প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিবিধ প্রসঙ্গ

মার্চ ১৫, ২০১৭

 

সিগারেটের ধোঁয়া, এক জোড়া ঠোঁট, আর একটি কবিতার গল্প   

মাহফুজুর রহমান


এই বুড়ো বয়সে এইসব লেখা মানানসই হবে কিনা জানি না। লেখা হয়ত উচিত ছিল সেকালেই, সেই বছর তিরিশ আগে। দীর্ঘ কালক্ষেপ শেষ পর্যন্ত আমাকে নিয়ে এলো অবসরে। আগে লিখলে খুশি হতেন সুভাষ ধর, খুশি হতেন আরও ক’জন। ওঁরা আজ কেউ আমাদের মাঝে নেই।

ম্যানহ্যাটানের ওয়েস্ট সাইডে সুভাষ ধরের এপার্টমেন্ট। লিভিং রুমটা গম গম করছে অতিথিতে। খাবার পাট চুকে গেছে । পানীয়ের গ্লাস হাতে নিয়ে বসে পড়েছে সবাই, যে যেখানে পেরেছে। কেউ হয়ত মেঝের ওপরে কুশন ফেলে। গোড়াতেই ঈষৎ নাজেহাল হয়েছি। বলে ফেলেছিলাম, বাঙ্গালির পার্টি মানেই নারীপুরুষ অনেকটা ছানা কাটলে যেমন ছানা আর জল আলাদা হয়ে যায়, তেমনি মেয়েরা হয়ে যায় একদিকে, আর পুরুষেরা রয়ে যায় অন্য দিকে। সুভাষ ধর টিপ্পনি কাটতে ছাড়লেন না, তবে আমার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার প্রশংসা না করেও পারলেন না। তবু আজকে যেন জলটাকে পুরোপুরি ছাড়তে পারেনি ছানা। মহিলা-পুরুষ সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ঘর জুড়ে। আমার পর্যবেক্ষণ খানিকটা নাকচ করে দেবার জন্যই বুঝি। আমার স্ত্রী বসেছে ওর এক প্রিয় বান্ধবীর সঙ্গে।

অরেঞ্জ জুসের গ্লাস হাতে নিয়ে বার কয়েক উঠে আর খানিকটা ঘুরে এসে, একটা চেয়ার খালি পেয়েই বসে পড়লাম। হাত কয়েক দূরে বসে আছেন যিনি তাঁকে আগেও দেখেছি দু’একবার। ছিপছিপে, ফর্সা, গায়ে হাতকাটা ব্লাউজ। পরনে শিফন শাড়ী। চুল বাঁধার স্টাইল ঠিক বিশেষ ছকে ফেলা যাবেনা বোধহয়। ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক। নখে লাল পলিশ। এক হাতে একটি বেঁটে গ্লাসে পানীয়। অন্য হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে সিগারেট। ঘরের অভ্যাগতদের আরও বেশ ক’জন ধূমপান করে চলেছেন।

আমি বসে পড়তেই স্মিত হেসে আলাপ জুড়ে দিলেন মহিলা। আমার বাঙ্গালত্ব সম্বন্ধে মহিলার কোনও সন্দেহ নেই। জানালেন ঢাকায় গেছেন বার দুয়েক, সেই বহুকাল আগে। আবার যাবার ইচ্ছে খুব। কেন যে দেশটা ভাগ হল !

নিজের আর অন্যের সিগারেটের হাল্কা ধোঁয়ায় মহিলার মুখটা আবছা হয়ে আসছে আমার চোখে। উনি বলে চলেছেন দেশের কথা, দেশ ভাগের কথা। আরও হয়ত অর্ধ ডজন বাঙালি মুখও কথা বলে চলেছে একই সাথে, ঘরের স্বল্প পরিসরে। মহিলার মুখনিঃসৃত বাক্যের অনেকটাই আমি শুনতে পাচ্ছি না। অনেকটা অনুমান নির্ভর হয়ে ওঠে আলাপচারীতে আমার ভূমিকা।

কথা বলে চলেন মহিলা। শুরু করেন একটি কবিতা। হঠাৎ করেই শুরু। প্রথম পঙক্তির দুএকটি শব্দ কানে এলো। যেমন, আমরা। তার সাথে তাল মিলিয়ে মহিলার ফরসা আঙ্গুল একে একে ছুঁয়ে এলো দু’চোখের কোন দু’টিকে। পরক্ষণেই তাঁর প্রসারিত তর্জনী প্রাচীরের মত নেমে এলো তাঁর নাকের ওপরে লম্বালম্বি হয়ে। চোখ দুটো হয়ে ওঠে হঠাৎ উদ্বিগ্ন। একটু যতি। তার পর মহিলা দু’হাত বাড়িয়ে অদৃশ্য কিছু খুলে ফেললেন দ্রুত, অনেকটা দুয়ার খোলার মত। তর্জনীতে জাগে কিসের যেন ইঙ্গিত। আর সাথে সাথেই যেন তাঁর চোখে ফিরল এক স্বস্তি। কুড়ি সেকেন্ডে মহিলা এঁকে ফেললেন একটি কবিতার ছবি।

একটু পরেই চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন মহিলা। অন্য একজন আসনটা দখল করে তৃতীয় কোনও গেস্টের সাথে আলাপ জুড়ে দিলেন। আমিও উঠে পড়ি। ঢুকে পড়বার চেষ্টা করি অন্য কোনও আলাপচারীর আবর্তে। রাত বাড়ে।

আবার ড্রাইভ করে ফিরছি ম্যানহ্যাটানের ওয়েস্ট সাইড থেকে ইস্ট সাইডে, নিজের এপার্টমেন্টে। মাথায় তখনো ঘুরপাক খাচ্ছে মহিলার কবিতা আবৃত্তি। যে আবৃত্তির মাত্র কয়েকটি শব্দ মাত্র আমি শুনতে পেয়েছি। কি নাম কবিতার। কে কবি? কথার ভিড়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নাম শুনতে পেলাম বুঝি একবার।

মাথার ভিতরে একটি অদ্ভুত কবিতা বয়ে নিয়ে ম্যানহ্যাটানের ট্রাফিকে গাড়ি চালিয়ে ঘরে ফিরি। বইয়ের ভিড় থেকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার বই খুঁজে বের করি। পাতা উল্টাই। বেশি দূর যেতে হল না। এই সেই কবিতা। নিঃসন্দেহে এই সেই কবিতা। এই সেই ছবি –

আমরা যেন বাংলাদেশের
চোখের দুটি তারা।
মাঝখানে নাক উঁচিয়ে আছে –
থাকুক গে পাহারা ।

দুয়ারে খিল।
টান দিয়ে তাই
খুলে দিলাম জানলা।

ওপারে যে বাংলাদেশ
এপারেও সেই বাংলা।।



লেখক পরিচিতি - বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। বহু বছর নিউ ইয়র্কে ইউনাইটেড নেশনস-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মূলতঃ ইংরেজিতেই লেখেন। বাংলাতে লিখেছেন অল্প কয়েকটি বই , যার মধ্যে একটি ওঁর স্মৃতিকথা -- 'কত ঘরে দিলে ঠাঁই'। বইটি ২০১৩ সালে বাংলাদেশের আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছে।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2015 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।