মোদাচ্ছের পীরের মাজার
শেখর মুখোপাধ্যায়
“ব্রাউন পেপার প্যাকেজেস টায়েড আপ উইথ স্ট্রিংস্
দিজ আর আ ফিউ অফ মাই ফেবারিট থিংস্।”
অবসরের সম্পাদক মশায় এবং পাঠকবর্গ, বাংলা সাহিত্য বিষয়ে লেখার শুরুতে ইংরেজি গানের ধুয়ো গেয়ে উঠলাম বলে অপরাধ নেবেন না। আমার বাংলা পড়ার শুরুতে বাদামী কাগজের প্যাকেট অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। গানটি প্রকাশের সালটিও আমার ক্ষেত্রে তাৎপর্যবাহী।
![]() |
সাউন্ড অফ মিউজিক। সন ১৯৬৫। ছবিতে ষোড়শী লিজ্ল ডাকপিওন রল্ফ-এর প্রেমে পড়ে – আই অ্যাম সিক্সটিন, গোয়িং অন সেভেনটিন ইত্যাদি – সে অন্য কথা।
এদেশেও, প্রকৃতপ্রস্তাবে গোলমেলে হলেও, ডাকব্যবস্থা গত শতাব্দীর শেষ অবধিও মান্য গণ্য ছিল। আমার শৈশবে তো ডাকপিওন দোরে দোরে দেবদূতের মান্যতা পায়। অবশ্য, ক্ষেত্রেবিশেষে ভগ্নদূত, এমনকী যমদূতও গণ্য হয়। তারা বিরহী প্রেমিকার কাছে প্রেমিকের, স্বামীর কাছে স্ত্রীর, পিতামাতার কাছে প্রবাসী সন্তানের, চিঠি বয়ে আনে, মানি অর্ডারে মানিও। আবার তারাই আনে হতকুচ্ছিত টেলিগ্রাম। ‘অমুক স্পেস এক্সপায়ার্ড স্টপ কাম স্পেস শার্প স্টপ’ – টেলিগ্রামে স্বজনের মৃত্যুসংবাদ। কিংবা, ইউ স্পেস আর স্পেস হিয়ারবাই স্পেস ট্রান্সফার্ড স্পেস টু স্পেস আইজল স্টপ জয়েন স্পেস ইন স্পেস টু স্পেস ডেজ স্পেস টাইম স্টপ – টেলিগ্রামে বদলির সরকারি আদেশ। আম বাঙালি তখন আইজল আর আফ্রিকার ইতরবিশেষ করে না। কিন্তু কী করা! পেটের দায়ে চাকরি। যুগপৎ সরকার ও ডাকপিওনকে গালি পাড়তে পাড়তে ব্যাগ গুছিয়ে ছোট আইজল। আবার এরকম টেলিগ্রামও হত – ওয়াইফ স্পেস গেভ স্পেস বার্থ স্টপ সান স্টপ কাম স্পেস সুন স্টপ। কপাল খারাপ হলে, সদ্য পিতৃত্বে উন্নীত লোকটা টেলিগ্রামের কপি, প্লিজ ফাইন্ড হিয়ারবাই অ্যানেক্সড উইথ দিস লেটার, বলে আবেদন ঠুকলেও ছুটি মঞ্জুর হত না। হতভাগ্য তখন চোখ মুছতে মুছতে ফিরতি টেলিগ্রাম পাঠাত – লিভ স্পেস ডিক্লাইন্ড স্টপ উইল স্পেস কাম স্পেস এএসএপি স্টপ। আমার পিতৃদেবের বরাতে অবশ্য ছুটি মঞ্জুর হয়েছিল। তিনি দু’রাত কয়লার ইঞ্জিনে-টানা ট্রেনে রুদ্ধশ্বাস ভ্রমণ করে অবশেষে পোর্টফোলিও ব্যাগহাতে লাফাতে লাফাতে উপস্থিত হয়েছিলেন আমার মামাবাড়ির সদর দরজায়। এই সবই আমার শোনা কথা। সত্যি মিথ্যের প্রমাণ চেয়ে বিব্রত করবেন না। দিতে পারব না। বিশেষত, জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বাবামশায়কে যেমন দেখেছি, তাতে চিত্তপটে অঢেল রংয়ে তুলির অসংখ্য আবদেরে আঁচড়েও তাঁর সাহ্লাদ লম্ফনোদ্যত মূর্তিটা আমি নিজে কিছুতেই এঁকে উঠতে পারি না। আমার পরিচিত দুনিয়ায় আমার বাবাকে ভয় পেত না এমন মানুষ আমি দেখিনি। অবশ্য, বাঘেও হালুম হেঁকে লাফায় – সে অন্য কথা।
ধান ভানতে অনেকখানি শিবের গান গেয়ে নিলুম। সনাতন দস্তুর। ভণিতা, গৌরচন্দ্রিকা এসব ছাড়া চারণকবি, কথকঠাকুর, কীর্তনীয়া ইত্যাদি প্রাচীন বঙ্গদেশজ তাবড় গল্পবলিয়েরা কাহিনির ক’য়ে পর্যন্ত আসেন না। আমি সামান্য ল্যাপটপ ঠোকা অর্বাচীন আসি কোন সাহসে! ভাগবত, আলকাপ, হাফ আখড়াই, কোনও আসরই আলাপ কিংবা প্রারম্ভিক খেউড় বিনা জমে না। আঝোড়া বেউড় না হলেও, সামান্য প্রলাপের প্রয়োজন স্মৃতির গভীরে পৌঁছে জল মাপতে। এক বাঁও, মেলে না, দো বাঁও, মেলে না, তিন বাঁও ----
জলের অনেকটা গভীরে দুটি কি-ওয়ার্ড ঠনঠনিয়ে ওঠে – ব্রাউন পেপার প্যাকেজ আর ডাকপিওন। সাউন্ড অফ মিউজিক প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়ার তিন না কি চার বছর পরে, সন ১৯৬৮ কি ১৯৬৯, স্মৃতির সেপিয়া পটে পার্সেল হাতে ডাকপিওনের মুখোমুখি এক তিন কি চার বছরের বালককে আবছা দেখা যায়। ‘কী আছে ওতে?’ বালক প্রত্যাশাভরা মুখে জানতে চায়।
‘কিতাব।’
‘মা, কিতাব বই!’ বালক লাফিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢোকে। মাকে রান্নাঘরে পেয়ে তাঁর আঁচল ধরে হেঁইয়ো টানে।
বিব্রত মা রান্না স্থগিত রেখে বাড়ির দরজায় উপস্থিত হন। নেপালি ডাকপিওনের কাছ থেকে সই করে ভিপি ডাকযোগে আসা পার্সেলটি গ্রহণ করেন। পার্সেলটি তখনকার মতো শোওয়ার ঘরের বিছানায় রেখে, আবার রান্নায় মন দেন। বালকের চিত্তে তখন কেবলই পার্সেল। সে ভাল করে হাতে নিয়ে দেখে, বারকয় শোঁকে বস্তুটাকে। অন্যদিন তাকে চান করাতে মাকে রীতিমতো কসরৎ করতে হয়। চান কর, চান কর বলে সারা বাড়ি ছেলের পিছনে ছুটতে হয়। আজ বালক তুরন্ত চান করে নেয়। গা-মাথা মুছে নিজেই ধোয়া জামা-প্যান্ট খুঁজে পরে নিয়ে রান্নাঘরে উপস্থিত হয়। ‘মা, খেতে দাও।’
‘এই যে দিই।’ মা ঘুরে তাকিয়ে ছেলেকে দেখেই ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। ‘এ কী! মাথা থেকে টপটপিয়ে জল পড়ছে! কী মাথা মুছেছিস?’ গামছা এনে ফের তার মাথা মুছিয়ে দেন। চুলও আঁচড়ে দেন। রান্নাঘরে একপাশে পিঁড়ি পেতে দিয়ে থালায় ভাত-তরকারি বেড়ে দেন। ছেলে আজ সাত তাড়াতাড়ি খেয়ে নেয়। মাকে তাড়া লাগায়, “মা, তুমি কখন খাবে? খেয়ে নাও না তাড়াতাড়ি।”
মায়ের খাওয়া সারা হতেই বালক লাফিয়ে পার্সেলটি হাতে ধরে মায়ের দিকে এগিয়ে দেয়। সকাল থেকে গেরস্থালীর বিবিধ পরিশ্রমের পর মায়ের তখন একটু বিশ্রাম হলে ভাল হয়। বৃথাচেষ্টা জেনেও তিনি একবার বলেন, ‘একটু শুয়ে নিই, বাবা। তুইও একটু ঘুমিয়ে নে। তারপর -’
‘না না না, এখনই।’ জেদি ছেলে সোচ্চার প্রতিবাদ জানায়। মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পার্সেলটি খোলেন। বালক আনন্দোজ্বল দু’চোখ মেলে আবিষ্কারকের বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। ডাকপিওনের আনা ব্রাউন পেপার প্যাকেজ থেকে বেরয় ‘শুকতারা’, আকাশের তারার মতোই রহস্যময়।
শিশুরা ক্ষেত্রবিশেষে কত স্বার্থপর, কত নিষ্ঠুর হতে পারে তা আমি জানি। কারণ, এতক্ষণ ফেনিয়ে বলা গল্পটির শিশুটি সম্ভবত আমি, আবছা সেপিয়া অবয়ব দেখে তেমনই সন্দেহ হচ্ছে। বাবার চাকরিসূত্রে আমরা তখন কালিম্পংয়ে। ডাকযোগে ‘শুকতারা’ আনানোর বন্দোবস্ত বাবাই করেছিলেন। কিন্তু, আগাগোড়া তার খেসারত দিতে হয়েছিল আমার মাকে। আরও দুটো কথা না বললে স্বার্থপরতার নিবিড়তা ও নিষ্ঠুরতার বিস্তৃতি বোঝানো যাবে না। আমার তখনও অক্ষরজ্ঞান হয়নি। বই পড়ার মুরোদ নেই এক আনা। ফলে, মাকে পড়ে দিতে হবে। কী রকম? মা প্রথমে একটি গল্প পড়বে। আমি হাঁ করে শুনব। কিছু বুঝব, বেশিটাই বুঝব না। অতএব, গল্প পড়া শেষ হলে, মাকে এবার গল্পটি বুঝিয়ে বলতে হবে। কী যন্ত্রণা! এতেই শেষ নয়। মা যখন গল্পটি বুঝিয়ে বলছেন, তখনও মধ্যে মধ্যে আমার বহু প্রশ্ন থাকবে। সেগুলিরও সটীক ব্যাখ্যা দিতে হবে। এইভাবে গোটা পত্রিকাটা পড়া হবে। মা অবশেষে ক্লান্ত, বকতে বকতে মুখ শুকিয়ে কাঠ (মনে হয়, এই অপরাধের প্রায়শ্চিত্তোপলক্ষেই আমার অধ্যাপনার বিধান হয়েছে। মুখ চালিয়েই পেট চালাতে হয়। চক-ডাস্টার হাতে যখন মুখে ফেনা তুলে চিল্লাই, উপরআলা নিশ্চয় একচোট হেসে ভাবেন, দেখ বেটা, কেমন লাগে! প্রভু, মাঝেমধ্যে শরীর-মন রীতিমতো বেজুত লাগে।) থেকেথেকেই বলছেন, ‘আজকের মতো থাক। বাকিগুলো আবার কাল হবে।’
আমি নারাজ। নাছোড়বান্দা। ‘না না, মা, পরের গল্পটা!’ ভাবখানা, পত্রিকার সব গল্পগুলি সেদিনই জেনে নিই!
সন্ধে লাগার মুহূর্তে বাড়িতে বাবার প্রবেশ! মা পত্রপাঠ বই বন্ধ করেন। ‘বাকিগুলো কাল হবে’, বলে চায়ের জল বসাতে যান। মায়ের চোখে তাঁর স্বামী তখন নিশ্চয় এক প্রিন্স চার্মিং ইন শাইনি আর্মার, ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ। আমার চোখে যদিও লোকটা তখন এক খিটকেল খোক্কস। আচ্ছা, বাবা একটু রাত করে ফিরলেও তো পারত! চতুর্থবর্ষীয় বালক অগত্যা গুটিগুটি পায়ে বাড়ির বাইরে এসে বারান্দায় বসে।
দূরে, এক দিগন্তবিস্তৃত কালচে-নীল পাহাড়ের পিছনে সূর্য সবে অস্তে গিয়েছে। পাহাড়ের চূড়াগুলি যেন এক সুবিশাল উনুনের পাশাপাশি ঝিক। তাদের ফাঁকে কাঠকয়লার আঁচের মতো লাল আভা। আকাশে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে আগুন রংয়ে বোনা কাঁথার মতো ছেঁড়া মেঘের দল। পাহাড় পরতে পরতে ভাঁজ হয়ে ঢালু পথে এগিয়ে এসে অন্ধকারে ঝাঁপ দিয়েছে অকস্মাৎ। গহীন আঁধার ঠেলে আবারও উঠে এগিয়ে এসেছে কাছে, ঘন সবুজ চা বাগান আর মালবেরি প্ল্যানটেশনের ঢেউ তুলে এলিয়ে বসেছে সামনে। তাতে ইউক্যালিপটাস, পাইন আর পিচ পরস্পর দূরস্থিত দ্বীপের মতো জেগে আছে। মধ্যে মধ্যে আলুবোখরার ঝোপ। হিমালয়ের কোলে এ এক তপোবন। কিংবা, এক প্রাচীন রাজ্য। বস্তুত, চতুর্থবর্ষীয় বালকটি এই মুহূর্তে ঘোর আইডেন্টি ক্রাইসিসে ভোগে। সে কি এক ঋষিকুমার যে অরণিসন্ধানে নির্গত হয়ে পথ হারিয়েছে? না কি, সে এক রাজপুত্র, অসীম সাহসে বিপুল এই বিশ্বে একাকী ভ্রাম্যমান? পক্ষীরাজ ঘোড়াটা কোথায়? সে বেটা অন্ধকারে কোথাও লুকিয়েছে। আচ্ছা, একইসঙ্গে ঋষিকুমার আর রাজকুমার হওয়ার কোনও রাস্তা নেই? থাকবে না কেন? লব আর কুশ! রাজা রামের ছেলে, কিন্তু তপোবনে থাকত ঋষিকুমার হয়ে। আমি না হয় লব। কুশটা কোথায় গেল? ছোট ভাই, দেড় বছর তার বয়স, এসে বসে দাদার পাশে। দাদার মুঠোভর্তি মালবেরি। ভাই এখনও রামায়ণের গল্প শোনেনি। মা যখন শুকতারা পড়ে শোনায়, ভাই তখন অঘোরে ঘুময়। সে আপাতত দাদার কাছ থেকে একটি পাকা মালবেরি নিয়ে মুখে পুরে চুষতে ব্যস্ত। দাদাও তাই। তবে, তারই ফাঁকে সে ভাবে, লব আর কুশকে তাদের বাবা রামের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছিল। যুদ্ধে রাম হেরেছিল। বাবাকে কি যুদ্ধে হারানো সম্ভব? বিশেষত, যে বাবা সকাল-সন্ধে ডন-বৈঠক টানে, ডাম্বেল, বারবেল এবং মুগুর ভাঁজে? যে বাবার মুখ প্রধানত বন্ধই থাকে, কিন্তু স্নানের আগে তেলমাখা গায়ে পেশিগুলি প্রবল প্রতাপে লাফালাফি করে? রাম কি এতবড় ব্যায়ামবীর ছিল? ব্যাপারটা রামায়ণের গল্পে কোথাও বলা নেই। দূর! তাতে কিছুই যায়-আসে না। রাজারা কেউ কুস্তি লড়ে না, ঘুষোঘুষিও করে না। তারা তির-ধনুক এবং তরবারির কারবারি। বাবা এসব জানে না। কিন্তু, আমি জানি। আমি অমরবীর কাহিনি পড়ি। তারা সবাই তরোয়াল হাতে লড়ে, ধনুকে তির এঁটে অব্যর্থ্য লক্ষবেধ করে।
এইভাবে আমার পড়া শুরু হয়েছিল, মায়ের চোখ, মায়ের বোধ, মায়ের সমস্তকিছুতে ভর করে। অমরবীর কাহিনি। বেতাল ও বিক্রমাদিত্য। ক্রমে ক্রমে সোনার ঘণ্টার ফ্রান্সিস। সে এক আশ্চর্য গল্প। অনিল ভৌমিক এক অদ্ভুত বিশ্বাস্য জগৎ নির্মাণ করেছিলেন। নিজেকে মনে হত ভাইকিং। বাংলায় আমার ছোট্ট জগৎটাই তখন নরওয়ে। ঠিক তার পাশেই বাঙালি বাঁটুল, বাঁটুল দি গ্রেট! কিচ্ছু কম যায় না। সেই বিচ্ছু ছোঁড়া দুটোও প্রাতঃস্মরণীয়। ওই বয়সে ওই কীর্তি! আর হাঁদা-ভোঁদা? ভোঁদাটাকেই বেশি সমর্থন করতাম। কিন্তু, ভালবাসার ছিটেফোঁটা হাঁদার দিকেও ছুটে যেত। আজ বুঝি, আফটার অল, সেও তো ছিল হাঁদা। সত্যি বলতে, ভোঁদা কিন্তু গোপালের মতো সুবোধ বালক ছিল না, হাঁদাও ছিল না রাখালের প্রটোটাইপ। এবং, এই কারণে, নারায়ণ দেবনাথ জিন্দাবাদ!
মামাবাড়ি গেলে মায়ের একটু রেহাই মিলত। মায়ের মা, দিদিমণির কাছে গল্প শুনতাম। রাত্রে খাওয়ার পর, ঘুমোনোর আগে, দিদিমণিকে ঘিরে আমরা ছোটরা কেউ শুয়ে, কেউ বসে, উৎকর্ণ শুনতাম রাজা-রানি, রাজকুমার-রাজকুমারী, রাক্ষস-খোক্কস, ভূত-পেত্নীর গল্প। গ্রামে তখন বিজলি বাতি আসেনি। ঘরের কোণে টিমটিম করে জ্বলত হারিকেন। সামান্য আলো আর অনেকটা অন্ধকারে রূপকথার গল্পগুলো জমাট বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠত। একটা গল্প এখনও মনে আছে, পাতনা-হটমটি পেত্নীর গল্প। অল্পবিস্তর ভয় পেলেও, কিছুদিন সেই পেত্নীটাই ছিল প্রিয় চরিত্র। রোজ দিদাকে অনুরোধ করতাম, ওই গল্পটা আর একবার বল, ওই পাতনা-হটমটির গল্প। ঠাকুরমার ঝুলি বলতে লোকে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারকে স্মরণ করে। কিন্তু, তখন বাজারে আরও বহু লেখকের ঠাকুরমার ঝুলি পাওয়া যেত। সবেতেই রাজা-রানি, রাজকুমার-রাজকুমারী, রাক্ষস-খোক্কস, ভূত-পেত্নী, পক্ষীরাজ ঘোড়া আর কাকচক্ষু পুষ্করিণী। গ্রামের জলাশয়গুলি তখন কাকচক্ষুই ছিল। সন্ধের মুখে নির্জন দীঘির বাঁধানো পাড়ে বসে রূপকথাদের নীরব উপস্থিতি দিব্য অনুভব করতুম।
আমার মতো মানুষেরা অনুগত প্রেমিক হয় না। প্রিয় চরিত্র কেবলই বদলাতে থাকে। কিংবা, একইসঙ্গে অনেক চরিত্র প্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষত, শৈশবে, বাল্যে ও যৌবনে। যৌবনে রক্তমাংসের প্রিয় চরিত্রকে রক্তমাংস দিয়ে ভালবাসতে এবং পাতার পর পাতা প্রেমপত্র লিখতে ক্লান্তি অনুভূত হত না। তারপর, তার অনেক দিন পর, অবসরের সম্পাদক মশায় বাংলা সাহিত্যে প্রিয় চরিত্র বিষয়ে লিখতে ফরমায়েশ করলে প্রৌঢ় পাঠকের মাথা চুলকোনো ছাড়া উপায় থাকে না। এমন পাঠককে কি চরিত্রহীন বলাই বিধেয়? সম্ভবত। তাহলে শৈশবেই যাই ফিরে। চরিত্রানুসন্ধানের চেষ্টা গোড়া থেকে শুরু করতে।
একসময় অক্ষরপরিচয় ঘটল। নিজে পড়তে শিখলাম। তখন বাচ্চা কুকুরের দাঁত বেরনোর অবস্থা। চোখের সামনে, হাতের কাছে, যা পাই তাই পড়ি। এমনকী, বাদামভাজা খেয়ে তার ঠোঙাটাও পড়তাম। এভাবে কত যে আদি-অন্তহীন গল্পের টুকরো কুড়িয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। বসে বসে ভেবেছি এর আগে কী ছিল, পরে কী হল? ছোটদের পত্রিকা তখন আরও অনেক ছিল। কিশোরভারতী, সন্দেশ আর শিশুতীর্থ তো বটেই, তাছাড়াও সোনার কাঠি, রুপোর কাঠি ইত্যাদি বিবিধ নামের, বিশেষত শারদীয় সংকলন পাওয়া যেত। তারপর এল আনন্দমেলা। নতুন ক্লাসে উঠেই, প্রথমেই বাংলা আর ইংরেজি পাঠ্যপুস্তকের গল্প আর কবিতাগুলি পড়ে ফেলতাম। র্যাপিড রিডারগুলি, প্রকৃতপ্রস্তাবেই, র্যাপিডলি পড়া হত। তিন তুড়িতে পড়ে ফেলতাম। তারপর বুভুক্ষুর মতো খুঁজে বেড়াতাম, আর কী পড়া যায়। সেই সময়েই কোনও একদিন, পড়লাম অবনীন্দ্রনাথের রাজ কাহিনী। কাকে ছেড়ে কার কথা বলি! শিলাদিত্য, গোহ, বাপ্পাদিত্য …।
![]() |
সেসব অনুভূতি সময়ের পথে, বয়সের ভারে, জমে ওঠা অভিজ্ঞতার পরতে পরতে কোথায় হারিয়ে গেছে। বছর দশ আগে হঠাৎ একদিন পাশের ঘর থেকে আমার ছোট্ট মেয়ের হাপুস কান্না শুনে চমকে উঠলাম। ছুটে গিয়ে দেখি চোখে তার অঝোর জলের ধারা, কোলে একটি চটি বই। নাম রাজ কাহিনী। মেয়ে ফুঁপিয়ে উঠে কান্নাজড়ানো স্বরে বলে, “বাবা, গায়েবীর কী কষ্ট! ও পাতালে কোথায় চলে গেল!” মেয়েকে জড়িয়ে নিঃশব্দে তার মাথায় হাত বুলোই। বড় এবং বুড়ো হয়ে ওঠার পথে রাজ কাহিনীর শিলাদিত্য, বাপ্পাদিত্য, হাম্বির কিংবা রানা কুম্ভকে কিছুদিন মনে ছিল। কিন্তু, গায়েবী! এ হল মেয়ের বাবার এক অসামান্য প্রাপ্তি। জীবনের শুরু থেকেই নারী আর পুরুষের পাঠ-অভিজ্ঞতা এবং প্রিয় চরিত্রগুলি যে প্রায়শ ভিন্ন হয় আত্মজার কাছে সেই শিক্ষালাভ। রামায়নের গল্পেও সেই একই কাণ্ড! গায়েব যেমন বনে রাজা শিলাদিত্য, তেমনই রঘুবীর রাম রাজা রঘুপতি হয়। সীতা পাতালপ্রবেশ করে, গায়েবীও তাই। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ তাদের আত্মদানে আপ্লুত বোধ করে। হয়তো দু’ফোঁটা চোখের জলও ফেলে। কিন্তু, মেয়েরা ছাড়া তাদের কষ্ট কেউ সর্বতো অনুভব করে না। গায়েবীর কষ্টে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ে না।
জীবনের সঙ্গে হয়তো এভাবেই লিখিত ও শ্রুত আখ্যান জড়িয়ে যায়। পাঠকের আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধানে আবিষ্কৃত হয় প্রিয় চরিত্ররা। আত্মানুভূতির আলো আর কালো অক্ষরের বিন্যাসে ঘটে যায় চেতনার বিস্তার। অজানা কোনও চরিত্রকেই শেষপর্যন্ত অদৃষ্টপূর্ব মনে হয় না। আমারও বই পড়ার বৃত্তান্তের মধ্যে অশ্রুতপূর্ব কোনও সংবাদ নেই। একদিন গ্রামের বাড়িতে, সম্ভবত ক্লাস ফোরে পড়ি তখন, দোতলা থেকে ছাদে যাওয়ার পথে এক পরিত্যক্ত জঞ্জালবোঝাই ঘরে আবিষ্কার করে বসলাম বঙ্কিম রচনাবলীর ইম্পিরিয়াল এডিসন। এমত সময়ে আমার এক স্যাঙাত, ক্লাস ওয়ানে পড়া পিসতুতো ভাই পল্টু, আমাকে খুঁজতে খুঁজতে সেখানে হাজির। কথায় আছে, টাইগারস হান্ট ইন পেয়ার্স। আমরা দুজনে তেমনই বাল্যকালে করণীয় যাবতীয় রোমহর্ষক কর্ম, ভাষান্তরে দুষ্কর্ম, একত্রে করতাম। তেমনই কিছু একটার উল্লেখ করে, পল্টু আমার হাত ধরে বলে, ‘চলো চলো, এই বেলা ন’দাদুর খামারবাড়িতে কাজটা সেরে আসি।’ আমি আনমনে কিছু একটা বলে তাকে মাছির মতো তাড়ানোর চেষ্টা করি। পল্টু আরও বারকয় আমাকে ডাকাডাকি করে ক্ষুব্ধচিত্তে প্রস্থান করে। আমিও আপদ বিদায় হয়েছে ভেবে সদ্য আবিষ্কৃত বইটিতে মনোযোগ দিই।
লম্বা-চওড়া বইটার চামড়াবাঁধানো কালচে বাদামি মলাট উল্টোতেই বুঝলাম বইটা কাউকে উপহার দেওয়া হয়েছিল। হলুদ মুড়মুড়ে পাতায় ধূসর কালিতে লেখা উপহারগ্রহীতার নাম – বাবু অন্নদাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। বাবু অন্নদাপ্রসাদ আমার প্রপিতামহ। তাঁকে আমি দেখিনি। কিন্তু, তাঁর বিষয়ে অনেক গল্প শুনেছি। আমার পিতামহ বাবু বিরজাচরণ মুখোপাধ্যায় নিজেই তখন সত্তর পার করেছেন। তিনি জন্মেছিলেন বিংশ শতকের প্রথম দশকে। অবিভক্ত বাংলায় সরকারি চাকরি করেছেন। দফতরের ইংরেজ কর্মচারীরা আর পাঁচজন নেটিভ কর্মচারীকে যেমন, তেমনই আমার ঠাকুর্দাকেও সম্বোধন করতেন ‘বাবু’। অন্নদাপ্রসাদ কখনও চাকরি করেননি। তাঁর বাবুগিরির বৃত্তান্ত সম্পূর্ণ ভিন্ন গোত্রের। আমি প্রবল উত্তেজনার বশে বই কোলে জঞ্জালভরা ঘরের পাশে সিঁড়িতে বসে পড়লাম। পড়তে শুরু করলাম বাবু বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিরচিত উপন্যাসগুলির প্রথমটি (গ্রন্থটিতে পূর্বাপর যেভাবে সংকলিত)। দূর্গেশনন্দিনী।
![]() |
আজ এতকাল পরে সেই পড়ার অভিজ্ঞতা বিশদে লিখতে গেলে অনেকটা বাজে বকে ফেলতে পারি। তাই সে চেষ্টা করব না। সংক্ষেপে দু-একটা কথা বলি বরং। বহুবার শোনা একটি শব্দবন্ধই মনে আসছে – বাহ্যজ্ঞানশূন্য।
খ্রিস্টীয় বিংশ শতকের সাতের দশকের মধ্যভাগ এবং রামপুরহাট মহকুমার মুখুজ্জেবাড়ির চিলেকোঠা থেকে অবলীলাক্রমে চালান হয়ে গেলুম ৯৯৭ বঙ্গাব্দের নিদাঘতপ্ত গড় মান্দারণে।
ক্রমে ক্রমে পরিচিত হতে থাকলুম জগৎসিংহ, তিলোত্তমা, বিমলা, বীরেন্দ্র সিংহ, কতলু খাঁ, আয়েষা প্রমুখের সঙ্গে। পরিচিতি এতই গাঢ় হয়ে উঠল, আমিই যেন জগৎসিংহ। বাস্তবিক, তখন তিলোত্তমার বিষয়ে অপরিসীম ঔৎসুক্য জাগরিত মনে। হেনকালে, বস্তুত অকালে, পঞ্চাশৎ সহস্র দুর্বিনীত মোগল সেনার দানবিক হুংকারে ত্রস্ত চমকিত হতে হল। ভয়ে সিঁড়ি থেকে পড়েই যাচ্ছিলাম। টাল সামলাতে সামলাতে বই থেকে মুখ তুলে দেখলাম, পঞ্চাশৎ সহস্র নয়, মাত্রই জনাকয় মোগল মনসবদার দাঁড়িয়ে আমার সামনে। দৃষ্টি তাদের খর, কপাল তাদের ভ্রুকুটিকুটিল। ঘোর আরও কাটতে দেখলুম, না, মোগল মনসবদার নয়, বড়পিসির ছেলে অঞ্জনদাদা, মেজপিসির ছেলে পল্টু, ছোটপিসি এবং সেজকাকা আমার ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে। এদের মধ্যে পল্টু সর্বকনিষ্ঠ, বয়স তখন বোধহয় বছর ছয়। বয়োজ্যেষ্ঠ সেজকাকা বিশ কি বাইশ। ছোটপিসি আর অঞ্জনদাদা সমবয়সি, দুজনেই পনেরো কি ষোল।
‘কী করছিস তুই এই আবর্জনার মধ্যে?’ তখনও আমার অস্ত্বিত্বের যে সামান্য অংশটুকু মান্দারণে দূর্গেশনন্দিনীর আশপাশে ঘুরঘুর করছিল, ছোটপিসির মন্দিরানিন্দিত ঝংকার-তাড়িত স্বরে সে একলাফে উপস্থিত হল চিলেকোঠার দোরগোড়ায়।
‘বই পড়ছে’, পল্টু গম্ভীরমুখে জানায়, ‘মনে হয় বড়দের বই।’
সেজকাকা নীরবে, পাঠান সেনাপতি ওসমান খাঁর কেতায়, নির্মম হাতে আমাকে কান টেনে দাঁড় করাল। বইটা হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখল। যত দেখে তত তার মুখভঙ্গি ঘোরালো হয়ে ওঠে। ‘এই বই তোর পড়ার কথা নয়।’ ওসমান খাঁ কানে মোচড়ের তীব্রতা বাড়িয়ে রায় দেয়। আমি যন্ত্রণায় ই-ই আর্তরবে হেলে পড়ি। অঞ্জনদাদা ইত্যবসরে গজপতি বিদ্যাদিগ্গজের ভঙ্গিতে মুখ বাড়িয়ে জানতে চায়, ‘কী, কী বই?
ছোটপিসি মাথার বেণি হাতে ধরে দোলাতে দোলাতে জবাব দেয়, ‘বঙ্কিমচন্দ্রের নভেল।’
‘নভেল! বঙ্কিমচন্দ্র?’ বিদ্যাদিগ্গজের বিস্ময় বাঁধ মানে না।
‘আমি ঠিক বুঝেছিলাম, লুকিয়ে লুকিয়ে বড়দের বই পড়ছে!’ উত্তেজনায় পল্টুর গলা কেঁপে যায়।
‘চল।’ ওসমান খাঁ সেজকাকা কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চলে আমাকে। ‘এই বয়সে এত বদমাসি ভাল নয়। দেখি, বাবা কী বলে!’
আমি প্রতিবাদে পিছিয়ে আসার উদ্যোগ করতেই অঞ্জনদাদা আমার হাত চেপে ধরে। পিছন থেকে কর্তব্যপরায়ণ মোগল নকিবদারের মতো ঠেলা মারে পল্টু। ছোটপিসি বেণি দুলিয়ে আগে আগে শাহজাদীর মতো হাঁটে। এইভাবে শক-হূণ-মোগল-পাঠান একযোগে শোভাযাত্রা করে কয়েদীকে নিয়ে চলে শাহেনশার দরবারে।
বাদশা আকবর বাবু বিরজাচরণ মুখুজ্জে তখন উঠোনে পাতা চৌকিতে বসে রোদ পোয়াতে পোয়াতে খালি গায়ে সরষের তেল ডলছেন। কাছেই কলতলায় বালতিভরা স্নানের জল, সূর্যের তাপে গরম হচ্ছে। অপরাধী সমভিব্যাহারে মিছিল সামনে এসে দাঁড়াতে জাঁহাপনা অবাক চোখে সকলের দিকে চান। সকলেই সমস্বরে আমার অপরাধের বিবরণ দিতে উদ্যত হয়। বিরজাচরণ কপাল কুঁচকে সমস্ত শোনেন। জানতে পারেন, নিষিদ্ধকর্মে রত আমাকে আবিষ্কারের কৃতিত্ব পল্টুর। সেই প্রথম আমাকে চিলেকোঠায় বড়দের বই হাতে মগ্ন দেখে। তারপর ডেকে নিয়ে যায় বাকিদের। আমার প্রতি এহেন শত্রুতাসাধনে পল্টুর বিশেষ একটু কারণ আছে। বেচারিকে দোষ দেওয়া যায় না। গত সন্ধেয় আমি আর পল্টু মেজঠাকুমার হাঁসের খাঁচা থেকে গুটি চার ডিম (মালকিনের বিনা অনুমতিতে) সংগ্রহ করেছিলাম। কথা ছিল, আজ দুপুরে ন’ঠাকুর্দার নির্জন ভাঙা খামারবাড়িতে ডিমগুলিতে পাঁকের মোটা প্রলেপ দিয়ে ঘুঁটের আগুনে পোড়ানো হবে। তারপর ডিমের খোসা ছাড়িয়ে একটু নুন, কাঁচালঙ্কা আর – ভাবতেই মুখ জলে ভরে আসে। কিন্তু, সেই পরিকল্পনা মাটি হয়ে গেল বঙ্কিম রচনাবলী আবিষ্কারে। দূর্গেশনন্দিনীতে মশগুল হয়ে ব্যাপারটার প্রতি অবহেলা করে ফেলেছি। স্যাঙাত পল্টুর সঙ্গে মদীয় আচরণও অমার্জনীয়। পল্টু সহজবোধ্য কারণেই বইটি ও সর্বোপরি সেটির পাঠকের প্রতি যারপরনাই ক্ষুব্ধ। একটা এসপার-ওসপার করতে চায়! ‘বড়দের বই পড়ছিল!’ সে দাদুর সকাশে নিবেদন করে।
‘বাবা! তাও আবার ওই জায়গায়!’ ছোটপিসি শিউরে উঠে জানায়, ‘আমার তো এখনও গা-টা কেমন করছে। ওই হাবিজাবি জিনিসে ভর্তি ঘর, কত যে পোকামাকড় তার মধ্যে। বড় বড় পাকা তেঁতুলে বিছে আর কাঁকড়াবিছের বাসা। তার মধ্যে বসে ও বই পড়ছে! এমন মত্ত যে, কথা কানে যায় না। সবাই মিলে কতবার ডাকার পর ওর ঘোর ভাঙল।’
‘বই মানে নভেল, বঙ্কিমচন্দ্রের।’ সোৎসাহে যোগ করে অঞ্জনদাদা।
‘লুকিয়ে পড়ছিল, মানে ও জানে কাজটা ঠিক নয়।’ সেজকাকা গম্ভীর গলায় জ্ঞানপাপীর অপরাধের মাত্রাটা বোঝায়।
‘দেখি, কী বই?’ বিরজাচরণ হাত বাড়ান। বইটি উল্টেপাল্টে দেখে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘এটা ওখানে ছিল?’
আমি নীরবে মাথা নাড়ি।
‘হুম।’ ঠাকুর্দা গম্ভীর মুখে সমবেত বিচারপ্রার্থীদের দিকে চান। বাদীপক্ষের রুদ্ধশ্বাস ভঙ্গিতে কঠোর কোনও দণ্ডবিধানের প্রত্যাশা স্পষ্ট। আসামীর কাঠগড়ায় একা বিবাদী আমি জগৎসিংহ। সওয়াল করার মুরোদ নেই। কী মরতে যে তিলোত্তমার প্রেমে পড়তে গেছিলুম! বিরজাচরণ বইটি আমার দিকে এগিয়ে দেন। ‘ধর। পুজোর ছুটির আর ক’দিন বাকি আছে?’
‘আরও কুড়ি দিন।’ আমি বই নিয়ে আমতা আমতা জবাব দিই।
‘বেশ। তোর শাস্তি হল, এই ছুটির মধ্যে গোটা বইটা পড়ে ফেলতে হবে।’
বিচারপতির রায়দানের পরিপ্রেক্ষিতে কারও মুখে কথা ফোটে না। আমিও বুঝে উঠতে পারি না, ব্যাপারটা ঠিক কী দাঁড়াল। অন্যদের অবস্থাও সম্ভবত তথৈবচ। ছোটপিসি ঠাকুর্দার কনিষ্ঠতম সন্তান, আদর পায় বেশি, তাঁকে ডরায়ও কম। সে ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘ওই বইটা ও পুরোটা পড়বে! এটা কী শাস্তি?’
‘কঠিন শাস্তি!’ বিরজাচরণ ভাবলেশহীন মুখে জানান। ‘কত বছর বইটার গায়ে ধুলো জমেছে, কেউ ওটা খুলে একটা অক্ষরও পড়েনি। এত বছরের এত মানুষের না-পড়ার প্রায়শ্চিত্ত একা ও করবে। এটা কম শাস্তি?’
ছোটপিসি যে ছোটপিসি, কথায় কারও কাছে হার মানে না, সে পর্যন্ত বাক্যিহারা বেব্ভুল ক্রমান্বয়ে চায় মুখুজ্জেবাড়ির বড় তরফের পক্বকেশ কর্তা ও তস্য অকালপক্ব পৌত্রের দিকে। কর্তা তখন মাথা চুলকে বলেন, ‘আচ্ছা, শাস্তি আরও একটু বাড়িয়ে দিচ্ছি।’ আমার দিকে ঘুরে প্রশ্ন করেন, ‘আর কোনও বই আছে ওই ঘরে?’
ভয়ে ভয়ে বলি, ‘আছে মনে হয়।’
‘ভাল করে দেখবি। খুঁজে আনবি আমার কাছে। আমি লিস্ট করে দেব। সেই লিস্ট মিলিয়ে বাকি বইগুলোও তোকে পড়তে হবে।’ বিরজাচরণ ভুরু নাচিয়ে বলেন, ‘কী, শাস্তিটা বেশ কড়াগোছের হল না এবার?’
সকলকেই বিভ্রান্ত দেখায়। ঠাকুর্দার মনোভাবের আমিও তল পাই না। বিরজাচরণ আমাদের সমবেত অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ফের তেল মাখতে ব্যস্ত হন। ভাবখানা, বিচার শেষ, কোর্ট ডিস্মিস্ড। আমরা অতঃপর যে যার মতো রাস্তা দেখি। সেজকাকা চাপাস্বরে বলে যায়, ‘আমি হলে তোর পিঠে বইগুলো চাপিয়ে একশোটা ডন টানার বিধান দিতাম।’ পল্টু আমার পিছন পিছন বলতে বলতে আসে, ‘শখ মিটেছে? যাও, এবার সারাদিন ঘাড়গুঁজে বই পড় গিয়ে। আমি আর দিদি বিকেলে নুন-লঙ্কা-তেল-গুড় জরিয়ে কৎবেল খাব, তুমি হাঁ করে দেখো তখন।’
‘আমিও খাব!’ জোরগলায় দাবি পেশ করি।
পল্টু কোমরে হাত রেখে তেরিয়া মেজাজে ঘোষণা করে, ‘তোমাকে দোব না!’
কৎবেলের ভাগ অবিশ্যি শেষপর্যন্ত পেয়েছিলুম। পল্টুর দিদি, আমার পিসতুতো বোন, আমারই বয়সি। ইনিয়েবিনিয়ে বেশ খানিকটা ঘ্যানঘেনিয়ে তার মন গলানো গেল। কিন্তু, পল্টু তখনও আমার প্রতি খড়্গহস্ত। তার মান ভাঙাতে রীতিমতো বেগ পেতে হল। শেষে চুক্তি হল যে, প্রতিরাতে ঘুমনোর আগে তাকে আমি একটি করে গল্প বলব। তার দিদি বেণি দুলিয়ে সায় দেয়, ‘আমিও গল্প শুনব।’
শুরু হল আরব্যরজনী গোছের কারবার। শিশুমহলের জন্য বরাদ্দ ঘরটির এককোণে জ্বলে টিমটিমে চারকোণা। মেঝেয় ঢালা বিছানায় রাজা, বাদশা ও খলিফার কেতায় এলিয়ে শুয়ে-বসে পরিবারের বিভিন্ন বয়সের যতেক বালক-বালিকা। মাঝে আমি কথকঠাকুর। সদ্য পড়া গল্পগুলির কোনও একটির অবতারণা করি। একসময় কয়েকটি কচিকাঁচা ঘুমিয়ে পড়ে। তখনও জাগরুক যারা তাদের জন্য গল্পের খেয়া তবু বাইতে হয়। আরও পরে সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছে আন্দাজ করে থামতেই, পল্টু ঘুমজড়ানো গলায় বলে ওঠে, ‘গল্প শেষ না হওয়া পর্যন্ত থামা চলবে না।’ অগত্যা, ঘুমচোখে আবার শুরু করি কথকতা। কখনও কখনও গল্প শেষ হওয়ার আগে পল্টুও ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু, ভোলে না। পরদিন রাতে আগের দিনের গল্প শেষ করে আবার নতুন গল্প ফাঁদতে হয়।
সেই যে শুরু হল, গল্পবলিয়ের ভূমিকায় তারপর আরও বহু বছর আমার চাকরি বজায় ছিল। ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে সবাই একত্র হলেই, রাতে সব বাচ্চা আমার চারপাশে ঘনিয়ে বসত গল্প শুনবে বলে। ছোটদের জন্য স্মৃতি হাতড়ে ভুলে যাওয়া প্রিয় চরিত্রদের আবছা মুখগুলোয় অগত্যা সাধ্যমতো নতুন রঙের পোঁচ লাগাতে থাকি। ভেজাল তাতে প্রচুর মেশে। তবু, সেকালের প্রিয় চরিত্ররা যে একালেও জনপ্রিয় হতে পারে, শ্রোতাদের নির্বাক চোখমুখ নিঃশব্দে তার প্রমাণ দিতে থাকে। কথকতার এই দ্বিতীয় অধ্যায়ও চলেছিল কয়েক বছর। পারিবারিক শিশুমহলে গল্পের আসরে আমার শেষতম শ্রোতাটি ছিল ছোটকাকার ছেলে। সে এখন বিবাহিত। কিছুদিন পরে নিজেই শিশুর বাবা হবে। তবু এখনও অনুভব করতে পারি, সে আমার গা ঘেঁষে বসে বড়বড় চোখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করছে, ‘তারপর?’
ধান ভানতে আবারও খানিকটা শিবের গান গাওয়া হল। উপায়ও নেই। বইপড়া শেষে পাঠের অভিজ্ঞতা বইয়ের সাথেই দুই মলাটে মুড়ে তাকে তুলে রাখা যায় না। পাতা যত ওল্টাই, বইয়ের সাদা-কালো লেখায় আঁকা চরিত্ররা তত গুটি কেটে বেরনো প্রজাপতির মতো উড়তে থাকে চারপাশে। আমি পাঠক তাদের ধরে ফেরত পাঠাতে পারি না বইয়ের পাতায়। কেনই-বা পাঠাব! আজ মনে হয়, লেখকের কাজ ওই শুঁয়োপোকার কাজেরই সমান। শূককীটের মতোই ডিম ফুটে সে বারেবারে বাইরে আসে, হাজার কিসিমের গাছের পাতা খেয়ে বাড়তে থাকে, মুখনিঃসৃত লালায় তরিবত করে নির্মাণ করে আপন সমাধিকক্ষ, নিজে নিঃশেষিত হয়। নিঃশেষিত হয় বলেই কল্পনার পুনর্জন্মের সম্ভাবনা থাকে। লেখককে ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে লেখার চরিত্ররা। মলাটবন্দি ছাপানো বই আসলে শূককীটেরই গুটি কিংবা, রচয়িতার কল্পনার সমাধি। পাঠকের হাতে সমাধিকক্ষের দ্বার উন্মোচিত হয়। উড়ে আসে প্রজাপতি। তার রং-রূপ পাঠকের পছন্দ হতে পারে, নাও হতে পারে। তবু, তার রংয়ের বাহার, রূপের গড়ন, এসবের সমস্তটা লেখকের দ্বারা স্থিরীকৃত নয়। এও একরকমের কালার স্পেকট্রাম। পাঠকের চোখ যেমন দেখে, লেখাকে তেমন দেখায়। আমি পাঠক। লেখকের মাউসোলিয়ামে যত্রতত্র বিচরণ করতে পারি। শাজাহান তাজমহল বানিয়েছিলেন কার জন্য? বেগম মমতাজমহলের জন্য? নিজের জন্য? না কি, তখনও অনাগত অসংখ্য দর্শকের জন্য? কী প্রয়োজন জবাবের? আগ্রায় যমুনার পাড়ে, তাজমহলের চবুতরায় দাঁড়িয়ে অপর পাড়ে একাকী দণ্ডায়মান শাহী ওয়াচ টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে কি মনে হয়নি, আপনাকেও কেউ দেখছে? যে দেখছে সে আপনি ছাড়া আর কেউ নয়। কিন্তু, ঠিক আপনিও নন। পাঠক, তখন আপনিই কিন্তু লেখক। দুই মলাটে বন্দি প্রজাপতিদের মুক্তি দিয়ে নিজেই নিজের তাজমহল নির্মাণে উদ্যত। পঠিত গ্রন্থের হাজার প্রজাপতি আপনার চারপাশে ওড়ে, পোশাকের পকেটে ঘোরে, আপনাকে প্রজাপতি বানায়, নিশ্চয় টের পেয়েছেন অসংখ্য বার।
আমি এভাবেই ডানা মেলেছি। দূর্গেশনন্দিনী, রাজসিংহ, আনন্দমঠ, ইন্দিরা, চন্দ্রশেখর, --, মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত, কমলাকান্তের দফতর। নবমবর্ষীয় বালকের বোধ এই সমস্ত লেখার সম্পূর্ণ ও সঠিক আস্বাদগ্রহণে সম্ভবত পারঙ্গম ছিল না। আমার দিদিমণি, মায়ের মাকে এই নামেই ডাকতাম, তিনি আমার বিষয়ে প্রায়ই বলতেন ‘অকালপক্ব হরিতকি’। সে কারণেই হয়তো, নিজের মতো একভাবে রচনাগুলি হৃদয়ঙ্গম করতাম। কতটা তার ভুল, কতটা ঠিক আজ আর বলতে পারব না। কীই বা যায়-আসে! আমার চারপাশে তো তখন রাজ্যের রঙিন প্রজাপতি, সামনে প্রসার্যমাণ বিপুল দিগন্ত। গল্পের সেই ব্যক্তির মতো – সূর্য কোথায় অস্তে যায় সেই জায়গাটা আবিষ্কার করবে বলে যে অভিযানে বেরয়। প্রতিদিন অনেক পথ চলার পরেও অস্তাচলের সঙ্গে তার অবস্থানের দূরত্ব কমে না। তবু সে রোজ পূবে হাঁটে, হাঁটতেই থাকে। আজও তো হাঁটছি। তবে, হাঁটছি এখন চোখে হাই পাওয়ারের চশমা পরে।
আমি অনেক পড়িনি। তবু, যা পড়েছি তার সবটা ইতিবৃত্ত তুলে ধরে সবাইকে ক্লান্ত করতে চাই না। সম্ভবও নয়। বঙ্কিমচন্দ্রের উল্লেখ যখন করেছি, ওই বিষয়ে আর দু-একটা কথা বলে নেওয়া যেতে পারে। উপন্যাসগুলি সবকটিই মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়েছিলাম। চরিত্রগুলি জীবন্ত প্রত্যক্ষ করতে পারতাম মানসপটে। জগৎসিংহ, তিলোত্তমা, রাজসিংহ, চঞ্চলকুমারী, নবকুমার, কপালকুণ্ডলা - তবু সবাইকে ছাপিয়ে যে চরিত্রটি বহুদিন মনকে আচ্ছন্ন রেখেছিল তার নাম চন্দ্রশেখর। ওই বয়সে কেন এটা ঘটল তার বিবিধ কারণ থাকতে পারে। সেই বিশ্লেষণে যেতে চাই না। আমি পাঠক, আর অতি সামান্য এক পরিসরে হয়তো কিছুটা লেখক। কিন্তু, সমালোচক কোনওভাবেই নই। এই কাজে যোগ্য ব্যক্তিদের চরণে নমস্কার জানিয়ে স্মৃতির অতলে জল মাপার কাজেই মন দিই বরঞ্চ।
স্কুলের বাংলা পাঠ্যবইয়ে, তখন পঞ্চম অথবা ষষ্ঠ শ্রেণির সম্ভবত, একটি গদ্য খণ্ডাংশ ছিল – মেজদা। অভূতপূর্ব সেই পাঠের স্মৃতি। একাকী আমার নির্জন পরিসরে নিঃশব্দে হাসতে হাসতে পেট চেপে ধরতাম। থুথু ফেলা, নাক ঝাড়া, তেষ্টা পাওয়া! কিংবা, বন্দুক লাও, সড়কি লাও! এবং অবশেষে, বাবু আমি ছিনাথ বউরূপী! শরৎচন্দ্রের সঙ্গে সেই বোধহয় আমার প্রথম পরিচয়। এরপর, যারা খবর রাখে তাদের কাছ থেকে ‘শ্রীকান্ত’-এর খোঁজ পাওয়া গেল।
এইখানে, ঠিক এইখানটিতে, আবার একটু শিবের গান গাইতে হচ্ছে। কবিতা আমি সামান্যই পড়ি। লিখি আরও কম। আমার ধারণা, একটি দীর্ঘ কবিতার, এমনকী চার-পাঁচ পংক্তির কোনও কবিতাতেও, কবিতা থাকে একটি বা দুটি পংক্তিতে। সেই একটি বা দুটি পংক্তি মর্মে এসে লাগে, সমগ্র সাদা-কালো নির্মাণটিকে কবিতা পদবাচ্য করে তোলে। এ আমার আগাগোড়া ব্যক্তিগত ধারণা। ভুলও হতে পারে। তবু, আমার ধারণা, গদ্যরচনাতেও এমনটা হয় সম্ভবত। একটি বা দুটি বাক্য হাজার কথার ভিড়ে উজ্জ্বল হয়ে ভাসে, বারেবারে ফিসফিসিয়ে ওঠে বুকে। ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ প্রথম ভাগে ‘জাড্য’, ‘মাণিক্য’, ‘তাড্যমান’ ইত্যাদি ছাড়া আর কী কী পড়েছিলাম তখন আর তত মনে নেই। কিন্তু, রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’ পড়তে গিয়ে অটুট ফিরে এসেছিল পাশাপাশি সাজানো চারটি শব্দ ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’। কমলকুমার মজুমদারের ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ ভাবলেই অনেকেরই মতো আমারও মনে পড়ে ‘আলো ক্রমে আসিতেছে’। সে ছিল উপন্যাসটির প্রথম বাক্য। ওদিকে, জোসেফ কনরাডের ‘Lord Jim’ মনে করলেই, মনে পড়ে একটি পরিচ্ছেদের শেষের একটি বাক্য, ‘The nights descended on her like a benediction’। এগুলি কয়েকটি উদাহরণমাত্র, রেলগাড়ির ইঞ্জিনের মতো, পিছনে আরও বহু রচনাংশ সার দিয়ে দাঁড়িয়ে। কেন যেন একটি বা দুটি বাক্য এমন করে মনে গেঁথে যায়। উপেন্দ্রকিশোরের ‘ছেলেদের মহাভারত’ ভাবলেই মনে পড়ে ‘বুড়া তখন বাপ্ বলিয়া বসিয়া পড়িল’। পাণ্ডব, কৌরব, কারও বীরত্ব উল্লেখ্য মনে হয় না, এমনকী বৃদ্ধ দ্রোণাচার্যের দুর্দশাও যেন অলক্ষে মুচকি হাসায়। ভাস্বর হয়ে থাকে ছ’টি নিতান্ত সাধারণ শব্দে সাজানো এক শিল্পকর্ম। প্রিয় চরিত্র মানে শুধু নায়ক বা নায়িকা তো নয়, খলনায়ক বা খলনায়িকাও, এমনকী পার্শ্বচরিত্র শাহ্জী কিংবা অন্নদা দিদিও। কীসে চরিত্র প্রিয় হয়, কোন্ শিল্পকর্মে, স্বয়ং জনপ্রিয় কথাশিল্পীও কি বলতে পারেন!
![]() |
‘শ্রীকান্ত’ খুলে প্রথম লাইনটি পড়ে বহুক্ষণ স্তব্ধ বসে ছিলাম। ‘---জীবনের অপরাহ্ন বেলায় দাঁড়াইয়া ----’। বারো-তেরো বয়স তখন আমার। জীবনের অপরাহ্ন বেলা থেকে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে। তবু, অপরাহ্ন বেলার আভাস আমার সামনে উপস্থিত। মনেমনে এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা। আজ সত্যিই যখন অপরাহ্নবেলা উপস্থিত হয়েছে, পিছনে তাকিয়ে শ্রীকান্ত পাঠরত বালকটিকে বহুদূরে আবছা দেখি, তার বিষণ্ণতা এই প্রৌঢ় বুকে দেখি একইরকম ছেয়ে আছে।
এই বিষণ্ণ মনের দৌলতেই আজও বেঁচে আছি। লেখকের যাবতীয় লেখা নস্টালজিক, অন্তত আমার তাই মনে হয়। যা কিছু লেখার মনই প্রথম লেখে, এমনকী আনমনে হলেও। তারপর তার প্রকাশ কাগজে, কালি আর কলমে, অধুনা কমপিউটার মনিটরে। ছাপা বই হয়ে বেরনোর সময় সে স্তরীভূত অতীত। বই হয়ে প্রকাশের পরে লেখক কি কখনও ফিরে দেখে নিজের লেখা? দেখলেই বা কী! নিজেরই লেখা নিজে পড়ে যে অনুভূতি হয়, লেখার অনুভূতির সঙ্গে তা মেলে না। কেন? জীবনের সবটা বুঝে ফেলতে পারিনি বলে আজও চমকে উঠি। বিস্ময় আর বিষণ্ণতা মিলেমিশে একরকম মানুষ আছি।
অনেক বছর আগে দেউলটি স্টেশনে নেমে রিকশা ভাড়া করে গেলাম সামতাবেড়। গ্রামের মানুষজনকে জিজ্ঞাসা করতে, তাঁরা দেখিয়ে দিলেন শরৎচন্দ্রের বাড়ি। বাড়িটি আছে। আর প্রায় কিছুই নেই। একটি ঘরে লেখার টেবিল। অন্য ঘরগুলিতে পুরনো তক্তপোশ, বিছানা, দেওয়ালে গুটিকয় আবছা ফটোগ্রাফ, তাকে কয়েকটি ধূলিধূসর বই। দোতলার একপাশে ময়ূরের খাঁচা। শূন্য। বাড়িটি তেমনই শূন্য লাগে। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারি, বেসরকারি কোনও প্রাতিষ্ঠানিক অনুদানের ব্যবস্থা নেই। গ্রামেরই এক দরিদ্র প্রৌঢ় দম্পতি নিজেদের উদ্যোগে বাড়িটি সাফসুতরো রাখেন। একপয়সাও চান না। আমার মতো ভ্রমনবিলাসী দর্শকেরা স্বেচ্ছায় কিছু দিলে খুশি হয়ে সাহায্য স্বীকার করেন। বাড়িটি থেকে আনুমানিক আধ মাইল দূরত্বে বয়ে চলেছে রূপনারায়ণ। ওঁদের কাছেই জানা গেল যে, শরৎচন্দ্রের সময়ে নদী বাড়ির আরও কাছে ছিল। জাগতিক নিয়মে রূপনারায়ণ দূরে সরে গেছে। ভবঘুরে শরৎচন্দ্রও আর এ-বাড়িতে নেই। শুধু রয়ে গেছেন তাঁর পাঠকদের হৃদয়ে। বহুক্ষণ চুপ করে বসে ছিলাম সেই বাড়ির চাতালে। অসামান্য কথাশিল্পীর ছেড়ে যাওয়া আঙিনায় নির্বাক। একসময় বাড়ি ছেড়ে রূপনারায়ণের দিকে এগোলাম। নদীর পারে বসে মনে হল, তাঁর লেখা গ্রন্থগুলি ছাড়া শরৎচন্দ্রের প্রায় কিছুই আমাদের কাছে নেই। তিনি কিছুই জমিয়ে যাননি। বইগুলি পড়তেও কাউকে মাথার দিব্যি দেননি। আমরা পড়ি নিজেদেরই তাগিদে।
মনে পড়ে ‘মহেশ’ আর ‘অভাগীর স্বর্গ’। শরৎচন্দ্রের ছোট গল্প। পড়তে পড়তে এই বয়সেও চোখে জল আসে। পড়ার পর বইয়ের খোলা পাতার সামনে স্তব্ধ বসে থাকতে হয় বহুক্ষণ। যে লেখক এই কাণ্ডটি ঘটাতে পারেন, সমালোচকের শংসাপত্রের প্রয়োজন তাঁর নেই।
দুঃখের কথা শুধু এই যে, শরৎচন্দ্রের যুগের পর বহুযুগ কেটে যাওয়ার পরেও, বাঙালি ঘোর আঁতেল পরিচিতি পাওয়ার পরেও, সমাজে ধর্মকর্ম, জাত-পাত, পুজোপাট, অশিক্ষা, অপুষ্টি আজও দাপিয়ে রাজত্ব করে। নাগরিক সভ্যতা প্রসঙ্গে বাঙালির বড়াইয়ের পাশাপাশি প্রতিদিন মহানগরের পথের মোড়গুলিতে গজিয়ে ওঠে নতুন শনি কি শীতলা মন্দির। আশ্চর্য এই যে, সেযুগে নাচার গফুরেরও বিকল্প কর্মসংস্থানের একটা আশা ছিল। সে গ্রাম ছেড়ে যেতে পেরেছিল ফুলবেড়ের চটকলে কাজ খুঁজতে। আর, আজ আধ বিঘে জমির আধপেটা মালিকও জমি ছেড়ে আর কোথাও কাজ পাওয়ার কথা কল্পনা করতে পারে না। পাশাপাশি, শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ে। অনিবার্য কারণবশত, বাংলা সাহিত্যের সমুদ্র ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে ছোট ডোবায়। আস্ফালনে সেখানে পাঁক আর কচুরিপানা ওঠে বেশি। জল ক্রমশ ঘোলা হয়। লেখার চরিত্রদের ছাপিয়ে লেখকের দামামা বাজে সামাজিক-মাধ্যমে।
আবার কিছুটা শিবের গান গাওয়া হল হয়তো। বক্তব্য এইটুকু যে, সামনে দিগন্ত প্রসারিত করতে পিছনের প্রেক্ষাপট সংকুচিত করা জরুরি নয়। ভবিষ্যতে তাকাতে অতীত ভোলবার প্রয়োজন নেই। কাউকে বড় করতে আর কাউকে ছোট করবার দরকার পড়ে না। পড়তে পড়তে আমি এভাবেই পড়তে শিখেছি।
বাবার বদলির চাকরির সূত্রে শিশুকালেই বেশ কিছু জায়গায় বসবাসের অভিজ্ঞতা হয়েছে। কার্শিয়ং, কালিম্পং ও শিলিগুড়ি হয়ে বাবা কলিঠায় বদলি হয়ে এলেন যখন, আমি ভর্তি হলাম চতুর্থ শ্রেণিতে। কলিঠা গ্রাম নলহাটি শহর থেকে মাইল কয়েক দূরত্বে অবস্থিত। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়টি মাটির, চাল টিনের। গোটা বাড়িটিতে দু’টিমাত্র ঘর। একটি ঘর একটু বড়। সেখানে পাশাপাশি প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির ক্লাস বসে। ছোট অন্য ঘরটি যুগপৎ প্রধান শিক্ষকের দফতর এবং চতুর্থ শ্রেণির শ্রেণিকক্ষ হিসাবে ব্যবহৃত। বিদ্যালয়ে শিক্ষক মোট তিন জন। প্রধান শিক্ষক ভশ্চাজ ‘সার’। তিনি চতুর্থ শ্রেণির সমস্ত বিষয়ই পড়াতেন। দ্বিতীয় শিক্ষক গনি সার। তিনি হিন্দি বাদে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির সমস্ত বিষয়ের অধ্যাপক। তৃতীয় শিক্ষক মৌলবী সার, আমরা বলতাম মোল্বী সার, তিনি আবশ্যিক হিন্দি ভাষার পাঠ দিতেন। মোল্বী সার জর্দা পান খেতেন। গনি সার হরদম বিড়ি। আর, ভশ্চাজ সার সারাটাক্ষণ থেলো হুঁকোয় মুখ লাগিয়ে। গোটা ইস্কুলবাড়িটা একশো-বিশ জর্দা, বিড়ির নেপানি তামাক আর হুঁকোর দা-কাটা তামাকের গন্ধে ম-ম করত। পাশাপাশি সে কী হট্টরোল! পাশের ঘরে গনি সার তিনটি ক্লাসের কোনওটিকে বাংলা ব্যাকরণ, কোনওটিকে ইতিহাসের ইতিবৃত্ত, কোনওটিকে ধারাপাত ঘোষাচ্ছেন। মাঝেমধ্যে মোল্বী সার হিন্দি পড়াতে গিয়ে ছাত্রের নির্বুদ্ধিতায় রেগে উঠে বাংলা ও উর্দুর এক মিশ্রভাষায় ক্রোধ উদ্গিরণ করছেন। বাইরে থেকেথেকেই গরু, মোষ, ছাগল ও ভেড়ার আগমন। ব্যা-ব্যা, ম্যা-ম্যা, প্রভৃতি ডাক ও ইস্কুলঘরের বারান্দায় মুহুর্মুহু মল ও মুত্রত্যাগ ... সম্ভবত, মনুষ্যজনোচিত বিদ্যাশিক্ষাদির অসারতা বিষয়ে তাদের বক্তব্যের প্রকাশমাত্র।
খাটো ধুতি পরিহিত হেড মাস্টার ভশ্চাজ সার ছাত্রদের গুটি দশ অঙ্ক কষার নির্দেশ দিয়ে, খালি গায়ে হাতল ভাঙা চেয়ারে বসে টেবিলে থামের মতো দুটি পা তুলে ঝিমোচ্ছেন। পরনের জামা ও থেলো হুঁকোটি পাশেই দেওয়ালে পোঁতা হুকে টাঙানো। টেবিলে সারের দুই পায়ের মাঝে পড়ে আছে শতচ্ছিন্ন হাতপাখা আর ফুট তিনেক লম্বা একটি কঞ্চি। আমরা পোড়োরা পাটিগণিত বই আর খাতা খুলে বসে আছি। থেকেথেকে আড়চোখে চাইছি সারের দিকে। ক্রমশ নাকডাকার আওয়াজ আসে – ফুর্র ফুর। তাঁর ঘুম এখন গাঢ় বলেই বোধ হচ্ছে। আরও গাঢ় হবে। নাকও বাজবে কখনও তাসাপার্টির ‘ফুলুট’-এর মতো সোচ্চার বেতালা সুরে, কখনও রাগী বাঘের ‘গর্র্-ঘ্র্যাঁও’ রবে। আমরা সাহসী হয়ে অন্যান্য জরুরি কাজে ব্যস্ত হওয়ার উদ্যোগ করি। জনা দুই বালক শ্রেণিকক্ষের গরাদহীন খোলা জানলা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। কাছাকাছি কোথাও আম-জাম পাড়তে পারে, পুকুরে মাছ ধরতে পারে, আবার ইস্কুলের পাশের বটগাছের ঝুরি ধরে দোল খেতেও পারে। জনাকয় চুপিচুপি লুডোর সরঞ্জাম বের করে খেলতে বসে গেল। বাকিরা নিজেদের মধ্যে নানা জাতের খুনসুটিতে ব্যস্ত। একজন আবার কোথা থেকে পাখির একটা পালক জোগাড় করে হেডসারের পাশে দাঁড়িয়ে গেল। সন্তর্পণে পালকটি কখনও সারের কানে, কখনও তাঁর নাকের কাছে ধরে। সার ঘুমের মধ্যেই কানে হাত বোলান, অস্বস্তিভরে ভ্রু কুঁচকে মাথা এপাশ-ওপাশ করেন, হাঁচতে হাঁচতেও হাঁচেন না। প্রতিবাদী নাক গর্জন করে – ফিঁ-ফ্যাঁশ্-ঘর্র্-ঘোঁত! আমি লোলুপ নয়নে চাই তিনটি কালো তোরঙ্গের দিকে। ওই তিনটি স্টিল ট্রাঙ্ক আমাদের বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারবিশেষ, বিবিধ বিচিত্র পুস্তকে ভর্তি। প্রতিদিনের মতো আজও সুযোগ বুঝে একটি তোরঙ্গের ডালা খুলি। প্রতিদিনের মতোই কেউ-না-কেউ সাবধান করে, ‘বাস্কোগোলা খুলিস না খো, ভশ্চাজ সার দেইখল্যে শালো পিটিঞে তাম্বারা ভেঙি দিবে।’ তবু, প্রতিদিনের মতোই বাক্সের ভিতরে বই ঘাঁটি। এই বাক্সটির বেশিরভাগ বই আমার পড়া হয়ে গেছে। রঙচঙে মলাটের তুলনামূলকভাবে নতুন দেখতে বইগুলি আগে পড়ে নিয়েছি। নীচের দিকে পড়ে আছে গুটিকয় পোকায় কাটা ধুলো মাখা বিবর্ণ পুস্তক। কিন্তু, আগেই বলেছি, বই পড়ার পক্ষে সেই বয়সটা কুকুরের দাঁত গজানোর বয়সের সঙ্গে তুলনীয়। ছাপা অক্ষরসম্বলিত কোনও কিছুই অগ্রাহ্য করা যায় না। সবই চিবিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। দাঁত ফোটাতে পারলে ভাল, নইলেও কেয়াবাত্। সেই মনোভাবাপন্ন আমি একটি বই বাক্স থেকে টেনে নিলুম। একেবারে টাইটেল পেজ থেকে পড়তে শুরু করলুম। ‘পালামৌ’। লেখক, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সম্পাদক, শ্রী ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রী সজনীকান্ত দাস, ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর শুরু হয়ে গেল, ‘বহুকাল হইলো আমি একবার পালামৌ প্রদেশে গিয়াছিলাম, --’। আরে ভাই! ধাঁ করে আমিও চলে গেলুম পালামৌ, সঞ্জীবচন্দ্রের পিছন পিছন। চরিত্র? পালামৌ নিজে ছাড়া আর কে! বহুদূরের পাহাড় ও জঙ্গল প্রভৃতিতে যখন আমি উধাও, যখন বীরভূম জেলাস্থ কলিঠা গ্রামে কারওরই আমাকে খুঁজে পাওয়ার কথা নয়, তখন শুনলাম হুঙ্কার, ‘বোটা!’
হেডমাস্টার ভশ্চাজ সার ‘বেটা’ না বলে বলতেন ‘বোটা’। প্রায় তড়িদাহত আমি বইহাতে ছিটকে-ছড়িয়ে এঁকেবেঁকে বেঞ্চি ছেড়ে উঠে দাঁড়ালুম। আমার পাশের জন তীক্ষ্ণস্বরে নালিশ জানাল, ‘সার, অখে না-হোক দশবার বুল্যাছি, বাস্কোর বইগোলা ঘাঁটিস না খো। সি শুনল্যে না খো!’
‘বটে!’ ভশ্চাজ সার হাতে কঞ্চি দোলাতে দোলাতে ডাক দিলেন, ‘ইট্ক্যে আয় ধিনি।’
দমকা হাওয়ায় আক্রান্ত বাঁশপাতার মতো কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে দাঁড়ালুম সারের সামনে। সার কঞ্চিটি টেবিলে সপাৎ মেরে বজ্রগর্ভ স্বরে গর্জালেন, ‘বইটো কী বটে দেখি!’
বইটি তাঁর হাতে দিলুম। তিনি উল্টেপাল্টে দেখে বললেন, ‘হুম।’ কঞ্চিটি টেবিলে নামিয়ে রেখে, ধুতির খুঁটে বইটির সামনের ও পিছনের পাতাদুটি মুছে ফিরিয়ে দিলেন আমার হাতে। শান্তস্বরে বললেন, ‘বাস্কোগোলা থেকে একখ্যান বইও য্যান্ না হারায়, বুইলি বোটা?’
‘আজ্ঞে, সার।’ আমি হাঁফ ছেড়ে মাথা নাড়ি। ওই তিন তোরঙ্গেই শাহ্নামা, সহস্র এক আরব্য রজনী, গোপাল ভাঁড়, বীরবলের কাহিনি এবং পালামৌয়ের পাশাপাশি আবিষ্কার করেছিলুম অপু, দুর্গা, সর্বজয়া, ইন্দির ঠাকরুন প্রমুখকে।
কিছুদিন আগে ঘাটশিলা গিয়েছিলাম। বিভূতিভূষণের বাড়ি গৌরীকুঞ্জ দেখলাম। শরৎচন্দ্রের বাড়ির মতোই, এখানেও বাড়িটি ছাড়া আর প্রায় কিছুই নেই। এই বাড়ি অবশ্য পরে নির্মিত। আসল বাড়িটির ছবি দেওয়ালে টাঙানো। বিভূতিভূষণের মৃত্যুর পর সে-বাড়িতে কোনওসময় আগুন লাগে। স্থানীয় মানুষেরা বাড়িটি সংস্কার করে দেন। বাড়িতে আছে কয়েকটি ছবি ও ফটোগ্রাফ, গুটিকয় পুরনো বই আর পুরনো একটি সার্জের কোট। বাড়ির বৃদ্ধ কেয়ারটেকার নিজের পরিচয় দিলেন, ‘আমি অপূর্ব।’ আমি তো থ! অপূর্ব মানে! অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়? অপু? বৃদ্ধ মাথা নাড়েন। বলেন, ‘হ্যাঁ। আমিই অপূর্ব। সত্যজিতের ছবিতে যাকে দেখেছেন, আমিই সে।’ অসংলগ্ন বিভিন্ন কাহিনি শোনান। এসবের মধ্যে থেকে অবশেষে অন্য একটি কাহিনি উঠে আসে। অপূর্ববাবুর এখনও মনে আছে, সেদিন সন্ধেয় ঘাটশিলার প্রাচীন রাজবংশজাত কোনও বাবুর বাড়িতে বিভূতিভূষণের নিমন্ত্রণ ছিল। বিভূতিভূষণ খেতে ভালবাসতেন। রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে বাড়ি ফিরে তিনি অপূর্বকে বলেন যে, তাঁর শরীরে সামান্য অস্বস্তি হচ্ছে। তাই সামনে একটু হাঁটতে যাচ্ছেন। রাতে তিনি যখন বাড়ি ফেরেন, তাঁকে দেখে অপূর্ব চমকে ওঠে। যেন এক অন্য মানুষ ফিরে এসেছেন। বিভূতিভূষণ স্তম্ভিত অপূর্বকে জানান যে, তিনি মারা গিয়েছেন। বলেন, জঙ্গলের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে এক মৃতদেহ দেখতে পান তিনি। কাছে গিয়ে দেখেন, শবটি তাঁর। অপূর্ব কান্নাকাটি শুরু করে। বিভূতিভূষণ আর কথা না বাড়িয়ে, বিছানা আশ্রয় করেন। সেই রাতেই মৃত্যু হয় তাঁর। বলা শক্ত, গল্পটি কতটা বিশ্বাসযোগ্য। অপূর্ববাবুর বার্ধক্যজনিত কোনও অসম্ভব কল্পনা? বিভূতিভূষণের অসুস্থতাজনিত মৃত্যুপূর্ব বিকার? না কি, বিভূতিভূষণ আসন্ন মৃত্যুকে সত্যিই সামনে দেখেছিলেন? বিভূতিভূষণ বলেই, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, তৃতীয় সম্ভাবনাটিই সত্যি। বিশ্বস্ত সমস্ত চরিত্ররাই তো তাঁর লেখার আধার।
![]() |
‘আম আঁটির ভেঁপু, পথের পাঁচালি, অপরাজিত, অপুর সংসার, আরণ্যক, কেদার রাজা, মৌরিফুল, ইছামতী, আদর্শ হিন্দু হোটেল, -----। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জগৎ। তাঁর এক-একটি লেখার কথা বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হয়। পথের পাঁচালি এবং অপরাজিততে বারবার যেন নিজেকেই খুঁজে পেয়েছি। অথচ, এই দুটির কোনওটিই তথাকথিত কিশোর সাহিত্য নয়। অন্তত, মূলত কিশোরদের জন্য লিখিত নয়। বিভূতিভূষণের অনেক বিশেষত্বের একটি হয়তো এই যে, তাঁর লেখায় বার্ধক্য ও যৌবনের গায়েগায়ে বারেবারেই উঁকি দেয় শৈশব ও কৈশোর। আরও স্পষ্ট করে বললে, শৈশব ও কৈশোরের কৌতূহল ও বিস্ময়। অন্যদিকে, তাঁর শিশু ও কিশোরসাহিত্য বলে পরিচিত লেখাগুলি (যেমন চাঁদের পাহাড় উপন্যাসটি) আদপেই শিশুপাঠ্য কেতায় লেখা হয়নি। গল্পদাদুসুলভ জ্যাঠামো তাঁর মধ্যে বিন্দুমাত্র নেই। লেখার ধরণে বিস্তর তফাত থাকলেও, সুকুমার রায় আর খানিকটা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরির পরে এই এক লেখক যিনি ছোটদের অবুঝ ধরে নেননি। লেখক বিভূতিভূষণ এক অনন্ত পথের যাত্রী। পথের পাশে হাজারির পরটার দোকান, দুই দেশের সীমানাচেরা নদী, কখনও পাহাড়ি ঝর্না, গাঁড়াপোতা গ্রাম, পাহাড়, জঙ্গল, মালভূমি –; পথেই দেখা জীবন। এবং, মৃত্যু। এত চরিত্রের কাকে বলব সবচেয়ে প্রিয়! আমাদের ‘দেশের বাড়ি’র গ্রাম আর আমার মামাবাড়ি মাইল দুই দূরত্বে অবস্থিত। ছুটিছাটায় গ্রামের বাড়ি গেলেই উন্মুখ হয়ে থাকতুম কখন মামাবাড়ি যাব। মামাবাড়ি বলে শুধু নয়, সেখানে একটি চমৎকার লাইব্রেরি আছে, অন্তত তখন ছিল। হাজার জাতের বই পড়েছি সেখানে। মামাবাড়ির গ্রাম। অতএব, গ্রামসম্পর্কে গুরুজনেরা অনেকেই আমার মামা। তেমনই একজন, সেন্টুমামা ছিলেন সেই গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিক। লাইব্রেরি যতক্ষণ খোলা থাকত, সেখানে বসে বই পড়তাম। লাইব্রেরি বন্ধের আগে গুটিকয় বই বগলে হাজির হতাম সেন্টুমামার সামনে। লাইব্রেরিতে আমার সদস্যপদ ছিল না। আমার দুই মামার ছিল। তাদের নামে বই ধার নিতাম। বইগুলির মধ্যে তথাকথিত বড়দের বই কিছু থাকলে, সেন্টুমামা নরম গলায় বলতেন, ‘ওটা এমনিই নিয়ে যা। খাতায় লিখব না। তাড়াতাড়ি পড়ে ফেরত দিবি।’ গ্রামে বিজলি বাতির আগমন ঘটেনি। মামাতো ভাইবোনেরা রাতে লন্ঠনের আলোয় পড়াশুনো করত। ছুটির ‘হোমওয়ার্ক’ আমারও থাকত। তারা যখন তেড়েফুঁড়ে অঙ্ক বা ইংরেজি ট্রানস্লেশন বা বাংলা ব্যাকরণ সামলাতে ব্যস্ত, আমি তখন তাদেরই ভিড়ে বসে নিবিষ্টচিত্তে পড়ে চলতুম ‘নিষিদ্ধ’ বইগুলি। আমার শুভাকাঙ্ক্ষী ভাইয়েরা মাঝেমধ্যে আমার মাকে ডেকে আনত, ‘দেখো পিসিমা, ও পড়া না করে বড়দের বই পড়ছে।’ মা দেখতেন। তেমনকিছু বলতেন না। এইখানে একটি কথা বলে রাখা জরুরি। আমার মা-বাবার আমি জ্যেষ্ঠ সন্তান। ঠাকুর্দার জ্যেষ্ঠ নাতি। গ্রামের বাড়ির কৃষাণ-মাহিন্দারও ডাকত বড়বাবু বলে। আমার ঠাকুর্দা এক বড়বাবু, বাবাও তাই, আমি আবার আর এক বড়বাবু। ঠাকুর্দা তাঁর ভাইয়েদের মধ্যে সবার বড়। আমার বাবাও তাই। এদিকে, আমার প্রজন্মে আমিই বাড়ির বড়, অনেক দায়িত্ব আমার কাঁধে, এই ধারণাটা নানাভাবে শিশুকালেই মগজে ঢুকে গিয়েছিল। অথচ, প্রবৃত্তিগতভাবেই আমি আজন্ম বোহেমিয়ান। জ্যাঠামি করা এবং সওয়া কোনওকালেই পছন্দ নয়। ভারী দায়িত্ববোধ আর নির্ভার জীবনবোধ, কর্তব্য আর পছন্দের এই বিকট দ্বন্দ্বে সারাটা জীবন ভুগেছি, আজও টানাপড়েনের শেষ নেই। তবু, হয়তো বাঁচার তাগিদেই, কোনও-না-কোনও সমাধানসূত্রের সন্ধানও পেয়েছি। সেভাবেই, ‘পাঠ্য’ ও ‘অ-পাঠ্য’ পুস্তকসমূহের মধ্যে একরকম ভারসাম্য বজায় থাকত। হোমওয়ার্ক একরকম ওয়ার্ক্ড আউট হয়ে যেত। মা সেটা জানতেন। বস্তুত, ‘বড়দের বই’ পড়ার ক্ষেত্রে বড়দের তরফে বাধার মুখোমুখি কখনও হইনি। বরং, উৎসাহই পেয়েছি বরাবর।
মামাবাড়ির সেই লাইব্রেরিতে একদিন একটি বই খুঁজে পেলাম – ঢোঁড়াই চরিত মানস। লেখক সতীনাথ ভাদুড়ি। নেশাগ্রস্তের মতো পড়েছিলাম। রামচরিত মানসের সঙ্গে এই বইয়ের তুলনা ইত্যাদি বিষয়ক চর্চার কিছুই তখন জানতাম না। বইটি পড়তে পড়তে সে প্রসঙ্গ মনে জাগরিতও হয়নি। কেবলমাত্র লেখার জাদুতে আগাগোড়া বইটি পড়েছিলাম, অবশ্যই যাবতীয় পাদচিহ্ন বাদ দিয়ে।
![]() |
সতীনাথ ও তাঁর লেখাপত্রের বিষয়ে আরও জেনেছি অনেক পরে। তখন আবার বইটি পড়েছিলাম, সমস্ত ফুটনোটসহ। কিন্তু, আজ যখন লিখতে বসে উপন্যাসটির কথা ভাবছি, প্রথমবার ঢোঁড়াই পড়ার বিচিত্র আনন্দের স্মৃতিই দূরাগত তরঙ্গের মতো ক্রমে নিকটবর্তী হচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। তরঙ্গোচ্ছ্বাসের মতোই শুনছি গানহী বাওয়া, গানহী বাওয়া উচ্চারণ। গানহী বাওয়া কে বা কী তা বুঝতে ফুটনোট পড়ার দরকার পড়ে না। আগ্রহী পাঠকের স্নায়ুস্রোত মোহনার উচ্ছ্বাস চিনে দিব্যি বইতে থাকে।
ওই একই লাইব্রেরিতে পড়েছিলাম মনোজ বসুর বন কেটে বসত। কপালে ভাঁজ পড়ল? সতীনাথ ভাদুড়ির সঙ্গে একই নিঃশ্বাসে মনোজ বসু! মনোজ বসু বড় লেখক। কিন্তু, সতীনাথ হলেন গিয়ে লেখকের লেখক! তাতে থোড়াই এসে গেল। আমি তো পাঠক। লেখকের ঋণস্বীকারের দায় আমার নেই। অন্তত আপাতত, যখন আমি ক্লাস এইটের ছাত্র। মনোজ বসু রচিত শব্দমালার স্রোতে ভেসে ঘুরছি তাঁর বাদাবনের দেশে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো। তবে, এও ঠিক যে, আজ যখন আবার “বন কেটে বসত” খুলে বসি, মনে ঠিক তেমন করে দাগ কাটে না। বয়স যত বাড়ছে, তত যেন খুঁতখুঁতে হচ্ছি। ছেলেবেলায় খোলা চোখে যা দেখতে পেতাম না, এখন হাই পাওয়ারের চশমায় সেসব ধরা পড়ছে বোধহয়। অথবা, তখন যা দেখতে পেতাম, আজ ক্ষীণতর দৃষ্টিতে সেগুলি খুঁজে পাই না। তখন রূদ্ধশ্বাসে পড়তাম। এখন পড়ি আস্তে ধীরে থমকে থেমে।
প্রায় একই সময়ে পড়েছিলাম “পদ্মানদীর মাঝি”। ‘কুবির’, কপিলা, হোসেন মিঞা, রাসু, ... ময়নাদ্বীপ। আজও যখন পড়ি, কপিলার “আ রে পুরুষ!” কুবেরের বুকে যেমন বাজে, আমার বুকেও সেভাবেই ধাক্কা দেয়। প্রিয় চরিত্র? উপন্যাসটির প্রায় সকলেই।
উপন্যাসটিই যে প্রিয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়েরই কিছু লেখা আবার মনে ধরে না। সেগুলো পড়তে পড়তে মনে হয় লেখকের পাণ্ডিত্য এবং আদর্শ তাঁর লেখাকে, লেখার চরিত্রগুলিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, মানুষ হতে দেয়নি। একই লেখকের বিভিন্ন লেখার কিংবা, ভিন্ন ভিন্ন লেখকের তুলনামূলক সমালোচনা হয়ে থাকে। লেখকের লেখা এবং পাঠকের পড়ার মতোই সমালোচনা সমালোচকের কাজ।
![]() |
বিশেষত, উত্তর ও উত্তরোত্তর আধুনিক ভাবধারায় লেখক যখন মৃত। পাঠকও লেখক। সমালোচক তো অতি অবশ্যই। এক বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ সেই কবেই বলে গেছেন, ইন দ্য লং রান উই আর অল ডেড। সে মন্তব্য অবশ্য সাহিত্যপাঠের প্রসঙ্গে করা নয়। তবু, দৃষ্টিভঙ্গিটি প্রণিধানযোগ্য, কারণ ধ্রুপদী অর্থনীতিবিদেরা এর বিরোধিতা করেন।
আজ যখন তাত্ত্বিকেরা বলছেন লেখক মৃত, তখনই তথাকথিত সিরিয়াস এবং উত্তর ও উত্তরোত্তর আধুনিক বইগুলি পড়তে গিয়ে দেখি তাদের অনেকগুলিতেই লেখক লেখার আগাগোড়া বড্ড জীবিত, পংক্তিতে পংক্তিতে ছত্রে ছত্রে সদ্যোজাতের মতো হাত-পা ছুঁড়ছেন। শিশুর মতোই বারংবার মনে করিয়ে দিতে চাইছেন, দেখ, এই হলাম আমি, আমার দিকে তাকাও। না তাকিয়ে উপায়ও নেই। প্রতিটি চরিত্রই লেখকের বিবিধ প্রত্যঙ্গের ভূমিকায় লেখায় উপস্থিত। সবার মধ্যেই লেখককে চোখে পড়ে, সবাই লেখকের মুখের কথা বলে। সকলেই লেখকের হর্ষ বা, বিষাদ বা, আর কোনও অনুভূতির প্রকাশক। সবটা মিলিয়ে, কাহিনিগুলি দাঁড়িয়ে যায় লেখকের আত্মজীবনী বা, আত্মকথা বা, রোজনামচা বা, লেখকের বিজ্ঞাপন। প্রসঙ্গত, শরৎচন্দ্রের কথাই আবার মনে পড়ে। কোনও এক লেখকের গল্পে একটি চরিত্র সাপের কামড়ে মারা যায়। গল্পের পারিপার্শ্বিক ও পূর্বাপর পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনাটি শরৎচন্দ্রকে খুশি করতে পারেনি। তিনি এ’বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন। লেখক পাল্টা প্রশ্ন করেন, কেন, মানুষকে কি সাপে কাটে না? শরৎচন্দ্র জবাব দেন, কাটে, কিন্তু লেখককে সাহায্য করতে কাটে না। তথাকথিত আধুনিক ঘরানার লেখকদের ক্ষেত্রে একটা বড় অভিযোগ হল তাঁরা না কি সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান, তাঁদের কলমের খোঁচায় যা নয় তাই ঘটে যেতে পারে – কী হইতে কী হইয়া যায় কিছুই বলা যায় না। কিন্তু, আধুনিক সাহিত্য যুক্তিনির্ভর বলে লেখককে অনেক আটঘাট বেঁধে লিখতে হয়। যুক্তির কাঠামোয় লেখক বন্দি বলেই অনেকাংশে পরাধীন। কী হইতে কী হইয়া যাওয়া সেখানে মহা অপরাধ। সেক্ষেত্রে, আইনের যেমন ফাঁক থাকে, যুক্তির বজ্র আঁটুনির যেমন ফসকা গেরো থাকে, তেমন ফাঁক এবং ফসকা গেরোগুলি ব্যবহার করার মুন্সিয়ানাতেই কথার কারবারির শিল্পের পরিচয়। উত্তর আধুনিক সাহিত্যে লেখক সেদিক দিয়ে অনেকটাই স্বাধীন। লোহার বাসরঘরে ছিদ্র না থাকলেও, ভাষা ও বাক্যজালে, ক্ষেত্রবিশেষে জটিল বাক্যজালে গড়া ডানায় উড়ে এসে সাপ লখিন্দরকে কামড়ে যেতে পারে। কীভাবে? বসে বসে ভাবুন গালে হাত রেখে, যদি হাতে সময় থাকে। শিল্প ওখানেও, শিল্প এখানেও। তবু, এর উচ্চনীচ বিন্যাসে বহু মানুষ বহু সময় ব্যয় করেন। পাঠক হিসাবে আমি শুধু বলতে পারি আমার মনে এরা কী দাগ রেখে যায়।
কমলকুমার মজুমদারের উপন্যাসগুলি বেশিরভাগই আমি টানা পড়তে পারিনি। শেষে জেদের বশে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে পরীক্ষার্থীর মতো শেষ করেছি। তাঁর কিছু ছোটগল্প ও অন্তর্জলী যাত্রা সম্পর্কে অবশ্যই এই কথা খাটে না। বলে রাখি, তিনি অননুকরণীয়। কেনই বা কেউ অনুকরণ করতে যাবে! যে লেখার ছত্রে ছত্রে লেখকের কণ্ঠস্বর বাজে, তাঁরই মুখ ভাসে, সে লেখা মুখোশের মতো আর কেউ কেন পরবে! শুনেছি, তিনি না কি ফরাসি শৈলীদ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলা লিখতে চেয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে, সেটা খুব সাহসী এক্সপেরিমেন্ট হতে পারে এবং সেই বাবদে তিনি ধন্যবাদার্হ।
![]() |
কিন্তু, সব এক্সপেরিমেন্ট তো সফল হয় না। পরীক্ষা-নিরীক্ষা লেখায় থাকে। কিন্তু, শুধুমাত্র তার উপরে সাহিত্য নির্ভর করে না।
বাংলায় কি শৈলীর এবং তার পরীক্ষা নিরীক্ষার জায়গার অভাব আছে! একে তো বাংলা মোটেও মৌলিক ভাষা নয়, সংস্কৃত থেকে তদ্ভব। তার উপর ফারসি, আরবি, উর্দু, হিন্দি হাজার জবানের মিশেল তাতে। এই ভাষায় ফরাসি বা, ইউরোপীয় বা, লাতিন আমেরিকান শৈলীতে কেন লিখতেই হবে এবং কেউ লিখলে সে লেখা পড়তে না চাইলে পাঠকের জাত নিয়েই কেন প্রশ্ন উঠে যাবে সে আমার মতো আম পাঠকের বোধের বাইরে। খোদ লেখককে প্রিয়জ্ঞানে পুজো করতে না পারলে এসব লেখায় প্রিয় চরিত্র খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের অন্তঃশীলা পড়তে গিয়ে ঘেমে-নেয়ে হেঁচকি তুলে একাকার। কিছুই বুঝছি না। হীনমন্যতার এক শেষ! পরে দেখলাম, এক মহামহোপাধ্যায় লেখকও একই অভিজ্ঞতার কাহিনী শুনিয়েছেন – সৈয়দ মুজতবা আলী।
মুজতবা আলীর কলমনিঃসৃত বহু শব্দ, বহু বাক্য, বহু চরিত্র বুকে গাঁথা হয়ে আছে। সুরাসক্ত, নামাজ-না-পড়া, নামে মুসলমান, ভাষায় বাঙালি, ধর্মে ও কর্মে মানুষ (যাঁরা আমাদের মতো দোপেয়ের ভিড়ে কোটিকে গুটিক), দেশে-বিদেশে অভিযাত্রী এই এলেমদার মহোদয়ের খুরে খুরে গো-বরাহাদি খাদকের সালাম। তাঁর কোদণ্ড মুথহানার মতোই তিনি নিজেও অননুকরণীয়। তবু কেন যে আজও কিছু লেখক বুকে বল নিয়ে চাচাকে অনুকরণের অপচেষ্টা করেন!
শুনেছি, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় পাঠকের উদ্দেশে বলতেন, আমার লেখাকে ভালবাসুন, আমাকেও ভালবাসুন। লেখক, সমালোচক নির্বিশেষে উত্তর আধুনিক প্রত্যাশার সবাক প্রকাশ! তবু, মনের কথা মুখে! হয়তো সন্দীপন নিজে উত্তর আধুনিক নন বলেই। বিজন আমার মনে দাগ রেখে যাওয়া এক চরিত্র হলেও, সন্দীপনের অনেক লেখাই বড্ড একঘেয়ে বিরক্তিকর ঠেকেছে। ছত্রে ছত্রে উপস্থিত ব্যক্তি সন্দীপন (কমলকুমারের কেতায় নয় অবশ্য)। পাঠক কোনও অমার্জনীয় অপরাধ করেনি যে, লেখকের অবসাদ, আমাশা, বাতের ব্যথা সবই তাকে হজম করতে হবে। পাঠক লেখা ভালবাসে। ব্যক্তি লেখককে জানা তার পক্ষে জরুরি নয়। তবু, কয়েকবার এমন আবিষ্কার করে স্তম্ভিত হয়েছি যে, সন্দীপন সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত গুণগান গাইলেন যিনি, দেখা গেল তিনি সন্দীপন প্রায় পড়েনইনি। প্রসঙ্গত, কমলকুমারের বহু ভক্তও এই একই রোগের শিকার দেখেছি। অনেকেই সন্দীপনের লেখায় কাফকার প্রভাব লক্ষ করেছেন জেনে বিভ্রান্ত বোধ করেছি। সন্দীপন লেখায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। সেই বাবদে তিনি ধন্যবাদার্হ। কিন্তু, কাফকার প্রভাব?
The Castle পড়েছিলাম প্রায় তিরিশ বছর আগে। কলেজে স্নাতক পাঠক্রমের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। উপন্যাসটি পড়ার পর মন বিপজ্জনক বিষণ্ণ। ঘর থেকে বেরতে ইচ্ছে করে না। আগা থেকে গোড়া জীবনযাপনই মনে হয় অর্থহীন। অথচ, রহস্যময় কালো পাথুরে পাকদণ্ডী পথে নিজেকে দেখি অভিযাত্রী। কে? K। সে কি হীনবল? বেশিরভাগ মাদকই শুনেছি ডিপ্রেস্যান্ট, মদ তো বটেই। তবু, মদ্যপ রোজ শুঁড়িখানায় ছোটে। গান গায়, কুদরত নে জো হম কো বখ্শা হ্যায়, ওহ্ সব সে হাসিন ইনাম হ্যায় ইয়ে! আমিও তেমনই নির্জন ঘরে ফের কাফ্কা হাতে করি। The Metamorphosis। আর যায় কোথা! অন্দরে আছাড়িপিছাড়ি যেতে যেতে কূল পাই না, বাঁচার অজুহাতে জীবন নামে তামাশার অন্ত কীসে হবে, গলায় দড়ি, বিষপান না কি, রেলের লাইনে মাথা রেখে? মাসখানেক ব্যাপী সে এক সময় গিয়েছে। তখন কাফ্কার জীবনবৃত্তান্ত কিছুই জানি না। এই ভানুমতীর খেল জনা কয়েক লেখকই জানেন। একজনের নাম কাফ্কা।
নবারুণ ভট্টাচার্য বাংলা বাজারে এক নতুন মেজাজ, নতুন ভাষা আমদানি করেছেন। একেবারে নতুন হয়তো নয়। সেই কবে হুতোমও খানিকটা এই প্রকরণেই কলমবাজি করেছেন। তবে, আজ যে সমস্ত শব্দবন্ধকে কাঁচা খিস্তি মনে করা হয়, হুতোমের আমলে তেমন ভাবনার চল ছিল না। ফলে, হুতোম ভেবেচিন্তে নুন ও গোলমরিচের মতো সেসব শব্দ লেখার শরীরে ছড়ানোর কথা ভাবেননি। নবারুণের রাবড়িতে খিস্তি ও খেউড়ের খোয়া ভরা থাকলেও, সেগুলি তার একমাত্র বৈশিষ্ট্য নয়। হুতোমের মতোই, নবারুণের লেখাতেও এক বিষণ্ণ নাগরিক ভাবনার আন্দাজ পাওয়া যায়। এটা আমার ভাল লাগে। নবারুণের লেখা বহুস্তরী কি না, সে-বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। লেখকের যেসব সীমাবদ্ধতা থাকে, পাঠকের তার অনেকটাই থাকে না। শিক্ষিত পাঠক কখনও প্রান্তিক নয়। রাষ্ট্রযন্ত্র, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা, সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্রের ক্ষোভ, সাবোতাজ ইত্যাকার বস্তু রিডিং বিটুইন দ্য লাইনস কেতায় খোঁজা আর পতাকাহাতে রাজপথে মিছিল করার মধ্যে তফাত দেখি না। পাঠক মিছিলে যাবে বলে বই হাতে করে না। চিলেকোঠার সেপাইয়ের মতোই নির্জনে বইটি পড়ে। লাইন এবং বিটুইন দ্য লাইনস, সবই পড়ে। প্রসঙ্গত, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ওসমান এবং হাড্ডি খিজির দুইই আমার প্রিয় চরিত্র। অবশ্য, সে দস্তয়েভস্কির রাসকলনিকভ এবং রাজুমিখিনও। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাংলা বাজারে নবারুণ জনপ্রিয়। চরিত্রগতভাবেই, মধ্যবিত্ত বিদ্রোহ করে না। বিদ্রোহের গল্প শুনতে ভালবাসে। লেখক ধিমে আঁচে দুধ জ্বাল দেন, পরতে পরতে ক্ষীরের সর তুলে বহুস্তরী রাবড়ি বানান। স্তরীভূত ভোজ্য গ্রহণান্তর তৃপ্ত পাঠক উদাস ভাবুক চোখে জানলার বাইরে চায়।
নবারুণও অননুকরণীয়, শুধু অন্যের জন্য নয়, নিজের কাছেও। ওই শৈলীতে অমন রচনা দু’টি, বড়জোর তিনটি পাশাপাশি রাখা যায়। অ্যাসেম্বলি লাইনে উৎপাদিত হতে থাকলে, অবশেষে কেজিদরে রদ্দিওয়ালার সামর্থ্যের আওতায় পৌঁছে যায়। কত যে রাশি রাশি ভারা ভারা এই মাল আজকাল বিভিন্ন কলমে পত্রপত্রিকায় দেখতে পাওয়া যায় তার ইয়ত্তা নেই। বেগম জনসন, পুরন্দর ভাট, ডিএস, দণ্ডবায়স বা হারবার্ট কেউই আমার প্রিয় চরিত্র নয়। কারণ, ওরা কেউই চরিত্র নয়, সকলেই নবারুণের চরিত্রাংশ। আমার বরঞ্চ তারই মধ্যে পছন্দ বড়িলাল আর কালীকে। কালি-কলমে আঁকা ওই দুটি দেহে শুধু নবারুণ কেন, অনেকেরই রক্তে রাঙানো আত্মা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। আমি তো নিজেকে দেখতে পেলুম। তাই ...
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গদ্য। সেই ছোটবেলাতেও কাকাবাবু দু’পাতার বেশি পড়তে পারিনি। বারেবারে ভেবেছি, ব্যাপারটা কী! লোকটা বাচ্চাদের কত বাচ্চা মনে করে? প্রথম আলো বা সেই সময় পড়তে গিয়েও সেই একই অভিজ্ঞতা। সুনীল বোধহয় তাঁর পাঠকদের কখনওই প্রাপ্তবয়স্ক মনে করতে পারেননি। ভাষা তাঁর কিছুতেই বদলায় না। নীললোহিতের নীলু আমার প্রিয় চরিত্র নয়। হুমায়ুন আহমেদের হিমুও নয়। কী আর করা! এ হল পাঠকের স্বীকারোক্তি। লেখকের নয়।
ভাষা বদলাত সমরেশ বসুর। কালকূট তো অতি অবশ্যই এক আলাদা লেখক। সমরেশও কি একজন? মনে হয় না। সমরেশ সেই লেখক যিনি প্রেক্ষাপট ও চরিত্রের প্রয়োজনে অনায়াসে ভাষা বদলাতে পারতেন। ছেলেবেলায় আনন্দমেলায় তাঁর একটি উপন্যাস পড়েছিলাম। উপন্যাসের নাম মনে নেই। সেখানে বালিকা চরিত্রটির নাম ছিল ঝিনি। ভীষণ প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম সেই মেয়ের। প্রেমের আভাসও যে ছিল উপন্যাসে! একেই বলে চরিত্র।
![]() |
কাকাবাবু বা ফেলুদা গোত্রের কোনও সিরিজের উপন্যাস নয়। উপন্যাসের নামও মনে নেই। প্রিয় চরিত্রটির নাম ঠিক মনে আছে, এই বুড়োবয়সেও! বড় দুঃখের কথা যে, দেখি নাই ফিরে শেষ হল না। অথবা হয়তো, ঠিকই আছে। সৃষ্টির কি শেষ থাকে কোথাও? একটি গল্প এইখানে বলতে হচ্ছে।
শান্তিনিকেতনে বিচিত্রা নামে একটি বাড়ি ছিল, এখনও আছে। বিচিত্রা বাড়িটি নাট্যঘর নামেও পরিচিত, কেন না নাটক তো বটেই, আরও নানাবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য এই বাড়িটি প্রেক্ষাগৃহ হিসাবে ব্যবহৃত হত। এই নাট্যঘরের সামনে বিস্তৃত প্রাঙ্গণটিতে পুজোর আগে একটি বইমেলার আয়োজন হত। এই বইমেলায় এক সন্ধেয়, সাল ১৯৮৩ কি ১৯৮৪, হঠাৎ সামনে দেখি সমরেশ বসু ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়। প্রসঙ্গত, শান্তিনিকেতনের বাসিন্দাদের কাছে রাস্তায়-ঘাটে অত্যন্ত অনাড়ম্বর পদ্ধতিতে সেলেব্রিটিদের দেখে ফেলা ও তৎপরে ফের নিজ চরকায় তেল দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়া অত্যন্ত স্বাভাবিক এক ঘটনা। অন্তত, তখন তাই ছিল। কলকাতার ট্যুরিস্ট (আমরা বলতাম বোটু) আজকের তুলনায় কম আসত। ফলে, ‘ওই দেখেছ উনি চলেছেন!’ বলে জিভ বের করে ছোটার লোক বেশি পাওয়া যেত না। সমরেশ বসুকে আগেও কয়েকবার দেখেছি। কিং-সাইজ কালচে চ্যান্সেলর সিগারেট খেতেন। শক্তি তো রীতিমতো পূর্বপল্লীর বাসিন্দাই ছিলেন কয়েক বছর; বিড়ি খেতেন। কিন্তু, এই ঘটনাটি হয়তো সামান্য অ-স্বাভাবিক ছিল। কবি ও ঔপন্যাসিক, দুজনেই গলা জড়িয়ে টলমলে পায়ে চলেছেন, কোথাও কোনওভাবেই অনুরাগী ও অনুরাগিনীদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন না, কেউ চোখ বড় করে ওঁদের দেখছে না, অটোগ্রাফ চাইতেও আসছে না কেউ (এটাই ছিল শান্তিনিকেতনের দস্তুর)। দুজনে নিশ্চিন্তে মেলা ঘুরছেন। কিছুদিন আগেই পড়েছি কোথায় পাব তারে। সমরেশই, না ভুল হল, কালকূটই লিখতে পারেন। সঙ্গে ছিল শান্তনু, শক্তির কবিতার ভক্ত। বলল, ‘চল, আমরাও একটু বাংলা খাই।’ হস্টেলে আমাদের আস্তানা ছিল। সেখানে যথেচ্ছ পান করা হল। তারপর একটি পংক্তি, একটি শব্দও ভুল না করে শান্তনুর অনর্গল আবৃত্তি – অবনী বাড়ি আছ? শান্তনু শক্তির পায়ে পড়তে যায়নি। সামনে গিয়ে বলে ওঠেনি, আমি আপনার কবিতা ভালবাসি। ভালবাসা-বাসির সমস্ত স্বীকারোক্তি গেয়ে উঠল রাতের বয়েজ হস্টেলে, যখন শক্তি সশরীরে আশেপাশে নেই। অবনী আমাদের প্রজন্মের প্রিয় চরিত্র। এবং, শান্তনু এখন উত্তর-পূর্ব ভারতের এক পাহাড়ি শহরে কলেজে পড়ায়।
![]() |
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ছোটদের জন্য লেখাপত্র ভারি ভালবাসতাম। মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি, হারানো কাকাতুয়া, মনে আছে। অধীর আগ্রহে আনন্দমেলায় পরের কিস্তির প্রতীক্ষা করতাম। আরও পরে তাঁর অন্যান্য লেখা কিছু পড়েছি। মনে আছে, একাদশ কি দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র তখন সম্ভবত, ঘুণপোকা আর দূরবীন মন দিয়ে পড়েছিলাম। গবা পাগলা, গোয়েন্দা বরদাচরণ, ধ্রুব, শ্যাম এরা সবাই ছিল একসময় আমার প্রিয় চরিত্র।
একটা গল্প বলে আলাপ শেষ করব। আশির দশকের মাঝামাঝি কোনও সময়। বন্যাপ্লাবিত এক গ্রামে বন্ধুর বাড়িতে আটকে পড়েছি। সারা গ্রামজুড়ে জল বয়ে চলেছে। রাস্তাঘাটের কোনও হদিশ নেই। এ-বাড়ির লোক জলে ডোবা একতলা ছেড়ে সকলে আশ্রয় নিয়েছে দোতলায়। মানুষজন নিতান্ত প্রয়োজনে কোথাও হাঁটুজল ভেঙে, কোথাও কলার ভেলা বানিয়ে, কোথাও তালের ডোঙায়, কোথাও ডিঙি নৌকায় যাতায়াত করছে। এভাবে তিনটে দিন যাওয়ার পর চতুর্থ দিন সকালে বৃষ্টি থামল। জলও নামতে শুরু করল। পরিবারে সামান্য শান্তি, সামান্য স্বস্তির ভাব। গত তিন দিনে নানান আশঙ্কা এবং আতঙ্কে সবাই আস্তব্যস্ত ছিল। বাইরের মানুষ আমি তার মধ্যে ছিলাম খানিকটা জবুথবু। আবহাওয়ার পটপরিবর্তনে আজ অনেক নির্ভার। আগেই লক্ষ করেছিলাম ঘরের মধ্যে একটি ভাঙাচোরা আলমারিতে গুটিকয় বই আগোছালো পড়ে আছে। এযাবৎ হাত বাড়াতে প্রবৃত্তি হয়নি, সাহসও হয়নি। আজ বইগুলি উল্টেপাল্টে দেখে একটি বই হাতে এসে বসলাম দোতলার বারান্দায়।
![]() |
লালসালু। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। “শস্যহীন জনবহুল এ-অঞ্চলের বাসিন্দাদের বেরিয়ে পড়বার ব্যাকুলতা ধোঁয়াটে আকাশকে পর্যন্ত ...”। ক্রমে শূন্য হয়ে গেল চারপাশ। পশ্চিমবঙ্গের প্লাবিত জনস্থান থেকে চালান হয়ে গেলাম বাংলাদেশের মহব্বতনগরে। মাঝে বন্ধুর ডাকে ফিরে এসে স্নান-খাওয়া সারতে যা ছেদ। আবার অভিযান শুরু। “সেদিন সন্ধ্যায় বুড়ো কোথায় চলে গেল।” কোথায় গেল? খুঁজতে খুঁজতে আমিও চলি ‘লালসালু’র বাংলা কালো অক্ষরে সাজানো আঁকাবাঁকা পথ ধরে। ... পথ শেষ হয় “সামনে ক্ষেতে-ক্ষেতে” যেখানে “ব্যাপ্ত হয়ে আছে ঝরে-পড়া ধানের ধ্বংসস্তূপ।” চোখ “তাই দেখে চেয়ে চেয়ে। চোখে ভাব নেই। বিশ্বাসের পাথরে যেন খোদাই সে-চোখ।”
বই বন্ধ করে চোখ তুলে দেখি বারো আনা আকাশে মেঘ কেটে গেছে। দূরে কোথাও সূর্য অস্তে যাচ্ছে। লাল হয়ে উঠেছে পশ্চিমে পৃথিবীর কিনারা। কানে আসে ছোট ছোট ছেলে-মেয়ের কোলাহল। তিন দিনের ঘরবন্দি বাচ্চারা লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে কাদায় খেলতে নেমেছে। বন্যার জল সরে গেছে। রেখে গেছে জমাট পাঁক। নদীর বালিজড়ানো থকথকে কাদামাটি দিনশেষের রাঙা আলোয় তরল রুবির মতো ঝিকমিকিয়ে ওঠে। চার আনা আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া ক্লান্ত নির্মন্থিত মেঘেরা একা একা বাড়ির পথে। মজিদ, ব্যাপারী খালেক, আমেনা, রহিমা, জমিলা ... এমনকী, গোধূলির আলোয় ভাসে লালসালু ঢাকা মোদাচ্ছের পীরের ভগ্ন মাজার ...
নাঃ! ঠিক হল না! সম্পাদক বলেছিলেন ‘প্রিয় চরিত্র’ নিয়ে লিখতে। পাঠক হিসাবে সেভাবে লেখা হয়তো সম্ভবও নয়, অন্তত আমার কলমে হয়ে উঠল না। লেখা শেষে দেখছি, বাংলা সাহিত্যের সমুদ্র কিনারে এতকাল দাঁড়িয়ে আঁজলাভরা জলও সংগ্রহ হয়নি। তবু, ভেজা তালুতেও তো অসংখ্য জলবিন্দু থাকে, জানা-অজানা নানাবিধ অণু ও পরমাণু। তার সবটুকু বিশ্লেষণ আমার মুরোদে কুলোবে না। অর্ধসিক্ত বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের ছাপটিই শুধু কোনওমতে এঁকে দিলুম। পাঠক’এর পাঠকের মুচকি হাসি শিরোধার্য শুধু নয়, সে আমার ন্যায্য পাওনা।
লেখক পরিচিত - লব্ধ প্রতিষ্ঠ সাহিত্যিক। ওঁর গোয়েন্দা কাহিনী "গজপতি নিবাস রহস্য" সম্প্রতি ধারাবাহিক ভাবে "দেশ" পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে । "অন্য কোনোখানে" দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত ওঁর আরেকটি ধারাবাহিক কাহিনী। এছাড়া অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে বৈবস্বত, জিয়ন নদী, অনিকেত ইত্যাদি।
Copyright © 2018 Abasar.net. All rights reserved.