প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

সাহিত্য

জানুয়ারি ৩০, ২০১৬

 

বহু শ্রুত এবং চর্চিত বাংলার লোকসাহিত্য

ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়


বাংলার প্রাচীনতম লোকসাহিত্য চর্যাপদ। বহু পদকর্তার লেখনীতে সমৃদ্ধ এই চর্যাপদ প্রধানত বজ্রযানী বৌদ্ধধর্মকে আশ্রয় করে রচিত। বাংলার লোকসাহিত্যে আধ্যাত্মিকতার একটা সূত্র গাঁথা ছিল সেই তার আদিম জন্মলগ্নেই। তারপর মধ্যযুগের কবি বড়ু চন্ডীদাসের রচনা সমৃদ্ধ করেছে বাংলার লোকসাহিত্যকে।

প্রাচীনতম বাংলা লোকসাহিত্য চর্যাপদ

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের প্রাচীনতম কবি চন্ডীদাস শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রচয়িতা লিখেছিলেন সেই বিখ্যাত উক্তি “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই ” ! একদিন ঘুরতে ঘুরতে রাজ দরবারে নিজের ভুর্জ্যপত্রের পুঁথিখানি খুলে বিনা প্রস্তুতিতে ঝুমুর গান শুনিয়ে রাজাকে তৃপ্ত করেন। আর তখনি রাজা নানুরের বাসলী দেবীর মন্দিরে পৌরোহিত্য করার ভার দেন তাঁকে। মন প্রাণ এক করে চন্ডীদাস তখন শ্রীকৃষ্ণকথার পর পর পর্বগুলির পদ আওড়ান মনেমনে আর সাথে সাথে লিখে ফেলতে থাকেন । এহেন পদকর্তার পদরচনায় প্রেরণা যুগিয়েছিলেন তাঁর সহজসঙ্গিনী রজকিনী রামী। মনে পড়ে যায় চন্ডীদাসের সেই মধুর পদ

"রজকিনী-রূপ কিশোরী স্বরূপ কাম-গন্ধ নাহি তায়
রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম বড়ু চন্ডীদাস গায়"

একদিকে রজকিনী রামীর সাথে প্রেম অন্যদিকে পদরচনা। চন্ডীদাস পড়ে যান দোলাচলে

"শুন রজকিনী রামি, ও দুটি চরণ শীতল জানিয়া শরণ ল‌ইনু আমি"

ক্রমে রামির প্রেম এবং বাসলীদেবীর আশীর্বাদ দুই মিলে যে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যগ্রন্থ তিনি রচনা করে গেছেন তা আজো বাংলাসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।

হার কঙ্কন বড়ায়ি সুন্দর কহ্নাঞি বাঁশী বাএ সুললিত ছান্দে।।
হার কঙ্কন বড়ায়ি সব তেয়াগিবো সুণী তার বুক কেবা বান্ধে।।
চলি জাইতে চাহোঁ পাহ নাহি চলে হারায়িলোঁ সখিজন সঙ্গে।।
এবে বাঁশীনাদ সুণী দেহ কাহ্ন আনী গাইল চন্ডীদাস বাসলীচরণে।।

চন্ডীদাসের হাত ধরে আরো এক কবির লেখায় রাধা কৃষ্ণের শাশ্বত প্রেমের কথা পাই তিনি হলেন মিথিলার কবি বিদ্যাপতি। তাঁর ব্রজবুলি ভাষায় রচিত পদগুলি এত সুমিষ্ট যে তাঁকে বলা হত "মৈথিল-কোকিল" বা “মিথিলার কালিদাস”। মিথিলা থেকে বাংলায় ছুটে এসেছিলেন তিনি চন্ডীদাসের সাথে দেখা করতে। রাধাকৃষ্ণের শাশ্বত প্রেম, বিরহ, বিচ্ছেদ, রাগ-অনুরাগ বিদ্যাপতির হাতের যাদুতে যেন অবশ করে আমাদের মনকে এখনো।

"মাধব বহুত মিনতি করি তোয়
দিয়ে তুলসী তিল দেহ সমর্পিণু
দয়া জানি ছোড় বিমোহে"

অথবা বর্ষার ঘনঘটায় পাগলপ্রায় রাধার মনের ব্যাকুল বিরহের প্রতিধ্বনি শুনি

"সখি হামার দুখের নাহি ওর, ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর"

কালীঘাটের পট - শিবদুর্গা

আর বিদ্যাপতির সাহিত্য রসে বাংলাভাষা মৈথিলির সাথে মিলেমিশে ব্রজবুলির অপূর্ব এক মিষ্ট আবহ রচনা করেছিল।

এরপর রামায়ণ ও মহাভারত এই দুই সংস্কৃত মহাকাব্যের বাংলা অনুবাদ পাই আমরা। সাধারণ মানুষের বোধগম্য হল রামায়ণ ও মহাভারত। ধর্ম ও সাহিত্য উভয়েই মানুষের জন্য সৃষ্ট। আর সৃষ্টিশীল মানুষের জীবনও সাহিত্য নির্ভর। তাই বুঝি বাংলার লোকসাহিত্য কিছুটা ধর্মকেন্দ্রিক, কিছুটা অধ্যাত্মবাদে পুষ্ট। ধর্মের কথা লেখা আছে বলে মানুষ বুঝি এগুলি মনোযোগ দিয়ে পাঠ করে আসছে। তার প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলার লোকশিল্প পটচিত্র দেখলে। লোকশিল্প ও সাহিত্য যেখানে মিলেমিশে এক হয়ে যায়। বোঝা যায় যে বাংলার লোকসাহিত্যে অন্যতম স্থান দখল করে রয়েছে দুই মহাকাব্য। নানা কবির অনুবাদে কৃত্তিবাসী রামায়ণ ও কাশীরাম দাসের মহাভারত সাহিত্যের গবেষণার বিষয় হয়ে এসেছে। বাংলার ঘরে ঘরে এই দুই মহাকাব্যের কাহিনী সর্বজনবিদিত। তাই আজো পটুয়াদের মুখে মুখে শুনতে পাই রামায়ণ ও মহাভারত নিয়ে তাদের লেখা স্বরচিত পটকবিতা যা তাদের আঁকা পটচিত্রের সাথে যথেষ্ট সাযুজ্য রেখেই রচিত।

বিবাহ হৈল, রামচন্দ্রের হৈল অধিবাস, পিতৃসত্য পালিতে রাম চলেন বনবাস।
আগে চলেন রামচন্দ্র পশ্চাতে জানকী, তাহার পশ্চাতে চলেন লক্ষণ ধনুকী
উপরে রবির তাপ নীচে তাত বালি, চলিতে না পারে সীতা ননীর পুতুলী
ভাঙিল তরুর ডাল লক্ষণ ধরে শিরে, তার ওপর ছায়ালক্ষ্মী চলে ধীরে ধীরে
পঞ্চবটীর বনেতে রাম তুলিল হাওয়ালি, রামসীতা রয়েছেন বসে লক্ষ্মণ প্রহরী।

আবারো বাংলার লোকসাহিত্য বেঁচে থেকে যায় মানুষের মুখে মুখে, চর্বিত, চর্চিত তবুও সাহিত্যরসে টৈটুম্বুর।

বৈশম্পায়ন বলেন রাজা জনমেজয়ে, মহাভারতের কথা অমৃত আলোয়
একদিন নারদমুনি কৃষ্ণগুণ গাইতে, উত্ত্রীয়া গেলেন মুনি কৃষ্ণের সাক্ষাতে।
যে যাহা মাগেন কর্ণ তাহাই করেন দান, লোকমুখে শুনি কর্ণ বড়‌ই পুণ্যবাণ ।
একদিন যাব আমি কর্ণের নিকটে, বুঝিব সে কেমন বীর দাতা কর্ণ বটে ।

সেই যুগ যুগ আগে যে সাহিত্যরস সৃষ্টি হয়েছিল সেই সাহিত্য রস নানাভাবে মানুষের মধ্যে দিয়ে, লোক শিল্পের মধ্য দিয়ে বেঁচে থেকে গেছে। শুধু বদলেছে স্থান, কাল ও পাত্র।

এরপর বাংলা সাহিত্যের ভান্ডার সমৃদ্ধ হয় বৈষ্ণবসাহিত্যের মাধুরীতে। শ্রীচৈতন্যের জীবনকে কেন্দ্র করে বৃন্দাবন দাস রচনা করেন চৈতন্যভাগবত। তারপর জয়ানন্দ ও লোচনদাসের চৈতন্যমঙ্গল এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত ঢুকে পড়ে বাংলার লোকসাহিত্য তথা লোকসঙ্গীত বা কীর্তনে। জয়ানন্দ বাংলায় গেয়ে ওঠেন তাঁর পদে, যেখানে পিতা জগন্নাথ মিশ্র দেহত্যাগের পূর্বে নিমাইকে বলছেন

" আমার বচনে বাপু কর অবধান। তোমার মায়ের যেন নহে অপমান।।
তোমার অবতারে সর্বলোক পরিত্রাণ। গয়াতে আমার বাপু দিও পিন্ডদান।।"

বৃন্দাবন দাস ঠাকুর লিখলেন মহাপ্রভু ও নিত্যানন্দের লীলা নিয়ে

" দন্ড লৈলেন প্রভু শ্রীহস্তে তুলিয়া। চলিলেন গঙ্গাস্নানে নিত্যানন্দ লৈয়া।
শ্রীবাসাদি সবেই চলিলা গঙ্গাস্নানে দন্ড থুইলেন প্রভু গঙ্গায় আপনে"

নিমাই সন্ন্যাস নেবার পর বিষ্ণুপ্রিয়ার মনের কথা ফুটে উঠল লোচনদাসের পদে

" এথা বিষ্ণুপ্রিয়া চমকি উঠিয়া পালঙ্কে বুলায় হাত,
প্রভু না দেখিয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া শিরে মারে করাঘাত "

অথবা

"ত্বরিতে জ্বালিয়া বাতি, দেখিলেন ইতিউতি, কোনো ঠাঁই উদ্দেশ না পাইয়া
বিষ্ণুপ্রিয়া বধূ মনে পড়ি বহিরাঙ্গনে ডাকে শচী নিমাই বলিয়া"

বাংলার সাহিত্য ভান্ডারে এই মণিমুক্তাগুলি আজো কীর্তন রূপে গীত হয়। আর কীর্তন তো বাংলার প্রাচীনতম লোকসঙ্গীত যা মানুষের মুখে মুখে ভেঙে গড়ে স্বমহিমায় আজো প্রতিষ্ঠিত। তাই বাংলা সাহিত্য তথা লোকসাহিত্যে চৈতন্যমঙ্গল বা চৈতন্যভাগবতের সমতুল্য গ্রন্থ খুব কম আছে।

আজ আমরা শরতকালে মহাসমারোহে দুর্গোত্সবে সামিল হ‌ই। কিন্তু বাংলার লোকসাহিত্য বলে আমরা প্রতিনিয়ত‌ই এই দেবীর পুজো করে থাকি। দুর্গা আমাদের ঘরের মেয়ে বা নারী যাকে তুষ্ট রেখে আমাদের পথ চলা। বছরে ঐ পাঁচটি দিন দুর্গা বিশেষভাবে সর্বত্র পূজিতা কিন্তু বছরের বাকী দিনগুলোতেও তিনি আমাদের অভয় আর রক্ষাকবচ দান করেন।

বাংলাদেশের সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা মাটির বুকে শক্তির আরাধ্যারূপে পূজিতা দেবী শীতলা, মনসা, বাশুলি, ষষ্ঠী, মঙ্গলচন্ডী সকলেই মা দুর্গার অংশ বিশেষ। শ্রীশ্রীচন্ডীর একাদশ অধ্যায়ে আছে দেবী শাকম্ভরীর কথা। দেবী শাকম্ভরীর আরেক প্রকাশ হল অন্নপূর্ণা বা অন্নদা। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে এর উল্লেখ পাওয়া যায়।

বাংলার লোকসাহিত্যের ইতিহাসে মঙ্গলকাব্যের যে রমরমা, বাঙালী হয়ে আমরা তা অস্বীকার করতে পারিনা। বারোমাসের তেরোপার্বণে এই মঙ্গলকাব্যকে আশ্রয় করে বাংলার মা-বৌয়েরা আজো গ্রামে গঞ্জে ও শহরে মঙ্গলচন্ডী, মনসা, শীতলা, ষষ্ঠী ও অন্নপূর্ণার পুজোয় সামিল হন।

বাংলার সাহিত্য জগতে পঞ্চাদশ শতাব্দীতে মঙ্গলকাব্যের সূচনা হয়। মঙ্গলকাব্য হল সেইসময়কার বাংলার কবিদের রচিত কাব্য যার আখ্যান মঞ্জরী শ্রবণ ও পাঠ করলে মানুষের মঙ্গল হত। তবে মঙ্গলকাব্যের লোকায়ত চেতনায় দেবী দুর্গাই হলেন মধ্যমণি। তাঁকে কেন্দ্র করেই মানুষের মনে বিশ্বাস জাগাতে এই সাহিত্য সৃষ্টি। মঙ্গলকাব্য ভাঙতে ভাঙতে মিশে গেছে বাংলার সংস্কৃতির মধ্যে।

কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল থেকে শুরু করে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল সবেতেই নানারূপে মাদুর্গার শক্তির প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। দেবী মাহাত্ম্য প্রচারে মঙ্গলকাব্যের জুড়ি নেই। অন্নদামঙ্গলের একটি অন্যতম অংশে দেখি নৌকার মাঝি ঈশ্বরী পাটনীর সাথে দেবীর বাক্যালাপ। মাঝি একাকীনী স্ত্রীলোককে নৌকা পার করতে গিয়ে দেবীর পরিচয় জানতে চাইলে দেবী বললেন

"গোত্রের প্রধান পিতা মুখ্য বংশ জাত।
পরম কুলীন স্বামী বন্দ্যো বংশ খ্যাত।।
পিতামহ দিলা মোরে অন্নপূর্ণা নাম।
অনেকের পতিতেই পতি মোর বাম।।

নামী দামী সাহিত্যের সাথে পংক্তিভোজে আজো এই কবিতা বাংলার স্কুলে পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত।

চন্ডীমঙ্গলের ব্যাপ্তি যে কতটা সূদুরপ্রসারী তা লক্ষ্য করা যায় গ্রাম বাংলার অন্যতম লোকশিল্প পটুয়াদের আখড়ায়। চন্ডীমঙ্গল সেখানে অপভ্রংশ হতে হতে সুললিত বাংলাভাষার হাত ধরেই কিন্তু পটচিত্রকরদের হাতে হাতে ও মুখে মুখে ঘুরছে আজো।

একদিন দুর্গামায়ের হয়েছিল দয়া
ডালিম্ব তলাতে রত্ন দিল দেখাইয়া।
ডালিম্ব তলাতে রত্ন কালকেতু পেল কাটিয়া
রত্ন সে গুজরাটের নগর বসাল
ভারবন্দী করে বীর লয়ে যায় ঘরে
খুল্লনা বসিয়া দ্যাখে কুঁড়ের দুয়ারে
আগে আগে যায় সাধু পিছন পানে চায়
না জানি সে বুড়ির বেটি রত্ন নে পালায়
এমনি মতি তোর যে বাছা এমনি মতি তোর।
আপনার রত্নেতে গো আপনি হলাম চোর
দ্বাদশ বছর ছিল সাধু বন্দী কারাগারে
শ্রীমন্ত হৈল জন্ম খুল্লনার ঘরে …

চন্ডীমঙ্গলের নায়ক নায়িকারা পটুয়াদের মুখে মুখে এমনভাবেই বেঁচে র‌ইল।

মঙ্গলকাব্যের মধ্যে মনসামঙ্গল একটি বিরাট জায়গা দখল করে রয়েছে। মনসামঙ্গলের সাহিত্যস্রষ্টার সৃষ্ট প্রধান চরিত্রগুলি, বেহুলা, লখীন্দর, চাঁদবেনে আজো বাংলার পটশিল্পীদের তুলি এবং স্বরচিত কবিতার মধ্য দিয়ে বেঁচে রয়েছে।

মনসা জগতে গৌরী জয় বিষহরি, পদ্মফুলে জন্ম মা তোর মনসা কুমারী
নাগের হোল খাট-পালঙ্ক নাগের সিংহাসন, হংসপৃষ্ঠে নাগমাতা মনসার আসন
তরজে গরজে বেণী মোজড়ায় দাড়ি, কাঁধে নিল চাঁদ বেনে হেতালের বাড়ি
যদি বেটির ঢ্যামনীরে নাগাল আমি পাই, মারিব হেতালের বাড়ি কোমর চূড়ায়
সেই গান বিষহরি আপনি শুনিল, ক্রোধভরে চাঁদবেনের ছ'বেটারে খাইল

সেখানেই বেঁচে থাকে বাংলার লোকসাহিত্য।

এরপর যার কথা না বললে বাংলার লোকসাহিত্য অসম্পূর্ণ থেকে যাবে তিনি হলেন লালন সাঁই। তাঁর বাউল গানের মূর্ছনায় আজো কেঁপে ওঠে বাংলার লোকসাহিত্যের অঙ্গন। তাঁর দেহতত্ববাদের কবিতাবলী গান হয়ে উঠেছে কিন্তু গানের আগে সাহিত্যের অগ্রাধিকার। কবির কথায় "সেই সত্য, যা রচিবে তুমি" আর লালন ফকিরের রচনায় গান তো তখন আর গান নয়, গান ও কবিতার সূক্ষ সীমারেখায় দাঁড়িয়ে বাংলার কবিতা প্রেমিক আজো হাতড়ে মরে সেই আধুনিকতাকে

" বাড়ির পাশে আরশিনগর, সেথা একঘর পড়শী বসত করে, আমি একদিনো না দেখিলাম তারে"

অথবা

" সত্য কাজে কেউ নয় রাজী, সবি দেখি তা না না না, জাত গেলো জাত গেলো বলে, এ কি আজব কারখানা"

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বে বাউল সম্প্রদায়টিকে পূর্ব এবং পশ্চিমবাংলার মানুষ বোধহয় কেবলই উদাসীন, খেপা, ছন্নছাড়া ভিক্ষুকের পর্যায় ফেলত । তাদের রচিত গান নিছক পাগলামি বলে প্রতিভাত হ'ত। শুধুমাত্র প্রচারের অভাবে বাউল, চারণ কবির রচিত গান যে কত উচ্চমার্গের লোকগান তা বুঝতে বাঙালীর অনেক সময় লেগেছিল। কিন্তু যুগযুগ ধরে এই খেপামি ও উদাসীনতার তাড়নায় এই সম্প্রদায় বাংলা-সংস্কৃতির তথা লোকসাহিত্যকে কতখানি সমৃদ্ধ করে এসেছে তা আমরা খুব ভাল ভাবে উপলব্ধি করেছি। মুগ্ধ হয়েছি আমরা এদের রচনাশৈলীতে। ঋদ্ধ হয়েছে বাংলা গানের সংস্কৃতি। আধ্যাত্মিক এবং দেহতত্ত্বের ওপর এই লোকগান ছড়িয়েছে মুখে মুখে।

এই বাউলগানের প্রতিষ্ঠা পাওয়ার মূলে আছেন রবীন্দ্রনাথ যিনি চর্চা করেছিলেন বাউলের লোকসাহিত্য এবং বুঝেছিলেন তাদের জীবনদর্শন। কোথায় যেন এক আত্মিক অনুভূতির সুরে তাঁর একতারায় বেঁধেছিলেন বাউলের দোতারার সুর।

কথিত আছে যে রবীন্দ্রনাথ বাংলার কিম্বদন্তী বাউল লালন ফকিরের খোঁজ পেয়েছিলেন তাঁর যৌবনে। এবং আকৃষ্ট হয়েছিলেন লালনের গানের কথায়। আপ্লুত হয়েছিলেন তার কবিতার ভাবাদর্শে। পরবর্তীকালে বাউল গগন হরকরা রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে গিয়েছিলেন। এবং বাউলের মনে তখন থেকেই রবীন্দ্রগানের প্রভাব পড়তে
থাকে। আর তাই বুঝি বাউলের একতারায়

" দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা" য়

অণুপ্রাণিত হয়ে কবির দোতারায় বেজে উঠেছিল

" ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে"

অথবা বাউল গগন হরকরা রচিত বিখ্যাত গান

"আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যেরে.."

কবি যার গন্ধ নিয়েই বুঝি লিখেছিলেন

"আমি তারেই খুঁজে বেড়াই, যে রয় মনে আমার মনে.."

বাউলের সৃষ্ট লোকসাহিত্যে সর্বজনীন দেহতত্ত্ব বাদ আজ সর্বজনবিদিত। রবীন্দ্রনাথও অকপটে স্বীকার করেছেন সমগ্র বাউল সম্প্রদায়ের কাছে তাঁর অপরিশোধিত ঋণের কথা। তাই আধুনিক বাংলা লোকসাহিত্যের জনক রূপে রবিঠাকুরও কিছু কম নন সেই অর্থে।

রবি-বাউল -- শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথের " The Religion of Man " ব‌ইটির এপেন্ডিক্সের একটি অধ্যায় রয়েছে যার নাম "The Baul Singers of Bengal" । কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাতড়ে বেড়িয়েছেন এই অমোঘ সত্যকে আর তাই শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক এডওয়ার্ড. সি. ডিমক রবীন্দ্রনাথকে বলেছেন "The Greatest Of The Bauls Of Bengal" !

একসময় লোকসাহিত্য খাতায় কলমে লিখিত হত না। মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে যেত। যেমন করে আমরা বাংলা লোকসঙ্গীতের মধ্যেও পাই পল্লীগীতি, ঝুমুর, ভাওয়াইয়া, লেটো, গম্ভীরা, ভাটিয়ালির মত লোকগানকে। পরে জেনেছি সব কবিতাই তো মানুষের জীবনে গান হয়ে উঠতে পারে যদি তাতে সুরারোপ করা যায়। তাই লোকগান আধুনিক সাহিত্যে আর মুখেমুখেই সীমাবদ্ধ থাকেনি । লোকসাহিত্য বর্তমানে বহু চর্চিত ও গবেষণার বিষয়। এমন কি ভাদুগান, মাদল, টুসু এইসব নাচের সাথে যে সব কবিতা বাংলায় লেখা হয় সেগুলিও আদতে লোকসাহিত্য। গীতিকার কবিরা যথেষ্ট পরিশ্রম করেন এই গান রচনার সময়।

অধাত্ম্যবাদের গন্ডী ছাড়িয়ে জন সচেতনতার বিষয়, প্রকৃতি, প্রেম, সবকিছুই ধীরে ধীরে আজ প্রবেশ করেছে এই লোকসাহিত্যে তথা লোকগানে। তাই পটশিল্পী গেয়ে ওঠেন এডস্ নিয়ে মানুষের সচেতনতা বাড়ানোর জন্য কবিতা কিম্বা পণপ্রথা বা নারী নির্যাতনের মত বর্তমান সমাজের বিষয়। মাদল শিল্পীর নৃত্যের তালে তালে ধরতে পারি গ্রামবাংলার নিপাট রূপটিকে ।

পলাশ ফুলের শোভা দেখে, মনে কত আশা জাগে
বল সখী বঁধুয়াকে কুথা পাই,
বনায়েলাম পুলিপিঠা, দিয়া করি গতর বাটা
কে খাইবে বঁধু না আসিলে গো, বঁধুয়া কি ভুলে গেল মোকে

ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার নবজাগরণের সময় সৃষ্টিশীল বাঙালীর লেখনীতে ফুটে ওঠে রম্যরচনা। তরজাগান বা কবিগান রচনা করে কত কবিয়াল তখন খ্যাতি লাভ করেন। তাই এইগুলিও বাংলার লোকসাহিত্যে এখনো সমুজ্জ্বল।

সবশেষে আসি বাংলার ব্রতকথায়। বাঙলামায়ের বারোমাসে তেরো পার্বণ । আর সেই তেরো পার্বণে হাজারো ব্রতের উপবাস। উভয়বঙ্গের মায়েরা নাছোড় এই ব্রত পালনে। প্রতিটি ব্রতকথার আড়ালে যে ছোট উপাখ্যানগুলি আছে সেগুলি প্রচলিত হলেও লোকশিক্ষার মোড়কে হাজির করা হয় আমাদের সামনে। ব্রতের কহিনীর সাথে সাথে ছোট ছোট ছড়াগুলিও লোকসাহিত্যের অঙ্গ হিসেবে বেঁচে রয়েছে বহুদিন ধরে। ইতুপুজোর এই ছড়াটি?

অষ্টচাল, অষ্টদূর্বা কলসপাত্রে থুয়ে
শুন একমনে ইতুর কথা সবে প্রাণ ভরে।
ইতু দেন বর !
ধনধান্যে পুত্র-পৌত্রে ভরে উঠুক ঘর।

অথবা মঙ্গলচন্ডীর ব্রতে অবশ্য পাঠ্য এই ছড়াটি

"সোনার মঙ্গল চন্ডী রূপোর বালা, কেন মাগো মঙ্গলচন্ডী হল এত বেলা
হাসতে খেলতে, তেলহলুদ মাখতে, পাটের শাড়ি পরতে, আঘাটায় ঘাট করতে,
হাপুতির পুত দিতে, আইবুড়োর বিয়ে দিতে, অন্ধের চক্ষু দিতে, বোবার বোল ফোটাতে,
নির্ধনের ধন দিতে, হল এত বেলা "

এমন কত কত ছড়া ও গল্পে সমৃদ্ধ বাংলার ব্রতকথারা। তাই তো বাংলার লোকসাহিত্যে ব্রতকথার ভূমিকা অপরিসীম।


লেখক পরিচিতি - বেথুন কলেজ ও পরে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে অর্গ্যানিক কেমিস্ট্রিতে স্নাতকোত্তর। লেখালেখিতে ঝোঁক বহুদিনের। ২০০৭ থেকে বাংলায় ব্লগ লেখার শুরু। ২০১১ তে দেশ পত্রিকায় প্রথম গল্প প্রকাশ। তারপর আনন্দমেলা, এবেলায় ছোটগল্প এবং আনন্দবাজার পত্রিকায় অনেক ভ্রমণকাহিনী প্রকাশিত। আনন্দবাজার ইন্টারনেটের শুরু থেকেই লিখে চলেছেন পাঠক কলমে ও হাওয়াবদলে। প্রথম উপন্যাস "কলাবতী কথা" সানন্দা পুজোসংখ্যায় ( ২০১৫ ) প্রকাশিত। এছাড়াও বহু প্রিন্ট পত্রিকা ও ওয়েব পত্রিকার নিয়মিত লেখক। এযাবত প্রকাশিত ব‌ই চারটি ।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।