কান পেতে রই...

অবসর (বিশেষ) সংখ্যা , ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪
সত্যান্বেষীর সাহিত্য-প্রীতি
পল্লব চট্টোপাধ্যায়
‘পথের কাঁটা’ থেকে শুরু করে ‘হেঁয়ালির ছন্দ’ পর্যন্ত ব্যোমকেশ বক্সীর কাহিনীগুলি অজিত-বর্ণিত হলেও সেগুলি আসলে তো একজন স্বনামধন্য কথাসাহিত্যিক ও কবি শ্রী শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা। হ্যাঁ, ‘দাদার কীর্তি’, ‘রাজদ্রোহী’ প্রভৃতি উপন্যাসে, ‘কানামাছি’ নাটক ও অন্যান্য অনেক রচনায় শরদিন্দুর অসামান্য কবিত্বের পরিচয়ও আমরা পেয়েছি। তাই অজিতের কলমে লেখা ব্যোমকেশের গল্পগুলি যে সাহিত্যরসগুণে সমৃদ্ধ হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের আলোচ্য বিষয় কিন্তু তা নয়। সাহিত্যে ও কাব্যে সমধিক জ্ঞান ও রুচিবোধের পরিচয় কিন্তু শুধুমাত্র অজিত নয়, ব্যোমকেশের আপাত-নীরস মস্তিষ্ক-প্রধান চরিত্রেরও একটা দিক হিসেবে তাঁর স্রষ্টা একাধিকবার দেখিয়েছেন, এবং তা হামেশাই এসেছে গল্পের প্রয়োজন ও প্রসঙ্গ ধরে, কাহিনীর মূল গতিকে ব্যাহত না করেই।
শরদিন্দু ব্যোমকেশকে নিয়ে তাঁর প্রথম গল্প-সংগ্রহ ‘ব্যোমকেশের ডায়েরী’র ভূমিকায় (১৯৩৩) লেখেন-
“ডিটেকটিভ গল্প সম্বন্ধে অনেকের মনে একটা অবজ্ঞার ভাব আছে- যেন উহা অন্ত্যজশ্রেণীর সাহিত্য- আমি তাহা মনে করি না। Edgar Allan Poe, Conan Doyle, G.K. Chesterton যাহা লিখিতে পারেন, তাহা লিখিতে অন্ততঃ আমার লজ্জা নাই।“
দেখা যাচ্ছে ১৯৩২-এ তিনি যখন ব্যোমকেশকে মাঠে নামান (না, ‘সত্যান্বেষী’ নয়, ‘পথের কাঁটা’ই তাঁদের প্রথম কাহিনী, যদিও ‘সত্যান্বেষী’ গল্পে তাঁর গোয়েন্দা-রূপে আত্মপ্রকাশ ও অজিতের সাথে জুটি বাঁধা, তিনি সেটি ‘পথের কাঁটা’ ও ‘সীমন্ত-হীরা’র পরে লেখেন), তখন কিন্তু শার্লক হোমস অবসর নিয়েছেন (১৯১৪)
ও আগাথা ক্রিস্টির এরকুল পোয়রো (Hercule Poirot) খ্যাতির মধ্যগগনে। পো আর ডয়েলের পর যদি কেউ সাহিত্যরসসমৃদ্ধ গোয়েন্দা গল্প লেখেন, তিনি অবশ্যই শ্রীমতী ক্রিস্টি যাঁর ও শরদিন্দু উভয়েরই অনুপ্রেরণা কোনান ডয়েল স্বয়ং। তবে তিনটি চরিত্রই মৌলিক ও তাদের মধ্যে বৈসাদৃশ্যই বেশী। হোমস একজন ভিক্টোরিয়ান যুগের সবরকম বৈশিষ্ট্য নিয়ে গড়া পাক্কা ইংলিশম্যান। তিনি পাইপ খান, ড্রাগও নিয়ে থাকেন, সর্বদা মস্তিষ্কের খোরাক চান, তেমন কেস পেলে দক্ষিণার তোয়াক্কা করেন না, অবসরে বেহালা বাজান, রসায়ন-চর্চা করেন ও মানবতার প্রয়োজনে অপরাধীকে ধরেও রেহাই দিতে দ্বিধা করেন না (Adventure of Abbey Grange)। এদিকে এরকুল পোয়রো
জন্মসূত্রে বেলজিয়ান কিন্তু গোয়েন্দাগিরি করেন বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জ-সমেত পশ্চিম ইউরোপে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাঝে ১৯১৪য় যখন শেষ হয় শার্লক হোমসের গোয়েন্দাজীবন-‘His Last Bow’ গল্পের সাথে, তার পরেই আবির্ভাব ঘটে পোয়রোর ‘The Mysterious Affair at Styles’ উপন্যাসে, ১৯২০তে। তবে হোমস, পোয়রো বা পো-র গোয়েন্দা C.A. Dupin- এঁদের নিয়ে গল্পগুলি যথেষ্ট সাহিত্যগুণ-সম্পন্ন হলেও এই গোয়েন্দাদের সাহিত্যজ্ঞান ও সাহিত্য-প্রীতি কিন্তু তেমন ছিল না। ‘A Study in Scarlet’এ ডাঃ ওয়াটসন হোমসের গুণাবলী বর্ণনা-প্রসঙ্গে বলেছেন যে তাঁর সাহিত্যজ্ঞান ছিল শূন্য। অবশ্য হোমস নিজেই তার খণ্ডন করেন ‘A Scandal of Bohemia’ তে শেক্সপিয়ার ও গ্যেটে থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বা ‘A Case of Identity’ তে হাফেজ থেকে আবৃত্তি করে। আগাথা ক্রিস্টির উপন্যাস ‘Ten Little Niggers’ (Racial নামের সমস্যা মেটাতে পরে যার নামকরণ হয় ‘And Then There Were None’) শুরু হয় ১৮৬৯তে রচিত ফ্র্যাঙ্ক গ্রীনের এই ছড়াটি দিয়ে-
“ Ten little soldier boys went out to dine;
One choked his little self and there were Nine.”
যোগীন্দ্রনাথ সরকার রচিত এর ভাবানুবাদ- ‘হারাধনের দশটি ছেলে ঘোরে পাড়াময়...’ পড়েননি এমন বাঙালী বিরল। কিন্তু আগাথার কোনও বইয়েই পোয়রোর সাহিত্যপ্রীতির তেমন কোনও নিদর্শন দেখা যায়নি যা লোকের মনে থেকে যেতে পারে, বরং তিনি মনে করতেন যে ইংল্যান্ডে বসে ইচ্ছে করে ভাঙা-ভাঙা ইংরাজী বললে ডিটেকটিভ হিসেবে বেশী লাভবান হওয়া যায়, বিদেশী বলে কিছু বাড়তি সহানুভূতি আদায় করে।
(২)
আগেই বলেছি, ‘পথের কাঁটা’ (১৯৩০) ব্যোমকেশের প্রথম গল্প যদিও তাঁর আত্মপ্রকাশ হয় ‘সত্যান্বেষী’ (১৯৩১) কাহিনীতে, কিছুটা flash-back-এ। তাঁর অনুপ্রেরণা অবশ্যই শার্লক হোমস, যদিও-
“হোমসের সঙ্গে ব্যোমকেশের মিল- নামের মধ্যে অনুপ্রাসের ঝঙ্কারটুকু কানে না তুললে- ওই পর্যন্তই। ব্যোমকেশ হোমসের মতো উৎকেন্দ্রিক প্রকৃতির নয়, বিজ্ঞান-দক্ষ নয়, গুণী বেহালাদার নয়, নেশাখোরও নয়; সে বর্তমান (বিংশ) শতাব্দীর তৃতীয় দশকের বাঙালী যুবক,- শিক্ষিত, মেধাবী, তীক্ষ্ণদৃষ্টি, সংযতবাক্, সহৃদয়......তবে বক্শিসের- প্রশংসা, যশ, আত্মতৃপ্তি ইত্যাদি ফাঁকা দক্ষিণার- প্রত্যাশা অবশ্যই করেন। তাই ব্যোমকেশের পদবী স-বর্জিত বক্সী ” – শ্রী সুকুমার সেন, ভূমিকা, ব্যোমকেশ সমগ্র।
তুলনা করতে ইচ্ছা হয় রেক্স গ্রাউটের দ্বিতীয় ডিটেক্টিভের পদবী Foxএর সঙ্গে।
ব্যোমকেশের পিতা ছিলেন গণিতে সুদক্ষ, পেশায় শিক্ষক। তাছাড়া কথাসাহিত্যিক শরদিন্দু যাঁর স্রষ্টা ও গল্পলেখক অজিত যাঁর সুহৃদ, তাঁর যে কিছুটা সাহিত্যে রুচি ও বৈদগ্ধ্য থাকবে তাতে আর আশ্চর্য কি? তবে সে পরিচয় ব্যোমকেশের গোড়ার দিকের গল্পগুলিতে তেমন পাওয়া যায় না । কারণ আর কিছুই না, শরদিন্দু হয়ত সে সময় হোমসের ছাঁচে ও পোয়রোর ধাঁচে ব্যোমকেশকে ঢালাই ও ডয়েলের অন্যান্য চরিত্র ও কাহিনীর ছায়ার তাঁর গল্পগুলিকে বঙ্গদেশীয় স্বাভাবিকতা দিতে ব্যস্ত ছিলেন। প্রফেসর মরিয়ার্টির আদলে গড়া অনুকূলবাবু, ‘Six Napeleons’ এর ছায়ার ‘সীমন্ত-হীরা’, ‘The Vacant House’এর অনুসরণে ‘উপসংহার’ ইত্যাদি গল্প রচনার প্রাক্কালে ব্যোমকেশের চরিত্রের সুকুমার বৃত্তিগুলি ফুটে ওঠার তেমন সুযোগ পায় নি। অবশ্য শেষের দিকের লেখা, যেমন ‘ছলনার ছন্দ’ তেও ‘Adventure of The Red-headed League’ এর ছায়া আছে, মৌলিকতা বজায় রেখেও। মনোসমীক্ষা ও মানব-মনের জটিলতার বিশ্লেষণের ব্যাপারে হোমস, পোয়রো ও ব্যোমকেশ তিনজনেই অতুলনীয়, কারণ বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করে মৌলিক গবেষণা করা যায় বটে, তবে মানব-চরিত্রের গতি কোনও বিজ্ঞানের সূত্র মানে না। তাই যেমন হোমস ‘The Norwood Builder’ গল্পটির তদন্ত শুরু করতে চান ঘটনাস্থল অর্থাৎ নরউড নয়, অভিযুক্ত আসামী ম্যাকফারলেনের মায়ের বাড়ি ব্ল্যাকহিদ্ থেকে, তেমনই ‘রক্তের দাগ’এ ব্যোমকেশ তদন্তে গুরুত্ব দেন নিহত সত্যকামের জন্মরহস্যের উপরে বা ‘শজারুর কাঁটা’য় অদৃশ্য খুনীর পিছনে না ছুটে দীপার প্রাক্-বৈবাহিক প্রেমের খোঁজে তার গানের বই-খাতায়।
(৩)
তাহলে এবার মূল প্রসঙ্গে আসি, কখন ও কবে আমরা ব্যোমকেশের সাহিত্য-জ্ঞানের পরিচয় পাই। ‘সীমন্ত হীরা’য় ব্যোমকেশের প্রতিদ্বন্দী ছিলেন একজন আপাতদৃষ্টিতে ও মস্তিষ্কের গঠন অনুযায়ী তাঁর থেকে অনেক বেশী বুদ্ধিমান ও ধূর্ত মহারাজা দিগিন রায়। এই অসম প্রতিযোগিতায় ব্যোমকেশের ভরসা ছিল মহারাজের বুদ্ধির দম্ভ, যা তাঁর কাজকে সফল করে তোলে। ঠিক এই কথাটাই ‘পথের কাঁটা’য় প্রকারান্তরে বলেছে তাঁকে অপরাধী প্রফুল্ল রায়-
“আমি আপনার বুদ্ধিকে অবজ্ঞা করেছিলাম, কিন্তু আপনি করেননি। শত্রুর শক্তিকে তুচ্ছ করতে নেই, এ শিক্ষা একটু দেরিতে পেলাম...।“
প্রফেসার মরিয়ার্টির মত সুপার-ক্রিমিনাল, যাদের বুদ্ধি ব্যোমকেশ থেকেও তীক্ষ্ণ, সেই একই কারণে ঘায়েল হয়েছেন তাঁর কাছে। না, মাইক্রফ্ট হোমসের মত super-sleuth ব্যোমকেশ পাননি, পেয়েছেন পরবর্তীকালে সত্যজিত রায়ের ফেলুদা তাঁর সিধু-জ্যেঠাকে, তবে সে অন্য গল্প। ‘মাকড়সার রস’ পর্যন্ত ব্যোমকেশকে আমরা প্রায় সাহিত্য-রসবঞ্চিত হিসেবেই দেখি।
‘অর্থমনর্থম্’ উপন্যাসে ইন্সপেক্টার লেস্ট্রেডের আদলে গড়া বিধুবাবুর সাথে ‘ল্যাজে খেলানো’ জাতীয় একটা ঠাট্টার মধ্যে ব্যোমকেশের রসবোধের পরিচয় মেলে বটে, তবে সত্যিকারের প্রেমে পড়লেই মানুষের কাব্য-প্রতিভা জেগে ওঠে, এই সুকুমার-রসের সন্ধান অর্থাৎ সত্যবতীকে তিনি এই গল্পেই প্রথম পান। তাঁর ভাষায় সত্যবতীর প্রথম বর্ণনা হল- “কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ।“ আবার ফণীর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি হঠাৎ দার্শনিক হয়ে শঙ্করাচার্য আউড়ে ওঠেন- ‘পুত্রাদপি ধনভাজাং ভীতিঃ’ ইত্যাদি। তারপরেই শুরু হয় তাঁর দ্বিতীয় দফার সত্যান্বেষণ, ফল সত্যবতীর সাথে বিবাহ।
রবীন্দ্রসংগীতে ব্যোমকেশের কতটা আকর্ষণ বা দখল ছিল জানিনা, তবে ‘চোরাবালি’তে অজিতকে মৃদু ভর্ত্সনা “’যদি বারণ কর তবে গাহিব না’, অর্থাৎ বারণ না করিলেই তারস্বরে গাহিব”- খুবই প্রাসঙ্গিক। আবার ‘দুর্গরহস্যে’র দুর্গটি দেখে ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর উপমাও তাঁর মনে আসে। ফল্গুস্রোতের মত ব্যোমকেশের মনের গভীরে যে সাহিত্য-রসবোধের অন্তঃসলিলা ধারাটি বইছে, তা দেখা যায় ‘অগ্নিবাণ’ কাহিনীতে সেই মর্মভেদী আক্ষেপ ‘Vengeance coming home to roost’ আর মানব-জাতি কিভাবে নিজের মৃত্যুবাণ নিজের হাতে গড়ছে তা নিয়ে এক চরম সত্যদর্শন।
(৪)
প্রাচীন ও আধুনিক, এই দুই প্রকারের গদ্যে ও পদ্যেই যে ব্যোমকেশের ইতস্ততঃ বা খাপছাড়া-ভাবে বিচরণ ছিল, তার অল্প-স্বল্প নিদর্শন গল্পগুলিতে মাঝে মাঝেই এসে পড়ে চমকে দেয় পাঠককে। ‘চিড়িয়াখানা’ উপন্যাসের super-criminal ডাঃ ভুজঙ্গধর ছিলেন এক বহুমুখী প্রতিভা, যিনি ডাক্তারি করেন, সেতার বাজান, শংকরাচার্যের ‘মোহমুদ্গর’ থেকে শুরু করে তার ‘অ্যান্টিডোট’ কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ থেকে ‘দন্তরুচি কৌমুদী’ আউড়ে যান। এ সবই আসে গল্পের প্রয়োজনে, ঠিক যেমন বর্ষার রাত্রে তদন্তের স্বার্থে ব্যোমকেশ-অজিত-ইন্সপেক্টার বরাটের নৈশাভিসারের সময় ব্যোমকেশ গীতগোবিন্দের ‘মেঘৈর্মেদুরম্বরম’ আবৃত্তি করে ওঠেন। আবার ফিরিঙ্গি-পাড়ার গণিকাদের বর্ণনাকালে রবীন্দ্রনাথের ‘পতিতা’ কবিতাটিকে একটু বদলে বলে ওঠেন-
“দেবতা ঘুমালে আমাদের (তাহাদের) দিন
দেবতা ঘুমালে আমাদের (তাহাদের) রাতি,
ধরার নরক সিংহ দুয়ারে
জ্বালাই আমরা (জ্বালায় তাহারা) সন্ধ্যাবাতি ।“
বিজ্ঞানের ছাত্র ব্যোমকেশ সংস্কৃত শ্লোক থেকে যে মাঝে মাঝে উদ্ধৃতি দিয়ে বসেন, যেমন- ‘ভাগ্যং ফলতি সর্বত্র ন বিদ্যা ন চ পৌরুষং’ (উপসংহার)- এগুলি হয়ত তাঁর স্রষ্টার একটু বাড়াবাড়ি। প্রেমেন মিত্তিরের পরাশর বর্মাও কবিতা লিখতেন, তবে সেটা হোমসের বা বিজ্ঞানী-শ্রেষ্ঠ আইনস্টাইনের বেহালা-বাদনের মতই একধরণের ‘রি-ভাইটালাইজার’।
‘আদিম রিপু’ উপন্যাসে ব্যোমকেশ পেলেন এক নতুন ধরনের কাব্য-রসের সন্ধান। অজিত খোকাকে
সুকুমার রায়ের লেখা বিখ্যাত ছড়ার বই ‘আবোল-তাবোল’ উপহার দেন, আর ব্যোমকেশের সেটা খুবই ভাল লেগে যায়। রসিক পাঠকমাত্রেই জানেন যে আবোল-তাবোলের আপাত-নিরীহ হাসির ছড়াগুলির মধ্যে কবির তীক্ষ্ণ অবলোকনে ধরা পড়া কিছু মজা আছে, কিছু ব্যঙ্গ, কিছু আজগুবি কাণ্ড ও কিছু সত্য-কথন। তার আগে মিস্ ননীবালা রায়কে দেখে ব্যোমকেশ রবি ঠাকুর আউড়েছিলেন বটে ‘চিত্রা’ থেকে- ‘জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে, তুমি বিচিত্ররূপিণী’। এবার সুকুমার রায় পড়ার প্রতিক্রিয়াটা কি হল দেখা যাক। ব্যোমকেশ অনাদি-
হত্যারহস্য নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। অজিত প্রশ্ন করায় অন্যমনস্ক উত্তর- ‘আকাশের গায়ে নাকি টক টক গন্ধ?’ আবার একসময় অনাদির দয়ালহরি মজুমদারকে বিনা বন্ধকীতে টাকা ধার দেওয়ায় ব্যোমকেশ বলে- ‘বানরে সঙ্গীত গায় শিলা জলে ভেসে যায় দেখিলেও না হয় প্রত্যয়’। অজিত জানতে চান এতে তাঁর কি সন্দেহ হয়। ‘দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম’- আবার আবোল-তাবোল। প্রভাত অজিতের গুণমুগ্ধ, তাঁর বই ছাপতে চায়, অজিত খুশী হয়ে প্রভাতের রুচির প্রশংসা করায় ব্যোমকেশের নির্বিকার উত্তর- ‘প্যাঁচা কয় প্যাঁচানী, খাসা তোর চেঁচানি’। বলা বাহুল্য, ব্যঙ্গটা উহ্য নয়! শেষে যখন নোট-ভরা বই সরাবার সময় প্রভাতকে হাতেনাতে ধরতে এসে দুজনে ঘাপটি মেরে বসে থাকে, সেখানেও আবোল-তাবোল- “গুড়-গুড়-গুড় গুড়িয়ে হামা, খাপ পেতেছেন গোষ্ঠমামা...।‘
‘রক্তের দাগ’ গল্পে এসে হঠাৎ দেখি ব্যোমকেশ উৎসাহিত হয়ে আবৃত্তি করছেন-
“ইচ্ছা সম্যক ভ্রমণ গমনে
কিন্তু পাথেয় নাস্তি
পায়ে শিক্লি মন উড়ুউড়ু
একি দৈবের শাস্তি ।“
অজিতের মতে এটা বিশুদ্ধ মন্দাক্রান্তা ছন্দ, তবে বিতর্কের অবকাশ আছে, সে প্রসঙ্গে আমরা যাচ্ছি না। রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাল্কাচালে লেখা এই দুটি পঙক্তি যদি শুদ্ধ মন্দাক্রান্তা নাও হয়, কিছু আসে যায় না। তবে এ প্রসঙ্গে অজিতের মন্তব্যটুকু অনুধাবনযোগ্য-
“হাতে কাজ না থাকিলে লোকে জ্যাঠার গঙ্গাযাত্রা করে, ব্যোমকেশ বাংলা সাহিত্যের পুরনো কবিদের লইয়া পড়িয়াছিল; ভারতচন্দ্র হইতে আরম্ভ করিয়া সমস্ত কবিকে একে একে শেষ করিতেছিল। ভয় দেখাইতেছিল, অতি আধুনিক কবিদেরও সে ছাড়িবে না । আমি সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিয়াছিলাম, কোন দিন হয়ত নিজেই কবিতা লিখিতে শুরু করিয়া দিবে। আজকাল ছন্দ ও মিলের বালাই ঘুচিয়া যাওয়ায় কবিতা লেখার আর কোনও অন্তরায় নেই। কিন্তু সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ কবিতা লিখিলে তাহা যে কিরূপ মারাত্মক বস্তু দাঁড়াইবে ভাবিতেও শরীর কণ্টকিত হয়। সেই যে খোকাকে একখানা ‘আবোল তাবোল’ কিনিয়া দিয়াছিলাম, ব্যোমকেশের কাব্যিক প্রেরণার মূল সেইখানে। তারপর বইয়ের দোকানের অংশীদার হইয়া গোদের উপর বিষফোড়া হইয়াছে।“
না, ব্যোমকেশ শেষ পর্যন্ত কবি হননি, স্রষ্টা শরদিন্দুর প্রভূত কবিত্ব-প্রতিভা থাকা সত্বেও এ যাত্রা বেঁচে
গেছেন। তবে কে জানে হয়ত পরবর্তীকালে প্রেমেন্দ্র মিত্রের গোয়েন্দা-কবি পরাশরের কাব্যিক প্রতিভার উৎস হিসেবে তিনি অনুপ্রাণিত করেছেন তাঁকে। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি যে উপরোক্ত দু’টি কাহিনীতেই ব্যোমকেশ অপরাধীকে ধরেও নৈতিক কারণে ছেড়ে দেয়, ঠিক শার্লক হোমসের ‘অ্যাবি গ্রাঞ্জে’র গল্পের মতো, জানিনা তাঁর কাব্য-রুচি বিকাশের সাথে এর কোনও সম্পর্ক আছে কি না।
(৫)
‘দুর্গ রহস্যে’ অজিতের বীররসাত্মক ভঙ্গিমায় নবীন সেনের ‘পলাশীর যুদ্ধ’ আউড়ানো শুনে ব্যোমকেশ লুকোন সোনার সন্ধান পান, ঠিক যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘পায়ে ধরে সাধা’ থেকে গুপ্তধনের হদিস পেয়েছিল ধারাগোলের মৃত্যুঞ্জয়। অতএব সাহিত্যকে বাদ দিয়ে যে গোয়েন্দা-গল্পও হয় না সে কথা আমরা বলতেই পারি। তবে প্রাসঙ্গিকতা বজায় রেখে তার সদুপযোগের যে মুন্সিয়ানা চাই, তা শরদিন্দুর মত সুসাহিত্যিকের পক্ষেই থাকা সম্ভব, নচেৎ তাঁর পূর্বসূরীদের লেখামত ‘গির্জার ঘড়িতে ঢং ঢং করে দেড়টা বাজা’ বা ‘অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দূরস্থ বৃক্ষকোটরে উঁকি মারা’ নিয়েই আমাদের তুষ্ট থাকতে হত। তার ফলটা উত্তরকালের পাঠকদের পক্ষে কেমন হত, তার একটা নিদর্শন দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না, ‘অমৃতের মৃত্যু’ থেকে একটা টুকরো-
“আমি বলিলাম, ‘এর মানে? দুপুর রাত্রে আমাকে শেয়াল দেখাবার কি দরকার ছিল?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আগে কখনও চাঁদের আলোয় শেয়াল দেখেছো?’
‘চাঁদের আলোয় শেয়াল দেখলে কি হয়?’
‘পুণ্য হয়, অজ্ঞানতিমির নাশ হয়। আমার মনে যেটুকু সংশয় ছিল তা এবার দূর হয়েছে।‘
টিকা নিষ্প্রয়োজন। আশা করি এটা পড়ে জ্ঞান-পিপাসু পাঠক ‘জ্যোৎস্না-রাতে সবাই’ আর বনে ছুটবেন না!
যাকগে, ব্যোমকেশের সাহিত্য-জ্ঞান ও রুচির আর অধিক পরিচয় দেবার প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা। তবে ইতিমধ্যে অর্থাৎ ১৯৬৪ সালে একটি অঘটন ঘটল যার ফলে ব্যোমকেশ-সিরিজে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন এল। ‘বেণীসংহার’ (১৯৬৮) গ্রন্থের ভূমিকাতে যার বিবরণ শরদিন্দু নিজেই জানিয়েছেন-
“অজিতকে দিয়ে ব্যোমকেশের গল্প লেখানো আর চলছে না। একে তো ভাষা সেকেলে হয়ে গেছে, এখনও চলতি ভাষা আয়ত্ত করতে পারেনি, এই আধুনিক যুগেও ‘করিতেছি’ ‘খাইতেছি’ লেখে। উপরন্তু তার সময়ও নেই। পুস্তক প্রকাশকের কাজে যে লেখকেরা মাথা গলিয়েছেন তাঁরা জানেন, একবার মা-লক্ষ্মীর প্রসাদ পেলে মা-সরস্বতীর দিকে আর নজর থাকে না।......দেখেশুনে অজিতকে নিষ্কৃতি দিলাম। এখন থেকে আমিই যা পারি লিখব।“
মনে আছে শার্লক হোমস একবার আক্ষেপের সুরে ডাঃ ওয়াটসনকে এরকমই কিছু বলেছিলেন, তবে সেটা ভাষা নিয়ে নয়, তদন্তের পদ্ধতির খুঁটিনাটি বিবরণ নিয়ে, যার সম্যক বর্ণনা ওয়াটসন তাঁর রচনায় দিতে পারতেন না বলে হোমস বিরক্ত হতেন। পরবর্তীকালে হোমসের কলমে ‘The Adventure of the Blanched Soldier’ এবং ‘The Adventure of the Lion's Mane’ জাতীয় দু-একটি কাহিনী ও কিছু গল্প ডয়েলের নিজের জবানবন্দীতেও লেখা হয়, যেগুলি উত্তরকালে ‘The Case-book of Sherlock Holmes’-তে সংকলিত হয়। ব্যোমকেশ অবশ্য অজিতকে এসব নিয়ে কখনও অভিযোগ-অনুযোগ করেননি, তবে রচয়িতা বুঝেছিলেন যে যুগের পরিবর্তন ঘটেছে। ষাটের দশক থেকে চলতি কথ্য ভাষা বাংলার সাহিত্যাঙ্গনে ঢুকে পড়েছে। শরদিন্দু নিজেই ১৯৫৬ সালে অন্যত্র (‘আমি কিভাবে লেখক হলাম’- প্রবন্ধ) কথ্য ভাষায় লিখতে শুরু করে দিয়েছেন, ‘রিমঝিম’ উপন্যাস লেখেন ১৯৬০-এ। তবে পরবর্তিকালে ‘বহু যুগের ওপার থেকে’ বা ‘রাজদ্রোহী’র মত পিরিয়ড-উপন্যাস লেখার সময় আবার ফিরে গেছেন সাধুভাষায়। ব্যোমকেশের এই গল্পগুলিও অজিতকে দিয়েই কথ্য ভাষায় লেখাতে পারতেন, বোধ করি পাঠকদের স্বীকৃতির কথা ভেবে অনাবশ্যক ঝুঁকি নিতে চাননি।
ব্যোমকেশের এই উত্তর-পর্বের সেরা কাহিনী হয়ত ‘শজারুর কাঁটা’ (১৯৬৭) যেটি তিনি সাহিত্যিক শংকরকে উৎসর্গ করেন। উল্লেখনীয় যে শরদিন্দুর মুগ্ধ ভক্ত শংকর তাঁর প্রথম আমেরিকা সফরের আগে পুণেতে তাঁর সাথে দেখা করেন, সে কথা লেখেন তাঁর ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা’ গ্রন্থে ‘চিঁড়ে’ বৌদির সাথে কথোপকথনের অধ্যায়ে।
ব্যোমকেশকে বাঙালী পাঠকেরা এত ভালবেসে ফেলেছিল যে তাঁকে exit দেওয়ার কথা ভাবতেই পারেননি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় । বন্ধু প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত উদ্ধারের জন্যে এগিয়ে আসতে চেয়েছিলেন, শরদিন্দু রচনাবলীর দ্বাদশ খণ্ডের ভূমিকায় তাঁর কল্পকাহিনী ‘ব্যোমকেশ ও সত্যবতীর প্রস্থান’ পঠনীয়। বস্তুতঃ তাঁদের শেষদিকের লেখা ‘বেণীসংহারে’ অজিতের নামোল্লেখ ছিল মাত্র, তারপর ‘লোহার বিস্কুট’ ও শেষ অসমাপ্ত কাহিনী ‘বিশুপাল বধ’-এ অজিত একেবারেই অনুপস্থিত, পরিবর্তে এসেছেন কেয়াতলার বন্ধুরা যাদের একজন এই প্রতুলবাবু- হয়ত ইনিই সেই প্রতুল গুপ্ত! তবে তাঁরই কলমে ব্যোমকেশ exit লাইনের কথা ভেবেছেন। কিন্তু ভাগ্যের এমন পরিহাস, তার আগেই ১৯৭০ সালে ‘বিশুপাল বধ’ অসমাপ্ত রেখে শরদিন্দুবাবুকেই চিরবিদায় নিতে হল এ পৃথিবী থেকে। শরদিন্দু কলম ধরার পরে হয় ব্যোমকেশকে কঠিন শাসনে রেখেছিলেন, বা ব্যোমকেশ নিজেই অতবড় লেখকের সামনে সাহিত্যের গভীর তত্ব নিয়ে বিশেষ মুখ খোলার সাহস পাননি। কিন্তু ব্যোমকেশ তখন প্রৌঢ়, স্থিতধী। তাই এ সময় তিনি কোনও চটুল কাব্যের মধ্যে না গিয়ে করেছেন কিছু প্রাজ্ঞজনোচিত মন্তব্য। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অপরাধ-জগতে নারীর ভূমিকা নিয়ে তাঁর বিদগ্ধ বিশ্লেষণ (বেণীসংহার) -
“রাখাল, মেদিনীর মত মেয়েকে তুচ্ছজ্ঞান কোরো না। যুগে যুগে এই জাতের মেয়েরা জন্মগ্রহণ করেছে- কখনো ধনীর ঘরে কখনো দরিদ্রের ঘরে- পুরুষের সর্বনাশ করার জন্যে। দ্রৌপদী এই জাতের মহিলা ছিলেন- কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের মূলে আছে দ্রৌপদী। ইলিয়াডের হেলেনও তাই। এ যুগেও এ জাতের মেয়ের অভাব নেই। ওরা সকলেই যে চরিত্রহীনা তা নয়, কিন্তু ওদের এমন একটা কিছু আছে যা পুরুষকে......কাণ্ডজ্ঞানহীন উন্মত্ত করে তুলতে পারে।
নারীবাদীরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, ব্যোমকেশ ও তাঁর স্রষ্টা উভয়েই নারীজাতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করতেন, যাঁর অজস্র উদাহরণ তাঁর বিভিন্ন রচনায় ছড়িয়ে আছে, এমনকি ব্যোমকেশের গল্পে ব্যোমকেশ পত্নী সত্যবতীই তো এক জ্বলন্ত উদাহরণ। এই উক্তি কেবল এক বিশেষ শ্রেণীর নারীদের জন্যে মাত্র।
কৃতজ্ঞতা -
১- ব্যোমকেশ সমগ্র- আনন্দ
২- শরদিন্দু রচনাবলী- আনন্দ
৩- রবীন্দ্র রচনাবলী- বিশ্বভারতী
৪- Sherlock Holmes- Complete
৫- ‘And Then There Were None’- Agatha Cristie (Penguine)
৬- ‘Frankenstein’- Mary Shelly (Penguine)
৭- ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা’- শংকর (দে’জ)
৮- Website ‘Wikipedia’ on Holmes, Hercule Poirot, Dupin etc.
৯- বাংলা ওয়েবসাইট- দেবেন্দ্রবিজয়, পরাশর বর্মা, গীতগোবিন্দম্ ইত্যাদি।
লেখক পরিচিতি - জন্ম ও বেড়ে ওঠা বিহার (অধুনা ঝাড়খন্ডের) ধানবাদ কয়লাখনি ও শিল্পাঞ্চলে, সেখানে 'নানা জাতি, নানা মত, নানা পরিধান' হলেও বাংলা ও বাঙালিদের প্রাধান্য ছিল একসময়। ১৯৮২ সালে রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে পেট্রোলিয়াম লাইনে চাকুরী, বর্তমানে কুয়েত অয়েল কোম্পানিতে কর্মরত। শখ-গান-বাজনা আর একটু-আধটু বাংলাতে লেখালেখি। কিছু লেখা ওয়েব ম্যাগাজিনে (ইচ্ছামতী, আদরের নৌকো, ট্রইনিক ও অবসর) প্রকাশিত ।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।