আমাদের
এখানে আমেরিকায় দুর্গাপুজোটা আসলে ঠিক কেমন?
-এক-
ষষ্ঠী: বোধন
অনেকে
আমাকে জিগ্যেস করেন। আমার কলকাতা ও ভারতবর্ষে ফেলে আসা বন্ধু-পরিজন,
ছাত্র-ছাত্রী, এরা সব। আজকাল ফেসবুকের কল্যাণে বহু পুরোনো বন্ধুর
সঙ্গে আবার যোগাযোগ হয়েছে অনেক বছর পর। আবার আমার ভাই, বোন, ভাইপো-ভাইঝি
ইত্যাদিরাও অনেকে ফেসবুকে জয়েন করেছে। এরা অনেকেই আমাকে ও আমার
ফ্যামিলিকে পুজোর সময়ে দেখতে পায়না। তাদের প্রশ্ন, এখানে পুজোতে
আমরা কেমন আনন্দ করি। হইচই করি, এই সব।
আমার
এই পঁচিশ-প্লাস আমেরিকার জীবনে প্রথম এক দশক কেটেছিল জনবিরল অঞ্চলে।
সেন্ট্রাল ইলিনয়, সাদার্ণ ইলিনয়, আর তারপর আপস্টেট নিউ ইয়র্ক'এর
অলবানি। প্রথম দুটো জায়গায় থাকার সময় পুজো বোঝার কোনো উপায় ছিল
না। আমার মনে আছে, লক্ষ্মী পুজোর রাতে আমি আমার স্টুডেন্ট এপার্টমেন্ট'এর
সামনে ঝাউগাছের ওপর পূর্ণিমার চাঁদ দেখছিলাম, আর ভাবছিলাম এই সময়ে
কলকাতায় লোকজন হই হই করছে। দুর্গাপুজো কেটে যেত বছরের পর বছর।
আমি কলকাতায় পুজোর দিনগুলোতে ফোন করে পাড়ার প্যান্ডেলে ঢাকের আওয়াজ
শুনতাম।
প্রথম
দুর্গাপুজো দেখি তিন বছর পর। সাদার্ণ ইলিনয় কার্বনডেলে থাকার সময়ে
রত্না সিনহা, যে এখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট
ডীন, সে তার ফ্যামিলি'র সঙ্গে আমাদের নিয়ে গেল একশ মাইল দূরে সেন্ট
লুইসের পূজো দেখাতে। সে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। আর, ঢেঁকি স্বর্গে
গিয়ে যেমন ধান ভানে, আমিও সেখানে গিয়ে কয়েকজনকে জুটিয়ে নিয়ে মনের
আনন্দে গান'টান গেয়ে এলাম। তারপর ওখানে পর পর তিন-চারবার গেছি।
অনেক বন্ধুও হয়ে গিয়েছিল সেখানে। গান খুব গাইতাম। একবার গেলাম
ন্যাশভিলে পুজো দেখতে, আর গান গাইতে।
একবার
গেলাম তিনশো মাইল গাড়ি চালিয়ে শিকাগো। তখন আমাদের একটা গাড়ি হয়েছে।
সেটা মাঝে মাঝেই খারাপ হয়ে যায়, কিন্তু তাও গাড়ি। নিজের গাড়ি।
কলকাতায় নিজের গাড়ি বলতে ছিল ৩৩ নম্বর বাস। ১১'র এ। বা, গ্যালিফ
স্ট্রিট যাবার ট্রাম। এখানে সত্যি সত্যি নিজের গাড়ি হলো। সেই গাড়ি
চালিয়ে সেন্ট লুইস। শিকাগো। ন্যাশভিল। যাকে বলে আমেরিকান ড্রিম।
-দুই-
সপ্তমী:
বোধোদয়
প্রথম
ইউফোরিয়া কেটে যাবার পর একটু ভাবতে শুরু করলাম। প্রথমেই যেটা দেখলাম
সেটা হলো, উইকএন্ডে পূজো। আসল পূজো হয়তো হয়ে গেছে, কিংবা এখনো
আসেই নি। কিন্তু পূজো হচ্ছে সেন্ট লুইস বা ন্যাশভিল বা অলবানি'তে।
এ আবার কেমন পুজো-রে বাবা? কই,
খ্রীষ্টান বা জু (ইহুদি) বা মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ তো এমনভাবে
শুধু চাকরি বাঁচিয়ে, চুপচাপ কারুকে না জানিয়ে নিজেদের ধর্ম পালন
করেন না। তাহলে, আমরা এরকম কেন? কেন আমরা যেদিন আমাদের পুজো, সেদিনকেই
করতে পারব না? ছুটিও তো নেওয়া যায়। কেন নিতে পারবনা? কেন আমাদের
চারদিনের দুর্গাপূজো শনিবার পুরো দিন আর রবিবার অর্ধেক দিনের মধ্যেই
শেষ করতে হবে?
যখন
ছাত্রজীবন শেষ করে (আমার আবার তিনটে ছাত্রজীবন হয়েছে -- প্রথমটা
কলকাতায়, দ্বিতীয়টা ইলিনয়'এ, আর তৃতীয়টা নিউ ইয়র্ক'এ -- আমি এখানে
দ্বিতীয়টির কথা বলছি) পোস্টডক্টরাল কাজ নিয়ে নিউ ইয়র্ক'এর হাড়-হিমকরা
অলবানি শহরে গিয়ে হাজির হলাম, তখন ঢেঁকির কাজ হলো নতুন ধান ভানা।
অর্থাৎ, দু এক বছর সেখানে থাকার পরই নির্বাচনে দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্ট
হলাম সেখানকার ছোট্ট বাঙালি সংগঠনে। ভাববেন না, কাজটা খুব সহজ
ছিল। আমি কোথাকার কে হরিদাস পাল, সবে এসেছি কোন গ্রাম থেকে, এবং
না আছে আমার নিজের বাড়ি, আর না আছে আমার মার্সিডিজ বা লেক্সাস।
নিদেন পক্ষে একটা টয়োটা বা হন্ডা। বা, নিজের সুইমিং পুল। বাড়িই
নেই নিজের, তা আবার সুইমিং পুল। এই অর্বাচীন আমি কিনা প্রেসিডেন্ট
হতে চাইছি এই সব ধনী বাঙালিদের ক্লাবের? কী স্পর্ধা!
এই
নিয়ে আমাদের বাঙালি এসোসিয়েশন ভেঙ্গেই গেল। আমার মনে আছে, তিরিশটা
ফ্যামিলির ষোলো ভোট আমি পেয়েছিলাম, আর চোদ্দ ভোট পেয়েছিলেন আমার
প্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁরা অনেকেই আমাদের পরবর্তী কয়েক বছরের সব অনুষ্ঠান
বয়কট করলেন, আর আলাদা পূজো করলেন। অবশ্য, বলতে বাধা নেই এখন, তাঁরা
অনেকেই অলবানির এখনকার পুজোতে আবার ফিরে এসেছেন, এবং সব চেয়ে বড়
কথা, এঁদের মধ্যে কয়েকজন আমার কাছে এসে, আমাদের কাছে এসে তাঁদের
সেই সময়কার কাজের জন্যে অনুশোচনা প্রকাশ করে গেছেন। মনের জ্বালাটা
একটু জুড়িয়েছে তাঁদের কথায়। আমরা তাই এখনও পুজোতে অলবানি যাই।
পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়। তাঁদের বাড়ি থাকি। খুব ভালো লাগে।
তা,
সে যাই হোক, দুর্গাপূজো আমেরিকার অধিকাংশ জায়গাতেই হয়না। এবং,
যেখানে হয়, তার মধ্যে ছোট ছোট জায়গায় এইভাবে উইকএন্ডে পূজো হয়।
সেখানে-যে আনন্দ হয়না, হইহই হয়না, তা নয়। খুব আনন্দ হয়। কারণ,
বাঙালি আনন্দ করতে খুব ভালবাসে। গান হয়, নাটক হয়, অনেক কিছু হয়।
আমরা অলবানিতে থাকার সময় প্রত্যেক বছর নববর্ষ-কাম-রবীন্দ্র জয়ন্তী'তে
একটা বড় প্রোগ্রাম করেছি, তাতে গান গেয়েছি, বাচ্চাদের দিয়ে প্রোগ্রাম
করিয়েছি, নাটক করেছি। পুজোর প্রোগ্রামেও তাই করেছি। তখন আমরা সব
কিছু করতাম বাংলাতে। শুধু নন-বেঙ্গলি যাঁরা আসতেন, তাঁদের কথা
ভেবে অনুষ্ঠানগুলো ঘোষণা করতাম দুটো ভাষায়। এমনকি, ইয়ং জেনারেশন'এর
জন্যে নিউসলেটার'ও প্রকাশ করেছি দুটো ভাষায়।
আজকের বলিউড হিন্দির মত এত বাড়াবাড়ি তখনো হয় নি। কিন্তু, পুজো
তিথি-নক্ষত্র মেনে করার ব্যাপারে কারুকে রাজি করাতে পারিনি। আর,
বাইরের কারুকে ডাকা, মার্কিন নরনারীকে আমাদের পুজোতে আমন্ত্রণ
জানানো, বা মিডিয়াকে ডাকা, এসব ব্যাপারে সবাইকে আশ্চর্য রকম উদাসীন
বলে মনে হয়েছে। এ হলো আমার তৃতীয় ছাত্রজীবনের আগের কথা, যখন মার্কিন
মিডিয়া সম্পর্কে আমার ভালো ধারণা ছিল না। নিজেদের জ্ঞান ও আইডিয়া'ও
সীমিত ছিল। তাই, অনেক কিছু করার সুযোগ থাকলেও করতে পারিনি। তার
ওপর ছিল, পশ্চিমবঙ্গের এই সব ইমিগ্র্যান্ট বাঙালিদের আকাশচুম্বী
নিস্পৃহতা।
আমরা
দুচারজন আমেরিকান বন্ধু, বান্ধবী ও তাঁদের ছেলেমেয়েদের আমাদের
প্রোগ্রাম'এ নিয়ে এসেছি। তারা খুবই আনন্দ করে গেছে। ডাকবার জন্যে
আমাদের অনেক ধন্যবাদ দিয়ে গেছে। কিন্তু তারা বেশিক্ষণ থাকে নি।
তার একটা কারণ হলো, কেউ এগিয়ে এসে তাদের সঙ্গে বেশি কথাবার্তা
বলেনি। বাঙালিরা অন্য ভাষার মানুষের উপস্থিতিতেও বাংলায় একটানা
কথা বলে যায়, এবং সেই পরিবেশে পরম ধৈর্যশীল, উষ্ণ আমেরিকানদেরও
ধৈর্যচ্যুতি ঘটে।
আর
একটা জিনিষ খুব মনে দিয়ে লক্ষ্য করলাম। আমরা কখনো কৃষ্ণাঙ্গ বা
অন্য জাতের মানুষদের ডাকিনা। বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গদের আমরা মোটেই
পছন্দ করিনা। একবার সেন্ট লুইসের দুর্গাপূজোতে এক বাঙালি ডাক্তার
তাঁর কৃষ্ণাঙ্গ স্ত্রীকে নিয়ে এসেছিলেন। তিনিও ডাক্তার। বলতে গেলে
কেউ তাঁর সঙ্গে কথাই বলল না। তিনি খানিকক্ষণ চুপচাপ চেয়ার'এ বসে
থেকে আস্তে আস্তে উঠে চলে গেলেন। মুসলমান'দের সম্পর্কেও সেই একই
বিজাতীয়তা। আমাদের মত লোকেদের পক্ষে মেনে নেওয়া খুব কঠিন।
এরমধ্যে অনেকের কাছে শুনলাম, এসব ছোট শহরে এরকম চুপচাপ, প্রায় লুকিয়ে
লুকিয়ে পুজো হয় বটে, কিন্তু একবার নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সি, বা টরন্টো'তে
যাও না, দেখবে সে এক অন্য ব্যাপার। ভাবতেই পারবে না। তা,
বলতে গেলে সেই তখন থেকেই নিউ ইয়র্ক'এ চলে আসবার এক অদম্য তাড়না
অনুভব করে এসেছি। এমনিতেই, অলবানির শীত আর মিনিংলেস "বৈজ্ঞানিক"
কাজকর্ম আর সহ্য করতে পারছিলাম না।
-তিন-
অষ্টমী:
বোধিবৃক্ষের ফল
শেষ
পর্যন্ত নিউ ইয়র্ক'এ এসে হাজির হলাম পরিবার নিয়ে। এবং প্রথম দুর্গাপূজো
দেখতে গিয়েই হোঁচট খেলাম। যাকে বলে দেশের কথা হাড়ে হাড়ে মনে করিয়ে
দিল নিউ ইয়র্ক'এর বিশাল পুজো ও তার বিশাল বিশাল কর্তাব্যক্তিরা।
ব্যাপারটা
হলো এইরকম। খোঁজ খবর নিয়ে দেখলাম পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা গুজরাটি
সমাজ হল বলে একটা জায়গায় দুর্গাপুজোর সময়টাতে ভাগাভাগি করে তিন কি
চারটে উইকএন্ডে পুজো করে। অর্থাৎ, নিজেদের মধ্যে কনফ্লিক্ট থাকার
কারণে প্রাক্তন একটা গ্রুপ এখন তিন কি চারটে গ্রুপে ভাগ হয়ে গেছে,
এবং তারা পুজোর দু সপ্তাহ আগে থেকে পুজোর দু সপ্তাহ পরের এই কটা
শনি ও রবিবার নিজেদের নিজেদের গ্রুপের পূজো অর্গানাইজ করে থাকে।
এবং, প্রতিটি পুজোতে বেশ ভালই ভিড়ভাট্টা হয়, আর গান বাজনাও হয়। কলকাতা
থেকে কোনো না কোনো শিল্পী আসেন জনগণকে আনন্দ দেবার জন্যে।
তা,
আমরাও সেই আনন্দের অংশীদার হবার জন্যে এক শনিবার সন্ধেবেলা গিয়ে
হাজির হলাম সপরিবারে। অনেক আগে থেকে গিয়ে চেয়ার টেয়ার দখল করে
বসলাম। শোনা গেল, উৎপলেন্দু চৌধুরী আসবেন। তিনি এক হাজার ডলার
নিয়েছেন। শোনা কথা। আরো শোনা গেল, অনুপ জালোটাও গান গাইবেন। তিনি
দশ হাজার ডলার নিয়েছেন। কেন এমন হলো? কারণ, অনুপ জালোটা হিন্দি
ভজন গাইবেন। তিনি বেশি ফেমাস। তাই তাঁর দর দশগুণ বেশি। সে যাই
হোক। আমরা ঢুকেই কর্তাব্যক্তিদের কাছে পূর্ব-নির্ধারিত চাঁদা ফেলে
দিয়েছি। আমাদের আর কেউ ঠেকাতে পারবেনা।
কিন্তু
ম্যান প্রোপসেস, গড ডিস্পসেস। হঠাৎ, ষন্ডা গোছের এক ব্যক্তি এসে
অত্যন্ত রাফ ভাবে বললেন আমাদের চেয়ার ছেড়ে দিতে হবে, এবং সেখানে
বসা চলবেনা। ততক্ষণে হল ভর্তি হয়ে গেছে, এবং আমরা বহু আগে থেকে
এসে বসে আছি। এখন সিট ছেড়ে দিলে বসার জায়গাই পাওয়া যাবেনা। পেলেও
একেবারে পিছনের দিকে। আমি তো জানেন একটু একরোখা গোছের। তার মধ্যে
ততদিনে আমার কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি'তে জার্নালিজম পড়া হয়ে গেছে,
পুরস্কার টুরস্কারও পেয়েছি, বড় বড় লোক'কে ইন্টারভিউ করেছি, আর
আমাকে কিনা এভাবে অপমান সকলের সামনে? আমার নিজের ফ্যামিলির সামনে?
আমিও
ছাড়ব না আমাদের সিট। এবারে, ষন্ডা কর্তাব্যাক্তিটি বাছা বাছা শব্দ
প্রয়োগ করতে শুরু করলেন, এবং আমার কলার ধরে টেনে সরিয়ে দেবার চেষ্টা
করলেন। আমি বাধ্য হয়েই তাঁকে বলাম আমি পুলিশ ডাকছি। এবার বঙ্গ সম্মেলনের বড় বড় কিছু কর্তাব্যক্তি এসে
পড়লেন, এবং আমাকে দেখে বুঝলেন আমি ঠিক ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি
গোছের গোবেচারা লোক নই। তাঁরা এবার হস্তক্ষেপ করলেন, এবং আমাদের
একটু মোটামুটি ভদ্রস্থ জায়গায় সিটের ব্যবস্থা করে দিলেন। কিন্তু
তাঁদের গুন্ডাকে কিছুই তেমন বললেন না। ক্ষমা চাওয়ার তো প্রশ্নই
ওঠে না।
এই
হলো আমাদের নিউ ইয়র্ক'এর দুর্গাপুজোর প্রথম অভিজ্ঞতা।
সত্যিই
মনে হচ্ছিলো কলকাতাতেই আছি। সিপিএম, কংগ্রেস, ইত্যাদি। মনে হচ্ছিলো,
এরা এদেশে বসেও সেই একই খেলা চালিয়ে যাচ্ছে। আমি বাজি ধরে বলতে
পারি, ৯৫ পার্সেন্ট লোক এই অবস্থায় পড়লে হয় চুপচাপ গুন্ডার কথা
মেনে নিতো, অনেক পিছনে গিয়ে বসতো, আর নয়তো অপমানের ভয়ে পরিবারকে
নিয়ে চলে যেত। আমি তাঁদের কোনো দোষ দিই না।
-চার-
নবমী: নৈব
নৈব চ
এই
ঘটনার পর থেকে পারতপক্ষে আমরা আর ওই গুজরাটি সমাজের পুজোয় যাইনা।
গেলেও আধঘন্টা থেকেই চলে আসি। অন্য কোথাও যাই। ভালো লাগে না। গুন্ডাবাজী
আমাদের সঙ্গে হয়ত সামনাসামনি আর কেউ করবেনা, কারণ গত পনেরো বছরে
নিউ ইয়র্ক'এ বিভিন্ন কাজকর্ম করার সুবাদে একটু আধটু পরিচিতি বেড়েছে।
আমাকে কর্তাব্যক্তিরা মোটামুটি চেনেন। এবং, তাঁদের মধ্যে ভদ্র,
মাথা ঠান্ডা লোকজনও দুচারজন আছেন, যাঁরা গন্ডগোল হলে তাড়াতাড়ি
মিটিয়ে ফেলার কৌশল জানেন।
কিন্তু
আমরা ওসব জায়গায় গিয়ে কোনো আনন্দ পাইনা। এক, ঢোকবার সঙ্গে সঙ্গেই
চাঁদা। আমরা এই ধরণের সার্বজনীন অনুষ্ঠানে বিশ্বাস করিনা। আমরা
মনে করি, তোমরা যদি বাইরে থেকে আর্টিস্ট আনার জন্যে এত হাজার হাজার
ডলার খরচা করতে চাও, সে টাকা তোমরা নিজেরাই সংগ্রহ কর। ...কোনো
প্রাণের স্পন্দন নেই। নিজেদের নিজেদের চেনা লোক খুঁজে পেলে তাদের
সঙ্গে একটু কথাবার্তা। ওল্ড জেনারেশন'এর পুজো। অল্পবয়েসী ছেলেমেয়ে
কিছু আসে। কিন্তু একটা বয়েসের পর আর আসে না। তারা ভালো বোঝেই না
আমাদের দুর্গাপুজো ব্যাপারটা আসলে কী। মার্কিন বন্ধু-বান্ধব, মিডিয়ার
লোকজনকে আমি কোনোকালে আসতে দেখিনি। তাঁদের কেউ ডাকেনা।
আর
এদেশে মিডিয়ার কল্যাণে হিন্দুধর্ম একটি বর্বর, প্রাগৈতিহাসিক ধর্ম।
আমরা শুধু নিচু জাতকে অত্যাচার করি, বউকে পোড়াই পণের জন্যে, আর
মূর্তিপূজো করি। আমাদের ছেলেমেয়েদের, পরের প্রজন্মকে শিক্ষিত করে
তোলার জন্যে এই সব কর্তাব্যক্তিদের কোনো ভূমিকাই নেই।
এই
সব কারণে সম্প্রতি দুটো বিষয় লক্ষ্য করার মত ঘটেছে। (১) এই সাংস্কৃতিক
ভ্যাকুয়াম'এর সুযোগ নিয়েছে ধর্ম-মৌলবাদীরা ও তাদের ভ্যারাইটি'র
ধর্ম ও মূল্যবোধ আমাদের এদেশে বড় হওয়া ছেলেমেয়েদের ওপর ইম্পোস
করতে সফল হয়েছে। আর নয়তো (২) কিছু কিছু ছেলেমেয়ে হিন্দুধর্ম সম্পর্কে
বিকৃত ধারণা পোষণ করে, ও এমনকি ধর্মান্তরিত হয়ে যায়। আমি দুটোই
এদেশে দেখেছি চোখের সামনে।
একটা
টোটাল ভ্যাকুয়াম'এর মধ্যে বছরের পর বছর পুজো হচ্ছে এদেশে। এখন,
গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত হয়েছে বাংলা অনুষ্ঠানে সস্তা-ভ্যারাইটির
বলিউড হিন্দি কালচার। এখানে পুজো দেখতে গেলে আমাদের দমবন্ধ হয়ে
আসে।
-পাঁচ-
বিজয়া দশমী:
বিপর্যয় ও বাংলাদেশের হৃদয়
একটা
সময় ছিল, যখন পুজোর সময় মন খারাপ করে থাকতাম। একে তো দেশে যেতে
পারিনা ইচ্ছে হলেই। সবাইকে নিয়ে, সব কাজকর্ম, স্কুল-কলেজ, পড়ানো
সব কিছু ফেলে হঠাৎ করে যাওয়া যায়না। এখানে এত ছুটিও দিতে চায়না
কর্তাব্যক্তিরা। তাছাড়া, একবার দুবার গেছি। আর কতবার যাবো?
তারপর
অনেকে দেশে আমাদের এখন বলেন, থাকিস তো আমেরিকায়। কত সুখে আছিস।
এখানে পুজোর সময়ে আসতে পারিস না বলে এত দুঃখ করিস কেন? এখানে তোদের
আর ভালোও লাগবেনা। আসিস না। ওখানেই ভালো আছিস তোরা। ওখানেই থেকে
যা।
আমাদের
জন্যে কারুর কোনো সময় ওখানে আর নেই। আমরা বেড়াতে গেলে বন্ধু-পরিজনের
সময়ের সঙ্গে, ছুটির সঙ্গে আমাদের সময় ও ছুটি ম্যাচ করেনা। দুটো
জগৎ, দুটো সম্পূর্ণ আলাদা জীবনযাত্রা। আমাদের পরিবর্তিত জীবন,
পরিবর্তিত মূল্যবোধ। ভেতর থেকে একেবারে বদলে যাওয়া জীবনদর্শন।
বাইরে থেকে দেখতে হয়ত আমরা অনেকটা একই রকম আছি। কিন্তু ভেতর থেকে
বদলে গেছি অনেক। ওরা আমাদের আর ভালো বোঝেনা। বোঝবার-যে খুব একটা
চেষ্টা করে, তাও না। আমরাও প্রথম প্রথম একটু চেষ্টা করেছি এখানে
থাকার অভিজ্ঞতাগুলো ওদেরকে দেবার। তারপর, অদৃশ্য দেওয়ালে ধাক্কা
খেতে খেতে একসময়ে সে-চেষ্টা বন্ধ করে দিয়েছি।
আমাদের
মত প্রজাতির মানুষ পৃথিবীতে আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছি। আমরা একটু
বেশি সেনসিটিভ। আমাদের একটু বেশি মূল্যবোধ। আমাদের একটু বেশি আত্মমর্যাদা।
আমাদের একটু বেশি বিবেকের তাড়না। আমাদের একটু বেশি পলিটিকাল উইসডম।
কিন্তু এদিকে আমাদের আবার এদেশে এত বছর থাকার পরেও মিলিয়নেয়ার
হওয়া হয়ে ওঠেনি। তেমন ইচ্ছে ছিলো না হবার। তাই, হতে পারিনি। ফলে,
ফ্রি টাইম নেই। সর্বক্ষণ কাজ করে যেতে হচ্ছে। অবসর নেই। বিশ্রাম
নেই। কাজ কাজ কাজ। নিজের কাজ নিজে। বাড়িতে। বাইরে। সর্বত্র। সর্বদা।
আমরা
আমাদের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধগুলোকে শেষ অন্তর্বাসের
মত আঁকড়ে ধরে রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছি প্রাণপন। কিন্তু পারছিনা।
এই ভয়ংকর অপসংস্কৃতি, নিস্পৃহতা, উদাসীনতা ও অজ্ঞানতার ঝড়, ভূমিকম্প-সুনামির
মত আমাদের শেষ করে দিচ্ছে। আমরা চীৎকার করছি, আর্তনাদ করছি, কাঁদছি।
কিন্তু সে আর্তনাদ, সে কান্না কেউ শুনতে পাচ্ছে না। যেন, একটা
দুঃস্বপ্নের মধ্যে আমরা একটা চোরাবালির মধ্যে দ্রুত তলিয়ে যাচ্ছি।
শীত
পড়তে আরম্ভ করেছে। এই দুর্গাপুজোর সময়েই এখানে কলকাতার জানুয়ারী
মাসের মত শীত। আরো অনেক বাড়বে। সন্ধেবেলা পূজো দেখতে যাই অফিস
থেকে ফিরে ধড়াচূড়া পরে। চুপচাপ গাড়ি পার্ক করে চুপচাপ পাঞ্জাবি-পাজামার
ওপর জ্যাকেট পরে, মাথায় টুপি ঢাকা দিয়ে মন্দিরে ঢুকে যাই। যেমন
যেতাম অলবানিতে ওই মিডল স্কুলের বাড়িটাতে। যেখানে পুজো হচ্ছে।
ভেতরে গিয়ে ঘন্টা কয়েকের জন্যে হই হই। বাঙালিত্ব। রবীন্দ্রসঙ্গীত।
নজরুল। জীবনানন্দ। বিষ্ণু দে। সুনীল-শক্তি।
পৃথিবীর
অন্য প্রান্তে বসে প্রাণপন চেষ্টা নিজের মনকে বোঝানোর-যে আসলে
আমরা তেমন কিছু খারাপ নেই। "এই বেশ ভালো আছি। শব্দ বা পরিবেশ-দূষণ-বালাই
নেই।" ইত্যাদি। তারপরেই আবার মন্দির, স্কুলের বাইরে বেরিয়ে
এসেই ভয়ংকর সত্য। তখন, "দুনয়নে ভয় আছে, মনে সংশয় আছে।"
আসলে,
এসব লেখাও আজকাল প্রায়শই অর্থহীন মনে হয়। "কেউ বোঝেনা, কেউ
বোঝে।" কজন বোঝে? বোঝার চেষ্টা করে আমাদের এই অস্তিত্বের
সংকট? আমাদের এদেশে বড় হওয়া ছেলেমেয়ের সোল-সার্চিং?
বাংলাদেশের
মন্দিরে যাই পূজোর সময়ে। নিউ জার্সির ভারত সেবাশ্রমের পুজোতেও
গেছি দু একবার। বেশ লাগে। ধর্মটা একটু বেশি ওখানে। বিশ্লেষণটা
অনেকটাই কম। কিন্তু, তাও একটা হৃদয় খুঁজে পাওয়া যায় ওখানে। বাংলাদেশের
হৃদয়।
বাংলাদেশের
হিন্দু আর মুসলমান বন্ধুদের মধ্যে একটু আন্তরিকতা বোধ হয় বেশি
এখনো। পশ্চিমবঙ্গের ইমিগ্র্যান্ট বাঙালিদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম
বোধ হয়। অবশ্য, ব্যতিক্রম সব কটা সোসাইটি'র মধ্যেই আছে। এরকম জেনারালাইজ
করা ঠিক হবে না। কিন্তু, তাও। এই আমাদের অভিজ্ঞতা।
হৃদয়
খুঁজে যাচ্ছি সারা জীবন ধরে। বাংলাদেশের হৃদয়। সে হৃদয়, বুদ্ধি,
বিশ্লেষণ, ভালবাসা যেখানে পাই, সেখানেই ছুটে ছুটে যাই। তা সে মার্কিনিদের
মধ্যেই হোক, আর ভারতীয়-বাংলাদেশী বা অন্য জাতির মানুষের মধ্যেই
হোক। ওখানেই কোমলতা, দয়া, বন্ধুত্ব, হাসি, প্রীতি। ওখানেই সান্ত্বনা।
হৃদয়ের
দুটো ছোট গল্প বলে এ-লেখা শেষ করব।
এক,
আমাদের এখানকার দাদা সালাম সারওয়ার। ঢাকার বাঙালি। এখানে একাউন্টেন্ট।
ব্রুকলিন'এর পরিচিত বাঙালি মুখ। দুর্গাপূজোর বহু বছরের প্রধান
পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। নতুন কর্তারা তাঁকে এখন আর ডাকেনা। আমি পূজোর
পর বিজয়া দশমীতে গিয়ে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করি প্রতি বছর।
ভালো লাগে।
আর
এক গল্প। একবার ব্রুকলিন'এর ছোট্ট বেসমেন্ট মন্দির গৌর নিতাই সংঘের
দুর্গাপুজো থেকে খিচুড়ি আর ঢাকের আর কাঁসরের আর আরতির শব্দ খেয়ে
দেয়ে বেরিয়ে দেখলাম ঠান্ডার মধ্যে রাস্তার ল্যাম্প পোস্টের নিচে
একটি বাঙালি যুবক চীৎকার করে কাঁদছে, আর তার বন্ধুরা তাকে সান্ত্বনা
দেবার চেষ্টা করছে।
শুনলাম,
ছেলেটি আজ এক্ষুণি দেশে তার মা মারা যাবার খবর পেয়েছে। কিন্তু
সে খবর পেয়েও যেতে পারবে না, কারণ তার ভিসা, গ্রীন কার্ড বা বৈধ
কাগজ নেই। দেশে শরীরের দারিদ্র্য তাকে অনেক ঝুঁকি নিয়ে এদেশে এভাবে
থেকে যেতে বাধ্য করেছিল। এখন সে একটু কম দরিদ্র। কিন্তু তার যন্ত্রণা
তাকে ছাড়েনি।
আমাদের
সুখের দুর্গাপূজোর দিনে তাকে তার চিরকালের দুঃখের কথা আর একবার
মনে করিয়ে দিয়ে গেলেন দেবী নিজেই।
আর,
সঙ্গে সঙ্গে, আমাদেরও।
পার্থ
বন্দ্যোপাধ্যায়
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।