প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিবিধ প্রসঙ্গ

জুলাই ৩০, ২০১৭

 

ফরগেট-মি-নট

মাহফুজুর রহমান


  ১৯৪৯। পড়ছি ঢাকা কলেজে। ইংরেজি ক্লাস। কবিতা পড়ান আজহার স্যার, ওরফে আজহার হোসেন।  সর্বদা স্যুট-টাই পরে কলেজে আসেন। এক স্যুট পর পর দু’দিন পরেন না। স্যুটের ভাঁজ সর্বদা পরিপাটি। দীর্ঘ,  ঈষৎ কোঁকড়ানো, চুল ব্যাকব্রাশ করা। হাঁটেন  দ্রুত, দেহ সামনের দিকে বেশ কয়েক ডিগ্রী ঝুঁকিয়ে।  পড়ান শেলী কীটস ওয়ার্ডসওয়ার্থ ।  

ইংরেজ রোমান্টিক কবিদের কবিতায় ছড়িয়ে রয়েছে বেশ কিছু ফুলের নাম। স্যার ফুল ভাল বাসেন। আমরা, তাঁর ছাত্ররাও , ভালবাসি। ক্লাসের জানালা দিয়ে চোখে পড়ে সবুজ লনে ডালিয়া- চন্দ্রমল্লিকার সমারোহ। শীতের মিষ্টি রোদে জেগে উঠে আমাদের মন উদাস করে তোলে। ক্লাসে বসে থাকতে ভাল লাগে? স্যার বলে চলেন অন্য সব বিলিতি ফুলের কথা যার নামও কখনো শুনিনি আমরা। আর একদিন হঠাৎ করেই বলে উঠলেন Forget- me- not নামটি। না, আমরা ও ফুল কখনো দেখিনি। নামও শুনিনি। আমার বাগানে আছে, বলেন স্যার । উনি বাস করেন ঢাকার  উয়ারীতে।  শহরের একটি অভিজাত এলাকা উয়ারী। ছোট্ট ফুল, হাল্কা নীল, তুলে নিয়ে গায়ের জামায় সেঁটে দিলে লেগে থাকে, আর তাই ফরগেট-মি-নট,  বলেন স্যার। তারপর কবিতায় ফেরেন। একটি  বিদেশি ফুল কেন জানি হঠাৎ ওঁর সঙ্গে দূরত্বটুকু আরও বাড়িয়ে দিল আমার।       

বহুকাল কেটে গেছে । ফরগেট-মি-নট-এর কথা ভুলে গেছি বেমালুম। বছর পনেরো পরে সেই রোমান্টিক কবিদের দেশে গিয়েছি ইকনমিক্স পড়তে। ফরগেট-মি-নট- এর কথা মনে পড়েনি কখনও।   

এর পরও বহুদিন  ভাবিনি ফরগেট-মি-নট-এর কথা। 

আমাদের নিউ ইয়র্ক জীবনের গোড়ার দিকে এক পথ মেলায় হাতে পেলাম দারুণ একটি সচিত্র ফুলের বই। ওটাই আমার আজকের  এক শেল্‌ফ ফুলের বইয়ের সারির শুরু। পাতা উল্টে চলেছি।  হঠাৎ চোখে ভেসে উঠল  Forget- me- not. কেতাবের ভাষায় Myosotis sylvatica . এক- দেড় ফুট উঁচু ঝোপ-গুল্ম। ছোট, বিরল, পাতাগুলো লম্বাটে ও ঈষৎ রোমশ। ছোট্ট, হাল্কা নীল ফুলগুলো ছোট্ট গুচ্ছে বিন্যস্ত। কথিত আছে, মধ্যযুগের এক “নাইট’ তার প্রেয়সীর জন্য নদীতীরে ফুল তুলতে গিয়ে পড়ে যায় নদীতে। নদী- স্রোত প্রেমিক নাইটকে দ্রুত টেনে নিয়ে যায় মৃত্যুর পানে । তার শেষ মিনতি থেকেই  নাকি ফুলটির নামের উৎপত্তি – ফরগেট-মি- নট! ফরগেট-মি-নট!

বাস করি  ম্যানহ্যাটানের  এক হাইরাইজে।  কবিগুরুর মত আমারও বহুকাল মনে ছিল আশা ধরণীর এক কোনে এইটুকু বাসা ভাগ্যে জুটবে। তা আর জুটল কোথায়? রয়ে গেলাম  ম্যানহ্যাটানে তিন যুগের অধিক কাল। ফরগেট-মি-নট আবার মিলিয়ে গেল মন থেকে। এপার্টমেন্ট ভর্তি করেছি প্রধানত: বাংলার ফুলের টবে। জবা, বেলি, দোলনচাঁপা, গন্ধরাজ, মায় রজনীগন্ধা। 

শতাব্দীর শেষ, আরেক শতাব্দীর শুরু। চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি বেশ কিছুদিন হল। দেশে যাই প্রতি বছর। এলেই ফুলের ছবি তুলে বেড়াই।  ওটা প্রায় বাতিকে  পরিণত হয়েছে। হঠাৎ করেই  বন্ধু আজহার, আজহারুল ইসলাম, বলে ওঠে একদিন, এই, আজহার হোসেন স্যরের বাড়ি যাবি? স্যরের সঙ্গে ওর দেখা হয় প্রায়ই রমনা পার্কে, প্রাতঃভ্রমণে। আজহারই খোঁজ দেয় কোথায় কোন ফুল ফুটেছে। 

গ্রীষ্মের এক শেষ বিকেলে উয়ারীর একটি দেওয়াল ঘেরা বাড়ির উঁচু লোহার পাতে গড়া বন্ধ গেটের সামনে দাঁড়াই দুই বন্ধু। পেছনে পঞ্চাশ বছরের পথ, যার শুরু ঢাকা কলেজে। মনে জাগে সদ্য ক্রিজ ভাঙ্গা স্যুট পরা আজহার স্যার। মাথা ভর্তি চুল ব্যাকব্রাশ করা। টাইয়ের নট সামান্য তির্যক ভঙ্গিতে জেগে আছে কলারে। আরও জাগে ওঁর ফুলের বাগান যা আমি কখনো চোখে দেখিনি, তবে আমার মনে যার মধ্যমণি ফরগেট-মি-নট ।

গেটের চোর দরজা ঠেলে সন্তর্পণে পা ফেলি। ভোজবাজির মত বাগানটি উধাও হয়ে যায়।  জেগে ওঠে একটি উঠোন। আগাছার ঝোপের সঙ্গে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অযত্নে বেড়ে ওঠা দু’চারটি ফুলগাছ। গেট থেকে একটি ইট-ঢাকা সরু পথ সোজা চলে গিয়ে ঠেকেছে একটি মাঝারি আকারের একতলা দালানে। বাড়ির আদি রঙ প্রায় ঢেকে দিয়েছে বহু বছরের রোদ বৃষ্টি বাদলা শেওলা।   

উঠোন থেকে দু’ধাপ  সিঁড়ি পেরিয়েই  বৈঠকখানা। বাঁয়ে জানালা ঘেঁসে একটি পুরোনো  সোফা। একটি ছোট টেবিল কফি টেবিলের কাজ করছে। টেবিলের আসে পাশে গুটি চারেক কাঠের চেয়ার। ঘরে ঢুকতেই  চোখে পড়বে অন্দরে যাবার দরজা। একটি অনতিপ্রস্থ পর্দা ঝুলছে তাতে। পর্দার ফাঁকে চোখে পড়বে একটি শোবার ঘরের একটি তক্তপোষের একাংশ।
কয়েক মূহুর্তেই পর্দা সরিয়ে প্রবেশ করেন আজহার স্যার। পরনে একটি বহু ব্যবহৃত সাদা শার্ট আর সাদা পাজামা । আজহার ওঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় আমার। সহাস্যে হাত বাড়িয়ে দেন স্যার। গালদুটো  তোবড়ানো, অনেকগুলো দাঁত খুইয়েছেন। মস্তক বিরলকেশ।

অনেক কথা হয় । স্যার অবসর নিয়েছেন অনেকদিন হল। একা থাকেন,। বিয়েথা  করেননি।  শুনেছি প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে আর বিয়ের কথা ভাবেননি। গোড়াতেই তুলি ঢাকা কলেজের কথা। বলি উনি আমাদের  চিনিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন ফরগেট-মি-নট। স্যর মুগ্ধ। এটাও তোমার মনে আছে? মহা উৎসাহে বলে ওঠেন উনি। হয়ত ওঁর দীর্ঘ অধ্যাপনা জীবনে কেউ বাঙালির অচেনা ওই ফুলটার উল্লেখও করেনি কখনও। ওঁর সেই বাগানের কথা তুলতেই বলেন, সত্যিই  একটি সুন্দর বাগান ছিল সে  জামানায়। আর ফরগেট-মে-নট ছিল সে বাগানে।  ওঁকে আমার সদ্য প্রকাশিত বাংলার ফুলের বইটা উপহার  দিলাম। দারুণ খুশি স্যর। বিশেষ করে আমার বাংলার ফুলের দিকে ঝোঁক দেখে। বলেন আর সবাইকে দেখাবেন আর রিভিউও করবেন। অনেকটা সময় কাটিয়ে বিদায় নিই। বলি আবার আসব। এসেছিও। যতবার ঢাকায় এসেছি।সাথে বন্ধু আজহার।  উনি খুব খুশি হয়েছেন।

আরও অনেকগুলো বছর কেটে গেল। বছর কয়েক আগে হঠাৎ করে ভাগ্যে জুটে গেল  এতটুকু এক বাসা। এক চিলতে সবুজ লন আর সবুজ ব্যাকইয়ার্ড।  নিউইয়র্কের এক শহরতলীতে আমাদের ছোট্ট বাড়ি। ফ্লাওয়ার বেডের স্থান সীমিত। প্রায় কিউয়ে দাঁড় করিয়ে বছরকয়েক ধরে ফুলের গাছ লাগাই – সন্ধ্যা মালতী, নয়নতারা, কসমস, ন্যাস্টার্শিয়াম, গ্লাডিওলাস, পরটুলিকা। টবের বেলি, জবা, গন্ধরাজ, আর হাসনাহেনা বাইরে এনে সাজিয়ে রাখি সার বেঁধে।

২০১৬। সযত্নে লালন করা এক সারি  চারা  ধীরে জেগে ওঠে বাগানের এক প্রান্তে। প্রতিদিন পরখ করি কতটা বাড়ল। একদিন একটি গাছে এল অতি ক্ষুদ্র একটি কলি। দেখতে দেখতে গাছগুলো ভরে গেল ফুলে ফুলে। হাল্কা নীল। গড়ন সেকালের বাঙালি নারীর নাকফুলের মত।  পাঁচটি অতিক্ষুদ্র পাপড়ি।  ফরগেট-মি-নট।  

অধ্যাপক আজহার হোসেন চলে গেছেন। তাঁকে বলা হল না, সাতষট্টি বছর আগে তাঁর ক্লাসে যে ফুলটির কথা তিনি আমাদের শুনিয়েছিলেন, সেটা এতদিনে আমার বাগানে। বন্ধু আজহারও চলে গেছে। ওকেও বলা হল না।

আর হ্যাঁ ,স্যারকে বলা হল না ফুলটা আমার শার্টের সঙ্গে কিছুতেই সেঁটে থাকতে চাইল না।    



লেখক পরিচিতি - বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। বহু বছর নিউ ইয়র্কে ইউনাইটেড নেশনস-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মূলতঃ ইংরেজিতেই লেখেন। বাংলাতে লিখেছেন অল্প কয়েকটি বই , যার মধ্যে একটি ওঁর স্মৃতিকথা -- 'কত ঘরে দিলে ঠাঁই'। বইটি ২০১৩ সালে বাংলাদেশের আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছে।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2015 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।