কারে আপোষহীন। সমাজে নারীর ভূষণ বলতে আমরা যা বুঝি – বাধ্যতা, ক্ষমা, তিতিক্ষা, স্বামীর আনুগত্য, প্রশ্নাতীত অপত্যস্নেহ, গুরুজনের প্রতি অন্ধ কর্তব্যবোধ, সবই ছোট হয়ে গেছে তার ন্যায়বোধের কাছে। ন্যায়ের জন্যে সে নিজের সন্তান-স্বামী-সংসার অবলীলায় পরিত্যাগ করেছে। সত্যবতীর বিরোধিতায় দৈহিক হিংস্রতা হয়ত নেই, কিন্তু মানসিক ও আবেগের কঠোরতায় তা কিছুমাত্র কম নয়। উপন্যাসের শেষে সত্যবতী প্রশ্ন তুলেছে মানুষের চিরাচরিত সম্পর্কের প্রতি – বিবাহ, সন্তান, স্বামী, পিতা। নারীর জীবনে এই সম্পর্কগুলির অবস্থান ও প্রভাবের সে মূল্যায়ন করতে চায়।
![]() আশাপূর্ণা দেবী |
***
অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যবতী উদ্যত অসি।
যে যুগে মেয়েদের শিক্ষা ছিল, “পুড়বে মেয়ে উড়বে ছাই / তবে মেয়ের গুণ গাই,” সত্যবতী শুধু মৌখিক প্রতিবাদ জানায়নি, সেই অনুসারে কাজও করেছে। “পতি বিনা রমণীর গতি নাহি আর” প্রবাদ অগ্রাহ্য করে স্বামীর বাড়িতে ফিরে যাওয়ার অনুনয়ে কর্ণপাত করেনি। শাস্ত্রমতে বিয়ের পবিত্রতা বা চিরস্থায়িত্বে তার বিশ্বাস নেই। তাকে প্রবোধ দিতে স্বামী যখন মেয়ের বিয়ে ভেঙে দেওয়ার কথা তোলে, তখন সত্যবতী -
পরবর্তী যুগে এই একই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন আরও বহু নারীবাদী কর্মী।
সময়ের বহু আগেই সত্যবতীর মুখে লেখিকা মেয়েদের স্বনির্ভরতার গুণগান গেয়েছেন। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা যে নারীমুক্তির কেন্দ্রবিন্দু, তার স্পষ্ট ইঙ্গিত পাই প্রথম প্রতিশ্রুতির পাতায়। গল্পের শেষে, স্বামী ও সংসার পরিত্যাগের পর, নায়িকা সত্যবতী ইঙ্গিত দেয় সে স্কুলের শিক্ষয়িত্রী হয়ে পেট চালাবে। কারোর কাছে হাত না পেতে তার নিজের পায়ে দাঁড়াবে।
স্বামী নবকুমারের সঙ্গে সত্যবতীর সংঘাত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আশাপূর্ণা দেবী এই ব্যক্তিগত টানাপোড়েন শুধু স্ত্রী-পুরুষের সংঘর্ষে আবদ্ধ রাখেননি। তাঁর এবং সত্যবতীর বিদ্রোহের লক্ষ্য পুরুষতন্ত্র – যা প্রতি পুরুষের সামাজিক পক্ষপাত ও সুযোগ সুবিধের (privilege) উৎস। এই সিস্টেমের মন্ত্রে শুধু পুরুষ নয়, মহিলারাও দীক্ষিত। সেই জন্যেই সত্যবতীর শাশুড়ি তার বিরুদ্ধাচরণ করে, তাকে ঝাঁকের কৈ করে তুলতে এত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সত্যবতীকে সে বুঝিয়ে দেয়, পুরুষশাসন মেনে পুরুষতন্ত্রের দ্বাররক্ষী হলেই মহিলাদের ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ থাকতে পারে। বিদ্রোহীরা হয় সমাজ-পরিত্যক্তা। কিন্তু এদেরই মধ্যে রয়েছে সদু – সত্যবতীর ননদ – যার সাহস কম, কিন্তু যে সুবর্ণলতার স্বাধীন চিন্তাধারার সমর্থক, তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
সত্যবতী নারীমুক্তির পথিকৃৎ। নারীবাদের মৌলিক শর্ত, তত্ত্ব ও প্রয়োগ, দুই-ই তার চরিত্রে প্রখরভাবে বর্তমান। পিতৃতন্ত্রের ফাঁদে পড়ে সত্যবতী অত্যাচারিত অবশ্যই, কিন্তু সেই নিগ্রহ তার জীবনকে ধ্বংস করতে পারেনি; বরং অনুপ্রাণিত করেছে জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার। সেই ঔপনিবেশিক সময়কে উত্তরণ করে সত্যবতী হয়ে উঠেছে বাংলায় নারীমুক্তির প্রতীক। বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারে তাই সত্যবতী আমার প্রিয় চরিত্র।
লেখক পরিচিত - লেখক একজন শিক্ষক, গবেষক ও সমাজকর্মী। উত্তর আমেরিকার প্রথম দক্ষিণ এশীয়় পারিবারিক নির্যাতন বিরোধী সংস্থা মানবী-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। কেতাবি লেখা বই সব ইংরেজিতে। বাংলাতেও পত্র পত্রিকায় লেখেন। বাংলা বই - দ্বন্দ্ব এবং মৃত্যুর মুখ চেনা। যৌথ সম্পাদনা - গোয়েন্দা হাজির ১ ও ২ । অবসর-এর জন্মলগ্ন থেকে উপদেষ্টা মণ্ডলীতে যুক্ত।
Copyright © 2018 Abasar.net. All rights reserved.