এক সার্বিক ভুলের প্রায়শ্চিত্ত
সরোজ দরবার
কী করে যে আমরা এমন অসামান্য ছবিকে শুধুমাত্র হাসির ছবি বলে ভুল করতে পারলাম! ' গল্প হলেও সত্যি' প্রসঙ্গে এহেন আক্ষেপ সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের। গোড়াতেই তিনি সন্দিহান ছিলেন। তপন সিংহের সম্পর্কে আমাদের সামগ্রিক অবস্থানে কি ভুল হয়েছিল? নিবন্ধ শেষে সঞ্জয়বাবু বুঝিয়েছিলেন, তা যে হয়েছিল সে নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। উত্তরকালে সে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করলেন আবেশ কুমার দাশ। বস্তুত তাঁর ' তপন সিংহ: সার্বিক চলচ্চিত্র বীক্ষা' বইটি যেন ততটাই ব্যঞ্জনাময়, প্রক্ষিপ্ত যেভাবে মহাকাব্যের গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচনকারী হয়ে ওঠে।
তপন সিংহ: সার্বিক চলচ্চিত্র বীক্ষা |
আসলে তপন সিংহ সম্পর্কে আমাদের ভুলটা হয়েছিল ঠিক সেখানে, যেখানে মহাকাব্য আর মঙ্গলকাব্যের মধ্যে দূরত্ব রচিত হয়। যদিও দুটোই ধারণ করে সময়কে, ও সময়কে চেনার ক্ষেত্রে দুটিই সমানভাবে প্রয়োজনীয়। সময়ের সে হাইফেনে যেন জুড়ে বসে সাংস্কৃতিক ঔদাসীন্য। ফলে, সত্যজিত-ঋত্বিক এবং কিছু অংশে মৃণাল সেন নিয়ে আমাদের মাতামাতি একটা ছদ্ম বুদ্ধিবৃত্তির স্মারক হয়ে ওঠে। আমরা অবলীলায় ভুলে যাই নির্মল দে, অজয় করদের। এবং তপন সিংহ ও তরুণ মজুমদারদের নাম প্রথম সারির আসনে লিখতে আমাদের দ্বিধার মধ্যেই আক্ষরিক ঐতিহাসিক ভুলের জন্ম হয়। আমার ধারণা, এই ঔদাসীন্য আসলে একরকম সাংস্কৃতিক মৌলবাদেরই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। নইলে জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়কে কেনই বা আমরা দিনে দিনে ভুলে যেতে থাকব!
এ লেখার শিরোনামে প্রায়শ্চিত্ত শব্দটি বসাতে দ্বিধা হয়েছিল ঠিকই। তপন সিংহের মতো বিজ্ঞানের ছাত্র ও মার্কসীয় দর্শনে দীক্ষিতের সম্পর্কে এ শব্দ হয়তো মানানসই নয়। তবু যে ভুল হয়েছিল, তার প্রায়শ্চিত্ত না হলেই নয়। এবং তা সম্ভব তাঁর ছবি ও ভাবনার মহলে ঢুকে গূঢ় এষণাতেই। আবেশ সে কাজটি করেছেন উজ্জ্বল উদ্ধারের মতোই। এ বইয়ের সবথেকে বড় কৃতিত্ব হল, প্রতিটি অধ্যায় শেষে এ বই আবার ছবিগুলোকে দেখতে প্ররোচিত করেছে। তপনবাবুর ছবি যে দেখিনি এমনটা নয়। কিন্তু এ বই সমস্ত ক্যাজুয়ালনেসকে ধমক দিয়ে চাবুকের মত কিছু দৃশ্য দেখিয়ে দেয়, ধরিয়ে দেয় কিছু সূক্ষ্ম সূত্র, হালকা মেজাজে ফ্রেমের পরতে যা লুকিয়ে রেখেছিলেন পরিচালক। মেজাজটা এমন বলেই বোধহয়, তথাকথিত পাড়ার খারাপ ছেলেদের মুখে রবীন্দ্রনাথের গান শুনেও রবীন্দ্রসংগীত তথা দর্শনের এতবড় সম্ভাবনার বিস্তারটি আমরা খেয়াল করতে পারিনি। শুধু গান কেন, সামগ্রিক রবীন্দ্র কাহিনিকে তপনবাবু যেভাবে চলচ্চিত্রায়িত করেছেন, বাংলা ছবির ইতিহাসে তা গুরুত্বপূর্ণ দলিল। ' রবীন্দ্র নাটকের সাফল্যমণ্ডিত মঞ্চায়নের নেপথ্যে বাংলা নাট্য জগতে শম্ভু মিত্রের যা অবদান, বাংলা ছবির ইতিহাসে রবীন্দ্র-কাহিনির সফল রূপায়ণে তপন সিংহের কৃতিত্ব তার কম কিছু নয়।'-এ যে মোটেও অত্যুক্তি নয়, তা বুঝি, যখন আবেশ ধরিয়ে দেন, 'কাবুলিওয়ালা'র মধ্য দিয়ে আসলে তপন সিংহ মার্ক্সীয় বীক্ষণের রাষ্ট্রসীমানাহীন কল্পবিশ্বের রূপকটিকেই তুলে ধরছেন, এবং সেখানেও উদারকামী রবীন্দ্রনাথের স্বতন্ত্রতা চিহ্নিত করে দিচ্ছেন।
এবং মার্ক্সীয় মতবাদের তথাকথিত বিখ্যাত চশমাটি নামিয়ে রেখেও পরিচালক যেভাবে ছবিতে তাঁর সমাজবীক্ষার পরিচয় দিয়েছেন, তা সেই সময়কে চেনার উল্লেখ্য মুদ্রা। মার্ক্সীয় তত্ত্ব ও তার বাস্তব প্রয়োগ নিয়ে বহু আলোচনার কচকচানি শোনা যায়। আর সে বাগাড়ম্বর থেকেই বোধহয় খোদ মার্ক্স পিছু হটতে থাকেন। সমাজ সচেতন শিল্পী হিসেবে এ জিনিস তপনবাবুর চোখ এড়ায় না। আর তাই সিনেমায় সিনেমায় তা নিয়ে তিনি কষাঘাত করেন। তবে যেহেতু তাঁর প্রকাশের ধরনটি ততটা রূঢ় নয়, তাই হয়তো আঘাতটা সমসময়ে মালুম হয়নি। কিন্তু মহাকাল তা উপেক্ষা করতে পারে না। কিংবা নিছক বিনোদনমূলক সিনেমা নির্মাতা হিসেবে যে সমালোচনা তাঁকে সয়ে যেতে হয়, তাঁর জবাব এত অভিজাত ভাবে সিনেমাতেই দিয়েছেন তপনবাবু, এত চোখে আঙুল দিয়ে ধরিয়ে দিয়েছেন ফ্যালাসিকে এবং তাও রবীন্দ্র অনুসারী হয়ে, তা উপলব্ধিমাত্র বিস্মিত হতে হয়। উদ্ধৃতি দিয়ে এ লেখা ভারী করছি না, কেননা চাই, অবসর-এর সিরিয়াস পাঠক, বইয়ের পাতাতেই এ আবিষ্কারের সাক্ষী থাকুন।
সিনেমার সম্ভবত এই কাজই ছিল। চোখে আঙুল দেওয়ার বাধ্যবাধকতা তার নেই, তবু চোখ খুলে দেওয়ার দায়িত্ব সে অস্বীকার করতে পারে না। এই দায়বদ্ধতা মেনেই তাকে বাণিজ্যের অনুবর্তী হতে হয়। বিনোদন ও বাণিজ্যের হাত ছেড়ে নান্দকিতার উদ্ভাস, তার কাছে আত্মঘাতের শামিল। বিজ্ঞানের ছাত্র তপনবাবু বিলক্ষণ জানতেন সব শর্ত রক্ষিত না হলে উপপাদ্য মেলে না। বিরল ও ব্যতিক্রমীভাবে তিনি তা মিলিয়ে চলেছেন। তাঁর ছবি তাই সময়-নীরিক্ষার সঠিক বয়ান। সমসময়ের সিনেকুলীন মাস্টারমশাইরা তা খেয়াল করেননি। মাস্টারমশাই আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি- তাঁরইই সংলাপ আজ তাই সময়ের প্রতি বেজে উঠেছে নির্মল পরিহাস হয়ে।
এ বই আসলে আমাদের সিনে সংস্কৃতির দ্বিচারিতাকে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে লেখা নয়। তবে তা ছিল বলেই এমন গহন ডুব সম্ভব হয়েছে। বাংলা সিনে জিজ্ঞাসুরা যত এর পাতা ওলটাবেন ততোই মঙ্গল। বইয়ের প্রকাশনার মান নিয়ে কিছু বলার নেই। তবে তপন সিংহের ছবিগুলির একটি কালানুক্রমিক সম্পূর্ণ তালিকার অভাববোধ শেষমেশ জেগেই থাকল।
লেখক পরিচিতি: সরোজ দরবার যাদবপুরের মাস কম্যুনিকেশনের ছাত্র। বর্তমানে সংবাদ প্রতিদিন-এর কনটেন্ট রাইটার। পাশাপাশি কবিতা ও গল্প লেখেন। প্রকাশিত কবিতার বই- ‘চলতি হাওয়ার পংক্তি' ও গল্প সঙ্কলন 'বিরাট কোহলির কভার ড্রাইভ'।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.