প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

“বাঙ্গালীর পুজো – গানে, পাঠে”!!

দুর্গা – যুগে যুগে

দিলীপ দাস

     মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের মায়াবী গলায় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শুনতে শুনতে মনে হত ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর ও অন্যান্য দেবতারা সম্মিলিত তেজরাশি দিয়ে সৃষ্টি করলেন এক দেবীকে, এক দেবতাকে নয় কেন? অষ্টমীর সন্ধ্যে বেলায় আরতি দেখতে দেখতে মনে হত দেবী দুর্গা কেন সিংহবাহিনী? যেহেতু বাঘ ভারতবর্ষে অনেক বেশী সংখ্যায় আছে, দেবী ব্যাঘ্রবাহিনী কেন নয়? পুরাণে দেবী মহাতেজা, যুদ্ধরতা, অসুরবিনাশিনী, যার হুহুঙ্কারে পৃথিবী বিকম্পিত। অথচ দেবীর এই রূপটির সাথে মনু সংহিতার আদর্শ ভারতীয় নারীর কোমল রূপটির কোন মিল নেই কেন? দেবীর সৃষ্টি হয়েছিল এক পরমা আদিশক্তি হিসেবে, অন্যান্য দেবীদের মতো কোন দেবতার স্ত্রী বা divine consort হিসেবে নয় কেন? আর মা দুর্গা বাপের বাড়ীতে এসেও মহিষাসুরের সাথে যুদ্ধ করছেন কেন আর তাঁর পুত্র-কন্যারা সেই যুদ্ধে মা-কে সাহায্য না করে সামনের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছেন কেন?

     দেবীর শুরু কোথায়? দেবীর ইতিহাস কি? সেই প্রাচীন যুগে দেবীর concept-টা এলো কোথা থেকে? মাথায় একগাদা প্রশ্ন অথচ উত্তর নেই। দেবীর ঘটনা সবচেয়ে বিশদ ভাবে লেখা মার্কণ্ডেয় পুরাণের ‘দেবী-মাহাত্ম্যে’, (যাকে শ্রীশ্রী চণ্ডী বলা হয়)। সেখানে পৌরাণিক ঘটনার মাঝে ইতিহাস পেলাম কই? অন্য পুরাণ-টুরান গুলি পড়ে তো আরো গোলমালে পড়ে গেলাম। এক এক পুরাণে এক এক রকম লেখা, সেখানেও আমার প্রশ্নের উত্তর পেলাম না। কিছু টিকিধারী (virtual টিকি) পণ্ডিতের সাথে কথা বলতে গিয়ে দেখি তারা বিভিন্ন পৌরাণিক গল্প ও রূপকের সাহায্য নিয়ে পুরো ব্যাপারটার ব্যাখ্যা করছেন। সেগুলি ভালো কথা, কিন্তু আমি চাইছি ইতিহাসের ও পুরাতত্ত্বের দিক দিয়ে দুর্গার রূপ ও প্রাচীন যুগ থেকে তাঁর বর্তমান অবধি বিবর্তনের বর্ণনা। সেটা কোথায় পাই?

     এসব প্রশ্ন যখন মাথায় ঠেলা মারছে তখন সবে শীত পেরিয়ে বসন্তকাল। শরত আসতে অনেক দেরী। চারিদিকে বেশ ফুল-টুল ফুটেছে, তাই মেজাজও খুশ। সুতরাং ‘দুগ্‌গা দুগ্‌গা’ বলে সমস্ত প্রশ্নের ঝুলি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমার মাস্টারমশাই, Religious History-র প্রোফেসর, সুমিত শ্রীনিবাসনের কাছে, যাঁর কাছে সব সময় সঠিক উত্তর পেয়েছি। তাছাড়া মাস্টারমশাইয়ের কাছে যাবার অন্য একটা সাধু উদ্দেশ্যও ছিল।

     মাস্টারমশাইয়ের বাড়ীর দরজা যে খুলে দিল তার সারা গায়ে জড়ানো নীল যমুনা নদী, মুখে আষাঢ়ের অভিমান ও চোখে চাপা খুশির ঝলক।

     সব শুনে প্রোফেসর শ্রীনিবাসন বললেন – প্রশ্নগুলি ভালো। দুগ্‌গা ঠাকুর দেখে অন্য সবার মতো স্রেফ মাথায় হাত ঠেকিয়ে যে চলে আসোনি তা বোঝা যাচ্ছে। উত্তরও পাবে, কিন্তু তার আগে এক কাপ করে কফি। হিল্লোলিত নীল-যমুনা আমাদের এক কাপ করে কফি এনে দিল, যাবার সময় লুকিয়ে আমাকে একটা কিল দেখিয়ে গেল। ধূমায়িত খুশবুদার নীলগিরি কফির কাপে চুমুক দিয়ে মাস্টারমশাই জিজ্ঞাসা করলেন, আগে বলো দেবী দুর্গা বলতে কি বোঝ। সবার আগে এটা পরিষ্কার করে নেওয়া চাই।
     - জগন্মাতা দুর্গা সিংহবাহিনী, দশভুজা, দশপ্রহরণধারিনী, সম্পদ-স্থানক ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে, ডান পা সিংহের পিঠে, বাঁ পা মহিষের ওপর, মহিষের থেকে অর্ধেক উত্থিত মহিষাসুর বধ করছেন, প্রশান্ত মুখে যুদ্ধের ছায়া নেই, ‘সিংহস্তা শশীশেখরা মরকতপ্রেক্ষা/ চতুর্ভিভূজৈ শঙ্খং চক্র-ধনু: শরাশ্চ দধাতি/ নেত্রৈস্ত্রিভিঃ শোভিতা’ - তাঁকে এই রূপেই আমরা জানি।
     - এখানে keywords গুলো হচ্ছে, সিংহবাহিনী ও মহিষমর্দিনী। দুর্গার হাতের সংখ্যা বিভিন্ন যুগে ও বিভিন্ন স্থাপত্যে বিভিন্ন রকম, তাই সেটা এখন ধরছি না। তুমি ইতিহাস জানতে চেয়েছিলে, তাই বলি, Iconographically সবচেয়ে প্রাচীন যে মূর্তিটি দুর্গার সাথে closest match, সেটি রাখা আছে মথুরা মিউজিয়ামে, কুষান যুগের অমূল্য কিছু ভাস্কর্যের সাথে।
     - সে তো ১ম/২য় শতকের কথা, তাই না?
     - হ্যাঁ, প্রথমে এই ছবিটি দেখো (ছবি-১)। কুষান যুগের, আনুমানিক ২০০ খ্রীঃ, ষড়ভুজা দুর্গা মহিষ দমন করছেন খালি হাতে। আবার এরকম আর একটি ছবিতে (মথুরা মিউজিয়ামের ৮৭৮ নম্বর একজিবিট) ষড়ভুজা দেবী ডান হাতে তরোয়াল ধরে বাঁ হাতে মানুষ রূপধারী অসুর দমন করছেন, সেই ছবিতে মহিষ নেই। খেয়াল করে দেখো, সব ছবিগুলিতেই সিংহ অনুপস্থিত। দুর্গা এখানে মহিষমর্দিনী হলেও সিংহবাহিনী নন।
     - কিন্তু, তাহলে দেবী সিংহবাহিনী কি করে হলেন? আর কুষানরা তো মধ্য এশিয়ার ইউ-চি জাতির একটি শাখা, যারা প্রথমে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল প্রায় খ্রীঃ ১ম শতকে, তাদের কাছে দুর্গা কি করে পূজিত হলেন? দুর্গার মূল উৎস কি তাহলে ভারতের বাইরে?
     - এর জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে প্রাচীন মেসোপটেমিয়া ও সুমের অঞ্চলে, যেখানে প্রায় ২৫০০ খ্রীঃ পূর্বাব্দে এক পরাক্রান্তা দেবীর পুজো করা হত, যার নাম ছিল ‘নানা’ বা ‘ইনানা’ বা ‘ইশ্‌থারা’। তিনি ছিলেন যুদ্ধ ও প্রেমের দেবী, তার নামে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় একটি মন্দির বা Ziggaraut-ও আছে, এবং...প্রোফেসর চুপ করলেন। বুঝলাম এবার তিনি আসল বোমাটি ছাড়বেন।
     - এবং? আমার সারা চোখে ও দেহে প্রশ্ন।
     - এবং সেই দেবী ছিলেন সিংহবাহিনী। এবারে দেবী ইশ্‌থারার ছবি দিলাম, (ছবি-২) দ্যাখোতো কিছু মিল পাও কি না।
     - ছবিতে দেবীর কাছে দেখছি অনেক অস্ত্র-শস্ত্র আছে। যুদ্ধের দেবী বলে বোঝা যায়। মনে হচ্ছে দেবী ইশ্‌থারা তাঁর পোষা সিংহটি নিয়ে সন্ধ্যে বেলায় রণসাজে হাঁটতে বেরিয়েছেন। বুঝলাম, ‘নানা’ বা ‘ইনানা’ বা ‘ইশ্‌থারা’ দেবী মধ্য এশিয়ার কুষান দের হাত ধরে ভারতে পদার্পণ করেছেন। কিন্তু প্রোফেসর এখন প্রশ্ন হচ্ছে ‘নানা’ সিংহ নিয়ে ঘোরেন কেন? এর পেছনে কোন কারণ আছে কি?
     - সিংহ হচ্ছে শক্তি, সাহস ও তেজের প্রতীক, তাই নানার বাহন সিংহ। বিভিন্ন প্রজাতির সিংহ এক সময় সারা মধ্যপ্রাচ্যে ঘুরে বেড়িয়েছে। মনে করে দ্যাখো সেজন্যে ঋগ্‌বেদে সিংহের উল্লেখ থাকলেও বাঘের উল্লেখ নেই। আর্যরা ভারতে আসার আগে বাঘের দেখা পান নি। তার মানে ‘নানা’ দেবী ভারতে এসেও তাঁর বাহন বদলান নি। ‘নানা’ দেবীর কিছু স্থাপত্য আফগানিস্তানেও পাওয়া গেছে, তার একটা নমুনা দিলাম (ছবি-৩)। এখানে নানা সিংহের ওপর বসে আছেন। খেয়াল করে দেখো এখান কিন্তু মহিষের কোন উল্লেখ নেই।
     - সুমেরের Ziggaraut মতো ‘নানা’-র কোনো মন্দির এদেশে ছিল না?
     - তুমি হিন্দুদের তীর্থক্ষেত্র হিংলাজ মাতার নাম শুনেছ, যাঁর মন্দির পাকিস্তানে করাচীর কাছে?
     - নিশ্চয়, হিংলাজ হিন্দুদের একান্ন পীঠের একটি, পুরাণ মতে যেখানে সতীর মাথা পড়েছিল। তাছাড়া সেই অমর বাংলা গান “পথের ক্লান্তি ভুলে...”, তা তো প্রতিটি বাঙ্গালীর জানা আছে। হিংলাজ ভুলি কি করে?
     - ভালো, কিন্তু এটা জানা আছে কি যে স্থানীয় লোকে হিংলাজ মাতাকে ‘দেবী নানী’ বলে ডাকে?
     - দেবী নানী, মানে ঠাম্মা/দিম্মা?
     - না, এর সাথে কিন্তু ঠাম্মা/দিম্মার কোন সম্পর্ক নেই। এই ‘নানা’-দেবীই এখনো পূজিত হচ্ছেন হিংলাজে, দেবী নানী রূপে।
     - আশ্চর্য! সাধারণ মানুষ ভুলে গেলেও হিংলাজ মাতার মাঝে ইতিহাস ঠিক তার জায়গা খুঁজে নিয়েছে। প্রোফেসর, তাহলে কি বলতে পারি এই দেবী ‘নানা’ বা ‘ইশ্‌থারা’-ই হচ্ছেন দুর্গার পূর্বসূরি?
     - আংশিক ভাবে। মনে রেখো ‘নানা’ iconographically দুর্গার পূর্বসূরি হলেও দেবী দুর্গা characteristically কিন্তু সম্পূর্ণ ভারতীয়।
     - এটা বুঝলাম না।
     - তুমি নিশ্চয় জানো যে, পর্বতের সাথে দুর্গার সম্বন্ধ আছে। যা দুর্গম তাই দুর্গা। আমরা দুর্গাকে হিমালয়দুহিতা পার্বতী বা বিন্ধ্যপর্বত-বাসী বিন্ধ্যবাসিনী বলেও ডাকি। দুর্গার যে ভয়াল রূপটি আমরা দেখি, যাঁর অট্টহাস্যে মহিষাসুর বিচলিত হয়, যিনি যুদ্ধক্ষেত্রে মহিষাসুরকে বলেন ‘গর্জ গর্জ ক্ষণং মূঢ়, মধু যাবৎ পিবাম্যহম্‌’, তাঁর সাথে আদিতি বা উষার মতো অন্যান্য বৈদিক স্ত্রী দেবতাদের সাথে মিল নেই কেন? আসলে শিবের মত দুর্গার-ও একটা অনার্য root আছে। এই অনার্য পার্বত্য দেবী উত্তর ভারতের কোনো কোনো অংশে কুষান আমলে বা তারও আগে জনপ্রিয় হয়েছিলেন। কুষান আমলে ‘নানা’ ও সেই অনার্য দেবীর এই দুইয়ের সংযোগ হয়ে সিংহবাহিনী মহিষমর্দিনী দেবীর দুর্গার একটা concept সৃষ্টি হয়েছিল। তবে এই সংযোগ কুষান যুগে শুরু হলেও, পরিপূর্ণতা পেয়েছিল গুপ্ত যুগে। ইতিহাসে এরকম সংযোগের আর একটা উদাহরণ হচ্ছে কুষানদের মুদ্রায় ‘নানা’-র বিবর্তন। কুষান কনিষ্কের মুদ্রায় ‘নানা’ একা দাঁড়িয়ে আছেন কিন্তু তার প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে রাজা হুবিষ্ক-র একটি মুদ্রায় আছে ‘নানা’ সিংহের পিঠে চড়ে ও অন্য একটি মুদ্রায় একসঙ্গে নানা ও উর্ধলিঙ্গ শিবের, যিনি হচ্ছেন গ্রীক বা কুষান দেবতা ওশো, তাঁর ছবি।
     - তাহলে, কুষান যুগ থেকে গুপ্ত যুগে দুর্গার বিবর্তন কিভাবে হল?
     - দেবীর কার্যকলাপ সবচেয়ে বিশদ ভাবে আছে যে পুরাণের একাশি থেকে তিরানব্বই পরিচ্ছেদে আছে, যাকে আমরা দেবী-মাহাত্ম্য বা শ্রীশ্রীচণ্ডী বলে থাকি, সেই মার্কণ্ডেয় পুরাণ লেখা হয়েছিল সম্ভবতঃ গুপ্ত যুগে, চতুর্থ শতকে। গুপ্ত যুগে দেবী যে যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন তার প্রমাণ হচ্ছে চন্দ্রগুপ্তের মুদ্রায় দেবীর সিংহবাহিনী রূপের ছবি (ছবি-৪)। কিন্তু দেবী-মাহাত্ম্য অংশটি লেখা হয়েছিল আরো পরে, সম্ভবত: ষষ্ঠ বা সপ্তম শতকে। কাজেই দুর্গা religious literature-এ বর্তমান রূপ পেয়েছিলেন ষষ্ঠ বা সপ্তম শতকে। কর্ণাটকের আইহোলে অষ্টম শতকের মন্দিরের গায়ের এই ছবিতে (ছবি-৫) আমরা সিংহ সমেত দুর্গার মহিষমর্দিনী রূপ দেখতে পাচ্ছি।
     - এখানে দেখছি দশভুজা দেবী মহিষ বধ করছেন, কিন্তু এই ছবিতে তো দেখছি সিংহ পাশ থেকে উঁকি মেরে যুদ্ধ দেখছে। প্রোফেসর, ইনি তো পুরাণের সিংহবাহিনী দেবী নন।
     - প্রাচীন ভাস্কর্যের দেবীর সিংহবাহিনী রূপ আমরা দেখতে পাই সপ্তম/অষ্টম শতকের পল্লব রাজাদের তৈরি তামিলনাড়ুর মহাবলীপুরমের পাহাড়ের গায়ে (ছবি-৬)। দেবী সিংহবাহিনী হয়ে যুদ্ধ করছেন, সামনে মহিষরূপী অসুর, পেছনে দেবতারা যুদ্ধ দেখছেন। এখানে অসুরের ভঙ্গিমা লক্ষ্য কর, একদম আলাদা।
     - কিন্তু প্রোফেসর, আবার গুপ্তযুগের উদয়গিরির গুহা চিত্রে আমরা দুর্গার অন্য রূপ দেখি। তাহলে, দুর্গার consistent ছবিটা, যেটা আমরা বর্তমানে দেখি, সেটা কখন থেকে পাওয়া যায়?
     - তুমি যদি মার্কণ্ডেয় পুরাণের পরিচিত দুর্গার সিংহবাহিনী ও মহিষমর্দিনী রূপ, তার কথা বল, তাহলে সেটা হতে হতে পাল রাজাদের আমল, প্রায় নবম/দশম শতক। তখন থেকে দুর্গা মোটামুটি consistent. এই ছবিগুলি (ছবি-৭, ৮) খ্রীঃ ১০-১২ শতকের, যেখানে দুর্গার রূপ প্রায় বর্তমান রূপের সাথে মোটামুটি মেলে। তবে মনে রেখো, দেবী দুর্গা এখনো কিন্তু ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রূপে পূজিত হন।

      - আর পূর্ব ভারতে দেবীর বেশী জনপ্রিয়তার কারণ কি পাল রাজাদের অনুগ্রহ?
     - হতে পারে, যদিও পাল রাজারা নিজেরা বৌদ্ধ ছিলেন।
     - আর আমরা পুজো প্যান্ডেলে যে দুর্গা মূর্তি দেখি, সপরিবার, পুত্র-কন্যা সহ মহিষাসুর বধ করছেন, সেটা কবে থেকে এলো।
     - সেটা হতে হতে মধ্যযুগ। বাংলা সাহিত্যের ১৬শ শতকের কবি কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলে দুর্গার classical রূপটি সুন্দর ধরা আছে। - “মহিষমর্দিনী রূপ ধরেন চণ্ডিকা/......সিংহ পৃষ্ঠে আরোপিলা দক্ষিণ চরণ/মহিষের পৃষ্ঠে বাম পদ আরোপণ/....../বাম করে মহিষাসুরের ধরি চুল/ডানি করে বুকে তার আরোপিলা শূল/........./অঙ্গদ-কঙ্কণ যুতা হৈল দশভুজা/যেইরূপে অবনীমন্ডলে নিলা পূজা/........./বামে শিখিবাহন দক্ষিণে লম্বোদর/বৃষে আরোহণ শিব ... মস্তক উপর/দক্ষিণে জলধিসুতা বামে সরস্বতী/সন্মুখেতে দেবগন করে নানা স্তুতি/.........ইত্যাদি।
     - বিভিন্ন পুরাণে অবশ্য দুর্গার সন্তান-সন্ততিদের কথা বিভিন্ন গল্পে ফলাও করে দেওয়া আছে, তাই না?
     - হ্যাঁ, এক এক পুরাণে এক এক রকম আছে। মজার কথা কি জানো, সরস্বতী হচ্ছেন ঋগ্‌বেদের দেবী, দুর্গার চেয়ে প্রায় দেড়-দু হাজার বছরের বড়ো তিনি। আমরা বাঙালীরা তাঁকে দুর্গার মেয়ে বানিয়ে দিয়েছি। দেবী সরস্বতীর কি বিড়ম্বনা! আর একটা কথা, মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুযায়ী দেবী কিন্তু মহিষাসুরকে খড়্গাঘাতে ‘শিরশ্ছিত্বা নিপাতিতঃ’ করে নিধন করেছিলেন, তোমাদের পুজো প্যান্ডেলের মতো শূলে বিদ্ধ করে নয়।

     মাস্টার মশায়ের একটা ফোন আসাতে কিছুক্ষণ বিরতি। এক বিকেলের পক্ষে এত কিছু জানার পর আমার Information overload হয়ে গেল। একটুক্ষণ চুপ করে সব হজম করার চেষ্টা করলাম। মাস্টার মশায় ফোনে কোনো এক প্রকাশক মশায়কে আপনি-আজ্ঞে করে অনুরোধ করতে লাগলেন, বইয়ের পাওনা টাকার তাগাদা দিয়ে। মাথাটা ছাড়াবার জন্য মনটা কফি কফি করছিল, এমন সময় নীল-যমুনা বেয়ে এক কাপ করে কফি এসে হাজির হল।
নীল-যমুনা তার রিনরিনে গলায় আমাকে বলে উঠলো, তুমি জানো হুয়েন চোয়াং-এর লেখায় দুর্গার উল্লেখ আছে? সুরেলা গলা বেহালার তারের মতো বেজে উঠল।
     - তাই নাকি, জানতাম না তো? কি লেখা আছে? কফিতে চুমুক দিতে দিতে আমি বলার চেষ্টা করলাম।
     - হুয়েন চোয়াং-কে কিছু দস্যু গঙ্গাতীর থেকে তুলে নিয়ে যায় দেবী দুর্গার কাছে বলি দেবার জন্য, আর আচমকা এক ঝড় এসে তাকে রক্ষা করে।
     - ঠিক কথা, সেটা সম্রাট হর্ষের আমলে সপ্তম শতকের ঘটনা। মাস্টারমশায় তাঁর ফোন শেষ করে আমাদের আলোচনায় যোগ দিলেন - মেজাজটা ভালোই মনে হল, তার মানে প্রকাশক কিছু মালকড়ি ছাড়ছেন- বানভট্টের রচিত ‘চণ্ডী শতকম্‌’, কাদম্বরী কাব্যে বহুবার মহিষমর্দিনী দুর্গার উল্লেখ বা হর্ষচরিতে বাবার আরোগ্য লাভের জন্য চণ্ডীর কাছে শ্রীহর্ষের প্রার্থনা, এসবও আছে। তার মানে সপ্তম শতকের সময় দুর্গা যে যথেষ্ট জনপ্রিয় ভাবে পূজিত হতেন তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে।
     - কিন্তু বাবা, চণ্ডী আর দুর্গা কি এক দেবী? নীল-যমুনা যোগ দেওয়াতে এবারে আলোচনাটা ত্রিমুখী হল।
     - চণ্ডী বা দেবী চণ্ডিকা হচ্ছেন দুর্গারই করাল ভয়াল রূপ। কিন্তু দুর্গার চণ্ডী রূপটি সম্ভবতঃ অনার্য দেবতাদের প্রভাব। ভবিষ্যতের তন্ত্রমতের শুরু এঁর থেকেই। পুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী দেবী একাধারে শিবজায়া ও স্নেহময়ী মা আবার প্রয়োজনে দুষ্ট অসুরদের দমন করে শিষ্টের পালন করেন। সেই যুগে দুর্গার চিন্তা ও ভাবধারার ওপর আর্য ও অনার্য দু’রকম প্রভাবই দেখা যায়, তাই দুর্গার প্রশান্ত ও ভয়াল এই দুই রূপ। এছাড়াও পুরাণে দেবীর আরো অনেক রূপের উল্লেখ আছে। খেয়াল করে দেখো তৈত্তরীয় আরণ্যকম্-এর (TA 10.7.1)। দুর্গার প্রণাম মন্ত্রে ‘কাত্যায়নায় বিদ্মহে কন্যাকুমারী ধীমহি তন্নো দুর্গিপ্রচোদয়াৎ’ –একাধারে দুর্গা, কাত্যায়নী ও কন্যাকুমারী-কে প্রণাম করা হয়েছে। কাজেই দেখছো দুর্গা কেমন diversified ভাবে পূজিত হয়েছেন এবং এখনো হচ্ছেন।
     - প্রোফেসর, আমরা দুর্গার ওপর বিদেশি প্রভাব দেখলাম, অনার্য প্রভাব দেখলাম, তাহলে দুর্গার ওপর বৈদিক প্রভাব কি কিছুই নেই?
     - আর দুর্গা নামটাই বা প্রথম কোথায় পাওয়া যায়? আমার ও নীল-যমুনার যুগপৎ প্রশ্নে মাস্টারমশাইয়ের মুখে একগুচ্ছ হাসি।
     - তিষ্ঠ, তিষ্ঠ!! তোমাদের দুজনের প্রশ্নের একটাই উত্তর। মিটিমিটি হেসে মাস্টারমশায় এবার নীল-যমুনাকে জিজ্ঞাসা করলেন, – তোমার দুর্গা-সুক্তম্‌ মনে আছে? তার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্লোকটা বলবে?
     - দাঁড়াও মনে করি, হুঁ হুঁ হুঁ.........মনে পড়েছে! প্রথমটা হচ্ছে ‘ওম্‌ জাতবেদসে সুনবাম সোমমরাতীযতো নি দহাতি বেদঃ/স নঃ পর্ষদতি দুর্গানি বিশ্বা নাবেব সিন্ধুং দুরিত্যাতগ্নিঃ’।
     - প্রথম শ্লোকটি ঋগ্‌বেদে (RV 1.99) এই শ্লোকটি অগ্নির উদ্দেশ্যে রচিত, এখানে দুর্গা বলতে দুর্গম সিন্ধুর বলা হয়েছে। যা একটু আগে বলছিলাম, দুর্গমতার সাথে দুর্গার সম্পর্ক, সেটা এখানে ফুটে উঠেছে। আর দ্বিতীয়টা শ্লোকটা?
     - দ্বিতীয় শ্লোকটা হচ্ছে ‘ত্বম্‌ অগ্নিবর্ণা তপসা জ্বলন্তীম্‌ বৈরোচনীম্‌ কর্মফলেষু জুষ্টাম্‌/দুর্গাং দেবীং স্মরনমহং প্রপদ্যে সুতরসি তরসে নমঃ’      – ঠিক বলেছি?
     - একদম ঠিক। দ্বিতীয়টি ঋগ্‌বেদে খিল অংশে (RV Khilani 4.2.1) পাওয়া যায়। এই শ্লোকটিতে দুর্গাকে দেবী হিসেবে সম্ভবতঃ সর্বপ্রথম উল্লেখ।
     - কিন্তু ঋগ্‌বেদে তো দুর্গার কোন উল্লেখ আমি পাইনি- আমি আশ্চর্য হয়ে বলে উঠলাম।
     - ঋগ্‌বেদের খিল অংশগুলি মূল ঋগ্‌বেদের অংশ বলে ধরা হয় না, এগুলি অনেক পরে ঋগ্‌বেদে সংযোজিত হয়েছে। তাই মূল ঋগ্‌বেদে দেবী দুর্গার সরাসরি কোনো উল্লেখ নেই। বেদের পরে রচিত তৈত্তরীয় আরণ্যকম্‌-এ (TA 10.2.1) দুর্গা-সুক্তের বাকী শ্লোকগুলি আছে। সেগুলি যদি দেখ তাহলে বুঝবে যে আসলে শ্লোকগুলি অগ্নির উদ্দেশ্যে রচিত। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে যে post-vedic সাহিত্যে অগ্নিকেই কি দুর্গা বলা হয়েছে? আবার কেনোপনিষদেও হৈমবতী উমার (3.12) উল্লেখ আছে, যা সম্ভবতঃ অনেক পরে রচনা ও প্রক্ষিপ্ত।
     - আর রামায়ণ মহাভারতে যে দুর্গার উল্লেখ আছে?
     - রামায়ণ-মহাভারত মহাকাব্য, এদের মহাকাব্য হিসেবেই দেখো, এদের মধ্যে এত প্রক্ষিপ্ত অংশ আছে, এদের মধ্যে দুর্গার ইতিহাস খোঁজা উচিত নয়। তবে দেবী-মাহত্ম্যম্‌-এর একটি শ্লোক “ইত্থং যদা যদা বাধা দানবোত্থা ভবিষ্যতি/তদা তদাবতীর্যাহং করিষ্যাম্যরিসঙ্ক্ষয়ম্‌”, এর সাথে গীতার সেই বিখ্যাত শ্লোক “যদা যদা হি ধর্মস্য...”, তার সাথে আশ্চর্য মিল আছে।
     - বাবা, একটু আগে তুমি বললে ঋগ্‌বেদে দুর্গার উদ্দেশ্যে সরাসরি কোনো উল্লেখ নেই, তাহলে কি অন্য ভাবে কিছু বলা আছে? নীল-যমুনা এবারে অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে।
     - দ্যাখো, দেবী-মাহাত্ম্যে দুর্গাকে সম্বোধিত করা হয়েছে সর্বভূতে বিরাজমানা, বিশ্বেশ্বরী, তিনিই ত্রিমাত্রিক ওঁকার ও আদিশক্তিরূপিনী সনাতনী, তিনি সমস্ত দেবতাদের আধার, সারা বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের ধারক ও পালক, তাঁর মাঝেই সবকিছু। দেবী আদ্যাশক্তি সনাতনীর এই core concept-টা ঋগ্‌বেদে্র একটা সুক্তে আছে, যেটা তোমরা সবাই জানো ও শুনেছ।
     - ঋগ্‌বেদে্র একটা সুক্তে আছে যা আমরা সবাই জানি? সেটা কি? আমি ও নীল-যমুনা চোখে চোখ রাখি, আজ এখানে আসার পরে এই প্রথম।
     - মহালয়ার ভোরে মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানের সেই বিখ্যাত গানটি ‘অহং রুদ্রেভি বসুভি’। গাও তো মা গানটি।

     নীল-যমুনা সুরেলা গলায় শুরু করল ‘অহং রুদ্রেভি বসুভিশ্চরাম্যহম্‌ আদিতৈরুত বিশ্বদেবৈ/ অহং মিত্রাবরুণোভা বিভর্ম্যহমিদ্রাগ্নি অহমশ্মিনোভা/ অহং সোমমাহনসং বিভর্ম্যহং ত্বষ্টারমুত পূষনং ভগম্‌/ অহং দধামি দ্রবিণং হবিষ্মতে ......’। শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, সত্যিই তো, বাক্‌ রূপিনী দেবী বলছেন আমিই রুদ্র, বসু, আদিত্য, বিশ্বদেবদের চালনা করি, আমিই মিত্র-বরুণ, ইন্দ্র, অগ্নি, অশ্বিনীদ্বয়কে ধারন করি। আমিই সোমকে ধারন করি ও যজ্ঞের ফলও আমিই প্রদান করি। এই গানটি কতবার শুনেছি কিন্তু কখনো ঠিক মন দিয়ে শুনে বোঝার চেষ্টা করিনি। শুনলে বুঝতে পারতাম দেবী বলছেন তিনিই সমস্ত কিছুতে পরিব্যপ্ত হয়ে আছেন, তিনিই বিশ্বের উৎস। এর মাঝেই তাঁর ‘বিশ্বস্য বীজং পরমাসি মায়া’ রূপটি লুকিয়ে আছে।

     গান শেষের ঝংকার সারা ঘরে কুটোপুটি খেতে লাগল। মাস্টারমশায় বলে উঠলেন, এটা হচ্ছে ঋগ্‌বেদে দশম মণ্ডলের ১২৫ তম সুক্ত, এর ঋষি বাক্‌-আম্ভৃণী আর দেবতা হচ্ছেন আত্মা। ঋষি আম্ভৃণ কন্যা বাক্‌ দেবত্ব প্রাপ্ত হয়ে একথা গুলি বলেছিলেন। একে দেবী-সুক্ত বা বাক্‌-সুক্তও বলা হয়। ইন্দ্র, অগ্নি, মিত্র-বরুণ ইত্যাদি ঋগ্‌বেদের প্রধান দেবতাদের ছাড়িয়ে, সমস্ত কিছুর আধার ও সব কিছুর মূল এক সনাতনী দেবীর উল্লেখ আছে এই সুক্তে। বৈদিক যুগের শেষের দিকে যে ঋষিরা বেদের বহুদেবতার ওপরে একেশ্বরবাদের খোঁজ করছিলেন, তারই এক উদাহরণ এটি। এখানে দুর্গা সম্পূর্ণ বৈদিক ও ভারতীয়। এখানেই প্রচ্ছন্ন আছেন ‘যা দেবী সর্বভূতেষূ চেতনেত্যভিধীয়তে’। এখানেই আছে ভবিষ্যতের দুর্গার বীজ।
     - অপূর্ব!! সেই বীজ আজ মহীরূহরূপে দিকে দিকে পূজিত হচ্ছেন। একটু থেমে বললাম - দেবীর দুর্গার সব প্রশ্নের তো সুরাহা হল। কিন্তু আরও একটা প্রশ্ন মাথায় খোঁচা মারছে।
     - সেটা কি?
     - প্রোফেসর আপনি একটু আগে কি যেন বললেন শিবের কি একটা অনার্য সম্বন্ধ আছে আর কুষান যুগে মুদ্রায় গ্রীক দেবতা ওশো নাকি আসলে শিব। সেটা একটু খুলে বলবেন?
     - না ডিনার দেওয়া হয়েছে, আজ আর শিবের গীত শুনে কাজ নেই। সেটা অন্যদিনের জন্য তোলা থাক। নীল-যমুনা চোখে বিদ্যুৎ খেলিয়ে আদেশ করল। আদ্যাশক্তির অংশ বলে কথা, সে আদেশ অমান্য করে কার সাধ্য! আমরা সকলে ডিনার মুখো হলাম।

      লেখক পরিচিতি - দিলীপ যাদবপুর ও ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্‌টিটিউট অফ সায়েন্সের প্রাক্তনী। বিগত ষোল বছর আমেরিকার সেন্ট লুইস্‌ (মিসৌরী) শহরবাসী। ইতিহাস পেশা নয়, নেশা। অবসর সময়ে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, বিশেষতঃ Indology নিয়ে নাড়াচাড়া করেন। দেশভ্রমন ভালোবাসেন, আজ পর্যন্ত ঊনিশটি দেশ হয়েছে, আশা করা যায় সংখ্যাটি ভবিষ্যতে আরো বাড়বে।

Selected bibliography

Agarwala R C, The Goddess Mahisasuramardini in Early Indian Art, Artibus Asiae Vol 21, No 2, 1958
Coburn T, Devi-Mahatmya: Crytalization of the Goddess Tradition, Motilal Banarasidass, New Delhi, 1984
Pal Pratapaditya, Indian Sculpture Vol-1 (500 BC – 700 AD), Los Angeles County Museum of Art and University of California Press, 1986
Mazumdar B C, Durga: Her Origin and History, Journal of Royal Asiatic Society, Apr 1906, Cambridge University Press
Mukherjee B N, Nana on Lion, Asiatic Society, Calcutta, 1969
Sircar D C, Studies in Religious Life of Ancient and Medieval India, Motilal Banarasidass, New Delhi, 1971
Sircar D C, The Sakta Pīṭhas: Volume 8 of Religion and Ethics Series, Motilal Banarsidass, 1998
Veinot, Odette, Goddess Mahisasuramardini in Kushan Art, Artibus Asiae, Vol 19 No 3 /4, 1956
Whitehead R B, Catalogue of Coins in Punjab Museum, Lahore (Vol-1), Oxford University at the Clarendon Place, 1914

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।