প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

মে ৩০, ২০১৬

 

ফুল পাতা শুকনোর পদ্ধতি, পুষ্পকলা ও ব্যবসা

সুবোধ কুমার দত্ত

রাস্তার ধারে শুকিয়ে যাওয়া ফুল

মানুষের জীবনের প্রতিটি অনুষ্ঠানে ফুলের ভূমিকা খুবই গুরুত্ত্বপূর্ণ৷ এজন্য ফুলের চাষ এবং ফুলের ব্যবসা পৃথিবীর নানা দেশেই রীতিমত লাভ জনক শিল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে এবং ক্রমবর্ধমান চাহিদার জন্য এই ব্যবসা বেড়েই চলেছে৷ তাজা ফুলের সৌন্দর্য খুবই আকর্ষণীয় এবং তার বৈচিত্র্যও অপরিসীম৷ তবে সচরাচর যে সমস্ত উচ্চমানের তাজা ফুল (কাট ফ্লাওয়ার) ফুল দানিতে রাখা হয় ঘর সাজানর জন্য তার দাম তুলনামূলক ভাবে বেশ বেশী৷ তাজা ফুলের আকৃতি ও সজীবতা স্বল্পস্থায়ী এবং গরম ও ঠাণ্ডার প্রতি খুবই সংবেদনশীল৷ উচ্চমানের রাসায়নিক ব্যবহার করেও ফুলের স্বাভাবিক সৌন্দর্য ও গঠন বেশিদিন বজায় রাখা সম্ভব নয়৷ এ ছাড়া সব ফুল সবসময় ফোটে না তাই অসময়ের ফুলের চাহিদার তুলনায় যোগান অত্যন্ত সীমিত হয়ে পড়ে আর এজন্য দামও হয়ে ওঠে আকাশচুম্বি৷ এ অবস্থায় আমরা বিকল্প ফুলের খোঁজ করি কিন্তু একই রকম সুন্দর শুকনো ফুলও যে বিকল্প হতে পারে সেকথা আমাদের মনে আসে না কারণ শুকনো ফুল গৃহসজ্জার অঙ্গ হিসেবে আমাদের দেশে এখনও তত প্রচলিত হয়নি যদিও শুকনো ফুলের আয়ু দীর্ঘদিন এবং সৌন্দর্যও কম নয়৷ দেখা গেছে ফুল বিশেষ পদ্ধতিতে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা সম্ভব এবং সেই ফুলের সৌন্দর্যও প্রায় তাজা ফুলের সমান এবং বহুদিন উপভোগ করা যায়৷ শুকনো ফুলের শিল্পকলা প্রায় চার দশক ধরে চলে আসছে৷

জংলী মরসুমি ফুল

মরসুমি চাষ করা ফুল

মরসুমি চাষ করা ফুল

ফুলের স্বাভাবিক রং ও আকৃতি বজায় রেখে ফুল শুকনো করার প্রচেষ্টা বহুদিন থেকেই করা হয়েছে৷ বিভিন্ন পদ্ধতিতে ফুল, পাতা, গাছের ডালের অংশ ইত্যাদিকে তাদের স্বাভাবিক আকৃতি, গঠন ও রং অবিকৃত রেখে শুকোনো হয় এবং সেই শুকনো ফুল এত সুন্দর হয় যে ঘর সাজাবার উপাদান হিসেবে বহুদিন ধরে উপভোগ করা যায় এবং শুধু ঘর সাজানোর জন্যই নয় আরও নানা ভাবে ব্যবহার করা যায় এই শুকনো ফুল এবং পএ মঞ্জরী৷ ফুল শুকোনোর জন্য যে সব পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়েছে তা মোটেই ব্যয়বহুল নয়৷ এজন্য এমন কিছু যন্ত্রপাতি প্রয়োজন হয়না যা ব্যয় সাপেক্ষ৷ চাপ প্রয়োগ করে এবং দৈনন্দিন ব্যবহারের ওভেন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, সোলার কুকার ইত্যাদি সাধারণ যন্ত্র ব্যবহার করে ফুল শুকোনো হয়৷ চাপ দিয়ে ফুল ও পাতা শুকনো করার জন্য পুরনো পত্রিকা বা বই- এর মধ্যে রেখে উপরে কোন ভারী জিনিষ চাপা দেওয়া হয়৷ এছাড়া ফুল ও পাতা ব্লটিং পেপারের ওপর রেখে সমস্ত পেপারগুলোকে এক সাথে দুটো কাঠের মাঝে রেখে পাটার চারকোণে নাট বোল্ট দিয়ে শক্ত করে চেপে দেওয়া হয়৷ এতে উদ্ভিদাংশের আকৃতি বজায় থাকে না কিন্তু রং বজায় থাকে৷ ফুল শুকোনোর জন্য ফুল মাটির টবে / প্লাস্টিক পাত্রে / কাঁচের পাত্রে রেখে সাধারণ বালি অথবা সিলিকা জেল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় ও নির্দিষ্ট তাপমানে (৪৫-৬০০C) নির্দিষ্ট সময়ের (৪৮-৭২ ঘণ্টা) জন্য হট এয়ার ওভেনে রেখে দেওয়া হয়৷ মাইক্রোওয়েভ ওভেনে ২ থেকে ৫ মিনিটে শুকিয়ে যায়৷ এই কৌশল বিভিন্ন জনপ্রিয় এবং পরিচিত ফুল যেমন –বাগান বিলাস, চন্দ্রমল্লিকা, জারবেরা, রঙ্গন, গাঁদা, মুসান্ডা, গোলাপ, প্যানজি, পদ্ম ইত্যাদি শুষ্ক করনের কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়৷ এসব শুকনো ফুল টাটকা ফুলের বিকল্প হিসাবে এত সুন্দর ভাবে ব্যবহার করা যায় এবং তার নান্দনিকতা এতই অপূর্ব যে তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না৷ এই শুকনো ফুলকে দৃষ্টি নন্দন গৃহসজ্জার সামগ্রী করার জন্য এ থেকে তৈরি করা হয় নানা ধরনের জিনিষ যেমন –গ্রিটিংকার্ড, ওয়াল প্লেট, ল্যান্ডস্কেপ, পেপারওয়েট, এছাড়াও অন্যান্য বহু জিনিষ৷ ফুলদানীতে যে ভাবে কাট ফ্লাওয়ার রাখা হয় সেভাবে রাখার জন্য সাধারণত কাঁচ বা স্বচ্ছ প্লাস্টিকের জারে ঢেকে রাখা হয় শুকনো ফুল ঘর সাজানর জন্য৷

বালি দিয় ঢেকে শুকনো ফুল

বালি দিয় ঢেকে শুকনো ফুল

চাপ দিয়ে শুকোনো নানা ধরনের পাতা ও ফুল

ইদানীং এই শুকনো ফুলের চাহিদা অত্যন্ত বেশী যা বলা হয় বিশ্বব্যাপী৷ আমাদের দেশে প্রচারের অভাবে এই শিল্পের সম্ভাবনা সম্বন্ধে এখনও তেমন ধারনা গড়ে ওঠেনি৷ অথচ দেখতে গেলে অত্যন্ত সামান্য মূলধনে এই শিল্প হয়ে উঠতে পারে অত্যন্ত লাভজনক একটি কুটির শিল্প যা একাধারে অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন এবং পরিবেশ অনুকূল৷ যে কেউ এ ব্যবসা করতে পারে – গ্রাম্য গৃহবধূ থেকে বেকার যুব সম্প্রদায়, কারণ এর মূল কাচা মাল হচ্ছে ফুল বা পত্রাংশ তা যেমন জনপ্রিয় পরিচিত বাগানের যত্নে তৈরি ফুল হতে পারে তেমনি বলতে গেলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা হতে পারে অযত্নে বেড়ে ওঠা জংলী ফুল ও পাতা৷ পরিবেশ এবং প্রকৃতিকে অক্ষুণ্ণ রেখে সামান্য প্রচেষ্টায় এই কুটির শিল্প হয়ে উঠতে পারে গ্রামীণ বা শহরের যুবক ও যুবতী, গৃহবধূদের রোজগারের একটি সহায় যা তাদের অনায়াসে করে তুলতে পারে স্বনির্ভর, এমনকি একটু চেষ্টা করলে এর বিদেশে রপ্তানির সম্ভাবনাও খুব উজ্জ্বল৷ সৌভাগ্যক্রমে ‘শুকনো ফুল’ শিল্পের অনুকূল প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব নেই আমাদের দেশে৷ ভৌগোলিক কারণেই ভারতের বনজ এবং উদ্ভিদ সম্পদ বৈচিত্র্যে ভরা এবং এই বিপুল সম্পদের প্রায় সবটাই প্রাকৃতিক নিয়মে নষ্ট হয়ে যায়৷ অথচ এই নষ্ট হয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক দানকে সহজেই অর্থকরী সম্পদে রূপান্তরিত করা যায়, এতে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক ভার সাম্যর বিন্দুমাত্র হানি হয়না৷

চাপ দিয়ে শুকোনো ফুল পাতা দিয়ে তৈরি পুষ্পকলা

গ্রিটিং কার্ড

কোস্টার

কাঁচ দিয়ে ঢাকা শুকনো ফুল

নানা ধরনের মরশুমি জংলী ফুল পাতা প্রতি বছরই জন্মায় এবং প্রকৃতির নিয়মে নষ্ট হয়ে যায়৷ তাই লক্ষ্য হল কিভাবে এই সমস্ত অব্যবহৃত ফুল পাতাকে শুকোনো যায় এবং শুকনো ফুল পাতাকে নানা ধরনের শিল্পকলাতে ব্যবহার করা যায়, নানা ধরনের বস্তু তৈরি করে বাজারে বিক্রি করা যায়৷ প্রচেষ্টা চলছে কিভাবে ফুল শুকোনো পদ্ধতিটিকে খুবই সহজ করা যায় এবং সমাজের নানা বর্গের মানুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়৷ সৃজনশীল পেশা হিসাবে এই ব্যবসা বেকার যুবক, যুবতী, গৃহবধূ, গ্রামের মানুষকে বিশেষত: স্ত্রীলোকদিগকে অবশ্যই বাড়তি রোজগারের রাস্তা দেখাবে৷ শুকনো ফুল পাতা দিয়ে তৈরি পুষ্পকলা একটি সুন্দর কুটির শিল্পের রূপ নিতে পারে যা গ্রামীণ বা শহরের যুবক যুবতী, গৃহবধূদের রোজগারের একটি সহায় যা তাদের অনায়াসে করে তুলতে পারে স্বনির্ভর, এমনকি একটু চেষ্টা করলে এর বিদেশে রপ্তানির সম্ভাবনাও খুব উজ্জ্বল৷ আমাদের দেশে বর্জ্য ফুলের পরিমাণ খুব বেশী৷ বর্জ্য ফুল পচে শুধু পরিবেশ দূষণ করেনা, প্রচুর আর্থিক ক্ষতিও হয়৷ বর্জ্য ফুল বলতে বোঝায় ফুল বাজারের এবং চাষির অবিকৃত ফুল, মন্দিরের পুজোর ফুল, বিয়ে বাড়ী এবং নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত ফুল ইত্যাদি৷ এই পদ্ধতিটি রুরাল ডেভেলপমেন্ট এর জন্য খুবই সুন্দরভাবে একটা সৃজনশীল শিল্প হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে৷ তবে এই ধরনের যে কোন শিল্পকে কার্যকরী করার জন্য বিভিন্ন স্বনির্ভর গোষ্ঠীদের এগিয়ে আসতে হবে৷ বিশেষকরে সরকারের উদ্যোগে এই ধরনের সহজ প্রয়োগ্য শিল্পকলা প্রয়োজন ভিত্তিতে তালিকাভুক্ত করা ও সাহায্যের একান্ত প্রয়োজন৷


লেখক পরিচিতি - ডঃ সুবোধ কুমার দত্ত (subodhskdatta@rediffmail.com) লখনউ স্থিত ন্যাশেনাল বোটানিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট এ ৩০ বছর ফুলের নানা দিক নিয়ে গবেষণা করেছেন৷ লেখক স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রেরিত উৎপরিবর্ত্তনের বিষয়ে বিশেষভাবে গবেষণা করেছেন৷ লেখকের গবেষণার মূল বিষয়বস্তু কিভাবে নানা ধরনের নতুন নতুন ফুলের রং ও আকার তৈরি করা যায় নানা ধরনের রসায়ন ও রশ্মি প্রয়োগ করে৷ লেখক ষে সব ফুল নিয়ে কাজ করেছেন তা হচ্ছে চন্দ্রমল্লিকা, গোলাপ, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, ডালিয়া, জবা, গাঁদা, জারবেরা, লিলি ইত্যাদি৷ লেখক ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ফুল শুকোনো পদ্ধতি ও পুষ্পকলা বিষয়ে সমাজের নানা বর্গের মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন৷

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।