নারী

ডিসেম্বর ৩০, ২০১৬
বিশ্বায়িত জগতে নারী পাচার
শমীতা দাশ দাশগুপ্ত
আজকের দুনিয়ায় ‘পাচার’ শব্দটার সঙ্গে প্রায় সকলেই পরিচিত। ২০১৬
সালের শেষে কলকাতা শহরে বসে দেখছি পত্রিকায় শিশু পাচার নিয়ে হৈ
চৈ হচ্ছে। হাসপাতাল থেকে চুরি করা শিশু দেশের সীমারেখার বাইরে
লুকিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছে দুষ্কৃতিকারী দল। প্রতিষেধক হিসেবে ধরপাকড়,
গণ-ধোলাই, আইনি কেস, সবই চলছে নিজের নিয়মে। কিছুদিন আগেও যা অকল্পনীয়
ছিল, বিদেশে মানুষ পাচার, বিশ্বায়নের ফলে আজ তা সহজ হয়ে উঠেছে।
তবে আমার আজকের আলোচনা পাচার নিয়ে নয়, বিশ্বায়ন নিয়েও নয়। এই
দুয়ের সমন্বয়ে কিছু তথ্য আর কিছু ভাবনা নিয়ে আজকের লেখা। আমরা
সকলেই বিশ্বায়ন সম্পর্কে মোটামুটি জানি। পাচার বলতে কী বোঝায় সেও
জানি। বিশ্বায়ন ও পাচার, এই দুটির ছেদে, যে মহিলারা দেহ ব্যবসায়ে
লিপ্ত রয়েছেন, তাঁদের লক্ষ্যে রেখেই আমার এই লেখা। অর্থাৎ বিশ্বায়িত
পাচারের ফলে মহিলা যৌনকর্মীরা কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন
তা বিশদ করাই আমার মুখ্য উদ্দেশ্য।
এই লেখার অনেক তথ্যই আমি নিয়েছি ২০০৯ সালে প্রকাশিত ইন্দ্রাণী
সিংহ ও আমার লেখা একটি বই থেকে। কলকাতায় কর্মরত ৭০০ জন সাধারণ
পর্যায়ের (স্ট্রীট লেভেল) যৌনকর্মীদের নিয়ে তিনটি সমীক্ষা ও পনেরোটি
বিস্তৃত সাক্ষাৎকার সংগ্রহ করে বইটি লেখা হয়েছিল। মোট ৭১৫ জন অংশগ্রাহী
মহিলার মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন সন্তানের জননী। এই মায়েদের জীবন
ও জীবিকায় বিশ্বায়িত পাচারের গতিপ্রকৃতি কী প্রভাব ফেলেছে, তাই
নিয়েই এই বই। ‘যৌনকর্মী’ নামপদটিও আমি ব্যবহার করছি সেই সময়ের
সঞ্চিত অভিজ্ঞতা থেকে। নারীবাদী শিক্ষায় ‘যৌনকর্মী’ কথাটা বর্জনীয়।
পশ্চিমে যৌন ব্যবসায়ে জড়িত মেয়েদের উল্লেখ করা হয় “যে মহিলাদের
যৌনবৃত্তিতে লিপ্ত করা হয়েছে” (prostituted women) বলে। এর প্রধান
কারণ নারীবাদ বিশ্বাস করে বেশির ভাগ মহিলা এই বৃত্তিতে আসেন নিজের
ইচ্ছের বিরুদ্ধে – হয় বিক্রিত হয়ে, নয় নাবালিকা অবস্থায়, অথবা
সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেবার আর্থিক তাগিদে। কিন্তু আমি যে
পনেরোজন মহিলার সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম, সকলেই বলেছিলেন তাঁরা
“যৌনকর্মী” বিশেষ্যটি পছন্দ করেন। তাঁদের ইচ্ছাকে সম্মান দিয়ে
আমি এই পরিচয়-শব্দটি ব্যবহার করছি।
এবারে এই আলোচনার বিষয়ে আসা যাক। বিশ্বায়ন কী তা সকলে অল্পবিস্তর
জানলেও সে সম্পর্কে দুয়েকটা কথা দিয়ে শুরু করি। বিশ্বায়ন আরম্ভ
হয়েছিল একটি অর্থনৈতিক ভাবাদর্শ ও প্রক্রিয়াকে ভিত্তি করে। বিশুদ্ধ
বিশ্বায়নে নিচের বৈশিষ্ট্যগুলি দেখা যায়:
• আন্তর্জাতিক অবাধ বাণিজ্য;
• উদার নীতির খোলা বাজার;
• রাষ্ট্রসীমার বাইরে শিল্প বিস্তার;
• আধুনিকীকরণ; এবং
• সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ।
বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবী থেকে, অন্তত:
বাণিজ্যের ক্ষেত্রে, সীমাবদ্ধতা সরিয়ে দিয়ে সর্বব্যপ্তি আনা। কিন্তু
বাণিজ্যের বাইরেও বিশ্বায়নের প্রভাব মানুষের জীবনযাত্রার ওপর পড়েছে
এবং ক্রমাগত পড়ে চলেছে। ভারতে বিশ্বায়নের প্রভাব সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য
করা যায় ব্যাঙের ছাতার মত ‘কল সেন্টার’ গজিয়ে ওঠার হার দেখে। কলকাতার
বুকে বিদেশী আই.টি. কোম্পানির নাম এখন আর নগরবাসীকে চমকে দেয় না।
গোটা দেশ থেকে কমবয়সী প্রফেশানাল, বিশেষত ছেলেরা, এখন কাজের খাতিরে
সদলবলে বিদেশে আবাস গেড়েছে; শুধু বিদেশে রপ্তানির উদ্দেশ্য উৎপাদন
করে চলেছে বহু শিল্প-কারখানা; বড় বড় দোকানে বিদেশী খাদ্যদ্রব্য
আর জামা কাপড়ের সমারোহ; টিভিতে বিদেশী অনুপ্রেরণায় অবাস্তব ‘রিয়ালিটি
শো’-এর রমরমা; আর জিন্স-টিশার্ট তো অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের জাতীয়
পোষাকেই পরিণত হয়েছে। এ সবই বিশ্বায়নের প্রভাব।
কিন্তু আমার বিশ্বাস, বিশ্বায়নের তীব্র সমর্থকও এই প্রক্রিয়া
যে শুধুমাত্র আশীর্বাদ তা বলতে রাজী হবেন না। রাজনৈতিক, সামাজিক,
এবং অর্থনৈতিক ব্যাপক অসাম্যের জন্যে বিভিন্ন রাষ্ট্র, এবং একই
রাষ্ট্রের মধ্যে বিভিন্ন সমাজ, একই সমাজের মধ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠী,
বিশ্বায়নের পৃথক ফল পাচ্ছে। এত বছর পরে আমরা বুঝতে পেরেছি সমাজের
প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলি বিশ্বায়নের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত
হয়েছে; এবং প্রান্তিক গোষ্ঠীর মধ্যে যেহেতু নারী সবচেয়ে অনুন্নত,
তার ওপর এর প্রভাব হয়েছে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক। এই পরিস্থিতি
সম্বন্ধে সচেতনতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে নারীবাদী
প্রবর্তকেরা বিশ্বায়ন প্রসারের সংঘবদ্ধ বিরোধিতা দৃঢ় করেছে।
নারীবাদী প্রতিরোধের বার্তা সত্ত্বেও আমি মনে করি মহিলাদের জন্যে
বিশ্বায়নের ফল মিশ্র। উপকার হিসেবে দেখি সমাজে মহিলাদের জন্যে
বহু ক্ষতিকারক ঐতিহ্য এবং সামাজিক প্রথার শিকল বিশ্বায়নের ফলে
শিথিল হয়ে পড়ছে; উন্নয়নশীল দেশের মহিলারা আন্তর্জাতিক চিন্তাধারা
এবং শিল্পকৌশলের সঙ্গে পরিচিত হতে পারছেন; বিশ্বায়ন মহিলাদের বিভিন্ন
কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে সাহায্য করছে; এবং চিরাচরিত লিঙ্গ সম্পর্কের
স্থিতাবস্থা নিয়ে সমাজে প্রশ্ন তুলতে বিশ্বায়ন উৎসাহ জোগাচ্ছে। স্বীকার
করতেই হবে পুরুষ সমাজের তুলনায় বিশ্বায়নের প্রভাব নারী সমাজে সম্পূর্ণ
স্বতন্ত্র ও অসম। ভিন্ন শ্রেণীর মহিলাদের জন্যে বিশ্বায়নের সুযোগ
সুবিধার মাত্রা পৃথক, আবার এর ফলে মহিলারা বিভিন্নভাবে শোষিতও
হন।
বিশ্বায়নের একটি ফসল নারী নির্যাতন নতুন রূপ। উদাহরণ হিসেবে আমেরিকা
যুক্তরাষ্ট্রে অস্থায়ী কর্ম-ভিসায় আসা অভিবাসী সমাজের দৃষ্টান্ত
দেওয়া যায়। এই অস্থায়ী প্রবেশাজ্ঞা পাওয়া কর্মীদের (সিংহভাগই পুরুষ)
স্ত্রীরা আমেরিকায় আসেন তাঁদের অধীনস্থ (ডিপেন্ডেন্ট) ভিসায়। বস্তুত:
এই ভিসার শর্ত প্রাপককে সত্যি সত্যিই মুখাপেক্ষী করে রাখে। কয়েকটি
গুরুত্বপূর্ণ শর্ত বিশ্লেষণ করলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে। প্রথমত,
যত শিক্ষিতই হন না, স্ত্রীরা কোন উপার্জন বা কাজ করতে পারেন না,
এমনকি স্বেচ্ছাসেবী হিসেবেও না। দ্বিতীয়ত, তাঁরা গাড়ি চালাবার
লাইসেন্স পেতে পারেন না। তৃতীয়ত, তাঁরা কোন সরকারী সাময়িক অর্থনৈতিক
সাহায্য পেতে পারেন না। অর্থাৎ মহিলাদের স্বামীর (প্রাথমিক ভিসা
প্রাপক) ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল থাকতে হবে। মুস্কিল হয় যখন কোন
মহিলা পারিবারিক উৎপীড়ন বা যৌনহিংসার শিকার হন। সেক্ষেত্রে তাঁরা
একেবারেই অসহায় অবস্থায় পড়েন। ইতর স্বামীকে ত্যাগ করে স্বাধীন
হবার কোন পথ তাঁদের জন্যে খোলা থাকে না। স্বামীকে ছেড়ে গেলে তাঁরা
যে শুধু অর্থনৈতিক ভিত খোয়াবেন তা নয়, আমেরিকায় থাকার ছাড়পত্রও
হারাবেন। সেই দেশে থাকার সুযোগ হারানো বহু মহিলার পক্ষে খুবই কষ্টকর।
অনেক সময়ে দেশের থেকে বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনেরা আপত্তি জানান, “এত
খরচ করে বিয়ে দিলাম, এখন ভেঙে দিলে চলবে না।” আবার বিয়ের চিরস্থায়িত্বে
বিশ্বাসী অনেক বাবা-মা বলেন, “বিয়ে টিকিয়ে রাখা মেয়েদের কাজ। একটু
ধৈর্য ধর, বাচ্চাকাচ্চা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে;” অথবা, “তুমি ডিভোর্স
করলে তোমার ভাই-বোনের ক্ষতি হবে, তাদের ভাল বিয়ে হবে না;” বা,
“আমাদের পরিবারে কোনদিন ডিভোর্স হয় নি, লোকের কাছে মুখ দেখাব কী
করে?” এই সব চাপে পড়ে অনেক নির্যাতিতা মহিলা দেশে ফিরতে চান
না। শুধু তাই নয়, অনেকেই সোজাসুজি প্রশ্ন করেন, “বাঃ, এতো বেশ!
যে দোষী, তাকে কোন জবাবদিহি করতে হবে না। আর যার প্রতি অন্যায়
করা হয়েছে, তাকে দেশ ছাড়তে হবে? এ কেমন ন্যায়নীতি!” প্রশ্নটি যে
খুবই যুক্তিযুক্ত তাতে সন্দেহ নেই।
আমেরিকার অভিবাসন আইনের জোরে অনেক অত্যাচারী স্বামী দেশ থেকে
তাড়িয়ে দেবার (ডিপোর্টেশন) ভয় দেখিয়ে স্ত্রীকে নিজের নিয়ন্ত্রণে
রাখেন; স্ত্রীর ওপর ছড়ি ঘোরান। এ ধরনের সমস্যা ছাড়াও আইনের আওতা
এড়িয়ে দেশের বাইরে স্ত্রীকে পরিত্যাগ করার সমস্যা (ট্যান্সন্যাশানাল
অ্যাবান্ডনমেন্ট) বিশ্বায়নেরই আরেকটি কুফল। এ নিয়ে অনেক লেখালেখি
ও আন্দোলন চলছে।
কিন্তু এসব তো হল বিবাহিত মহিলাদের সমস্যা। যে মহিলারা যৌন ব্যবসায়ে
লিপ্ত, বিশ্বায়ন তাঁদের কী ক্ষতি করছে? সে সম্বন্ধে আলোচনার আগে
আমি নারীর মৌলিক সামাজিক অধিকারের প্রাসঙ্গিক একটি তালিকা দিতে
চাই।
• নিজস্ব উপার্জনের অধিকার;
• অবাধে চলাফেরার অধিকার;
• পরিবার পালনের অধিকার;
• যে কোন সময়ে, যেখানেই হোক, সুরক্ষিত থাকার অধিকার;
• সৎ এবং নির্ভুল আদানপ্রদান এবং যাতায়াতের অধিকার; এবং
• মানবিক অধিকার ভঙ্গ হলে প্রতিকার দাবীর অধিকার।
অধিকারগুলি মানুষ হিসেবে নারীর প্রাপ্য; কিন্তু এই অধিকারগুলিই
প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাদের জীবন থেকে বিনা অজুহাতে নিমেষে কেড়ে নেওয়া
হয়। এই তালিকার মধ্যে সুরক্ষা এবং অবাধে চলাফেরার অধিকার নারীর
পক্ষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বেশির ভাগ প্রগতিশীল সমাজেও মহিলাদের
নির্ভয়ে চলাফেরার অধিকার সীমিত। এই সীমাবদ্ধতায় আমরা এতই অভ্যস্ত
হয়ে গেছি যে কোন মেয়ে যদি ধর্ষিত হয় ,আমরা প্রথমে প্রশ্ন করি,
“মেয়েটি অমন সময়ে, ঐখানে কী করছিল,গেছিল কেন ?” এই পরিস্থিতিতে যাই ভুলে
সবচেয়ে প্রয়োজনীয় প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করতো, “এই মেয়েটির
সমাজ ঐ স্থানটি কেন সব নারীর জন্যে, সব সময়ের জন্য সুরক্ষিত রাখতে
পারে নি? এবং ভবিষ্যতে কেমন করে তারা সেই সুরক্ষা নিশ্চিত করবে?”
শুধু সাধারণ মানুষ নয়, দেশের আইন-প্রণয়নকারীরাও নিজেদের দায়িত্ব
ফাঁকি দিয়ে আক্রান্ত মহিলাদেরই দোষী সাব্যস্ত করে নিন্দামন্দ করেন।
মেয়েদের চলাফেরায় বিধিনিষেধ কম হলে আমরা মনে করি তাদের বিশেষ সুবিধে
দেওয়া হচ্ছে, অতএব তাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। অথচ নারীর চলাফেরা
বাধাহীন করে আমরা শুধু তাদের লুণ্ঠিত মানবিক অধিকার ফিরিয়ে দিচ্ছি,
নতুন কোন সুবিধে দিচ্ছি না। বিশ্বায়িত জগতে মহিলাদের যাতায়াত এবং
উপার্জনের অধিকার হননই এক অভিনব নির্যাতনের রূপ নিয়েছে – নারী
পাচার।
২০০০ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ পাচারের সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে, “ভয়,
জোরজবরদস্তি, অপহরণ, প্রতারণা, ছলচাতুরী, ক্ষমতার অপব্যবহার, অথবা
ক্ষমতাহীন পরিস্থিতিতে জুলুম করে মানুষ সংগ্রহ, পরিবহন, হস্তান্তর,
পোষণ, আদানপ্রদান করা; অর্থের লেনদেন, অথবা কোন সুযোগ-সুবিধের
প্রতিশ্রুতি দিয়ে কোন ব্যক্তিকে স্থানান্তরিত করার সম্মতি আদায়
করা।” অর্থাৎ পাচার বলতে বুঝতে হবে অসহায় কোন ব্যক্তিকে জবরদস্তি
করে বা ভুলিয়ে ভালিয়ে রাজ্য বা রাষ্ট্রসীমার বাইরে নিয়ে যাওয়া,
সেই উদ্দেশ্যে কাউকে বিক্রি করা, অথবা কাউকে আশ্রয় [বস্তুত লুকিয়ে
রাখা] দেওয়া। যদি কোন ব্যক্তির ওপর অর্থনৈতিক বা মানসিক চাপ থাকে,
তাহলে সেই অবস্থায় সে স্থানান্তরিত হতে সম্মতি দিয়েছে কিনা সে
প্রশ্ন অবান্তর। ইদানীং বিশ্বায়িত অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে
চলতে গিয়ে বহু দেশেই পাচার বেড়ে গেছে। যে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো
তুলনামূলকভাবে দুর্বল, যুদ্ধ, আঞ্চলিক সংঘর্ষ, বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের
ফলে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল নয়, সেখানেই মানুষ পাচার
ছড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে।
রাষ্ট্রপুঞ্জের সংজ্ঞার এই প্রেক্ষাপটে মনে রাখতে হবে মহিলারা
কাজের খাতিরে, উপার্জনের জন্যে, এবং উন্নতির প্রত্যাশায় বিভিন্ন
স্থানে ঘোরাফেরা করেন। আই.টি. পেশাদার, পরিচারিকা, অথবা যৌনকর্মী,
যে ভূমিকায় হোক না কেন, সংসার পালন, উপার্জন, বা কর্মজগতে নিজের
উচ্চাশা চরিতার্থ করার অধিকার প্রত্যেক নারীর রয়েছে। শুধু তাই
নয়, পরিবার, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অথবা অন্য
যে কোন বিপজ্জনক অবস্থা এড়িয়ে নিরাপত্তার খোঁজে মহিলারা নানা জায়গায়
যাতায়াত করে থাকেন। অন্য পাঁচজন মহিলার মত, যৌনকর্মীরাও একই উদ্দেশ্যে
স্থানান্তরিত হতে সম্মত হন। আর সেই সময়েই বাড়ে পাচারের সম্ভাবনা।
কিন্তু যৌনকর্মী পাচার নিয়ে সমাজ এবং পুলিশ, দু’দলই খুব একটা মাথা
ঘামায় না। যে যৌনকর্মী নিজেই স্থানান্তরে সম্মতি দিয়েছে এবং যে
শরীর বিক্রির পেশায় লিপ্ত, সে কেমন করে পাচারের অভিযোগ আনবে?
আমাদের দেশে বহু পরিবার মেয়ে বিক্রি করে, মেয়েরা রাস্তাঘাটে অপহৃত
হয়, অথবা তাদের লোভ দেখিয়ে পাচার করে যৌন ব্যবসায়ে ব্যবহার করা
হয়। যেহেতু এই মেয়ে বা মহিলারা স্বেচ্ছায় দেহব্যবসায়ে নামেন নি,
সমাজ এদের নির্দোষ ভাবে, শোষণের শিকার ভাবে, এদের প্রতি সহানুভূতিশীল
হয়। তবে যে মহিলারা যৌনব্যবসায়ে নিযুক্ত, যাঁরা বেশি উপার্জনের
লোভে অন্য দেশে যেতে রাজি হন, তাঁরা পাচারের স্বীকৃতি পান না।
তাঁদের অভিযোগ অনুযোগ ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না; সমাজের করুণা তাঁদের
ওপর বর্ষিত হয় না।
সাধারণত, বেশি উপার্জন বা অধিকতর সুযোগ সুবিধে পাওয়ার খাতিরে
যৌনকর্মীরা স্থান পরিবর্তন করতে রাজি হন। ‘বাবু’ (পিম্প) বা দালালেরাই
এই মহিলাদের স্থানান্তরের ব্যবস্থা করে দেয়। ভালভাবে আরম্ভ হলেও
এই স্থানান্তরের প্রক্রিয়াই শেষে হয়ে দাঁড়ায় ভয়াবহ। অনেক সময়ে
এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়ার সময়ে এই মহিলারা যৌন উৎপীড়নের শিকার
হয়েছেন। নতুন দেশে গিয়েও তাঁদের নিস্তার নেই। সেখানে তাঁরা এমন পরিস্থিতি
বা কর্মশর্তের সম্মুখীন হতে পারেন, যা স্বপ্নেও আশা করেন নি। যেমন
নিষিদ্ধ মাদক বা অন্যান্য বেআইনি পণ্য আমদানি করতে বাধ্য হওয়া
অথবা চুরি-ডাকাতি বা অন্য অপরাধে সাহায্য করা। অনেক সময়ে এধরনের
মানবিক অধিকার লঙ্ঘন তাঁদের মুখ বুজে মেনে নিতে হয়। এই জাল থেকে
পালাবার চেষ্টা করলে আরও ভয়ঙ্কর বিপদ ঘটে। দেখা যায় প্রথমে ইচ্ছুক
হলেও পরে বহু যৌনকর্মীই পাচারের ফলে চরম অত্যাচারের শিকার হন।
স্থানান্তর বা অভিবাস সংক্রান্ত যাত্রায় যৌনকর্মীদের নির্যাতনের
উৎসের তালিকা নিচে দিলাম:
• স্থানান্তর বা অভিবাসের সময় – এই ধরণের স্থানান্তর বেআইনী বলে
অনেক সময়ই মহিলাদের যৌন সম্পর্ক বা অন্যান্য অবৈধ কাজ করতে বাধ্য
করা হয়;
• কর্মশর্ত – নতুন দেশে দেহ ব্যবসায়ে অযাচিত ভাবে আগ্রাসী দালাল
বা পিম্প মহিলার উপার্জনে ভাগ বসাতে পারে। বস্তুত অনেক সময়ে মহিলাদের
উপার্জনের সিংহভাগই দালালের পকেটে যায়;
• কর্মজগত – বিদেশের দেহ ব্যবসায়ের জগত মহিলাদের পক্ষে খুবই বিপদসংকুল
হতে পারে। সেখানে খরিদ্দারের বিকৃত যৌন রুচি মেটাতে তাঁরা বাধ্য
হতে পারেন; দালাল ঘরে বন্দী করে বা অত্যাচার করে মহিলাকে তার নিজের
ইচ্ছেমত খাটাতে পারে;
• উন্নতির শর্ত হিসেবে – উপার্জনে উন্নতির শর্ত হিসেবে যৌন কর্মী
মহিলাকে বিভিন্ন ভাবে অত্যাচার ও শোষণ করা যেতে পারে; এবং
• পারিবারিক, কর্মক্ষেত্র, ও সামাজিক নির্যাতন থেকে বাঁচতে – বহু
মহিলা এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে নির্যাতন এড়াতে পালিয়ে পাচারের জালে
পড়ে।
পাচারের উদ্দেশ্য শুধু অসহায়ের শোষণ নয়, এ প্রায় ৪০ বিলিয়ান
ডলার মূল্যের জগত জোড়া শিল্প। সংগঠিত অপরাধ জগতের সঙ্গে পাচারের ঘনিষ্ঠ
যোগাযোগ রয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের অনুমান অনুসারে, প্রতি বছর পাচারের
শিকার হয় প্রায় দু’ মিলিয়ান শিশু, নারী, ও পুরুষ। এর মধ্যে আশি
শতাংশই শিশু ও নারী, যাদের যৌন ব্যবসায়ে ব্যবহার করা হয়। নিষিদ্ধ
মাদক পাচার ব্যবসায়ের পর বেআইনী অস্ত্র সরবরাহের সঙ্গে তাল রেখে
একই পর্যায়ে চলছে নারী ও শিশু পাচারের ব্যবসায়। প্রতি বছর দক্ষিণ
এশিয়া থেকেই নাহোক ১৫০,০০০ শিশু, নারী, ও পুরুষ পাচার হয়। ইদানীং
এই সংখ্যা বেড়েছে বৈ কমেনি। দেহের পসরা তরতাজা রাখতে সারা পৃথিবীতে
প্রতি দশ মিনিটে একজন মেয়ে বা মহিলাকে পাচার করা হয়। এমন লাভজনক
বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে শারীরিক অত্যাচার ব্যবহার করা হবে তা আর
আশ্চর্য কী! পাচারের সমস্যা পৃথিবীর সর্বত্র এত বিশাল হয়ে উঠেছে
যে প্রায় প্রত্যেক দেশেই পাচার-বিরোধী আইন পাশ করা হয়েছে।
বিশ্বায়িত সমাজে পাচার সম্বন্ধে সম্যক ধারণা করতে গেলে তিনটি
বিষয়ে আমাদের ওয়াকিবহাল হতে হবে – (১) পাচার কোথা থেকে হচ্ছে (উৎস);
(২) পাচারের নির্দিষ্ট পথ (রুট) কী; এবং (৩) পাচারের গন্তব্যস্থল
কী। মজদুর পাচার এই ব্যবসায়ের একটি অঙ্গ হলেও সাধারণ সমাজ যৌন
ব্যবসায়ের জন্যে নারী পাচারের দিকেই বেশি মনোযোগ দেয়। অবশ্য মহিলাদের
জন্যে শ্রমিক পাচার ও যৌন পাচারের মধ্যে খুব একটা তফাৎ নেই। কায়িক
শ্রম এবং যৌন শ্রম, দু’ভাবেই মহিলারা শোষিত হন।
আজকের জগতে বিশ্বায়নের ফলে মানুষের গতিবিধি বেড়ে গেছে। ভ্রমণ,
কাজ, পড়াশোনা, বা অন্য বহু কারণে মানুষ দেশের গণ্ডীর বাইরে যাওয়া
আসা করে। কর্মখাতিরে বা পড়াশোনার জন্যে পুরুষেরা আজ অতি সহজেই
দেশে-বিদেশে যাতায়াত করেন। বিদেশে গিয়ে বহু পুরুষই আর ফেরেন না;
তাঁদের অবর্তমানে স্ত্রী, কন্যা, বা বাড়ির অন্য মহিলাদের সংসার
প্রতিপালনের জন্যে প্রধান উপার্জকের ভূমিকা নিতে হয়। অথচ আমাদের
সমাজে ঐতিহ্যগতভাবে মেয়েরা বৃত্তিমূলক শিক্ষা পান না, অনেক সময়ে
তেমন পড়াশোনার সুযোগও পান না। ফলে সংসার চালাতে গণিকাবৃত্তি গ্রহণ
করা ছাড়া তাঁদের জন্যে আর কোন উপার্জনের পথ খোলা থাকে না।
দুনিয়াজুড়ে ভ্রমণশিল্প বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে দেহ ব্যবসায়।
পশ্চিমী পুরুষ ট্যুরিস্টের জন্যে এশিয়ায় বেশ্যাবৃত্তি অনেকটা ছড়িয়ে
গেছে। নম্র ও অনুগত এশিয় নারীর ভাবমূর্তি বহু পশ্চিমী পুরুষের
কাছে আকর্ষণীয়। এছাড়া ধরে নেওয়া হয় এশিয় মহিলারা সহজলভ্য। কিন্তু
শুধু পশ্চিমী পুরুষ নয়, যে কোন পুরুষই দেহ ব্যবসায়ের সম্ভাব্য
খরিদ্দার। বহু দেশই এখন বেশ্যাবৃত্তির আয়ের থেকে অর্থনৈতিক আনুকূল্য
লাভ করে। উদাহরণ স্বরূপ থাইল্যাণ্ডের নাম উল্লেখ করা যায়।
পাচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হল কলকাতা। বাংলাদেশ ও নেপাল
থেকে মেয়ে পাচার হয়ে কলকাতায় আসে। আবার পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য
অঞ্চল থেকেও এখানে মেয়ে পাচার হয়। কলকাতা একাধারে পাচারের উৎস,
গন্তব্যস্থল, এবং এখান থেকে মহিলাদের চারদিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়,
অতএব রুট। এই মহিলাদের মধ্যে অনেকে নিজেদের দেশে এবং অঞ্চলে দেহ
ব্যবসায়ে জড়িত ছিলেন এবং উন্নতির প্রলোভনে পাচারের ফাঁদে পা দিয়েছেন।
পাচার নিয়ে বহু আন্তর্জাতিক বিতর্ক চলে। অনেক আন্দোলনকারীরা মনে
করে গণিকাবৃত্তি আইনগত ভাবে বৈধ ঘোষিত হলে পাচার হ্রাস পাবে। আবার
অন্যান্যদের মতে এই বৈধিকরণে হিতে বিপরীত হবে। তার চেয়ে বেশ্যাদের
অপরাধী গণ্য না করলেই চলবে। পাচার বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ভারতে মাঝেমধ্যেই
অদ্ভুত সব নীতি উপস্থাপন করা হয়। যেমন, পঁচিশ বছর অনূর্ধ্ব কোন
মহিলা দেশের বাইরে যেতে চাইলে অভিভাবকের অনুমতি লাগবে। নীতিটি
অবশ্যই নারীর মানবিক অধিকার খর্ব করে; তাছাড়া অনেক পরিবারই যে মেয়ে
বিক্রি করে দেয় সে তথ্য বেমালুম অবজ্ঞা করে।
সমাজে যে নীতি এবং আইনগত পরিবর্তনই আনার প্রচেষ্টা করি না কেন,
খেয়াল রাখত হবে কোন মহিলা বা প্রান্তিক গোষ্ঠী যেন তাতে ক্ষতিগ্রস্ত
না হয়। একজন সমাজ-সংগঠক হিসেবে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমি নিজেকে
কতগুলি সহজ প্রশ্ন করি। সেগুলি হল:
• আমি যে সিদ্ধান্ত নিতে চলেছি, তা সৎ এবং আমার নিজের নৈতিক মাপের
মধ্যে পড়ে তো?
• এই সিদ্ধান্ত কার্যকরী করতে যে প্রক্রিয়ার প্রয়োজন, তাতে কার
ক্ষতি হবে? সে ক্ষতি কত গভীর ও কত দীর্ঘস্থায়ী?
• যে কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করব, তা কি শুধুমাত্র আমলাসুলভ খুঁটিনাটি
নিয়ে নাড়াচাড়া, না এতে সত্যিই কোন অর্থপূর্ণ পরিবর্তনের সম্ভাবনা
রয়েছে?
• এই সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য এবং কর্মপদ্ধতি সমাজের প্রান্তিক গোষ্ঠী
এবং মহিলাদের পক্ষে শুভ তো?
পাচার বা অন্য যে কোন সামাজিক সমস্যা সমাধানে সিদ্ধান্ত এমনভাবে
নিতে হবে যাতে অসহায় গোষ্ঠীর মানবিক অধিকার স্থায়ী ভাবে প্রতিষ্ঠিত
হতে পারে।
লেখক পরিচিতি - লেখক একজন শিক্ষক, গবেষক ও
সমাজকর্মী। তিন দশকের অধিককাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষিণ এশিয়
সমাজে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা ও তাঁদের ক্ষমতায়নের
প্রচেষ্টায় নিযুক্ত। উত্তর আমেরিকার প্রথম দক্ষিণ এশিয়পারিবারিক
নির্যাতন বিরোধী সংস্থা মানবী-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। অবসর-এর জন্মলগ্ন
থেকে উপদেষ্টা মণ্ডলীতে যুক্ত।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।