জ্যোতিষশাস্ত্র
প্রবেশিকা (অন্যান্য
অনুচ্ছেদ)

৩য়
অনুচ্ছেদ
লগ্ন ও রাশি কাকে বলে ?
জ্যোতিষশাস্ত্র মতে
ভ-চক্র (zodiac) হচ্ছে আকাশে বিস্তৃত একটি কাল্পনিক আলোকময়
বৃত্ত যার মধ্যে কয়েকটি নক্ষত্রপুঞ্জ বা রাশি (constellations)
অব্স্থান করছে। আমরা জানি যে পৃথিবী প্রকৃতপক্ষে সূর্যের
চারিদিকে ঘুরছে কিন্তু পৃথিবী থেকে মনে হয় সূর্যই পৃথিবীকে
প্রদক্ষিণ করে চলেছে। সূর্যের গতিপথ যে বৃত্তপথ তৈরী করছে
তাকে বলা হয় ইক্লিপ্টিক (ecliptic) বা ক্রান্তিবৃত্ত। মনে
করা যেতে পারে এই ইক্লিপ্টিক-এর উপর ১২ টি রাশি পরপর আছে
এবং এই ইক্লিপ্টিক বৃত্তটি ২৪ ঘণ্টায় একবার অর্থাৎ ৩৬০ ডিগ্রি
ঘুরে আসছে। এই ইক্লিপ্টিক-টিকে সমান ১২ ভাগে ভাগ করে এক
একটি ভাগে এক একটি রাশি কল্পনা করা হয়। প্রত্যেক রাশিকে
একটা কাল্পনিক চিত্ররূপ দেওয়া হয়েছে। তা হ'লে দাঁড়াল যে,
প্রতি রাশির অব্স্থান ৩০ ডিগ্রি করে এবং যেহেতু ১২ টি রাশি
প্রদক্ষিণ করতে ২৪ ঘণ্টা সময় লাগছে, এক একটি রাশি অতিক্রম
করার সময় ২ ঘণ্টা। ধরা যাক কোন এক জায়গায় সূর্যোদয়ের সময়
পূর্বাকাশে একটি রাশির উদয় হলো, সেটা ২ ঘণ্টা পর্যন্ত অবস্থান
করলো এবং তারপরে পরের রাশিটি উঠলো। এইভাবে পর্যায়ক্রমে ১২
টি রাশি ঘুরে গিয়ে ২৪ ঘণ্টা পরে সেই স্থানে পূর্বাকাশে আবার
প্রথম রাশিটি ফিরে এলো।
কোনো ব্যক্তির জন্মের
সময়ে যে রাশিটি পূর্বগগনে উদয় হয়, সেটাই হলো তার ( জাতক
বা জাতিকার ) লগ্ন। প্রতি বছর একই স্থানে একই সময়ে লগ্ন
ঠিক একই ডিগ্রিতে হবে না। তবে তফাৎ খুব সামান্যই। বিশদভাবে
এর কারণ খুঁজবার এখনই কোনো প্রয়োজন নেই।
বৈশাখ মাসে ( অর্থাৎ
এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে মে-র মাঝামাঝি পর্যন্ত ) রবি মেষ
রাশিতে অবস্থান করে; অতএব এই মাসে যদি কোনো ব্যক্তির সূর্যোদয়ের
সময় জন্ম হয়, তবে তার লগ্ন হবে মেষ। ঐ একই স্থানে যদি সূর্যোদয়ের
২ ঘণ্টা পরে কারো জন্ম হয় তবে তার লগ্ন হবে মেষের পরবর্তী
রাশি অর্থাৎ বৃষ। এই ভাবে দু-ঘণ্টা পরপর লগ্ন পরিবর্তন হতে
থাকবে। শ্রাবণ মাসে ( জুলাইের মাঝামাঝি থেকে অগাষ্টের মাঝামাঝি
) রবি থাকে কর্কট রাশিতে; সেইজন্যে ঐ মাসে যদি সূর্যোদয়ের
সময় কারো জন্ম হয়, তবে তার লগ্ন হবে কর্কট। দু-ঘণ্টা পরে
জন্ম হলে, লগ্ন হবে তার পরের রাশি অর্থাৎ সিংহ। মাস ও জন্মের
সময় থেকে, এইভাবে মোটামুটি লগ্ন বের করা যায়।
জন্মের সময় রাশিচক্রের
যে রাশিতে চন্দ্র অব্স্থান করে, সেটাই হল জাতকের রাশি। অর্থাৎ
জন্মের সময়ে কোনও ব্যক্তির রাশিচক্রে চন্দ্র যদি তুলা রাশিতে
অবস্থান করে, তবে তার রাশি হবে তুলা।
লগ্ন ও রাশি কাকে বলে
সেটা বোঝা গেল। জন্ম সময় জানা থাকলে খুব সহজে মুখে মুখে
কি করে কোন ব্যক্তির লগ্ন মোটামুটিভাবে বের করা যায় সেটাও
জানা গেল; তবে সঠিকভাবে লগ্ন নির্ণয়ের পদ্ধতি পরে ব্যাখ্যা
করা হবে।
রাশি, তার অধিপতি ও
বৈশিষ্ট্য
আগেই বলা হয়েছে যে
১২ টি রাশি ২৪ ঘণ্টায় ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে আসছে; অর্থাৎ একটি
রাশি সরে গিয়ে পরের রশিটি উদয় হতে সময় লাগে ২ ঘণ্টা। এই
রাশিগুলি মেষ থেকে শুরু হয় এবং এক একটি রাশির ব্যাপ্তি ৩০
ডিগ্রি করে। সাধারণতঃ পূর্ব ভারতে যে পদ্ধতি অনুসরণ করে
এই রাশিগুলিকে সাজানো হয় তা ১ নং চিত্রে দেখানো হলো। মেষ
থেকে শুরু করে বামাবর্তে (anticlockwise) পরপর এগিয়ে যেতে
হবে। রাশিগুলি হলো : - মেষ (Aries); বৃষ (Taurus); মিথুন
(Gemini); কর্কট (Cancer); সিংহ (Leo); কন্যা (Virgo); তুলা
(Libra); বৃশ্চিক (Scorpio); ধনু (Sagittarius); মকর (Capricorn);
কুম্ভ (Aquarius) ও মীন (Pisces)।
এই রাশিগুলির প্রত্যেকটির একটি করে অধিপতি গ্রহ (lord) আছে।
মেষ ও বৃশ্চিকের অধিপতি মঙ্গল; বৃষ ও তুলার অধিপতি শুক্র;
মিথুন ও কন্যার অধিপতি বুধ; কর্কট ও সিংহের অধিপতি যথাক্রমে
চন্দ্র ও রবি; ধনু ও মীনের অধিপতি বৃহস্পতি এবং মকর ও কুম্ভের
অধিপতি শনি। অতএব দেখা যাচ্ছে, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র
ও শনি - এদের প্রত্যেকটির দু'টি রাশির উপর আধিপত্য রয়েছে
কিন্তু চন্দ্র ও রবি কেবল একটি করে রাশিরই অধিপতি।
৩(১) নং চিত্রে বৃত্তের
মধ্যে মেষ থেকে শুরু করে পরপর রাশির সংখ্যা এবং বন্ধণীর
মধ্যে রাশিটির অধিপতির নাম লেখা আছে।
_astro.jpg)
রাহু ও কেতুকে যেহেতু
গ্রহ হিসাবে গণ্য করা হয় না, সেজন্য তারা কোনো রাশির অধিপতি
নয়। তবে তাদের বলাবল নির্ণয়ের জন্য কয়েকটি রাশিকে তাদের
স্বক্ষেত্র, মূলত্রিকোণ ও তুঙ্গস্থান হিসাবে ধরা হয়। এটা
৭ম অনুচ্ছেদে আলোচিত হবে।
প্রকৃতি ও গুণ অনুযায়ী
রাশিগুলিকে অগ্নি, পৃথ্বী, বায়ু, জল এই চারভাগে ভাগ করা
হয়। আবার চর, স্থির ও দ্যাত্মক এই তিন ভাগেও ভাগ করা হয়।
মেষ থেকে শুরু করে রাশিগুলিকে অগ্নি, পৃথ্বী, বায়ু, জল অথবা
চর, স্থির, দ্যাত্মক হিসাবে পর পর ভাগ করে যেতে হবে। অর্থাৎ
মেষ, সিংহ, ধনু হ'ল অগ্নি রাশি ( fiery signs ) ; বৃষ, কন্যা,
মকর পৃথ্বি রাশি ( earthly signs ); মিথুন, তুলা, কুম্ভ
বায়ু রাশি (airy signs) এবং কর্কট, বৃশ্চিক ও মীন জল রাশি
( watery signs )। অন্য রকম বিভাগে, মেষ, কর্কট, তুলা, মকর
চর রাশি ( movable signs ); বৃষ, সিংহ, বৃশ্চিক, কুম্ভ স্থির
রাশি ( fixed signs ) এবং মিথুন, কন্যা, ধনু ও মীন দ্যাত্মক
রাশি ( common signs )। ফলাফল বিচারে রাশিগুলির এই বৈশিষ্ট্যও
অনেক সময় কাজে লাগে। রাশিগুলির অন্য একটি শ্রেণীবিভাগ হ'ল
পুরুষরাশি ( masculine signs ) ও স্ত্রীরাশি ( feminine
signs )। বিজোড় সংখ্যার যে রাশিগুলি অর্থাৎ মেষ, মিথুন,
সিংহ, তুলা, ধনু, কুম্ভ এই ছয়টি পুরুষরাশি এবং জোড়সংখ্যার
বাকি ছয়টি - বৃষ, কর্কট, কন্যা, বৃশ্চিক, মকর ও মীন স্ত্রীরাশি।
এক নজরে মনে রাখবার
জন্য উপরে বর্ণিত বৈশিষ্ট্য গুলিকে এ ভাবেও সাজানো যেতে
পরে -
অগ্নিরাশি - মেষ,
সিংহ, ধনু।
পৃথ্বীরাশি - বৃষ, কন্যা, মকর।
বায়ুরাশি - মিথুন, তুলা, কুম্ভ।
জলরাশি - কর্কট, বৃশ্চিক, মীন।
চররাশি - মেষ, কর্কট, তুলা, মকর।
স্থিররাশি - বৃষ, সিংহ, বৃশ্চিক, কুম্ভ।
দ্যাত্মকরাশি - মিথুন, কন্যা, ধনু, মীন।
পুরুষরাশি - মেষ, মিথুন, সিংহ, তুলা, ধনু, কুম্ভ।
স্ত্রীরাশি - বৃষ, কর্কট, কন্যা, বৃশ্চিক, মকর, মীন।
প্রতিটি লগ্নের চারিত্রিক
বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে জ্যোতিষ শাস্ত্রের বইতে অনেক বিস্তৃত
ভাবে লেখা আছে। এগুলি নিতান্তই সাধারণ গুণাগুণ এবং এগুলি
যে সবার ক্ষেত্রে নির্ভুল ভাবে মিলবে এমন নয়। গ্রহের বল
ও অবস্থান অনুযায়ী বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হতে পারে। তবে এগুলি
কিছুটা না বললে লগ্নের প্রকৃতি বর্ণনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
সেজন্য সংক্ষেপে এদের সম্বন্ধে কিছুটা বলা হল।
মেষ - এরা স্বাধীনচেতা, জেদী, হঠকারী ও সাহসী হয়। এদের কর্মক্ষমতা
খুব বেশী। এদের একটু তোষামোদ করলে এরা অনেক বেশী উদ্বুদ্ধ
হয়। এরা বৈজ্ঞানিক আলোচনা ভালোবাসে এবং একটু তর্কপ্রিয় হয়।
এরা অনেক বাধা বিপত্তি সত্বেও এগিয়ে যেতে পারে। এরা শরীরে
আঘাত বা মস্তিষ্ক সংক্রান্ত অসুখে ভুগতে পারে। হঠাৎ কোনো
কিছুতে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রবণতা থাকতে পারে।
বৃষ - এই লগ্নে জাত স্ত্রীলোকেরা সুশ্রী হতে পারে। এই লগ্নের
জাতক জাতিকার অতিরিক্ত ইন্দ্রিয়পরায়ণ হওয়া সম্ভব। কল্পনা
প্র্বণতা বা প্রভুত্ব করার ইচ্ছা বেশী মাত্রায় থাকতে পারে।
স্মৃতিশক্তি ভাল থাকবে। তামসিক ভাব থাকতে পারে এবং প্ররোচিত
হলে অতিমাত্রায় ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতে পারে।
মিথুন - এদের মধ্যে একটু দ্বৈত ভাব থাকবে এবং কোনো সিদ্ধান্ত
নিতে দ্বিধায় ভুগতে পারে। এর জাতকেরা চঞ্চলমতি ও অস্থিরচিত্ত
হতে পারে। স্নায়ুর অসুখে এদের আক্রান্ত হবার প্রবণতা থাকে।
এদের বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে মেলামেশায় সংযত হলে ভাল হয়।
কর্কট - সৌন্দর্যপ্রিয়, আত্মবিশ্বাসী, সদালাপী, আবেগপ্রবণ,
দীর্ঘদেহী। এরা অত্যন্ত স্পর্শকাতর হতে পারে এবং বিয়ের ব্যাপারে
হতাশায় ভুগতে পারে। এদের চট করে ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে এবং
কফের প্রবণতা থাকে।
সিংহ - এরা গাম্ভীর্যপ্রিয় এবং এদের একটু অহমিকার ভাব থাকবে।
এরা আত্মবিশ্বাসী হয় এবং অনায়াসেই অপরের শ্রদ্ধা আকর্ষণ
করতে পারে। এরা অধ্যবসায়ী ও উদ্যোগী হতে পারে এবং রবি দুর্বল
না হলে এরা অসাধারণ জীবনী শক্তির অধিকারী হয়। এই লগ্নের
জাতিকারা অনেক সময়েই অত্যধিক স্বাধীনচেতা হওয়ায় বিবাহিত
জীবন খুব সুখের হয় না।
কন্যা - সাহিত্য, শিল্প ও সঙ্গীতপ্রিয়। লেখালেখির অভ্যাস
থাকতে পারে। মানসিকতার দ্রুত পরিবর্তন সম্ভব। আরাম প্রিয়
ও ছেলেমানুষী স্বভাব হতে পারে। সাধারণতঃ স্ত্রী বা স্বামীর
ব্যাপারে সুখী হয়।
তুলা - দূরদৃষ্টিসম্পন্ন; মানুষের সঙ্গে ব্যবহারে সমভাব।
জন সাধারণের উপর প্রভাব থাকতে পারে। খুব তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত
নিতে গিয়ে বাস্তবতা হারিয়ে যেতে পারে। বিবাহিত জীবন খুব
সুখের নাও হতে পারে।
বৃশ্চিক - একটুতেই রেগে যেতে পারে। কর্কশ ব্যবহার। সবাইকে
নিজের মতে টেনে আনার চেষ্টা। জেদী; চঞ্চলতা। গোপনীয়তা। এরা
একটু প্রভুত্ব প্রিয় হতে পারে এবং ব্য্বহারের জন্য অনেক
সময়েই অন্যের কাছে অপ্রিয় হয়।
ধনু - আদর্শপ্রিয়তা। রক্ষণশীলতা। এই লগ্নের জাতকেরা অনেক
সময়েই জীবনে সফলতা লাভ করে। এদের মধ্যে আধ্যাত্মিক ভাব থাকে
এবং ঈশ্বরে বিশ্বাসী হয়। এদের অনেকেই ভুল বুঝতে পারে কারণ
এদের কথা বলার ধরণ অনেকের পছন্দ নয়।
মকর - পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতা থাকে। এদের জীবন
ঘটনা বহুল ও দুঃখ্পূর্ণ হয়। এরা উচ্চাভিলাষী হয় এবং বাধা
বিপত্তি অতিক্রম করতে ভালবাসে। এদের মধ্যে নিয়মানুবর্তীতা
ও শৃঙ্খলাবোধ থাকবে। এদের স্ত্রী বা স্বামী ভাগ্য সাধারণ
ভাবে ভাল। লোকের বিপদে এরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।
কুম্ভ - দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গী, ধীর স্থির ও একাগ্রতা এই
লগ্নের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। এই লগ্নের জাতক একটু একাকীত্ব
পছন্দ করতে পারে। এরা মানুষের চরিত্র খুব ভাল বুঝতে পারে
এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হয়।
মীন - এই লগ্নের জাতকেরা সাধারণ্তঃ একটু রক্ষণশীল হয়। ঈশ্বরে
বিশ্বাস থাকবে। আপাত উচ্ছ্বাসের মধ্যেও গাম্ভীর্য থাকবে।
এদের একটু স্পর্শকাতর হওয়া সম্ভব। পায়ের অসুখে ভুগতে হতে
পারে। স্বামী বা স্ত্রীর চর্মরোগ বা স্নায়ুর অসুখ হতে পারে।
মনে করিয়ে দেওয়া যেতে
পারে যে এই বৈশিষ্ট্যগুলি নিতান্তই সাধারণ। এগুলি মিলতেও
পারে নাও মিলতে পারে। কারণ কোনো জাতকের চেহারা বা চারিত্রিক
বৈশিষ্ট্য শুধু লগ্ন কোন রাশিতে তার উপর নির্ভর করে না।
বিভিন্ন গ্রহের বল ও অবস্থানের উপর সেটা অনেকাংশেই নির্ভরশীল।