“বাঙ্গালীর পুজো – গানে, পাঠে”!!

‘শতবর্ষ
পরে’
পল্লব
চট্টোপাধ্যায়
“আজি
হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি শুনিছ পূজার এ গানখানি, কৌতূহল ভরে” –
বা -“আজি তোমাদের ঘরে গাহিছে গান, সে কোন নূতন গায়ক, আজিকার শরতের
আনন্দ-অভিবাদন পাঠায়ে দিলাম তার করে” – না:, এইরকম কোন কবিতা লেখা
হয়নি ঠিকই। হতেও পারতো কারণ বাংলার গান তো শুরু থেকেই বাংলার কবিদের
হাত ধরেই রীতিমত সম্পদশালী হয়ে উঠেছে।
সম্প্রতি
শ্রীমতী হৈমন্তী শুক্লার একটি স্মৃতিচারণে পড়লাম যে পুজোর গান
নাকি শুরু হয় ১৯১৪ সালে, অর্থাৎ তা এ বছর শতবর্ষ ছুঁয়েছে। তার
প্রায় অর্ধেক সময় ধরে আমি সে চলার সাক্ষী, সেই যাত্রাপথের আনন্দগানের
অনেক সুন্দর মুহূর্তই গভীর ভাবে ‘দাগ দিয়েছে মর্মে আমার গো,‘ তাই
লিখে জানাচ্ছি।
ছোটবেলা থেকেই দুর্গাপূজা বলতেই বুঝতাম নতুন জামা, নতুন জুতো,
ঘুরে ঘুরে পাড়ায় পাড়ায় পুজো দেখা আর অনেক, অনেক আনন্দ। প্যান্ডেলে
প্যান্ডেলে মাইকে গান বাজত, সেগুলোর দিকে মন দেবার অবসর, বা আগ্রহ
তখনও ঠিক গড়ে ওঠেনি। বিহারে মানুষ হয়েছি, যদিও সেই আধা শহরে তখন
প্রায় এক চতুর্থাংশ বাঙালী, হিন্দি গানই কানে আসত বেশী। বন্ধুরা
বিনাকা গীতমালা আর বিবিধ ভারতী শুনে কিশোর আর রফির নকল করত, আর
অবচেতনেই সেগুলো কখনও-সখনও গুনগুন করে উঠতাম। ইতিমধ্যে বাড়িতে
এলো গ্রামোফোন আর বাবার পছন্দের দুই গায়ক-গায়িকা হেমন্ত-সন্ধ্যার
রেকর্ড আমি এমুহূর্তেই একসাথে ভেঙে বিখ্যাত হয়ে গেলাম। গানদুটি
ছিল-‘অলির কথা শুনে বকুল হাসে’ আর তার উল্টোপিঠে ‘মায়াবতী মেঘে
এলো তন্দ্রা’- যুগলের এল-পি’র প্রথম দুটি গান! ভাগ্যিস অন্য গানগুলোর
কোনও ক্ষতি হয়নি, নয়ত সুরের সাথে পরিচয় হতে আমার অনেক দেরী হয়ে
যেত। সেই প্রথম শোনা হেমন্ত ও সন্ধ্যার কণ্ঠের গানদুটি আজও স্মৃতিতে
অমলিন –
অলির
কথা শুনে বকুল হাসে
মায়াবতী
মেঘে এলো তন্দ্রা
তখনও
জানতাম না পুজোর গান কাকে বলে। দেওয়ালির আগে স্কুল খুলেছে, দেখি
আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয় ভজু টিফিনে টেবিল বাজিয়ে গাইছে-‘মনে
পড়ে রুবি রায়’। আমি আবার বোকার মত শুধলাম, এই রুবি রায় কে রে,
তোদের পাড়ায় থাকে? সাথে সাথে সবার অট্টহাস্য। তার পরের পনের মিনিটে
ভজুর লেকচারে আমার মনের একটা আজন্ম বন্ধ রাখা জানলা যেন খুলে গেল।
জানলাম ওটা সে
বছরের
(১৯৬৯) রাহুলদেব বর্মণের পুজোর গান, নিজেই গেয়েছেন। আরও বড় হয়ে
জানলাম রুবি রায় কোনও একজন মেয়ে নয়, কিশোর ছেলেদের হার্টবীট বাড়াতে
তারা ছড়িয়ে আছে পাড়ায় পাড়ায়, প্রতি গ্রামে, প্রতিটি শহরে। আর-ডি
বর্মণ হলেন সেই আলাদীন যিনি তাঁর জাদুর চেরাগ দিয়ে রুবি রায়দের
ঠিকানা সকলকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। কৌতূহলী পাঠক-শ্রোতাদের সে ঠিকানা
জানিয়ে দিই, কেমন!
মনে
পড়ে রুবি রায়
তখন
থেকেই বন্ধুদের মত আমিও রাহুল দেবের ফ্যান। তখন বাংলায় ফিল্মি
গানে আর-ডির দেখা পাওয়া যেত কম, তিনি বোম্বাইয়ে। তাই প্রতি বছর
অপেক্ষায় থাকতাম এবার পুজোয় রাহুলের সুরে কে কি গাইছেন, অবশ্য
গায়ক বেশীরভাগই হতেন আশা, কিশোর বা স্বয়ং রাহুল। ধীরে ধীরে মনের
মণিকোঠায় সঞ্চিত হতে থাকল অবিস্মরণীয় গানগুলি- কিশোরের ‘একদিন
পাখি উড়ে যাবে’(গৌরীপ্রসন্ন), ‘সে তো এলনা’, ‘চলেছি একা’, ‘আকাশ
কেন ডাকে’ (মুকুল দত্ত), আশা ভোঁসলের ‘যেতে দাও আমায়’, ‘চোখে চোখে
কথা বল’, ‘ফুলে গন্ধ নেই’, ‘মহুয়ায় জমেছে আজ’, ‘লক্ষ্মীটি দোহাই
তোমার’, ‘না, এখনই নয়’, ‘ময়না বল তুমি’, (গৌরী); ‘হায় গো আমার
মন মানে না’, ‘সন্ধ্যাবেলায় তুমি আমি’, ‘কিনে দে রেশমি চুড়ি’,
রাহুলদেবের নিজের কণ্ঠে ‘মনে পড়ে রুবি রায়’, ‘ফিরে এসো অনুরাধা’,
‘স্বপ্ন আমার হারিয়ে গেছে’ (শচীন ভৌমিক), ‘যেতে যেতে পথে হল দেরী’(গৌরী),
‘বলও কি আছে গো’, ‘শোনো মন বলি তোমায়’, ‘অ-এ অজগর আসছে তেড়ে’ (স্বপন),
রাহুল-আশা জুটির ‘একটু আরো নয়’(গৌরী), ‘দেখ গো এনেছি টাঙ্গাইল
শাড়ী’ (স্বপন)। তাছাড়া কিশোর-পুত্র অমিতেরও রাহুলের সুরে দু-একটি
পুজোর গান সেসময় আমাদের পছন্দের তালিকায় ছিল। তবু বলব, ৬৮ থেকে
৭৬ ছিল পঞ্চমদার গানের স্বর্ণযুগ। ৮০র পর থেকে তিনি যেন সংগীতের
দুনিয়া থেকেই হারিয়ে গেলেন। শেষ মনে পড়ে আশার গাওয়া ‘দুর্গে দুর্গে
দুর্গতিনাশিনী’(১৯৮৮ পুজোর গান, কথা- স্বপন চক্রবর্তী) যার মধ্যে
সেই অকৃত্রিম রাহুলের ছোঁয়া ছিল, (দুর্গে
দুর্গে দুর্গতি নাশিনী) তারপর নিভে যাওয়ার আগে একবার দপ করে
জ্বলে উঠেছিলেন ৯১-৯২ তে, বাংলা ‘শ্বেতপাথরের থালা’ ও কিংবদন্তী-সমান
‘১৯৪২- এ লাভ স্টোরি’ র গানে সুর দিয়ে।
সঙ্গীত
পরিচালকদের কথা বলতে গেলে সত্যি কথা বলতে হয়, সেকালের রাইচাঁদ
বড়াল, শচীন দেব বর্মণ , কমল দাশগুপ্ত, সুরসাগর হিমাংশু দত্ত, সুধীন
দাশগুপ্ত, অনিল বাগচী, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবীর মজুমদার-
এঁদের নামই শুনেছি বড় হবার পর। এমনকি সলিল চৌধুরীরও সোনার দিনগুলো
তখন দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে যখন হেমন্ত, লতা আর সবিতা চৌধুরী ওঁর
একটার পর একটা ক্লাসিক রেকর্ড করে গেছেন- আর তার বেশীরভাগই ‘নোবল্
মেটালে’র মতই সুরের আকাশে স্পটলেস শুকতারা হয়ে জ্বলছে। ‘রানার’,
‘গাঁয়ের বধূ’, ‘পাল্কীর গান’, ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’, ‘অবাক পৃথিবী’,
‘না যেয়োনা’, ‘ওগো আর কিছু তো নাই’, ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘নিশিদিন
নিশিদিন বাজে’, ‘না, মন মানে না’, ‘ওই ঝিলমিল ঝাউএর বনের ঝিকিমিকি’,
‘এনে দে এনে দে ঝুমকা’, ‘লাগে
দোল পাতায় পাতায়’, ‘বৌ কথা কও বলে’ এবং আরো অনেক ।
আগেই জানিয়েছি, সচেতনভাবে পুজোর গান শোনা শুরু সেই ৬৯-এ, সেবার
যখন, শচীন ভৌমিকের কথায় আর পঞ্চমদার সুর ও কণ্ঠে, “রুবি রায়” বাঙলার
যুবকদের মনে চিরন্তনী হয়ে অধিষ্ঠান করতে শুরু করলেন । তখন শ্রী
পঙ্কজ মল্লিক খ্যাতির শীর্ষে, রবীন্দ্রসংগীত ও আধুনিক, এমনকি রাগপ্রধান
ও গজলেও সমান স্বচ্ছন্দ ও জনপ্রিয়। আমাদের পুজোও তাই শুরু হত মহালয়ার
ঊষালগ্নে বাণীকুমার- বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র- পঙ্কজ মল্লিক-হেমন্ত-
দ্বিজেন-নির্মলা-প্রতিমা-সন্ধ্যা-শ্যামল-মানবেন্দ্র-আরতি-উৎপলা
ইত্যাদিদের পরিবেশিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ সঙ্গীতালেখ্য দিয়ে। এ ছাড়া
আর কিছু তখন কেন, আজও ভাবতে পারি না।
আমার
স্মৃতির এক্তিয়ারের বাইরে হলেও সেই প্রথম পুজোর গানের সম্বন্ধে
কিছু আহরিত তথ্য পরিবেশন করার লোভ সামলাতে পারছি না। তাই জানাই
যে ১৯১৪র দুর্গোৎসবের প্রথমে ‘শারদীয়া’ ও তার অব্যবহিত পরেই ‘শারদাবলি’
নামে ৭৮ RPM disc এর দুটি সিরিজ বার করেন তৎকালীন গ্রামোফোন কোম্পানি
যাতে মানদাসুন্দরী দাসীর, নারায়ণ চন্দ্র মুখার্জি ও কে মল্লিকের
কণ্ঠে দুটি করে গান ছিল। যথাক্রমে—'এস এস বলে রসিক নেয়ে' ও 'আর
সুন্দর না’, 'দেখো লো সজনী আসে', 'ও মা ত্রিনয়নী যেয়ো না, যেয়ো
না', 'গিরি এ কি তব বিবেচনা’ ও 'কি হবে, কি হবে উমা চলে যাবে’।
‘শারদাবলি’ নামে যে তেরটি রেকর্ড বেরোয় যাতে ১১ জনের কণ্ঠ ছিল।
এখানে উল্লেখনীয় যে গায়ক কে মল্লিকের পুরো নাম মোহম্মদ কাসেম মল্লিক
কখনও ছাপা হত না, সম্ভবত: আগমনী গানে তাঁর মুসলমান পরিচয় আড়াল
করার জন্যে। আরো জানাই যে এই গায়িকাদের মধ্যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের
ভগ্নী অমলা দাশও ছিলেন, যিনি সম্ভবত: এলিট বাঙালী পরিবার থেকে
আসা প্রথম রেকর্ড-গায়িকা।
তবে যাই হোক, সত্তর দশকের পুজোর গান শুধু আমার সুর-চেতনার উন্মেষের
প্রথম ‘সোনার কাঠি’ বলেই নয়, অমর হয়ে আছে বাংলা গানের স্বর্ণযুগের
সাক্ষী হয়েও। পঙ্কজ ম্লান হলেও স্তিমিত হন নি, হেমন্ত খ্যাতির
শীর্ষে, আভাসচন্দ্র ওরফে কিশোরকুমার গাঙ্গুলি বোম্বাই মাতাচ্ছেন
আর মাঝে মাঝে কলকাতাও। বাঙালী সঙ্গীতরসিকদের আরেক নয়নের মণি প্রবোধ
তখন বোম্বে জয় করে বাঙ্গালি-শ্রোতাদের হৃদয় জয় করে ফেলেছেন প্রায়
দুই দশক ধরে। আজ্ঞে হ্যাঁ, কিম্বদন্তী-প্রতিম অন্ধ গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র
দে’র ভাইপো মান্না দের কথাই বলছি।
বঙ্কিম
ঘোষের লেখা ‘এই পারে আমি আর ওই পারে তুমি’ আর শ্যামল গুপ্তের কোথায়
‘ও আমার মন যমুনার অঙ্গে অঙ্গে’ নিজের সুরে গেয়ে বাঙালির হৃদয়ের
সিংহদুয়ার দিয়ে ঢুকে অন্তঃপুরে নিজের স্থান পাকা করে নিয়েছেন।
তখন কি একেকজন গীতিকার ছিলেন। সুধীন দাশগুপ্তের কথায় ও সুরে ‘চার
দেওয়ালের মধ্যে নানার দৃশ্যকে’, পুলকের কথায় মান্নার গাওয়া ‘সেই
তো আবার কাছে এলে’, আবার হবে তো দেখা’, এই তো সেদিন তুমি’, ‘আমি
তার ঠিকানা রাখিনি’ শুনে হৃদয়স্থ করে ফেলেছি, ইতিমধ্যে ৬৯ সালের
পুজোয় পঞ্চমদার রুবি রায়ের হাত ধরে এসে পড়ল- ‘ও ললিতা, ওকে আজ
চলে যেতে বলনা’ আর ‘রঙ্গিণী কত মন দিতে চায়’। তারপর বছরের পর বছর
ধরে চলতে লাগলো কথা, সুর আর গলার – কম্পিটিশন নয়, সার্থক কম্বিনেশনের
ম্যাজিক, একের পর এক, ৭০-এ ‘এ তো রাগ নয়’ ও ‘সুন্দরী গো, দোহাই
দোহাই’, ৭১-এ পুলকের কথা ও নচিকেতার সুরে ‘আকাশ পানে চেয়ে চেয়ে’
ও ‘ক’ফোঁটা
চোখের জল ফেলেছ’ তো আজ ইতিহাস । ৭২-এ ‘আজ আবার সেই পথে’, ‘অপবাদ
হোক না আরো’, ৭৩-এ ‘বেশ তো, তাই হোক’, ‘কথা দাও, আবার আসবে’ ৭৪-এ
নচিকেতার EPতে চারটে গান- ‘তুমি একজনই শুধু বন্ধু আমার’, যদি কাগজে
লেখো নাম’, ওগো বরষা তুমি’, ও ‘আমার ভালবাসার রাজপ্রাসাদে’- সবগুলি
হিট, কত আর নাম করব! ৭৭ সালের পুজোয় তিনি একটি ই-পি করেন কাকা
কৃষ্ণচন্দ্রের গাওয়া চারটি গানের শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়ে, জলধর চট্টোপাধ্যায়ের
কথায় ‘স্বপন যদি মধুর এমন’, হেমেন রায়ের ‘অন্ধকারের অন্তরেতে অশ্রুবাদল
ঝরে’ ও ডি-এল রায়ের ‘ঘনতমসাবৃত অম্বর-ধরণী’ ও ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার
থেকে’। কৃষ্ণচন্দ্রের কণ্ঠে একবার গানটি শুনুন-
ঐ
মহাসিন্ধুর ওপার থেকে
সেই সত্তরের দশকে হেমন্ত-মান্না-শ্যামল-সন্ধ্যা-লতা-কিশোর-আশা-রাহুল
এঁরা তো মাতিয়ে রেখেছিলেনই ও তাঁদের রশ্মিচ্ছটায় অসামান্য কিছু
গায়ক-গায়িকা তখন তাঁদের ফ্যান-ফলোয়ারদের একটা নির্দিষ্ট গণ্ডিই
পেয়েছিলেন, অথচ নিজ-নিজ ক্ষেত্রে কেউ কারো থেকে কম যেতেন না। কয়েকজনের
নাম করছি- জগন্ময় মিত্র, ধনঞ্জয়, সনৎ সিংহ, মানবেন্দ্র, তরুণ,
সুবীর সেন, তালাত মামুদ, সতীনাথ, মৃণাল, জটিলেশ্বর, অনুপ ঘোষাল,
অংশুমান, গীতা রায় (দত্ত), আরতি, প্রতিমা, নির্মলা, হৈমন্তী, উৎপলা,
সবিতা চৌধুরী, জপমালা ঘোষ, সুপ্রীতি ঘোষ ইত্যাদি প্রত্যেকেই স্বনামধন্য,
তবু বলব, এঁরা নিজেদেরকে একটা সীমার মধ্যে কমবেশি আবদ্ধ রেখেছেন,
ফলে প্রতিভা ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তা কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
আবার যখন সুযোগ পেয়েছেন নিজেকে ছাড়িয়ে গিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।
একটা উদাহরণ দিচ্ছি। তখন গীতিকার শ্যামল গুপ্ত ও গায়িকা সন্ধ্যা
মুখোপাধ্যায়ের মধ্যে গভীর প্রেমপর্ব চলছে, অথচ অভিভাবকদের আপত্তিতে
(এটা তখনও ছিল!) এগোতে পারছেন না কেউই। তাই শ্যামল গানে গানে তাঁর
মনের কথা জানিয়ে যাচ্ছেন শ্যামল মিত্র, মান্না, মানবেন্দ্রদের
গলায় একটার পর একটা প্রেমের গান বসিয়ে। মানবেন্দ্র চিরকালই খ্যাত
(বা কুখ্যাত) ছিলেন তাঁর গলার অতিরিক্ত সূক্ষ্ম কাজের জন্যে, একটা
সাদামাটা গানকেও তিনি সরগম-মীড়-গমক-তারানা-তানে ভরিয়ে দিতেন। অথচ
শ্যামল গুপ্ত ঠিক করে ফেলেছেন ‘আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি’ গানটি
কোনও অতিরিক্ত কারুকার্য ছাড়াই মানবেন্দ্রকেই গাইতে হবে যাতে মনের
একান্ত আর্তিটি তিনি সহজ-সরল ভাবে যথাস্থানে পৌঁছে দিতে পারেন।
এবং কি অসাধারণ তিনি গাইলেন! এ গানটিও সৃষ্টি করল জনপ্রিয়তার একটি
নতুন ইতিহাস। চাইলে গানটি আমরা শুনে দেখতে পারি -
আমি
এত যে তোমায় ভালবেসেছি
প্রবন্ধের
এই ছোট পরিসরে শতবর্ষের সম্ভারের অগুনতি পুজোর গান আর তাদের স্রষ্টা
বা গায়ক-গায়িকাদের কথা আলোচনা করা যাবে না। আমি কিন্তু ভালবাসতাম
প্রায় তেমন প্রত্যেকেরই গান যার মধ্যে কিছুটা অন্তত: মৌলিকতা আছে
আর সেভাবেই যেন অল্প-কথায় তাঁদেরকে চিহ্নিত করেছিলাম। যেমন মধুকণ্ঠে
সুরের উৎক্ষেপণ- হেমন্ত, দ্বিজেন; দরদী গায়ক- মান্না দে, ধনঞ্জয়;
অসাধারণ গলার কাজ- মানবেন্দ্র, অনায়াস গায়ন-ভঙ্গী-ভূপেন হাজারিকা;
সুমিষ্ট গলা- শ্যামল, প্রতিমা; বলিষ্ঠ ও সাবলীল- কিশোর, লতা, আরতি,
তরুণ, সবিতা; মাদকতা-পূর্ণ- আশা, গীতা দত্ত, জটিলেশ্বর, গলায় তবলা
বাঁধা- শচীন কত্তা, গলা যেন সেতার- সন্ধ্যা । সুরকার? সেই স্বর্ণযুগে
যারই
নাম করি মহাকাব্য রচিত হয়ে যাবে। নজরুলোত্তর যুগে সলিল চৌধুরীর
জীবনই তো এক ইতিহাস- একাধারে কবি, সুরকার ও বিপ্লবী। গায়ক সলিলকে
তো আমরা চিনলাম বহু পরে। পঙ্কজ-শচীন-হেমন্ত-মান্না –ভূপেন-শ্যামল-
রাহুল এঁরা একাধারে সফল সুরকার ও গায়ক। নচিকেতা ঘোষ-সুধীন দাশগুপ্ত-রবীন
চট্টোপাধ্যায়-অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়- অজয় দাস-প্রবীর মজুমদার-প্রভাস
দে- অনিল বাগচী ও নচি-পুত্র সুপর্ণকান্তি, এঁরা প্রত্যেকেই সুরের
জগতের দিকপাল। আর গীত রচনায় প্রবাদপ্রতিম সলিল চৌধুরী এবং শিবদাস-শ্যামল
গুপ্ত-মিল্টু ঘোষ তো ছিলেনই, এছাড়া পরস্পর এক সুস্থ প্রতিযোগিতায়
গানের কথাগুলিকে সমৃদ্ধতর করে চলেছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ও
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। এঁদের বিখ্যাত গানগুলির জন্মমুহূর্তেরও রয়েছে
কত না বিচিত্র উপাখ্যান। সৌভাগ্যক্রমে তার একটি ঘটেছিল আমারই বাল্যের
শহর সিন্দ্রীতে, ১৯৭৫-এ মান্না দে আর পুলক আসছেন একটি অনুষ্ঠানে
যোগ দিতে, উঠবেন ভায়রাভাই গৌরীসাধন মুখার্জীর বাসায়। সার কারখানার
কোয়ার্টার্স সব একইরকম, ভুল করে পুলক একটি বাড়ীতে করাঘাত করতেই
এক অপরূপা সুন্দরী মহিলা দরজা খুলে বলেন, না এটা সে বাড়ী নয়। পরক্ষণেই
ছুটতে ছুটতে গাড়িতে এসেই পুলক বললেন, একটা গানের জন্ম হল-
‘ও
কেন এত সুন্দরী হল? এমনি করে ফিরে তাকালো! দেখে তো আমি মুগ্ধ
হবই, আমি তো মানুষ!’
তবু
যেন ‘এ জীবনে মিটিল না সাধ’। মান্না দে কথায় কথায় পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে
বলছিলেন রবীন্দ্রনাথের গানের বাণীর ভাষা ও আবেদন সম্পর্কে। বলছেন-
‘লেখার
কয়েক লাইন পড়তে না পড়তেই চোখের সামনে দেখতে পাবেন সে দৃশ্যটা।
আমি যখনই গাই- নাই, রস নাই, দারুণ দহনবেলা- তখন যেন সেই রোদে
পোড়া গরমের একটা হলকা হাওয়া এসে গায়ে লাগে। আবার যখন গাই বা
শুনি- শ্রাবণের গগনের
গায়- মনে হয়, সেই শ্রাবণের বাদলধারার একটা ভিজে বাতাসের ছোঁয়া
পাচ্ছি দেহে, মনে।‘
পুলককে
উনি সেদিন বেশ একটা ভাবনার খোরাক দিয়েছিলেন সেদিন। তার কদিন পরে
পুলক জানালেন,
‘মান্নাদা,
সারা বছরের ছয়টি ঋতুর জন্য আমি ছয়টি গান লিখেছি। না, আমি জানি
রবীন্দ্রনাথের দূরতম সীমানাতেও আমার যাওয়ার কোনও ক্ষমতা নেই।
তবে এই গানগুলি আমি ভাল করে চিন্তাভাবনা করেই লিখেছি। অনেক ভাবনা-চিন্তা
করেই শব্দচয়ন করেছি। মনে হয় আপনার পছন্দ হবে।‘
তারপর
আরেক ইতিহাস তৈরি হল প্রভাস দে’র সুরে ও জারিন দারুওয়ালার অতুলনীয়
সরোদের সঙ্গতে গানদুটি- ‘প্রখর দহন অতি দীর্ঘ দগ্ধ দিন’ (গ্রীষ্ম)
ও ‘গহন মেঘের ছায়া ঘনায়ে সে আসে’- (বর্ষা)। আরো চারটি গান ছিল
আরো চার ঋতুর । পুজোতে বৃষ্টি চাই না, কিন্তু বর্ষার সে অপূর্ব
গানটি শোনার লোভ সম্বরণ করা কঠিন –
গহন
মেঘের ছায়া
আমার
মনে হয় সে যুগের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল যোগ্যের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা
রেখে সততা ও নিষ্ঠাপূর্বক নিজের কাজ করে যাওয়া, বিশ্ব-বন্দিত ব্যক্তিদের
তুড়ি মেরে বা ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া নয়, যার ফলে সে যুগ শুধু আমাদের
বয়সী প্রৌঢ়দের স্মৃতিতেই নয়, যারাই রবীন্দ্র-নজরুলোত্তর যুগের
বাংলা গানকে ভালবাসতে শুরু করে, এই দশকে একবার থমকে থামবেই, মধু-কবির
সেই অমোঘ epitaph-এর মতই-
‘দাঁড়াও
পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে
তিষ্ঠ ক্ষণকাল!’
পরক্ষণেই
উতলা ‘চিত্ত পিপাসিত গীতিসুধার তরে’ আবার ধেয়ে চলে রবীন্দ্র গীতি-সম্ভারের
সুধা-সমুদ্রের দিকে, সে শুধু ডেকে বলে-
‘মোর দানে
নেই দীনতার লেশ
যত নেবে তুমি না পাবে শেষ।
আমার দিনের সকল নিমেষ
ভরা অশেষের ধনে!’
লেখক
পরিচিতি - পল্লব চট্টোপাধ্যায় - জন্ম ও বেড়ে ওঠা বিহার (অধুনা
ঝাড়খন্ডের) ধানবাদ কয়লাখনি ও শিল্পাঞ্চলে, সেখানে 'নানা জাতি,
নানা মত, নানা পরিধান' হলেও বাংলা ও বাঙালিদের প্রাধান্য ছিল একসময়।
১৯৮২ সালে রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং
পাস করে পেট্রোলিয়াম লাইনে চাকুরী, বর্তমানে কুয়েত অয়েল কোম্পানিতে
কর্মরত। শখ-গান-বাজনা আর একটু-আধটু বাংলাতে লেখালেখি। কিছু লেখা
ওয়েব ম্যাগাজিনে (ইচ্ছামতী, আদরের নৌকো ও অবসর) প্রকাশিত ।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর
ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর
নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।