প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

“বাঙ্গালীর পুজো – গানে, পাঠে”!!

শারদীয় আনন্দবাজারে আমার প্রথম উপন্যাস

শেখর বসু

     ১৯৭৪ সাল। বোধ হয় এপ্রিল কি মে মাস। আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসের লম্বা করিডর ধরে হাঁটছি। উলটো দিক থেকে আসছেন রবিবাসরীয় দফতরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও লেখক রমাপদ চৌধুরী। ছিপছিপে চেহারার সম্পাদকের মুখে অসম্ভব এক কাঠিন্য দেখতাম, হয়তো বা তা অল্প-পরিচিত কোনও মানুষকে এড়াবার জন্যে--। ওঁর এই এড়িয়ে যাওয়ার কাজটি সহজ করার জন্যেই বুঝি আমি করিডরের একটু বেশি ধারে সরে গিয়েছিলাম। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ উনি থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এই শুনুন --।’
     বেশ গম্ভীর গলা। অমন গলা বোধহয় ভালো কথা বলার সময় বার হয় না কারও। আমি একটু জড়সড় হয়ে দাঁড়াতেই প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কি আড়াই-তিন মাসের মধ্যে একটা উপন্যাস লিখে দিতে পারবেন? পুজোসংখ্যা আনন্দবাজারের জন্যে --। পারবেন?’
     থতমত খেয়ে কোনওমতে সায় দিয়েছিলাম।
     উনি আর দাঁড়াননি, নিজের ঘরের দিকে এগোতে এগোতে বললেন, ‘ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি লিখতে শুরু করে দিন—।’

     নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। যা শুনেছি,ঠিক শুনেছি তো! সেই আমলে দেশ-আনন্দবাজারের পূজাসংখ্যায় কোনও তরুণ লেখকের উপন্যাস লেখার ডাক পাওয়া মানে বিরাট ব্যাপার!
     ‘রবিবাসরীয় আনন্দবাজার’ ও ‘দেশ’ পত্রিকায় তখন আমার বোধ হয় ছ-সাতটি গল্প বেরিয়েছে। ১৯৭০ সালে দেশে প্রকাশিত আমার প্রথম গল্পটির নাম ‘টাঙ্গি’। গল্পটির কপালে বেশ একটু প্রশংসা জুটেছিল। প্রকাশের অব্যবহিত পরেই ‘নতুন স্রোতের বাংলা গল্প’ অভিধায় গল্পটির হিন্দি অনুবাদ বার হয় নয়া দিল্লি প্রকাশন সংস্থার ‘আজকাল’-এ। ‘রবিবাসরীয় আনন্দবাজার’-এ আমার প্রথম গল্প ‘নীল আলোয়’,যেটি অনেক পরে আনন্দবাজার পত্রিকার পঁচাত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত নির্বাচিত গল্পসংকলন ‘আনন্দসঙ্গী’তে স্থান পায়।
এই পরিচিতি আনন্দবাজার পূজাসংখ্যায় উপন্যাস লেখার বরাত পাওয়ার ব্যাপারে কিছুটা সাহায্য করেছিল কি না জানি না, তবে এটা সত্যি-- বড় কাগজে গল্প লেখার সুবাদে বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠীর কাছে কিছুটা হয়তো পৌঁছতে পেরেছিলাম। তবে তখন আমার প্রধান জায়গা ছিল আমাদের ছোটগল্পভিত্তিক সাহিত্য-আন্দোলন। আমাদের পত্রিকার নাম ছিল ‘এই দশক’। আন্দোলনের স্লোগান ছিল ‘শাস্ত্রবিরোধী ছোটগল্পের পত্রিকা’। এই শাস্ত্রের সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক ছিল না, আমরা শাস্ত্র বলতে গতানুগতিক ধারার লেখা বুঝিয়েছিলাম। নতুন ধরনের গল্প

লিখতে চেয়েছিলাম আমরা। আমাদের পত্রিকার প্রকাশ শুরু হয়েছিল ১৯৬৬ সাল থেকে। আন্দোলন নিয়ে বেশ মেতে ছিলাম। কোনও চাপ ছিল না, হাতে অঢেল সময়। মাথায় নতুন গল্পের বীজ ঘুরত সবসময়, ছোট আকারের একটি গল্প লিখে ফেলতে পারলেই বেজায় খুশি। হয়তো তারপর কিছুদিন শামুকের খোলসের মধ্যে ঢুকে যেতাম। এমনই একটা সময়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আনন্দবাজারে পূজাসংখ্যার উপন্যাস লেখার নির্দেশ এসেছিল।

     তখন উপন্যাস লেখার একটিমাত্র অভিজ্ঞতা ছিল আমার পুঁজিতে। দু-বছর আগে একটি ছোট পত্রিকায় ‘সিঁড়ি’ নামের একটি উপন্যাস লিখেছিলাম, যেটি কয়েক বছর বাদে দিল্লির ‘প্রাংশু’ প্রকাশনী থেকে ‘ফিরে এলাম’ নামে বার হয়। চোখের সামনে দিয়ে তখন দিনগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে সরে যাচ্ছিল, কিন্তু কিছুতেই উপন্যাসের পছন্দসই বিষয় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সেই সঙ্গে ছিল মনের মধ্যে অদ্ভুত এক অস্থিরতা—-যাহোক-তাহোক নয়, একটি নতুন ধরনের উপন্যাস লিখতে হবে। অন্যরকম উপন্যাস। পাঠকরা নতুন স্বাদ পাবে এবং লেখককে মনে রাখবে কিছুদিন।
     আরও কয়েকটা দিন গড়াবার পরে বিষয় পেলাম—আমার জীবনেরই একটি ঘটনা। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু নকশালবাড়ি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তাত্ত্বিক নেতা। নিজের বাড়িতে বসে ছোট মাপের লাল-লাল মলাটের বইপত্র খুলে তরুণতরদের ক্লাস নিত নিয়মিত। তখন আবার পুলিশি ধরপাকড় শুরু হয়েছিল খুব। এক রাতে আমার সেই বন্ধুকে পুলিশ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম ওকে স্থানীয় থানার লক-আপে রাখা হয়েছে।
     আমি কখনোই সক্রিয় রাজনীতি করিনি,কিন্তু আমাদের ওই ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে পুলিশের হাত থেকে উদ্ধার করার জন্যে লাফিয়ে পড়েছিলাম। আমি একা নই, সঙ্গে আমাদের আর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিল। লোকাল থানা, লালবাজার, শিয়ালদা পুলিশ কোর্টে শুরু হয়ে গিয়েছিল আমাদের যাতায়াত। কোথায় কতটুকু প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটানো যায়, তার সন্ধান ও তদ্বিরে নাওয়াখাওয়া ভুলতে বসেছিলাম প্রায়।
     একটি সূত্রের সুপারিশে একদিন সকালে আমরা লালবাজারে ডিসি ডিডি ওয়ানের কোয়ার্টার্সেও পৌঁছে গিয়েছিলাম। উনি আমাদের সব কথা শোনার পরে ফোন টেনে নিয়ে খুব নিচু গলায় কী-সব কথাবার্তা সেরে নিয়ে বললেন, ‘তোমাদের বন্ধু তো সব দোষ স্বীকার করে নিয়েছে।’
     আমরা আর এক দফা ওকালতি করার পরে উনি গম্ভীর গলায় বলেছিলেন, ‘যারা দু-চারটে খুন করে, আমরা তাদের চাইতেও বেশি বিপজ্জনক মনে করি যারা অল্পবয়সীদের মাথা খায়—তাদের। তোমাদের এই বন্ধুটি তো থিয়োরিস্ট—তাত্ত্বিক নেতা। আর একটা কথা, তোমরা যদি তোমাদের এই বন্ধুকে খুব বেশি করে ছাড়াবার চেষ্টা করো, তোমরাও ফেঁসে যেতে পারো। এসব ছেড়ে দিয়ে নিজেদের কাজে মন দাও।’
     কিন্তু গোয়েন্দাপ্রধানের ওই সতর্কীকরণ আমাদের থামাতে পারেনি। অল্পবয়সে বন্ধুপ্রীতি প্রবল থাকে। আমরা নানা ভাবে আমাদের ওই বন্ধুকে উদ্ধারের জন্যে লেগে থাকি এবং শেষ পর্যন্ত সফলও হই। নিকট-অতীতের এই সত্যি ঘটনাটাই আমার উপন্যাসের বিষয় হয়েছিল। তবে শুধু সত্যি দিয়ে তো আর গল্প-উপন্যাসের চলে না, তার সঙ্গে বিস্তর মিথ্যেও মেশাতে হয়। এই মিথ্যেটুকু মেশাবার প্রধান দায়িত্ব নিয়েছিল উপন্যাসের এক কাল্পনিক নায়িকা।
     উপন্যাসে ঘটনার ঘনঘটা ছিল না। পাত্রপাত্রীর মনোজগতের বিচিত্র সব আবর্তই প্রধান। শেষে গুরুতর আরও একটি আবর্ত ওঠার আভাস দিয়েই উপন্যাস শেষ। অন্যরকম উপন্যাস লিখতে চেয়েছিলাম, উপন্যাসের নামও দিলাম ‘অন্যরকম’।
খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম। উপন্যাস জমা দেওয়ার কয়েক দিন পরে সম্পাদক আগেরই মতো গম্ভীর মুখে জানালেন, ‘আপনার উপন্যাসটা ভালো হয়েছে, এবারের পুজোর আনন্দবাজারে যাবে।’

     আনন্দবাজারে উপন্যাসটি ছাপা হওয়ার খবর বাইরে বেরিয়ে পড়েছিল। পথেঘাটে অনেক লেখকই আমাকে প্রশ্ন করে খবরের সত্যতা যাচাই করে নিতেন। প্রশ্নকর্তাদের তালিকায় অগ্রজ লেখকদেরও কেউ-কেউ ছিলেন। উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলায় কেউ-কেউ বলেছিলেন—বাহ্‌! খুব ভালো খবর! কারও-কারও মুখ আবার বেশ গম্ভীর হয়ে যেতে দেখেছিলাম। একজন বলেছিলেন—তুমি তো হাতে আকাশের চাঁদ পেয়ে গিয়েছ!
     ‘আকাশের চাঁদ’ নিঃসন্দেহে অতিশয়োক্তি, তবে এর মধ্যে খানিকটা সত্যি হয়তো ছিল। সেই আমলে দেশ বা আনন্দবাজারের পুজোসংখ্যায় একজন তরুণ লেখকের উপন্যাস লেখা নিঃসন্দেহে একটি বড় ঘটনা। তখনকার দিনকাল একেবারে অন্য ধরনের ছিল। কী রকম—বলার চেষ্টা করা যেতে পারে--।

     তখন বহুলপ্রচারিত পুজোসংখ্যা বলতে ছিল মাত্র তিনটি। ‘আনন্দবাজার’, ‘দেশ’ ও ‘যুগান্তর’। মানের দিক থেকে বিচার করলে যুগান্তর থেকে আনন্দবাজার গোষ্ঠী বেশ কিছুটা এগিয়ে ছিল সেই সময়। এই তিনটি পুজোসংখ্যার একটি বা দুটি তখন অধিকাংশ শিক্ষিত বাঙালির হাতে পৌঁছে যেত। সেই আমলে পুজোর বাজার করার সঙ্গে সঙ্গে বেশির ভাগ বাঙালি একটি করে পুজোসংখ্যা কিনতেন।
১৯৭৪ সালে ‘আনন্দলোক’ ও ‘আনন্দমেলা’ বার হয়নি পত্রিকা আকারে। ওই দুটির আত্মপ্রকাশ বোধহয় পরের বছর। ‘সানন্দা’, ‘পত্রিকা’ ইত্যাদি তখন দূর ভবিষ্যতের গর্ভে। আরও দূরে আজকের ‘আজকাল’, ‘বর্তমান’, ‘প্রতিদিন’ ইত্যাদি পত্রিকা।

     ন্যাশনাল ব্রডকাস্টার হিসেবে ‘দূরদর্শন’-এর আবির্ভাব ১৯৮২ সালে। ওই সময়েই ভারত সরকারের প্রযোজনায় মুন্‌শি প্রেমচন্দের গল্প নিয়ে তৈরি সত্যজিৎ রায়ের ‘সদগতি’ দেখানো হয় টিভিতে। আজকের মতো গাদা-গাদা টিভি চ্যানেলের কথা কেউ তখন বোধহয় ভাবতেও পারতেন না। কম্পিউটার,ইন্টারনেট, মোবাইল তখন তো দূর আকাশের তারা!
     শহুরে শিক্ষিত বাঙালির কাছে তখন প্রধান বিনোদন ছিল সিনেমা। তারপর থিয়েটার। পুজোর সময় বা একটু পরে বসত গানের জলসা। শীতের সময় কলকাতায় হত বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলন। সারা রাত ধরে ওখানে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসরও বসত। আর ছিল ছোটখাটো কিছু হস্তশিল্পের স্টল। অল্পস্বল্প যাত্রা-থিয়েটারের ব্যবস্থা ছিল। গ্রামবাংলার কিছুটা সংস্কৃতিও তুলে আনা হত প্রাঙ্গণে। ছিল পিঠে,পুলি,পায়েসের দোকান। ছোট-বড় কয়েকটি মন্ডপ তৈরি হত সম্মেলনে। একটি ছোট মন্ডপের একধারে গোটাকুড়ি বইয়ের দোকান থাকত। ওই কুড়িটি দোকানের আঠারোটিই ছিল ছোট এবং অখ্যাত প্রকাশকদের। আমরা বিনি পয়সায় একটা স্টল পেতাম। সেটি সাজাতাম আমাদের পত্রপত্রিকা ও চটি-চটি কয়েকটি বই দিয়ে। ‘কলকাতা বইমেলা’ তখন দূরের ব্যাপার। ফুটবল ও টেস্ট ক্রিকেট ছিল, তাও দুটি ঋতুর কিছু সময়ে। সেই আমলে কলকাতায় বিনোদনের এই ছিল মোটামুটি চেহারা। শিক্ষিত বাঙালিরা তখন বই ও পত্রিকা পড়ার অভ্যাসটি পুরোপুরি বজায় রেখেছিলেন।

     বেশ কয়েকটি উঁচু মানের ছোট পত্রিকা বার হত তখন। কিন্তু স্বাভাবিক কারণেই সেগুলির প্রচারসংখ্যা ছিল সীমিত। বহুলপ্রচারিত পূজাসংখ্যা বলতে ছিল ওই তিনটিই। গোটাদুয়েক মোটাসোটা আকারের সিনেমা-পত্রিকা বার হত, ওই দুটিতেও কয়েকটি উপন্যাস ছাপা হত। মাঝারি চেহারার আরও দু-চারটি ব্যবসায়িক পূজাসংখ্যা ছিল, তবে সেগুলি তেমন বিক্রি হত না। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটটি তুলে ধরলাম এই কথাটি বোঝাবার জন্যেই যে, সে-আমলে দেশ ও আনন্দবাজারের পুজাসংখ্যার ব্যাপ্তি ছিল বিশাল।
     বিখ্যাত লেখকরাই ওই দুটি পত্রিকার পূজাসংখ্যায় লিখতেন। নিয়মিত ঔপন্যাসিকদের লেখকসূচিতে ছিলেন সুবোধ ঘোষ, সন্তোষকুমার ঘোষ, রমাপদ চৌধুরী, বিমল কর, সত্যজিৎ রায়। সমরেশ বসু দুটি পত্রিকাতেই লিখতেন—একটি স্বনামে, অপরটি ‘কালকূট’ ছদ্মনামে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মতি নন্দী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় পুজাসংখ্যার নিয়মিত ঔপন্যাসিকদের তালিকায় সবে যুক্ত হয়েছেন। অনিয়মিত ভাবে উপন্যাস লিখতেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, বরেন গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ। দেশ পূজাসংখ্যার অন্য আকর্ষণও ছিল। সাগরময় ঘোষের সৌজন্যে প্রাপ্ত রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু চিঠি ও ওইসব সম্পর্কে বিস্তৃত নোট বার হত। আনন্দবাজার পূজায় তথ্যবহুল নিবন্ধ লিখতেন শ্রীপান্থ ও অমিতাভ চৌধুরী। গুরুত্বপূর্ণ ওই সময়টিতেই শারদীয় আনন্দবাজারে উপন্যাস লেখার ডাক পেয়েছিলাম আমি।
     উপন্যাসের নাম দিয়েছিলাম ‘অন্যরকম’। পুজোসংখ্যা বেরুবার আগে অত্যুত্সাহী লেখকদের কেউ-কেউ আমার কাছে উপন্যাসের নাম জানতে চেয়েছিলেন। বলেছিলাম। একজন অগ্রজ লেখকের কথা মনে পড়ছে। তিনি নাম জিজ্ঞেস করাতে বলেছিলাম—‘অন্যরকম’। শুনে তিনি বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, আপনি তো অন্যরকমই লিখবেন, কিন্তু উপন্যাসটির নাম কী?’

     বহুলপ্রচারিত সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনে বড়-বড় লেখকদের সারিতে নিজের নামটা দেখে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম সন্দেহ নেই। যথাসময়ে সাড়ম্বরে প্রকাশিত হল শারদীয় আনন্দবাজার। উপন্যাসটি অনেকের ভালো লেগেছিল। কেউ-কেউ বলেছিলেন—সম্পূর্ণ নতুন ধরনের লেখা। কেউ বলেছিলেন—ভালো, তবে আরও ভালো হলে ভালো হত! একজন বিশিষ্ট লেখক সেই বছরের ছোট-বড়-মাঝারি পত্রিকার ‘শতাধিক’ শারদীয় উপন্যাস পাঠ করার দাবিদার হয়ে ষষ্ঠীর দিনেই একটি বহুলপ্রচারিত দৈনিকে লম্বা একটি সমালোচনা লিখে ফেলেছিলেন। তার মধ্যে আমার জন্যেও একটি লাইন ছিল। সেটি হল এই উপন্যাসটি ‘ যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক নয়’। মার্ক টোয়েন শ্ত্রু আর বন্ধুর তফাত বোঝাতে গিয়ে চমত্কার একটি মন্তব্য করেছেন। সেটি হল-- ‘শত্রু নিন্দে করে, আর বন্ধুর কাজ হল সেটা বন্ধুর কানে তুলে দেওয়া।’ আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। ফোন করে বেশ কয়েকজন বন্ধু ক্ষোভ এবং সমবেদনা জানিয়েছিলেন। ষষ্ঠীর মধ্যেই শতখানেক উপন্যাস পড়ে ফেলার দাবিদার ওই লেখক-সমালোচক আমাকে চমত্কৃত করেছিলেন।

     শারদীয় আনন্দবাজারে প্রকাশিত ওই উপন্যাসটির সুবাদে বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠী, যাঁরা লিটল ম্যাগাজিন বা সাহিত্য-আন্দোলনের বিশেষ খোঁজখবর রাখেন না, তাঁদের সঙ্গে অল্পবিস্তর পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। দূর-দূর থেকে কিছু চিঠিপত্তরও এসেছিল তখন।
পুজোসংখ্যা বার হওয়ার মাসখানেকের মধ্যে আনন্দ পাবলিশার্স প্রকাশনা-সংস্থার বাদলবাবু বেশ বড়সড় একটা খাম পাঠালেন আমার কাছে। সেই খামে আমার মুদ্রিত উপন্যাসটি একতাড়া বড় আকারের কাগজে সাঁটা ছিল। তিনি জানালেন, বইটি আনন্দ পাবলিশার্স বার করবে। আমি উপন্যাসের প্রয়োজনীয় সংশোধন, দরকার বোধ করলে কিছু সংযোজন ইত্যাদি করে প্রেসকপি তাঁর কাছে যেন পাঠিয়ে দিই।
     নির্দিষ্ট তারিখে প্রেসকপি জমা দেওয়ার চাপ না থাকায় ধীরেসুস্থে সংশোধনের কাজ চালিয়েছিলাম, সংযোজনও করেছিলাম দু-একটি পরিচ্ছেদ। বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন বহুমুখী প্রতিভাধর পূর্ণেন্দু পত্রী। আঁকা হয়ে গেলে একদিন আমাকে ডেকে বললেন, ‘দেখ তো কেমন লাগছে ?
     বইয়ের নামটি আড়াআড়ি ভাবে মলাটে লেখা। হরফ সাজানোর কৌশলে একটি নারীমূর্তির আভাস ফুটে উঠেছে। বেশ ভালো লেগেছিল প্রচ্ছদটি। উদ্ভাসিত মুখে সে-কথা শিল্পীকে জানিয়েও ছিলাম ।
আনন্দ পাবলিশার্স থেকে বইটি ছাপা হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। লাইনো টাইপে ছাপা ১১০ পাতার শক্ত মলাটের বইটির দাম ছিল দশ টাকা। দুটি সংস্করণ হয়েছিল ‘অন্যরকম’-এর।

     পুজোসংখ্যায় উপন্যাস লিখে কত টাকা পেয়েছিলাম—সেটিও একটি আকর্ষণীয় তথ্য। শুনেছি, ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত লেখকভেদে বিভিন্ন হারের সম্মানদক্ষিণা দেওয়া হত ঔপন্যাসিকদের। কেউ পেতেন বেশি, কেউ বা কম। ১৯৭৪ সাল থেকে এ-ব্যাপারে নতুন নিয়ম চালু হল। প্রবীণ বিখ্যাত ঔপন্যাসিক থেকে শুরু করে অখ্যাত তরুণ ঔপন্যাসিক একই হারে টাকা পাবেন।

     ১৯৭০ সালে ‘দেশ’ পত্রিকার সাধারণ সংখ্যায় প্রথম গল্প লিখে পেয়েছিলাম পঞ্চাশ টাকা। ১৯৭২ সালে রবিবাসরীয় আনন্দবাজারে প্রথম গল্প লেখার জন্যেও দক্ষিণা ওই পঞ্চাশই। কিন্তু ১৯৭৪ সালে শারদীয় আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রথম উপন্যাস লেখার জন্যে পেয়েছিলাম তিন হাজার টাকা। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগের হিসেবে টাকার অঙ্কটি নিঃসন্দেহে বিরাট!

      লেখক পরিচিতি - শেখর বসু (http://sekharbasu.com/) – প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও ছোটগল্পকার।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।