প্রত্যেক গ্রহের কিছু
নিজস্ব গুণ বা বৈশিষ্ট্য আছে। এই সব বিশেষত্ব যে সব সময়েই
প্রকাশ পাবে তা নয়। কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে একটি গ্রহ কোন
বিশেষ রাশিতে অবস্থানের ফলে বা অন্য গ্রহের দ্বারা প্রভাবিত
হবার কারণে তার গুণের পরিবর্তন ঘটতে পারে। তবে সাধারণভাবে
তাদের কারকত্বগুলি এই রকম :
১। রবি - আত্মা, অহঙ্কার,
আত্মসম্মান, উত্সাহ, প্রতিষ্ঠান, পিতা, জীবনীশক্তি, হৃদয়
(heart), অস্থি (bones), উচ্চপদস্থ কর্মচারী, রাজনীতি, জ্বর,
রক্তচাপ, মস্তক, চক্ষু (বিশেষতঃ ডান চক্ষু), রক্তবর্ণ, ঝাল
ইত্যাদি।
অপর নাম - ভানু, অর্ক, সবিতা, আদিত্য প্রভৃতি।
২। চন্দ্র - মন, শারীরিক
পুষ্টি ও লাবণ্য, মাতা, শ্বেতবস্ত্র, আদর্শবাদিতা, শ্লেäমা,
রক্ত(শ্বেতকণিকা), গলগণ্ড, জন সাধারণ, ফুসফুস, দেহের জলীয়
অংশ, চক্ষু (বিশেষতঃ বাম চক্ষু), শ্বেতবর্ণ, লবণরস ইত্যাদি।
অপর নাম - সোম, ইন্দু, শশাঙ্ক, উড়ুপ প্রভৃতি।
৩। মঙ্গল - সাহস,
শক্তি, ক্ষিপ্রতা, ক্রোধ, অগ্নি, উগ্র মানসিকতা, কুমারত্ব,
কর্মক্ষমতা, তর্ক, ভ্রাতা, রক্ত (লোহিতকণিকা), গুহ্যদেশ,
রক্তচাপ, অর্শ, রক্তপাত, দুর্ঘটনা, জমি, ভূমি, আগুন, ক্ষত,
কাটাছেঁড়া, গাঢ় রক্তবর্ণ, তিক্তরস ইত্যাদি।
অপর নাম - কুজ, ভৌম, বক্র, ত্রুÝর, মহীজ প্রভৃতি।
৪। বুধ - পরিহাস,
বালকসুলভ কথাবার্তা, বাকশক্তি, বুদ্ধি, স্মৃতিশক্তি, অস্থিরচিত্ততা,
বিচার বিশ্লেষণ, ভাল মন্দ বিচার করার ক্ষমতা, মুদ্রিত রচনা,
খবর, তথ্য, তথ্য আদান-প্রদান, সংবাদ, হিসাব, লেখন, জ্যোতির্বিদ্যা
ও জ্যোতিষ, গণিতশাস্ত্র, বাণিজ্য, অÂমরস, ত্বক, স্নায়ু,
নাক, গলগ্রন্থি (thyroid gland), নিঃশ্বাস, সর্দি, জিহবারোগ,
ইত্যাদি।
অপর নাম - সৌম্য, হেম, সোমসুত, চন্দ্রসুত, চন্দ্রজ, প্রভৃতি।
৫। বৃহস্পতি - পূজাআর্চা,
শাস্ত্রপাঠ, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বাEøতা, জানুদেশ, যকৃত্, প্লীহা,
বাকশক্তি, স্থূলতা, মধুমেহ (blood sugar or diabetes), শ্লেäমা,
যকৃত্ ও মূত্রাশয়, ধর্ম, গুরু, আধ্যাত্মিকতা, মূল্যবোধ,
আদর্শবাদিতা, পুরোহিত, শিক্ষক, শাস্ত্রপাঠ, আইনবিদ্যা, আইনজ্ঞ,
বিদ্যা, মধুর রস ইত্যাদি
অপর নাম - গুরু, জীব, আর্যz, সূরি প্রভৃতি।
৬। শুক্র - কাম-সম্বন্ধীয়
কার্য, জাগতিক সুখ, বিভিন্ন শাস্ত্র, আমোদ-প্রমোদ, সৌখিন
ও বিলাস দ্রব্য, সৌন্দর্য, মাধুর্য, মুখমণ্ডল, মোহ, শিল্প,
সঙ্গীত, শয়নসুখ, দৃষ্টিশক্তি, যৌন আকর্ষণ, যৌনরোগ, অম্ল
রস ইত্যাদি।
অপর নাম - কবি, সিত, ভার্গব, উশনা, ভৃগু, দৈত্যগুরু প্রভৃতি।
৭। শনি - বৃদ্ধ, বয়স্ক
লোক, বিলম্ব, শৃÍলা, দুরারোগ্য ব্যাধি, নিঃসঙ্গতা, ক্লেশ,
দুঃখ, দুঃশ্চিন্তা, ভীতি, মৃত্যু, অস্থিপীড়া, পক্ষাঘাত,
মৃত্যুভয়, বধিরতা, শরীর কম্পন, শ্বাসরোগ, যক্ষা, আয়ু, সংযমী,
স্বল্পতা, বিচ্ছেদ, সন্ন্যাসী, ত্যাগ, শ্রম, ধৈর্য, শ্রমিক,
আধ্যাত্মিকতা, নিম্নবর্গের লোক, দাস দাসী, অস্থি, দাঁত,
পর্বত ভ্রমণ, কেশ, কষায় রস ইত্যাদি।
অপর নাম - যম, মন্দ, রবিসুত, শনৈশ্চর, অর্কপুত্র প্রভৃতি।
৮। রাহু - ভোগ, কপটাচার,
বিভ্রান্তি, অতৃপ্তি, আকাশ পথ, বিদেশ যাত্রা, উচ্চস্থান,
শ্বাসপ্রশ্বাস, অপবাদ, তমোগুণ, যথেচ্ছাচার, সর্প, ইন্দ্রজাল,
অনির্ণিত রোগ ইত্যাদি।
অপর নাম - তম, অহি, অসুর, ভুজঙ্গ প্রভৃতি।
৯। কেতু - গোপনিয়তা,
ব্রণ, আচম্বিতে ঘটা ঘটনা, আঘাত, ক্ষত, মোক্ষ, কৈবল্য ইত্যাদি।
অপর নাম - শিখী, ধবজ, রাহুপুচ্ছ, ধুমবর্ণ প্রভৃতি।
জ্যোতিষশাস্ত্রে একটা
খুব প্রচলিত কথা আছে। 'শনিবত্ রাহু' ও 'কুজবত্ কেতু'। রাহু
ও কেতু অনেক বিষয়েই যথাক্রমে শনি ও মঙ্গলের মত বৈশিষ্ট্য
প্রকাশ করে ও তদনুরূপ ফল প্রদান করে।
গ্রহের
দৃষ্টি
জ্যোতিষশাস্ত্রে গ্রহদের
দৃষ্টি (aspect) কল্পনা করা হয়। সব গ্রহই যে রাশিতে থাকে
তার সপ্তম রাশিতে অর্থাত্ বিপরীতে অবস্থিত রাশিতে পূর্ণদৃষ্টি
দিয়ে থাকে। এ ছাড়া কয়েকটি গ্রহের কিছু বিশেষ দৃষ্টি আছে।
যেমন মঙ্গল যে রাশিতে থাকে তার ৪র্থ ও ৮ম রাশিতে পূর্ণদৃষ্টি
দেয়। অর্থাত্ মঙ্গল যদি কারও কুণ্ডলীতে মেষ রাশিতে থাকে,
তবে মেষের ৭ম ঘর তুলা ছাড়াও তার দৃষ্টি ৪র্থ বা কর্কট রাশিতে
এবং ৮মে বা বৃশ্চিক রাশিতে থাকবে। এই ভাবে বৃহ্রপতির ক্ষেত্রে
৭ম ছাড়াও ৫ম ও ৯ম ঘরে দৃষ্টি থাকবে। এর অর্থ হ'ল বৃহ্রপতি
যদি কারও কর্কটে থাকে, তবে ৭ম ঘর মকর ছাড়াও কর্কট থেকে
৫ম ঘর বৃশ্চিকে এবং ৯ম ঘর মীনে বৃহ্রপতির পূর্ণদৃষ্টি থাকবে।
একই ভাবে শনির দৃষ্টি থাকবে ৭ম ছাড়াও ৩য় ও ১০মে। উদাহরণ
স্বরূপ, শনি যদি কোনও ব্যক্তির জন্মকুণ্ডলীতে তুলায় থাকে
তবে তার পূর্ণদৃষ্টি পড়বে ধনুতে (৩ য়ে) , মেষে (৭ মে )
ও কর্কটে অর্থাত্ ১০ম রাশিতে। পূর্ণদৃষ্টি ছাড়াও গ্রহদের
অর্ধপাদ-দৃষ্টি, ত্রিপাদ-দৃষ্ট ইত্যাদি আছে। তবে ফল বিচারের
জন্য কেবল পূর্ণদৃষ্টিই মুলতঃ গ্রহণীয়।
রাহু ও কেতুর দৃষ্টি
সম্বন্ধে মতভেদ আছে। দক্ষিণ ভারতের প্রখ্যাত জ্যোতিষী প্রয়াত
ডঃ বি. ভি. রমন রাহু ও কেতু যে ঘরে আছে তার ৭ম ঘর ছাড়া
অন্য দৃষ্টির কথা বলেন নি। কিন্তু বিখ্যাত জ্যোতিষী জে.
এন. ভাসিন মুম্বই থেকে প্রকাশিত পারাশরী হোরার একটি সংস্করণ
উল্লেখ করে বলেছেন যে, উক্ত গ্রন্থের ৫১ নং পরিচ্ছেদের ২৬
নং শ্লোক অনুযায়ী রাহু ও কেতুর ৭ম ছাড়াও ৫ম ও ৯ম দৃষ্টিও
গ্রাহ্য। অনেক সময় এটা ধরলে ফল ভালই পাওয়া যায়। তবে বহু
জ্যোতিষীই এটা মানেন না। এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে রাখা
প্রয়োজন। দ্রষ্টা গ্রহ একটি রাশিতে যত ডিগ্রিতে থাকবে, দৃষ্ট
রাশির ঠিক তত ডিগ্রিতেই পূর্ণদৃষ্টি পড়বে। একটি উদাহরণ
নেওয়া যাক। শনি যদি মকরে ১০ ডিগ্রিতে থাকে, তবে মীনের ১০
ডিগ্রিতে (৩য় দৃষ্টি), কর্কটের ১০ ডিগ্রিতে (৭ম দৃষ্টি)
ও তুলার ১০ ডিগ্রিতে (১০ম দৃষ্টি) শনির পূর্ণদৃষ্টি থাকবে।
উদাহরণ স্বরূপ, শনি যদি মকর রাশির ২০ ডিগ্রিতে এবং চন্দ্র
তুলা রাশির ২১ ডিগ্রিতে থাকে তবে চন্দ্রের উপর শনির প্রায়
পূর্ণ দৃষ্টি থাকবে। কিন্তু চন্দ্র যদি তুলার ২ ডিগ্রিতে
থাকে তবে চন্দ্রের উপর শনির দৃষ্টির তীব্রতা অনেক কম হবে।
তবে খুব সূক্ষভাবে বিচার না করলে চন্দ্র মোটামুটি শনির দ্বারা
দৃষ্ট হিসাবেই ধরা যেতে পারে।
গ্রহের শুভত্ব, অশুভত্ব, শত্রুতা
ও মিত্রতা
নয়টি গ্রহের সবকটিই
শুভ নয় বা অশুভ নয়। রবি, মঙ্গল, শনি, রাহু ও কেতু নৈসর্গিক
বা প্রাকৃতিক অশুভ গ্রহ (natural malefics)। বৃহস্পতি ও
শুক্র প্রাকৃতিক শুভ গ্রহ (natural benefics)। বুধ গ্রহ
অতি সহজে অন্য গ্রহ দ্বারা প্রভাবিত হয় বলে, কোনো পাপ গ্রহের
(অশুভ গ্রহ) সংস্পর্শে পাপ গ্রহের মতই অশুভ ফল প্রদান করে।
কিন্তু কোনও পাপ গ্রহের সংস্পর্শে না এলে বুধকে সাধারণভাবে
শুভই ধরা হয়। চন্দ্র কৃষ্ণপক্ষের হ'লে পাপগ্রহ এবং শুক্লপক্ষের
হ'লে শুভ ধরা হয়। কোনও জন্মকুণ্ডলীতে চন্দ্র ও রবির দুরত্ব
যদি ৭২ ডিগ্রির বেশী হয়, তবে সেটা শুক্লপক্ষের চন্দ্র এবং
৭২ ডিগ্রির কম হলে, কৃষ্ণপক্ষের চন্দ্র।
গ্রহগুলির পারäপরিক
সম্পর্ক সব সময়েই বন্ধìত্বপূর্ণ নয়। এদের পারäপরিক সম্পর্ক
দু'ভাবে নির্ণীত হয়। প্রথমতঃ দুটি গ্রহ স্বভাব বশতঃই পরäপরের
মিত্র বা শত্রু হতে পারে, একে বলে নৈসর্গিক মিত্রতা (natural
friendship) বা শত্রুতা। দ্বিতীয়তঃ জন্মকুণ্ডলীতে কোনো গ্রহ
থেকে যে সব গ্রহ ২য়, ৩য়, ৪র্থ অথবা ১০ম, ১১শ ও ১২শ ঘরে থাকে,
তারা প্রথমোক্ত গ্রহের বা গ্রহদের সাময়িক বা তাত্কালিক মিত্র
(temporary or tatkalik friendship)। নীচে গ্রহদের নৈসর্গিক
বন্ধìত্ব, সমতা বা শত্রুতার একটা বিবরণ দেওয়া হচ্ছে।
* (ক) রবির মিত্র
- চন্দ্র, মঙ্গল, বৃহ্রপতি; সম - বুধ; শত্রু - শুক্র, শনি।
* (খ) চন্দ্রের মিত্র - রবি, বুধ; সম - রবি ও বুধ ছাড়া
বাকি সব গ্রহ; শত্রু - চন্দ্রের শত্রু নেই।
* (গ) মঙ্গলের মিত্র - বৃহস্পতি চন্দ্র, রবি; সম - শুক্র,
শনি; শত্রু - বুধ।
* (ঘ) বুধের মিত্র - রবি, শুক্র; সম - বৃহস্পতি, মঙ্গল,
শনি; শত্রু - চন্দ্র।
* (ঙ) বৃহস্পতির মিত্র - রবি, চন্দ্র, মঙ্গল; সম - শনি;
শত্রু - বুধ, শুক্র।
* (চ) শুক্রের মিত্র - বুধ, শনি; সম - মঙ্গল, বৃহস্পতি;
শত্রু - রবি, চন্দ্র।
* (ছ) শনির মিত্র - শুক্র, বুধ; সম - বৃহস্পতি; শত্রু -
রবি, চন্দ্র, মঙ্গল।
* (জ) রাহুর মিত্র - শুক্র, শনি; সম - বুধ, বৃহস্পতি; শত্রু
- রবি, চন্দ্র, মঙ্গল।
* (ঝ) কেতুর মিত্র - রবি, চন্দ্র, মঙ্গল; সম - বুধ, বৃহস্পতি;
শত্রু - শুক্র, শনি।
উদাহরণ স্বরূপ, চন্দ্র
যদি কোনো রাশিচক্রে তুলাতে থাকে, তবে তুলার অধিপতি শুক্র
যেহেতু চন্দ্রের শত্রু, অতএব চন্দ্র শত্রু গৃহে অবস্থিত
ধরতে হবে।
দুটি গ্রহ যদি একে
অন্যের নৈসর্গিক মিত্র হয় এবং অবস্থান হেতু তাত্কালিক মিত্রও
হয় তবে তাদের পরস্পরের অধিমিত্র বলা হয়। এক হিসাবে সম এবং
অন্য হিসাবে মিত্র হলে পরস্পরের মিত্র এবং এক হিসাবে শত্রু
ও অন্য হিসাবে মিত্র হলে তারা পরস্পরের সম হিসাবে গণ্য হয়।
শত্রুতার বিষয়েও একই ভাবে বিচার করতে হবে। যেমন দুই বা ততোধিক
গ্রহ একে অন্যের নৈসর্গিক শত্রু ও একই সঙ্গে তাত্কালিক শত্রু
হলে তারা পরস্পরের অধিশত্রু ইত্যাদি।
গ্রহদের স্ত্রী, পুরুষ
ইত্যাদি ভাগেও ভাগ করা হয়। যেমন চন্দ্র ও শুক্র স্ত্রীসংজ্ঞক
গ্রহ (feminine planets); রবি, মঙ্গল, বৃহ্রপতি পুরুষ সংজ্ঞক
গ্রহ (masculine planets) এবং বুধ ও শনি নপুংসক গ্রহ (hermaphrodite
planets )।
দীপক
সেনগুপ্ত
জানুয়ারী ৭, ২০১১
(চলবে)