প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

সংগীত

নভেম্বর ৩০, ২০১৬

 

বাহাদুর শাহ্ জাফর-এর সহেলা

ওমর শামস


মির্জা আবু জাফর সিরাজুদ্দীন মহম্মদ বাহাদুর শাহ্ জাফর (১৭৭৫-১৮৮২), সংক্ষেপে বাহাদুর শাহ্ জাফর মোগল শাসক বংশের শেষ অধিপতি। তিনি ১৮৩৭ থেকে ১৮৫৭ অবধি দিল্লির শাহানশাহ্ ছিলেন। তিনি কি ভাবে সম্রাট হয়েছিলেন, কি ভাবে রাজ্য হারিয়েছিলেন, প্রজা-শাসন ইত্যাদি আমরা আলোচনা করবো না। শুধু শাসকই তিনি ছিলেন না, জীবনে তিনি একজন কবি-সঙ্গীতজ্ঞ এবং সূফিও ছিলেন। তাঁর কবিতার কথা সমধিক পরিচিত, কিন্তু তিনি সঙ্গীতজ্ঞও – বিশেষ করে খেয়ালের বাণী রচয়িতা ছিলেন। এই দিকটাতেই আমরা নজর দেবো একটু শায়েরির ভূমিকার পর। ‘সহেলা’ কি জিনিশ ? পরে বলবো ।

রেঙ্গুনে বন্দী অবস্থায় লেখা, বাহাদুর শাহ্ জাফর-এর বিলাপের গজল্‌, “লাগতা নেহি জি মেরা ইয়ে উজ্‌ড়ে দ’য়ার মেঁ” – কে না শুনেছে!। নিচে তার আর দুটো গজল্‌ অনুবাদসহ দেয়া হলো।

 

মূল উর্দু
হিন্দি

بُلبُل کو پاسباں سے نہ صیاد سے گلہ
قسمت میں قید لکھی تھی فصلِ بہار میں

کہہ دو اِن حسرتوں سے کہیں اور جا بسی
اتنی جگہ کہاں ہے دلِ داغدار میں
اِک شاخِ گل پہ بیٹھ کے یار میں

बुलबुल को पासबाँ से न सैयाद से गिला
क़िस्मत में क़ैद लिखी थी फ़स्ल-ए-बहार में


कह दो इन हसरतों से कहीं और जा बसें
इतनी जगह कहाँ है दिल-ए-दाग़दार में


রোমান হরফায়িত
বাংলা অনুবাদ
būlbūl ko pāsbāń se na saiyyād se gilā
qismet méń qaid likhī tthī fasl-e-bahār méń

kaeh do in hassretoń se kahīń aur jā bas'éń
itnī jageh kahāń hé dil-e-dāGhdār méń




বুলবুল না গাইয়ে না ব্যাধের বদনাম করে,ভাগ্যে তার বসন্তে বিলাসে কয়েদ লেখা ছিলো।

এইসব আকাঙ্ক্ষাকে ব’লে দাও অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে,
এই দাগাদার দিলে এতো জায়গা কোথায় ?


এবার তাঁর সঙ্গীতের গুণপনা নিয়ে কথা বলবো। তাঁর দরবারে যথারীতি সেকালের ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ মৌসিকিকাররাই ছিলেন। আমীর খুসরোর কাল থেকে প্রচলিত ‘কাওয়াল বাচ্চা’ ট্র্যাডিশনের মিয়াঁ আছপাল খেয়ালের প্রধান পুরুষ, বাহাদুর শাহ্‌-র গুরু ছিলেন। মিয়াঁ আছপালের এক শিষ্য কুতুব বক্স গান শুনিয়ে এতো মুগ্ধ করেন যে বাদশাহ্‌ তাঁকে তানরস খান খেতাব দেন। মিয়াঁ আছপাল, তানরস খান দিল্লি ঘরানার প্রধান পুরুষ মানা হয়। এঁদের খেয়ালের জন্য তিনি বেশ কিছু বাণী বা ‘বোল’ রচনা করেন। এগুলোর ভাষা খড়িবুলি বা ব্রজভাষা, মাঝে দুয়েকটা উর্দু, ফারসি আছে। খেয়ালে সাধারণত অস্থায়ী, অন্তরা থাকে। কিন্তু বাহাদুর শাহ্‌-র বোলে দুটো বা তিনটে অন্তরা আছে। এগুলোকে ‘সহেলা’ বলা হয়ে থাকে। [ পাশে উস্তাদ তানরস খানের প্রতিকৃতি। ]

প্রথম গানটি বাহারের বিখ্যাত গান, প্রায় সব কাওয়ালরা এবং খেয়ালিয়ারাও গেয়ে থাকে। উস্তাদ সালামত আলী খান এবং নাসির আহমদের শুনেছি। এখানে শাহিদা বেগম এবং কাওয়াল ওয়ার্সি ভাইদের গাওয়া ভিডিওতে দেয়া হলো। শাহিদা বেগম-এর গানের বোলে কিছু অপভ্রংশ আছে। এখানে লেখা বাণীটিই ঠিক। বলতে হবে, অনেকেই এই গানটিকে আমীর খুসরোর বলে ভুল করে।


(১)

সরসোঁ সগল বন ফুল রহি
আম্বুয়া মোলে টেঁসু ফুলে
কোয়েল বোলে ডার ডার
ঔর গোরি করত শৃঙ্গার
মালনিয়া গর্‌বা লে আয়ে ঘর্‌সোঁ
সরসোঁ সগল বন ফুল রহি।

তরাহ্‌ তরাহ্‌ কে ফুল লে আয়ে
লে গার্‌বা হাথন্‌ আয়ে
নিজামুদ্দীন কে দরওয়াজে পর
আওন কহ্‌ গয়ে আশেক-রঙ্গ্‌
ঔর বীত গয়ে বরসো সরসোঁ
সগল বন ফুল রহি।
বাহার / তিনতাল





গানে বাহাদুর শাহ,-এর তাখাল্লুস, আশেক-রঙ্গ্‌, আছে। কোথাও শুধু শওক-রঙ্গ ব্যবহার করেছেন। এই বাণীটিতে বসন্তের প্রাকৃতিক বর্ণনা আছে – সব জায়গায় শর্ষের হলুদ ফুল ফুটে আছে। আমের মৌল এসেছে, টেঁসু ফুল ফুটেছে। ললনাদের মনে প্রেম। মালি ফুলের ডালি নিয়ে এসেছে ঘর থেকে। বিভিন্ন রকমের ফুল এনেছে, তোড়া হাতে এনেছে। হযরত নিজামুদ্দিনের দরজায় আসবে বলেছে আশেক-রঙ্গ । কিন্তু বছর পেরিয়ে গেছে।

দ্বিতীয় গানটি বাগেশ্রী বাহারের বন্দিশ। বসন্ত ঋতুতে উদ্দীপনা নিয়ে আপন প্রিয়াকে খুঁজতে বেরোলাম ঘর থেকে। যদি সে আসে উৎসব করবো, শর্ষে-হলুদ রঙের ফাগ-ঝুলনা বাঁধবো। নার্গিস এবং ‘আকে’ ফুলের রঙ সবুজ। সরসরঙ্গ্-কে শওক-রঙ্গ্ বলছেন, এই ফুলের পার্থক্য লোকে জানে না । আমি বললাম, লোকে গল্প করে। সরসরঙ্গ্, আগ্রা ঘারানার বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ।


(২)

ঋতু বসন্ত মেঁ আপনে উমঙ্গ সোঁ
পি ঢুড়ন মেঁ নিকশি ঘর সোঁ।

আওয়ে তো লালা গর্বা লাগাউঁ
ফাগ বন্ধাউঁ পীলি সরসোঁ ।

রঙ্গ্ হ্যায় সব্জা নার্গিস আকে
কহে শওক-রঙ্গ্ সরসরঙ্গ্কো
ইন ভেদনকো কোয়ি না জানে
বাকে কহুঁ ম্যায় বাকি চর্চো।
বাগেশ্রী কানাড়া / তিনতাল





এই বন্দিশটি কেসরবাই বাগেশ্রী বাহারে গেয়েছেন। আগ্রা ঘারানার উস্তাদরাও তাই গান। বড়ে গুলাম আলী খাঁ সাহেব ১৯৩০ এর দিকে ৭৮ র.প.ম.-তে গেয়েছিলেন, কিন্তু আড়ানা বাহারে।

শেষ গানটি হিন্দোল বাহারের। এর বাণীতে বসন্তে ফোটা বিভিন্ন ফুলের নাম আছে। নতুন নতুন ফুলে সব লাল, বসন্তের ফর্‌মান এসেছে। বন্দিশটি দিল্লি ঘরানায় গাওয়া হয়।


(৩)

অব্ নয়ি নয়ি ফুলে ফুলে লাল
না ফর্মান শাগুফা বসন্ত

মোতিয়া মদন বান চামেলি
কেওড়া দোনা মারওয়া
লায়ি লায়ি আপনা কন্ঠে
অব্ নয়ি নয়ি ফুলে ফুলে লাল

কছু না সরসো বইলে লাগি কলিয়া
ঔর ফুলে হার শৃঙ্গার অনেক ব্সন্তী
শওক-রঙ্গ নয়ি নয়ি ফুল বনকি
শেহর করো গুলকো হসন্ত ।
অব্ নয়ি নয়ি ফুলে ফুলে লাল
হিন্দোল বাহার / তিনতাল


উপরে আঁকা ছবিতে বাহাদুর শাহ্‌ ঈদের দিনে আনন্দ মিছিলে সদলবলে দিল্লিতে বেরিয়েছেন।
বাহাদুর শাহ্‌-র দরবারের সংগীতজ্ঞদের মধ্যে এই কজনের নাম পাওয়া যায় – বীণকর-ধ্রুপদীয়া মুরাদ খান, তানসেন বংশের তিন জন -প্যার সেন, নূর খান (নূর রঙ্গ), মিয়াঁ হিম্মত খান বীণকর। মিয়াঁ হিম্মত খানের প্রতিকৃতি নিচে দেয়া হলো।

বাহাদুর শাহ্‌ মোগল সাম্রাজ্যের শেষ অধিপতি। তাঁর সঙ্গে প্রথম বাদশাহ্‌ জহীরুদ্দীন মহম্মদএর এক জায়গায় মিল আছে। দুজনেই শিল্পবোদ্ধা ছিলেন। বাবর আত্মজীবনী ছাড়াও কবিতা লিখেছিলেন। বাবরনামায় এক পরিচ্ছদে তিনি এক সঙ্গীত মাহফিলের রীতিমত ক্রিটিক লিখেছেন। তিনি ভারতবর্ষে উদ্যানের ধারণা নিয়ে এসেছিলেন। কাবুলে বাগান করেছিলেন। যমুনার তীরে একটি পদ্মের বাগান করেছিলেন। কিন্তু বাবর যোদ্ধাও ছিলেন। বাবরের ২৩০ বছর পরে দিল্লিতে সমরের শক্তি ক্ষীণ হয়ে এসেছিলো। কিন্তু সাহিত্য এবং সঙ্গীতের মাহ্‌ফিল ঠিকই ঐশ্বর্যশীল ছিলো।


লেখক পরিচিতি : বাংলাদেশের কবি – বর্তমানে নিউ জার্সিতে থাকেন। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - বোধিবৃক্ষতলে, খোয়াবনামা, সত্তরের মিছিল, আসা যাওয়া, কৃতি প্রতিকৃতি ও অন্যান্য কবিতা, বাবররের পদ্ম অশোকের চক্র, ইন্টারনেট গায়ত্রী, অনন্তর পান্না ,নিউ ইয়র্কে যিষ্ণু, ও ওমর ও বোরহেস, এবং হাইব্রিড মুরগি। কেন শুদ্ধতম / প্রবন্ধ গ্রন্থ (প্রেসে)।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।