প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

“বাঙ্গালীর পুজো – গানে, পাঠে”!!

সুনীলের কবিতা আর আমি

ঈশানী রায়চৌধুরী

      বালিকাটির বয়স কত আর! ন 'বছর মেরেকেটে। চঞ্চলমতি। বাড়ির লোক বসিয়ে রাখে বই দিয়ে। বুঝুক না বুঝুক, পড়ুক। তবু তো হইহুজ্জতি কম হবে। গদ্য তাকে টানে বেশি। পদ্য কম। কেন? পদ্যর বই সব চটি চটি। একটু পরেই শেষ হয়ে যায়। খুব পড়ে সে। রবি ঠাকুর থাকেন বোঝা না-বোঝার আলো -আঁধারিতে, বঙ্কিম থাকেন কিশোর সংস্করণে, শরৎবাবু ভালো লাগে না..ওই রামের সুমতি, বিন্দুর ছেলে, পরিণীতা আর দত্তা ছাড়া। খালি ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কান্না পায়। বইয়ের ঘরে চৌকিদার নেই। অনেক বই; যা খুশি যেমন খুশি পড়। পদ্যও পড়ে বৈকি। রবি ঠাকুর, নজরুল , কালিদাস রায়, সত্যেন দত্ত। বেশ পদ্য। ঝিমঝিম দুলুনি। কিন্তু খানিক বাদে হাই ওঠে! পদ্যর নেশা ফুরিয়ে যায়। মেয়েটা আবার কয়েকবারের পড়া গদ্য টেনে নেয়।

      ঋতুচক্রের স্বাভাবিক নিয়মে বালিকা থেকে বয়:সন্ধিতে পৌঁছে যায় সে। গদ্যে পছন্দ বদলে যায়; পদ্যেও। পদ্যকে এখন সে “কবিতা” নামে ডাকে । মায়াবী কলমে আসেন জীবনানন্দ, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন দত্ত, বুদ্ধদেব বসু। মেয়েটি কল্পলোকের চাবি আঁকড়ে দিব্যি থাকে। এই সময় বড় সুসময়, আবার বড় দু:সময়ও বটে । নি:শব্দ মার্জারপায়ে আসে প্রেম। বাড়িতে বইতে পাহারাদার নেই, কিন্তু প্রণয়ে খরদৃষ্টি আছে স্বঘোষিত ও অঘোষিত হাজার অভিভাবকের। প্রেমের খিড়কির দরজাটিতে খিল তুলে দেবার আগেই এক ভরদুপুরে মেয়েটির শোবার সটান ঢুকে পড়ে ফুলকাটা পশমী আসনটি দিব্যি মেঝেতে বিছিয়ে গুছিয়ে বসে এক কবি। অচেনা, না-পড়া।

      মেয়েটি ততদিনে পঞ্চদশী । সে অবাক হয়ে বলে, " তুমি কে?"
      মুচকি হেসে কবি বলে, " ভালোবাসতে ইচ্ছে করে?"
      পঞ্চদশী লাল হয়, " যা :!"
      কবি মুচকি হাসে ।

"মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই
কেউ তা বোঝে না সকলি গোপন মুখে ছায়া নেই...."

      "কার লেখা গো এটা?"
      কবি নিজের বোতামবিহীন ছেঁড়া শার্টের আড়ালে উঁকি দিতে থাকা পাঁজরে টোকা মেরে বলে, " কার আবার । এই শর্মার ।"
      মেয়েটি বলে, " এই, তুমি যাও এবার । আর এই ঘরে এলেই বা কী কর?? মা দেখে ফেললে বকবে আমায় । অচেনা ছেলেদের সঙ্গে কথা বলা মানা আমার ।" 

" অচেন?? অচেনা আবার কোথা?? আর তা ছাড়া -
…….যাবার কথা ছিল ফেরার পথ নেই
এখন বেলা গেল....."

      " না না, তুমি যাও । আর শোনো, ওই খাতাটা রেখে যাও । আমি পড়ব ।"
      
" একটা খাতাতেই হবে ত?? আমার কিন্তু এমন অনেক ক'টা খাতা আছে । কালিমাখা , হিজিবিজি , কাটাকুটি ..."
      
“তুমি রোজ দুপুরে এই সময়টাতে এস । আমাকে দিয়ে যেও । তখন সব্বাই ঘুমোয় । আমি দরজা খুলে রাখব । আসবে না?"

কবি বলেছিল,

" কেন রবীন্দ্রনাথকে তুমি বুকে জড়িয়ে বসে আছো>
জানলার ধারে
আমি কি কেউ না?
আমি গরিব ইস্কুল মাস্টারের ছেলে দাঁড়িয়ে আছি রাস্তায় হাঁ করে
জলকাচা ধুতির ওপর পেঁজা শার্ট পরে , পায়ে রবারের স্যান্ডেল
আমার কোনো জ্যোতিদাদা ছিল না , পিয়ানো অর্গান শুনিনি
সাত জন্মে
আমার বাবা কোনো দিন সিমলে পাহাড়ে যাননি আমাকে নিয়ে
জন্মদিনে রুপোর চামচে পায়সান্ন দূরে থাক , ফ্যানা ভাতে
কোনো দিন ঘি জোটেনি
তবু আমি কি কেউ না?
আমার নিজস্ব ঘর নেই , লেখার টেবিল নেই , যখন তখন আমার বিছানায়
উড়ে আসে
উনুনের ঠাণ্ডা ছাই
তিনবেলা টিউশানি করি , সর্বক্ষণ পেটে ধিকিধিকি করে খিদে
তবু আমি কবিতা লিখেছি , সবাইকে লুকিয়ে , মোম-জ্বলা মাঝ রাত্রে
আমার রক্ত , ঘাম , আত্মার টুকরো মিশে আছে তাতে ।"

       অভিমানে কবির ঠোঁট বেঁকে যায় । আর সেই শুরু । প্রেম, নাকি অন্য এক ভালোবাসাবাসি খেলা ?
      
পঞ্চদশী এতদিন জানত " প্লেটনিক লাভ"। শরীর নিয়ে হট্টগোল নৈব নৈব চ । বড়জোর ফিসফাস । সেখানে বেনোজলের মতো হু হু করে ঢুকে পড়ল এই মাথা চিবিয়ে খাওয়া কবি ও কবিতা । যে কবিতা হাত ধরে মেয়েটিকে নিয়ে গেল শরীরী প্রণয়ের নন্দনকাননে ।

       মেয়েটি অষ্টাদশী । আয়নার সামনে ।

       "উদাসীন গ্রীবার ভঙ্গি, শ্লোকের মতন ভুরু
              ঠোঁটে স্বপ্ন কিংবা অসমাপ্ত কথা
       এ যেন এক নারীর মধ্যে বহু নারী, কিংবা
              দর্পণের ঘরে বাস

সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে না , কেননা আবহমান কাল
      থেকে বেণীবন্ধনের বহু উপমা রয়েছে

নীল জামা, সাদা ব্রা, স্তনের গোলাপী আভাস, এক
      বিন্দু ঘাম
পেটের মসৃণ ত্বক, ক্ষীণ চাঁদ নাভি, সায়ার দড়ির গিট
      উরুতে শাড়ীর ভাঁজ, রেখার বিচিত্র কোলাহল
পদতল--আল্পনার লক্ষ্মীর ছাপের মতো "

মেয়েটি খর চোখে মেঝেতে আঁকা নিজের পায়ের জলছাপ পরখ করে ।

সে ফিসফিস করে বলে,

"দেখো দেখো
     
আমার বাগানে এক অগ্নিময়
ফুল ফুটে আছে
      তার সৌরভেও কত তাপ!"

সে বুঝতে শেখে ,

      "হাতের মুঠোয় ছিল একটা মস্তবড় নদী
নদীর মধ্যে ছিল আমার বাল্যকালের ভয়
      ভয়ের পাশে সরলতার বাগান আর প্রাসাদ
হারিয়ে গেল,
      সমস্তই হারিয়ে গেল!
নদীও নেই , ভয়ও নেই , কোথায় সেই
      কাননঘেরা বাড়ি ।
এখন আমি মানুষ, আমি কঠিন একটি মানুষ .."

এখন সে সত্যি এক নারী!

       মেয়েটি কবিতার আগুনআঁচে পুড়তে থাকে , পুড়তে পুড়তে মরতে থাকে , এবং ভালোবাসতে থাকে । সে শিখে নেয় "এসো " শব্দের অর্থ...

" গভীর অরণ্য থেকে ভোরবেলার আলো এসে বলছে, এসো
এইমাত্র জন্ম হল যে ঝর্নার, সে বলছে , এসো
মধ্যরাত্রির আকাশের শান্ত নীরবতা বলছে , এসো
শুধু প্রকৃতিতে নয়, শুধু হৃদয়ে নয়, শরীর বলছে এসো
ওষ্ঠের অমৃত, স্তনবৃন্তের উষ্ণতা, যোনির লাবণ্য বলছে , এসো
আরও পরে, আরও গভীরে, যেখানে সময়ের সঙ্গে মিশে আছে
চিরকালের শূন্যতা
সেখান থেকেও ডাক শুনতে পাচ্ছি , এসো
এক জন্মের সমস্ত চলে যাওয়ার মধ্যে ধ্বনিত হচ্ছে , এসো....."

       এভাবেই মেয়েটি কিশোরীবেলার চৌকাঠ পেরিয়ে পা দেয় যৌবনের চবুতরায় । আর সেই কবি । মাঝবয়সের পড়ন্ত রোদ্দুরে পিঠ রেখে সে লিখেই যায় , লিখেই যায় । মেয়েটি কালো কালো পিঁপড়ের সারি অক্ষরমালাকে আঁকড়ে ধরে আদর করে, তাদের পায়ের কাছে লুটোয় , সিংহাসনে বসিয়ে দিয়ে আগুন নিয়ে খেলে।

"তবু নিজের বুক পুড়ে যায় বুক পুড়ে যায়
বুক পুড়ে যায়
কেউ তা বোঝে না
ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে ।"

       মেয়েটির কলেজের পাশেই বসন্ত কেবিন । এদিক ওদিক তাকিয়ে প্রেমিকের আঙুলে আঙুল ছুঁইয়ে ঢুকে পড়লেই হয়! কিন্তু প্রেমিক কী ভীরু! ছি:!

"ক্যাবিনের পর্দা উড়লে দেখা যায় উরুর কিঞ্চিৎ
একটি বাহুর ডৌল, টেবিলে রয়েছে ঝুঁকে মুখ
ওপাশে কে? ইতিহাস চূর্ণ করা নারীর সম্মুখে
রুক্ষচুল পুরুষটি এমন নির্বাক কেন? শুধু সিগারেট
নড়েচড়ে , এর নাম অভিমান? পাঁচটি চম্পক
এত কাছে , তবু ও নেয় না কেন , কেন ওর ওষ্ঠে
দেয় না গরম আদর?"

       মেয়েটি ছিটকে বেরিয়ে আসে হেদুয়ার সামনের ট্রামলাইনে । চাঁদিফাটা গরমে চটি ঘষে ঘষে হাঁটে নতমুখ।
শরীর তো আসলে ঘরেরই মতো । মেয়েটি খাতার পাতা উল্টে খুঁজে যায়..

“বহু রকমের চাবি-বন্দী হয়ে আছে এই ঘর
দেরাজ, আলমারি, বাক্স, বস্তুর সমস্ত স্পর্ধা
দমন করেছে এই
একটি মাত্র পিতলের কাঠি
মাঝে মাঝে ভাবি আমি, চাবিরও কি প্রাণ আছে নাকি?
বড় তেজী, অভিমানী, ওরা জানে
জীবনের মর্ম ঠিক কিসে
তাই তো অজ্ঞাতবাসে চলে যায় প্রায়শই
অন্ধকারে চুপিচুপি হাসে
যেমন এক একটা চিঠি সভ্যতার মর্মমূলে
বদলে দিতে পারে সব
স্বপ্নের স্থাপত্য!
পরবর্তী আলোড়ন, হুলুস্থুলু -- আসলে যা ইন্দ্রিয়ের
ভাত-ঘুম ভাঙা!"

       এবং সেই ভাত-ঘুমটি ভাঙার প্রতীক্ষায় থাকা । শবরীর ।

       কবিতার হাত ধরে অমল আলোর মতো প্রেম আসে। অবশেষে । শরীরের । ভাতঘুম -ভাঙা । মেয়েটি সেই প্রেমকে যত্ন করে বসায় , হাতপাখা দিয়ে বাতাস করে, জল-বাতাসা দেয়, তারপর চুপিচুপি জানতে চায়,

"এমন রোদে বেড়িয়ে এলো শরীর
শরীর, তোমার কষ্ট হলো নাকি?
দু:খ ছিল একটা কানাকড়ির
তাও হারাবার একটুখানি বাকি!

শরীর, তুমি ওষ্ঠ ছুঁয়ে ছিলে
স্বর্গ থেকে এলো বেভুল হাওয়া
চক্ষু এবং নাভির স্পর্শে মিলে
যা পেলে তার নাম কি ছিল পাওয়া?"

       যৌবন বড় সুখের । আবার বড় দু:খেরও বটে! যৌবন যা দেয় এক হাতে , অন্য হাতে তার চতুর্গুণ আদায় করে নেয় । সময়ে সময়ে সে নিংড়ে নেয় বিশ্বাসের জল, মুছে দেয় নির্ভরতার ছায়া । খর রোদ্দুরে তখন শুধু জেগে থাকে প্রবঞ্চনা আর মিথ্যাচার । আর সেই একলা-যৌবনা নারী ভাবে,

" আমার যা ভালোবাসা , কাঙালের ভালোবাসা , এর কোনো মূল্য
আছে নাকি?
এ যেন জলের ঝারি , কেউ দেখা দেবে বলে হঠাৎ মিলিয়ে যায়
বাবলা কাঁটার ঝোপে
যেমন জোনাকি!"

       শরীরী সুখ টুপটাপ খসে যায় । কখনো কখনো । আকাশে গা বেয়ে ঝরে পড়া মৃত নক্ষত্রের মতো । সেই মেয়ে বড় হয়ে যায় । আয়নার সামনে আবারও । এভাবেই।
       যৌবনের অহনায় এ গল্পের শুরু । যৌবনের বিহানবেলায় এ গল্পের শেষ । সেই দুপুরবেলায় চোরের মতো চুপিসারে আসা কবি আর কবিতার অগুনতি পাতা মেয়েটির রক্ষণশীল মনের জানালার কপাট হা হা করে খুলে দিয়েছিল ; তাতে ঝলকে ঝলকে ভেসে এসেছিল সোনালি রোদ্দুর ...শরীরের রোদ্দুররেখা .....
       মেয়েটি রোদ্দুর চিনেছিল , মেয়েটি তাপ চিনেছিল , মেয়েটি আলোও চিনেছিল ।


      
বিহান থেকে শেষ বিকেলের আলো
.........................................................................

" রৌদ্রে এসে দাঁড়িয়েছে রৌদ্রের প্রতিমা
এ যেন আলোরই শস্য , দুপুরের অস্থির কুহক
অলিন্দে দাঁড়ানো মূর্তি ঢেকে দিল দু'চক্ষের সীমা
পথ চলতে থমকে গেল অপ্রতিভ অসংখ্য যুবক ।"

       বিহানবেলার আলো । সে আলো বড় নরম । তাতে শরীর মন ওম পায় , কিন্তু ঝলসে যায় না । সে আলোয় শরীরের যে ছায়াটি পড়ে , তা আবছা , ভাসা ভাসা ।মেয়েটি দাঁড়িয়ে থাকে সেই বিহানের আলো মেখে ।

" রোদ্দুর লেগেছে তার ঢেকে রাখা যৌবনের প্রতি কোণে কোণে
এ যেন নদীর মতো , নতুন দৃশ্যের শোভা প্রতি বাঁকে বাঁকে ..."

       এভাবেই সকাল-আলোতে যুবতী শরীর আঁকা থাকে!

       রোদ বাড়ে , তাপ বাড়ে , আলো বাড়ে । যৌবনের আকাশে ভরদুপুর । সূর্য যখন মাঝ আকাশে , দুপুরের ছায়া তখন ছোট ; কিন্তু তার সীমারেখাটি যেন খানিক বেশি স্পষ্ট । মেয়েটি কী যেন দেখে আকাশের দিকে চোখ চেয়ে .. "সুকুমার উদাস আঙুলে " ভিজে চুল আলতো জড়িয়ে ....। সে বলে ,

" মৌমাছির চাক ভেঙেছি , আমার চোখে মুখে
উড়ে বসলো কয়েক হাজার , সমস্ত বিষ বুকে
জমছে এসে , জ্বলে উঠলো অসীম মরুভূমি
হা-হা শব্দে বালি পুড়ছে , যদি পারতে তুমি
ছড়িয়ে দিতে বুকের বিষ আশিরপদনখে
আমি যেতাম সমুদ্রতীর , ঝলসে উঠতো চোখে
তীব্র নীল বাঁচার স্বাদ -- অন্ধকার জলে
আমি হয়ত ডুবে যেতাম আলোর কৌতূহলে ।"

       প্রেম আসে, প্রেম থাকে, প্রেম ঘন হয় । চুমুর অনেক রকমফের ; আলোর যেমন । সেই আলোতে সময়ে সময়ে অন্ধত্ব আসে । সে বড় সুখের জীবন । অন্ধজীবন ।

" অরুন্ধতি, সর্বস্ব আমার
হাঁ করো, আ- আলজিভ চুমু খাও, শব্দ হোক ব্রহ্মাণ্ড পাতালে
অরুন্ধতি, আলো হও, আলো করো , আলো আলো , অরুন্ধতি ..আলো --
চোখের টর্চলাইট নয়, বুকের আলো, অরুন্ধতি, লাইটহাউস হয়ে দাঁড়াবে না?"

       কবে কেউ তাকে বাতিঘর করে সাজাবে , সেই আশায় কন্যে বসে থাকে । গায়ে , মাথায় , মনে আগুন আগুন কত রোদ্দুর মেখে ।

"ঝড় দিসনে আকাশ সেই সুন্দরীর ঘরে
থিরথিরিয়ে কাঁপতে থাকুক ভীরু দীপের শিখা
আঁচল পেতে মাটিতে বুক চেপে থাক সে শুয়ে
একা ঘরের প্রতীক্ষিতা, আকাশ কনীনিকা ।"

       বাতিঘর । বাতিঘর । সে ঘরে অসংখ্য টুনিবাতি জ্বালিয়ে দেয় প্রেমিক পুরুষ । এবং অসহ্য আর্তিতে বলে,

"ঝড়ের রাত্রির মতো
কাছে এসো
যেমন নদীর গর্ভে গুমরে ওঠে নিদাঘের তোপ
প্রতিটি শিমুল বৃক্ষ সর্বাঙ্গে আগুন মেখে যেমন অস্থির
আমি প্রতীক্ষায় আছি

বৃষ্টির চাদর গায়ে, হালকা পায়ে, দিকবধূর মতো তুমি
এই দরদালানে একটু বসো
মুখের একদিকে আলো, অন্যদিকে বিচ্ছুরিত, উদ্ভাসিত কালো
ভুরুতে কিসের রেণু, নরম আঙুলে কোন অধরার লীলা
ওরে তোকে ভালো করে দেখি, কিছুই তো হলো না দেখা
সামান্য জীবনে
নির্লজ্জ শরীরবাদী এই লোকটা এখনো তোমায় ছোঁয়নি স্থাণুর শিকড়ে
দ্যাখো তার হাতে
হাঁসের পালকে লেখা বসন্ত প্রবাস!”

       তখনও ছায়ার রেখা পরিস্ফুট থাকে উঠোন জুড়ে । তখনও অনন্ত পরিক্রমা..কায়ার, ছায়ার ।

" তোমার পাশে, এবং তোমার ছায়ার পাশে
ঘুরে বেড়াই
তোমার পোষা কোকিল এবং তোমার মুখে
বিকেলবেলার রোদের পাশে ঘুরে বেড়াই
তোমার ঘুমের এবং তোমার যখন তখন অভিমানের
অর্থ খুঁজি অভিধানে
ঘুরে বেড়াই ঘুরে বেড়াই ......"

       যদিও তখন " দীঘির মতো শরীর তার , নরম জলে ভরা ", তবুও মেয়েটি দুপুর রোদে ক্লান্ত হয়ে পড়ে । শরীর আলো চায় , তাপ চায় ; সে তো ছায়াও চায়! সে ছটফট করে । এত পাওয়া , তবু যেন কত পাওয়া বাকি! সে কবিকে ডাক দেয় । এখন তো আর অচেনা নয় কবি , সে সটান ঢুকে আসে যখন তখন অন্দরমহলে, হাতে কবিতার খাতা নিয়ে । সে পাশে পাশে হাঁটে মেয়েটির , বইপাড়ার অলিতে গলিতে । মেয়েটি অনুযোগ জানায় ,

"আগুন এক এক সময় মুগ্ধ হয়ে দেখে আগুনেরই রূপ
শুধু আজও তেমন করে দেখতে পেলাম না ভালোবাসাকে
সমস্ত শরীর ছাপিয়ে তার এক পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা ।"

       মেয়েটির চোখে ছায়া পড়ে । জলে ছায়া পড়ে । থিরথির করে কাঁপে । সবসময় কি বিকেল গড়ালেই ছায়া ঘনিয়ে আসে । এ ছায়া অন্য ছায়া । এ ছায়া আসতে পারে বিহানবেলায়, আসতে পারে ভরদুপুরে, আসতে পারে যখন তখন । এ ছায়ার নাম ….ঘুমোবার মতো ভালোবাসা ।

      এ ছায়া আসে আলো মেখে । এ ছায়া আসে মাত্রই হয়ত বা একটিবার । সারা জীবনে । তখন কী অবলীলায় বলা যায় ,

"শরীর নাকি শরীর চায় , আমার কিছু মনে পড়ে না
মনে পড়ে না , মনে পড়ে না ..মেঘলা মতো বিচ্ছুরণ
যেমন পথ মুখ লুকিয়ে ভিখারিণীর কোলে ঘুমোয় .."

       সে বড় অদ্ভুত জীবন । কখনো মনে হয় আলো চাই, কখনও মন চায় ছায়া । এ সময়ে ছায়া আলো দেয় , আবার আলো দেয় ছায়া ।

"মানুষের মতো চোখ , বিস্ফোরণ , সমাধির মতো শূন্য প্রচ্ছন্ন কপাল
পদচুম্বনের মতো ভালোবাসা ভিতরে রয়েছে
ভালোবাসা তিনশো মাইল দূরে গিয়ে আলিঙ্গন করে
দূর থেকে ভালোবাসা দেখে যেতে লোভ হয়, শরীর লুকোতে চায়
জ্যোৎস্নালোকে, তবুও জ্যোৎস্নায়
স্পষ্ট ছায়া পড়ে এত স্পর্শকাতরতা ।"

       শরীর জাগে, শরীর ঘুমোয় , মন বসে থাকে অতন্দ্র প্রহরী হয়ে । যখন ..

"শরীর ছেলেমানুষ, তার কত টুকিটাকি লোভ
সব সাঙ্গ হলে পর, ঘুম আসবার আগে
নতুন টাকার মতন সরল নিরাবরণ
দুখানি শরীর
বিছানায় অবিন্যস্ত ।"

কিন্তু সেই আবছা ধূলিমলিন অন্ধকারে বড় " ইচ্ছে করে তোমার দু:খের সঙ্গে
আমার দু:খ মিশিয়ে আদর করি ।"

       কিংবা যেন অনেকটা

"তোমাকে যখন দেখি, তার চেয়ে বেশি দেখি
যখন দেখি না ...."

       এই ঘুমোবার মতো ভালবাসার সম্পর্ক অনেকটা যেন ওই অন্তরীপের মাটির মতো , যার পরে আর কিছুই নেই, কিচ্ছুটি নেই..শুধু জল ছাড়া ।

       তখন এক সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া..ছোট ছোট দু:খকথা , দমকা হাসি , আলটপকা মান-অভিমান , পা ছড়িয়ে বসে অভিযোগ অনুযোগের ঝাঁপি হাতড়ানো আর রোজ রোজ পুতুলের বাক্স গোছানোর মতো পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা টুকিটাকি ভালোবাসা । মনের সঙ্গে শরীর আসতেও পারে , নাও পারে । মনন বিনিময়তখন এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে শরীর তখন অনেক ক্ষেত্রেই সরব এবং অনিবার্য উপস্থিতি নিয়ে মনকে আড়াল করে সামনে এসে দাঁড়ায় না । আর সেই টুকিটাকিভালোবাসার জাফরিকাটা জানালা দিয়ে যখন সাদায় আর গোলাপীতে আলপনা আঁকা হয় মেঝে জুড়ে , তখন

" নি:শ্বাসে স্মৃতির সঙ্গ , চেতনার দিগন্ত ছাড়ালো
বারে বারে চমকে উঠি , কে এসেছে..গোধূলির আলো ।"

       সেই সম্পর্কের কথাই তো ভেবেছিল মেয়েটি । সেই সম্পর্ককে চিনেছিল কবির হাত ধরে , যে সম্পর্কের মহার্ঘতা তাকে দীর্ণ আর ক্ষতবিক্ষত করে নিয়ে যাবেআলোর দিকে । ছায়াময় সে আলো । মেয়েটি এখন আর পতনের ভয় পায় না । খাদের অতলতা তার শিরায় শিরায় ভয়ের কাঁপন জাগায় না । সে যে উড়তেশিখে গেছে !

       মেয়েটি দেখে রোদ্দুরও ছায়াকে কেমন শান্ত আর দীর্ঘতর করে । তীব্র বিদ্যুতের আলোয় ধাঁধিয়ে যায় তার চোখ , অথচ বজ্রের নির্ঘোষ থাকে নিরুচ্চার । রোদ্দুরমেখে বৃষ্টি নামে । সে চোখ বুজে দু'টি হাত বাড়িয়ে দেয় আকাশের দিকে । তার কানে কানে প্রেমিক পুরুষ নাকি কবি..কে যে তাকে ডেকে ডেকে বলে..

“তুমি ভয় পেও না, তুমি ঘুমোও, আমি বহুদূরে আছি
আমার ভয়ঙ্কর হাত তোমাকে ছোঁবে না, এই মধ্যরাত্রে
আমার অসম্ভব জেগে ওঠা, উষ্ণতা, তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও
চাপা আর্তরব তোমাকে ভয় দেখাবে না -- আমার সম্পূর্ণ আবেগ

শুধু মোমবাতির আলোর মতো ভদ্র হিম,
শব্দ ও অক্ষরের কবিতায়
তোমার শিয়রের কাছে যাবে -- এরা তোমাকে চুম্বন করলে
তুমি টের পাবে না , এরা তোমার সঙ্গে সারারাত শুয়ে থাকবে

এক বিছানায় -- তুমি জেগে উঠবে না , সকালবেলা তোমার পায়ের
কাছে মরা প্রজাপতির মতো এরা লুটোবে । এদের আত্মা
মিশে থাকবে তোমার শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে, চিরজীবনের মতো
বহুদিন পর তোমার সঙ্গে দেখা হলে ঝর্ণার জলের মতো
হেসে উঠবে , কিছুই না জেনে । নীরা , আমি তোমার অমন
সুন্দর মুখে বাঁকা টিপের দিকে চেয়ে থাকবো । আমি অন্য কথা বলার সময় তোমার প্রস্ফুটিত মুখখানি আদর করবো মনে মনে
ঘরভর্তি লোকের মধ্যেও আমি তোমার দিকে
নিজস্ব চোখে তাকাবো ।
তুমি জানতে পারবে না -- তোমার সম্পূর্ণ শরীরে মিশে আছে
আমার একটি অতি ব্যক্তিগত কবিতার প্রতিটি শব্দের আত্মা |’’

 

 

     লেখক পরিচিতি - ঈশানী । বিজ্ঞানের ছাত্রী । কিন্তু প্রথম ভালোবাসা সাহিত্য । তিন দশক ধরে ভাষান্তরের কাজে যুক্ত । বেশ কিছু অনূদিত বই প্রকাশিত হয়েছে সাহিত্য আকাদেমি, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট ইত্যাদি বিখ্যাত সংস্থা থেকে । ভাষান্তরের পাশাপাশি নিজস্ব লেখালেখির ঝোঁক । তবে খুব নিয়মিত নয় । ভালবাসেন টুকরো গদ্য, পদ্য লিখতে ।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।

 

 

louis vuitton outlet louis vuitton outlet louis vuitton outlet black infrared 6s louis vuitton outlet Cheap louis vuitton legend blue 11s jordan 11 legend blue jordan 6 sport blue beats by dre cheap black infrared 6s louis vuitton outlet jordan 6 sport blue retro jordans michael kors outlet cheap jordan shoes jordan 11 legend blue louis vuitton outlet black infrared 6s retro jordans jordan 6 louis vuitton outlet sport blue 6s louis vuitton outlet jordan 3 sport blue louis vuitton outlet coach outlet online coach outlet online sport blue 6s louis vuitton outlet jordan 3 sport blue legend blue 11s louis vuitton outlet jordan 11 louis vuitton outlet sport blue 6s kate spade outlet jordan 11 legend blue retro jordans louis vuitton outlet Lebron 11 louis vuitton outlet foamposites shooting stars michael kors outlet kate spade outlet Foamposites sport blue 6s louis vuitton outlet Louis Vuitton Outlet sport blue 6s michael kors outlet Michael Kors Outlet louis vuitton outlet Lebron 11 sport blue 3s sport blue 6s wolf grey 3s kate spade outlet louis vuitton outlet kate spade diper bag