সাহিত্য
অগাস্ট ১৫, ২০১৬
ছন্দমিলের পরাকাষ্ঠা ও অন্যান্য: সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
ওমর শামস
১ ভূমিকা
রবীন্দ্রনাথ বাংলা কবিতার ছন্দের সিদ্ধি এবং স্থাপনার প্রধান পুরুষ। মাত্রাবৃত্ত তাঁর কলমেই পূর্ণ বিকশিত হয়েছিলো। এবং সকল ছন্দের বিভিন্ন মাত্রার বাঁট লক্ষ্য করে বিভিন্ন স্তবক তৈরী করে গিয়েছিলেন। তাঁর কৃতকর্মের বাইরে টেকনিক্যালি খুব বেশী করার বাকী ছিলো না। যেটুকু করার তা করেছিলেন জীবনানন্দ এবং বিষ্ণু দে – জীবনানন্দ অক্ষরবৃত্তে বিলম্বিত লয় আনলেন এবং বিষ্ণু দে মাত্রাবৃত্তে ৫, ৭-এর কিছু নতুন চলন এবং মুক্তকের কিছুটা নতুন ধ্বনি দেখালেন। আমার বিচারে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ছন্দের নতুন কিছু আবিষ্কার না করলেও তিনি দক্ষতায় তুঙ্গপ্রতিম। তাঁকে আমি ছন্দের ওস্তাদ মানি। এখানে এজরা পাউন্ড-এর সংজ্ঞা স্মরণীয়ঃ
1 Inventors. Men who found a new process, or whose extant work gives us the first known example of a process.
2 The masters. Men who combined a number of such processes, and who used them as well as or better than the inventors.
বিষ্ণু দে-র চোরাবালি-র আলোচনা করতে গিয়ে সুধীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “ আমার বিচারে কবিপ্রতিভার একমাত্র অভিজ্ঞানপত্র ছন্দঃস্বাচ্ছন্দ্য।” ছন্দ সম্বন্ধে সুধীন্দ্রনাথের আরো কিছু উক্তি স্মরণ করা যাকঃ
“গদ্যের অবলম্বন বিজ্ঞান, কাব্যের অন্বিষ্ট প্রজ্ঞান। তাই গদ্য চলে যুক্তির সঙ্গে পা মিলিয়ে, আর কাব্য নাচে ভাবের তালে তালে, গদ্য চায় আমাদের স্বীকৃতি আর কাব্য খোঁজে আমাদের নিষ্ঠা, রেখার পর রেখা টেনে পরিশ্রান্ত যে ছবি আঁকে, গোটা কয়েক বিন্দুর বিন্যাসে কাব্যের যাদু সেই ছবিকেই ফুটিয়ে তোলে আমাদের অনুকম্পার পটে। কাব্যের এই মরমী ব্রতে সিদ্ধি আসে প্রতীকের সাহায্যে। ……… এদের অনির্বচনীয়তার মূলে শুধু শব্দার্থ নেই, আছে শব্দের অন্তঃশীল আবেগ, সমাবেশ ও ধ্বনিবৈচিত্র্য, এবং ছন্দের শোভনতা। এই গুণ সমষ্টির নাম রূপ; এবং রূপের প্রত্যেক অঙ্গ অপরিহার্য। রূপ আর প্রসঙ্গের পরিপূর্ণ সঙ্গমেই কাব্যের জন্ম।” >
“ভাষা, ভাব আর ছন্দ, তিনের সন্নিপাতে কাব্য গ’ড়ে ওঠে। ভাষা ও ভাব সম্বন্ধে কোনও রকম পূর্বসংস্কার পোষণীয় নয়। …… এ-বারে এসেছে ছন্দের পালা। এখন প্রশ্ন এই যে কৃত্রিমতার আশঙ্কায় কি মাত্রাগণনাও উঠে যাবে, এবং তাহলে কাব্যের আর থাকবে কী? …… কেবল এইটুকুই স্মরণীয় যে ছন্দ আর মিল এক জিনিস নয়; মিল কাব্যের অপেক্ষাকৃত নূতন অলঙ্কার, ছন্দ অনাদি।…… ছন্দ আর আবেগ যমজ, তাদের টান নাড়ির টান। …… আমরা মানতে বাধ্য যে আলঙ্কারিকের গণিতসাপেক্ষ ছন্দ ব্যতিরেকেও কবিতা রচনা সম্ভব। বস্তুত আলঙ্কারিক যাকে ছন্দ বলে, সে একটা যান্ত্রিক কৌশলমাত্র; সেই নাগরদোলার ঘূর্ণি লেগেই আমাদের মন অনেকসময়ে কবিতাবিশেষের মধ্যে ভাব আর আবেগের অভাব দেখতে পারে না।”
কাব্যের মুক্তি
“মালার্মে-প্রবর্তিত কাব্যাদর্শই আমার অন্বিষ্টঃ আমিও মানি যে কবিতার মুখ্য উপাদান শব্দ; এবং উপস্থিত রচনাসমূহ শব্দপ্রয়োগের পরীক্ষা-রূপেই বিবেচ্য।”
সংবর্ত-র ভূমিকা।
২ উদাহরণ
আমার উপরের মন্তব্যর সমর্থনে এখানে কতগুলো অন্ত্যমিলের নজীর পেশ করলাম। বুদ্ধি ও কৌশল তো বটেই, তার উপরে শব্দের এবং শ্রুতির দখল বিনা এ করা অসম্ভব। জীবনানন্দ-র দান বিলম্বিত লয়ের অক্ষরবৃত্তে। এখানে মধ্য লয়ের অক্ষরবৃত্ত এবং মাত্রাবৃত্ত । তাছাড়া শব্দ চয়ন আলাদা – যুগ্ম তৎসম শব্দ বেশি।
মিল >> [হয়তো বা নির্বাণ ।। হবে তা (৩) // জোয়ার-ভাঁটার সন্ধি ।। নদীবখ।। খে, যেথা (৩)] + [পিতা ও প্রতীক, (৩+৩)।। স্বস্থ, প্রগতিক (২+৪)]
স্বপ্ন আজ ব্যর্থ বিড়ম্বনা;
জরাবিগলিত দেহে আত্মস্থ যন্ত্রণা
বিজিগীষা।
যে প্রাক্তন তৃষা
মেটাতে পারেনি সিন্ধু, হয়তো বা নির্বাণ হবে তা
জোয়ার-ভাঁটার সন্ধি নদীবক্ষে, যেথা
মুকুরিত মহাশূন্য, সমুদ্রের পিতা ও প্রতীক,
দূরতায়, স্বস্থ, প্রগতিক।
জেসন/ সংবর্ত
মিল >> [ ভূমিকায়ও ঢুকি, ।। ঘুমন্ত কঞ্চুকী। ] >> ৪+২ ।। ৩+৩
কদাচ দৈবাৎ যদি বাস্তবিক ভূমিকায়ও ঢুকি,
কামাখ্যার ষড়যন্ত্রে সাজি তবে ঘুমন্ত কঞ্চুকী।
কঞ্চুকী/ সংবর্ত
মিল >> [প্রতিবেশী নীহারিকা । যত ।। ... অকস্মাৎ ত্রিশঙ্কু স্ব। গত।] [ ৪+৪+২ // ৪+৪+২ ]
প্রতিবেশী নীহারিকা যত
পালায় সংসর্গ ছেড়ে। অকস্মাৎ ত্রিশঙ্কু স্বগত।
প্রতিপদ/উত্তরফাল্গুনী
মিল >> [ চমকিত হৃদে; ।। ...... বাণী দে, বা / ণী দে ] [ ৪+২ // ৪+২ ]
দ্রুত-বিলম্বিত নৃত্য আরম্ভিল চমকিত হৃদে;
অহৈতুক কৃতজ্ঞতা গুঞ্জরিল, বাণী দে, বাণী দে;
রোমাঞ্চিত বন্যতায় মুগ্ধ হল উদ্দীপ্ত শরীর।
কুক্কুট / ক্রন্দসী
মিল >> [নয় কল্পতরু ।। ...... সমুদ্র- না / মরু? ] [২+৪ // ৪+২]
স্বপ্নে, জাগরণে যেন মনে রাখি নয় কল্পতরু
ঊর্ধ্বমূল, অধঃশাখ, দুর্নিরীক্ষ্য সেই মহীরুহু,
যাকে কেন্দ্র ক’রে ছোটে দিগ্বিদিকে সমুদ্র- না মরু?
যযাতি / সংবর্ত
মিল >> [অনচ্ছ অভিধা / …… প্রদোষের দ্বিধা ] [ ৩+৩ / ৪+২ ]
রহস্যর অনচ্ছ অভিধা
--
ঘরে ঘরে প্রদোষের দ্বিধা ;
অগ্রহায়ণ / দশমী
৩ কবিতার ছন্দ ও সঙ্গীতের তাল-লয়
ছন্দ ধ্বনির পৌনঃপুনিক আবর্তন। যেহেতু ছন্দ বিরতিবিহীন নয় সব সময়। কবিতা স্তবকিত হতে পারে, যেখানে পঙক্তিরা অসমান। তা ছাড়া কবিতাপাঠ গানের মতো নয়, আমরা পাঠে যতি, বিরতি নিই। গানে তবলা অনবরত চক্রাকারে চলতেই থাকে। সুধীন্দ্রনাথে উদাহরণ আছে যেখানে কবিতাপাঠ (১২ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত) মেট্রোনোম বা তবলার সঙ্গে করা সম্ভব বিরতিহীনভাবে।
জনমে জনমে মরণে মরণে
মনে হয় যেন তোমারে চিনি,
ও শরমার্ত অরূপ আনন
দেখেছি কোথায় ও বিদেশিনী।
নীলনবঘন চঞ্চল আঁখি,
যে তড়িৎময়ী কালবৈশাখী
থেকে থেকে আজ হানিছে আমার
তাপনিরিক্ত চিত্তাকাশে,
ফুরায়েছিল কি বিগত জীবন
ও মদমত্ত সর্বনাশে !
কবিতাটি ৩/৩/৩/৩ মাত্রা প্রতি পংক্তি করে আবর্তিত হচ্ছে। ৩ মাত্রাকে ১ ইউনিট ধরলে, ৪ লাইনে ৪+৪+৪+৪ = ১৬ ইউনিট দাঁড়ায়। কবিতার ৩ মাত্রাকে তবলার ১ মাত্রা ধরলে আমরা তিনতাল পেয়ে যাচ্ছি, যা তবলার বোলে –
ধাঘেনে ধেতেটে ধাত্রেকে ধেতেটে
ধাত্রেকে ধিনাঘ ধিগ ধিনা ঘিনা,
তাকেনা তাতেটে তাত্রেকে তেতেটে
ধাত্রেকে ধিনাঘ ধিগ ধিনা ঘিনা।
ধাঘেনে(৩) ধেতেটে(৩) ধাত্রেকে(৩) ধেতেটে(৩), চারবারে তিনতাল। একটু যান্ত্রিক মনে হলেও, এখানে এই কবিতার লয়/তাল = তবলার লয়/তাল।
৪ পদ্যর মধ্যে গদ্য
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ, “কাব্যের মুক্তি”-তে লিখেছেন , “এটুকুই স্মরণীয় যে ছন্দ আন্র মিল এক জিনিস নয়, মিল কাব্যের অপেক্ষাক্রিত নূতন অলঙ্কার, ছন্দ অনাদি। কাব্যের জন্মবৃত্তান্তের তদন্তে নেমে আমরা বুঝেছিলুম যে আবেগের সঙ্গে ছন্দের সংমিশ্রণেই কাব্যের উৎপত্তি। কিন্তু সে-বিবরণ হয়তো একেবারে নির্ভুল নয়, তাতে ছন্দই জ্যোষ্ঠের আসন পেয়েছিল। হয়তো আসলে সে-সম্মান তাকে অদেয়। কারণ ছন্দ আর আনেগ যমজ, তাদের টান নাড়ির টান ; এবং আবেগ আর বেগ বিষমার্থবাচক, আবেগের মধ্যে বেগের চেয়ে বিরামই বেশি। অর্থাৎ মুখর আবেগ ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ায় না, চলে বিরতিবহুল গতিতে। ধ্বনি ও যতির এই সুব্যবস্থিত নক্সাই বোধ হয় ছন্দ ; এবং ছন্দের এই সংজ্ঞা সমীচীন হলে, গদ্য-পদ্যের সীমাসন্ধি অনিশ্চিত।“ এতোদূর বুঝে এবং লিখেও সুধীন্দ্রনাথ কোন গদ্য-কবিতা লেখেন নি। তাঁর ‘অর্কেস্ট্রা’ ছন্দ বৈচিত্রের এবং দক্ষতার পরাকাষ্ঠা। শৈলীর দিক থেকে এর বাইরে নানা কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তাঁর ১৪ মাত্রার মাত্রাবৃত্তগুলি – ‘শাশ্বতী ' , ‘উটপাখি ' , ‘জাতিস্মর ' , ‘১৯৪৫ ' , ‘লগ্নহারা ' ; এবং ১৮ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত। সনেট সবগুলো তাঁর ১৮ মাত্রার অক্ষরবৃত্তে। তাঁর শব্দচয়ন এমন যে যুগ্মশব্দের ধাক্কায় এটি ধ্বনিগতভাবে ঠিক iambic pentameter হয়ে ওঠে। নিচের বাক্যের, ‘অসম্ভব প্রিয়তমে অসম্ভব শাশ্বত স্মরণ’, Bold অক্ষরগুলোতে ধাক্কা দিয়ে পড়া যায়,
অসম ভব প্রিয় ত মে অসম ভ ব শাশ শ্ব ত স্মর ণ
Shall I com pare thee to a sum mer’s day?
১ ২ ৩ ৪ ৫ ৬ ৭ ৮ ৯ ১০
গানের জগতে এটি ঝাঁপতাল। এই সাউন্ড শব্দচয়নের এবং তাঁর কথিত “ধ্বনি ও যতির এই সুব্যবস্থিত নক্সা”-র জন্য। একই ছন্দে আল মাহমুদ, বুদ্ধদেব-এ এই ধ্বনি মিলবে না। সুধীন্দ্রনাথ-এর প্রাথমিক শিক্ষা হয়েছিল ইংরেজিতে। তাই, আমার মনে হয়, বাংলা কবিতার ছন্দকে তিনি ইংরেজি ব্যাকরণে বিশ্লেষণ করে নিয়েছিলেন মনে মনে।
গদ্য-কবিতা না লিখলেও তিনি ছন্দের মধ্যেই ঋজুতা এনে গদ্যর পেশী দ্যাখালেন ‘যযাতি’ কবিতায় –
ভেলা
আমি ভাসিয়েছিলুম একদা। তাদেরই মতো, আজ
ওটুকুই আমার পরম পরিচয়। আমাকেও
লক্ষ্যভেদী নিষাদের উল্বণ উল্লাস উদাসীন
নদীর উজানে দিয়েছিল অব্যাহতি মাল্লাদের
গুণটানা থেকে । গাঁট গাঁট বিলাতী বস্ত্রের …
তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থ দশমী-তে ‘নৌকাডুবি’, ‘অগ্রহায়ণ’, ‘তীর্থপরিক্রমা’, ‘উপস্থাপন’, ‘নষ্টনীড়’ কবিতাগুলো এই প্রকরণের উদাহরণ।
৪ সারার্থ
ধ্বনি এবং ছন্দের দিক থেকে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত রবীন্দ্রনাথ-কেই অনুসরণ করে শুরু করেছিলেন। তাঁর প্রথম বইয়ের উৎসর্গে লখেছিলেন, “ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্রীচরণে অর্ঘ্য ঋণশোধের জন্য নয় ঋণস্বীকারের জন্য”। আমার বিচারে তাঁর শ্রুতি এতো সূক্ষ্ণ ছিল যে তিনি ক্রিস্টালের মতো ছন্দ-ধ্বনি স্তবক রচনা করতে পেরেছিলেন, যার উদাহরণ উপরে দিয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পছন্দের লয়ে ছন্দকে যতোটা সম্ভব গদ্যর কাছে নেয়া যায়, তা তিনি করে দেখিয়েছিলেন।
লেখক পরিচিতি : বাংলাদেশের কবি – বর্তমানে নিউ জার্সিতে থাকেন। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - বোধিবৃক্ষতলে, খোয়াবনামা, সত্তরের মিছিল, আসা যাওয়া, কৃতি প্রতিকৃতি ও অন্যান্য কবিতা, বাবররের পদ্ম অশোকের চক্র, ইন্টারনেট গায়ত্রী, অনন্তর পান্না ,নিউ ইয়র্কে যিষ্ণু, ও ওমর ও বোরহেস, এবং হাইব্রিড মুরগি। কেন শুদ্ধতম / প্রবন্ধ গ্রন্থ (প্রেসে)।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।