২০১৪
শারদীয় সংখ্যা
কি
গভীর ‘বাণী’ এলো
ভাস্কর
বসু
খুব
ছোটবেলাতেই পুজোর এক বিশেষ আকর্ষণ ছিল শারদীয়া সংখ্যা। আমাদের
কৈশোরে, সত্তরের দশকের শুরুতে তখন শারদীয়া বলতে মুখ্যত ছিল কিশোর
ভারতী ও দেব সাহিত্য কুটীরের সেই সংখ্যা গুলি যা ভিন্ন ভিন্ন নামে
প্রত্যেকবার উপস্থিত হত আমাদের কাছে। গোগ্রাসে আমরা গিলতাম, মারামারি
হত ভাই-বোনেদের মধ্যে – কে আগে পড়ে ফেলতে পারবে!
আস্তে
আস্তে বড় হয়ে আমাদের সময়কার বরেণ্য সাহিত্যিকদের সঙ্গে পরিচিত
হতে লাগলাম। সেই সময় তাঁদের বিভিন্ন লেখার জন্য পুজোতে, নতুন জুতো
বা জামা কাপড়ের চেয়েও, শারদীয়া পড়ার আকর্ষণ ছিল অনেক বেশী। আশাপূর্ণা
দেবী, রমাপদ চৌধুরী, বিমল কর, সমরেশ বসু (ও কালকূট) প্রমুখ বর্ষীয়ান
লেখকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উপন্যাস ও ছোট গল্প লিখে চলেছিলেন পরবর্তী
প্রজন্মের লেখকেরা - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (ও নীললোহিত), প্রফুল্ল
রায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়রা।
এইভাবে আস্তে আস্তে বড় হয়ে ১৯৮৩ সালে কলকাতা ছেড়ে প্রবাসে এসে
গেলাম ব্যঙ্গালোরে। সেই আশির দশকে কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা এত
উন্নত হয়নি, ছিল না স্যাটেলাইট টিভি বা অন্তর্জালের সুবিধা! কাজেই
আমরা বাংলা কাগজ বা পত্রিকা পড়ার জন্য উদগ্রীব থাকতাম, বেশ অনেক
দূর গিয়ে সংগ্রহ করতে হত। তাও উৎসাহের অন্ত ছিলনা। ব্যঙ্গালোরের
পুজো মণ্ডপগুলোতে শারদীয়ার স্টল থাকত আর পৌঁছে গিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়তাম
কেনার জন্য।
সেটা
১৯৮৭ সাল। সেই সময় শারদীয়া আনন্দলোকে হঠাৎ ই একটি উপন্যাসের নাম
দেখলাম – ‘জন্মভূমি মাতৃভূমি’! নামটি খুবই কৌতূহলোদ্দীপক, কাজেই
সহজেই উৎসাহী হলাম। আমাদের সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী জীবনে কিন্তু
এই দুটি ভূমি ছিল একই – ভারতবর্ষ। লেখকের নাম –‘বাণী বসু’। আমি
এনার আগে আর কোন লেখা পড়িনি। অস্বীকার করে লাভ নেই আগে অন্যান্য
জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকদের লেখা গুলি শেষ করে তারপরই হাত দিয়েছিলাম
এটিতে।
শুরুতেই ছিল চমক -
“মার্চের
দশ তারিখ হয়ে গেল। কিন্তু এখনও দেখছি দু একদিন অন্তর অন্তরই
ব্রুকলিনের আকাশ তুষার ঝরিয়ে চলেছে। পনেরোটা শীতের মধ্যে তেরোটাই
কেটেছে আমাদের দক্ষিণে যেখানে কর্কটক্রান্তি নিকটবর্তী হওয়ার
দরুণ আবহাওয়া অনেকটা নম্র। শীতটা শুধু একটু কড়া। দিল্লীর শীতের
মতো। তাও জানুয়ারির পরই শীত পাততাড়ি গুটোয়”।
একেবারে
অন্য স্বাদ। একথা মনে রাখা দরকার তখনও বিশ্বায়ন হতে অনেক বাকী।
সারা পৃথিবীর জানলা দরজা আমাদের মত ছাপোষা বাঙালীদের কাছে অনেকটাই
ছিল বন্ধ। আমাদের অবশ্য তার জন্য কোন দুঃখ ছিলনা। আমারা আমাদের
বাঙ্গালী বা ভারতীয় জীবনের কাহিনী পড়েই সুখী ছিলাম। এর আগে অবশ্য
আমরা নীললোহিতের ‘সুদূর
ঝর্ণার জলে’ তে বাঙ্গালী ছেলের ফরাসী প্রেমিকার আভাস পেয়েছি। ধারাবাহিক
ভাবে সাপ্তাহিক পত্রিকাতে প্রকাশিত ‘নোটন নোটন পায়রাগুলি’তে বিদেশে
বসবাসরত বাঙালী নারীর বিদেশী পরিবারের গল্প শুনেছি। কিন্তু জন্মভূমি
ও মাতৃভূমির এই টানা-পোড়েনের কাহিনীটি একেবারে অন্যরকম ছিল। যতই
এগোতে লাগলাম, মুগ্ধতা আরো বাড়তে লাগল। এখনো মনে আছে, গভীর রাতে
যখন উপন্যাসটি শেষ করেছিলাম, কিছুতেই ঘুম আসছিল না। কি এক অদ্ভুত
ভাবনায় আবিষ্ট হয়েছিল মন।
উপন্যাসটিতে
বিশদ ভাবে বিবৃত হয়েছিল একই পরিবারের চারটি মানুষের চারটি ভিন্নরকম
আশা – আকাঙ্ক্ষা ও অভিজ্ঞতার কথা। পরিবারের কর্তা সুদীপ –তিনি
বড় হয়েছেন উত্তর কলকাতার একটি মধ্যবিত্ত যৌথ পরিবারে। পড়াশোনায়
তুখোড় এই মানুষটি কাজের তাগিদে বিদেশে বসবাস করলেও অনুভব করেন
নিজের দেশের মাটির প্রতি এক অসাধারণ টান – এই মানুষরা হয়তো শারীরিক
ভাবে বিদেশে গেলেও মনে মনে থেকে যান তাঁর দেশের মাটিতেই। হয়তো
দেশের মাটি ছাড়ার সময়ও তিনি বাস্তবকে মেনে নিলেও মনে নিতে পারেননি,
হয়তো তাঁর চেতনাতে সবসময়ে দেশমাতৃকা ঘিরে ছিলেন- ‘জানি নে তোর
ধনরতন, আছে কিনা রাণীর মতন, শুধু জানি আমার অঙ্গ জুড়ায় তোমার
ছায়ায় এসে'!!
অনন্য
তাঁর দেশপ্রেম, তিনি মনে করেন বিদেশের শিক্ষা নিয়ে দেশের মাটিতে
তা দিয়ে বীজ রোপণ করলেই শিক্ষার সার্থকতা। কাহিনীর শুরু সুদীপ
কমলিকার মেয়ে আরাত্রিকার ত্রয়োদশ জন্মদিনের দিন। এই দিন সুদীপের
মধ্যে দেশের প্রতি টান যেন আরো দৃঢ় হয়। সুদীপের স্ত্রী কমলিকা
কিন্তু যথেষ্ট সুখী এই প্রবাস জীবনে যার ব্যবহারিক কারণটিও সুদীপের
পরিষ্কার জানা –
“আমি
জানি আসলে দেশে কমলিকা অসুখী ছিল। যা রোজগার করতুম তাতে যৌথ
পরিবারের পাওনা গণ্ডা চুকিয়ে হাতে বিশেষ কিছুই থাকত না। কমলিকা
সচ্ছল, উপরন্তু ছোট পরিবারের মেয়ে। খুবই সুখ স্বাধীনতার মধ্যে
মানুষ। ওর তাতে অসুবিধে হত।”
লক্ষণীয়
যে এখানে তিনি খুব সূক্ষ্মভাবে দুই পরিবারের মধ্যে আর্থ-সামাজিকতার
বৈষম্যের কথা উল্লেখ করে প্রবাস জীবনে মানিয়ে নেওয়ার দুটি দিককে
খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করলেন। এই পরিস্থিতি আমাদের কাছে খুবই
চেনা, আমরা অনেকেই নিজেদের বা বন্ধু বান্ধবদের জীবনে তা প্রত্যক্ষ
করেছি। সুদীপের কিন্তু স্ত্রীর এই মনোভাবের প্রতি যথেষ্টই সস্নেহ
দৃষ্টি আছে –
“ছায়াভরা
দীঘির মত গভীর কালো চোখগুলো সবসময় বিষণ্ণ হয়ে থাকত। আমাদের প্রথম
সন্তান বাবুকে প্রতিদিন ডিম-কলা-পরিজের ব্রেকফাস্ট খাওয়াতে না
পারলে ও চোখের জল ফেলত।”
তিনি
কমলিকার দেশে ফেরার অনাগ্রহের কারণটি ভালোই জানেন, কিন্তু এ সত্ত্বেও
তাঁর দেশের প্রতি টান ক্রমবর্ধমান। সুদীপ – কমলিকার ঘনিষ্ঠ পারিবারিক
বন্ধু দীপঙ্কর-এনা বা জ্যোতি-দীপালিরা কিন্তু সুদীপের ভাবনার একেবারেই
বিপরীত মরুতে অবস্থান করেন। দেশের প্রতি টান আছে, সে জন্য তাঁরা
মাঝে মাঝে দেশে যান, কিন্তু বরাবরের মত দেশে থাকার কথা তাঁরা ভাবতে
পারেন না। তাঁরা আমেরিকান সিটিজেন হয়ে গেছেন বা হয়ে যাওয়ার মুখে।
তাঁদের এই মনোভাবের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন কমলিকার। তিনি স্বামীকে
প্রশ্ন করেন –
“তুমিই
বা নিচ্ছনা কেন (আমেরিকান সিটিজেনশিপ), তোমার কি দেশে ফিরে যাওয়ার
ইচ্ছে আছে” -
তাঁদের
দুই ছেলে মেয়ে– বড় ছেলে বাবু ওরফে স্বদেশের জন্ম কলকাতায় আর ছোট
মেয়ে আরাত্রিকার জন্ম আমেরিকাতেই। সেই সূত্রে খুব ঘনিষ্ঠ হওয়া
সত্ত্বেও দুই ছেলে মেয়ের ভাবনা চিন্তার বিস্তর ফারাক। বস্তুত:
এই চার জনের কাছে “জন্মভূমি-মাতৃভূমি’র ভিন্নধর্মিতাই এই উপন্যাসের
মূল উপজীব্য। লেখক ও তা জানতেন। তাই প্রথম চারটি অধ্যায়ে এই চারটি
চরিত্রের আত্মকথনের মাধ্যমে এই চরিত্রগুলিকে পাঠকের আপনজন করিয়ে
দেন। উপন্যাস রচনার এই আঙ্গিকটি একেবারে অভিনব না হলেও এই উপন্যাসে
তার প্রয়োগটি ভারী সুন্দর আর কার্যকরী। পঞ্চম অধ্যায়ে এসে আবার
লেখক স্বয়ং কর্তৃত্ব নেন, উপন্যাসটি চলতে শুরু করে তার নিজের গতিতে।
পাঠক কিন্তু ততক্ষণে পরিচিত হয়ে গিয়েছেন মূল আখ্যানটির পাত্র-পাত্রীদের
সঙ্গে, কাজেই সেই গতিপথ অনুসরণ করতে তাঁদেরও বিন্দুমাত্র অসুবিধে
হয় না। যেমন একবাক্যে কমলিকা যখন জানিয়ে দেন তাঁর স্বস্তির কথা
আর আমরা বুঝতে পারি তাঁর জীবনদর্শন তাঁর স্বামীর থেকে অনেকটাই
ভিন্ন-
“পনের
বছর এদেশে কেটে গেল। নিরঙ্কুশ তা বলব না। জ্যোতির্ময়-দীপালির
মত ‘রোজেস, রোজেস অল দা ওয়ে’ হয়নি। সমস্যাহীন, সম্পূর্ণ দুঃখহীন
জীবন আমি আশাও করিনা। মোটের ওপর ভালো আছি একথা স্বীকার না করলে
অপরাধ হবে।”
তাঁদের
ছেলে স্বদেশ ওরফে বাবুর জন্ম এদেশে কন্তু চার বছর বয়সের পর থেকে
বেড়ে ওঠা বিদেশেই। দেশে থাকাকালীন সে তার ঠাকুমার খুব ঘনিষ্ঠ ছিল,
সেই কারনেই হয়ত তার মধ্যে কিছুটা দেশজ সংস্কার বা দেশের প্রতি
আকর্ষণ রয়েছে। মেয়ে আরাত্রিকার কিন্তু জন্ম আমেরিকাতে, সে মার্কিন
নাগরিক। এই দুই সহোদর ভাইবোনের মধ্যেই অনেক ফারাক। ছেলে বাবু ভারতবর্ষকেই
তার দেশ ভাবে– কাজেই তার বন্ধু পিটার যখন প্রশ্ন করে –
শেষে একদিন
বলল – ‘নিজের দেশ নিয়ে চিন্তা হয়না তোমার?’
বাবুর ভাবনা -
“আমার
দেশ? আমার দেশের অসুখ যে কত গভীরে তা এই কুপার নামক বালকটিকে
আমি কি করে বোঝাই?”
বাবু যে নিজের দেশের জন্য
গভীর ভাবে চিন্তা ভাবনা করার চেষ্টা করে, তা তার ঐ উপরের উক্তিটিতেই
পরিষ্কার। ধীরে ধীরে অবশ্য আমেরিকার ভালো দিকটাও তার নিরপেক্ষ
চোখ দেখতে পায়-
“কুপারের
সঙ্গে সেবার সেই আমেরিকা-আবিষ্কার যাত্রায় বেরিয়ে আমার কিন্তু
একটা সত্যিকার লাভ হয়েছিল। ছোটবেলার মার্কিন পারিপার্শ্ব থেকে
যে ঘৃণা সংগ্রহ করে বুকের মধ্যে জমিয়ে রেখেছিলুম তার অনেকটাই
মুছে গিয়েছিল।”
আর
আরাত্রিকা যেহেতু জন্মেছে ও বড় হয়েছে পুরোপুরি মার্কিন পরিবেশে,
কাজেই তার ভাবনা অন্যরকম। যদিও তার ত্রয়োদশ জন্মদিনে সে কিন্তু
তার আমেরিকান বন্ধুদের নিয়ে পালন কথা ভাবে না, বাবা, মা দাদা,
আর পারিবারিক বন্ধুদের সঙ্গে সে কাটাতে চায়। তার বাবার তাকে নিয়ে
ভাবনা তাকে বিশেষ ভাবে চিন্তিত রাখে। সে ভীষণ ভাবে ‘এডমায়ার’ করে
তার বাবা ও দাদাকে। দাদা তার বন্ধু-বান্ধবদের একেবারে পছন্দ করে
না, আরাত্রিকার প্রথমে খারাপ লাগলেও পরে সে দাদার কথার মানে বুঝতে
পারে।
“স্টীভ
আর রকহার্ডকে তো দাদা স্ট্যান্ড করতেই পারে না সোজাসুজিই বলে
– ‘তোর এই প্লে-বয় বন্ধুগুলোকে ছাড় তো মনি! ডোন্ট য়ু এভার মীট
এনিবডি ওয়ার্থ মিটিং’। প্রথমে রাগলেও দাদার কথাগুলো আমার মাথার
মধ্যে ঘোরাফেরা করতে থাকে। ইনফ্লুরেন্সড হয়ে যাই। সব বাজে, সিলি
লাগতে থাকে। কি করব! দাদাটা এমন!”
এরপর
সুদীপ তার পরিবারকে নিয়ে পাড়ি দেন দেশের দিকে। কিন্তু কলকাতায়
ফিরে সুদীপ বুঝতে পারেন স্বপ্নের কাছে এলেও স্বপ্ন আর নেই। প্রাথমিক
ভালো লাগাটা আস্তে আস্তে সরে যেতে থাকে। যে কলেজে চাকরী নেন সুদীপ,
সেই কলেজে ছাত্র রাজনীতির এক ভয়াবহ ছবি তিনি প্রত্যক্ষ করেন। ওদিকে
আরাত্রিকা তার কলেজে পড়তে গিয়ে বুঝতে পারে এখানকার ছাত্ররা একেবারে
অন্য ধাঁচের। পরীক্ষার ফলাফল তাকে স্তম্ভিত করে দেয়। কমলিকাও আমেরিকা
থেকে বন্ধু বিয়োগের খবরে মর্মাহত হয়, এখানেও ঘনিষ্ঠ আত্মীয় মারা
যাওয়াতে পরিবারে বিষাদের ছায়া – সব মিলিয়ে যে আনন্দের জন্য দেশে
ফেরা তা যেন অধরাই থেকে যায়। সর্বশেষ আঘাতটি বড়ই সাংঘাতিক - কলেজ
রাজনীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়ছিলেন সুদীপ, কিন্তু তাঁর শরীর তাঁকে
আর সঙ্গ দিল না। এক চরম উত্তেজনার মুহূর্তে আকস্মিক হৃদরোগ তাঁর
প্রাণ কেড়ে নিল। তাঁর স্মরণে কোন একদিন গান চালাতে গিয়ে আচমকাই
সবাই আবিষ্কার করেন সুদীপের রেকর্ড করা আবৃত্তি – যেন তিনি নিজের
অজান্তেই যা রেখে গিয়েছিলেন তাঁর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের
জন্য-
“আজ আমার
প্রণতি গ্রহণ করো, পৃথিবী, ----------
হে উদাসীন পৃথিবী,
আমাকে সম্পূর্ণ ভোলবার আগে
তোমার নির্মম পদপ্রান্তে
আজ রেখে যাই আমার প্রণতি”।
এ
কোন সুতীব্র অভিমান নিয়ে চলে গেলেন আকণ্ঠ দেশপ্রেমী মানুষটি! বিদেশের
সঞ্চয় দিয়ে তিনি তো দেশের মাটিতে নতুন করে কিছু গড়তে চেয়েছিলেন
– দেশ হয়তো তৈরি ছিল না তার জন্য। এই অভিমান ছড়িয়ে পড়ে পাঠকের
মনেও। তাই হয়তো আমরাও অজান্তেই আরাত্রিকার আমেরিকা প্রত্যাবর্তনের
সিদ্ধান্তের শরিক হয়ে পড়ি।
“
মুক্তির দায়িত্ব আছে। যন্ত্রণা আছে। আছে নৈঃসঙ্গ। কিন্তু এইসব
দায়িত্ব, যন্ত্রণা, একাকিত্বের শরিকানা তো অনেকের। আছে স্টীভ,
বাথসেবা, তানি, এডাম, রকহার্ট, প্রিয়াঙ্কা। আছে এমিলি, জ্যোতিষ
কাকু। ---
এখন নিশ্চয়ই আমার জন্মভূমির পত্রমোচী অরণ্যে ফল এসেছে--- কিন্তু
কে থাকল, কে থাকল না তাতে খুব বেশী আর এসে যাবে না। কারণ একজন
সবসময়ে সঙ্গে সঙ্গে থাকবেন, বুকের মধ্যে নির্ভর আত্মপ্রত্যয়
জাগিয়ে। তিনি লিবার্টি। আমার দেশে নাগরিকের ইচ্ছেমতো মানুষের
মতো বাঁচবার স্বাধীনতা কেউ কারো কাছ থেকে কেড়ে নেয় না।”
এমনভাবে
সমস্ত ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে কাহিনীটি বিধৃত যে তা আমাদের মনে
গভীর দাগ কাটে। বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে এতটাই মিল যে আমরা অসহায়
ভাবে আরাত্রিকার সঙ্গী হয়ে পড়ি। তবে মনে মনে ভাবি হয়ত দেশকে তার
একদিন মনে পড়বে – সুদীপের দেখানো পথে সে হয়তো দেশে ফিরে আসবে আর
সফলও হবে। তার বাবার দেওয়া নাম ‘আরাত্রিকা’ (আরতির প্রদীপ) কে
সার্থক করে এই আঁধার দেশে শিক্ষা ও জ্ঞানের দেবতাকে পথপ্রদর্শন
করাবে।
তার
উত্তর আমার জানা নেই, কিন্তু আমার মনে ততদিনে জন্ম নিয়েছেন এক
প্রিয় সাহিত্যিক যাঁর লেখার জন্য পরের পুজোতেও আমি অপেক্ষা করব।
এই অপেক্ষা আমার সার্থক হল। এর পরের বছর পূজাবার্ষিকীতে তিনি আমাদের
উপহার দিলেন আর একটি অনন্য উপন্যাস – “অন্তর্ঘাত”। ষাট-সত্তরের
দশকে যে নকশাল আন্দোলন বাঙালী তরুণ সমাজকে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত
করেছিল – তার এবং সেই স্বপ্নভঙ্গের কাহিনী ই উপন্যাসের ভিত্তি।
সেটি পরিবেশিত হয়েছিল একটি রোমাঞ্চকর কাহিনীর মোড়কে – বড়ই মর্মন্তুদ।
এরপর একে একে আমরা পেতে লাগলাম ‘পঞ্চম পুরুষ’, ‘উত্তরসাধক’, ‘গান্ধর্বী’,
‘একুশে পা’ এর মত অসাধারণ আখ্যানগুলি। আর এই ভাবে, ধীরে ধীরে,
বাণী বসু আমার অন্যতম প্রিয় সাহিত্যিক হয়ে উঠলেন। ফি বছর শারদীয়ার
সূচীপত্র হাতে পেলেই আমি খুঁজতে থাকতাম কোন পত্রিকাতে তিনি এবার
লিখলেন।
লেখক
পরিচিতি - ভাস্কর বসু - জন্ম কলকাতায়, বেড়ে ওঠা দক্ষিন চব্বিশ-পরগনার
রাজপুর-সোনারপুর অঞ্চলে। ১৯৮৩ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
ইলেক্ট্রনিক্স ও টেলিকম্যুনিকেশন ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে কর্মসূত্রে
ব্যাঙ্গালোরে। শখের মধ্যে অল্প-বিস্তর বাংলাতে লেখা - অল্প কিছু
লেখা রবিবাসরীয় আনন্দবাজার, উনিশ-কুড়ি, নির্ণয়, দেশ, ইত্যাদি পত্রিকায়
এবং বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিন (সৃষ্টি, অবসর, ইত্যাদিতে) প্রকাশিত।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর
ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর
নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।